ব্রেনে ব্রাউন কতটা প্রাসঙ্গিক?

সৃজনশীলতা কে না চায়? সৃজনশীলতা নিয়ে একটা অনুসন্ধানের পথে যেতে গিয়ে ব্রেনে ব্রাউনের নাম বারবার চোখে পড়ছিল। তাঁর লেখা পড়ছিলাম আন্তর্জালে সর্বত্র। উদ্বুদ্ধ হয়েছি বারবার। এই মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক। কয়েক বছর আগে তাঁর টেড টক সাম্প্রতিককালে  রেকর্ড সৃষ্টি

করেছে। প্রায় সাড়ে তিন কোটি দর্শক সেই টেড টক দেখেছে আজ পর্যন্ত। তাই সে-সংবাদ জানার পর, ‘পাওয়ার অব ভালনারেবিলিটি’ শিরোনামে আন্তর্জালে পাওয়া তাঁর টেড টক শুনে  ফেললাম। এবং শুনে তাঁর কথা আরো জানতে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। তাঁর বইয়ের খোঁজ করতে লাগলাম। তাঁর আন্তর্জালে মিলে যাওয়া সব সাক্ষাৎকার শুনে নেওয়া গেল।

টিভি হোস্ট বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ওপ্রা উইনফ্রির করা ব্রেনে ব্রাউনের সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতা দেখেছিলাম এর আগে। জেনেছিলাম বিখ্যাত কবি, লেখক, শিল্পী, অ্যাক্টিভিস্ট মায়া অ্যাঞ্জেলু-অনুপ্রাণিত এই ব্যক্তি মায়া অ্যাঞ্জেলুর সাক্ষাতেও এসেছিলেন। অ্যাঞ্জেলু তাঁকে তাঁর জরুরি কাজের জন্য অভিবাদন জানিয়েছিলেন। যত শুনেছি, ততই তাঁর কাজকে জানতে আগ্রহী হয়েছি।

জানতে ইচ্ছা করছিল, অধ্যাপক ব্রেনে ব্রাউন এমন কী সামাজিক গবেষণা করলেন যে, টেড টকের বক্তৃতার মঞ্চে তাঁকে আহ্বান করা হলো আর আজ পর্যন্ত সেই টেড টক শুনতে তেত্রিশ মিলিয়নের বেশি দর্শক ইউটিউবে ভিড় করল? এমন কী বললেন যে, দেশ-বিদেশের টিভি হোস্ট ডাকতে লাগল তাঁকে? এমন কী কাজ তাঁকে করতে হয়, লেখালেখি আর গবেষণা ছাড়াও, যে তিনি এখন এক সমাজসেবী কম্প্যানির সিইও হয়ে ওঠেন অবধারিতভাবেই? সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পেশাদারি সংস্থার ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য, উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর ডাক আসে – কেন? হাসি হাসি মুখে সহজ ভাষায় কী পরিবেশন করেন তিনি? কেন তাঁর বই রাইজিং স্ট্রং আর ব্রেইভিং দ্য উইল্ডারনেস নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলারের তালিকায় উঠে যায়? কেন তিনি সমাজ, সংসার, ব্যক্তি আর বিশ্বের সীমানায়, রাজনীতি আর পেশাদারি জগতে এক অপরিহার্যতা নিয়ে হাজির হচ্ছেন বারবার? অথচ এই বাংলায় এখন পর্যন্ত আমরা তাঁর কাজের কথা তেমন শুনতে পাইনি।

নিজের মতো পাঠ আর অনুসন্ধানের দিকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা পাই।

একটু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাকি এমন এক সমাজ-গবেষক তিনি, যিনি ‘শেইম’ (লজ্জা), ‘হেইট’ (ঘৃণা), ‘কারেজ’ (সাহসিকতা), ‘ভালনারেবিলিটি’ (সত্যের স্বচ্ছতায় দাঁড়িয়ে পড়া), ‘ডি-হিউম্যানাইজেশন’ (মানুষকে মানবেতরভাবে তুলে ধরা), ‘এম্প্যাথি’ (সমবেদনা), ‘ক্রিয়েটিভিটি’ (সৃজনশীলতা) ইত্যাদি ব্যক্তিগত আর সম্মিলিত মানুষের নানা রকম গহিন জায়গা নিয়ে বছরের পর বছর অপ্রচলিত ‘অদ্ভুত’ সমস্ত অনুসন্ধানের কাজ করে তা সহজ সাদাসিধে ভাষায় আর অনেক রসবোধের সঙ্গে তুলে ধরেন জনতার সামনে – লেখেনও বটে। ইউটিউবে তাঁর বিবিধ সাক্ষাৎকার আর টেড টকে তাঁর বক্তব্য শুনে, আর হাসিখুশি অমায়িক  লোকটাকে দেখে বুঝতে পারি, তিনি বেজায় ভদ্রলোক হলেও বেজায় ডানপিটে সাহসীও বটে।

ব্রেনে ব্রাউন ডটকম বলে একটা ওয়েবসাইট আছে, সেখানে কিছু কথা লেখা। আমি একটু সচেষ্ট ছিলাম সংশয় নিয়ে পড়ার। তবু সংশয় বৃষ্টির জলে ধুয়ে যেতে থাকে একটু যখন পড়ি ÔCourage is contagious. Every time we choose courage, we make everyone around us a little better and the world a little braver.Õ এ-কথাগুলো একজন সমাজবিজ্ঞানীর বলেই বিস্মিত হতে হলো।

এ-লেখার নাতিদীর্ঘ পরিসরে আমি তাঁর ব্রেভিং দ্য ওয়াইল্ডারনেস – দ্য কুয়েস্ট ফর ট্রু বিলঙ্গিং অ্যান্ড দ্য কারেজ টু স্ট্যান্ড অ্যালোন নামে ২০১৭ সালে প্রকাশিত, বিপুলখ্যাত সর্বশেষ বই থেকে বাছাই করা ভাব-নির্যাস তুলে দিচ্ছি।

ব্রাউন জানাচ্ছেন, নিঃসঙ্গতা সমাজের একটি ট্যাবু বিষয়। আমরা এ নিয়ে আলোচনা করতে ভয় পাই। ব্রাউনের ভাবানুবাদ যা করেছি  সেখান থেকে তুলে দিই –

