ভালো লাগে না, কেবল মনে মনে!!!

মালেকা পারভীন

ভালো লাগে না – এই শব্দজোড়া আমাকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে, ভাবছি। ভালো যদি না-ই লাগে, কী করব তাহলে। বসে বসে মাথার চুল ছিঁড়তে পারি অথবা কাগজ ছিঁড়ে কুটিকুটি। তাতে লাভ? জিরো। মাঝখান থেকে আমার চেহারার সর্বনাশ। চুলবিহীন মাথাটা কল্পনা করে একটু হাসার চেষ্টা নিষ্ফল হলো। বরং আবার সেই কিছুতেই কোনো কিছু ভালো না লাগার অসহায় অনুভূতিটা ফিরে আসতে চাইছে সজোরে। আমাকে আজকের মতো ওর হাতে ধরাশায়ী হতে হবে বুঝে নিলাম।

তার চেয়ে বরং পছন্দ করি না – এমন কাউকে ভেবে অলস সময়টা সাঁতরে যেতে পারি। গুড আইডিয়া। কিন্তু কার কথা দিয়ে শুরু করি। আমার যে কাউকেই ভালো লাগে না। ও, ও, ওহ্ – আবার সেই না ভালো লাগা। ঠিক আছে। জনাব শামসুল আরেফিনকে দিয়ে শুরু করি। আমার ইমেডিয়েট বস। একটা বেকুব। এ পারফেক্ট স্পেসিমেন অব অ্যান  আইডিয়াল ইডিয়ট। ওহ্, নো, নো – যা ভাবছেন তা নয় মোটেও। দস্তয়েভস্কি? রাখুন, আপনার ওসব উচ্চমার্গীয় বিশ্বসাহিত্যের কচকচানি। আমি মনে মনে বলি, বেকুবের বাচ্চা বেকুব। অথবা কখনো কখনো আমার ভাই যেমন কাউকে গালি দেয়, শালা, ভোম্বলের বাচ্চা।

যদি মনে করেন বলা যায়, তাহলে বলি। ভাইয়ের এই গঞ্জনামিশ্রিত গাল আমার গোলাপি গালে শুধু টোল ফেলে যায়। যখনই বা যে-কারণেই হোক, তার ওই মুখনিঃসৃত অমৃতবচন শোনামাত্র এই আমি অবধারিতভাবে একটা মুসকুরান দিয়ে ফেলি। সশব্দ নয়, নীরবে। কারণ নিঃশব্দে হাসির জন্য আমার আলাদা সুনাম আছে। তার চেয়েও বড় কারণ, শব্দ করে হাসলে ওই  ভোম্বলের অম্বল আমার দিকে ছুড়ে ফেলার সম্ভাবনা শতকরা আশিভাগ।

যা হোক, যা বলছিলাম। আমার বেকুব বস শামসুল আরেফিনের কথা। তিনি কী করেন, জানেন? সারাক্ষণ শুধু মানুষকে জ্ঞান বিতরণ করেন। জ্ঞান বিতরণ করবেন ভালো কথা। কিন্তু তা করতে গিয়ে তিনি এক খবরের সঙ্গে আরেক খবর মিলিয়ে এমন একটা ভজঘট অবস্থা তৈরি করেন যে, তার উদাহরণ দিলে আপনার পিত্তি জ্বলে অঙ্গার নয়, একেবারে ছাই হয়ে যাবে। সেজন্য দিতে চাই না। আর যদি দিই, তাহলে তাকে যে বস হিসেবে কিছুটা হলেও আমাকে গুরুত্ব দিতে হয় সেটা প্রমাণিত হয়ে যাবে। এটা আমি বেঁচে থাকতে হতে দেবো না। সামনে হুজুর হুজুর করি বলে পেছনেও? কস্মিনকালেও না, জনাবে আলা। বুঝে রাখুন।

