বেলি কেড্সের স্মৃতি

প্রশান্ত মৃধা

পুব-পশ্চিমে টানা খানজাহান আলী রোড, মেইন রোডে মিশে যেখানে শেষ, সেই নাগেরবাজারের আগে বামে ঢুকে যাওয়া রাস্তাটার নাম কাজী নজরুল ইসলাম রোড। শহরের পুরনো বাসিন্দারা কেউ বলে, এই রাস্তার কাজিবাড়িতে একদিন এসেছিলেন বিদ্রোহী কবি, তাই এই নামকরণ। কেউ বলে, ওসব কিছুই না, এমনিতেই কাজী নজরুল ইসলামের নামে নাম, ওই কাজিরা কাজী নজরুলের কিছু হতো-টতো না। কাজী নজরুল রোড উত্তরমুখী, দৈর্ঘ্যে শখানেক গজ। এর ভেতরে কোর্ট মসজিদ রোড মিশেছে, একটু এগোলে পুবে চলে গেছে আরেকটি – কাপুড়েপট্টির গলি, বাকিটুকু মেইন রোডে গিয়ে শেষ।

এই রাস্তার মানুষজন অনেকদিন বাদে একজোড়া বেলি কেড্সের কথা উঠলে জগৎলালের কথা মনে করতে পারে। কাজী নজরুল ইসলাম রোডে ঢুকতেই বাঁয়ে খোদেজা ফার্মেসি, ডানে মোবাইলের শোরুম, তারপর সাগরিকা হোটেলের সরু গলি, এদিকে বাঁয়ে বাটার শোরুম, তারপর সিরহিন্দ সুপার মার্কেট। এখানেই ছিল কাজিবাড়ির গলি এবং সে-বাড়ির সামনে একটা বড় দালান। এরপরে সম্রাট সুজ আর এক সময়ের নিরালা হোটেল, একেবারে কোর্ট মসজিদ রোডের গা-লাগোয়া। এদিকে ডানে সাগরিকা হোটেল ফেলে পুরনো বসু বুক বাইন্ডিং, তারপর একটি রেডিমেড কাপড়ের দোকান, পরে অ্যাপেক্সের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শোরুম। তারপর ছোট্ট গলি, গলির ভেতরে পুরনো নাবিক হোটেল। পরের সামনের বড় বাড়িটা তহশিল অফিসের মহাফেজখানা। এরপর কয়েকটা জুতোর দোকান, বইয়ের দোকান আর ছিট কাপড়ের দোকানের পর কাপুড়েপট্টির গলি।

ঘটনা হয়েছে কী, এই সিরহিন্দ সুপার মার্কেটের মালিক একদিন বিকেলে তার জোববা পরিহিত শরীরে খুবই স্থির পায়ে আসরের নামাজ আদায় করতে কোর্ট মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন এর উল্টো দিকে অ্যাপেক্সের শোরুম থেকে জনাতিনেক প্রায় চল্লিশ বছরের কাছাকাছি মানুষ বেরিয়ে অতটা স্থিরভাবে সাত্তার মিয়াকে কোর্ট মসজিদের দিকে হেঁটে যেতে দেখে একজন অন্যজনকে বলে, ‘উনি সিরহিন্দ মার্কেটের সাত্তার মেয়া না?’

অন্যজন বলে, ‘হয়। তুমি দেখি এহোনো চেনো!’

‘না চেনার কী আছে? তয় মানুষটা কত ঠান্ডা হইয়ে গেইচে!’

‘হয়। তার ছেলে আমাগো সাতে পাড়ত।’

‘সাত্তার মেয়ারে মনে আছে? তা’লি তো তোমার মনে থাকার কথা, এখন যেখানে অ্যাপেক্সের দোকানে এই জায়গায় সত্যরঞ্জন বলে একজনের একটা বড়সড় জুতার দোকান ছেল!’

অন্যজন বলে, ‘হয়। সেই যে তার দোকানে আনা বেইলি কেডস্!’

এইসব কথা এখন একটার পিঠে একটা আসবেই। কিন্তু মূল ঘটনা হলো, এই সাত্তার মিয়ার ছেলে তখন নতুন বাজারে আসা একজোড়া বেলি কেড্স কেনার বায়না ধরেছে। তখনকার হিসেবে ওই কেড্সের যা দাম, সবাই কিনতে পারে না। আজকের অ্যাপেক্সের শোরুমের গলির কোনার অংশ তখন সত্যরঞ্জনের জুতোর দোকান। নাম পাদুকা বিতান। দোকানের প্রায় সামনে ছোট্ট একটা টুল পেতে সে বসে। বাটার দোকান উল্টো দিকে। পাদুকা বিতান তখন রমরমা। আশপাশে বেশিরভাগ দোকানেই তখন জুতো বলতে চপ্পল আর স্পঞ্জ। সেগুলোকে বেশিরভাগ মানুষ বলে স্যান্ডেল। কেড্স বলতে কাপড়ের, রঙে সাদা অথবা নেভি ব্লু। বাটার অথবা খাদিমের। সে-সময় বাজারে এসেছে এই বেলি কেড্স। সিনেমার কোনো একজন নায়ক নাকি তার বিজ্ঞাপন দিয়েছে। বেশ লম্বা ফিতে। ফিতে ভরার অনেকগুলো ঘর। উঁচু আর নানা বাহারি রং। সামনের দিকে একটু জায়গায় জাল-জাল কাপড়। বেশিরভাগ জায়গায় পাতলা রেকসিন। হাতে ধরে চেপে একেবারে বাঁকানো যায়। ফিতেগুলো অত লম্বা হওয়ায় কেউ কেউ কেড্সের ওপরে ফিতের একটা গেঁড়ো দিয়ে পেছন গোড়ালির দিক থেকে ঘুরিয়েও আনত। যদিও এসব ভঙ্গি একটু পরের। শহরে তখনো বেলি কেড্স আসেনি। টিভিতে টারজানের ফাঁকে বিজ্ঞাপন দেখে, সাত্তার মিয়ার ছেলে সজল সবে বাপের কাছে ঘ্যানোর ঘ্যান শুরু করেছে। সেদিনের ক্লিন শেভড, জামা-প্যান্ট ইন করা আর ঠিকাদারির আয় থেকে এই সিরহিন্দ মার্কেটের নানা পদের দোকানের মালিক হওয়া সাত্তার মিয়া তার একমাত্র পুত্রের ঘ্যানঘ্যানিতে উল্টো পাশের জগৎলালের কাছে জানতে চাইল, ‘ওদা, আছে নাকি বেলি নামের কোনো কেড্স?’ জগৎলাল সাত্তার মিয়ার দিকে চেয়ে হেসেছিল। আশপাশে সব দোকানে রাখে স্পঞ্জের স্যান্ডেল, মোগল হাওয়াই চপ্পল, সেও রাখে, কেড্স বলো আর জুতো বলো তা যা কিছু পাওয়া যায় এই জগৎলালের দোকানেই। কিন্তু জগৎলালের দোকানে নেই বেলি কেডস্; সেও শুনেছে, কোম্পানির লোক এসেছিল এই কেড্সের অর্ডার নেওয়ার জন্য। জগৎলাল তাদের বলেছিল যে, এলাকার লোক এহোনে প্রায় কেউ প্যান্ট পরে না, প্যান্ট পরে ইশ্কুল-কলেজের ছাত্ররা, কেড্সও পরে তারাই, সেই কেড্স ওই বাটার দোকানে পাওয়া যায়, আর তারা রাখে খাদিমের কেড্স, এর ভেতরে অমন প্রায় দশগুণ দামের বেলি কেড্স কিনবে কে? জগৎলাল তাকে আরো বলেছিল, সে ভেবেছে, যদি কেউ কোনোদিন অর্ডার দেয় তাহলে আনবে। তখন সাত্তার মিয়ার পাশে ছিল তার ছেলে সজল। তার বাপের সঙ্গে জগৎলালের এ-কথা শুনে সে আরো আবদার করে, ‘ও আববা, তা’লি আমার জন্যি এক জোড়ার অর্ডার দাও।’

