ভাষণ

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনোত্তর ভাষণ

১০ জানুয়ারি, ১৯৭২, রেসকোর্স মাঠ, ঢাকা

আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সেপাই, সৈনিক, জনগণকে, হিন্দু-মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমি আপনাদের কাছে দু-একটি কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমার বাংলা স্বাধীন থাকবে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারবো না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যারা সংগ্রাম করেছে, আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে কেউ দাবায় রাখতে পারবে না। আমার বাংলার মানুষ স্বাধীন হবেই। আমি আমার সেই যে ভায়েরা যারা আত্মাহুতি দিয়েছে, শহিদ হয়েছে তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

আজ আমার মনে হয়েছে, প্রায় ত্রিশ লক্ষ লোককে মেরে ফেলে দেয়া হয়েছে এই বাংলায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও এবং প্রথম মহাযুদ্ধেও এতো লোক, এতো সাধারণ নাগরিক মৃত্যুবরণ করে নাই, শহিদ হয় নাই। যা আমার এই সাত কোটির বাংলাদেশে হয়েছে। আমি জানতাম না, আপনাদের কাছে আমি ফিরে আসবো। তাই আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম। তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও আমার আপত্তি নাই। মৃত্যুর পরে আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিও। এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে রাখলাম।

আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে। আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের জনসাধারণকে। আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের সামরিক বাহিনীকে। আমি মোবারকবাদ জানাই রাশিয়ার জনসাধারণকে। আমি মোবারকবাদ জানাই ব্রিটিশ, জার্মানি, ফ্রান্স সব জায়গায় যে গভর্নমেন্ট জনসাধারণ আছে, তাদের আমি মোবারকবাদ জানাই যারা আমাকে সমর্থন করেছে। আমি মোবারকবাদ জানাই আমেরিকার জনসাধারণকে। আমি মোবারকবাদ জানাই বিশ্ব দুনিয়ার মজলুম জনসাধারণকে যারা আমার এই মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য করেছে। আমার বলতে হয় এক কোটি লোক এই বাংলাদেশের থেকে ঘর-বাড়ি ছেড়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের জনসাধারণ মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাদের খাবার দিয়েছে। তাদেরকে মোবারকবাদ জানাতে পারি নাই। যারা, অন্যরা, সাহায্য করেছে, তাদেরকেও মোবারকবাদ দিতে হয়। তবে মনে রাখা উচিত বাংলাদেশ স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। বাংলাদেশকে কেউ দাবাতে পারবে না। বাংলার মধ্যে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি বলেছিলাম যাবার আগেও বাঙালি, এবার তোমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, তোমরা তাই করেছো। আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে সংগ্রাম করেছো। আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই। আমার বহু ভাই, আমার বহু কর্মী, আমার বহু মা-বোন, আজ দুনিয়ায় নাই। তাদের আমি দেখবো না। আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়া অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় বড় ভালোবাসি। খোদা তার জন্যই আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে।

আমি আশা করি, দুনিয়ায় সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন যে, আমার রাস্তা নাই, ঘাট নাই, আমার জনগণের খাবার নাই, আমার মানুষ গৃহহারা, সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি, তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো। মানবতার খাতিরে আমি তোমাদের কাছে সাহায্য চাই। দুনিয়ার সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। আমার বাংলাদেশকে তোমরা রিকগনাইজ কর, জাতিসংঘে স্থান দাও। দিতে হবে উপায় নাই। দিতে হবে। আমরা হার মানবো না, আমরা হার মানতে জানি না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সাত কোটি বাঙালেরে হে বঙ্গজননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি। কবিগুরুর মিথ্যা কথা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে, দুনিয়ার ইতিহাসে স্বাধীনতার সংগ্রামে এতো লোক আত্মাহুতি, এতো লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি, আমায় দাবায় রাখতে পারবা না। আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম, ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, কর্মীবাহিনী তোমাদের মোবারকবাদ জানাই। তোমরা গেরিলা হয়েছো, তোমরা রক্ত দিয়েছো, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই। একটা কথা, আজ থেকে বাংলায় যেন আর চুরি-ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়। বাংলায় যে লোকেরা আছে, অন্য দেশের লোক, পশ্চিম পাকিস্তানের লোক, বাংলায় কথা বলে না। আজও বলছি তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। আর আমরা আমার ভাইদের বলছি, তাদের ওপর হাত তুলো না। আমরা মানুষ, মানুষ ভালোবাসি। তবে যারা দালালি করেছে, যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। বিচারের দায়িত্ব বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন, একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে, আমি চাই স্বাধীন দেশে স্বাধীন নাগরিকের মতো স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আপনারা, আমি দেখায় দিবার চাই দুনিয়ার কাছে যে শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে। আমারে আপনারা পেয়েছেন আমি আসছি। জানতাম না আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়ে ছিলাম, বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু আইসে থাকে যদি আমি হাসতে হাসতে যাবো, আমার বাঙালি জাতিকে অপমান করা যাবে না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না এবং যাবার সময় বলে যাবো – জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান। ভাইয়েরা আমার, যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আপনারা জানেন আমি সমস্ত জনসাধারণকে বলতে চাই যেখানে রাস্তা ভেঙে গেছে নিজেরাই রাস্তা করতে শুরু করে দাও। আমি চাই জমিতে ধান বুনাও। সব কর্মচারীদের বলে দিবার চাই একজনও ঘুস খাবেন না। মনে রাখবেন তখন সুযোগ ছিল না। আমি দোষ ক্ষমা করবো না। ভাইয়েরা আমার, যাবার সময় যখন আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় তাজউদ্দীন, নজরুল এরা আমার কাছে যায়। আমি বলেছিলাম সাত কোটি বাঙালির সাথে আমাকে মরতে দে তোরা। আমি আশীর্বাদ করছি। তাজউদ্দীনরা কাঁদছিল, তোরা চলে যা, সংগ্রাম করিস, আমার আত্মা রইল, আমি এই বাড়িতে মরতে চাই, এই হবে বাংলার জায়গা, এই শহরে আমি মরতে চাই। ওদের কাছে মাথা নত করে আমরা পারবো না।

