বেদনার স্থাপত্য-ভরা অনুপম

‘যার হাতে গড়ে ওঠে মানুষের বাস্তু-সংস্থান, একটা জাতির কীর্তি, স্মৃতিস্তম্ভ, সৌধমালা, গগনস্পর্শী ঘরবাড়ি, আবার সেই হাতেই যখন রচিত হয় অনর্গল ধারায় কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ভারি ভারি নিবন্ধ সন্দর্ভ, কলা সমালোচনা Ñ তখন যে কোনো বিশেষণই তার জন্য বাহুল্য মাত্র। রবিউল হুসাইনের কবিতার নির্মাণ স্থাপত্যশিল্পের মতোই হিমায়িত ধ্রুপদী সংগীত।’ যে আসে সে ফিরেও যায়। তবু তো কারো কারো পায়ের ছাপে ফুটে ওঠে বর্ণময় পুষ্পশোভা, দেশগন্ধ। পলির ভেতর, ধুলোর মধ্যে, কাঁকড়ার পিঠে খেলা করে রোদ Ñ মায়া বাড়ায় ছায়া। রোদখেলা আর ছায়ামায়ার জগৎসংসারে নির্মাতা যখন সৃষ্টিরূপে নিমগ্ন হন, তখন তল্লাশের অংশটি নানা পর্যায়ে বিবেচনায় ভর করে। এবং তাই স্থপতি রবিউল হুসাইনকে, কবি রবিউল হুসাইনকে অবলোকনও এক পোশাক বদলের পালা। স্থপতির কর্মযোগে আছে নির্মাণের বিবিধ কৌশল, তদ্রƒপ কবির সৃষ্টিধর্মে আছে প্রভূত লীলা।
ওপরে দুই যমজ শিশু
একজন কাঁদে অন্যজন হাসে
একজন ভরপেট অন্যজন ক্ষুধার্ত
একজন অস্থির অপরটি চুপচাপ
ওদের মা দিশেহারা
রকমারি নক্সীকাঁথা
রবিউল হুসাইন উন্মোচনে আমরা কি অপরাগ? তিনি কি রকমারি অসমাপ্ত নকশা? না, চিত্রটি পরিপূর্ণ এবং স্বচ্ছ। ভ্রান্তির অবকাশ সেখানে ক্ষীণ! কেননা নির্মাণ ও সৃষ্টির অভ্যন্তরের একটি ‘না’কে তিনি অবিরাম ‘হ্যাঁ’তে পরিণত করার অভিলাষ প্রকাশ করেছেন আমৃত্যু। বাংলা কবিতায় তাঁর বিশিষ্টতার সাক্ষ্য বহন করে কবিতাগ্রন্থসমূহ। একে-একে উল্লেখ করা যায় Ñ সুন্দরী ফণা, কোথায় আমার নভোযান, কেন্দ্রবিন্দুতে বেজে ওঠে, আরো ঊনতিরিশটি চাঁদ, কী আছে এই অন্ধকারের গভীরে, কর্পূরের ডানাঅলা পাখি, স্থিরবিন্দুর মোহন সংকট, এইসব নীল অপমান, যে নদী রাত্রির, আমগ্ন কাটাকুটি খেলার কথা। গ্রন্থের নামকরণের মধ্যেই যে বিরাজ করে অপর এক পৃথিবী, পৃথক এক সংসার। যা কখনো-কখনো বেদনার অংশ হয়েও আনন্দের সংবাদ জ্ঞাপন করে। একটা বৃহৎ অংক কোথায় যেন শূন্যকে লোফালুফি করতে-করতে হারিয়ে যায় মহাশূন্যে। আবার এর অন্যপিঠে একটা ভূগোল একের সঙ্গে জুড়ে দেয় বহুর চাকা। ফলে ও ফসলে যার চেহারা অপরিচিত হতে-হতে পরিচিত হয়ে ওঠে। আমাদের কামনার অংশগুলো, আমাদের বাসনার খ-গুলো ‘বিষুব রেখা’ অতিক্রম করে ঢুকে পড়ে ‘উজ্জয়িনীর মকরগলি’তে।
কবিতার পাশাপাশি আছে তাঁর নানান মাপের, ভিন্নমাত্রার গদ্যরচনা। সে-রচনার বৃত্তটি কেবলই বড়ো হয়, কেবলই অতিক্রম করতে চায় কেন্দ্রের শাসন। তাঁর-রচনায় জীবনের নিরর্থতা অননুকরণীয় ব্যঞ্জনায় ফুটে উঠেছে, যদিচ অন্তিমে তিনি জীবনবন্দি দর্শনেরই অনুগামী। বর্জনের ধর্মের মধ্যেই তিনি গ্রহণের কর্মটি করেছেন সুচারুভাবে। ‘একটি সত্যিকার অর্থে মানুষ, তার যা ভালো লাগবে তাই করবে, শুধু মানুষের অস্তিত্বের এবং পরিচয়ের তার সার্বিক কল্যাণের বিপরীতে না গেলেই হল।’ Ñ রবিউল হুসাইনের এই যে উক্তি Ñ তা কি কোনোভাবেই দ্ব্যর্থবোধক করার অবকাশ আছে? তা যেমন নেই, তেমনি আবার তাঁকে বলতে শুনি Ñ