এই কারণে শহরে প্রথম বেলি কেড্স আসে। জগৎলাল তখন চার জোড়া বিভিন্ন সাইজের কেড্সের অর্ডার দেয়। এক জোড়া পাঁচ সাইজ, এক জোড়া সাত সাইজ ও দুই জোড়া ছয়। সজলের পায়ের সাইজ ছয়। তার সুযোগ হলো দুই জোড়া কেড্সের ভেতর থেকে এক জোড়া বেছে নেওয়ার।

সেই প্রায় বিকেলের কথা এখনো অনেকের মনে আছে। শহরের ছেলেরা, যারা তখনো পর্যন্ত কেড্স বলতে বোঝে ইশ্কুলে পায়ে দেওয়ার জুতো, তারা এই প্রথম টিভিতে দেখা বেলি কেড্স দেখল। সেদিন হাটবার। জগৎলালের দোকানের সামনে ছোটখাটো জটলা। সেই জটলায় ধীরগতিতে আসা      দু-একখানা রিকশাও মন্থর হয়। জগৎলাল বলেছিল, গুনে গুনে দিনসাতেক লাগবে আর নয় ছয়দিন। কিন্তু কোনো কারণে একদিন আগেই ঢাকা থেকে লঞ্চে তার চালানের মাল এসেছিল। ওই অবস্থায় সজল দুই জোড়া কেডস্ হাতে নেয়। কাজী নজরুল ইসলাম রোডের অন্য ছেলেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। এত দামি জুতো! চামড়া নেই এমন জুতো! সেই জুতোর এত দাম! দেখতে কি সুন্দর আর বাহারি!

সজল যে খয়েরি জোড়া পছন্দ করেছে, সে জোড়ার দাম চারশো টাকা। সাত্তার মিয়া আর জগৎলাল পরস্পর দরদাম করে। দোকানদার হিসেবে তারা প্রতিবেশী। কতকাল মুখোমুখি রাস্তার এপাশে-ওপাশে দোকানে বসেছে, এখন এই পদের নতুন এক জোড়া জুতোর দাম চারশো! নাকি সাত্তার মিয়ার টাকা আছে তাই জগৎলাল এত দাম চাইল? এমন কথাবার্তার ফাঁকে সজল পায়ের স্যান্ডেল খুলে কেড্স পরেছে। ভেতরে গদি গদি! সে পাশের বন্ধুদের বলে, এই জুতো মনে হয় মোজা দিয়ে পরা লাগবে না। তখন সাত্তার মিয়া শেষ দফারফা করে, জগৎলালকে আবারো দাদা ডেকে বলে, পোনে চাইরশো। জগৎলাল মাথা নাড়ে, ঠিক আছে, ভাইপোর শখ। তারপর সে সজল ও তার সমবেত বন্ধুমহলের উদ্দেশে বলে, ‘ও ভাইপোরা, তোমাগো বন্ধুগো কেউর লাগলি কইয়ো। সবাইরে কইয়ো, পাদুকা বিতানে বিলি কেড্স আছে।’

শহরে বেলি কেড্স আসার সঙ্গে জগৎলালের জীবনের প্রায় কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি এরপর অন্যান্য দোকানে যখন বেলি কেড্স এলো আর সেই কেড্স পরে সরকারি ইশ্কুলের বড় ক্লাসরুমের পেছন দিকে বসা দুষ্টু ছেলেরা কেউ কেউ যখন সমবেতভাবে ফ্লোরে কেড্স ঘষতে লাগল, তখন তাদের শিক্ষক দবিরউদ্দিন বলেছিলেন, ‘ওরে বিলি কেড্স! দোমাইস নে, দোমাইস নে। এই দেখ, ওইয়ে আমার পায়ও এক জোড়া আছে।’ দবিরউদ্দিন খাটো পাঞ্জাবি পরতেন। তার পাজামাও একটু খাটো, কালো মোজা বেশ দেখা যেত। তিনি বেলি কেড্স পরে খুব দ্রুত গতিতে ছাতা মাথায় হাঁটতেন।

ফলে কারো পায়ে বেলি কেড্স দেখলে তখন ছাত্রদের মুখে তাদের দবির স্যারের সংলাপ, ‘দোমাইস নে, দোমাইস নে। বিলি কেড্স, এই দেখ আমার পায়েও এক জোড়া আছে।’ আর এর কিছুদিন আগে টারজানের ফাঁকে বিজ্ঞাপন ও সজলের আবদার এবং সাত্তার মিয়ার তাকে এক জোড়া বেলি কেড্স কিনে দেওয়াই এখন পর্যন্ত জগৎলালকে মনে পড়ার কারণ।

এই জায়গায়, তহশিল অফিসের পাশে নাবিক হোটেলের গলির মুখে দাঁড়ালে, মনে হবে সামনের পাদুকা বিতানে বসে আছে জগৎলাল। তখনো তার বহুমূত্র রোগ শুরু হয়নি, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বারবার দোকানের সামনে থেকে নাবিক হোটেলের গলি ধরে একটু এগিয়ে, ডাইনে নিজের বাসায় যেত। সামনে ছোট্ট আঙিনা। সেখানে নয়নতারা, সাদা কাঠফুল, আশপাশে নিচু ঝুড়ে দেওয়া ডালের জবা ফুলগাছ, তারপর টিনের ছোট্ট তিনচালা। ডাইনে ছোট আর একখানা ঘর। সেটা দোকানের গুদাম। জগৎলালের দোকানখানা ছোট নয়, কিন্তু কোনো কোনো মাল বারবার আনার চেয়ে একসঙ্গে বেশি আনা ভালো। বাসায় ঢুকে সে দেখে মেয়েটা কোথায়, ছেলেটা খেলা থেকে এসেছে কিনা। বউ কতক্ষণ পরে তাকে চা খেতে ডাকবে। ততক্ষণে জগৎলাল মনে করেছিল তার প্রস্রাবের বেগ এসেছে, তাই এসেছিল, কিন্তু বাসায় ঢুকে সেসব নেই। আবার মনে হয়, দোকানেই যাওয়া ভালো। সে চা খাওয়ার কথা বলে চলে যাবে ভাবে। এই সময়, কী ভেবে সে বলে বউকে, ‘নাগেরবাজারের বাসা থেকে কোনো খবর দিয়ে গেছে তোমারে?’ কী খবর? কিছুই জানে না জগৎলালের বউ মহামায়া। জগৎলাল, বউয়ের চাহনিতে কী বুঝল কে জানে, তারপর বলল, ‘আর ভালো লাগে না, যতসব ঝামেলা।’

বাসা আর বাড়ির একটা তফাৎ আছে। তাদের ফতেপুরের বসতভিটাকে তারা বলে বাড়ি। সেটা নদীর ওপার, এই জায়গা থেকে মাইল চারেক পথ। সেখানেই তাদের মলঙ্গিবাড়ি। আসলে এক সময় মলঙ্গিরা কচুয়ার টেংরাখালী ও মঘিয়ার কাছের বলেশ্বর নদের ওপরে চালিতাখালীতে এসে উঠেছিল। সে-কথা বহু বহুদিন আগের। কতদিন আগের আজ জগৎলাল কোনোভাবেই গুনে-গেঁথে বলতে পারবে না। তার ঠাকুরদার ঠাকুরদা কি তার ঠাকুরদা? কিন্তু সেই চালিতাখালীতে বলেশ্বরের বাঁকে একটা চর পড়লে, সেই চরেরও নাম হয় মলঙ্গিরচর। ততদিনে তাদের হাতে আর লবণের বাণিজ্য না থাকায়, ধীরে ধীরে পরিবারের মানুষজন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেতে থাকে। কেউ চালিতাখালীর সদর থানা নাজিরপুরে, কেউ নাজিরপুরের মহকুমা সদর পিরোজপুরের দিকে যায়। কেউ আসে নদীর এপার বাগেরহাটের দিকে, তাদের কথায় পশ্চিম দিকে। জগৎলালের বাবা আসে ফতেপুর। বাগেরহাট পিরোজপুর রাস্তার কোলে। এখানে আসার সুবিধা ছিল এই : চালিতাখালী কাছে, আবার তার ছোটভাই যে পিরোজপুরে নতুন বাসা করেছে, তার বাড়িও মাইল দশেকের মাথায়। তখন থেকে তাদের কাছে এই চালিতাখালীর বাড়িটাই বাড়ি। বাকি সব বাসা। তারপর তারা তিন ভাই আরো পশ্চিমে বাগেরহাট শহরে আসে। একজন বাসাবাটি, একজন আমলাপাড়া আর সে প্রায় বাজারের কাছে কাজী নজরুল ইসলাম রোডে জায়গা কেনে। তখনো বাড়ি চালিতাখালী। বহুদিনই তাই। এমনকি এখনো সেই চালিতাখালীতে মলঙ্গিদের প্রায় কেউ না থাকলেও, চালিতাখালীর বাড়িই বাড়ি।

