বৈরী বাস্তবতার রূপায়ণ

নাজিয়া ফেরদৌস

আত্মিক সঞ্চালন আর যান্ত্রিক সঞ্চালনের মধ্যে পার্থক্য শুধু বাহ্যিক নয়, অভ্যন্তরীণও। যান্ত্রিকতার গতি নিয়মতান্ত্রিক বলেই অপরিবর্তনীয় কিন্তু আত্মিকতার গতিকে চূড়ান্তভাবে নিয়মতান্ত্রিকতায় আবদ্ধ করা যায় না, সময় এবং পরিস্থিতির মুখাপেক্ষী মানুষ তাই নিয়ত রূপান্তরিত হয় অন্তর্গত পরিবর্তনের স্পর্শে। প্রতিনিয়ত প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা তার পূর্বের অর্জিত জ্ঞানকে ছাপিয়ে নতুন চিন্তাধারার পথে তাকে চালিত করে। স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিষ্পেষিত সমাজ আর অত্যাচারী শাসকের রূপ। ভিন্নধারার সেই রূপ প্রত্যক্ষ করে তাকে ভাষিক কাঠামো দান করেছিলেন গল্পকার ইতালো ক্যালাভিনো। অসাধারণ চিন্তাশক্তি, আবেগের উপস্থাপন ও সমাজের নিয়মতান্ত্রিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ বাস্তবতার অভ্যন্তরীণ প্রকাশ তাঁকে করে তুলেছিল বৈরী বাস্তবতার রূপকার। অনুবাদক মহীবুল আজিজের রূপান্তর দক্ষতায় তাঁর গল্পগুলো ‘ইতালো ক্যালাভিনোর গল্প’ নামে বাংলায় অসাধারণ ভাষারূপ লাভে সমর্থ হয়েছে।

কিউবার সান্তিয়াগো শহরের দে লাসভেগাসে ইতালো ক্যালাভিনোর জন্ম। মা-বাবার ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন তাঁকে নতুনভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দিয়েছিল। সহানুভূতিশীল বাবার সংস্পর্শ তাঁকে দিয়েছিল বৃহত্তর জনজীবনের স্পর্শ। ক্যালাভিনোর জীবন তাঁর লেখাকে সমৃদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁর ছোটগল্পের মধ্যে প্রকাশিত বাস্তবতা তাঁর বিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতা থেকেই উৎসারিত। প্রকৃতি, মানুষ, রাষ্ট্র, সমাজ, শাসক, সভ্যতা, সবকিছুই ক্যালাভিনোর গল্পে নতুন রূপে উপস্থাপিত হয়েছে। তাঁর চিন্তার গভীরতা সাধারণত্বকে অতিক্রম করে অসাধারণ এক জগতে মানুষকে নিয়ে যায়। যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে প্রচলিত নিয়মতান্ত্রিক সমাজের বাইরে গিয়ে চিন্তার পক্ষ উন্মোচনে সমর্থ হয়। ‘এক বিকেলে অ্যাডাম’ গল্পের পরিচারিকা মারিয়া নুঞ্জিয়াটা যা কল্পনা করতে পারে না, তা অতি সহজেই করে দেখায় মালির ছেলে লিবেরেসো। লিবেরেসো অর্থ স্বাধীনতা; তাই সে স্বাধীনভাবেই চলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। প্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক নিবিড় বলেই মারিয়ার জন্য উপহার হিসেবে অনায়াসেই সে ধরে আনে ব্যাঙ, বিচিত্র বর্ণের পোকা, গিরগিটি, মাছ, কেঁচো এমনকি বিষাক্ত পিঁপড়া ও কু-লিত রঙিন সাপ ধরতেও তার মধ্যে কোনো ভয় কাজ করে না। প্রকৃতির উপাদানই লিবেরেসোর কাছে সবচেয়ে বড় উপহার, যেগুলো একই সঙ্গে সুন্দর ও গুরুত্ববহ। তাই সে তার সর্বোচ্চ উপহার হিসেবে মারিয়ার পুরো রান্নাঘরে অদ্ভুত সব প্রাণী ছড়িয়ে দেয়। ক্যালাভিনোর বিচিত্র চিন্তাশক্তির একটি বিস্ময়কর প্রকাশ ঘটে এ-গল্পটিতে।