নিঃসঙ্গতাবোধ নিয়ে আমাদের মধ্যে কিন্তু লজ্জা (shame) কাজ করে। যেন নিঃসঙ্গতাবোধ এক ধরনের মনোবিকার। এমনকি এই নিঃসঙ্গতা যখন শোক, মৃত্যু, বিচ্ছেদ বা বুকভাঙা অভিজ্ঞতা থেকে আসে, তখনো। কাচিওপো জানান, নিঃসঙ্গতা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ যেভাবে কথা বলেছি তার জন্যই এই হাল।

নিঃসঙ্গতা শুধু এক বেদনাদায়ক পরিস্থিতিই নয়, রীতিমতো বিপজ্জনক শারীরিক, মানসিক অবস্থা।

আমাদের যখন বিচ্ছিন্ন, একা, নিঃসঙ্গ বোধ হয়, আমাদের মগজ তখন দীর্ঘদিনের বিবর্তনের ফলে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে থাকে। সে-অবস্থায় আমাদের যদিও সবার আগেই সংযোগ চাই, তবু আমাদের মগজ সংযোগ ছাপিয়ে চেষ্টা করে যায় আত্মরক্ষা করতে, নিজেকে গুটিয়ে রাখতে। এর অর্থ দাঁড়ায়, এরকম এক সময়ে সমবেদনা (empathy) কমে যায় আমাদের মধ্যে, আত্মরক্ষার  বোধ কাজ করে বেশি এবং আরো নিঃসাড় হয় আমাদের বোধ আর ইন্দ্রিয়গুলো; আরো জেগেও ঘুমিয়ে থাকি আমরা।

তাই নিঃসঙ্গতা দূর করতে হলে আগে তাকে ভালো করে চিনতে হবে। জানতে হবে, নিঃসঙ্গতা মূলত আমাদের শরীরের দেওয়া একটা সতর্কবাণী। এর মর্ম হলো, আমাদের এখন সংযোগ খুঁজতে হবে। তার মানে এই নয় যে, এখুনি আমাদের এক ডজন বন্ধু খুঁজে বের করতে হবে। অনেক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, বন্ধুর সংখ্যায়  তেমন কিছু এসে-যায় না, এসে-যায় বন্ধুত্বের উৎকর্ষ কেমন তার ওপর।

বিশ্বব্যাপী গবেষণা নিয়ে কাজ করতে করতে গবেষক জুলিয়ান হল্ট-লানস্ট্যাড, টিমোথি বি স্মিথ এবং জে ব্র্যাডলি লেয়টন আবিষ্কার করলেন এই অদ্ভুত তথ্যটি – বায়ুদূষণ নিয়ে বেঁচে থাকলে মৃত্যুর ঝুঁকি (odds) বেড়ে যায় শতকরা পাঁচ ভাগ। শারীরিক মেদ বাহুল  থাকলে সেই ঝুঁকি দাঁড়ায় শতকরা বিশ ভাগ। অতিরিক্ত অ্যালকোহল  খেলে ঝুঁকি বাড়ে ত্রিশ শতাংশ। আর নিঃসঙ্গতা নিয়ে বেঁচে থাকলে?  সেক্ষেত্রে আমাদের ঝুঁকি বাড়ে পঁয়তাল্লিশ শতাংশ।

ব্রেনে পরবর্তী এক কাজে দেখান, নিঃসঙ্গতা যা আমাদের শারীরিক বিপদসংকেত, তার জন্য দরকারে আমাদের অপরিচিতজনের এবং পরিবেশের মানুষের কাছাকাছি আসতে হবে। হাত বাড়িয়ে দিতে হবে; কিন্তু কিছু সীমারেখা মেনে।

নিচের অংশটি ব্রেনের আগে উল্লিখিত বইয়ের একটি অধ্যায়ের  ভাবানুবাদ :

 

‘সীমারেখা  আছে, এমন কি জনঅরণ্যেও’

আমরা যখন কাছাকাছি আসার দায়বদ্ধতা নিই, তখন আমাদের মুখোমুখি সংঘর্ষের সম্ভাবনাও বাড়ে। খাবার টেবিলে হোক, অথবা কাজে, অথবা বাজারের লাইনে দাঁড়িয়ে, মানুষে মানুষে সংঘর্ষের ব্যাপারটা বরাবর অস্বস্তিকর। পরিবারের ক্ষেত্রে তো বলাই বাহুল্য।  ব্রেনে জানান, তাঁর পরিবারের মতো যদি আমরা হই, তবে সাধারণ বিরক্তি থেকে বিপুল ক্রোধের মুখেও আমরা ভব্যতা আর ভালোবাসা ধরে রাখতে জানব।

পরিবারে অথবা সমাজে অথবা অপরিচিত ভিড়ে, সকল মতের উলটোদিকে একা দাঁড়ানোর সাহস ধরে রাখতে গিয়ে মনে হয় – এ এক বন্য এলাকা – এ এক জনঅরণ্য। ব্রেনে বলেন, মাঝে মাঝে তিনি হাল ছেড়ে দিতে চান। বড় বেশি লোভ হয় তাঁর স্রোতের মুখে ভেসে ভেসে নির্ঝঞ্ঝাট নিরাপদ অবস্থানে থাকার। কিন্তু স্মরণে আসে মায়া অ্যাঞ্জেলুর কথাও – ‘এ-পথে চড়া দাম দিতে হয়। অনবদ্য পুরস্কার মেলে।’

কিন্তু ব্রেনের গবেষণায় যে-প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছিল তা হলো, সীমারেখা কি আদপে আছে? থাকলে কোথায়? কতখানি আচরণ সহনীয়, আর কখন সেই মাত্রা লঙ্ঘন হয়? এ ভব্য সহনীয়তার পথে পুরস্কার যত অবিস্মরণীয় হোক, আমাদের অস্তিত্বকে যারা অস্বীকার করে, যারা আমাদের ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে, তাদেরও কি সহ্য করতে হবে? এমন কি কোনো সীমা আছে, যা লঙ্ঘন করা যাবে না? এর উত্তর হলো, হ্যাঁ।

ব্রেনের গবেষণায় যারা অংশগ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে যারা নিজেদের অস্তিত্বের ব্যাপারে স্বচ্ছন্দ, তারা তাদের সীমারেখার ব্যাপারেও বেশি সোচ্চার। আগে ব্রেনে যে-গবেষণা করেছেন তার সঙ্গেও মিলে যায় এই ফলাফল – আমাদের সীমারেখা যত সুস্পষ্ট আর মান্য হবে, ততই সমবেদনা আর করুণার সুযোগ পাব আমরা, অন্যদের জন্য। আমাদের সীমারেখা যত অপরিষ্কার হবে, উদারতা তত কম হবে অন্যদের জন্য। যদি কাউকে সুযোগ বুঝে ব্যবহার করতে থাকে কেউ, অথবা ভয় দেখিয়ে কাজ করিয়ে নিতে চায়, তখন সেই ব্যক্তির পক্ষে কোমল-হৃদয় থাকা কঠিন বইকি!