ছোট ভাই সমরেন্দ্রর বাসা থেকে কোনো খবর এসেছে কিনা মহামায়ার কাছে তাই জানতে চেয়েছে জগৎলাল। খবরটা কী মহামায়া জানে না। খবরটা কেন মহামায়ার কাছেই আসবে, তাও মহামায়া জানে না। তবে মহামায়া জানে, আসলে জগৎলাল এতক্ষণ ধরে দোকানে, দোকানের প্রায় সামনের দিকে একখানা টুলে বসে ঝিমিয়েছে, কাপুড়েপট্টির দিকে খেয়াল করেনি। যদি সেই দিক থেকে কেউ এসে, দোকানের সামনে তাকে না খুঁজে বাসায় এসে থাকে? এমন কেউ এসেছে কিনা সে সংবাদ নিতে এসেছে সে। মহামায়া জানে না কে আসবে। নিশ্চয় সমরেন্দ্র। কী সব বিষয়ে গত কিছুদিন ধরে দুজনে আলাপ করে তারাই জানে। সমরেন্দ্র অনেক বুঝমান মানুষ। নিশ্চয়ই এমন কোনো বিষয়, যা তাকে বলতে চায় না।

কিন্তু মহামায়া যা-ই ভাবুক, জগৎলালের ঝিমুনি কাটে না। এমনকি জগৎলালের এই ঝিমুনির মাত্রা যখন বাড়ে তখন ছেলেমেয়ে দুটোও কেমন যেন গুটিয়ে যায়। গোটানোটা অবশ্য জ্যোতির্ময়ের ভেতরে সবসময়ই ছিল। সে তুলনায় তাদের মেয়ে জয়া বেশ চটপটে। এই চটপটে ভাব নিয়ে মহামায়ার কোনো সমস্যা নেই, মেয়েমানুষ চোখ-কান খোলা রাখা স্বভাবের হওয়া ভালো। কিন্তু এমন স্বভাব নিয়ে সমস্যা মেয়ের বাপ জগৎলালের। বলবে, ‘মাইয়েডারে অত বাড়তি দিয়ো না। বাইরোইয়ে যাবে।’ কী কথা! বাপের মুখে এই কথা মানায়? ইশ্কুলের হয়ে কোনো না কোনো প্রতিযোগিতায় কী পুরস্কার পেয়েছে, সে-জন্য গিয়েছিল রণবিজয়পুর উপজেলা অফিসে, সেখানে প্রতিযোগিতা হয়েছে, এ নিয়ে জগৎলালের গজরানি। কিন্তু মেয়েকে সে কিছু বলবে না। বলে না মহামায়াও। শুধু মেয়ে সেই প্রতিযোগিতার পুরস্কার বাপকে দেখালে জগৎলাল মুখে মুখে খুশির ভাব করে, আর মহামায়া ও জ্যোতির্ময়কে শুনিয়ে বলে, ‘এইয়ে দিয়ে হবে কী? এই দেশে থাকতি তো পারব না। সব লইয়ে যাবে মেয়ারা! এয়া কইরে লাভ?’

জ্যোতির্ময় তখন ক্লাস নাইনে। জয়া সেভেনে। জ্যোতির্ময় বোঝে না, বাবা এসব কী বলে? তবে ভেতর-বাইরে মিলে তার মনে হয়, বাবা একেবারে ভুলও বলেনি। তার বোনটা যখন বেণি দুলিয়ে ইশ্কুলে যায়, তখন তার কেন জানি মনে হয়, এ-পাড়ার সব লোক তাকিয়ে দেখছে। অথচ রাফিয়াকে প্রায় কেউ দেখে না, কাজিবাড়ির মেয়ে! জ্যোতির্ময়ের মনে হয়, রাফিয়ার দিকে সবার তাকাতে ভয় হয় আর জয়াকে সবাই দেখে। অথচ মহামায়া এসব কিছুই যেন বোঝে না। ভাবে, কার হাতে না কার হাতে পড়বে মাইয়ে। তার আগে ভালো করে লেখাপড়া শিখুক, একটু চটপটে হোক, মাস্টার-পন্ডিতরা ভালো বলুক, আবৃত্তি শিখুক, গান গাইতে জানুক, গানের ইশ্কুলে যাক, বক্তৃতা দিয়ে পুরস্কার আনুক, ডিবেট করুক।

এসব মহামায়ার জানা আর ভালো লাগার কারণ আমলাপাড়ার ভাসুরঝি ও ভাসুরপো যথাক্রমে শুক্লা-চিন্ময়। চিন্ময় এক কথায় অলস্কয়ার। পড়াশোনায় ভালো। নাটক করে। আবৃত্তি করে। মানুষজন বলে, তারপরও ও ছেলে স্ট্যান্ডও করল! ওসবে কিছু আটকাল? ওদিকে শুক্লা ম্যাট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন, আইএসসিতেও তাই পাবে। সে মেয়ে যা রবীন্দ্রসংগীত গায়। আর চলাফেরা দেখেই মনে হয়, একদিন সত্যিকারের মানুষ হবে। কিন্তু এসব দেখেও মহামায়া জগৎলালের জন্য মেয়ের কোনো কিছুতে বাতাস দিতে পারে না। বরং একদিন হঠাৎ দোকান থেকে এসে মহামায়াকে শোনায়, ‘শুনিচো, ওই নাগেরবাজারের উপেন বিশ্বাসের মাইয়েডা এক মেয়া ছেমড়ার সাথে বাইরোইয়ে গেইচে!’

মহামায়া চুলোর ওপর ভাতের হাঁড়িতে হাতা দিচ্ছিল। শুনে তার হাত থেমে যায়। মেয়েটার মুখ তার মনে পড়ে না। বছরপাঁচেক আগে হরিসভা মন্দিরে কীর্তন শুনতে গিয়ে ওই মেয়ে শেষ দেখেছিল, তখন ফাইভে না সিক্সে পড়ত। কিন্তু তার মনে পড়ে, উপেন বিশ্বাসের বউয়ের শ্যামলা মুখখানা। মেয়েটা কলেজে পড়ত? নাকি এখনো ইশ্কুলে? কোন ইশ্কুলে? গার্লস ইশ্কুল? বাগেরহাট ইশ্কুলে? আমলাপাড়া ইশ্কুলে? নাকি জাহানাবাদে? যদি কলেজে পড়ত তো কোনটায়? গার্লসে না পিসি কলেজে? গেলে কোথাকার কোন ছেলের সঙ্গে গেল? কিন্তু সেসব শোনার আগেই জগৎলালের গলা আরো কর্কশ হয়ে ঢুকে পড়ে, ‘যাবি তো যাবি – গেইচে এক মস্তানের সঙ্গে। এরশাদ গেইচে পরদে দেশে যে এহোন কত পদের মস্তান গজাতিচে!’

মহামায়া জানে, এরশাদকে পছন্দ জগৎলালের। তার কারণ নাগেরবাজারের দেওর সমরেনদ্র। সমরেন্দ্র জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়ার পর কতদিন যে এরশাদের গুণকীর্তন গাইচে। এরশাদ যেন শ্রীচৈতন্য! পারে তো তারে নিয়ে একেবারে কীর্তন গায়।

‘কোনহানের মস্তানের সাতে গেইচে?’