ক্যালাভিনোর গল্প পাঠকসমাজে সুখপাঠ্য তাঁর ব্যতিক্রমী বিষয় নির্বাচন আর উপস্থাপন-দক্ষতার কারণে। চিন্তাশক্তির যে-ক্ষমতাকে সামাজিক দায়বদ্ধতা, সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ থাকতে হয়, ক্যালাভিনো ছিলেন তা থেকে মুক্ত। পুরনো জংধরা সমাজ যে নীতি-নৈতিকতা আর সমাজ-শৃঙ্খলার জালে মানুষকে আবদ্ধ করে রেখেছিল, তার মধ্যে বিচরণ করেও তিনি নতুন চিন্তায় ব্রতী ছিলেন। স্মৃতির প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজস্ব অবস্থান থেকে তিনি সাহিত্য রচনা করেছিলেন। যে-সত্য লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল, যে-চিন্তা ছিল কল্পনার অতীত তাকে তিনি ধারণ করেছিলেন নিজস্ব লেখনীতে। বিচিত্র বিষয় ও গভীর চিন্তা তাই স্থান পেয়েছিল তাঁর গল্পে। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও বারবার নিরস্ত্র লোকটি প্রশ্ন করতে থাকে সশস্ত্র সৈনিককে ‘তারপর কি ওরা আমাকে ছেড়ে দেবে?’ নিজের মনকে প্রবোধ দেয় সে, ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে থাকলেও সৈন্যদের সব বলে দেওয়ার পুরস্কারস্বরূপ সে জীবন দান পেতে পারে ভেবে সারা পথ হাজারো চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়। জঙ্গলে সৈনিকদের আনাগোনা, তার সঙ্গীদের মৃত্যু সবকিছুকে উপেক্ষা করেও সে বাঁচতে চায়, যুক্তি খোঁজে কেন তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। দীর্ঘ সময় পর যখন তাকে গুলি করা হলো, তখনো সে চিন্তা করতে থাকে, ‘ও ভাবছে ও আমাকে মেরে ফেলেছে, কিন্তু আমি বেঁচে আছি।’ তার সব চিন্তাতেই কিছুক্ষণের মধ্যে সে পরিণত হয় পিঁপড়ায় ঢাকা মৃতদেহে। আবার ‘পুত্রকে পিতা’ গল্পের নানিন ও মেরোটোবেলেস্নার চিন্তার জগৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বরাবর অপমানিত হওয়া নানিন চিন্তা করে ধনী, সভ্য হওয়ার কথা, যা তার সামর্থ্যের একেবারে বাইরে আর তার ষাঁড় মেরোটোবেলেস্না চিন্তা করে গাভিদের ওপর রাজত্ব করার, তাই বারবার সে দড়ি ছিঁড়ে চলে যায় মাঠে। নানিন ভাবে এবার সেসব অভাব দূর করবে, অসহায়ত্বকে পরাজিত করবে; কিন্তু বংশপরম্পরায় গরিব ক্ষমতাহীন পিতা বাতিস্তিনের মতোই শেষে হার মানতে হয় নানিনকে। ছেলের আবদারে তাই সে গর্জে ওঠে ‘কখ্খনো না’ বলে। পিতার মতোই ব্যর্থ জীবনের দিকে অগ্রসর হয় নানিন ও তার পরিবার। প্রতিটি গল্পের মধ্যেই মানুষের চিন্তার গভীরতা ও আবেগের প্রকাশ ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছেন গল্পাকার। মানব মনের বাস্তব অনুভূতিকে ধারণ করেছে তাঁর গল্প।

