বুনোহাঁস

ভগীরথ মিশ্র

ঠা-ঠা দুপুরে আমরা ধরেছি রানীহাঁস দিঘির পথ। আমি আর কল্পনাথ।

কল্পনাথ আমার দূরসম্পর্কের জেঠতুতো ভাই। ওই বয়সে, যারপরনাই বাউ-ুলে। সব অর্থেই ভবঘুরে। চতুর্দিকে চষে বেড়ানোর যেসব গল্প শোনায়, কেমন জানি মনে হয়, এই ছোট্ট বয়সেই না-হোক আধখানা দুনিয়া চক্কর মেরে ফেলেছে।

জেঠারা থাকে গ্রামের অন্য প্রান্তে। কল্পনাথের সঙ্গে তাই রোজ দুবেলা দেখা হওয়ার উপায় নেই। তবে যেদিন দেখা হয়, কোনো-না-কোনোভাবে ও আমার বিস্ময়টাকে খুঁচিয়ে গনগনে করে দিয়ে যায়।

ও আমার চেয়ে এক বছরের নাকি বড়, মা বলেছে। আমি এগারো, ও  বারো। কিন্তু ওকে দাদা বলে ডাকার উপায় নেই। কল্পনাথই ডাকতে দেয় না। বলে, ধুশ, এক বছরের বড় আবার
বড় নাকি?

কল্পনাথ যেদিন আমাকে খবরটা দিলো, কিনা, রানীহাঁস দিঘিতে কয়েকশো বুনোহাঁস এসেছে, আমি লোভে লোভে তাকাই ওর মুখের দিকে। বুনোহাঁস এযাবৎ কখনো দেখিনি।

রানীহাঁস দিঘি। আমি কখনো ওদিকটায় যাইনি। বাড়ির বাইরে, এক প্রাইমারি স্কুল ছাড়া, বেশি দূরে যাইইনি। মা-ই যেতে দেয় না। বলে, বড় হলে যেও? বড় হওয়ার আর কত দেরি তাই তো বুঝি নে। বড়দা আমার চেয়ে ঢের বড়। কলেজে পড়ে, তাকেই তো মা কদিন আগে বলল, তোর জন্য একটা ফুটফুটে মেয়ে বেছে রেখেছি বড়খোকা, বড় হলে ওর সঙ্গেই তোর বিয়ে দেবো। তার মানে, বড়দা এখনো অবধি বড় হয়নি!

কল্পনাথ বলে, একটু দূরেই, তবে পৌঁছে যাওয়ার পর, সব কষ্ট পুষিয়ে যাবে।

– তা অবশ্য ঠিক। কোনো গতিকে ওখানে পৌঁছে গেলেই সহসা চোখের সামনে রানীহাঁস দিঘি। গোটা দিঘিজুড়ে শ্বেতপদ্মের মতো শয়ে শয়ে বুনোহাঁস। বসে থাকলে ওদের পাখনায় অনেক রং, তবে পাখনা মেললেই ফটফটে সাদা। আর, দিঘির পাড়ে ঠাসবুনোট গাছগাছালির মধ্যে খেলা করছে পুন্নিমের ফটফটে জ্যোৎস্নার মায়াবী আলো! নয়ন মেলে দেখার মতো বটে দৃশ্যটা। বিশেষ করে জীবনে কখনো বুনোহাঁস দেখেনি যেজন, তার কাছে তো -।

শুধোই, তাও কতক্ষণ লাগবে?

– কতক্ষণ আর, ডোমপাড়াটা পেরোলেই গরু-নাচানির ভাঙা, ভাঙা পেরিয়ে করগাপাড়া, চোখটেপা আশথতলা, পাগলা-শিবের মন্দির, তারপরই তো দিঘিটা। খুব সহজ গলায় কল্পনাথ বললে বটে কথাগুলো, তবে শুনতে শুনতে আমি বেশ দমে যাই। অত দূরে! ইস, আগে বললি না কেন? অত দূরে জানলে আসতাম না… আমি সমানে গজগজ করতে থাকি… আমার ভয় করে। গরু-নাচানি ডাঙাকে, চোখটেপা আশথতলাকে, পাগলা-শিবের মন্দির-চত্বরকে, মা-কে… বাবাকে… সববাইকে আমার ভয় করে বেজায়। মা-তো জানেই না, কখন আমি পা টিপে টিপে বেরিয়ে এসেছি।