ভাইয়েরা আমার, ডক্টর কামালকে নিয়ে তিন মাস পর্যন্ত সেখানে ইন্টারোগেশন হয়েছে মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষী দাও। কয়েকজন বাঙালি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে। তাদের আমরা জানি এবং চিনি। তাদের বিচার হবে। আজ আমি বক্তৃতা করতে পারছি না। আপনারা বুঝতে পারেন। ‘নম নম নম সুন্দরী মম, জননী জন্মভূমি, গঙ্গার তীর সিক্ত সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।’ আমার জীবন আজ যখন আমি ঢাকায় নামছি। তখন অমি চোখের পানি রাখতে পারি নাই। আমি জানতাম না, যে মাটিকে আমি এতো ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এতো ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এতো ভালোবাসি, যে বাংলাদেশকে আমি এতো ভালোবাসি, সেই বাংলায় আমি যেতে পারবো কিনা! আজ আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি, আমার ভাইদের কাছে, আমার মাদের কাছে, আমার বোনদের কাছে, বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলার মানুষ আজ আমার স্বাধীন।

আমি পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের বলি, তোমরা সুখে থাকো, তোমাদের মধ্যে আমাদের ঘৃণা নাই। তোমাদের আমরা শ্রদ্ধা করতে চেষ্টা করবো। তোমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা যা করেছে, আমার মা-বোনের ওপর রেপ করেছে। আমার ৩০ লক্ষ লোককে মেরে ফেলে দিয়েছে। যাও সুখে থাকো। তোমরা সুখে থাকো। তোমাদের সঙ্গে আর না। শেষ হয়ে গেছে। তোমরা স্বাধীন থাকো। আমিও স্বাধীন থাকি। তোমাদের সঙ্গে আমার স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বন্ধুত্ব হতে পারে; তাছাড়া বন্ধু হতে পারে না। তবে যারা অন্যায় করেছে তাদের সম্বন্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হবে। আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চাই। আর একদিন আমি বক্তৃতা করবো, কিছুদিন পরে একটু সুস্থ হয়ে নেই। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন আমি সেই মুজিবর এখন আর নাই। আমার বাংলার দিকে চাইলেই দেখেন সমান হয়ে গেছে জায়গা, গ্রাম গ্রাম পোড়ায় দিয়েছে। এমন কোনো ঘর নাই যার মধ্যে আমার লোকদের হত্যা করা হয় নাই। কতো বড় কাপুরুষ যে নিরপরাধ মানুষকে এভাবে হত্যা করে সামরিক বাহিনীর লোকেরা। আর তারা বলে কি আমরা পাকিস্তানের মুসলমান সামরিক বাহিনী। ঘৃণা করা উচিত, তাদের জানা উচিত দুনিয়ার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পরে এই বাংলাদেশই দ্বিতীয় স্থান মুসলিম কান্ট্রি। মুসলমান সংখ্যায় বেশি; দ্বিতীয় স্থান। আর ইন্ডিয়া তৃতীয় স্থান, আর পশ্চিম পাকিস্তান চতুর্থ স্থান। আমরা মুসলমান, মুসলমান মা-বোনদের রেপ করে। আমরা মুসলমান! আমার রাষ্ট্রে এই বাংলাদেশে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা। এই বাংলাদেশে হবে গণতন্ত্র। এই বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। যারা জানতে চান, আমি বলে দিবার চাই, আসার সময় দিল্লিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সেসব আলোচনা হয়েছে। আমি আপনাদের বলতে পারি যে, আমি জানি তাকে, তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। সে পণ্ডিত নেহরুর কন্যা, সে মতিলাল নেহরুর ছেলের মেয়ে। তারা রাজনীতি করেছে, ত্যাগ করেছে। তারা আজকে সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছে। যেদিন আমি বলবো, সেইদিন ভারতের সৈন্য বাংলার মাটি ছেড়ে চলে যাবে এবং তিনি আস্তে আস্তে কিছু কিছু সরায় নিচ্ছেন। তবে যে সাহায্য করেছেন, আমি আমার সাত কোটি দুঃখী বাঙালির পক্ষ থেকে ইন্ধিরা গান্ধীকে, তার সরকারকে, ভারতের জনসাধারণকে, মোবারকবাদ জানাই। অন্তরের অন্তস্তল থেকে তাকে ধন্যবাদ জানাই। ব্যক্তিগতভাবে এমন কোনো রাষ্ট্রপ্রধান নাই যার কাছে তিনি আপিল করেন নাই যে, শেখ মুজিবকে ছেড়ে দাও। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে বলেছেন, তোমরা ইয়াহিয়া খানকে বলো শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। একটা রাজনৈতিক সলিউশন করার জন্য। এক কোটি লোক মাতৃভূমি ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে গেছে। এমন অনেক দেশ আছে যেখানে লোকসংখ্যা ১০ লাখ, ১৫ লাখ, ২০ লাখ, ৩০ লাখ, ৪০ লাখ, ৫০ লাখ। শতকরা ৬০টা রাষ্ট্র আছে যার জনসংখ্যা এক কোটির কম। আর আমার বাংলা থেকে এক কোটি লোক মাতৃভূমি ত্যাগ করে ভারতে স্থান নিয়েছিল। কতো লোক সেখানে অসুস্থ অবস্থায় মারা গেছে। কতো লোক না খেয়ে খেয়ে কষ্ট পেয়েছে। কতো লোকের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এই পাষণ্ডের দল। ক্ষমা করো আমার ভাইয়েরা, ক্ষমা করো। আজ আমার কারো বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা নেই। একটা মানুষকে তোমরা কিছু বলো না। অন্যায় যে করেছে তাকে সাজা দেব। আইনশৃঙ্খলা তোমাদের হাতে তুলে নিও না। মুক্তিবাহিনীর যুবকরা, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো। ছাত্রসমাজ, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো, শ্রমিকসমাজ, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো, কৃষকসমাজ, তোমরা আমার সালাম গ্রহণ করো। বাংলার হতভাগ্য হিন্দু-মুসলমান আমার সালাম গ্রহণ করো। আর আমার কর্মচারী, পুলিশ, বিডিআর, ইপিআর, যাদের ওপর মেশিনগান চালিয়ে দেয়া হয়েছে, যারা মা-বোন ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছে, তার স্ত্রীদেরকে গ্রেফতার করে কুর্মিটোলা নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তোমাদের সকলকে আমি সালাম জানাই, তোমাদের সকলকে আমি শ্রদ্ধা জানাই। নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা। বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে, এই আমার জীবনের সাধনা, এই আমার জীবনের কাম্য। আমি যেন এই দেশে এই চিন্তা করেই মরতে পারি। এই দোয়া এই আশীর্বাদ আপনারা আমাকে করবেন। এই কথা বলে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নেবার চাই। আমার সহকর্মীদের সকলকে আমি ধন্যবাদ জানাই, যারা আমার, যাদেরকে আমি যে কথা বলে গেছিলাম তারা সকলেই এখানে আছে। তারা একজন একজন করে তা প্রমাণ করে দিয়েছে যে না মজিব ভাই বলে গেছে তোমরা সংগ্রাম করো, তোমরা স্বাধীন করো, তোমরা জান দাও, বাংলার মানুষকে মুক্ত করো, আমার জন্য চিন্তা করো না, আমি চললাম, যদি ফিরে আসি আমি জানি ফিরে আসতে পারবো না, কিন্তু আল্লাহ্ আছে। তাই আজ আমি আপনাদের কাছে ফিরে এসেছি। তোমাদের আমি, আমার সহকর্মীরা, তোমাদের আমি মোবারকবাদ জানাই। আমি জানি কী কষ্ট তোমরা করেছো। আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম। নয় মাস পর্যন্ত আমাকে কাগজ দেয়া হয় নাই। এ কথা সত্য, আসার সময় ভুট্টো সাহেব আমাকে বলেছিলেন, শেখ সাহেব চেষ্টা করেন দুই অংশের কোনো একটা বাঁধন রাখা যায় কি-না। আমি বললাম, আমি কিছু বলতে পারি না, আমি কোথায় আছি জানি না। আমার বাংলা, আমার মাটিতে যেয়ে আমি বলবো। আজ বলছি, ভুট্টো সাহেব, সুখে থাকো বাঁধন ছুটে গেছে। তুমি যদি কোনো বিশেষ শক্তির সঙ্গে গোপন পরামর্শ করে আমার বাংলার স্বাধীনতা হরণ করতে চাও, এবার মনে রেখো, এবার তাদের নেতৃত্ব দেবে শেখ মুজিবুর রহমান, মরে যাবো, স্বাধীনতা হারাতে ছাড় দেবো না। ভাইয়েরা আমার, আমার ৪ লক্ষ বাঙালি আছে পশ্চিম পাকিস্তানে। আমি তাদের অনুরোধ করবো, তাদের একটা জিনিস আমি বলতে চাই, তোমাদের অ্যাপ্রুভাল নিয়ে আমার সহকর্মীরা, ইন্টারন্যাশনাল ফোরামে, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে, অথবা ওয়ার্ল্ড জুরিসডিকশনের পক্ষ থেকে একটা ইনকোয়ারি হতে হবে, যে কী পাশবিক অত্যাচার, কীভাবে হত্যা করেছে আমাদের লোকদের, এ সত্য দুনিয়ার মানুষকে জানাতে হবে। আমি দাবি করবো জাতিসংঘকে, হিউম্যান রাইটসকে, বাংলাদেশকে আসন দাও এবং একটি ইনকোয়ারি করো।