তাকে আমি পেছনে ডাকি মিস্টার অমুক-সমুক। শুনুন তাহলে কেন। ‘এসব বলে-টলে কোনো কিছু করতে পারবা? তুমি সিস্টেমের বাইরে যেতে পারবা? পারবা না। যেভাবে সবাই চলে তোমাকেও সেভাবেই চলতে হবে। অমুক-সমুক বললে লোকে তোমাকে পাগল বলবে। বুঝতে পারছ পাগল? কাজেই যা বলি, যেভাবে বলি, সেভাবে কাজ করো। বসের সঙ্গে ত্যাঁদড়ামি করার চেষ্টা করো না কখনো। তাতে আম-ছালা সব যাবে। কিছুই করি নাই আমার বসের সামনে। সবসময় স্যার স্যার করছি। যা বলছে তাতেই ইউ আর রাইট স্যার বলে মাথাটা বাঁ-দিকে কাত করে রেখেছি। তাতে কি রসগোল্লাটা মিলেছে জানো? আমার এসিআর যখন উনি লিখেছেন, উনার যেন কৌষ্ঠকাঠিন্য হয়েছিল। হাতে কলম সরেনি। নাম্বার তো নয়ই। আর ওই এসিআর যখন কাউন্টার-সিগনেচারের জন্য বড় বসের কাছে গেছে, ওইটা দেখে মানে আমার মার্কের বেহাল দশা দেখে তিনি কী বলছে শুনবা? না, থাক, শুনে তোমার কাজ নেই। কাজে-কাজেই অমুক-সমুক করো না। যাও, ফাইল নিয়ে যে নোটটা দিতে বললাম, সেটা পুটআপ করো।’

ব্যাটা অমুক-সমুকের বাচ্চা। আমাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কী বলল আমি যেন বুঝলাম না। এদিক-সেদিক করে অমুক-সমুক বলে মুখে ফ্যানা অথবা লালা (আপনার পছন্দমতো বসিয়ে নিন) তুলে বুঝিয়ে দিলেন, বেশি কিন্তু তেড়িবেড়ি করো না। এসিআর মনে রেখো আমার হাতে। ওইখানে জায়গামতো চিপা দিয়ে দিব।

আর আমি বলি মনে মনে, নতুন করে আর কি চিপা দেবেন, স্যার। আছি তো চিপার মধ্যেই। এক্কেবারে মাইনকা চিপা। হায়দার আলীর ‘মাইনকা চিপায় ফাঁইস্যা গেছি’ – আপনার এখানে যোগ দেওয়ার পর থেকে। কিন্তু ওই যে, আমি যে একটা ভোম্বল। অথবা ভোম্বলের বাচ্চা। আমার চেহারা দেখে, ভাই, আপনার বোঝার কোনো সাধ্য নাই যে, আমার ভেতরে কী চলছে। কী বাক্যবিনিময় হচ্ছে আপনার সঙ্গে। যদিও আপনার সামনেই বসে আছি নির্বিকার – কখনো মাথাটা নিচু করে কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে না-লেখা বা লিখতে চাওয়া গল্পের কাহিনি খুঁজে খুঁজে অথবা কখনো নোটপ্যাডের ওপর কলমটা ঘোরাতে ঘোরাতে।

ভাবছেন, ছাই, আপনার অমূল্য কথামৃত অন্ধভাবে অনুগত অধীনস্থ কর্মকর্তার মতো সব টুকে নিচ্ছি? কচু! ভালো করে তাকিয়েছেন কখনো আমার নোটপ্যাডটার দিকে অথবা দেখতে চেয়েছেন কী লেখা হচ্ছে ওখানে? দেখুন, ওখানে লিখে রেখেছি ওই মুহূর্তে আপনার ব্যাপারে, আপনাকে নিয়ে আমার অন্তর্জগতে যা চলছে তার কাব্যিক বয়ান। শুনতে চান?

তুমি যতই বলো এভাবে বলো

আমি বলি, না, না, না।

আমার সমস্ত কিছু দেয়ালের ওপারে

নিষিদ্ধ নগরীর অম্বরখানা,

‘তুমি যতই বলো এভাবে করো

আমি বলি, করব না, পারব না, না।

বুঝেছেন, আমি ভেতরে ভেতরে কতটা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছি? মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, বিদ্রোহের উষ্ণ ফেনিল জল উগড়ে ফেলে কিছুটা হালকা হই, ভেতরটা ঠান্ডা হোক। কখনো মনে হয়, ধুর ছাই, বলে ফেলি সব কথা। কী হবে এসব গোপন করে পুষে রেখে? জীবন তো একটাই। ঝটপট বলে ফেলে বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত হয়ে যাই। এই গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে, বরং তথাকথিত এই প্রথাগত জীবনযাপনের মুখে ঝাঁটা মেরে ‘একজন কিছু একটা’ হয়ে যাই। কিন্তু আমার কিছুই হওয়া হয় না। আমি যা তা-ই থেকে যাই। তা-ই থেকে যাব হয়তো। আমার ওই ধারাবাহিক কিছুই ভালো না লাগার শক্তি এতটাই প্রবল যে, তা আমাকে মুহূর্তের ঝলকানিতে কাবু করে ফেলে –  যখন সে যেভাবে চায় তখনই এবং সেভাবে।