‘মোড়ে-মোড়ে ওঁতপেতে থাকে শব্দ-সন্ত্রাসী, অভাবনীয়, Ñ তেমনি থাকে আনন্দময় ফল্গুধারা যা জীবনের, এই বড্ড জনমদুঃখী এক মানব সম্প্রদায়ের, যার সঙ্গে মিলিত হয় সমগ্র মানবকুলের মানবিকতা, শঠতা, প্রেম, নারী, পুরুষ আর প্রকৃতিজাত ঘটনা-বিঘটনার।’
তাঁর গদ্যভাবনার চিত্র দীর্ঘ এবং কিছুটা জটিল হলেও, অন্তরমহলের গাঢ় ও গূঢ় ভাষ্য আমাদের প্রসন্ন করে। যা কিছু বিপরীত, তারও একটি নির্দিষ্ট অনুশাসন থেকে যায়। আবার যে-সকল বিষয় পক্ষের, তাদেরও থাকে নানা প্রান্তে ফাঁক-ফোঁকড়। তাঁর দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাঁর প্রকাশের শব্দমাধ্যম ছিল কেবলই তাঁর। সেখানে তিনি ভাষারূপকে সজ্জিত করেছেন আপন মাধুর্যে। কল্পনা ও বাস্তবের খ-গুলো একত্রিত করে গড়িয়ে দিয়েছেন অন্তিমের পথে। কোনো ফলাফলের আশা কিংবা কোনো বিন্দু স্পর্শের অভিলাষ তিনি পোষণ করেননি। মানুষের ভেতর থেকে অন্য মানুষ বের করে আনার অভিযানে তাঁকে কখনো ক্লান্ত হতে দেখা যায়নি।
দুই
আমাদের যখন পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢোকার সময়, তখন তাঁর পাল্লা খুলে বেরোনোর বেলা। গত শতাব্দীর সেই ষাটের দশকের মধ্যভাগে যখন আকাশভর্তি অন্ধকার, জমিনজোড়া ধুলো এবং জল-ছলছল নেত্রম-ল Ñ তখন প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় তোলপাড় করে কতিপয় বিদ্যার্থী ‘না’ ধ্বনিতে হারিয়ে দিচ্ছে সকল ‘হ্যাঁ’কে। এই ‘না’ যেন অবজ্ঞার, অবহেলার, বিসর্জনের এবং বিনির্মাণের। শিল্প-সাহিত্যের প্রচলিত অঞ্চলটি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবার খেলায় মত্ত তরুণদের অন্যতম ছিলেন রবিউল হুসাইন। স্থপতি রবিউল হুসাইন শব্দ-লাটিমের তৈরি বৃত্তটি পেনসিলের অগ্রভাগে ভেঙে কলমের ডগায় তৈরি করলেন অনন্ত নক্ষত্রের মেলা। আকাশ উপুড় করে যেন তারকারাজি ছড়িয়ে পড়ল ভূ-ভাগে Ñ তৈরি হলো নতুন কবিতার মালা। ‘আকাশ থেকে ঝোলানো জলের দোলনায় চ’ড়ে/ শূন্য থেকে তারা অবিরাম নিচে নেমে পড়ে।’ কবি রবিউল হুসাইনের বোধের বিন্দুটি এত বেশি নড়েচড়ে যে, তাকে ছোঁয়া প্রায় দুরূহ। যে-মুহূর্তে তিনি বলেন, ‘তখন ছিলো বৃহৎ জীবন ক্ষুদ্র বৃত্ত/ এখন অনেক ক্ষুদ্র জীবন বৃহৎ বৃত্ত’; ঠিক পরমুহূর্তেই স্থিরকৃত কেন্দ্র থেকে স’রে গিয়ে আবিষ্কার করেন Ñ ‘ঘুরছি আমি ঘুরবো আমি/ মধ্যবৃত্তে মৃত্যুবধি ঘুরছি আমি অবিরত।’ কবিতাকে নিয়ে এই যে খেলা, তা বুঝি-বা ছড়িয়ে গেলো জীবনে। জীবন খুঁড়ে পেতে চাইলেন হীরকখ-। কিন্তু খোঁড়া, কেবল খোঁড়া Ñ পাথর যে আর শেষ হয় না। একজন রবিউল হুসাইন ভিটেবাড়িতে যে খনন প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে গেলেন, তা তাঁকে স্থপতির মর্যাদা দিলো যেমন, আবার তেমনি ঘোর কুয়োর ভেতর নামিয়ে অতলের ফন্দি-ফিকিরে মজিয়ে দিলো!