‘ডেমা না কোন জায়গার।’

‘ও বাবা, মাইয়ে ডেমার ছওয়ালের সাতে লাইন লাগাল কোয়ানদে?’

মহামায়ার প্রশ্নের উত্তর চেয়ে তখন জগৎলালের সাবধান বাণী দেওয়া বেশি জরুরি, ‘শোনো, মাইয়েডারে সাবধানে রাইহো, বড় হইচে। তারপর এই প্রায় বাজারের মদ্যি আমাগো বাসা।’

মহামায়ার বুকে হাপরের বাড়ি পড়ে। উপেন বিশ্বাসের বউয়ের জায়গায় নিজেকে দেখে, সেই মেয়েটির জায়গায় জয়াকে। আর এক এক করে ভাবে, তাহলে কি নিজের মেয়েটাকে আর বাইরে যেতে দেবে না? এত গুণী মেয়ে তার। কোথাকার কী কী সমস্ত সংবাদ আসে, সেই সংবাদে ওর জীবন এভাবে উল্টে-পাল্টে যাবে।

এদিকে জ্যোতির্ময় যেন জগৎলালের চেয়ে এক কাঠি সরেস। জয়ার চলন তার পছন্দ হয় না, ইশকুল ছাড়া বাইরে গেলে তা নিয়ে গলা তোলে। মাঝেমধ্যে কাপুড়েপট্টির অধীর সাহার মেয়ের কাছে যায়, তাও ভালো চোখে দেখে না। আর গান গাওয়াও না? বাসার এত কাছে শুকলাল সংগীত বিদ্যাপীঠ, সেখানে মেয়েটা গেলে হবে কী? তাও এক শুক্রবার বলে, ওসব বাদ দিতে হবে।

 

দুই

আসল কারণ অবশ্য ভিন্ন। মহামায়া দিনমান বাড়িতে, সবকিছু জানে না। কিন্তু জগৎলাল জানে, সমরেন্দ্র ঠিক করেছে তার ছেলেটাকে ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দেবে। হঠাৎ, কেন এই সিদ্ধান্ত তা অবশ্য জানে না জগৎলাল। হয়তো সমরেন্দ্র রাজনৈতিক কারণে একটু সমস্যায় আছে। এরশাদ গদি থেকে নামার পরে প্রথমে কিছুদিন সমরেন্দ্র পালিয়ে ছিল। চালিতাখালী গেলেই সুবিধা, বিশাল চরের পরে সে গ্রাম, আবার অন্য জেলা। সেখানে          বাপ-দাদার ভিটায় সমরেন্দ্র কেন কী কাজে এসেছে, কেউ ডেকে জিজ্ঞাসা করারও নেই। কিন্তু তার নাগেরবাজারের বাড়িতে থাকে বউ আর ছেলে, সেখানে মাঝেমধ্যে সমরের খোঁজে আসে সব দলের লোকজন। তারা এরশাদকে গদি দিয়ে নামিয়েছে, সমরেন্দ্র জাতীয় পার্টি করত, ও সময়ে কন্ট্রাক্টরি করে পয়সাপাতি কম কামায়নি, এখন তার কিছু ভাগ চায়। ওদিকে সমরেন্দ্রর ছেলে সমীর জ্যোতির্ময়ের ঠিক উল্টো। প্রায়শ ঘরে থাকে না। খেলে বেড়ায়। ফুটবলের সময় ফুটবল, ক্রিকেটের সময় ক্রিকেট। সারাদিন ক্রিকেট খেলে সন্ধ্যারাতে ব্যাডমিন্টন। সব খেলায় আছে। তাকে এমনিতে কেউ কিছু বলেনি। তবে মাঝেমধ্যে ওর কাছে জানতে চাইত, ‘ও ভাইপো, তোমার বাবারে দেকতিচি না, গেইচে কোথায়?’ সমীর বলত, সে জানে না। সমীর আসলেই হয়তো জানত না তার বাপ কোথায়। অথবা, জানত যে বাবা এখন চালিতাখালী, কিন্তু মা তাকে বলতে মানা করেছে। অথবা, সে জানেই না চালিতাখালী না কোনো কাজে ঢাকা অথবা অন্য কোথাও গেছে। যেখানেই থাক, সমীর মায়ের নির্দেশমতো একটু চুপ করে থাকত। অথবা বলত, মনে হয় বাড়ি গেইছে। বাড়ি যাওয়ার কথা সে আগেও বলেছে। কিন্তু তার জবাবে একদিন তাকে শুনতে হলো, ‘নাকি ইন্ডিয়ায় চইলে গেইচে? হিন্দগো তো আচে ওই একটা জায়গা, আর যাবে কোয়ানে?’

সমীর সে-কথা মাকে বলে। সেখান থেকে শোনে মহামায়া। মহামায়ার কাছ থেকে কথায় কথায় জানতে পারে জগৎলাল। জানার কথা। জগৎলাল এমন কথা জানে। কেউ কেউ তাকে ঝিমাতে দেখে বলেওছে, ‘দাদা কি দোকান-টোকান আর করবেন না? এহোন খালি দোকানের সামনে বইসে ঝিমোন!’

জগৎলালের তাতে ঝিমোনো ভাব কিছুটা কাটে। ভাবে, সমরেন্দ্র কাছে থাকলে বল-ভরসা পেত। অন্য ভাই অমরেন্দ্র ব্যাংকে চাকরি করে। তার বউটা প্রাইমারি ইশ্কুলে পড়ায়। আছে ভালো। কিন্তু সমরেন্দ্রটা হঠাৎ যে কেন এমন পোতইয়ে (মিইয়ে) গেল!

উত্তরে জগৎলাল ঝিমোনি কাটিয়ে বলল, ‘এই তো আমার শরীরডা ভালো যায় না। নানা রোগ-শোক আছে। এই দেহো, ডায়বেটিস মনে হয় বাধল। কিছুই ভালো লাগে না।’

‘না, ক’লাম কী – যদি এই দোকান না করেন তো জানাইয়েন। আপনি দোকান করলি কী আর না করলি কী – বাড়ি যে জায়গা-সম্পত্তি আছে, ওইয়ে দিয়ে তিন পুরুষ খাইয়ে বাঁচতি পারবেন।’

‘না করব করব। ছওয়ালডা এট্টু বড় হোক।’

‘আসলে, এই শহরে আপনিই প্রথম বেলি কেড্স আনিলেন মনে আছে। তহোন সবাই বেচে মোগল হাওয়াই চপ্পল! আপনার সে কী রমরমা অবস্থা!’

‘ছওয়ালডাও তাই কয়। ওরে ক’লাম, তুই বড় হইয়ে আবার কর, ওই বাটার দোকানের মতন দোকান সাজাবি!’

‘হয়, কী যে কন! আইজকাইলকার ছওয়াল-পওয়াল – ওই আসপেনে জুতো বেচতি? কী যে কন?’

‘তাও ঠিক। দেহি।’

‘আর আপনাগো ছওয়াল, ওয়াতো এট্টু বড় হলি পাঠাইয়ে দেবেন ইন্ডিয়া!’

শুনে, ঝিমোনো জগৎলাল আড়মোড়া ভাঙে। বক্তার দিকে তাকায়। তাহলে রশিদ মল্লিককে দিয়ে একথা বলতে সাত্তার পাঠাল না তো? সাত্তার কাজিদের কাছে থেকে সামনের জায়গা কিনে মার্কেট বানিয়েছে। এখন এ-পাশের জায়গাগুলোও কিনতে চায়। পেছনের জায়গা না কিনুক, সামনের দোকানগুলো তো কিনতে পারে। এই পাদুকা বিতান ও এর পরের বাঁধাইখানাটাও জগৎলালের জায়গায়, তারপরের জায়গাটা দেপাড়ার অজিয়ার মেয়ার। তার দুই ছেলে বিদেশে, মেয়েটা অফিসার, সেও এই জায়গা বেচে দিয়ে ঢাকা চলে যেতে পারে। তাতে সাত্তারের সুবিধা। তারপর?

