বুলবুল চৌধুরী : নৃত্যপাগল ব্যাকুলতার অন্য নাম

ফেরদৌস আরা আলীম

প্রতিভা এক প্রশ্নাতীত প্রপঞ্চ।  কে, কখন, কোথায় কোন শ্রেণির প্রতিভা নিয়ে জন্মাবে, সে-প্রতিভার বিকাশ কীভাবে ঘটবে বলা কঠিন। নিষ্প্রাণ, বিবর্ণ, রুক্ষ কাঁটাঝোপের চুরুলিয়ার মাটি ফুঁড়ে এতো প্রাণ, এতো রং, এতো সুর নিয়ে নজরুল কীভাবে মাতিয়ে তোলেন সারাটা দেশ? পরিশুদ্ধ, পরিচর্চিত এবং শিল্পিত পারিবারিক পরিবেশের আনুকূল্যের সবটুকু মহর্ষির চতুর্দশ সন্তানটির ওপরেই কেন অর্শালো? সাধারণ সকল মূল্যে সে-মূলধনকে অভিষিক্ত করেও কি একজন রবীন্দ্রনাথের হয়ে ওঠা সম্ভব? চট্টগ্রামের রশীদ আহমদ চৌধুরী কলকাতার প্রেসিডেন্সিতে গিয়ে বুলবুল চৌধুরী হতেই পারেন কিন্তু তাঁর স্বদেশে, স্বধর্মে বা পরিবারের ত্রিসীমানায় যে-ভাবনা নেই সে-ভাবনার অতল গভীরের সন্ধান তিনি কোথায় পান যেখানে তাঁর ‘চেতনা ও শরীর একাত্মতা লাভ করে’?

সাতকানিয়ার চুনতি গ্রামের আজম উল্লাহ চৌধুরী ও মাহফুজা খাতুনের সন্তান রশীদ আহমদ চৌধুরী জন্ম নিয়েছেন ১৯১৯ সালের ১ জানুয়ারিতে, বগুড়ায়, পিতার কর্মস্থলে। মাত্র ৩৫ বছরের একটা ছোট্ট জীবনে ততোধিক স্বল্পবৃত্তের (মাত্র ২০ বছরের) একটি শিল্পীজীবন যাপন করে গেছেন বুলবুল চৌধুরী। এটুকু জীবনের কথা বলতে গিয়ে নীলরতন মুখোপাধ্যায়কে লিখতে হয় ৫৩৭ পৃষ্ঠার একটি বই। আর ‘বুলবুল চৌধুরী’ শিরোনামে নাতিদীর্ঘ একটি প্রবন্ধে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর মূল্যায়ন করেন এভাবে : ‘…নৃত্যকলায় লোকসংস্কৃতির এরকম ব্যাপ্তি এই উপমহাদেশে আর কেউ দিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।’