শুধু একটি মানুষ
গভীর রাতে বারান্দায়
দাঁড়িয়ে একা একা
আঁধারের পাতাঝরা দ্যাখে
কবি রবিউল হুসাইন। জন্ম ৩১ জানুয়ারি ১৯৪৩, রতিভাঙ্গা, ঝিনাইদহ। পিতা তোফাজ্জল হোসেন। স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক। ষাটের দশক থেকে লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। কবিতা প্রধান বিষয় হলেও, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ কিংবা শিশুসাহিত্যেও তাঁর রয়েছে সবল অভিযান। পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, স্বজনদের প্রতি সহানুভূতি, দেশ ও দশের জন্য মঙ্গলময় ভাবনা তাঁকে দিয়েছে সর্বজনগ্রাহ্যের সনদ। আজীবন ভালোবাসার কাঙাল এই মানুষটি নকশিকাঁথা থেকে তুলে এনেছেন কাকাতুয়া, আণবিক বোমার অপরপ্রান্তে দেখেছেন শস্যময় উজ্জ্বল প্রান্তর। তাঁর অন্ধকার যেমন রজনিভেদী এক দিকনির্দেশনা, তেমনি আলোও সূর্যের এক জীবনদায়িনী উপমা। রক্তের প্রবাহকে হৃদয় থেকে মস্তিষ্কে সঞ্চালনের মাধ্যমে যেমন চৈতন্যের বিস্তার ঘটে, তেমনি কবিতাকে সার ধরে দাঁড় করিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে দিলে শুরু হয় জড়ের মনোক্রীড়া। চৈতন্য ও জড়ের দ্বৈরথে কবি কেবল খোঁজেন তাঁর লক্ষ্যবিন্দু। কবি রবিউল হুসাইনের এই লক্ষ্যবিন্দু কী? যুক্তির মধ্যে প্রতিযুক্তি স্থাপন করে যে-কুহক সৃষ্টি হয় তাই বুঝি-বা তাঁর অভিধান। কিংবা সরলরেখাটি ক্রমান্বয়ে ফিরিয়ে এনে কোনো আয়তন সৃষ্টি করাও হতে পারে অভিনিবেশ। সদাপ্রফুল্ল এই মানুষটি ‘কোন্ প্রবল কারণে ঘুরে ঘুরে ঘূর্ণাবর্তে মরে…!’

তিন
যে বাঁধাধরা ছকে বাংলা কবিতা এখন দাবা খেলছে, তার বাইরে রবিউল হুসাইনের কোর্ট। এ মাঠ কখনো তীর ছোড়ার, কখনো কুস্তির। তীরের ডগায় বিষ নেই, তবে চোখে স্থির হয়ে আছে চালানোর কৌশল। অপরদিকে পেশির অন্তরালে যে-লোহিতকণিকা Ñ তা তো আমিষ ও সব্জির মিলমিশ।
দুই কাঠা জমিতে স্বপ্নসবুজ সোনালি এইসব
জীবনধারণ প্রণালী কি সম্ভব কোনোমতে
হে মহান স্থপতি’
তীর ছোড়া হলো। এখন বিন্দুকে স্পর্শ করার দায়িত্ব সূচালো অগ্রভাগের। স্থপতি যখন তাঁর অবস্থান স্থির করে স্বপ্ন তুলে আনতে চান, তখনই দেখা দেয় বিপত্তি।
পাতার আড়ালে একটা শুঁয়ো পোকার
প্রজাপতিত্ব চলছে।
সৃষ্টিরহস্যের কাছে কবি নিজেকে সমর্পণ করলেন। এই যে চলছে, এই-ই বুঝি নিয়তি। এই চলার অন্তিমে কী Ñ তা কি কখনো কেউ দেখেছে?