আর তাই আমি বসের মুখের দিকে তাকাই, দেখি। সরাসরি নয়, এমনভাবে যেন তিনি আমাকে না দেখেন। আর ভাবি শহিদুল জহির স্যারের কথা। মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন। অথচ এক জীবনের আফসোস আমার, এই জীবনে কস্মিনকালে দেখা হলো না তাঁর সঙ্গে, কথা তো হলোই না। তাহলে তাঁকে আমার দুয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার ছিল। অবধারিতভাবে জানতে চাইতাম, সেই প্রশ্নটার উত্তর যেটা, থাক, সেটা আপনাকে বলে কাজ নেই। আপনি আমার বসের মতো কিছুই বুঝবেন না। অর্ধেক কথার মাঝখানে আচমকা থামিয়ে দিয়ে নিজের ফিরিস্তি গাইতে শুরু করবেন। আর কেন এত বিবিধ বিষয়াদি জেনে-বুঝে বসে আছি সেই প্রশ্নবাণে আঘাত করে আপনার মান-সম্মানের চূড়ান্ত অপমান করবেন। অফিসের কাজ ফেলে দুনিয়াদারির খবর? যতসব ওয়েস্টেজ অব গভর্নমেন্ট মানি আর টাইম। তার চেয়ে চুপ থাকেন। ওইটাই উৎকৃষ্ট পন্থা। সাধে কি আর বলে, বোবার কোনো শত্রু নেই। কিন্তু এখনো যে কথা বলার মতো শক্তি আছে। তাই মাঝে মাঝে কিছু বলার জন্য মুখের ভেতরটা কেমন চিড়বিড় করে। কিন্তু অবস্থা বুঝে…

যা বলছিলাম, ঘুরেফিরে সবকিছুকে নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে তুলনা করার এক মারাত্মক ব্যাধি আছে তার। আপনি যা কিছুই বলতে যান, তার পছন্দমতো না হলেই আপনার কর্ম সাবাড়। তিক্ত-বিষাক্তও বলতে পারেন, কথার আঘাতে অথবা আছাড়ে একেবারে মাটিতে শুইয়ে দেবে আপনাকে। এরকম ভূলুণ্ঠিত অবস্থাতেও কবির শেষ আশ্রয় ওই কবিতাই মনে আসবে আপনার – ‘ধরণী দ্বিধা হও’।

আর প্রচন্ড চাপা ক্ষোভের আগুনে জ্বলে আপনার মনে হতে থাকবে, মা-বাবা কি জন্মেরকালে এক ফোঁটা মধু না হোক, এক চিমটি চিনি বা এক টুকরো মিছরির দানাও জোগাড় করতে পারেনি? সারাউন্ডিং হিসাব-নিকাশ অবশ্য তা বলে না। মধু কেন? হীরে না হোক, সোনার চামচে তা মুখে তুলে দেওয়ার মতো সামর্থ্যের ইতিহাস আপনি তার বয়ান থেকে সহজেই অনুমান করে নিতে পারবেন। কারণ তিনি তো শুধু নিজের গল্প করতেই ভালোবাসেন। কিন্তু হা-হতোস্মি! পঞ্চাশের চৌকাঠ পেরোনো বয়সে কে কবে তার জন্মের কালের কথা মনে রাখে? আমার, আপনার মতো মানুষেরা এসব মনে রাখার মাঝে এক ধরনের বিলাসী আনন্দ পেলেও পেতে পারে। কিন্তু ‘উনারা’, মানে এই বসশ্রেণিভুক্ত কেউকেটারা, সেসব মনে রাখাকে এক ধরনের সেন্টিমেন্টালিটি অপবাদ দিয়ে থাকেন আর অবশ্যই তা তাদের এতদিনের কঠোর সাধনায় অর্জিত-লালিত কড়া অথবা কড়কড়া ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