ভাইয়েরা আমার, যদি কেউ চেষ্টা করেন ভুল করবেন। আমি জানি ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই। সাবধান বাঙালিরা, ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই। একদিন বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করো, বলেছিলাম? বলেছিলাম যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধ করো, বলেছিলাম? বলেছিলাম এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এ সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এই জায়গায়। ৭ই মার্চ তারিখে। আজ বলে যাচ্ছি, তোমরা ঠিক থাকো, একতাবদ্ধ থাকো। কারো কথা শুনো না। ইনশাআল্লাহ্ স্বাধীন যখন হয়েছি, স্বাধীন থাকবো। একজন মানুষ এই বাংলাদেশে বেঁচে থাকতে কেউ আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারবে না।

আজ আমি আর বক্তৃতা করতে পারছি না। একটু সুস্থ হলে আবার বক্তৃতা করবো। আপনারা আমারে মাফ করে দেন। আপনারা আমারে দোয়া করেন। আপনারা আমারে দোয়া করবেন। আপনারা আমার সাথে সকলে আজকে একটা মোনাজাত করেন, আল্লাহুম্মা আমিন।

জয় বাংলা

জয় বাংলা

জয় বাংলা

বাংলাদেশ ভারত – ভাই ভাই …

ভাইয়েরা আমার,

শহীদের স্মৃতি, অমর হউক,

স্বাধীন বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।

[ওঙ্কারসমগ্র : বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের শ্রুতিলিপি, ঐতিহ্য, ২০১৭] ***

প্রথম স্বাধীনতা দিবসে ভাষণ

২৬ মার্চ, ১৯৭২, ঢাকা

আমার প্রাণপ্রিয় বীর বাঙালি ভাই ও বোনেরা, আমরা আজ স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তি উৎসব পালন করছি। এই মহান দিনে স্বাধীনতা অর্জনের পথে যে লক্ষ লক্ষ বীর শহিদ হয়েছেন তাঁদের জন্য গভীর বেদনা-আপ্লুত মন নিয়ে আমার শোকাতুর দেশবাসীর সাথে পরম করুণাময়ের দরবারে মাগফেরাত কামনা করছি। সেইসঙ্গে স্বাধীনতার সংগ্রামে গৌরবোজ্জ্বল ও অনন্য ভূমিকা পালনের জন্য আমি মুক্তিবাহিনীর সকল অঙ্গদল যথা বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সশস্ত্রবাহিনী …, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক-মজদুর, বুদ্ধিজীবী আর আমার সংগ্রামী জনসাধারণকে অভিনন্দন জানাই তাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও একনিষ্ঠ আত্মদান অনাগত কালের ভাবী বাঙালিদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

আমাদের মুক্তিসংগ্রামের অভিজ্ঞতা বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত মুক্তিপাগল জনতার চেতনাকে উদ্ভাসিত করবে।

আমার প্রিয় দেশবাসী, বিগত ২৫ বৎসর ধরে আপনারা ক্ষুধা, যন্ত্রণা, অশিক্ষা, সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরতন্ত্র, দারিদ্র্য ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী শোষকরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে একটা নিষ্ঠুরতম উপনিবেশে পরিণত করেছিল। দুঃসহ ও ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেও আমরা দিন কাটাচ্ছিলাম। পিষ্ট হয়েছিল শোষণের জগদ্দল পাথরের নিচে চাপা পড়ে। দারিদ্র্যের ও অনাহারের বিষবাষ্পে যখন আমরা আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তখন তদানীন্তন পাকিস্তান শোষকরা আমাদের কষ্টার্জিত ৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুট করে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তোলার কাজে মত্ত ছিল। ন্যায়বিচার, মৃত্যুর হিমশীতল কষ্ট আমাদের ওপর নেমে এসেছিল। সমসাময়িক কালের নিষ্ঠুরতম স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের ৩০ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছে। আজ তিন কোটি মানুষ হয়েছে সর্বস্বান্ত। এ সবকিছুই ঘটেছে আমাদের স্বাধীনতার জন্য। আজ আমি যখন আমার সোনার বাংলার দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই যুদ্ধবিধ্বস্ত ধূসর পাণ্ডুর জমিন। ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, ক্ষুধার্ত শিশু, বিবস্ত্র নারী আর হতাশাগ্রস্ত পুরুষ। আমি শুনতে পাই সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ। নির্যাতিতা নারীর ক্রন্দন, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ফরিয়াদ। আমাদের স্বাধীনতা যদি তাদেরকে আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ধার করে এদের মুখে হাসি ফোটাতে না পারে, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে তুলে দিতে না পারে এক মুঠো অন্ন, মুছে দিতে না পারে মায়ের অশ্রু ও বোনের বেদনা, তাহলে সেই স্বাধীনতা বৃথা, সে আত্মত্যাগ বৃথা। আমাদের এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতা বর্ষপূতি উৎসবের লগ্নে দাঁড়িয়ে আসুন আজ আমরা এই শপথ গ্রহণ করি, বিধ্বস্ত মুক্ত বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী নয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার ফসল ভোগ করবে। আমি ভবিষ্যৎ বংশধরদের … উন্নত জীবন পরিবেশের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আজ আমাদের সামনে পর্বততুল্য সমস্যা উপস্থিত। মহাসংকটের ক্রান্তিলগ্নে আমরা উপস্থিত হয়েছি। বিদেশফেরত এক কোটি উদ্বাস্তু। স্বদেশের বুকে … গৃহহারা মানুষ। বিধ্বস্ত কর্মহীন চালনা, চট্টগ্রাম পোতাশ্রয়। নিশ্চল কারখানা, নির্বাসিত বিদ্যুৎ সরবরাহ, অসংখ্য বেকার, অপরিবেশে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, বাণিজ্যিক অচল অবস্থা, ভগ্ন সবকিছু ও বিচ্ছিন্ন বন্দোবস্ত ব্যবস্থা, দারিদ্র্য, খাদ্যাভাব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অকর্ষিত জমি সবকিছুই আমরা পেয়েছি উত্তরাধিকারসূত্রে। জনকল্যাণের গভীর ভালোবাসা, আস্থা, অদম্য সাহস, অতুলনীয় ঐক্য, এগুলিকে সম্বল করেই আমার সরকার এই মহাসংকট কাটিয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। আমি আশা করবো এই যে আপনারা যেভাবে দুর্জয় সাহসে বুক বেঁধে ইয়াহিয়ার সামরিকতন্ত্রকে পরাভূত করেছিলেন, গভীর প্রত্যয় ও সাহস নিয়ে তেমনি বর্তমান সংকটের মোকাবিলা করবেন। আমরা পুরাতন আমলের ছিন্ন ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে নূতন সমাজ গড়ে তুলবো।