ব্রেনে তাঁর উপাত্ত ঘেঁটে দেখলেন, সীমারেখা দুটি জায়গায় চিহ্নিত হয়। একটি শারীরিক নিরাপত্তার সীমা, আরেকটি অনুভূতির নিরাপত্তা সীমা। শারীরিক নিরাপত্তার ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। আক্কেল থাকলে বোঝা যায় সহজেই। যে-কোনো প্রকারে সত্য উদ্ঘাটনের সাহস (ভালনারেবিলিটি) চর্চা করতে  গেলে এই শারীরিক নিরাপত্তার বোধে কোনো আপস চলে না। যে-পরিবেশে শারীরিক নিরাপত্তা নেই, সেই পরিবেশে কেউ সত্যি নিজেকে নিজের মতো করে প্রকাশ করবে, এমনটা আশা করা উচিত নয়।

অনুভূতির নিরাপত্তা বোঝা অত সহজ ছিল না। বিশেষ করে এজন্য যে, কিছু কিছু মানুষের কাছে, অনুভূতির নিরাপত্তা বলতে  বোঝায় এই অভিব্যক্তি, ‘আমার থেকে আলাদা, আমার অপছন্দের, আমাকে যা বেদনা দিতে পারে, অথবা আমি যা সঠিক মনে করি তার থেকে ভিন্ন মত, আমার শোনার দরকার নেই।’ এই কারণে, অনুভূতির নিরাপত্তা ব্যাপারটা নিয়ে ব্রেনেকে আরেকটু গভীরে যেতে হলো।

যখন ব্রেনে অংশগ্রহণকারীদের অনুভূতির নিরাপত্তা কখন কখন লঙ্ঘন হয়েছে বলে জিজ্ঞাসা করে দৃষ্টান্ত চাইলেন, তখন ভূরি ভূরি

এমন দৃষ্টান্তই পেলেন, যা থেকে একটা পরিষ্কার প্যাটার্ন পাওয়া  গেল। তারা সাধারণত নিজের থেকে ভিন্নমত শুনতে বাধ্য হয়েছেন এমনটা বলেননি, তারা বলছিলেন তাদের মানবতাকে খাটো করে তুলে ধরা কিছু উক্তি আর আচরণের কথা। ব্রেনে পুরনো গবেষণায় দশ বছর ধরে ডিহিউম্যানাইজেশন অথবা মানবেতর হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতা নিয়ে কাজ করেছেন বলে সেটা তাঁর বুঝতে বেগ  পেতে হলো না।

ডেভিড স্মিথ তাঁর বই লেস দ্যান হিউম্যানে বলেন যে, মানবেতর হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতা দুটি সংঘর্ষে আসা মতের ভেতর থেকে  তৈরি হয়। আমরা একটা গোষ্ঠীর ক্ষতিসাধন করতেই চাই, কিন্তু মানুষ হিসেবে অপর মানুষের ক্ষতি করা, নির্যাতন করা, মেরে ফেলা, উৎপীড়ন করার ব্যাপারে আমাদের অন্তরে বাধে। স্মিথ জানান, আমাদের মানবপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত আছে সেই বাধা – মানুষের সঙ্গে পশুর মতো, শিকারের মতো ব্যবহার করার ব্যাপারে আমরা অপারগ। মানুষকে মানবেতর হিসেবে তুলে ধরতে পারলে কিন্তু সেই প্রকৃতিগত বাধা অনায়াসে অতিক্রম করা যায়।

ডিহিউম্যানাইজেশন বা মানুষকে মানবেতরভাবে তুলে ধরার প্রবণতা একটা প্রক্রিয়া। মিশেল মেইজ, এম্যানুয়েল কলেজের দর্শনের অধ্যাপক এই ব্যাপারে যা বলেছেন তা বোঝা সহজ বলে এখানে তাঁর কিছু কথা ব্যবহার করা যায়। মেইজ ডিহিউম্যানাইজেশনকে চিহ্নিত করেন এভাবে – ‘শত্রুকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দানব হিসেবে প্রতিপন্ন করা, এই উদ্দেশ্যে, যেন তাদের সঙ্গে মানুষের মতো ব্যবহার করতে না হয়।’ আমরা যদি কোনো পক্ষ নিয়ে দাঁড়াই, বিশ্বাস হারাই, ক্রোধে যত উত্তপ্ত হয়ে উঠি, তত শত্রুর ধারণাকে অন্তরে আরো কঠিন করে অনুভব করি। শুধু তাই-ই নয়, একই সঙ্গে আমরা বধির হয়ে উঠি, যোগাযোগ করার দক্ষতা হারাই, লুপ্ত হয় আমাদের সহমর্মিতা।

আমরা যখন কোনো সংঘর্ষের উলটোদিকের লোককে নীতিগতভাবে ইতর বা বিপজ্জনক বলে মনে করি, তখন সেই সংঘর্ষ হয়ে ওঠে ভালো আর মন্দের দ্বন্দ্ব। মেইজ লেখেন, ‘দলগুলো যখন তাদের দ্বন্দ্বকে এভাবেই তুলে ধরে, তাদের অবস্থান আরো অনমনীয় হয়ে ওঠে। কখনো কখনো বিফল হয় সমস্ত ইতিবাচক ভাবনা, কারণ দলগুলো মনে করে – হয় জিততে হবে, নয়তো হারতে হবে। প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা বা শাস্তি দেওয়ার আরো নতুন কলাকৌশল উঠে আসতে থাকে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে পরিস্থিতিতে আরো জঙ্গি নেতৃত্ব ক্ষমতায় আসে।’

