বেলাল চৌধুরীকে একটা লম্বা সময় শুধু বেলাল বলেই চিনতাম এবং ও যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা মানুষ তাও জেনেছি ঢের পরে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়া থেকে।
ছিপছিপে, সুদর্শন বেলালকে দেখতাম ছোটখাটো কবিতার আসরে কবিতা পড়তে। তাতে যে ওপার বাংলার আভাস থাকত না, তা নয়; তবে সব বাঙালির মধ্যেই তো তখন প্রবল অনুভূতি ওই বাংলার মানুষের প্রতি। কে জানে, সেই সহানুভূতি থেকেই নিজেকে ঈষৎ আড়াল করতেই বেলালের নিজেকে স্রেফ বেলাল হিসেবে চালিয়ে যাওয়া কিনা!
আমাদের দেখা-সাক্ষাতের একটা অদ্ভুত ঠিকানাও ছিল তখন। কলেজ স্ট্রিটের বাটার জুতোর দোকানের পাঁচতলা। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজির এমএর ছাত্র আমি, কবি অলোকরঞ্জনের ভাই শুভরঞ্জন এবং আরো বেশ কজন ওই পাঁচতলায় জাঁকিয়ে চলা আমেরিকান ইউনিভার্সিটি সেন্টারে সুযোগ পেলেই ঢুকে পড়তাম হয় কবিতা কী লেকচার, কুইজ বা আলোচনা শুনতে, ডাক পেলে দু-চার কথা বলতেও হয়তো। আসল লাভটা ছিল মাগনায় ভালো ব্ল্যাক কফি আর কপাল ভালো থাকলে ফ্রিতে চমৎকার মার্কিন বই।
এরকমই এক কবিতার আসরে বেলাল এসে নিজেকে পরিচয় করাল, ‘আমি বেলাল। কবিতা পড়ি। নিজেরই কবিতা। আজ পড়ব।’
বড় সুন্দর করে নিজের কবিতা পড়ে এসে পাশে বসে বলল, ‘এবার একটু কফি খাওয়া যাক তাহলে!’
এই শুরু। তারপর চলতেই থাকল … বিকেলে কলেজপাড়ায় দেখা হয়, কখনো সে-দেখা সন্ধের বৈঠক অবধি গড়ায় বন্ধুবান্ধবের আস্তানায়। যখন কবিতা, গান, তর্কবিতর্কের সঙ্গে জুড়ে যায় রঙিন পানীয়। রঙিন পানীয় বলছি বটে, তবে জলের রংটা সাদাই থাকত – বাংলা মদ তো! জলের মতো সহজ, – সরল ও নির্বর্ণ।
এভাবেই একদিন বন্ধুরা আমরা চালান হয়ে গেলাম শহরের বিখ্যাত খালাসিটোলায়। এবং সেদিনই সম্ভবত প্রথম বেলালকে বলতে শুনলাম পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি কবিদের কথা ও কবিতা।
বেলাল চৌধুরী এর কিছুদিন পর পূর্ণ বেলাল চৌধুরী হয়ে ধরা দিলো বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতে। আমি তখন সদ্য এমএ পাশ দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর ইংরেজি সংবাদপত্র হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে যোগ দিয়েছি। মাঝেমধ্যেই ওখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে ও এবং সেই ফাঁকে আমার সঙ্গেও দেখা করে নেয়।
আমি সদ্যমুক্ত বাংলাদেশে আমার পিতৃভূমি খুলনা ঘুরে এসেছি শুনে কী উচ্ছ্বাস বেলালের! আমি বর্ণনা করছি আর বুঝতে পারছি ও মনে মনে দেশে ফিরে গেছে।
একসময় দেশে ফিরেও গেল এবং মাঝেমধ্যে কলকাতায় ফিরে আসতেও থাকল। তদ্দিনে ঢাকা এবং কলকাতা দু-শহরই ওর পাড়া। এই পর্বেই সুনীলদার (গঙ্গোপাধ্যায়) সঙ্গে আমাদের প্রচুর বসা হয়েছে নানা আড্ডায়। শক্তিদা, সুনীলদা খোঁজ নিতেন বাংলাদেশের কবিদের। দেখতাম সক্কলের হালহকিকত কণ্ঠস্থ বেলালের। বুঝতাম এদিককার কবি, লেখকদের খবরাখবরও ও বয়ে নিয়ে যায় ঢাকায়।
তখন থেকেই দুই বাংলার যোগসূত্র বেলাল।
যখনই ঢাকা এসেছি বেলালকে মিস করেছি এমনটা হয়নি। সে বাংলাদেশ জাতীয় কবিতা সম্মেলন হোক কি বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী সভা হোক। সে-সময় সান্ধ্য পানাহারের বৈঠকে ওকে দেখাটাই ছিল বুকের আরাম। শেষবারের দেখায় কী সুন্দর বলল, ‘শরীরটাই বুড়ো হয়ে গেল গো। মনটা কিন্তু সেই কচিই আছে।’
দুটো স্মৃতি এখন খুব মনে আসে। দুটি বৃত্তান্তের কেন্দ্রেই কবি শামসুর রাহমান; এবং একেবারে পাশে বেলাল। প্রথমটা কলকাতার গঙ্গাবক্ষে স্টিমারে কবিতা উৎসবের মিলনপর্ব। শীতের সকালে স্টিমারে বসে কথা হচ্ছিল শামসুর সাহেবের সঙ্গে। পাশে নিশ্চুপ হয়ে শুনছিল বেলাল। শেষে শুধু বলেছিল, ‘একটা টেপ থাকলে ভালো হতো। ভারত বিচিত্রার কাজে লেগে যেত।’
অন্য স্মৃতি এক পয়লা বৈশাখের আসরের পর দুপুরের বিয়ার-ভোজে। শামসুরের সঙ্গে সেদিন সুনীলদাও। কী অপূর্ব
কথাবার্তা সেদিন, হাবিজাবি গপ্পের কত বাইরে! আলাপে দিব্যি সূত্রধরের কাজ বেলালের।
দুপুরের আহারে বসে আমাকেই বলতে হলো, ‘আজকেও একটা টেপ থাকলে ভালো হতো।’
ও শুধু বলল, ‘তোমার এখনো মনে আছে গঙ্গার সেই সকালটা!’
বললাম, ‘তুমিও তো ভোলোনি দেখছি।’
সত্যি, বেলালকে ভুলি কী করে?
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.