 ভাই ও বোনেরা, আপনারা জানেন, হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের বাংলার রাইফেলস ও পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্যকে হত্যা করেছে। আইনের শাসন কায়েম, শান্তি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংগঠনের অভাব বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। … আমরা পুলিশ বিভাগকে সংগঠিত করেছি। ইতিমধ্যেই সে সকল সমাজবিরোধী দুষ্কৃতিকারী স্বাধীনতা-উত্তর সুযোগ-সুবিধাদির অপব্যবহারে লিপ্ত হয়েছিল তাদের দমন করে জনসাধারণের মনে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করেছি। … আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন জাতির জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী একটি প্রাদেশিক প্রশাসনিক কাঠামো। এর কিছু কিছু আমলা, ঔপনিবেশিক মানসিকতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। তারা এখনো বনেদি আমলাতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয় দিয়ে চলেছে। আমাদের দেশের স্বাধীন জাতীয় সরকারের অর্থ অনুধাবনের জন্য উপদেশ দিচ্ছি এবং আশা করছি তাদের পশ্চাৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করবে। এই সরকার নব রাষ্ট্র ও নতুন সমাজের উপযোগী করে সমগ্র প্রশাসনযন্ত্রকে পুনর্গঠন করতে চায়। প্রস্তাবিত প্রশাসন কাঠামোকে জনগণ ও সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নৈকট্য সৃষ্টির পূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করার চেষ্টা করছে। আমরা বাংলাদেশের সমস্ত মহকুমাগুলোকে জেলা পর্যায়ে উন্নত করার পরিকল্পনা নিয়েছি। বিশেষজ্ঞরা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তাদের কাজ অনেকটা অগ্রসর হয়েছে এবং শাসনতন্ত্র গণপরিষদের সামনে পেশ করা হবে। এই শাসনতন্ত্রের মূলস্তম্ভ হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ৫৪টি বন্ধু রাষ্ট্র এ-পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। … উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য আমরা বন্ধুরাষ্ট্রের কাছ থেকে উদার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। বিশেষ করে ভারত আমাদের সুদিন ও দুর্দিনের প্রতিবেশী। সম্প্রতি মহান ভারতের মহান নেতা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে সফর করে গেছেন। এই শুভেচ্ছা সফরের প্রাক্কালে আমরা শান্তি ও বন্ধুত্ব ও মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি। এই চুক্তি দুই দেশের মেহনতি মানুষের শুভেচ্ছা, সহযোগিতা, বন্ধুত্ব এবং বন্ধনকে মজবুত করবে বলে আমি আশা করি। সোভিয়েত রাশিয়া আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুর্যোগময় মুহূর্তে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি সোভিয়েত রাশিয়া সফর করে এসেছি। সেখানে তাদের অকৃত্রিম আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ বিপর্যস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের কাজে সর্বাধিক সার্বিক সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে আমি পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রপুঞ্জ, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম র্জামানি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলি এবং অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রসমূহ যারা আমাদের দিকে সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তাদের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি জোটবহির্ভূত এবং সক্রিয় নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে রচিত। বৃহৎ শক্তির আন্তর্জাতিক সংঘাতের বাইরে আমরা শান্তিকামী। আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী এবং প্রতিবেশীর সাথে সদ্ভাব সৃষ্টিতে আগ্রহী। দেশ গড়ার কাজে কেহ আমাদের সাহায্য করতে চাইলে তা আমরা গ্রহণ করবো, কিন্তু সে সাহায্য অবশ্যই হতে হবে নিষ্কণ্টক এবং শর্তহীন। আমরা জাতীয় সার্বভৌমত্ব, সব জাতির সমমর্যাদার নীতিতে বিশ্বাসী। আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেউ হস্তক্ষেপ করবে না এটি আমরা আশা করি। দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানের শাসক বাংলাদেশের বাস্তবকে মেনে নিচ্ছে না। তারা ৫ লক্ষ নিরীহ বাঙালিকে সন্ত্রাস ও দুর্দশার মধ্যে আটকে রেখেছে। বিশ্বব্যাপী বিবেকসম্পন্ন মানুষ বিশেষ করে মি. ভুট্টোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হোক। এই ইস্যুকে কোনোক্রমেই যুদ্ধবন্দিদের সাথে সমপর্যায়ে ভাবা চলবে না। কারণ তাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে যারা শতাব্দীর নৃশংসতম হত্যা অপরাধে অপরাধী। তারা মানবাধিকারকে লংঘন করেছে। আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালার ভিত্তিতে তাদের বিচার করতে হবে। পাকিস্তানের সংবেদনশীল সাধারণ মানুষের কাছে আমার আবেদন, নুরেমবার্গ মামলার অসামিদের থেকেও নিষ্ঠুর ধরনের এই অপরাধীদের তারা জাতি বলে ভাববেন না।