নৃত্যকলা বুলবুল প্রতিভার প্রধান দিক নিঃসন্দেহে। তবে অভিযাত্রী ছিলেন তিনি সংস্কৃতির নানা পথের; ব্যর্থ হননি কোথাও। শুধু সময়ের প্রসাদ পেলে সাহিত্যিক বুলবুল নৃত্যশিল্পী বুলবুলের প্রতিদ্বন্দ্বী হতেও পারতেন, হয়তো-বা। প্রাথমিক সূচনা সেরকমই বলে। মানিকগঞ্জ হাইস্কুলের ছাত্র বুলবুল স্কুল-বিচিত্রায় উপস্থিত সুধীজনদের যখন তার চাতক-নৃত্যে চমকে দিচ্ছেন তখন, ততোদিনে বিশ্বকবিকে উৎসর্গীকৃত তাঁর কাঁচা হাতে কবিতার পান্ডুলিপি তৈরি হয়ে গেছে। তাঁর গীতিকবিতার পান্ডুলিপি বুলবুলি থেকে গান নিয়ে তাতে সুর দিচ্ছেন বেণীমাধব বন্দ্যোপাধ্যায়, তখনকার খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী, সংগীতব্যক্তিত্ব, মানিকগঞ্জের। বুলবুল চৌধুরীর সুন্দর হস্তাক্ষরে তাঁরই একক প্রচেষ্টায় বকুল নামে একটি পত্রিকার দুটি সংখ্যা তিনি করেন নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন সময়ে। একটি শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে পারিবারিক পরিবেশের কাছে তাঁর কিছুটা ঋণ অবশ্যই ছিল। ঘরে কলকাতা থেকে আনানো পত্র-পত্রিকা ও বই-পুস্তকের ছোটখাটো সংগ্রহ ছিল। পিতা শুধু যে উদার হৃদয়ের অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন তাই নয়, তিনি একজন আদর্শবাদী মানুষও ছিলেন। স্বদেশি যুগে বিপ্লবী রাজবন্দি-নজরবন্দিদের তিনি সুযোগ পেলেই পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। সরকারি নীতিবিরুদ্ধ এসব কাজের জন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর পদোন্নতি ব্যাহত হয়েছিল বলে জানা যায়। পিতার কর্মস্থল বাঁকুড়া থানা অফিসের কাছাকাছি নজরবন্দি এক স্বদেশি বিপ্লবীকে বুলবুল পেয়েছিলেন, যাঁর কাছে তাঁর ছবি অাঁকার হাতেখড়ি হয়। সেইসঙ্গে নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের দীক্ষাটিও যে হয়নি, কে বলবে! বাঁকুড়ার গেরুয়া মাটির দেশে কালো বালক ‘ঝমরু’, ঝমরুদের সাঁওতাল পল্লী, আদিবাসীদের আনন্দমুখর নৃত্যপর জীবন বুলবুলের বালকমনে মূল্যবান স্মৃতির সঞ্চয় হয়ে ছিল নিশ্চয়ই। অনেক পরে, আমরা দেখেছি, এই ছন্দে তাঁর জীবন কথা বলেছে। মানিকগঞ্জে জনৈক মুন্সেফের শান্তিনিকেতনে পড়ুয়া দুই পুত্রকন্যার নাচ দেখাও বুলবুলের নৃত্যপ্রতিভার পক্ষে নতুন সংযোজন নিশ্চয়ই। ধারাজলের জন্য চাতকের প্রতীক্ষা এবং সে-জলে অবগাহনের আনন্দ নিয়ে এক কিশোরের নৃত্যপরিকল্পনা যে একেবারে ভুঁইফোঁড় কোনো বিষয় ছিল না তার একটা সমর্থন এসবের মধ্যে আমরা পেয়ে যাই। অচিরেই আমরা দেখবো যে, ঊষর এক শিল্পভূমিতে বর্ষার অগ্রদূত হয়ে আসা চাতক তিনি নিজেই।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর স্বগ্রাম চুনতিতে স্থানীয় একটি হাইস্কুলের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে সাতকানিয়া টাউন হলে পরিচিত বন্ধুদের অনুরোধে চাতক-নৃত্যই তিনি আবারো পরিবেশন করেন। এ-অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাতকানিয়ার আরেক কৃতী সন্তান আবুল ফজল বলেছিলেন, ‘…নৃত্য যে আনন্দের কত বড় উৎস, সেদিন বুলবুলের নৃত্য দেখেই আমি তা বুঝতে পেরেছিলাম।’ অথচ একই নৃত্যের জন্য বুলবুলকে রক্ষণশীলদের আক্রমণের মুখোমুখিও হতে হয়েছিল। ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে নৃত্য মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে নিন্দিত এবং নিষিদ্ধই ছিল বলা চলে। নানা কারণে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় নৃত্যও তখন অধঃপতিত হয়ে পড়েছিল। ভদ্রসমাজে নৃত্য এতোটাই অশ্রদ্ধেয় হয়ে পড়েছিল যে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতনে নৃত্যপ্রশিক্ষণের বিষয়টি আড়াল করার জন্য বলতে হয়েছিল যে, ‘ছাত্ররা মৃদঙ্গের তালের সঙ্গে ব্যায়াম শিক্ষা করছে।’ কলকাতার মঞ্চে ১৯২৭-এ নটির পূজায় নন্দলাল বসুর বন্যা গৌরী বসুর নৃত্য প্রশংসিত হলে কবি স্বয়ং হালে পানি পান। অন্যদিকে, সমসময়ে ইউরোপে চিত্রকলার পাঠ নিতে গিয়ে উদয়শঙ্কর চিত্র ফেলে নৃত্যে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। রাজস্থানের উদয়পুরের (তাঁর জন্মস্থান) লোকনৃত্য, রাজনর্তকীদের নৃত্যভঙ্গি এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ভারতীয় ঐতিহ্যমন্ডিত নৃত্য ও নৃত্যের ভাস্কার্যচিত্র দেখে নিজেকে তিনি তৈরি করে নিতে থাকেন। ইউরোপে নৃত্যশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর রাশিয়ার বিখ্যাত ব্যালে শিল্পী আনা পাভলোভার সঙ্গে যোগ দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা জয় করে উদয়শঙ্কর কলকাতায় ফেরেন ১৯৩০ সালে। উদয়শঙ্কর যখন ‘অসি-নৃত্য’, ‘রাধা-কৃষ্ণ’, ‘অজন্তা-ব্যালে’, ‘হিন্দু-ওয়েডিং’ এবং ‘ইন্দ্রপতনে’র মতো নৃত্যে কলকাতা মাতাচ্ছেন, তখনো রশীদ আহমদ চৌধুরী বুলবুল চৌধুরী হননি। কলকাতায় তিনি পা রেখেছেন ১৯৩৪ সালে।