মানবেতরভাবে মানুষকে তুলে ধরা নানা হিংসাত্মক ঘটনার মূলে; মানবাধিকার লঙ্ঘন, যুদ্ধ-অপরাধ এবং গণহত্যার পেছনে এটাই কাজ করে। এর জন্য সম্ভব হয়েছে মানুষকে ক্রীতদাস বানানো, নির্যাতন এবং মানবপাচার। মানবেতরভাবে মানুষকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে আমরা মানুষের প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেতে শুরু করি, মানুষের আত্মার বিরুদ্ধে কাজ করি এবং মজ্জাগত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শুরু করি।

কীভাবে ঘটে এমন? মেইজ বলেন, আমরা প্রায় সকলেই ভাবি, মানবিক অধিকার লঙ্ঘন করা উচিত নয়। সুতরাং হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, এসব ভ্রান্ত কাজ। কিন্তু যদি সফলভাবে মানুষকে মানবেতর হিসেবে প্রতিপন্ন করা যায়, তখন ওই নিয়মের যে ব্যতিক্রম আছে, এমনটা আমরা মেনে নিই। তখন দলীয় পরিচয়ে – কখনো লিঙ্গ, কখনো চামড়ার রং, কখনো ধর্ম, কখনো জাতীয়তার ভিত্তিতে মানুষকে আমরা মানুষের চেয়ে কিছু কম অথবা অপরাধ অথবা শয়তান বলেও চিহ্নিত করতে শিখি। তখন তারা আর আমাদের নীতিগত আশ্রয়ের মধ্যে পড়ে না। এটাকে বলা হয় মোরাল এক্সক্লুশন (নীতিগত ব্যতিক্রম) এবং ডিহিউম্যানাইজেশন বা মানবেতরভাবে মানুষকে তুলে ধরা এর মূলে।

মানুষকে আমরা মানুষের চেয়ে খাটো করে তুলে ধরি প্রথমত শব্দের মাধ্যমে। তারপর ভাবমূর্তির মাধ্যমে। ইতিহাসে প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে। নাৎসিরা ইহুদিদের বলত – মানবেতর। তারা ইহুদিদের জীবাণু বয়ে বেড়ানো ইঁদুরের সঙ্গে তুলনা করত, তাদের সামরিক খাতায় এবং ছোটদের বইয়ে। রুয়ান্ডার গণহত্যায় হুটুরা টুটসিদের বলত আরশোলা। আদিবাসী মানুষদের আমরা প্রায়ই বলি অসভ্য। সার্বরা বসনিয়ার মানুষকে বলত ভিনগ্রহের জন্তু। প্রভুরা চিরকাল ক্রীতদাসদের মানবেতর পশু বলে অভিহিত করে এসেছে।

আমরা নিজেরা এমনটা কখনো করতে পারি – কিছু মানুষকে  ঠেলে মানুষের চেয়ে খাটো করে তুলে তাদের প্রতি আমাদের মানবিক মর্যাদা আর নীতিবোধকে এড়িয়ে যেতে পারি, এ আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য। কিন্তু এ হলো জীববিজ্ঞানের কথা। আমরা এমনভাবে প্রকৃতির হাতে তৈরি যে, প্রতিটা শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে সেটার সঙ্গে আমরা একটা ছবি তৈরি করে ফেলি। আমরা জানি, গণহত্যায় অংশ নেওয়া অথবা মদদ দেওয়া প্রত্যেকটা মানুষ সাইকোপ্যাথ হতে পারে না, সেটা অসম্ভব। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা হলো, আমরা যদি তাই মনে করি, তাহলে আমরা আসল সত্য থেকে আরো দূরে চলে যাব। সত্য হলো, আমরা প্রত্যেকেই একটু একটু করে মানুষকে মানুষের চেয়ে খাটো করে দেখতে পারি, যদি চর্চাটা প্রাত্যহিক হয়। সুতরাং আসল কথা, এই ব্যাপারে আমাদের সবাইকেই সচেতন হতে হবে এবং চিহ্নিত করে থামাতে হবে।

 

‘আমাদের মানবতাকে বুকে জড়িয়ে ধরার সাহস’

ব্রেনে বিশ্বাস করেন –

১। হিলারি ক্লিনটনকে কুত্তি বা বেশ্যা বলে কেউ গালাগাল করলে আমাদের খারাপ লাগে, তবে অনুরূপ গালাগাল ইভাঙ্কা ট্রাম্পকে করলেও আমাদের আপত্তি থাকার কথা।

২। হিলারি ক্লিনটন যখন ট্রাম্পের অনুগতদের এক বস্তা ঘৃণা বলে অভিহিত করেন, তখন যদি দুঃখ হতে থাকে, তবে এরিক ট্রাম্প যখন বলেন, ‘ডেমোক্র্যাটরা মানুষ নয়’, তখনো উৎকণ্ঠিত হওয়ার কথা।’

৩। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যখন নারীদের ‘কুকুর’ বলে অভিহিত করেন এবং তাদের নিতম্ব খামচে ধরার কথা বলেন, তখন আমাদের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল বরফ নামে, আমাদের শিরা বেয়ে প্রতিরোধের আগুন বাহিত হয়। যখন লোকে সেই প্রেসিডেন্টকে ‘শুয়োর’ বলে গালাগাল করে, তখনো আমাদের সেই ভাষাকে বিনাবাক্যে পরিহার করতে হবে।

৪। যখন যে-কোনো গোষ্ঠী বা মানুষকে পশু অথবা ভিনগ্রহের বলে অভিহিত করা হয়, তখন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে মনে করতে  হবে, ‘এই মানুষের মানবতাকে ছিলে নেবার এক প্রচেষ্টা চলছে নাকি? যাতে সহজেই তার ওপর আঘাত হানা যায়? যেন যে-কোনো মানবাধিকার সহজেই লঙ্ঘন করা যায়?’