ভিন্নধারার চিন্তাশক্তির পরিচয় মেলে তাঁর ‘গ্রন্থাগারে এক জেনারেল’, ‘বিড়াল এবং পুলিশ’, ‘বিবেক’, ‘একটা কিছু কর’ গল্পগুলোতে। এসব গল্পে ক্যালাভিনো চিন্তা করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। সাধারণত্বের বাইরে গিয়ে নিয়ম-শৃঙ্খলার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি বৈরী বাস্তবতাকে রূপদান করেছেন। গল্পের চরিত্রগুলো তাদের সাধারণ ধরাবাঁধা রূপ থেকে রূপান্তরিত হয়ে পরিণত হয়েছে ভিন্ন মানুষে। নিজের তৈরি শৃঙ্খলার জাল কেটে তারা নিজেরাই বেরিয়ে এসে সন্ধান পেয়েছে নতুন এক জগতের, যার অবস্থান সভ্য নিয়মতান্ত্রিক সমাজের বিপরীতে। গ্রন্থাগারের বইগুলোতে সামরিক নিয়মের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কথা আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে নিয়োজিত হলেন জেনারেল ফেদিনার। অনেক তদন্ত, দীর্ঘ পড়াশোনার পর তিনি যে-রিপোর্ট দিলেন তাতে ‘জাতির সমূহ দুর্ভাগ্যের জন্য শাসকশ্রেণিকে দায়ী করা হলো। আর জনগণকে অভিষিক্ত করা হলো ভ্রান্ত রাজনীতি এবং অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের বীরোচিত শিকারের মর্যাদায়।’ গ্রন্থের তথ্য আমূল পালটে দিলো সরকার এবং নীতির রক্ষক জেনারেল ও তার সঙ্গী লেফটেন্যান্টদের। চাকরি ছেড়ে তারা আবার যেতে শুরু করলেন গ্রন্থাগারে। একইভাবে ‘একটা কিছু কর’ গল্পে শহরের লোকদের জন্য সবকিছু নিষিদ্ধ করে দিয়ে তাদের অচল করে রাখার জন্য কেবল ডাংগুলি খেলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এক সময় যখন সিপাহিরা তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল তখন আর প্রজারা কাজে ফিরে যেতে পারল না। তাদের কর্মজীবন ততদিনে রূপান্তরিত হয়েছিল অকর্মণ্য জীবনে। আবার ‘বিড়াল এবং পুলিশ’ গল্পে নতুন চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত পুলিশ বাভারিনো অস্ত্রের তল্লাশিতে বস্তিতে গেলে গরিব বস্তিবাসীকে তার মনে হয় শত্রম্ন, সামান্য গৃহস্থালি জিনিসের শব্দ মনে হয় আগ্নেয়াস্ত্র। শাসকশ্রেণির অত্যাচার ও সন্দেহকে ধারণ করে বাভারিনো চলতে থাকে বস্তির মধ্য দিয়ে, তার সঙ্গে একটা বিড়ালও তাল মিলিয়ে চলে। শেষে বাভারিনো অনুভব করে পুরো স্থানটিতে সে একা, শত্রম্নঘেরা। তার ছকবাঁধা জীবনের বিপরীতে সে দেখতে পায় নতুন এক বাস্তবতাকে, যেখানে তার ইচ্ছা হয় নিজের পরিচয় কবর দিয়ে স্বাধীন হয়ে উড়ে যেতে।