যারা উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তারা দেশে ফিরে এসেছে। সাহায্য পুনর্গঠন, পুনর্বাসনের জন্য আমরা কার্যকরী কর্মসূচি গ্রহণ করতে চেষ্টা করছি। বিনামূল্যে ও ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ কিছুটা হয়েছে। ছিন্নমূল মানুষের মাথা গোঁজবার মতো করে কয়েকদিনের জন্য অস্থায়ী বাসগৃহ তৈরির কাজ হাত দেওয়ার চেষ্টা হইতেছে। বিধবা, অনাথ ও নির্যাতিত মহিলাদের পুনর্বাসন পরিকল্পনাকে সরকার অগ্রাধিকারভিত্তিক বিবেচনা করেছে। হানাদার পাকিস্তান বাহিনী যেভাবে বাংলাদেশকে ধ্বংস করে গেছে তাতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধারে কয়েক বছর সময় লাগবে। তবে বিপ্লবী সরকার আশা করছে যে তিন বছর সময়ের মধ্যে এ কাজ সমাধা করা যাবে। বিপুল খাদ্য ঘাটতি আমাদের জন্য এক দুঃসহ অভিশাপ। কিন্তু আমি কাউকে না খেয়ে মরতে দিতে চাই না। আগামী জুলাই মাসের মধ্যে আশা করি ১০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আনতে পারবো। আর ডিসেম্বরের মধ্যে আরো ১০ লক্ষ টন আমদানি করার ব্যবস্থা করা হইতেছে। সামনের কয়েক সপ্তাহ আমাদের জন্য বড় দুর্দিন। আমার প্রাণপ্রিয় দেশবাসী, আপনারা ধৈর্য ধারণ করুন। উচ্চতম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খাদ্য ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মজুদদার, চোরাকারবারি ও … বিলাসীদের হুঁশিয়ার করতেছি, তারা যেন নিরন্ন মানুষের মুখের রুটি নিয়ে ছিনিমিনি না খেলে। তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে। এজন্য আমি জনগণের সাহায্য এবং সহযোগিতা চাইছি।

আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী এবং সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজ তো চাট্টিখানি কথা নয়। আমার সরকার, আমার পার্টি বৈজ্ঞানিক, সমাজতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এদেশের বাস্তবিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে পুরাতন সামাজিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে। শোষণ, অবিচার মুক্ত নূতন সমাজ আমাদের গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে এবং জাতির এই মহাক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে সম্পদের সামাজিকীকরণে পর্যায়ক্রমিক … শুভ সূচনা হিসেবে আমরা উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো জাতীয়করণ করছি। ব্যাংকসমূহ, বিদেশি ব্যাংকের শাখাসমূহ বাদে সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানিসমূহ, বিদেশি সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানিসমূহ বাদে সকল পাটকল, সকল বস্ত্র ও সুতা, সকল চিনিকল, অভ্যন্তরীণ উপকূলীয় নৌযানের বিরাট অংশ, ১৫ লক্ষ টাকা মূল্যেও … সকল পরিত্যক্ত ও অনুপস্থিত মালিকানাভুক্ত সম্পত্তি, বাংলাদেশ বিমান ও বাংলাদেশ সিভিল করপোরেশনকে সরকারি সংস্থা হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে। সমস্ত বহির্বাণিজ্যকে রাষ্ট্রীয়করণের লক্ষ্য নিয়ে সাময়িকভাবে বহির্বাণিজ্যের বৃহৎ অংশকে এই মুহূর্তে … বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত বাঙালি প্রতিভাবান ব্যক্তিদের আমি দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সরকারি সেক্টরে কাজ করার জন্য তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। শিগগির একটি কমিটি ঘোষণা করা হচ্ছে। তাতে এসব ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হবে। এ সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে বাঙালিদের মালিকানার স্বার্থ সরাসরি জড়িত, সে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের সাবেক মালিক অথবা প্রধান কর্মকর্তাদের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি যে, তারা যেন এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনায় দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়। আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, আমরা যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি এগুলো সব দিক থেকে বাস্তব এবং জনসাধারণকে অবশ্যই এসব ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করে তুলতে হবে।