৫। ট্রাম্পকে ফটোশপ করে হিটলারের আদল দেওয়ায় আমাদের যদি আপত্তি থাকে, তাহলে আমাদের নিজেদের ফেসবুক দেয়ালে ওবামাকে ফটোশপ করে জোকার হিসেবে তুলে ধরা উচিত হবে না।

একটা সীমারেখা আছে। সেটা মর্যাদাবোধের আঁচড়ে সুচিহ্নিত। এবং রাজনীতির ডানপন্থী, বামপন্থী, সন্ত্রাসবাদী এবং প্রগতিবাদী সকলেই – সেই সীমারেখাকে উঠতে বসতে লঙ্ঘন করে চলেছেন।

মানুষকে মানবেতরভাবে প্রতিপন্ন করা – আমাদের কখনো  কোনোভাবে সহ্য করা উচিত নয়। কারণ উৎপীড়নের একটা অমোঘ হাতিয়ার এটা। প্রত্যেক গণহত্যার পেছনে এটাই কাজ করে।

আমরা যখন মানুষকে মানবেতর ভাষায় এবং ছবি দিয়ে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করি, তখন একই সঙ্গে আমরা নিজেদের মানবতাকে ধ্বংস করি। আমরা যখন মুসলিমদের ঢালাওভাবে ‘সন্ত্রাসী’ অথবা মেক্সিকানদের এক কথায় ‘ইল্লিগাল’ অথবা পুলিশ অফিসারদের শুয়োর হিসেবে তুলে ধরি, যাদের উদ্দেশ করে এসব কথা বলা হলো, তাদের সম্পর্কে আসলে কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না। বোঝা গেল আমাদের সম্পর্কে। বোঝা গেল এই কথা যে, আমরা নিজেদের অখ- পূর্ণতাবোধের ওপর ভর করে কতখানি কাজ করছি।

মানুষকে মানবেতর হিসেবে তুলে ধরে হেয়প্রতিপন্ন করা, আর মানুষের কাছে জবাবদিহিতা দাবি করা, এ দুই-ই পারস্পরিকভাবে বিচ্ছিন্ন ব্যাপার। মানুষকে লজ্জা দেওয়া (humiliation) অথবা মানবেতর প্রতিপন্ন করা (dehumanization) জবাবদিহিতা   অথবা সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার নয়। এগুলো কম করে হলে আবেগের ভার নামানো বা গায়ের ঝাল মেটানোর ইচ্ছা। বেশি করে হলে ঝাল মেটানোর জন্য অন্যের ওপর আক্রমণ।

আমাদের বেঁচে থাকার মানদ-কে তুলতে হলে অবিরাম সচেতনতা আর পরিশ্রম লাগে। আমরা কিছু কিছু শব্দ আর ছবির ব্যবহারে এতটাই অভ্যস্ত যে নীতিগতভাবে কিছু মানুষ যে ব্যতিক্রমের খাতায় পড়বে, এ-কথা আমরা স্বাভাবিকভাবে ধরে নিয়েছি। সচেতনতা আর পরিশ্রমের বাইরে আমাদের লাগে সাহস। কারণ শত্রুদের বিরুদ্ধে এমন মানবেতর প্রতিপন্ন করা ক্যাম্পেইন চালালে অথবা সকলকে এক নীতিবোধের আওতায় আনতে চাইলে,  সে-মানুষকে অনেক সময় খুব কঠোর পরিণাম ভুগতে হয়।

আমরা যদি নাগরিক হিসেবে সব নাগরিক এক – এভাবে ভাবি, তাহলে কি আমাদের চিৎকার করে বলা উচিত – সব জীবনের দাম আছে? না। কারণ সব জীবন থেকে তো মানবতা বরবাদ করে দেওয়া হয়নি। কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে যেভাবে হয়েছে। ক্রীতদাস প্রথা যেন নিটোলভাবে কাজ করে, কৃষ্ণাঙ্গদের কেনা, বেচা, মারধর করা, পশুদের মতো তাদের নিয়ে বাণিজ্য করা, এসবের জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পূর্ণভাবে মানবেতর মনে করতে (dehumanize) হয়েছে। আজকের মার্কিন নাগরিক সেই সংস্কৃতিতে বড় হয়েছে বলে তাদের ওপর এর প্রভাব পড়বে। এই ইতিহাস আমেরিকানদের মনের গড়ন আপনাআপনি তৈরি করে দেবে। এই মানবেতর মনে করাকে এক বা দুই প্রজন্মে মুছে দেওয়া যায় না।

(ব্রেনে ব্রাউন পড়তে পড়তে ভাবি, সেভাবেই আমাদের সংস্কৃতিতে আমরা অবাঙালি আদিবাসী আর প্রান্তিক সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠী,

কৃষক, মজুর, নারীদের যেভাবে মানবেতর বলে মনে করি, সে-সংস্কৃতি নিশ্চয়ই হরেদরে আমাদের চিন্তার গড়নকে তৈরি করে দেয়। তাই সব জীবনের দাম আছে, এ-কথা বলা দরকার না থাকলেও এসব গোষ্ঠীর জীবনের যে দাম আছে, তা আমাদের বারবার বলতে হবে।)

পুলিশ এবং অ্যাক্টিভিস্টকে যুগপৎ সমর্থন করার মধ্যে কি টানাপড়েন নেই? আলবত আছে। এই সেই জঙ্গল। সেই জনঅরণ্য। কিন্তু সবচেয়ে বেশি সমালোচনা আসে তাদের কাছ থেকে, যারা এটা অথবা ওটাকে বেছে নেওয়াবার দ্বৈততা আরোপ করার জন্য ব্যগ্র। ঘৃণার পাত্রদের ঘৃণা না করার জন্য যারা আমাদের লজ্জিত করতে চান। এই সূক্ষ্মতম অবস্থান বেছে নেওয়া জটিল এবং কঠিন, কিন্তু নিজের কাছে অনুগত থাকতে গেলে, নিজ অস্তিত্বের কাছে আপন হতে গেলে (true belonging), এমনটাই করতে হয়।

কোনো সংগঠনের সংস্কৃতি যখন আমাদের শেখায়, ক্ষমতাবানদের আর সিস্টেমের মানসম্মান, সেই সিস্টেমে অংশ- নেওয়া ব্যক্তি-মানুষের মানবিক মর্যাদার চেয়ে বড়, তখন বুঝতে হবে লজ্জাকে (shame) রীতিমতো সব নিয়মের আওতায় আনা হয়েছে, টাকাকড়ি নৈতিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, এবং জবাবদিহিতা ধুঁকে মরছে। এই বাস্তবতা করপোরেট জগতে যেমন সত্য, তেমন সত্য এনজিও, সরকারি, বেসরকারি সংস্থায়, ধর্মীয় সংগঠনে, ইশ্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেখানে একটা স্ক্যান্ডেল ঘটে যাওয়ার পরে দ্রুত তা ধামাচাপা দেওয়া হয়, সেসব ক্ষেত্রে তো বটেই। ধামাচাপা সত্যের পুনরুদ্ধার, এবং সমাধান কিন্তু সেই জনঅরণ্যেই হয়, যখন একটিমাত্র ব্যক্তি তাঁর নিরাপদ আস্তানা থেকে বেরিয়ে সাহস করে নিজের মতো সত্য কথা বলতে থাকেন।