তারপর আর এখন ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। এরা সব খোঁজ রাখে। সমরেন্দ্র বাসাছাড়া। ওদিকে অমরেন্দ্রও তার মেয়েটাকে ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দেবে ঠিক করেছে। ফলে ওই মুহূর্তে ওইসব কথা বলতে বলতে যেন জগৎলালের ঝিমোনি আসে অথবা সে আপসে ঝিমোনিতে তলিয়ে যায়। কেননা এইদিন অথবা এর এক-দুদিন বাদে যখন সমীরকে নাগেরবাজারের ছেলেরা কী বলেছে, সেসব নিয়ে তারা কথা বলছিল তখন জ্যোতির্ময় বলল, ‘মা জানো, চিন্ময়দা এবার ড্রপ দিচে!’

মহামায়া ড্রপ বোঝে না। জয়া বোঝে। তবে মহামায়া এটুকু বুঝল, অমরেন্দ্রর ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো কাজ করেছে যে, কাজটা ভালো না। সে জানার জন্য জিজ্ঞাসা করল, ‘চিন্ময় কী করিচে? কোথায়? ঢাকায়?’

এর ভেতরে জয়া জানতে চাইল, ‘এদা, চিনি-ময়দা কী করিচে?’ চিন্ময়কে তারা চিনি-ময়দা বলে।

জ্যোতির্ময় বলল, ‘ড্রপ দিচে। ফার্স্ট ইয়ার দে সেকেন্ড ইয়ারে উঠিনি। ইশ্কুলের মাঠে বড় ভাইরা কচ্ছিল শুনিচি। মনে হয় অমরকাকু জানে না।’

‘ওরে জানে জানে, অমরের মতো চাপা মানুষ।’

‘না মা জানে না। চিন্ময়দা নাকি গোপনে ইন্ডিয়ায় গেইচে আবার আইচে – এহোন নাকি ইন্ডিয়ায় যাইয়ে নাইনে ভর্তি হবে!’

‘কইস কী? ঢাকা ভার্সিটিতে আইআর না কী কয় ওইতে পড়ে!’

‘হয়।’ জয়া বলল, ‘শুনিচি আইয়ারে পড়লি ফরেন অ্যাফেয়ার্সে যাওয়া যায়, রাষ্ট্রদূত।’

‘খাইয়ে কাজ নেই, বাংলাদেশে নোমোগো ছ’লরে দেবেনে ফরেন অ্যাফেয়ার্সের চাকরি?’

জয়া চুপ। এইটুকু মানুষ সে। জ্যোতির্ময়ও তাই। তারপরও জয়া যাদের সঙ্গে গান শেখে, গান গায়, আবৃত্তি করে, তাদের কারো কাছ থেকে এমন আচরণ পায়নি। তাও একদিন কথায় কথায় সে বললে জ্যোতির্ময় একটু গলা তোলে, ‘ক’দিন তো ওই সারেগামাপাধানিসায় কয়জন হিন্দু আর কয়জন মুসলমান – আমি তো দেখি সব হিন্দু। আর হিন্দুঘরের মাইয়েগুলোন আসে, সেই জন্যি কতগুলোন লোক বইসে তোগো চাইরধারে নিয়ে সখী করে। খেড়ুর বাল সব।’

‘দাদা, ভালোভাবে কথা কইস! স্যাররা আছে, কত ভালো মানুষ। মুক্তিযোদ্ধারা আছে, সব মানুষ খারাপ নাকি?’

‘কী রে তুই দেখি জ্ঞানী হইচিস!’

মহামায়া জানতে চাইল, ‘খোকা, চিন্ময় তা’লি চইলে যাবে?’

‘যাবে মানে মা, গেইচে দেইহো।’

‘দেখি অমরেন্দ্র ঠাকুরপোর ধারে জিগোইয়ে। কাইল আমার আমলাপাড়ায় বাসায় যাওয়ার কথা আছে। জিগোবানে (জিজ্ঞাসা করব)।’

‘জিগোইয়ো, তয় অমরকাকু তোমারে কবেনানে কিছু কইয়ে দেলাম। আর চিনি-ময়দা যে চালাক মানুষ। কেউরে জানতি দেবে? এইহেনদে ঢাকা যাওয়ার কতা কইয়ে চইলে যাবে ইন্ডিয়া।’

হয়তো তেমন কোনো সংবাদের জন্যই জগৎলাল ভেতরে এসেছিল। সত্যি নাগেরবাজার থেকে কোনো খবর এসেছে কিনা? নাগেরবাজারের খবর মানে কী? মহামায়া জানে না।

কিন্তু সেইদিন তো ভালো, তার পরদিন তার পরদিন করে প্রায় মাসখানেকের ভেতরে সমরেন্দ্রর কোনো খবর আসে না। ফতেপুরের বাড়িতে ফাঁকে একবার যায় জগৎলাল, কিন্তু সেখানে জ্ঞাতিরা সমরেন্দ্রর কোনো খবর জানে না। কেউ জানায়, পিরোজপুরে তাদের জ্ঞাতিভাই শুভ্রাংশুর বাসায় ছিল। রাজনৈতিক অবস্থা ভালো হলে আসবে। এদিকে খবর পায়, সমরেন্দ্রর বউ খুলনায় তার ভাইয়ের বাসায় গেছে। সেখান থেকে মাঝখানে একদিন রাতে তাদের বাসায় এসেছিল। পরদিন খুব সকালে উঠে গেছে নাগেরবাজার, তারপর নয়টার ট্রেনে আবার চলে গেছে খুলনা। সমীর কোথায় জিজ্ঞেস করলে শোনে, সমীরকে খুলনায় তার ভাইয়ের বাসায় রেখেছে।

এসব সংবাদের ফাঁক গলে একদিন জগৎলাল জানতে পারে, সমরেন্দ্র ইন্ডিয়ায় গেছে। সমীরকে তারা আগেই পাঠিয়েছে।  যে-কোনোদিন যাবে সমরেন্দ্রর বউ। তার ভাই তাকে নিয়ে যাবে। তবে সমরেন্দ্র পাসপোর্টে গেছে। ছেলেটাকে ঠাকুরপুকুর না কোথায় ক্লাস এইটে ভর্তি করিয়েছে। নাগেরবাজারের জায়গাজমি যা যা বিক্রি করতে বাকি, সেগুলো পরে এসে বেচবে। আপাতত রাজনৈতিক অবস্থা অনুকূলে নয়। এ নিয়ে অবশ্য মহামায়া কিছুই বলে না। শুধু ফাঁকে ফাঁকে জগৎলালকে শুধায়, ‘কি তোমার পেয়ারের লাঙলমার্কা কইরে সমর ঠাকুরপো দেশ ছাড়ল?’

জগৎলালের ঝিমোনির ভাব থাকলে ঝিমায়। কোনো উত্তর দেয় না। আর ঝিমোনি না থাকলে বলে, ‘লাঙলমার্কা লোঙল মার্কা না, এমনিতেই এই দেশে থাকা যাবে না।’

‘তুমি তয় এই জন্যি ব্যবসা গুটোইয়ে ফেলাতিচো?’

জগৎলাল কথা বলে না। মহামায়া আজো লোকটাকে বুঝতে পারল না। এই লোকটাকে চেনা সত্যি ভগবানেরও অসাধ্য। নাকি ভগবান এমন মানুষ এই একখানা বানাইচে, যে তার বউয়ের কাছেও সারাটা জীবন অপরিচিত থেকে যাবে!