প্রেসিডেন্সি কলেজের আইএ ক্লাসের ছাত্র বুলবুল চৌধুরী কলেজের বিচিত্রানুষ্ঠানে ‘সূর্য-নৃত্য’ পরিবেশন করে চিলড্রেন ফ্রেশ এয়ার এক্সকারশন সোসাইটির কর্ণধার সমাজসেবী শ্রীমতি স্নেহলতা মিত্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শিল্পীজীবনে পিতা এবং স্বামীর দিক থেকেও প্রভাবশালী এই নারীর যথেষ্ট আনুকূল্য পেয়েছেন বুলবুল। এরই সূত্রে যন্ত্রশিল্পী মিহির কিরণ ও সুরশিল্পী তিমির বরণ ভট্টাচার্য ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে বুলবুলের পরিচয়। এঁদের একজন বুলবুলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, অন্যজন তাঁর কলকাতা-কেন্দ্রিক শিল্পীজীবনের সংগীত প্রযোজক ছিলেন আদ্যন্ত। শ্রীমতি মিত্র ও তিমির বরণের সহযোগিতায় একক নৃত্যনাট্য সুধম্বা তৈরি করেন বুলবুল। মিসেস মিত্রের এক্সকারশন সোসাইটির বার্ষিক অনুষ্ঠানে ফাস্ট এম্পায়ার মঞ্চে ১৯৩৮-এ এর প্রদর্শনী হয়। বস্ত্তত, কবি নজরুলের মতো বুলবুলেরও বন্ধুভাগ্য ছিল ঈর্ষণীয়। এঁদের কার্যকরী সহযোগিতা বুলবুলকে নৃত্যজগতে প্রশংসনীয় প্রতিষ্ঠা পেতে নানাভাবে সাহায্য করেছে। যেমন সেকালের স্বনামধন্য ইম্প্রেসারিও হরেন ঘোষ সাধনা বসুর সঙ্গে বুলবুলকে নাচের সুযোগ করে দেন। রবীন্দ্রস্নেহধন্য সাধনা বসু ছিলেন কেশব সেনের নাতনি। এর সঙ্গে বুলবুল ‘কচ ও দেবযানী’, ‘রাসলীলা’, ‘মেঘদূত’, ‘স্ট্রিটসিঙ্গার’ প্রভৃতি নাচে অংশ নেন। এঁদেরই সাহায্য-সহযোগিতায় বুলবুল ‘ওরিয়েন্টাল ফাইন আর্টস’ (ওফা) গড়ে তুলেছিলেন। ওফার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বুলবুল অতিথি হিসেবে বাংলার গভর্নর লর্ড ব্রাবোর্ন ও লেডি ব্রাবোর্নকে পেয়েছিলেন। ১৯৩৮-এর ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বরে বন্যাদুর্গতদের জন্য চ্যারিটি শো আয়োজন করেছিল ‘ওফা’।