রানীহাঁস দিঘির পাড়ে পৌঁছতে গেলে যেসব জায়গা একে একে পেরোতে হবে, সবগুলো জায়গার কথা কল্পনাথই আমায় একদা কিসিত্মতে কিসিত্মতে শুনিয়েছে। কোনো-না-কোনো দিক থেকে খুব ভয় পাওয়ার মতো ওই জায়গাগুলো। অন্য কোনো কারণে আমি কিছুতেই যেতাম না, কিন্তু বুনোহাঁস, আমার কাছে তার আকর্ষণ কিছু অন্যরকম। কল্পনাথই আকর্ষণটা বাড়িয়েছে। ও-ই তো ওদের নিয়ে কত কথা বলেছে আমায়, কত গল্প শুনিয়েছে। না, এমন হাঁস আমি দেখিনি। তবে কল্পনাথ যা বলেছে, ওদের পাখনায় নাকি ময়ূরকণ্ঠী রং খেলে। আর সবগুলোর চোখে গাঢ় করে কাজল আঁকা। এমন রূপবান-রূপবতী হাঁস যে হতে পারে, সেটাই তো জানতাম না। কল্পনাথ না বললে -।

– হবেই তো, স্বর্গের হাঁস যে। কল্পনাথ বলে।

– স্বর্গের হাঁস! আমার বিস্ময়ের সীমা থাকে না, স্বর্গ থেকেই আসে ওরা?

– আবার কি! কল্পনাথের গলায় গুমোর, কিনা, কী এক মহার্ঘ প্রাণীকে দেখানোর জন্য সারথি হয়ে নিয়ে চলেছে আমায়।

– কেন আসে? ওই দিঘিতে ওদের কী দরকার? ওদের স্বর্গে এমন দিঘি নেই?

– থাকবে না কেন? তাও আসে। রানীর সঙ্গে আসে। রানীর সহচরী ওরা।

– রানী কে?

এতক্ষণে বুঝি সামান্য হোঁচট খায় কল্পনাথ। বাস্তবিক, রানীটি যে ঠিক কে, কোন রাজ্যের রানী সে, সম্ভবত সেটা ওরও জানা নেই। কিন্তু তাই বলে দমে না সে। বলে, এটা আর জানিস নে? তুই তো একটা গ-মূর্খ রে! রূপনগর রাজ্যের রানী ছিলেন যে তিনি। রানীহাঁস দিঘির পাড়েই ছিল তাঁর বিশাল প্রাসাদ। পাগলা-শিবের মন্দিরটাও ওঁরই বানানো। দিঘির জলে স্নান করে ওই মন্দিরে পুজো দিতে যেতেন। আর, রানীর প্রিয় পোষা হাঁসগুলো ওই দিঘির জলেই চরে বেড়াত। ওই কারণেই তো দিঘিটার নাম রানীহাঁস। মানে, রানীর হাঁস।

রূপনগর নামে একটা রাজ্যের নাম কোথায় যেন শুনেছি আমি। পড়ার বইয়ে, নাকি ঠাম্মার মুখে, মনে করতে পারিনে। তবে শুনেছি। নির্ঘাত। সে কি তবে এখানেই ছিল? এই, আমাদের গাঁয়েই!

বানিয়ে বানিয়ে বলায় ওস্তাদ কল্পনাথ। জানিনে, গল্পটার কতটা ঠিক, আর কতটা জল মেশাল, নাকি পুরোটাই বানানো। কল্পিত।

ওই বয়সে স্বর্গ সম্পর্কে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। আকাশের মধ্যেই যে কোথাও, সেটাই শুধু জানি। আর মাত্র জানি, জায়গাটা যারপরনাই ভালো। দ্যাবতারা থাকেন। ওখানেই আমার তাবৎ ধন্ধ। রানী ওখানে যেতে যাবেন কেন? রানী তো মানুষ ছিলেন। মানবী।

সে না-হয় হলো, হাঁসগুলো ফি-বছর আসে কেন রানীহাঁস দিঘিতে? কীসের টানে আসে?

কল্পনাথ বলে, বা-রে, স্বর্গ থেকে রানী আসে যে ফি-বছর ওই সময়টায়। হাঁসগুলো তো আসবেই। রানীরই তো পোষা হাঁস ছিল ওগুলো।

– রানীই বা আসে কেন ফি-বছর!