আমাদের পথ তাই খাপে খাপে মিলে যাওয়া থেকে পালটে গিয়ে হয়ে যায় জনঅরণ্যে জংলি অবস্থার মধ্যে বেদনালিপ্ত পদপাত, কারণ একমাত্র সেভাবেই আমরা সবকিছুর সঙ্গে আপন হতে পারি (true belonging), এবং এই কাজ করতে গিয়ে অন্যদের শারীরিক নিরাপত্তার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা যে কত জরুরি সে-কথা বুঝলে আমাদের সাহায্য হতে পারে। অন্যদের সীমানাকে শ্রদ্ধা করেই আমরা সেসব সংগঠনের বা অভিজ্ঞতার সঙ্গে একাত্ম হবো না, যারা (যে-কোনো) মানুষকে মানবেতর ভাষায় বা আঙ্গিকে তুলে ধরে (dehumanize)। মানুষকে মানবেতর ভাষায় তুলে ধরলে শুধু অল্পবিস্তর অনুভূতির নিরাপত্তা বিঘিœত হয়, এমন মনে করা ভুল। মানবেতরভাবে তুলে ধরা আরো গভীর ছাপ রাখে আমাদের সমাজে। আমরা এখানে আহত অনুভূতির কথা বলছি না, বলছি হিংস্রতা, উৎপীড়ন আর শারীরিক ঝুঁঁকির মূল বুনিয়াদের কথা।

‘দ্বন্দ্বের রূপান্তর’(Conflict Transformation)

সদা সত্যের পথে থাকার সাহসসহ, এবং সাহসী সমর্থ স্বনির্ভর হতে গেলে দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে পথ খুঁজে বের হওয়ার

ছেনি-বাটালি যন্ত্র আমাদের হাতে থাকতে হবে। আমি আমার বন্ধু ডক্টর মিশেল বাককে প্রশ্ন সাহায্য করতে বলি। বাক একজন ক্লিনিক্যাল নেতৃত্ব প্রবর্তনার অধ্যাপক – কেলগ ব্যবস্থাপনা স্কুল, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি এই স্কুলের নেতৃত্ব প্রবর্তনার প্রথম পরিচালক। গত বিশ বছর তিনি দ্বন্দ্ব রূপান্তর নিয়ে কাজ করেছেন। আমরা সংঘর্ষের সময় নিজেদের যেভাবে পরিচালিত করি, এ-ব্যাপারে তাঁর পথ কিছু জরুরি পরিবর্তন আনতে পারে। নিচে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার তুলে দিচ্ছি। তাঁর নিজের কথা খুব শক্তিশালী বলে সেভাবেই তা রেখে দিয়েছি।

ব্রেনে : আমরা যখন বিহ্বল লাগে, তখন আমার মনে হয় আমি চুপচাপ দ্বিমত পোষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। এই সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

বাক : লোকে কখনো কখনো নিজেদের সম্পূর্ণ গুটিয়ে নেয়, চুপ করে থাকে, অথবা দ্বিমত পোষণ করার মৌন সিদ্ধান্ত নেয়, অথচ দ্বিমতগুলোকে সঠিকভাবে বুঝতে চেষ্টা করে না। হয়তো তারা একটা সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার জন্য বা সংযোগ ধরে রাখার জন্য এমনটা করে। কিন্তু কিছু কিছু আলোচনা যদি না করি, তাহলে অন্য ব্যক্তি  সে-ব্যাপারে কেমনটা ভাবছে, তা কখনো জানা যাবে না। এতে ভুল বোঝা, আর গড়পড়তা অসন্তোষ বাড়বে শুধু। বরং তর্ক হলে হয়তো অসন্তোষটা একটু কম হতো। চাবিকাঠি হলো দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে এমনভাবে এগোনো, যাতে পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়ে, যত মতপার্থক্য থাক। কল্পনা করুন – একটি অর্থপূর্ণ আলোচনার পর দুই ব্যক্তির মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সংযোগ  বেড়ে গেল, অথচ তারা কিন্তু মতের দিক থেকে এক জায়গায় এলেন না। আলোচনা এড়িয়ে গিয়ে অপর পার্টির কাছ থেকে কিছু না নেওয়ার থেকে – বিষয়টা কত আলাদা।

ব্রেনে : তাহলে আমাদের আলোচনার টেবিলে থাকতে গেলে, কীভাবে সত্যকথনের সাহসে দাঁড়িয়ে ভদ্রতা, ভব্যতা বজায় রাখতে পারি?

বাক : আমি যখন শঙ্কিত, তখন আমার সবচেয়ে খারাপ প্রতিরোধ হয় এরকম, আমি মানুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিই। উকিলের মতো দাঁড় করিয়ে কথা বলে যাই এবং তার কথা শুনি না। ‘গত সপ্তাহ তুমি এমনটা বলেছিলে, আজ তুমি আরেক রকম বলছ, তাহলে মিথ্যে বলছিলে কখন? আজ, না গত সপ্তাহে?’ এরকম ব্যাপারগুলো হয় – সাধারণত এর পরিণতি ভয়াবহ কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি আসলে চেষ্টা করছি ‘সঠিক’ বলে নিজেকে প্রতিপন্ন করার। এর সমাধান কী?

ব্রেনে : আমার ভালো লাগে যে, আপনি একে দ্বন্দ্বের সমাধান না বলে দ্বন্দ্বের রূপান্তর বলছেন। মনে হলো যেন আপনি সংযোগের কথা বলছেন। এই দুইয়ের মধ্যে তফাৎ কী?