ওই দুদিনের আয়োজনে উদ্বোধক হিসেবে বুলবুল পেয়েছিলেন নেতাজি সুভাষ বসু ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে। শ্রীমতি মিত্রের সংগঠনটির সপ্তম বার্ষিক অনুষ্ঠান এবং ‘ওফা’র দ্বিতীয় নৃত্যানুষ্ঠানের জন্য বুলবুল অজন্তা, জাগরণ, মিলন-মাথুর, তিন-ভবঘুরে, অর্জুন, কালবৈশাখী, হাফিজের স্বপ্ন, সোহরাব-রুস্তম ও ব্রজবিলাসের মতো নৃত্যরূপ তৈরি করেন। নৃত্যশিল্পী হিসেবে নিজের পরিপূর্ণ স্বীকৃতি লাভের পথ প্রশস্ত করেন। ওই সময় ভারত সফররত আমেরিকান মার্কাস কোম্পানি (বিশ্বের সেরা ব্যালে শিল্পীদের সমন্বয়ে গড়া) দুমাসের জন্য ভারত সফরে এলে তাদের বিদায়ী অনুষ্ঠানে বুলবুল অতিথিশিল্পী হিসেবে আমন্ত্রণ পান। পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া, ব্যাপক চর্চা ও সাধনা ব্যতিরেকেই বুলবুলের যাবতীয় অর্জনের মূলে রয়েছে গণমানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা যা তাঁর সহজাত শিল্পধর্মের অন্তর্গত ছিল। এ সম্পৃক্ততা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নৃত্যে তার প্রয়োগের জন্য উদয়শঙ্করকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগদান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এঁদের যৌথ প্রচেষ্টায় নৃত্য যখন অনেকটাই গণমুখী রূপ নিয়েছে কলকাতার নৃত্যমঞ্চে তখনই বুলবুলের আবির্ভাব। তিনি এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। ’৪২-এর পরে মেদিনীপুরের দুর্ভিক্ষ অবলম্বনে তাঁর The Great Hunger এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তাঁর Black out নৃত্যনাট্য ভারতীয় গণনাট্য সংঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এঁদের ব্যালে স্কোয়াডের দায়িত্ব পান বুলবুল।

গণনাট্য সংঘের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে বুলবুলের মানসচেতনা মিলে যাওয়ায় নৃত্যে ওদের কাঙ্ক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তুলতে বুলবুলকে কোনোরকম বেগ পেতে হয়নি। এ-সময়, স্বাভাবিক, নতুন মাত্রায় অভিষিক্ত হয়েছে তাঁর সৃষ্টি। বাংলায় মন্বন্তর এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি নিয়ে যথাক্রমে Lest we forget (যেন ভুলে না যাই) এবং The Alluring Trap (বীতংস) নৃত্যনাট্য রচনা করেন বুলবুল। ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতির উত্তাপ নিয়ে তিনি তৈরি করেন Quit India। সৃজনের এই তুঙ্গ সময়টাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে তাঁকে ফিরতে হলো তাঁর মাতৃভূমিতে।