– বা-রে, তার বাপের বাড়ি, সে আসবে না? বড়দি, ছোড়দি, শ্বশুরবাড়ি থেকে ওরা ফি-বছর আসে না তোমাদের বাড়িতে? কুন্দবউদি ফি-বছর যায় না তার বাপের বাড়িতে? বাপের বাড়ি মেয়েদের খুবই প্রিয় জায়গা। এই দুনিয়ায় সববাই তাদের প্রিয় জায়গায় যেতে ভালোবাসে যে।

তখনই আমার কচি মনে আশার কুঁড়িটি মুখ দেখায়, তাহলে কি মেজদিও ওখানে আসে মাঝে মাঝে! জায়গাটা মেজদিরও তো খুবই প্রিয় ছিল। পালিয়ে যাওয়ার আগে ওখানেই তো কিংকরদার সঙ্গে ওর নিয়মিত যুগল-মিলন ঘটত। তবে?

কিংকরদা ছিল তুখোড় লাঠি-খেলিয়ে। আমাদের গাঁয়ের একপ্রান্তে ছিল ওদের বাড়ি। ওর একটা লাঠিখেলার দল ছিল। গাঁয়ের উৎসবে-পার্বণে, গাজনে, গরু নাচের সময় ওর দলটা লাঠি খেলত সর্বসমক্ষে। কিংকরদাই ছিল মধ্যমণি।

অন্য সময়ে গেরসেত্মর বাড়ি বাড়ি গিয়েও খেলা দেখাত। কিছু নগদ-দক্ষেণার বিনিময়ে। তার ছিল একটা তেলমাখানো লাঠি। লম্বায় ছ-ফুটের কম নয়। কিংকরদার শরীরটাও ছিল তার লাঠির মতোই ছিপছিপে আর তেলতেলে। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল। লাঠি খেলার সময় চুলগুলোকে ফাঁপিয়ে নিত।

সেবার কিংকরদা আমাদের বাড়িতে লাঠি খেলতে এলো। আমাদের উঠোনে বনবন করে লাঠি ঘুরিয়ে সবাইকে অবাক করে দিলো। সবচেয়ে অবাক হয়েছিল মেজদি। ওই বয়সে ওর চোখেই দেখেছিলাম সবচেয়ে বেশি বিস্ময়। এককালে কিংকরদার সঙ্গে মেজদি গাঁয়ের স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত। সেই তার একদা সহপাঠী যে, আজ এতখানি জাঁহাবাজ হয়েছে, সম্ভবত এটাই ছিল তার বিস্ময়ের অন্তর্নিহিত কারণ।

আমাদের দেশে-গাঁয়ে সাধারণত এয়োতি মেয়েরা ওদের শ্বশুরবাড়িতেই থাকে। মেজদিও সারাক্ষণ এয়োতির বেশে থাকত। অথচ মেজদি কেন জানি আমাদের বাড়িতেই থাকত। কানাঘুসোয় শুনেছি, ওর শ্বশুরবাড়িতে নাকি নেয় না ওকে।

তো, ওইদিন দেখেছিলাম, সারাটা সময় কিংকরদার দিকে স্থিরপলকে তাকিয়ে রয়েছে মেজদি। ওর চোখদুটো একেবারে বিঁধে গিয়েছে কিংকরদার ছিপছিপে শরীরটায়।

খেলাশেষে বড়দের কাছে একখিলি পানের জন্য বায়না ধরল কিংকরদা। মেজদিই দৌড় লাগাল পান সাজতে। গাঁয়ের স্কুলে কিংকরদার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ার সুবাদে কিংকরদাকে পান সেজে দেওয়ার সবচেয়ে বেশি অধিকার যেন তারই। এমনটাই ভেবেছিলাম ওই বয়সে।

পানের খিলিটা মেজদি আমার হাত দিয়েই পাঠাল কিংকরদার কাছে। কিংকরদা পানটা খেল না। আঁটোসাঁটো করে পরা কাপড়ের ট্যাঁকে গুঁজে রাখল।

দুদিন না যেতেই ছোটকাকা কোত্থেকে যেন একটা চিরকুট এনে হইচই বাধিয়ে দিলো বাড়িতে। আর তাতে করেই রহস্যটা ফাঁস হলো। ওইদিন পানের খিলির মধ্যেই চিরকুটটা ভরে দিয়েছিল মেজদি।

ছোটকাকা হিসহিসে গলায় বলতে থাকে, পুন্নিমের রাতে দুটিতে রানীহাঁস দিঘির পাড়ে দেখা করার ছক বানিয়েছিল। আগেও নাকি এমনতরো যুগল-মিলন ঘটেছে দুজনের মধ্যে। ওখানেই।