এই সমস্ত দিন জগৎলালের জন্য বড় অনিশ্চয়তার। হয়তো এই সমস্ত দিনের কোনো এক সময়ে সে বারবার নাবিক হোটেলের গলি দিয়ে বাড়ি আসছিল আর মহামায়াকে জিজ্ঞেস করেছিল নাগেরবাজারের কোনো খবর আছে কিনা। মহামায়ার কাছে বারবার এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার কারণ আছে। সমরেন্দ্র বয়সে তার অনেক ছোট, তার বউ পূর্বা সাধারণত তার সঙ্গে কথা বলে না। যে খবরটা জানতে চায় জগৎলাল, সেটা পূর্বা মহামায়ার কাছেই দেবে। অথবা এসে জানতে বলবে, ‘ও বড়দি, দাদা কোথায়, দাদাকে এট্টা খবর দেয়ার আছে।’

কিন্তু সমরেন্দ্রর কাছে থেকে কোনো খবর আসেনি। আসেনি সমরেন্দ্রর বউ। ওদিকে মহামায়া জগৎলালের এই উতল-হওয়া ভাব দেখে একবার তার কাছে জানতে চায়, ‘কোনো বিশেষ খবর আছে?’

চাপা স্বভাবের মানুষ জগৎলাল। সোজা কথায় এভাবে মহামায়াকে কিছু বলবে না। বলার কথাও না। কেননা, জগৎলাল মনে করে, মহামায়াকে কোনো কথা না বলাই ভালো। পেটপাতলা মেয়েমানুষ। তাছাড়া মেয়ে অন্তপ্রাণ, সব কথাই মেয়েকে বলে দেয়। একথা বললে তাও মেয়েকে বলবে না, তাই-বা নিশ্চয়তা কী।

এদিকে জয়া আর জ্যোতির্ময় যা জেনেছিল, তা সত্যি, চিন্ময় ইন্ডিয়া চলে গেছে। সমীর তাদের চিঠি লিখে জানিয়েছে। এখন তারা ভাবে, কোনদিন না কোনদিন শুক্লাও চলে যায়। তবে জয়ার কেন যেন মনে হয়, শুক্লার যাওয়া ঠিক হবে না। শুক্লা এখানে থাকলে, চিন্ময়দার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে। রেডিয়ো-টিভিতে গান গাইতে পারবে। অমন গুণী মেয়ে হয় না।

দিন কয়েকের ভেতরেই জগৎলালের জানতে চাওয়ার সেই সংবাদটা আসে। সংবাদটা মহামায়ার কাছে আসেনি; আসেনি জগৎলালের কাছেও। সংবাদটা নিয়ে এসেছে জ্যোতির্ময়। জ্যোতির্ময়কে বলেছে তাদের ছোটকাকি পূর্বা, ‘তোর মারে কইস, ধীরে ধীরে জয়ারে বুঝোতি।’

‘কেন, ও কাকিমা, জয়ার হইচে কী?’

‘তোর মারে কইস, আমি এট্টু ফতেপুরের বাড়ির দিক যাব। সেইখেনদে আইসে একবার যাবানে তোগো বাসায়।’

‘আচ্ছা। জয়ারে কইস শুক্লাও যাবে। আমি সব ঠিক কইরে রাইখে আইচি।’

‘কী?’

‘ক’লাম তো তোর মারে কইস।’

পূর্বা ভেবেছিল, মহামায়া সবই জানে। কিন্তু তার বড় ভাসুর ঠাকুর জগৎলাল যে-কোনো কথাই কাউকে বলে না, সারাটা দিন বসে বসে ঝিমোয় আর সেই ঝিমোনি নিয়ে কথা বললেও মহামায়াকে ঝাড়ি মারে, তা সে জানবে কীভাবে। গুনে গুনে তিনদিন সে জীবনে জগৎলালের সঙ্গে কথা বলেনি। জানে মানুষটা নিরীহ। ওদিকে সমরেন্দ্রর মতন অমন স্বামী যার, জগৎ একাই উল্টে ফেলে, তার স্ত্রীর কোথাও তিষ্ঠোনোর উপায় আছে? সে মনে করে, সমরেন্দ্রর কারণেই তাদের এই দশা। ফতেপুরের লোকজনের সঙ্গে লাঙলমার্কার পেছনে দৌড়োইয়ে নিজের জীবনডা এইভাবে শেষ করল। বাপের করে দেয়া বাড়িঘর সবই প্রায় জলের দরে বিক্রি করে এখন যাও ইন্ডিয়ায়। ইন্ডিয়ায় যে কোন মধু আছে! পূর্বা এসব ভাবতেই পারে। তার বাপ-ভাই থাকে খুলনায়, বোনদের বিয়ে হয়েছে খুলনায় ও যশোরে, ছোটবেলা কেটেছে তার খুলনা শহরে। এখন সমরেন্দ্রর কারণে তাকে এইসব ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে।

জ্যোতির্ময় এসে মহামায়াকে বলল, ‘ওমা, ছোটকাকি ক’ল, জয়ারে বুঝোতি। আর শুক্লাও যাবে। কী বুঝোতি, কোথায় যাবে?’

মহামায়া আকাশ থেকে পড়েনি। পূর্বার ওই কথার কিছুটা হলেও সে বুঝতে পেরেছে। আগে জগৎলাল সরাসরি তাকে কিছুই বলেনি। উপেন বিশ্বাসের মেয়েটা একটি মুসলমান ছেলের সঙ্গে চলে যাওয়ার পর ঠারেঠারে বুঝিয়েছে, এই দেশে মেয়েটাকে আর রাখা যাবে না। কিন্তু তার মানে তো এই নয়, একেবারে সব পাকাপাকি করার পর মহামায়ার জানতে হবে। মহামায়া জ্যোতির্ময়ের কাছে কোনো বিস্ময় প্রকাশ করে না। আবার এমন ভাবও করে না যে সে সবই জানে, ‘দেখি তোর বাবার কাছে জিজ্ঞাসা করে। কেন তুই তোর বাবারে কিছু জিজ্ঞাসা করিসনি?’

‘না, ছোটকাকি তো তোমারে ক’তি ক’ল।’

‘ও, দেহি তোর বাবা আসুক। জিগোইয়ে দেকপানে।’

এবার, এই প্রায় এক মাসব্যাপী প্রায় প্রতিদিন অন্তত বারতিনেক বাড়ির ভেতরে ঢুকে জগৎলালের জানতে চাওয়ার শেষবার। জগৎলাল যেন ভেবে রেখেছিল, এই শেষ, একথা আর মহামায়ার কাছে জানতে চাইবে না, ছোটবউ কোনো খবর দিয়েছে কিনা? অথবা, নাগেরবাজারের কোনো খবর আছে কিনা? আসলে জগৎলালের এই জানতে চাওয়ার ভেতরে একটা ছল ছিল। মহামায়া যদি জানতে চাইত নাগেরবাজারের খবর মানে কী? তাহলে বলত, সমরেন্দ্রর খবর। আবার মহামায়াও ভেবেছিল, এ সময় নাগেরবাজারের খবর মানে সমরেন্দ্র আর পূর্বার খবর। তাই সেও কখনো ভাঙিয়ে জানতে চায়নি।

জগৎলাল মহামায়ার কাছে জানতে চাইল, ‘আছে নাগেরবাজারের কোনো খবর?’

অবশ্য তার আগেই নাবিক হোটেলের কোনা থেকে জগৎলালের মুখখানা ও শরীর বাড়ির ভেতরের দিকে ঢুকতে ঢুকতে জানার জন্য যে প্রস্ত্ততি নিয়েই ছিল, তাই বুঝে জগৎলাল বাড়িতে ঢুকে জানতে চাওয়ার আগেই মহামায়া শুধু বলল, ‘আছে’।

‘কী, ছোটবউ আইচেল?’

‘না, ছোটবউর সঙ্গে খোকার আমলাপাড়ায় দেহা হইল। ছোটবউ শুক্লাগো বাসারদে বাইরোতি ছেল, তহোন কইচে।’

‘কী কইচে?’

‘জানি না। তুমি যে কী? আমার ধারে কিছুই কও না!’

‘আহা কও না?’

‘কইচে জয়ারে বুঝোতি, শুক্লাও যাবে। সমরেন্দ্র ঠাকুরপো সব ব্যবস্থা কইরে রাখিছে, কোনো অসুবিধা হবে না।

‘তাই নাকি?’