১৯৪২ সালে, দেশটা যখন আসন্ন দুর্ভিক্ষের পদধ্বনিতে আতঙ্কগ্রস্ত, সীমান্তে জাপানি হুমকি, তখন বুলবুল ছিলেন চুনতিতে। এমএ পরীক্ষাটা সেবারে তাঁর দেওয়া হয়নি। বন্ধু সন্তোষচন্দ্র (সরোদবাদক) কলকাতা থেকে চিঠিতে পরীক্ষার কথা মনে করিয়ে দিলেন। উত্তরে বুলবুল লিখলেন, ‘শতাব্দীর অগ্নিযজ্ঞে আমাদের মৃত্যুপরীক্ষা হোক।’ এক ২৫শে বৈশাখে লেখা এ-চিঠির শেষে কবিগুরুর স্মৃতির উদ্দেশে প্রণাম জানিয়েছিলেন বুলবুল। লিখেছিলেন, ‘মহাকালকে উপেক্ষা করে যিনি আমাদের মাঝেই রয়েছেন তাঁর জন্মউৎসব তো চিরকাল ধরেই চলবে। ২৫শে বৈশাখ সেই আনন্দে অধীর হয়েছে।’ আসলে চট্টগ্রাম শহর থেকে অনেক দূরে (৪০ মাইল দক্ষিণে) পাহাড়, বনভূমি ও সমতলের সবুজ সমুদ্রে ডুবে থাকা চুনতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ বুলবুলের ভেতরে তখন নতুন এক শিল্পযাত্রার প্রস্ত্ততি চলছে। সবুজের বুক চিরে চলে যাওয়া আরাকান ট্রাঙ্ক রোডের আসা-যাওয়ার পথে যুদ্ধভীত, যুদ্ধতাড়িত উদ্বাস্ত্তদের মুখ থেকে শোনা কাহিনি চৈতন্যে অন্যরকম ঘা দিয়ে যাচ্ছে। জাপানি বোমায় বিধ্বস্ত রেঙ্গুন শহর থেকে দলে দলে উদ্বাস্ত্ত বাঙালিরা পালিয়ে আসছে এ-পথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজাত একটা সংকটকে বার্মা-আরাকান-চট্টগ্রামের জীবন ও ইতিহাসের সুতোয় গেঁথে একটা উপন্যাস লিখছেন বুলবুল। কলকাতার মলয় ও বার্মার তরুণী থিনের ভালোবাসা এ-উপন্যাসে প্রেম, শান্তি ও আশার প্রদীপটি জ্বালিয়ে রাখে। কামরুল হাসানের প্রচ্ছদ ও সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকা-সংবলিত বুলবুলের এই একমাত্র উপন্যাসটি (প্রাচী) গোপাল হালদারের সহায়তায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। বোন সুলতানা রহমান বুলবুলের জীবনীগ্রন্থে (বুলবুল চৌধুরী) নাগরিক, পাদপ্রদীপ ও আরাকান ট্রাঙ্ক রোড নামের আরো তিনটি উপন্যাসের উল্লেখ করেছেন। তবে এর কোনোটিই পাওয়া যায়নি।

কলকাতার নামকরা সাহিত্যপত্রিকা পরিচয় বুলবুলের ‘পয়মাল’ ও ‘অনির্বাণ’ নামের দুটি গল্প ছেপেছে ১৯৪৫ সালে। দ্বিতীয় গল্পটি ১৩২০ সনের শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এ-গল্পটি রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েছিল বলে বোন সুলতানা রহমান বুলবুলের জীবনকাহিনিতে জানিয়েছেন। বুলবুলের ‘আগুন’ গল্পটি চট্টগ্রামের মাসিক পত্রিকা উদয়নে প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। ১৯৫৩ সালে পূর্ব বাংলার সমকালীন সেরা গল্প সংকলনে এটি স্থান পেয়েছে। মানুষের স্বপ্নভঙ্গের গল্প লিখেছেন বুলবুল। লিখেছেন নির্বাচিত মানবতার গল্প। লিখেছেন দুঃসময়ে দানবীয় চরিত্রের উত্থানের গল্প। সবই যুদ্ধের অনুষঙ্গে। ভাষাসৈনিক মাহবুবুল আলম চৌধুরী স্মৃতির সন্ধানে গ্রন্থে বুলবুলের ‘রক্তের ডাক’ গল্পটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘রশীদ আলী দিবস ও নৌ বিদ্রোহের পটভূমিতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন ‘চিহ্ন’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন ‘ঝড় ও ঝরাপাতা’ এবং চট্টগ্রামের সন্তান ও নৃত্যশিল্পী বুলবুল লিখলেন ‘রক্তের ডাক’।’ বুলবুলের এ-গল্পে অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচয় পরিস্ফুট হয়েছে।