আর এসব ভাবনায় জড়িয়ে গিয়ে তখন, তখনই আপনি আবার সেই আপাত নিরাময়-অযোগ্য কিছুই ভালো না লাগার অবসাদে বিষণ্ণ হয়ে পড়বেন। মনে হবে আর কত? আর যে ভালো লাগে না। যা কিছুই করেন, যা কিছুই বলেন কোনো কিছুই যদি আপনার বসের মনমতো না হয়, তাহলে আপনার ভালো লাগবে কোন জিনিস, বলেন আমাকে? লাগবে না ভাই, লাগবে না, কোনো কিছুই ভালো লাগবে না। তার চেয়ে বরং আপনাকে কিছু শোনাই আমার দুঃখের দিনলিপি থেকে। অর্থাৎ কবে থেকে এই ভালো না লাগা রোগে আক্রান্ত হয়েছি আর কীভাবে দিনের পর দিন তা শুধু বেড়েই চলেছে (ফিসফিস করে বলে রাখি, লোকে পাগল হয়ে গেছি ভাববে বলে কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়ার চিন্তাও বাদ দিতে হয়েছে, যদিও একাধিকবার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়-হয় অবস্থা হয়েছে)।

এই অমানুষিক মানসিক বিষাদগ্রস্ততায় আক্রান্ত হয়েছি সেদিন থেকে, যেদিন আমি পরিষ্কার বুঝে ফেললাম, এখানে তার অধীনে আমার স্বাধীনভাবে কাজ করার কোনোরকম সুযোগ নেই। ওহ্, হো, সরকারি অফিসাররা আবার কোনকালে স্বাধীন, ভাবছেন আপনি? আছে, আছে রে, ভাই, বসের মুড বুঝে ভাব দেখে মন জুগিয়ে চলতে পারলে আপনার দারুণ যোগ্যতার যেমন পরিচয় পাওয়া যায় (এই ব্যাপারটাকে নাকি সরকারি পরিভাষায় বসিং বলা হয় – অয়েলিংয়ের সমার্থক প্রতিবেশী; আমার একজন সিনিয়র কলিগ আমাকে এই জ্ঞান দিয়েছেন আর সেই জ্ঞান লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে বিপন্ন বিস্ময়ে আমার এক বোধ হয়েছে এমন যে, আমি এখনো অনেক কিছুই জানি না, জানিই না; বসকে কীভাবে কোন বিশেষ প্রক্রিয়ায় কোনো অপরচুন মোমেন্টে বসিং/ অয়েলিং করতে হয় তা তো নয়ই। এই দৈন্যদশা আমার হবে না তো আর কার হবে!) তো কথা যেখানে ভিন্ন বাঁক নিয়েছিল, সরকারি চাকরি করেও কীভাবে স্বাধীনভাবে চলা যায় তা আপনি আশপাশের সবাইকে দেখিয়ে দিতে পারেন ঠারে ঠারে, আড়ে আড়ে, কড়ায়-গন্ডায়।

এসবই অনেক পুরনো কথা, কিন্তু কথা সত্য, অমোঘ। বসের মনের ঝোপ বুঝে কোপ মারার কোয়ালিটি না থাকলে সরকারি অফিসে ‘স্বাধীনতার মর্মমূল্য’ বলতে আসলে কী বোঝায় তা কখনো আপনার অনুধাবনের বড়শিতে লটকাবে না আর আপনিও জানতে পারবেন না ওই বিশেষ গুণে গুণান্বিত জন বা জনেরা কেমন করে তার বা তাদের প্রয়োজনমতো বীরদর্পে অফিসের চত্বর কাঁপিয়ে থাকেন। এরকম ডাঁটের সঙ্গে উড়ন্ত অবস্থায় আপনার তথাকথিত চেইন অব কমান্ড অনুসরণ করার দরকার পড়ে না। আপনি তখন সরাসরি বসের বিশ্বস্ত অনুচর, পরিশীলিত ভাষায় তার অনিবার্য ডান হাত, খাঁটি বাংলায় দালাল বা চামচা, যা খুশি একটা ভেবে নেন। আপনাকে ছাড়া বস যেমন কিছু বুঝতে চাইবে না, আপনিও একেবারে সব ধাপ পেরিয়ে কেবল বসের সঙ্গে সরাসরি রেড লাইন কানেকশন। মাঝে মাঝে যে আরো দুয়েক স্তরের মিডিয়াম মাপের বস-টস আছে; আচ্ছা বস অনেক বিশাল ব্যাপার, সেটা না মানেন, একই অফিসের সিনিয়র সহকর্মী বলেন, তা-ই সই; আপনি তাদের করেন থোড়াই কেয়ার। যে অবশ্যপালনীয় নিয়মরীতি আর সকলকে মানতে হয় বা হয়েছে অফিসের প্রশাসনের শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে, সেই একই নিয়মের আর কোনো বালাই নেই আরেকজনের ক্ষেত্রে, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত আপনার জন্য। তাহলে দেখেন, সরকারি কর্মকর্তা হয়েও শুধু বসের অনুকম্পা-আনুকূল্যে ধন্য হয়ে কত স্বাধীনভাবে আপনি কাজ করে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন!