এ-সময় ঘর থেকে তেরছা হয়ে-পড়া আলোয় পায়ে পায়ে জ্যোতির্ময় আসে। ঘাড় নিচু। পূর্বার কাছ থেকে ওকথা শোনার পর থেকে সে জয়ার কাছে কাছে। মহামায়া এটা লক্ষ করেছে। জয়ার পাশ থেকে ওই তেরছা আলো বেয়ে জ্যোতির্ময় হেঁটে আসতে আসতে জগৎলালের সামনে ঘাড় না তোলা জ্যোতির্ময় এ মুহূর্তে একটু ঘাড় তুলেই বলে, ‘ছোটকাকি কী কল, ও বা?’

‘ওই তো কইচে’ –

‘মার ধারেও এট্টু জিগোলা না? ওরে ওইরম একলা একলা পাঠাইয়ে দেবা! চইলে যাবে?’

‘একলা কোথায়? চিন্ময় আছে, সমীর গেইচে, শুক্লা আর ও একসাতে যাবে। আর এই জিগোইয়ে হবেডা কী? মনে চা’লি কি একদিনে পাঠানো যায়। কোনোতায় কোনোকিছু জোগাড় না কইরে জানাই কীভাবে?’

‘সেই জন্যি তুমি আমারেও কিছু কবা না?’ মহামায়া নিচু গলায় বলে। গলা যেন কোনোভাবে জয়ার কাছে না পৌঁছোয়।

‘এইয়ে ক’তি হয় না। দেহিস, তারপরও কয়দিনের মদ্যি মানষি জাইনে যাবে। এই যে সমরেন্দ্র চইলে গেল, গেল তো চাইলিতাখালী – তারপর সেইহেনদে যে চইলে গেইচে ওপার, তাও মানুষ জাইনে গেইচে। ছোটবউ যতই আসুক যাক, মাইনষে জানবে, যাগো ধারে জমি জায়গা বাড়ি বেচি তারাওবা কয়দিন কথা চাইপে রাকপে!’

জ্যোতির্ময় চুপ। মহামায়া অন্ধকারে আবারো প্রায় অপরিচিত জগৎলালকে দেখল।

 

তিন

জ্যোতির্ময়ও আর পারতপক্ষে মাথা তোলে না। রাস্তার একপাশ থেকে হাঁটে। কেউ কেউ তার কাছে জানতে চায়, জয়ারে দেখে না কেন? জ্যোতির্ময় বলে, তার ছোটকাকির সঙ্গে খুলনা থাকে। জয়ারে খুলনা করোনেশন গার্লস স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে।

সামনে মার্কেটের সাত্তার মিয়ার ছেলে সজল একদিন তার বোন সুপ্তির কথা বলে জগৎলালের কাছে জানতে চায়, ‘ও কাকা, আমাগো বুন্ডি ক’ল জয়া নাকি আর ইস্কুলে যায় না! কেন?’

জগৎলালের ঝিমুনি বেড়েছে। সেই অবস্থা থেকে চোখ তুলে সজলকে দেখে। সজল এখন আর বেলি কেড্স পরে না। তার পায়ে রিব্ক। সাত্তার মিয়া বলেছিল, ওয়াসিম আকরাম নাকি বাংলাদেশে এসে রিবক কেড্সের শোরুম উদ্বোধন করেছে। এক এক জোড়া কেড্সের দাম ছয়-সাত হাজার টাকা।

সজলের পায়ে রিব্ক। ঝিমুনি চোখে জগৎলাল মাথা তুলে তাকায় না। সে বলে, ‘ওই তো খুলনোয় গেইচে, খুলনোয় পড়ে।’

সজল জানতে চায়, ‘কী করোনেশনে?’

জগৎলাল বলে, ‘হয়?’

‘তা গার্লস ইস্কুলদে টিসি নিয়ে যায়নি, করোনেশন তো সরকারি ইস্কুল, সেইহেনে ভর্তি হতি দেল?’

জগৎলাল চুপ। চোখে ঝিমুনি। মিনমিন করে বলে, ‘ওই আমার ভাইর বউ কীভাবে না কীভাবে কায়দা করিচে?’

জগৎলালের কথা বলায় অনিচ্ছা আর চোখের ওই ঝিমুনি দেখে সজল সরে যায়। সজল সরে কোনোদিকে গেল তাই দেখতে জগৎলাল চোখ খোলে। তার মনে হয়, সজল তার বাপের হয়ে যা জানার জানতে এসেছিল।

এদিকে জয়ার চলে যাওয়ার পরে জ্যোতির্ময় অস্থির। ইশকুলে যায়, কিন্তু রাস্তার এক পাশে দিয়ে যেন কেউ তারে দেখছে না অথবা সবাই তারে দেখতে পারছে, এখনই জয়ার কথা জিজ্ঞাসা করবে। জয়ার ইশকুলের পরে আরো প্রায় পৌনে এক মাইল পথ তাকে যেতে হবে, সেই পথে পথে ইশকুলের সহপাঠীসহ ওপর-নিচের ক্লাসের ছাত্ররা সঙ্গে জুটবে। জ্যোতির্ময়ের মনে হবে, সেই পথে তাকে আজকাল সুযোগ পেলেই সবাই জয়ার কথা জানতে চাইবে। প্রতিদিন জ্যোতির্ময়ের এই মিইয়ে যাওয়া ভাব বাড়ে। বিকেলে খেলতে যায় না। গেলেও সন্ধ্যার বেশ আগেই ফিরে আসে। সে যেন বুঝে গেছে, তাকেও চলে যেতে হবে। খেলার সঙ্গীরা প্রায় কেউই খুঁজতে আসে না, আগেও আসত না। তবে ঘোষপট্টির অলক ব্যানার্জি আসত, সঙ্গে থাকত মাসুম আর পিকলু। কিন্তু একদিন মহামায়াকে জ্যোতির্ময় বলে, ‘মা জানো অলক ইন্ডিয়ায় চইলে গেইছে। আমাগো কারুরে কিছু কয়নি, আমরাও জানি না, কিন্তু আমি একদিন অলকের ছোটভাই অসীমরে ঘটিগরম খাওয়াইয়ে ক’লাম, ইন্ডিয়ায় এইয়ে আর এক পদের বানায়, চিন্ময়দা কইচে। দেলাম ফাট্কি। ও কয়, অলকদাও গেইচে ইন্ডিয়ায় আসলি পর শোনবানে, সেই ঘটিগরম কীরাম! কইয়ে অসীমের চোখ-মুখ ছোট হইয়ে গেল। মনে হলো কোনো গোপন কথা কইয়ে ফেলাল।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কী? অসীম কয় জ্যোতিদা, অলকদা যে ইন্ডিয়ায় গেইচে কেউরে কইয়ে না। মা কতি মানা করিচে।’

মহামায়া চুপ করে থাকে। তারপর একটু বিরতি নিয়ে বলে, ‘ওরে গেরস্তবাড়ির ছেলেপেলে পাড়ার লোকজন এতদিন দেখিছে, এহোন কয়দিন না দেখলি বুঝদি বাকি থাহে? হিন্দুর ছ’লপ’ল যাবে আর কোহানে? মানষি ধইরে নে, ইন্ডিয়ায় গেইচে।’

জ্যোতির্ময় চুপ। সরে যেতে চায়। মহামায়া আরো বলে, ‘তা তোর হইচে কী? আইজকাল তোর দেহি কোনো কাজে মন নেই। পড়িস না। গান গাইস না। খেলতি যাইস্ না।’

জ্যোতির্ময় গলা নামিয়ে জানায়, ‘বুন্ডি গেইচে পরদে মা কোনোতা আর ভালো লাগে না। সব কেমন জানি বিষাদ লাগে।’

মহামায়া ভাবে এ-কথা জগৎলালকে বলবে। কিন্তু সে জানে, ও লোকের পেটে কী আছে তা কাউকে বলবে না, বলে না।

এ সময়ের এক বিকেলে সাত্তার মিয়াসহ আশপাশের দোকানের কয়জন তার দোকানের সামনে আসে। জগৎলাল জানত সজলের কাছে থেকে সব শুনে সাত্তার মিয়া এক সময় না এক সময় তার কাছে আসবে। দোকান আবার আগের মতো সাজাতে বলবে। বলবে, এভাবে ব্যবসা হয় না, দাদা। বলবে, আপনে এক সময় ছিলেন ওই বাটা বাদে সবচেয়ে বড় জুতোর দোকানের মালিক। এমনকি সঙ্গে এ-ও জানাবে, আপনার এই দোকানদে যখন সজলের চারশো টাকা দিয়ে এক জোড়া বেলি কেড্স কিনে দিয়েছি, তখন বাকি সবাই বেচে মোগল হাওয়াই।

তাদের একজন জগৎলালকে বলে, ‘সমরদা এইডা কোনো কাজ করল, দাদা? একজন ফার্স্ট ক্লাস কন্ট্রাক্টর রাজনীতির জন্যি দেশ ছাইড়ে যাবে! দরকার হলি জেল খাটত। আতিয়ার, আজগর, পল্টু সবই তো জেলদে বাইরোই গেল। সমরও ছাড়া পাইয়ে যাত। যে আয় উন্নতি হ’তিল (হচ্ছিল)!’