১৯৪৩ সালে বুলবুল সংসারী হয়েছিলেন। শিল্পচর্চার পাশাপাশি চাকরিও করছিলেন। দেশভাগের সময় তিনি বেসরকারি ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজে কাজ করছিলেন। এ-প্রতিষ্ঠানটি পিআইএর অন্তর্ভুক্ত হয় এবং উঁচুপদে করাচিতে বুলবুলকে বদলিও করা হয়। শেষ পর্যন্ত এ-চাকরিও বুলবুল করেননি। শুরু হয় তাঁর নতুন যুদ্ধ। জীবনের এবং শিল্পের। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারের আমন্ত্রণে সেখানকার কৃষি ও শিল্পপণ্য মেলা উপলক্ষে প্রদর্শনী করতে এলেন বুলবুল। সাধনা বসু ও কলকাতার দলবল নিয়ে আগেও তিনি চট্টগ্রামে অনুষ্ঠান করে গেছেন। এখান থেকে নতুন করে জনাকুড়ি নানা ধর্মের নবীন শিল্পী নিয়ে সংস্কৃতির বন্ধ দুয়ারে আঘাত হানার জন্য তৈরি হতে থাকেন তিনি। অনুষ্ঠান করলেন ঢাকার রূপমহল সিনেমায়। এই ঢাকা বুলবুলকে একরকম ফিরিয়েই দিয়েছিল ১৯৪০ সালে। তখন তাজমহল ও পিকচার হাউসের অনুষ্ঠান বুলবুলকে হতাশ করেছিল। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ ও বরিশালে গেলেন বুলবুল। সেখান থেকে সরকারি আমন্ত্রণে সিলেটের পৃত্থীমপাশায় সফররত ইরানের শাহের সম্মানে দুরাত অনুষ্ঠান করেন। ইরানরাজের মুগ্ধতা এবং অনুষ্ঠানের সাফল্যে অনুপ্রাণিত বুলবুল গড়ে তোলেন ‘বুলবুল চৌধুরী অ্যান্ড হিজ ট্রুপস’।

করাচির বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে করাচিতে অবস্থানরত বুলবুল (ততোদিনে পাকিস্তানের জাতীয় নৃত্যশিল্পীর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত) প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আমন্ত্রণে সফররত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলার নেহরুর সম্মানে অনুষ্ঠান করেন। নেহরু হিন্দু-মুসলিম উভয় সংস্কৃতির রূপকার বুলবুলকে ‘গ্রেট আর্টিস্ট’ হিসেবে অভিহিত করেন। করাচির ডন পত্রিকায় তাঁকে ‘দ্য ভেরি স্পিরিট অব কালচার ইন পাকিস্তান’ বলা হয়।

এসময় বুলবুল একটি অবিস্মরণীয় কাজ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি সরকারি অবহেলা তিনি দেখেছেন। মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রটা অাঁচ করতেও অগ্রসর চিন্তা ও উন্নত সাংস্কৃতিক বোধসম্পন্ন বুলবুলের অসুবিধা হয়নি। করাচির হোটেল মেট্রোপলে এক সংবাদ সম্মেলনে একজন বাঙালি শিল্পী হিসেবে তিনি একটি প্রতিবাদী ভাষণ দেন। এ-ভাষণ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে তাঁর লড়াইয়ের কথা বলে। বুলবুল বলেন যে, বহুজাতি ও বহু সংস্কৃতির দেশ পাকিস্তানে ইসলাম কখনো সংস্কৃতির মূল বা একমাত্র উপাদান হতে পারে না। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, ভৌগোলিক পরিবেশ ও বিভিন্ন জাতিসত্তার ভিন্নতা সাপেক্ষে দেশটির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য মানতেই হবে। এও মানতে হবে যে, সব সংস্কৃতির মর্মমূলে রয়েছে জীবনের জন্য ভালোবাসা এবং সৌন্দর্যপ্রীতি। সুতরাং জাতীয় ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে সংস্কৃতির বিচিত্র গতি রুদ্ধ করা সমীচীন নয়। বাংলা এবং উর্দুর বিষয়টিকেও তিনি এ প্রেক্ষাপট থেকে বিচারের পরামর্শ দেন। এর অন্যথা হলে, বুলবুল বলেন, রাষ্ট্রের সংহতি বিপন্ন হতে বাধ্য। বুলবুলের এই ভাষণটি ডন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ভাষা ও বিষয়বস্ত্তর দিক থেকে এটাকে মুলকরাজ আনন্দ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ বা গোপাল হালদারের রচনার সমকক্ষ বলে বিদগ্ধজনের অভিমত স্বীকার্য। ‘ভারতীয় নৃত্যে’র মতো প্রবন্ধ ও বুলবুলের বিষয়-ভাবনা, ভাষার দার্ঢ্য ও চিন্তার স্বচ্ছতার পরিচয় বহন করে।

নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় সংস্কৃতির বিচিত্র পথের অভিযাত্রী বুলবুলের জীবনতৃষ্ণার আরেক রূপ। মুক্তচিন্তা ও সুস্থ শিল্পচর্চার লক্ষ্যে তিনি একসময় ‘ক্যালকাটা কালচার সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ-প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ইবসেনের দ্য গোস্ট অবলম্বনে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা চোরাবালি নাটকে অভিনয় করেন বুলবুল। সেদিনের শ্রীরাম মঞ্চে (আজকের বিশ্বরূপায়) তাঁর পরিচালনা ও অভিনয় দুটোই বিপুল প্রশংসা অর্জন করে। আনন্দবাজার পত্রিকায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সুন্দর সুসংহত অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন। নিউ এম্পায়ারে ‘নাট্যচক্র’ নিবেদিত প্রতিবাদী গণনাটক নীলদর্পণে বিন্দুমাধব চরিত্রে অভিনয় করে বুলবুল নিজে খুব আনন্দ পেয়েছিলেন।

অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মন্মথ রায়ের লেখা অবলম্বনে কৃষাণ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন বুলবুল। বোম্বাই থেকে অভিনয়ের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন কিন্তু ও-পথে আর তিনি যাননি। ফিরে এসেছেন আপন ভুবনে। বুলবুলের এই বিচিত্রগামিতার সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। তিনি বলেন যে, ‘জীবন ও অস্তিত্বের মূল সত্যটিকে স্পর্শ করার জন্য বুলবুল চৌধুরী যেমন নিবিড় অনুসন্ধান চালান এবং তাকে অনুভব করেন তার প্রকাশের জন্য ভাষা, নাট্যমঞ্চ বা তার পর্দা তাঁর কাছে যথেষ্ট বিবেচিত হয়নি। অনুসন্ধান জ্ঞাপনের জন্য তাঁর দরকার পড়ে গোটা শরীরের, অন্য কোনো মাধ্যম সেখানে অল্প ও অসম্পূর্ণ।’

লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে বুলবুলকে বিদেশে পাঠানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে ভগ্নস্বাপ্নিক বুলবুলকে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে হয়। এ-সময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে তো বটেই, বড় বড় মফস্বল শহরেও বুলবুল অনুষ্ঠান করেন। ধর্মান্ধদের প্রবল বিরোধিতার মুখেও তিনি আপন কর্তব্যে অটল ছিলেন। এ-সময় তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃত্যনাট্য যেন ভুলে না যাই সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কিছুদিন তিনি ময়মনসিংহের শশীলজে মহারাজা স্নেহাংশু বাবুর সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন। পরিবার ও দল নিয়ে সেখানে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি আগুন ও প্রজাপতি এবং অ্যাংলো আমেরিকান বস্নক ভার্সাস ইরান নৃত্য সৃষ্টি করেন।