বৈষম্যের কি ভীষণ বাহারি ব্যবহার! যখন কেউ বা কেউ কেউ ছড়ি ঘুরিয়ে অফিস দাবড়ে বেড়াচ্ছেন; সকাল-বিকাল পিয়ন-পেয়াদাকে তর্জনী হেলনে উঠবস করাচ্ছেন আর প্রতিমুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন এই কথা বলে যে, তারা অফিসার নয়, হুকুমের আসামি। অন্যদিকে আপনি এ-ও দেখছেন, আপনার চোখের সামনে কাজের তালিকার বেশ খানিকটা রদবদল হয়ে গেল কেবল আপনাকে চিপায় ফেলে আটকিয়ে মজা দেখার জন্য।

আবার সেই চিপা? দেখলেন, ঘুরেফিরে পৃথিবী যে গোল তার প্রমাণ পাওয়া গেল। মানে, আপনি যতই আমার সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হতে চান এই বলে যে, সবই আমার ভুল ধারণা, আমার সাময়িক মানসিক অবসাদ বা বিরহ-কাতর বিষণ্ণতার অনিবার্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। আসলে তা নয়। আমি আসলেই একটা ‘মাইনকা চিপা’য় আটকা পড়েছি। আর ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’র দশায় মাঝে মাঝে নীরবে দুচোখের ভিজে আসা কোল  ফ্লেভার্ড ফেসিয়াল টিস্যুতে মুছে নিচ্ছি। একে তো সরকারি আমলার তকমা গায়ে, তারপর আছে নানারকম বহির্মুখী-অন্তর্মুখী চিপার চাপ। তাই বলে অশ্রুবর্ষণ? জি না, জনাব। ওটি হচ্ছে না। ওটি আপনার জন্য অনুমোদিত নয় কোনো প্রকারে। ওটি আপনাকে আবশ্যিকভাবে যে-রূপেই হোক, চেপেচুপে রাখতে হবে। তা সে যতই চতুর্মুখী চাপে থাকুন। তা না হলে ছিঁচকাঁদুনের ছাপ লেগে যাবে গায়ে, যা আবার আপনার পছন্দ নয়। তাহলে আর কী? বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না, এভাবেই থাকার চেষ্টা করুন এবং কান্না রাখুন চেপে। যত্তসব!

এখন আমার কথাবার্তায়, ভঙ্গুর ভাব-ভাবনা প্রকাশে সরকারি স্মারকের ইউফেমিজম চর্চা করতে হবে যতভাবে সম্ভব। কারণ এই স্মারকে মিথ্যা কথাকে সরাসরি মিথ্যা বলা যায় না, চোরকে বলা যায় না চোর। তাহলে কি বলা যায় না কিছুই? যায়, যায় অবশ্যই যায়। এই যে এমন করে মিথ্যা কথাকে শোভন-শালীন ভাষায় বলা হয় অসত্য ভাষণ, সত্যের অপলাপ, কল্পনাপ্রসূত, মনগড়া ও ভিত্তিহীন ইত্যাদি ইত্যাদি। বোঝেন অবস্থা? আপনি ভাষার ওই আলঙ্কারিক ইউফেমিজম বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান না রাখলে অভিধান ঘাঁটতে ঘাঁটতে আপনার অফিস টাইম শেষ!

