বুদ্ধদেব বসু

শহীদ কাদরী

আপনার সবচেয়ে প্রিয় কবি কে?’ – এই প্রশ্নের উত্তরে সেদিন বলেছিলাম ‘বুদ্ধদেব বসু’। পরিণামে আমাকে (পঞ্চাশের দশকের একজন সাম্যবাদে অঙ্গীকারবদ্ধ কবি) ভীষণভাবে তিরস্কার করেছিলেন। হ্যাঁ, আমি এখানে তৎকালীন পূর্ব-বাংলার কথাই বলছি। বুদ্ধদেব বসু অবধি পৌঁছানোর আগে আমিও সুকামত্ম, সুভাষ, মঙ্গলাচরণ, রাম বসু প্রমুখকে নিয়ে ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছি বুদ্ধদেবের ঢাকা শহরেই। অথচ কী আশ্চর্য, বায়ান্ন সালেও (বাবার মৃত্যুর পর কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছি আমরা) – বুদ্ধদেব আমার কাছে অনাবিষ্কৃতই থেকে গেছেন। তখনকার আবহাওয়াই ছিল ওরকম।

বাংলা বাজারে জি-পি-ও-র সামনে ছিল খান মজলিসের একমাত্র পত্রিকার স্টল। কলকাতা থেকে আসত পরিচয়, নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ ইত্যাদি মার্কসবাদী পত্র-পত্রিকা। বামপন্থী সাহিত্যের ভরা জোয়ার বইছে তখন গোটা বাংলাদেশে। তার ধাক্কা এসে লেগেছে ঢাকাতেও। রাত জেগে পড়ছি বলশেভিক বিপস্নবের ইতিহাস। এরই মধ্যে একদিন (সম্ভবত ১৯৫৪ সালে) স্কুলের ছুটিতে এক মাসের জন্যে কুমিলস্না যাই বেড়াতে। যে-আত্মীয়ের বাসায় উঠেছিলাম, সেখানে কোনো বইয়ের বালাই নেই। কুমিলস্নার নিস্তরঙ্গ জীবনে দুদিনেই ক্লামত্ম হয়ে, আমার প্রায় সমবয়সী সদ্য-চেনা ওই বাড়ির একটি ছেলেকে সাহস করে জিজ্ঞেস করি যে, তাদের ঈশ্বর-পরিত্যক্ত গৃহে ধর্মগ্রন্থ ছাড়া অন্য ধরনের পুস্তকাদির সন্ধান তার জানা আছে কিনা। ছেলেটি বেশ কিছুক্ষণ পর, আমার শোয়ার ঘরের টেবিলে একটি পোকা-কাটা ধূলিমলিন বই এনে রাখল। বইটির নাম কঙ্কাবতী, লেখক : বুদ্ধদেব বসু। পাগলের মতো সারাদিন সারারাত ধরে আবৃত্তি করলাম কবিতাগুলো। বুদ্ধদেব আমার প্রাণ-মন হরণ করলেন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে কঙ্কাবতীর কবিতাগুলো সম্বন্ধে জীবনানন্দের উক্তি ‘বইটির কোনো-কোনো কবিতার পুনরুক্তি বেশি, কথার অজস্র ডালাপালার ভীড়ে আবেগ চাপা প’ড়ে পাখা মেলতে পারেনি।’ পুনরুক্তি, পুনরাবৃত্তি, অতিকথন রবীন্দ্রনাথে আছে, নজরুলে তো বটেই, এমনকি জীবনানন্দেও আছে। প্রত্যেক বড়ো কবির মধ্যেই বোধহয় এক ধরনের অতিকথন বা ‘ফাইন এক্সেস’ থাকে। ওটা আমার কাছে উপরি পাওনা বলেই মনে হয়। এখনো, এবং আজও কঙ্কাবতীর কতিাগুলো আমাকে সমুদ্রসণানের অভিজ্ঞতা দেয় – তরঙ্গের পর তরঙ্গ এসে আমাকে আঘাত করে, আমি আন্দোলিত হতে থাকি তাদের ফেননিভ চূড়ায়।

বলা বাহুল্য, বুদ্ধদেব এক জায়গায় থেমে থাকেননি। আমি জানি, বুদ্ধদেব অসাধ্য সাধন করেছেন যে-আঁধার আলোর অধিকের স্বল্পবাক্ ধাতব-কঠিন কবিতাগুচ্ছে। তারপর এসেছে মরচে-পড়া পেরেকের গান, একদিন : চিরদিন ও অন্যান্য কবিতা, স্বাগতবিদায় ও অন্যান্য কবিতা। তবু আমি বলতে চাই যে, তাঁর এসব কাব্যগ্রন্থের ধ্রম্নপদীসিদ্ধি সত্ত্বেও কঙ্কাবতীর শব্দবন্যাকে কিংবা শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তরের কবিতাগুলোকে কেবল বাক্যবিলাস বলে যাঁরা হেলাফেলা করবেন, শেষ পর্যমত্ম বঞ্চিত হবেন তাঁরাই। যাকগে, এক কথায় আরেক কথা এসে পড়ল। এই রচনার উদ্দেশ্য বুদ্ধদেবের মূল্যায়ন নয়।