ওই বয়সে অবশ্য যুগল-মিলন ব্যাপারটা পুরোপুরি বোধগম্য ছিল না আমার। পুঁজি বলতে, রাইকিশোর-কাকার বালক-সংগীত অপেরায় ‘মানভঞ্জন’ পালায় একটি গানের তিনটিমাত্র কলি, তৎসহ একটি দৃশ্য। আমারই দুই সহপাঠী খুব স্বল্প সময়ের জন্য দৃশ্যটা গড়ে তুলত আসরে। ওই পালায় পদকর্তা সাজত রাইকিশোর-কাকারই ছেলে বেনুদা। গানের গলাটি ছিল খাসা। গোটা পালাজুড়ে শ্রীরাধিকা আসরজুড়ে নেচে নেচে, গেয়ে গেয়ে কৃষ্ণের প্রতি তার মান-অভিমান দেখাত, পালার এক্কেবারে শেষে গিয়ে সেই অভিমান ঘুচত। তখন দুটিতে পাশাপাশি দাঁড়াত আসরের মাঝ-বরাবর। কৃষ্ণ আড়াআড়ি পা রেখে হাতে বাঁশের বাঁশি নিয়ে দাঁড়াত, ওর এক্কেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শ্রীরাধিকে ঘাড়টাকে সামান্য হেলিয়ে দিত কৃষ্ণের কাঁধের ওপর। সেই মুহূর্তে পদকর্তারূপী বেনুদা গেয়ে উঠত, আজ কেন গো নিধুবনে/ রাধা-কিষ্ণ একাসনে/ যুগল-মিলন হইল -। বলেই লম্বা টান দিত সুরে। বাস্তবিক, পুরুষ-নারীর মিলন বলতে ওই একচিলতে ছবি আর গানের ওই তিনটে কলিই ওই বয়সে ভাসত আমার মগজে।

বাবা চিরকালই বেশ নীতিবাগীশ। নীতির প্রশ্নে কারোর সঙ্গেই তিলমাত্র আপস করেন না। শুনেছি একটা শসাগাছের মালিকানা নিয়ে তিনি নাকি একদা গাঁয়ের জমিদারদের সঙ্গে নাগাড়ে আঠারো বছর আইনি মামলা লড়েছিলেন। শেষ অবধি জমিদারবাবু ওঁর জেদ আর নীতিভক্তির কাছে স্বেচ্ছায় হার মানেন। কাজেই, এমন একটা ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানোর পর কিংকরদার যে রেহাই নেই, সেটা বুঝি সবচেয়ে বেশি বুঝতে পেরেছিল খোদ কিংকরদাই। বেগতিক বুঝে রাতারাতি গাঁ ছেড়ে পালাল সে। একেবারে দেশান্তরি হলো। আর, তার পরেরদিনই রাতের বেলায় বাড়ি ছাড়ল মেজদি। একেবারে কপ্পুরের পারা উবে গেল সে।

রাত পোহাতেই সবাই দেখে মেজদি নেই। ভাইবোন, ভাইপো-ভাইঝিদের মধ্যে আমাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত মেজদি। সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসও করত আমাকে। কাজেই, ভোরবেলায় আমার গায়ে ঠেলা মেরে কাঁচাঘুম ভাঙিয়ে মা শুধোল, হ্যাঁ-রে, তোর মেজদি কোথায় জানিস? তোকে কিছু বলেছে?

শুনেই আমি তড়াক করে উঠে বসি। বুকের মধ্যেটায় অচেনা মোচড়। ছুটে বেড়াই সারা বাড়িময়।

আমাদের বাড়িটা সাবেক আমলের। অজস্র খুপরি খুপরি ঘর, গলিঘুঁজি, বাঁক-ঢ্যাক মিলিয়ে খানিকটা গোলকধাঁধার মতো। আমরা ভাইবোনেরা তার সুযোগ নিয়েছি গোটা ছেলেবেলা জুড়ে। লুকোচুরি খেলতে আমাদের বাইরে কোথাও যেতে হয়নি। আমাদের বাড়িটাই ছিল লুকোচুরি খেলার একেবারে আদর্শ জায়গা। আসলে, একান্নবর্তী পরিবার হওয়ার সুবাদে আমাদের পরিবারে চিরকালই লোকজনের সংখ্যাটা বেশ বেশিই। বাড়িতে যখন যখন লোকসংখ্যা যত বেড়েছে, সাবেক বাড়িটাতে কুঠরির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কোথাও একটা ঘরকে ভেঙে দুটো করা হয়েছে, কোথাও-বা বারান্দার একদিকটা ঘিরে পাশের ছোট্ট কুঠরির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সুবাদে, গোটা বাড়িটা একসময় গলিঘুঁজি, বাঁক-ঢ্যাকসহ হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি আস্ত গোলকধাঁধা। কেউ যদি গোস্সা করে কিংবা স্রেফ মজা করেও লুকিয়ে বসে থাকে ওই গোলকধাঁধার কোনো প্রান্তে, তাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