অতঃপর বেসরকারিভাবে ইউরোপ সফরের ব্যবস্থা করতে গিয়ে বুলবুলকে প্রচুর হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। অর্থ সংগ্রহের জন্য নানাজনের দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করতে হয় তাঁকে। ইচ্ছার বিরুদ্ধেও অনেকের কাছে হাত পাততে হয়। শুধু তাই নয়, দলের ভারতীয় সদস্যদের জন্য পাকিস্তানি পাসপোর্ট বানাতে হয়। অনেকের হিন্দু নাম বদলে মুসলমানি নাম দিতে হয়। আট মাসের ইউরোপ সফরে বুলবুল ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ছাড়া বেলজিয়াম, ফ্রান্স, হল্যান্ড ও ইতালিতে অনুষ্ঠান করেন এবং বিপুল স্বীকৃতি অর্জন করেন। দল নিয়ে যখন ইউরোপের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বুলবুল; ততোদিনে মরণব্যাধি ক্যান্সারে তাঁর প্রাণশক্তি নিঃশেষিতপ্রায়। নিদারুণ অর্থকষ্টও তখন তাঁর অন্যরকম যন্ত্রণার কারণ। দলের সদস্যদের মধ্যেও চলছে নানারকম দ্বন্দ্ব। নিষিদ্ধ লেস্ট উই ফরগেটের প্রদর্শনী করার দায়ে পাকিস্তান দূতাবাস প্রতিশ্রুত ধারের টাকা থেকেও তাঁকে বঞ্চিত হতে হয়। ১৯৫৩ সালের ২৯ মার্চ ভিক্টোরিয়া জাহাজে যাত্রা শুরু করেছিলেন স্বদেশ থেকে। ফিরলেন ডিসেম্বরে। রুগ্ণ, অশক্ত, একরকম চলৎশক্তিরহিত বুলবুল চট্টগ্রামের মাটি স্পর্শ করে চলে গেলেন কলকাতায়, চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে। পৈতৃক ভিটা দেখার শেষ সাধটুকু অপূর্ণ রেখেই লোকান্তরিত হন বুলবুল। ১৯৫৪ সালের ১৭ মে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে বুলবুল চলে গেলেন।

বুলবুল চৌধুরী। এক নৃত্যপাগল ব্যাকুলতার অন্য নাম। নৃত্যে সমর্পিত ছিলেন সারাটা জীবন। ইউরোপ ভ্রমণকালে ব্যাধির প্রকোপ বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছায়। অপারেশনের পর তাঁর পক্ষে নৃত্য চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে – এই ভেবে বুলবুল সেখানকার ডাক্তারের পরামর্শমতো শল্যচিকিৎসায় সম্মতি দান করেননি। বাংলার মুসলমান সমাজে তিরিশের দশকে যখন হারমোনিয়াম ধরা পাপ তখন বুলবুল পায়ে নূপুর বেঁধেছেন। ধর্মের দোহাই মানা এই নাজায়েজ ও বেশরিয়তি নৃত্যকেই বুলবুল তাঁর আরাধ্য করেছেন। বুলবুলের এ-সাহসকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ‘কোনো সচেতন উদ্যোগের পরিণতি’ বলে মনে করেননি। তিনি বলেছেন, ‘তাঁর অনুসন্ধান, অনুভূতি ও শরীরকে তিনি একটি অখন্ড সত্তায় সংহতি দিয়েছিলেন।’ গ্রিক কথাশিল্পী নিকোস কাজান-জাকিসের জোরবা দি গ্রিক উপন্যাসের ‘জোরবা’র সঙ্গে তিনি বুলবুলের তুলনা করেছেন। জীবনের ‘তীব্র ও গভীর মুহূর্তগুলো অসহনীয় হয়ে উঠলে নিজের ভেতরকার প্রবল কম্পন থেকে রেহাই পাবার জন্য নাচই ছিল ‘জোরবা’র একমাত্র আশ্রয়।’ বুলবুলের সঙ্গে তার পার্থক্য এইটুকু যে, ইলিয়াস বলেন, ‘জোরবা এক মহৎ শিল্পীর বিরল সৃষ্টি। … বুলবুল চৌধুরী নিজেই নিজের সৃষ্টি, তিনি নিজেই শিল্পী, শিল্পও তিনি।’ নৃত্য যে তাঁর স্বধর্ম ছিল সেকথা গোপাল হালদারও বলেছিলেন। তাঁর মতে, বুলবুলের ‘দেহছন্দে উচ্ছিৃত ছন্দোচ্ছ্বাসে নৃত্য ছিল সহজগোচর।’ বন্ধু সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের চোখে বুলবুল ছিলেন ‘Poet of physical rhymes’, বস্ত্তত নৃত্যই ছিল বুলবুলের জীবন প্রকাশের মূল মাধ্যম।