বাক : সব কাজে আমি দ্বন্দ্ব রূপান্তরের কথাই ভাবি। দ্বন্দ্ব নিরসনের কথা নয়। যদিও সেটাই গতানুগতিক ধারণা। আমার কাছে মনে হয় দ্বন্দ্ব নিরসনে একজন জিতবে, আরেকজন হারবে। অথবা কোনো এক পেছনের ঘটনায় ফিরে যেতে হবে। অন্যদিকে  দেখুন, দ্বন্দ্ব রূপান্তর বলতে মনে হয় আমরা দ্বিমতের মানচিত্রে  হেঁটে নতুন কিছু তৈরি করতে পারছি। কম করে হলে, পরস্পরকে আরেকটু জানার সুযোগ পাচ্ছি। আমরা যদিও চাইছি, এমন কোনো সমাধান আসুক, যা আমরা আগে ভাবতে পারিনি। দ্বন্দ্ব রূপান্তর হলো গভীরতর সমঝোতা তৈরির পথ। ফলে সংযোগ বাড়ে, মত না মিললেও বাড়ে।

ব্রেনে : শেষ প্রশ্ন করি! আমি বেশিরভাগ সময় যখন অন্য লোকে কথা বলে তখন পালটা যুক্তি তৈরি করতে ব্যস্ত থাকি। আমি চাই ‘পালটা যুক্তি’ তাদের কথার পিঠে ছুড়ে দিতে। কিন্তু অন্যরা যখন  সেই একই কাজ আমার সঙ্গে করে আমার ভারি খারাপ লাগে। আমি বুঝতে পারি, তারা আমার কথা শুনলই না। কী বিশ্রী অনুভূতি! দ্বন্দ্বের মাঝখানে কীভাবে ধীরে এগোতে হবে?

বাক : রূপান্তরের জন্য যে-আলোচনা, সেখানে সবচেয়ে সাহসী কাজ মুক্তমন হওয়া শুধু নয়, বরং তীব্র ইচ্ছা নিয়ে অন্যের দিকটা  শোনা। আমি বিশ্বাস করি, এবং আমার ছাত্রদের প্রায়ই বলে থাকি, একটা অস্বস্তিকর আলোচনার মধ্যে বলতে হবে, আমি আরো শুনতে চাই। ঠিক যে-মুহূর্তে আমার সেখান থেকে সরে যেতে, আলোচনা   থেকে গুটিয়ে নিতে, পালটা যুক্তি তৈরি করতে ইচ্ছা করছে, তখনই আমাদের সুযোগ আছে অপরের দৃষ্টিকোণ জানার। আমাকে বুঝতে দাও – এ বিষয় তোমার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ কেন, বুঝতে সাহায্য করো – কেন আমার এই মতের সঙ্গে তুমি মিলতে পারছ না। আর তারপর আমাদের শুনতে হবে কান খাড়া করে। বুঝতে হলে শুনতে হবে। মতে মিলল কি মিলল না সেটা বড় কথা নয়। আমরা যেমন চাই কেউ আমাদের বুঝুক, তেমনি আমাদেরও তাদের বুঝতে হবে।

 

বেদনা থেকে উৎসারিত সাহস আর শক্তি : ভিয়োলা ডেভিসের সঙ্গে সক্ষাৎকার

এই অধ্যায় আমি একটি সাক্ষাৎকার দিয়ে শেষ করতে চাই। ভিয়োলা ডেভিসের এ সাক্ষাৎকার। আপনারা হয়তো অভিনেত্রী হিসেবে তাঁকে চেনেন। দ্য হেল্প হাউ টু গেট আওয়ে উইথ মার্ডার এবং ফেন্সেসে (তিনি অস্কারে যার জন্য বেস্ট সাপোর্টিং অভিনেতার  খেতাব পান) হয়তো তাঁকে দেখেছেন। কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা হিসেবে তিনিই প্রথম যিনি একাধারে তিনটি পুরস্কার পেলেন – এমি, টোনি আর অস্কার। ২০১৭ সালে টাইমস পত্রিকায় তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির একজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

ভিয়োলার গল্প থেকে জানতে পারি সাহসের শক্তির কথা,  বেদনার মুখে। ভয় নিয়েও সত্য হয়ে দাঁড়ানোর সে-গল্প। জানতে পারি কীভাবে জীবনটা কাছ থেকে বাঁচলে এবং ভালোবাসলে নিজের আপন হওয়া যায়।

আমি যখন ভিয়োলাকে তাঁর নিজের কাছে আপন হওয়ার গল্পের শুরু থেকে শুরু করতে বলি, তখন তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের চার ভাগের প্রথম তিন ভাগ মনে হতো একটি গোল ছ্যাদার মধ্যে ঠিকমতো বসতে না পারা চৌকো স্ক্রু আমি। শারীরিকভাবেই বেমানান লাগত নিজেকে। ছিলাম রোড আইল্যান্ডের এক ক্যাথোলিক আইরিশ পল্লিতে। সেখানে সচরাচর লম্বা সোনালি চুল মেয়েদের দেখা যেত  বেশি। আমার কোঁকড়ানো কালো চুল, কালো চামড়া, উচ্চারণ আলাদা। সুন্দর দেখতে নই। মারাত্মক দারিদ্র্যে বড় হওয়ার ধ্বস্ততার চিহ্ন আমার মধ্যে। আমি একজন অতিরিক্ত মদ খেয়ে মাতাল থাকা বাবার মেয়ে। বারো-তেরো বছর পর্যন্ত আমি আমার বিছানা ভিজিয়ে দিয়েছি। আমার গায়ে বোঁটকা গন্ধ। শিক্ষকরা অভিযোগ করতেন। পাঠিয়ে দিতেন নার্সের অফিসে। আমার সবকিছু ভুলে ভরা। এটাই আমার শুরু।

‘আমার নিজের কাছে আপন হওয়ার ভাষা ছিল টিকে থাকার ভাষা। আজ কি গরম জলে স্নান করতে পারি? আজ কি টেবিলে খাবার আছে? বাবা কি আজ মাকে খুন করবে? বাড়িতে কি ইঁদুরের উপদ্রব হবে?