মায়ের কথা শুনে বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস নিয়ে আমি দৌড়ে বেড়াই সর্বত্র। বাড়ির প্রতিটি কুঠরি, গলিঘুঁজি, বাঁক-ঢ্যাক খুঁজে বেড়াই। কিন্তু না, মেজদি কোত্থাও নেই। তখনই বড়রা নিঃসংশয় হন, মেজদি বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। এবং একবাক্যে এমন সিদ্ধান্তেও পৌঁছে যান, কিনা, কিংকরদার সঙ্গেই পালিয়েছে। সম্ভবত পুন্নিমের রাতেই পালানোর ছক কষেছিল, পুন্নিমের এখনো কদিন বাকি, কিন্তু ছকটা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তার আগেই পালিয়েছে দুটিতে। কারণ, কেবল কিংকরদাই নয়, খোদ মেজদিও বাবার নীতিজ্ঞানকে যমের মতো ভয় করত। ওই তো আমাকে শুনিয়েছিল শসাগাছ নিয়ে জমিদারের সঙ্গে বাবার আঠারো বছর ধরে চলতে থাকা মামলার কিস্যা। কাজেই, হাতেনাতে ধরা পড়ে যাওয়ার পর, সেও আর বাড়িতে থিতু হতে সাহস পায়নি।

দিনকয় খুব হা-হুতাশ করল বাড়ির সবাই। সবাইকে লুকিয়ে মা খুব কাঁদল। তারপর সবকিছু আবার চলতে লাগল স্বাভাবিক গতিতে। কেবল মা-কেই দেখেছি, আড়ালে-আবডালে যখন-তখন তার চোখদুটি ভিজে গিয়েছে অজান্তে। তবে, মেজদিকে হারানোর ক্ষতটা বহুদিন ছিল আমার বুকে। বেশ দগদগে হয়েই ছিল। কারণ, ওই যে, মেজদি আমাকেই সবচেয়ে ভালোবাসত, আমিও মেজদিকে। বাস্তবিক, মায়ের পর মেজদিকেই সবচেয়ে ভালোবাসতাম আমি। আসলে, মেজদি যখন শ্বশুরবাড়ি গেল… ফিরে এলো… আমি তখন এক্কেবারেই বাচ্চা। তখন মেজদির বুঝি সারাক্ষণ কাজেকর্মে ডুবে থাকতে ইচ্ছা করত। আমাকে যত্ন করার কাজটাই দশহাত বাড়িয়ে নিল সে। তাতে করে মা-ও বুঝি ওই বয়সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সেই সুবাদে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি মায়ের চেয়ে মেজদির কোলেপিঠেই বেড়ে উঠেছি বেশি।

কল্পনাথের শেষ কথাগুলোয় আমার মধ্যে তাই জেগে ওঠে ক্ষীণতম আশা, কিনা, রানী যদি তাঁর প্রিয় জায়গাটিতে আসতে পারেন, মেজদিই বা আসবে না কেন? জায়গাটা মেজদিরও তো খুব প্রিয় ছিল। নইলে ছোটকাকা-বর্ণিত যুগল-মিলনটা ওখানেই ঘটাবে কেন মাঝেমাঝেই!

তখন থেকেই আশায় আশায় বুক বাঁধতে থাকি। বুনোহাঁস দেখতে এসে আজ না আমার মেজদি-দর্শনও হয়ে যায়! পাশাপাশি, জায়গাটা বাড়ি থেকে দূরবর্তী হওয়ার কারণে কল্পনাথের ওপর যতটা রাগ হয়েছিল, ততটাই কৃতজ্ঞতায় ভরে যায় মন, কেন কি, বাড়ির থেকে অতখানি দূরে না হলে মেজদি তো ওখানে আসতে সাহসই পাবে না। বাবাকে তো সেও যমের মতো ভয় করত। সহসা জায়গার দূরত্বটা আমার কাছে খুব কাঙিক্ষত বলে মনে হয়।

 

দুই

দেখতে দেখতে সূর্য বসল পাটে। রানীহাঁস দিঘির দেখা নেই।

কল্পনাথ বলে, দাঁড়া, করগাপাড়াটা আগে পেরোই।

– ততক্ষণে তো সন্ধে হয়ে যাবে।

– তাতে কি, আজ পুন্নিমের রাত। চাঁদ উঠবে আকাশে।

– পুন্নিমের রাত!! আমি মনে মনে শিহরিত হতে থাকি। মেজদি আর কিংকরদা তো পুন্নিমের রাতগুলোতেই যুগল-মিলন করতে আসত ওখানে!