সরাসরি কথা বলার বা নিজের মতপ্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। আর আমি তো সারাজীবনই ম্যাড়ম্যাড়া স্বভাবের। যেখানে যা বলার, যেভাবে বলার কোনোদিনই বলতে পারলাম না আজতক। শুধু মনে মনে কাগজের পাতায় নিজের সঙ্গে বিদ্রোহের ব্যর্থ আস্ফালন। তাই তো কয়েক বছরের জুনিয়র সহকর্মীও আমার নাকের সামনে লাফ দিয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করার স্পর্ধা দেখায়। দোষ তার নয়, দোষটা আমার। আমি বলি, হ্যাঁ বলি, অবশ্যই মনে মনে, বেয়াদব একটা। পরিবার থেকে কোনো শিক্ষাই পায়নি। ভাগ্যগুণে একটা সরকারি চাকরি বাগিয়ে নিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। কিন্তু আমি জানি, এভাবে শুধু মনে মনে উথাল-পাতাল ভাবনা নিয়ে বসে থাকা আর অহেতুক অশান্তিতে অসুস্থ হয়ে পড়ার কোনো অর্থ হয় না। দিনের পর দিন কাউকেই আপনার এরকম লাগামছাড়া বেয়াদবি চালিয়ে যেতে দেওয়া  একদমই উচিত নয়। এত যে কথায় কথায় কবিগুরু ফলান, ওই গুরুবাক্যটা ভুলে যান কেন যে, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে’ ইত্যাদি।

রাখেন, রাখেন, ওসব বাকোয়াজ আর অর্থহীন তত্ত্বকথার ছটফটানি। ওসব শুধু বইয়ের পাতায় আর ছাত্রছাত্রীদের বাংলা ব্যাকরণ পড়াতে গিয়ে ভাব-সম্প্রসারণের কাজে লাগে। হৃদয়হীনতার মোড়কে আচ্ছাদিত বাস্তব জীবন বড়ই জটিল ও কুটিল। এখানে যা সম্প্রসারিত হয় তা হচ্ছে আপনার যাবতীয় কর্মকান্ডের অপব্যাখ্যা অথবা ভুল ব্যাখ্যা। ঝুম্পা লাহিড়ির ইন্টারপ্রিটেশন অব ম্যালাডিজ পড়া আছে আপনার? পড়া থাকলে বুঝতেন, ম্যালাডিজ কত ধরনের হয় আর তার ব্যাখ্যা ছাড়ায় কত মাত্রায়। ভাগ্যিস, বইটা সময়মতো পড়া ছিল। কাজেই এই ক্রনিক ভালো না লাগার ক্রিটিক্যাল মুহূর্তগুলোতে একেবারে শেষমুহূর্তে নার্ভাস ব্রেক-ডাউন হয়ে যায় না। নিজেকে কিছুটা হলেও ধরে রাখতে পারি, সান্ত্বনা দিতে পারি। বলতে পারি, ইগনোর অল দিজ সুপার-ফিশিয়ালিটি, অল দিজ হিউম্যান ফলিজ, অল দিজ মিনিংলেস বোগাস ব্র্যাগিং ইত্যাদি।

মনে মনে চলছে একনাগাড়ে এই মনোটোনাস মনোলোগ। নিজেকে বলছি, কল্পনায় কোনো একজন পছন্দের দার্শনিককে, হতে পারে সক্রেটিস অথবা আর কেউ, জীবনে ওই যে তাদের, ওইসব হম্বিতম্বিওয়ালাদের বোধের তীব্রতা খুবই সামান্য। বলা যেতে পারে গড়মাত্রার স্কেলেরও নিচে। মোটা দাগের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, তাদের ধ্যান-ধারণা খুবই সাধারণ একটা গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ এমন ভাব দেখাবে যে, পুরা দুনিয়া তাদের নখদর্পণে। ওহ্, হো, ভাবছেন, নিজেকে বুঝি সক্রেটিসের ভাবশিষ্য বা দার্শনিক গোছের কোনো কেউকেটা মনে করছি। একেবারেই তা নয়।

ঘুরেফিরে আমার কেবলই মনে হয়, আবারো মন!  আহ্ কেন তারা একবারও মনে রাখে না কবির সেই চিরন্তন বাণী। সব পথ তো মিলবে গিয়ে ওই কবরের অন্ধকারে। কবরের অন্ধকারে যাওয়ার কথা যখন চিন্তায়-মগজে, ইন্টারকমটা বেজে উঠল ঝনঝনিয়ে। সর্বনাশ! বসের ফোন। কখনো কোনো অবসরে যদি আমার কথা ভুল করে তার মনে পড়ে যায়, তিনি আমাকে এভাবে বাজনা বাজিয়ে স্মরণ করেন। ত্যক্তবিরক্ত কণ্ঠে জানতে চান – ‘হোয়াট কিপস ইউ বিজি’।