স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইন কিন্তু মেলবন্ধনের কাজটি খুব সহজেই করেছেন। তাঁর বাল্যকাল, তাঁর স্মৃতি, তাঁর যৌবন, তাঁর যাপন Ñ তাঁকে ‘ঘুঙুরপরা ন্যাংটো বাচ্চাটার নূপুর ঘুঙুর/ টুংটাং শব্দ গুটি-গুটি পায়ে দৌড়ুচ্ছিলো’ Ñ অতিক্রম করতে দেয় না। তাই তো তাঁর কবিতা বর্ণনার সারল্যে, কাব্যিক যৌক্তিকতায় অপরাপর থেকে ভিন্ন। তিনি কঠিনকে গলিয়ে তরল করেন, তারপর তরলকে বাষ্প। সে-বাষ্প আমাদের চিত্তে দেয় চিন্তার নতুন রসদ। চকখড়ি-পেনসিল-কলমের এক যৌথ অভিযানে রবিউল হুসাইনের কবিতা সহজপাঠ অতিক্রম করে।
বারবার তাঁর কথা ফিরে আসে। একজন রবিউল হুসাইন কখনো রবিউলভাই, আবার কখনো রবিদা হয়ে পুব-পশ্চিমে সমানভাবে আঙুল তোলেন এবং ঘ্রাণ শোঁকেন।
আমার চেনাজানার এই দীর্ঘ সময়ে, ছাত্রজীবন পার করে কর্মজীবনে ধানম-ি এলাকায়, মধ্যদুপুর-গভীর রাত করেছি। তাঁর টেবিল ঘিরে ট্রেসিং পেপার এবং কবিতার পা-ুলিপিরত ছিল যুগল নৃত্যে। ‘পদাবলী’র সেই মুগ্ধ কালটি ছিল কত সুনাম নিয়ে Ñ শামসুর রাহমান, আবুজাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, অরুণাভ সরকার, হায়াৎ সাইফ কেউ নেই। রবিউলভাই, আজ কি আপনার কথা বলার জন্যই আমাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে?
জাতীয় কবিতা পরিষদের সেই শুরু থেকে ভরসার শীর্ষে ছিলেন রবিউল হুসাইন। আরো কত সংগঠন : বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, কচিকাঁচার মেলা … সবখানে ছিলো তাঁর ঠাঁই। স্থপতি হিসেবে দৈর্ঘ্য-েপ্রস্থে যেমন বিস্তৃত হয়েছেন, তেমনি ছিলেন ঊর্ধ্বমুখী। কবিতার পাশাপাশি হরেকরকমের লেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন আমৃত্যু।
একজন ভেতরের মানুষ নদীর নিয়মে প্রবাহিত হয়, আর বাইরে থাকে হাজারো বন্দর। স্পর্শ করতে হয়, ভিড়তে হয়, আবার খুলতেও হয়। কিন্তু কবিকে যে হতে হয় সমুদ্র।
নদীরা প্রবাহিত হোক নদীর নিয়মে
মানুষ ও সমুদ্র এতে খুব খুশি হবে

দুই
অনেক ঘাট অতিক্রম করে, কিংবা বহু বন্দর স্পর্শ করে মোহনায় পৌঁছুতে হয় স্বপ্ন-সাধ পূরণের জন্য। এক জীবনে তা হয়তো না-ও হতে পারে Ñ তারপরও যাত্রাপথের অভিজ্ঞতাই বা কম কীসের? কাঁটা ও পুষ্পের সহ-অবস্থান থেকে শুরু করে হিম ও তাপের প্রতাপ প্রাণকে দেয় প্রাণ অতিক্রম করার স্পর্ধা। কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন এক জীবনে বহু জীবন খুঁজতে চান বলেই উচ্চারণ করেন Ñ
যাদের জীবন ঠিক বানানে জীবন তাদের হ্রস্ব
জীবন বানান ঈ-কারে ব্যাকরণ-সর্বস্ব
সময়ে জ-এ ই-কারও বেশ মহার্ঘ
জীবন যাদের ভুল বানানে তাদের জীবন দীর্ঘ