দিঘির পাড়ে যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে সোনার থালার মতো চাঁদ উঠেছে পুব-আকাশে। সেই চাঁদের আলো গোটা দিঘির জলভাগকে মায়াময় করে তুলেছে। আর, চারটি পাড়ের অজস্র গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে অজস্র আলোর টুকরো সমানে লুকোচুরি খেলছে।

পাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা দিঘিটাকে অপার বিস্ময় নিয়ে দেখতে লাগলাম।

– ওই দ্যাখ -। কল্পনাথ তর্জনী তাক করে দেখাতে লাগল, কত কত বুনোহাঁস দিঘির বুকে বসে রয়েছে।

পূর্ণিমার ফিনফিনে জ্যোৎস্নায় গোটা দিঘির বুক মায়াময়। কল্পনাথের তর্জনীকে অনুসরণ করে আমি গোটা দিঘিটার বুকে সন্ধানী দৃষ্টি চালাই। চাঁদের আলোয় সবকিছু অস্পষ্ট লাগছিল।

– ওগুলো হাঁস নাকি? আমার মনে সংশয় জমে, পদ্ম নয়?

– ধুশ। কল্পনাথ ফুৎকারে উড়িয়ে দেয় আমার কথা, শীতে পদ্ম ফোটে নাকি? পদ্ম তো ফোটে বর্ষায় আর শরতে।

পদ্ম ঠিক কোন ঋতুতে ফোটে, ঠিকঠিক জানা নেই আমার। কল্পনাথ এসব ভালোই জানে। একটুবাদে কল্পনাথ বলে, তুই এখানে দাঁড়া, আমি ওদিকটায় একটু ঘুরে আসি।

কল্পনাথ পায়ে পায়ে চলে যায় দিঘির দক্ষিণ পাড়ের দিকে। আমি একলাটি দাঁড়িয়ে থাকি। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দেখতে থাকি দিঘির বুকে ভেসে থাকা অজস্র বুনোহাঁস কিংবা পদ্মকে।

তখন থেকেই মনে মনে আশার কুঁড়িটি একটু একটু করে খুলছিল। আজ তো পুন্নিমে, কিংকরদা আর মেজদি তো আসতেই পারে এখানে।

আমার চারপাশে অনেক প্রাচীন গাছগাছাল। চাঁদের আলো গাছগাছালির ফাঁকফোকরে খেলা করছে। গাছের তলাগুলোতে সমানে চলছে আলো-আঁধারি খেলা।

হঠাৎই আমার নজর চলে গেল দূরের গাছতলাটার দিকে। শিহরিত হয়ে দেখলাম, গাছের তলায়, চাঁদের চিলতে আলোর বৃত্তের মধ্যে কিংকরদা আর মেজদি ঠিক যুগল-মিলনের ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে!

নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল, চোখের ভুল। রাইকিশোর-কাকার অপেরা দলের পালার ওই শেষ দৃশ্যটাই হয়তো-বা এতকাল বাদে মনশ্চক্ষে দেখলাম।

কিন্তু খানিক বাদেই আমার সেই ভুলও ভেঙে গেল। কিংকরদার বামপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেজদি একসময় যুগলমূর্তি ভেঙে বেরিয়ে এলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে। একসময় দাঁড়াল আমার সামনেটিতে।

মিটিমিটি হাসছিল মেজদি। এক্কেবারে কাছটিতে এসে আমার পিঠে হাত রাখল সে। আমার কপালে একটা গাঢ় চুমু এঁকে দিয়ে শুধোল, কেমন আছিস রে খোকা?

আমি তখন নির্বাক। হতভম্ব। স্থির পলকে তাকিয়ে থাকি মেজদির মুখের দিকে।

মেজদির সারামুখে খেলা করছিল এক জাতের অপার্থিব হাসি। তাতেই বুঝতে পারি, কিংকরদার সঙ্গে দূর-প্রবাসে সংসার পেতে সুখেই আছে মেজদি।

মেজদি একে একে বাড়ির সববাইয়ের খোঁজখবর নিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বারবার মায়ের কথা জানতে চাইল।

একসময় কাঁপা কাঁপা গলায় শুধোই, তোমরা কোথায় থাকো মেজদি? কত দূরে?