সাত্তার মিয়া বলে, ‘কেন যে যায়?’

পাশের দোকানের সফদার বলে, ‘বন্ধু তুমি আবার যাইয়ে না।’

জগৎলাল সফদারের মুখের দিকে তাকায়। ফতেপুরে বাড়ি। ছোটবেলায় এই সফদারের সঙ্গে কত খেলেছে, এখনো       সুখে-দুঃখে সফদার তার সঙ্গী। কিন্তু তাতেও জগৎলালের ঝিমুনি কাটে না। আজকাল জগৎলালের মনে হয়, কেন সে ঝিমায়, সে নিজেই জানে না।

কিন্তু সামনের ছিট কাপড়ের দোকানের রহমতের কথায় এইমাত্র ঝিমুনি কেটে গেল, ‘তা আপনি যতই যতকালের বন্ধু হন সফদারদা, যাওয়ার সময় জগৎদাও আপনারে জানাইয়ে যাবে না।’

এ-কথায় জগৎলাল সত্যি ঝিমুনি কেটে সফদারের মুখের দিকে তাকায়। সফদার জানাল, না তা সত্যি নয়, জগৎলাল   অন্তত তাকে না জানিয়ে কোথাও যাবে না। যুদ্ধের সময় যায়নি। সেদিন এই সফদারকে না জানিয়ে এক পা নড়েনি জগৎলাল, আর আজ? এখন আর সমস্যা কী? ছেলেমেয়ে দুটো বড় হচ্ছে। ওর মেয়ের মতো মেয়ে হয়। সবার মুখ উজ্জ্বল করবে।

কিন্তু রহমতই আরো বলল, ‘মাইয়েডারে পাঠাইয়ে দেল। জানল কেউ?’

জগৎলাল সফদারের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। রহমত যেন সেই সুযোগটা নিল। জগৎলাল কিন্তু মিনমিন করেও বলতে পারল না, জয়া খুলনায়। বুঝল, একমাত্র সফদারই এই খবর জানে না। জানলে, এক সময় নিচু গলায় তার কাছে জানতে চাইত।

এখনো সফদার আর কিছু জানতে চাইল না। কিন্তু পরে এক সময় এসে জানতে চাইল, ‘সত্যি, জয়ারে দেলা পাঠাইয়ে?’

জগৎলাল চুপ।

‘খারাপ করো নাই, চারদিকে যে উৎপাত!’

‘কী করব?’

‘হয়। তাছাড়া উপেনদার মাইয়েডা ওই কান্ড ঘটাল, তহন সবাইর ওইরম মনে হলো। ওইরম বাটপার ছওয়ালের সঙ্গে আমাগো ঘরের মাইয়েঝিবুত গেলিই তো বাপ-মা মাইনে নেনা।’

জগৎলাল বলে, ‘বোঝো তো।’

‘কী যে কও, বোঝব না কেন?’

ফলে সফদারই জানে না আর জানবে মহামায়া? যতই ছেলেটা বোনটার জন্য ওইরকম করুক। চিন্ময় কোথায় আছে, সে খবর নিশ্চয়ই নিয়েছে অমরেন্দ্রর কাছে থেকে। অমরেন্দ্র যাবে না। সরকারি চাকরি। পেনশন পর্যন্ত থাকবে। কিন্তু এর ভেতরে কিছু ঘটলে, মহামায়া জানতে পারবে তার নিশ্চয়তা কী?

ফলে একদিন মহামায়া বুঝল, সত্যি দিন ঘনিয়ে আসছে। জগৎলাল তাকে বলল, ‘এহোন দে (থেকে), ঘোনো ঘোনো ফতেপুরের বাড়ি যাবা।’

‘কেন?’

‘যাবা। তুমি ও জায়গায়ও থাকপা এ জায়গায়ও থাকপা।

‘খোকার ইস্কুল?’

‘হবে। বাপ-বেটা চইলে যাবে। আর ইস্কুলেও-বা যাবে কয়দিন?’

‘কী বোঝো, আর কী কও?’

‘কী কব? কোনো সমস্যা হইচে কোনোদিন? আমার বোঝাবুঝি এহেবারে খারাপ না।’

মহামায়া তাই করে। এদিকে জগৎলালের ঝিমুনি আরো বাড়ে। দোকান রেখে গলি দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ বাসায় যাওয়া বাড়ে। কোনো কোনো জিনিস নিয়ে ফতেপুরের বাড়ি যাওয়া বাড়ে। যেন এখন আর এই বাসায়ই থাকবে না। সফদার বোঝে জগৎলাল নিজেকে গুটিয়ে ফেলছে। কিন্তু কিছু বলে না।

একদিন শীতকালীন ছুটিতে জ্যোতির্ময় পূর্বার ভাইয়ের বাড়ি খুলনা যায়। মাসুম, পিকলু, আলম এসে ক্রিকেট খেলার জন্য জ্যোতির্ময়কে পায় না। খুলনা যেতেই পারে। কিন্তু তারাও পরস্পর বলে, জ্যোতিও চলে গেল নাকি? গেলিও কিছু জানাইয়ে গেল না! একজন অন্যজনকে বলে, হয়, জানাইয়ে যাবেনে! ইন্ডিয়ায় কেউ জানাইয়ে যায়?

কিন্তু এর কিছুদিন পরে দেখে সব ঠিক। জগৎলাল দোকানে বসে। মহামায়া আবার এই বাড়িতে। সপ্তাহে কোনোদিন ফতেপুর যায়। কোনোদিন সকালে যায়, বিকেলে আসে। নৌকা না পেলে পরদিন খুব সকালে আসে। জগৎলালের ঝিমুনি কিছুটা কমেছে। এমনকি জ্যোতির্ময়ও আসে।

যদিও জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু হলে জ্যোতির্ময় আর ইশকুলে যায় না। আবার সে খুলনা গেছে। আর সেই শীতের ভেতরে, এক দুপুরের আগে আগে জগৎলাল সেদিন দোকান খোলেনি দেখে সফদার বাড়ির ভেতরে যায়। ফিরে আসে। কেউ নেই। সাত্তার মিয়া আসে। রহমতকে ডাকে। তারাও যায়। বাড়ির ভেতরে ঢোকে। কেউ বলে, সকালেও তো বাজারে গেল। একজন বলে, দেহিলাম, মনে হয় খালি থলি নিয়েই আবার ফিরে আইল। খেয়াল করিনি।

তারা খেয়াল করুক কী না করুক। সফদারের যাতায়াত আছে বলে সে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। সাত্তার মিয়ার আগ্রহ নেই। সফদার দেখে, সত্যি সবই ঠিক আছে। মহামায়া বউদি নেই। জগৎলাল নেই। কেউ নেই। শুধু রান্নাঘরে চুলায় পানিভরতি একটা হাঁড়ি। নিচে অাঁচ প্রায় নেই। হাঁড়ির জল এখনো কিছুটা গরম!