বেসরকারি ক্ষেত্রে মাঝারি ও ছোট শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর আমাদের নীতির নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সরকারি নীতির মধ্য থেকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কাজ ন্যায্যভাবে চালানোর জন্য উৎসাহ দেয়া হবে। আমি এমন একটা নীতিনির্ধারণ করতে চাই যাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যকরী নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতে পারে। এই বলিষ্ঠ নিরীক্ষা চালানোর ব্যাপারে মেহনতি শ্রেণির কর্তব্যবোধের ওপর আমরা অনেকখানি নির্ভর করি। শ্রম ও পুঁজির মধ্যে আবহমান কাল ধরে যে পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে আমাদের নতুন নীতি গ্রহণের ফলে বাংলাদেশের থেকে তা অনেকখানি বিলুপ্ত হবে। শ্রমিক-কর্মচারীদের সর্বদা মালিকের সাথে বিরোধিতায় লিপ্ত থাকতে হবে না। বর্তমানে তাদের মালিক হলো বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। যারা মালিক ও ম্যানেজারদের হাতে নিঃস্বার্থে নিজেদের সম্পত্তি জমা রেখেছে। আমি খুব শীঘ্রই শ্রমিক ইউনিয়নের একটি সভা আহ্বান করেছি। সেই সভায় শ্রমিক সংক্রান্ত সরকারি নীতি এবং আমাদের বিপ্লবী নীতিসমূহ বাস্তবায়িত করতে তাদেরকে যে পূর্ণ সহযোগিতা লাগবে এটা আলোচনা করবো। এ ব্যাপারে পূর্ণ মতৈক্যে পৌঁছানোর পরে আমি আশা করবো শ্রমিক নেতারা আমার সরকার ও আমার সাথে একযোগে কাজ করবেন এবং এই বিপ্লবী নীতিসমূহ সরাসরি শিল্প এলাকায় কার্যকরী করবো। তদুপরী শ্রমিকদের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত করতে হবে। আমার ছাত্র-ভাইয়েরা, যারা মুক্তি সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তাদের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন আমাদের বিপ্লবের লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য তাদের কাজ করে যেতে পারেন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিপ্লব সাধনের লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা তৈরি করাসহ একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। …  

আমাদের সমাজে চাষীরা হলো সবচেয়ে শোষিত ও নির্যাতিত এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে। সম্পদের স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও, আমরা চাষীদের স্বল্পমেয়াদি সাহায্যদানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। ২৫ বিঘার চেয়ে কম জমি যাদের আছে তাদের খাজনা চিরদিনের জন্য মওকুফ করে দেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বের সমস্ত বকেয়া খাজনা মাফ করা হয়েছে। তাগাবি ঋণ বাবদ ১০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে এবং আরো ১৬ কোটি টাকার ক্যাশ বিতরণ করা হয়েছে। লবণের ওপর থেকে কর তুলে দেয়া হয়েছে। সারা বছর ধরে সেচের কাজ চালানো, উন্নতমানের বীজ বপন, সার, কীটনাশক ঔষধ, চাষীকে পর্যাপ্ত ঋণদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভূমি মালিকানার ক্ষেত্রে পশ্চাতের বৈষম্য দূর করার জন্য পারিবারিক, ব্যক্তিগত মালিকানা … ১০০ বিঘায় আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে তা আরো কমিয়ে আনা যায় কিনা চেষ্টা করছে। … এ অবস্থা মনে রেখে পল্লী এলাকায় ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করতে চেষ্টা করছে। এর ফলে চাষীরা আধুনিক ব্যবস্থা শুরু করেছে এবং সমবায়-এর মাধ্যমে সহজ শর্তে দ্রুত ঋণ পাবে। এরই সাথে আমাদের উদ্দেশ্য হলো ভূমিহীন, স্বল্প জমির অধিকারী চাষীদের জন্য ব্যাপক পল্লী সংগঠন গড়ে তোলা। … এই সংগঠনের অংশ হিসেবে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার টন খাদ্য বরাদ্দ হয়েছে। এছাড়া টেস্ট রিলিফের অধীনে পল্লীর সংগঠনের জন্য নগদ ১৬ কোটি টাকা দেয়া হয়ে গেছে। আমরা আমাদের এ উদ্যোগ বেকার যুবকদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চাই, …

এই সরকার নগরভিত্তিক ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যকার বৈষম্য সম্পর্ক সচেতন। সেসব ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার যারা পাটচাষীদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে মানুষ হয়েছেন তাদেরকে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। আমি ইতিমধ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামে কাজ করার জন্য ৫০০ ডাক্তারকে নিযুক্ত করেছি। বাংলাদেশের মানুষে মানুষে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বণ্টনব্যবস্থার সমতা আনতে হবে। উচ্চতর আয় ও নিম্নতম উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ ছিল তা দূর করার ব্যবস্থা বের করার জন্য আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি। আজ আমরা বিংশ সভ্যতার এক ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত, নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর। একটি সামাজিক বিপ্লব সফল করার প্রতিশ্রুতিতে আমরা অটল। আমাদের সমস্ত নীতি, আমাদের সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টা এ-কাজে নিয়োজিত হবে। আমাদের দুর্লঙ্ঘ্য পথ। এ-পথ আমাদেরই অতিক্রম করতে হবে। আমার প্রিয় দেশবাসী, লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের লাল অন্তরালে দাঁড়িয়ে আমরা আপনাদের কাছে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবো না। আমি জীবনে কোনোদিন প্রতিশ্রুতি কারো কাছে দেই নাই। শত্রুরা বাংলাদেশকে শেষ করে দিয়ে গেছে। কিছুই রেখে যায় নাই। কী করে যে এই দেশ চলছে। সত্যই চিন্তা করলে আমি শিহরিয়া উঠি। তবে আমি আপনাদেরকে নির্দিষ্ট আশা দিচ্ছি, শহীদের রক্ত বৃথা যেন না যায়। … বাংলাকে আমরা সোনার বাংলায় গড়ে তুলতে চাই। সে বাংলার আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলবো। আপনারা নিশ্চয়ই আমার সাথে সহযোগিতা করবেন। ক্ষেত-খামার কারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমেই দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেত হয়ে আমরা চেষ্টা করি যেন সোনার বাংলা আবার হবে। সোনার বাংলা যেন আবার নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।