মেজদি খুব খুশি খুশি গলায় বলে, সে অনেক দূর। তুই ওই জায়গায় যাসনি কখনো। দুঃখু করিসনে। বড় হলে তোকে একদিন নিয়ে যাব আমাদের বাড়িতে। একটুখানি থেমে বলল, তুই বরং এখানেই আসিস। ফি-পুন্নিমেয় আমরা আসি এখানে। আর, মা-কে আমার কথা বলিস। কিন্তু খবরদার, আর কাউকেই যেন বলিস নে। তোকে আমি বিশ্বাস করি খোকা।

ঠিক সেই মুহূর্তে দক্ষিণপাড়ের দিক থেকে কল্পনাথের পায়ের আওয়াজ ভেসে আসে। তৎক্ষণাৎ বুঝি সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে মেজদি। দ্রম্নতপায়ে চলে যায় আগের অবস্থানে। তারপর দুটিতে ঝটিতি হারিয়ে যায় গাছগাছালির ঘেরাটোপে।

আমি স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

কল্পনাথ কাছে এসে বলে, চল, এবার ফিরি। বেশ রাত হলো।

তখন কথা বলার মতো শক্তি ছিল না আমার। কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। কী এক ঘোরের মাথায় আমি হাঁটতে থাকি কল্পনাথের পিছু পিছু।

বেশ রাত করে বাড়ি ফিরলাম।

বাড়ির সবাই চিমত্মায় ভেঙে পড়েছিল। আমায় দেখে যেন ধড়ে প্রাণ এলো সবাইয়ের।

বাবা রুদ্রমূর্তি ধরে শুধোলেন, কোথায় গিয়েছিলি? সত্যি করে বল।

একসময় সত্যি কথাটা কবুল করি আমি, কল্পনাথের সঙ্গে রানীহাঁস দিঘিতে বুনোহাঁস দেখতে গিয়েছিলাম।

ওই রাতে আর বাবা আমায় বেশি কিছু বলল না। শুধু গুমরানো গলায় বলল, ওই কল্পটার সঙ্গে যদি আর কখনো মেলামেশা করতে দেখি তো -।

 

তিন

সে-রাতে ভালো করে ঘুমই হয়নি আমার। রাতভর কেবল মেজদির কথাই ভেবেছি। আধো-তন্দ্রার মধ্যে তাকে বারবার দেখেছিও।

রাত পোহাতেই কথাটা আর কিছুতেই চেপে রাখতে পারলাম না মায়ের কাছে। তা-বাদে মেজদি তো বলেই দিয়েছিল, মা-কে আমার কথা বলিস।

মায়ের শরীরের সঙ্গে একবারে লেপটে গিয়ে বলি, মা, তোমায় একটা কথা বলব, কাউকে বলবে না বলো।

– কী কথা? মায়ের দুচোখে কৌতূহল।

– আগে বলো, তুমি কাউকেই বলবে না।

– বলব না, বল।

বলি, আমি না – আমি না – কাল রাতে মেজদিকে দেখেছি।

তৎক্ষণাৎ থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে মা, কোথায়?

– রানীহাঁস দিঘির পাড়ে।

গেল-রাতের পুরো ঘটনাটা বললাম মা-কে।

শুনতে শুনতে মায়ের চোখদুটি ভরে গেল জলে। একসময় ধরা গলায় শুধোয়, কেমন আছে সে হতভাগী?

– ভালোই আছে মা। সেই আগের মতোই ভরাট করে হাসছিল।

বেশ খানিকক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারে না মা। একসময় ফিসফিস করে বলে, এক-পুন্নিমেয় আমায় নিয়ে যাবি রানীহাঁসের পাড়ে? লুকিয়ে যাব, লুকিয়ে ফিরব। পাগলা-শিবের মন্দিরে পুজো দিতে যাচ্ছি বললে, তোর বাবা কিছু বলবে না।

কিন্তু মা-ও কথাটা কিছুতেই চেপে রাখতে পারল না। দিনভর হাজারো টানাপড়েন সয়ে অবশেষে রাতের বেলায় কথাটা বলে ফেলল বাবাকে।

আমাদের শোয়ার ঘরের খাটটা ছিল বিশাল। আমরা তিনজনায় ঘুমোতাম ওই খাটে। প্রথমে আমি, তারপর মা, সবশেষে বাবা। বড়দের চেয়ে ঢের আগেই বিছানায় ঠাঁই নিই আমরা, বাচ্চারা। এতক্ষণে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ওই রাতেও ঘুম আসছিল না কিছুতেই। কী করে আসবে, মেজদি যে বারবার হাজির হচ্ছিল সামনে।

মা বলল, তোমায় একটা কথা বলব, রাগ করো না, মাথা খাও।

উলটোদিকে পাশ ফিরে শুয়েছিল বাবা, ওই মুদ্রাতে থিতু থেকেই বলল – কী কথা? মা খুব চাপাগলায় বলল, গতকাল খোকা সুহাসিকে দেখেছে।

– দেখেছে মানে? বাবা মায়ের দিকে পাশ ফেরেন, কোথায় দেখেছে?