‘আমার কোনো হাতিয়ার ছিল না – আমি এই মানসিক যন্ত্রণা, ভয়, এই দুর্ভাবনা, এবং নিজের জন্য উঠে দাঁড়াতে না পারার অক্ষমতা নিয়ে বড় হয়েছি। এসব লজ্জার ভেতরে গভীর প্রোথিত ছিল। আমি আমার সবটুকু শক্তি আমার জীবনের এই ধ্বস্ততার ছবি লুকিয়ে রাখতেই ব্যয় করতাম। এই অকার্যকর জীবন নিয়ে আমি বড় হয়ে গেলাম।’

ভিয়োলা এমন একজন যিনি জনঅরণ্যে ভয়কে সাহসী পদচারণায় রূপান্তরিত করেছেন। আমি জানতে চাইলাম কী করে সেটা হলো।

‘আটত্রিশ বছর বয়েসে, সবকিছু একদিন বদলে গেল। বিছানা  থেকে হঠাৎ জেগে উঠে এমনটা হলো, তা নয়। আমি সবসময় জানতাম আমি এক শক্তিময়ী মহিলা, কিন্তু আমি চাইতাম চটজলদি খাবারের মতো আনন্দ। সহজ ফুর্তি। আরো কলাকৌশল। এবং প্রায়ই আমি সেই পুরনো গাড্ডায় পড়ে যেতাম – যথা, আমি যথেষ্ট সুন্দর নই। যথেষ্ট তন্বী নই। যথেষ্ট ভালো নই। একদিন আমার থেরাপিস্ট আমাকে জিজ্ঞেস করলেন এক প্রধান প্রশ্ন, ‘ধরো কিছুই কোনোদিন পালটাবে না। তোমার চেহারা, তোমার ওজন, তোমার সফলতার ইতিহাস, এরপর কি তুমি ভালো থাকবে?’ সেই প্রথমবার আমি এভাবে ভাবলাম, ‘তাই তো! আমি থাকব ভালো। সত্যিই তো ভালো থাকব আমি।’

‘তখন বুঝতে পারলাম, আমার অতীত আমাকে নির্ধারণ করবে না। একই সঙ্গে আমার এমন এক মানুষের সঙ্গে বিয়ে হলো, যে আমাকে সত্যি দেখতে পেত। আমার নিজেকে নিয়ে এতখানি খাটাখাটনির উপহার ছিল সে। তাঁর ভেতরে আমি সহৃদয়তা খুঁজে  পেলাম। এবং সেই সহৃদয়তাই আমার সত্য হয়ে ওঠা সহজ করে তুলল।’

আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা যখন নিজের সঙ্গে স্বচ্ছন্দ, আপন হই, অনেক সমালোচনাও তখন কিন্তু সহ্য করতে হয়। এই ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা বলুন?’ ভিয়োলা বলেন, ‘অভিনয়ের জগৎ খুব নিষ্ঠুর। মন্তব্য যা আসে তা অনেক সময় এরকম, যথেষ্ট আকর্ষণীয় নয়। বড্ড বুড়ো। বড্ড কালো। যথেষ্ট রোগা নয়। সকলে উপদেশ দেন, এখানে এমন মোটা চামড়া গজিয়ে তুলতে হয় যেন কিছুতে কিছু এসে না যায়। কিন্তু গ-ার-চামড়া অনেক মূল্যবান সংবেদনকেও দূরে রাখে – যেমন ভালোবাসা, ঘনিষ্ঠতা, সত্য হওয়ার সাহস।

‘আমার ওই মোটা চামড়ার দরকার নেই। গ-ার-চামড়া আর কাজ করছে না আমাদের জন্য। আমরা স্বচ্ছতা চাই, আমাদের রং আমাদের আত্মা আমাদের আবেগ ধরা পড়–ক সেই স্বচ্ছতায়। তবে আমি অন্য লোকের অক্ষমতা আর সমালোচনাকে আমার আপন করে তুলব না। অন্যরা যা বলে তা আমার বোঝা হতে দেবো না।

‘আমার বাবা যখন মারা যান আমি তাঁর হাত ধরে ছিলাম। তাঁর প্যাঙ্ক্রিয়াটিক ক্যান্সার হয়েছিল। আমাদের সম্পর্কে আমরা নিরাময় করে নিয়েছিলাম। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসতাম। আমি আর আমার বোন যখন তাঁর সঙ্গে বসেছি, জানতে পারলাম তিনি সারাজীবন তাঁর কাজকে ঘৃণা করে এসেছেন। কয়েক দশক ধরে তিনি রেসের ঘোড়াদের জুততেন, দেখাশোনা করতেন। জানতাম না, এ-কাজকে তিনি ঘৃণা করেন। তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। তাঁকে অনেক সময় মেথরের কাজ করতে হতো। আমরা জানতাম না, তাঁর এমন খারাপ লাগত। তিনি তাঁর সারাজীবন যে-কষ্ট পেয়েছেন ভাবতে গিয়ে আমরা ধ্বস্ত হয়ে গেছি।

‘এমন এক অলিখিত বার্তা আছে যে, ইতিহাসের পাতায় সেসব গল্পই লেখা হবে, যে-গল্পের দাম আছে। এটা সত্যি হতে পারে না। সব গল্পেরই দাম আছে। আমার বাবার গল্পের দাম আছে। আমাদের সবার সেই গহন মূল্য আছে, যা আমাদের গল্পকে শোনার যোগ্য করে তোলে। আমরা যেন সকলে দৃশ্যমান হই, গভীর শ্রদ্ধা পেতে পারি, এসব পাওয়ার চাহিদা নিঃশ্বাস নেওয়ার মতোই মৌলিক।’

ভিয়োলা ডেভিস এখন সেই অরণ্য। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, নিজের কাছে আপন হয়ে বাঁচার জন্য কোনো প্রাত্যহিক অনুশীলন আছে কিনা তাঁর। তিনি জানান, ‘হ্যাঁ। আজ আমি অল্প কিছু নিয়ম মেনে চলি –

১। আমি আমার যথাসাধ্য ভালোটা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

২। আমি অন্যদের কাছে নিজেকে তুলে ধরব, তাদের দেখতে দেবো আমাকে।

৩। ‘আরো দূরে যাও। ভয় পেও না। যা আছে সব ঢেলে দাও। কিছু বাকি রেখো না।’ – আমার অভিনয়ের শিক্ষকের এই উপদেশ আমি জীবনে খাটাই।

৪। আমি আমার মেয়ের কাছে রহস্যে আবৃত থাকব না। সে আমাকে জানবে। আমার গল্প শুনবে। আমার ব্যর্থতা, লজ্জা, আমার সফলতার সব গল্প। তখন সে বুঝবে এই গহিন অরণ্যে সে একা  নেই।

এই তো আমি।

এই আমার উত্তরাধিকার।

এই আমার ভুলচুক।

এসবকে মেনে নেওয়া মানে, নিজের আপন হওয়া।’