ক্যালাভিনো ছিলেন স্বাধীনচেতা। তাঁর সৃষ্টিশীল মন অন্যের কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারেনি কখনো। তিনি ছিলেন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন তাঁর প্রিয় ভূমি লিগুরিয়া দখল করে নিয়েছিল জার্মানরা। সুন্দর সমাজ গঠনের স্বপ্ন তাঁকে আজীবন তাড়িত করেছিল আর বাস্তবতার নির্মমতা উৎসাহিত করেছিল নতুনভাবে সাহিত্য নির্মাণে, যেখানে থাকবে বাস্তবতার নবরূপের উন্মোচন। সমকালীন রাজনীতি, বিরূপ বৈশ্বিক পরিস্থিতি আর মানুষের অনুভূতির রূপান্তর তার গল্পের রসদ জুগিয়েছে। ‘শত্রম্নর চোখ’, ‘আকাশমুখো নৃ-গোষ্ঠী’, ‘বিবেক’ ইত্যাদি গল্পে প্রকাশ পেয়েছে রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সমাজের শৃঙ্খলে আবদ্ধ পুতুল মানবের চিন্তার বৈচিত্র্য। নিজের কল্পনা ও প্রখর অনুধাবন শক্তিকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন গল্পে। তিনি সমাজের সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে বুঝেছিলেন গভীরভাবে। তাদের মনোজগতে অনবরত ক্রিয়াশীল স্বপ্ন আর উচ্চাশাগুলোকে অনুভব করেছিলেন মর্মে মর্মে। পৃথিবীজুড়ে ক্ষমতাশীলদের রাজত্ব আর উপনিবেশ দখলের নীলনকশা তাঁকে কষ্ট দিত। সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিসত্মৃতির ওপর তিনি আস্থাবান ছিলেন। রাজনীতি আর বিশ্বদখল নীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতার ছাপ তাঁর গল্পে ছায়া বিস্তার করেছে। ‘শত্রম্নর চোখ’ গল্পে পিয়েত্রো সাধারণ মানুষের প্রতীক, যে সর্বক্ষণ ভাবে, কারো দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ রয়েছে সবসময়। সর্বক্ষণ তাকে কেউ আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছে। এক সময় বোঝা যায় তার এই শংকা ব্যক্তিগত থেকে বিস্তার লাভ করেছে পুরো সমাজে। তার বন্ধু কোরাডো ও মায়ের মনেও এমন ভয় কাজ করতে থাকে। জার্মান বাহিনীর আক্রমণের ভয়ে তারা সর্বদাই ভীত, ভীত অনাকাঙিক্ষত ভবিষ্যৎ নিয়ে, যেখানে ওঁৎ পেতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে শত্রম্নসৈন্য আর নজর রাখছে প্রতিটি পদক্ষিপের। অন্যদিকে ‘আকাশমুখো নৃ-গোষ্ঠী’ গল্পে এই ভীত মানুষগুলো ভয়কে অতিক্রম করে কাল্পনিক সুখময় দিনের স্বপ্ন দেখে। ধর্মের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হওয়ার অপেক্ষায় তারা দিন গোনে ‘শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলমান দাসত্ব ও দারিদ্র্য শেষে আমাদের নৃ-গোষ্ঠী রাজত্ব করতে থাকবে বিশাল নদী এলাকার সমগ্র উপত্যকায়।’ কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্রের একদিকে গমন যেমন তাদের স্বপ্নের দ্বারে কড়া নাড়ে, তেমনি অন্যদিক থেকে ধেয়ে আসা দ্বিগুণ শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রের ছুটে চলা তাদের আশার আকাশে ছড়িয়ে দেয় কালো মেঘের ছায়া। তবে সভ্যতার শুরু থেকে এই নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা যেভাবে নারকেল সংগ্রহ করে নিজেদের