– রানীহাঁস দিঘির পাড়ে। মা-র গলায় চাপা উচ্ছ্বাস, কাছাকাছি কোনো গ্রামে সংসার পেতেছে নির্ঘাত। মাঝে মাঝেই নাকি আসে দিঘির পাড়ে। মা গুনগুন করে পুরো ঘটনাটা বলল বাবাকে।

বাবা বেশ খানিকক্ষণ গুম মেরে থাকেন। একসময় ভরাট গলায় বলেন, খোকাটা খুব মিথ্যাবাদী হয়েছে।

বাবার শেষ কথাটা শুনে অভিমানে আমার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসার জোগাড়।

– কক্ষনো না, খোকা আর যা হোক, মিছে বলে না। আর, এমন খুঁটিনাটি বলল সবকিছু, অতটুকু বাচ্চার পক্ষে সম্ভবই নয়।

মায়ের কথাটা শুনে মনটা একটুখানি শান্ত হলো আমার।

বাবা আবারো খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। একসময় বিড়বিড় করে বলে, তাও বলছি, এক্ষেত্রে ছেলেটা মিছেই বলেছে।

– এত জোর দিয়ে কেমন করে বলছ কথাটা? মা অস্থির গলায় বলে ওঠে, দেখতেও তো পারে। কাছাকাছি কোথাও সংসার পাতলে ওই দিঘির পাড়ে আসাটা বিচিত্র কী? হাজার হোক, ওটা তো ওদের খুব প্রিয় জায়গা ছিল।

– না, আসতে পারে না। অন্ধকারে বাবার গলায় রুদ্ররোষ ফুটে ওঠে।

বাবার গলাটাতেই এমন কিছু ছিল, আমি টের পেলাম, মায়ের শরীরটা সহসা কেঁপে কেঁপে উঠল। ভয়ে ভয়ে শুধোল, কেন? আসতে পারে না কেন?

বাবা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইল। আমি ওর ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেওয়ার আওয়াজ পেলাম অন্ধকারে।

একসময় খুব হিসহিসে গলায় বলল, পারে না এই কারণে যে, সে আর ইহলোকে নেই।

মায়ের সারাশরীর জুড়ে ততক্ষণে শুরু হয়েছে অবিরাম কাঁপুনি। পাশটিতে শুয়ে আমি স্পষ্টই টের পাই, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লেগেছে সে। একসময় কোনো গতিকে বলে, বাবা হয়ে এমনটা বলছ কেন গো?

– বলছি এই কারণে যে, আমি জানি, তার লাশটা সায়েরদিঘির পাড়ে মাটির তলায় শুয়ে রয়েছে।

– কীসের জোরে এমন কথাটা বলতে পারছ তুমি।

আবার ঘরের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণের অস্বসিত্মকর নিস্তব্ধতা।

একসময় ফিসফিস করে বাবা বলে, ওই রাতেই সে শেষ হয়ে গিয়েছে। তোমাদের চোখের আড়ালে আমি আর নগেন্দ্র মিলে
তাকে -। বাবা আর কথাটা শেষ করে না।

একটু বাদেই আবার বাবার গলা অন্ধকারে ভেসে ওঠে। খুব কঠোর গলায় বলে, তুমি তো জানোই, নীতির প্রশ্নে আমি আত্ম-পর ভেদ করিনে।

ততক্ষণে মায়ের হৃৎস্পন্দন থেমে গিয়েছে। অন্ধকারেও টের পেলাম তার। অকস্মাৎ নিদারুণ আঘাতে একেবারে বোবা বনে
গিয়েছে মা।

আমি জানি, আমার বাবা মিছে কথা বলেন না। সত্যের জন্য তাঁর জীবনপণ। কিন্তু এই একটা ক্ষেত্রে মেজদি ওঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেই ছেড়েছে।

কারণ, আমি স্থির-নিশ্চিত, বাবা ও ছোটকাকা মিলে ওকে যতই না কেন মেরে ফেলার চেষ্টা করুক, রানীহাঁস দিঘির বুনো হাঁসগুলো আর ফি-পুন্নিমেয় মায়াময় ছিট-জ্যোৎস্নাই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে। r