পঞ্চাশের দশকের ঢাকায় আমরা মাত্র কয়েকজন ছিলাম বুদ্ধদেবের অনুরাগী পাঠক। আমরা মানে, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, কায়সুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক এবং আমি। হয়তো আরো অনেকেই ছিলেন যাঁদের আমি চিনি না। পঞ্চাশের সেই ঝোড়ো আবহাওয়ায় বামপন্থীদের নেতৃত্বে ভাষা-আন্দোলন যখন তুঙ্গে, যখন মনে হচ্ছিল বিপস্নব প্রায় আসন্ন, বুদ্ধদেব তখন জগদমত্মমিনারবাসী বুর্জোয়া, লেখক হিসেবে আমাদের চেনা-মহলগুলোয় সবিশেষভাবে নিন্দিত। একদিন হঠাৎ হাতে এলো পরিচয় পত্রিকা, বু্দ্ধদেবকে তীব্র আক্রমণ করে লেখা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ আমরা সবাই পড়লাম। মার্কস-এঙ্গেলস- লেনিনবাদের আধিপত্যের সেই যুগে বুদ্ধদেব বসু অবৈধ। কিন্তু আমাদের মন কিছুতেই এতে সায় দিচ্ছিল না। দিনের বেলায় বুখারিনের এ, বি, সি অব কমিউনিজম হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াই আর রাত্তিরে গোপনে জোগাড় করা বু্দ্ধদেবের গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ পড়ছি। বুদ্ধদেবের সব রচনাতেই এক বিশুদ্ধ কিন্নরকণ্ঠের গান আমরা শুনতে পাই যা-কিনা রবীন্দ্রনাথের গল্প-কবিতার মতোই অপ্রতিরোধ্য।

শ্রেণিসংগ্রামে হাতিয়ার-হতে-পারে জাতীয় আমার একটি কি দুটি গদ্য ছাপা হয়েছে, এই সময় ঘটনাচক্রে শামসুর রাহমানের সঙ্গে হঠাৎ একদিন আলাপ হলো। শামসুর রাহমানের কল্যাণে অনেকগুলো কবিতা পত্রিকা এলো আমার হাতে। কলকাতার মার্কসবাদী পত্রপত্রিকার পর কবিতা যেন দ্বন্দ্বমূলক বস্ত্তবাদে আচ্ছন্ন আমার অর্বাচীন মক্তিষ্কে বসন্তের হাওয়া বইয়ে দিলো। উপরন্তু একদিন শামসুর রাহমান বললেন : কালের পুতুল জোগাড় করে পড়ুন। কোথায় পাব কালের পুতুল। ঢাকা শহরের (অর্থাৎ বাংলা বাজারের) বইয়ের দোকানগুলো চষে বেড়ালাম। উড়ো-উড়ো গুজবে শুনতে পেলাম কবি ও গল্পলেখক আলাউদ্দীন-আল-আজাদ একটি কিংবদমিত্মতুল্য নাম। মার্কসপন্থী প্রগতিবাদী লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য এক ব্যক্তিত্ব। আমার মতো স্কুলের ছাত্রকে তিনি কি পাত্তা দেবেন!

একদিন শামসুর রাহমানের সঙ্গে গেলাম তখনকার বিখ্যাত মাসিক সওগাত অফিসে। সেখানে প্রায় দেব-দয়ায় আলাউদ্দীন-আল-আজাদের সঙ্গে পরিচয় হলো। সেদিন আমার হাতে ছিল হরপ্রসাদ মিত্রের বাংলা কাব্যে প্রাক্-রবীন্দ্র যুগ। জনাব আজাদ বললেন যে, তিনি এই বইটিই অনেকদিন ধরে খুঁজছেন। জানালেন যে, বইটি তাঁর পরীক্ষার কাজে লাগবে। জনাব আজাদ তখন এম.এ. পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে প্রস্ত্তত হচ্ছিলেন। এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে বইটি তাঁর হসেত্ম সমর্পণ করলাম। এর কিছুদিন পর (ঠিকানা জোগাড় করে) বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো তাঁর বাসায় গিয়ে চড়াও হলাম। এবং অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর কালের পুতুল আমার হস্তগত হলো। বলা বাহুল্য, ওই বই আমি গিয়ে কোনোদনি ফেরত দিইনি। কেননা যে-বই বাংলা কবিতার একটা নতুন দিগমত্ম খুলে দিলো আমার জন্যে, আমার কাব্যবোধকে প্রসারিত এবং গভীরতর করল, সেই বই কি আর ফেরত দেওয়া যায়?

কালের পুতুলের সহায়তায় আমি আবিষ্কার করলাম সাহিত্যের প্রধান ও তাৎপর্যময় আধুনিক কবিদের। তারপর যথাসময়ে পাশ্চাত্য সাহিত্যে হাতেখড়ি হলো। কিন্তু তৎসত্ত্বেও আমাকে এ-কথা স্বীকার করতেই হবে যে, আমার কৈশোর ও প্রথম যৌবনের কাব্যবোধের উৎসে রয়েছে বুদ্ধদেবের অজর অমর প্রবন্ধাবলি।