টিকিয়ে রাখে, সেখানে সভ্যতার বার্তা নিয়ে শ্বেত মানবেরা আসে, তারা নারকেলের দাম নির্ধারণ করে এবং লোকেদের কাজ বেড়ে যায়। তারা ক্ষেপণাস্ত্র ও ভবিষ্যদ্বাণীর কথা চিন্তা করে। কিন্তু পৃথিবীর অবস্থা যেভাবেই পরিবর্তিত হোক না কেন তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না, তারা নারকেলগুলো সস্তা দামেই বিক্রি করতে থাকে। সমৃদ্ধ পৃথিবীর স্বপ্ন তাদের কল্পনাতেই জাগরূক থাকে সহস্রকাল ধরে।

যুদ্ধ ও দখলদারি বৈশ্বিক রাজনীতির অপর নাম। ক্যালাভিনো বাধ্যতামূলক সামরিক ট্রেনিং থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি। যুদ্ধের সাজ ও অসংখ্য মানুষের মৃত্যু তাকে ভাবিত করত। ‘বিবেক’ গল্পটিতে লুইগি সৈন্য না হলেও যুদ্ধ করতে চেয়েছিল তার এক শত্রম্নকে হত্যা করার জন্য; কিন্তু যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী তাকে হত্যা করতে হয়েছিল অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে। যুদ্ধ শেষে যখন সে তার কাঙিক্ষত শত্রম্নকে খুঁজে পেল না তখন অসংখ্য মানুষ হত্যার দায় নিজের কাঁধে নিয়ে সব পদক বিলিয়ে দিলো মৃতদের পরিবারে। যুদ্ধের সময় অকারণে মানুষ হত্যা করার জন্য সে পদক পেল ঠিকই, যুদ্ধ শেষে তার সেই কাঙিক্ষত শত্রম্নকে যখন সে হত্যা করল, তখন তাকে দেশীয় নিয়ম ভঙ্গের জন্য ফাঁসি দেওয়া হলো। ক্যালাভিনো মানুষের অনুভূতি ও চিন্তার জগতে বিচরণ করেছিলেন। তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল ‘যে লোকটা ‘তেরেসা’ বলে চিৎকার করেছিল’ কিংবা ‘অকম্মার ঢেঁকি’র মতো গল্প রচনা করা। মানব চিন্তার ভিন্ন রকম দিক তাঁর গল্পে প্রকাশিত। সেখানে মানুষ নিজের খেয়ালের বশে অচেনা জায়গায় গিয়ে কারো নাম ধরে অহেতুক চিৎকার করতে পারে, যখন সে জানে সে যাকে ডাকছে তার অস্তিত্ব নেই। তার সঙ্গে এই অদ্ভুত আহবানে যোগ দেয় আরো বিশজনের মতো মানুষ। তারপর যখন সে হাল ছেড়ে দিয়ে চলে যায়, তখন নতুন আরেকজন একই উদ্যমে চিৎকার করতে থাকে অদৃশ্য কারো উদ্দেশে। আবার ‘পথভ্রান্ত সৈন্যদল’, ‘নিয়ানডার্থাল মানব’, ‘আবার শীঘ্র বেরিয়ে পড়া’ ইত্যাদি গল্পেও পাওয়া যায় মানুষের ব্যতিক্রমী চিন্তার ছাপ।

ইতালো ক্যালাভিনোর প্রতিটি গল্পই মূলত গভীর চিন্তাপ্রসূত। সমাজবাস্তবতার বিরূপ চিত্র তিনি কখনো সরাসরি, কখনো ইঙ্গিতে তুলে আনার চেষ্টায় সচেষ্ট ছিলেন। লেখক পাভেজে তাঁকে বলেছিলেন ‘লেখালেখির কাঠবেড়ালি’। সৃষ্টিশীলতা দিয়ে অনুভূতির চোরাপথে প্রবেশ, আবেগের প্রাধান্য আর সমাজবাস্তবতার প্রকৃত চিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে ইতালো ক্যালাভিনো অর্জন করেছেন বিশ্বব্যাপী খ্যাতি। বাংলায় তাঁর গল্পের অসাধারণ রূপান্তরের জন্য অনুবাদক মহীবুল আজিজও সমান প্রশংসার দাবিদার। r