আমি কিছু বলি না অথবা বলার প্রয়োজন অনুভব করি না। ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার পরশপাথর আমাকে এই নীরব থাকার পথ অবলম্বন করতে শিখিয়েছে। কী বলব বলেন। বিজি তো তিনি একাই। একাই দেশ ও জাতির তরে তথা জনস্বার্থে নিবেদিত। আর আমরা, আমাদের মতো চুনোপুঁটিরা, বিশেষ করে আমি, বিজি ফর নাথিং। তাই কিছু বলি না। বলতে ইচ্ছেই হয় না। তারপর এভাবে কিছু না বলতে বলতে, স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াও না প্রদর্শন করতে করতে এক সময় দেখি, অবস্থা চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। একজন অধস্তনকে বলা যায় অথবা বলা যায় না এই মাত্রাসীমার কোনো তোয়াক্কাই করছেন না তিনি। সব বলছেন তিনি। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে বলছেন। প্রশ্নের উত্তরে বলছেন – কী মুশকিল!

তারপর যা হোক, এভাবে কেবল কারণে-অকারণে শুনতে শুনতে চাপতে চাপতে একদিন আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। ম্যালাখানিক সাহস-টাহস জোগাড় সাব্যস্ত করে তার বয়স-কুঞ্চিত মুখের ওপর ফস করে কিসব যেন বলে ফেললাম। বলে ফেললাম মানে বলা হয়ে গেল। আমার আম্মা যেমনটা বলে থাকেন প্রায়ই, বন্দুকের গুলি আর মুখের বুলি। ব্যস, সাঁই করে ঠ্যা-ঠ্যা করে বেরিয়ে গেল, আমিও তার বিপরীতমুখী আঘাতে খানিকটা ধরাশায়ী অনুভব করলাম আর আগপিছ না ভেবে বিরক্ত-বিস্মিত বসের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে এসে চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লাম। আর যদি ফ্যালাসি বানাতে চান, সজোরে বসার পর ধপাস জাতীয় একটা শব্দ হলো।

তো কী বলে ফেললাম সে আর নাইবা শুনলেন। ভালো যে কিছু বলিনি তা তো ভালো করেই বুঝতে পারছেন। ভালো কথা, ভালো ব্যবহারের ভালো প্রত্যুত্তর হয়। এর উল্টো হলে জবাবও তেমন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যাক গে, যা বললাম, বললাম, একবারই মুখ খুললাম। কিন্তু এরপর থেকে চিপার মাত্রা বেড়ে গেল বহুগুণে। সেইসঙ্গে চামড়া তুলে লবণ লাগানো সেঁকা। রূপকার্থে। নানাভাবে, বিভিন্ন প্রয়োজনে।

দয়া করে ক্ষমা করবেন আমার এসব স্ল্যাং বাতচিতের জন্য। যা কিছু মিনমিনে প্রতিবাদ তা আমার-আপনাদের সঙ্গেই, আপনাদের সম্মুখেই। ওই মানসিকভাবে অসুস্থ বসের সামনে গেলে আমিও কেমন যেন সিক হয়ে পড়ি, নেতিয়ে যাই গনগনে আগুনে পানি ঢালার পর মিইয়ে যাওয়া ছাইয়ের মতো। কখনো কখনো ভাবি, এভাবে আর নয়। কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়। সহ্যেরও তো একটা সহ্যসীমা আছে। অবশ্যই এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। সরকারি চাকরি করতে এসেছি বলে আত্মসম্মান শিকেয় তুলে রেখে এসেছি নাকি? আর বানের জলেও ভেসে আসিনি। মেধার হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে জিতে তবেই এতদূর। এসবই মনে মনে। পরক্ষণেই কবিগুরু সামনে এসে গাইতে শুরু করেন – ‘এমনি করে যায় যদি দিন যাক না…’

মনের এই রকম অস্থির-অধৈর্য অবস্থায় গুরুজির এই গান স্মরণে আসার কোনো অর্থ খুঁজে পাই না। সংগীত দিয়ে কি জীবন চলে? জীবনের ক্ষত সারিয়ে তোলা যায়? হ্যাঁ, কিছুটা সময়ের জন্য তা মনের কষ্টটাকে প্রশমিত করতে পারে বটে, তবে অনেকখানি মুহূর্তজুড়ে নয়। তাহলে তো কবেই কতকিছু হয়ে যাওয়ার কথা ছিল যখন একদিন আমি মনের অমন ঘোরতর অশান্ত অবস্থাতেই মুখের ওপর একটা চিরপ্রশান্তির সৌম্য, ধীরস্থির মূর্তি ধরে রেখে তাকে গেয়ে শুনিয়েছিলাম – ‘কেন এ- হিংসাদ্বেষ, কেন এ-ছদ্মবেশ, কেন এ-মান-অভিমান’। ফলাফল শূন্য। একটা প্রশংসাবাক্যও কপালে জোটেনি। আর আমি হৃদয়-বিমলকারী গানের মাধ্যমে পাষাণপ্রাণে যে-প্রেম বিতরণ করতে চেয়েছিলাম, যে-শান্তির বারি বর্ষণ করতে চেয়েছিলাম, তা           শুষ্ক-কর্কশ মাঠেই মারা পড়ে গেছে। আমার ভিতরটা বেদনায়-যন্ত্রণায় খিঁচিয়ে উঠেছে।

নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আমার মানসিক অসুস্থতা কোন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। যখন প্রচন্ড রকম মানসিক নিপীড়নের মাঝেও আমার মাঝে এমন সংগীতের উদয় হয় যা আমার মুখ দিয়ে গাইয়ে নেওয়া হয়, ‘এমনি করে যায় যদি দিন যাক না…’, প্রকৃতপক্ষে সে-মুহূর্তে আমি নিষ্ফল সান্ত্বনায় নিজেকেই বোঝাতে চেয়েছি, যেভাবে দিন যাচ্ছে, যেতে থাক। সবকিছুই শেষ হয়। এই তো। ঘাড় গুঁজে, মুখ বুজে সময় তো চলেই গেল খানিকটা, সিংহভাগটা। আর কটাদিন এমনি করে রবি সুর ভেঁজে চালিয়ে দিতে পারলেই তো এই নরক গুলজারের অবসান।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় একেবারে বিপরীত কোনো ভাবনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ওই গান রচনা করেছিলেন। সেটা আমি জেনেবুঝেও এভাবে তাঁর সংগীতের অপব্যবহার করা ঠিক হলো কিনা তা আমার ওই পয়জন-মাউথড বসকে জিজ্ঞাসা করুন গিয়ে (এই ‘পয়জন-মাউথড’ ব্যাপারটা আমার বিশেষণ না, ধার করা… হয়তো আমার মতো কোনো ভুক্তভোগীর। আমি নিজের খবর রেখেই কূল-কিনারা করতে পারি না। তাই অন্যের ব্যাপারে খুব একটা উৎসাহ বোধ করি না। তবে ইথারে-বেতারে এরকম কিছু কানে চলে আসে বলে সেটার সুযোগমতো প্রয়োগ সম্ভব হয়)। দেখুন, গ্রহণযোগ্য কোনো উত্তর পান কিনা। আমার সাধারণজ্ঞান বলে, জবাব পাওয়া তো দূরের কথা, এমন কিছু শুনে-বুঝে আসবেন যে জীবনের বাকি সময়টা আর কখনো এই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বিস্মৃত হবেন না। আর যদি এমনটা না হয়ে তেমনটা হয় অর্থাৎ আমি যা বলেছি ঠিক সেরকম কিছু নয়, তাহলে ফেরত আসবেন পুরোটাই কনফিউজড হয়ে। তবে এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি, আপনারা তখন সন্দেহাতীতভাবে মেনে নিতে বাধ্য থাকবেন যে, আমার এই যখন-তখন যেখানে-সেখানে মানসিকভাবে অসংগতিপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপনের ব্যর্থ চেষ্টার মূল কারণ হলো গিয়ে তিনি। আমার এই ভয়াবহ মাত্রার ক্রনিক কিছুই ভালো না লাগা ব্যাধির প্রকৃত পটভূমি কোথায় রচিত হয়েছে তা এতক্ষণে এত শব্দ খরচ করে না বুঝিয়ে উঠতে পারলে আমাকে সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে হবে।  ভালো লাগে না… অবস্থা এমন হয়েছে          হয়তো সেখানেই আমার মুক্তি… আর আমি তাতেই তৃপ্ত… ফর দ্য টাইম বিয়িং, বলা বাহুল্য…।