জয় বাংলা।

[ওঙ্কারসমগ্র : বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের শ্রুতিলিপি, ঐতিহ্য, ২০১৭]

সমবায়ের ওপর ভাষণ

৫ এপ্রিল, ১৯৭২, বাংলাদেশ বেতার

আজকে কী? আজ আমাদের কী অবস্থা? আজ আমাদের পপুলেশন, আজকে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। আজ আমরা শ্রমিক আন্দোলন করবো। কী করবো? কারখানায় কাজ হবে না। কারখানায় প্রোডাকশন না বাড়াইয়া – ভিক্ষুকের জাতির কোনো ইজ্জত আছে? দুনিয়ায় জীবনভরে ভিক্ষা পাওয়া যায়? স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। সেজন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন রয়েছে।

কাজ করবো না ফাঁকি দেবো, অফিসে যাবো না ফাঁকি দেবো, ফ্রি স্টাইল! ফ্রি স্টাইল মানে গণতন্ত্র নয়।অফিসে ১০টার সময় যাওয়ার কথা বলে ১২টার আগে যাব না। ছুটি ৫টায় হলে ৩টায় ফিরে আসতে হবে। কারখানায় কাজ করবো না। পয়সা দিতে হবে।

আমার কৃষকরা খারাপ নয়। আমার কৃষকরা কাজ করতে চায়। আমার কৃষকরা এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা বাধার সৃষ্টি করি। আমরা ষড়যন্ত্র করি। আমরা লুট করে খাই। আমরা জমি দখল করে লোক নিয়ে যাই। আমরা যারা বড় বড় এখানে আছি তারা এ সমস্ত করে। তারা কারা? তারা এই দেশের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ। এই দেশের তথাকথিত লেখাপড়া করা মানুষ। যাদের পেটের মধ্যে দুই অক্ষর বুদ্ধি, ওই বাংলার দুঃখী মানুষের কথা তারা ভুলে যায়।

 – আমি কী পেলাম, আমি কী পেলাম? আমি বারবার বলেছি – আজকে আমাদের আত্মসমালোচনার প্রয়োজন। আজকে আমাদের আত্মসংযমের প্রয়োজন, আজকে আমাদের আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন। না হলে দেশকে ভালোবাসা যায় না। দেশের জন্য কাজ করা যায় না। কল-কারখানায়, ক্ষেত-খামারে আমার প্রোডাকশন বাড়াতে হবে। তা না হলে দেশ বাঁচতে পারে না। কী করে আপনি করবেন? ধরেন, বিশ লক্ষ টন খাবার যদি বৎসরে হয় কত হয়? কমপক্ষে ৫৪০ লক্ষ মণ, হ্যাঁ, ৫৪০ লক্ষ মণ …। – প্রত্যেক বৎসর বিদেশ থেকে, এ তিন বৎসরে বন্ধুরাষ্ট্ররা সাহায্য করেছে, ত্রাণ দিয়েছে, লোন দিয়েছে, আনতেছি, খাবার-দাবার বন্দোবস্ত হয়েছে। কতকাল ধরে কতদিন ধরে? মানুষ বাড়তেছে। বৎসরে ত্রিশ লক্ষ লোক আমার নতুন বাড়ে। আজকে আমাদের পপুলেশন প্ল্যানিং করতে হবে। পপুলেশন কন্ট্রোল করতে হবে। না হলে বিশ বৎসর পরে ১৫ কোটি লোক হবে, ২৫ বৎসর পরে…। ৫৪ হাজার স্কয়ার মাইল। বাঁচতে পারবেন না। যেইখানে গিয়ে থাকুন বাঁচার উপায় নাই। পপুলেশন কন্ট্রোল আমাদের করতে হবে। প্রোডাকশন বাড়াতে হবে। না হলে মানুষ বাঁচতে পারবে না এবং এজন্য তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে হবে। বিশৃঙ্খল জাতি কোনোদিন বড় হতে পারে না। উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গিয়েছি আমরা। ফ্রি স্টাইল! এটা হবে না, ওটা হবে না। যাকে অ্যারেস্ট করবো, বলবে যে অমুক পার্টির লোক, ওরে অ্যারেস্ট করবো অমুক পার্টির লোক।

খবরের কাগজে বিবৃতি, জিনিস এক জায়গায় দাম ১১০ টাকা হলে, হঠাৎ এক জায়গায় দাম ২০০ টাকা হয়ে গেল। খবরের কাগজ ছাপাইয়া দিলো হোল বাংলাদেশে ২০০ টাকা হয়ে গেল।

যেখানে সমস্ত কিছুর অভাব, যেখানে দুনিয়ার কাছে সবকিছু কিনতে হয়। আমরা কলোনি ছিলাম, আমরা কোনো জিনিসে সেলফ সাফিশিয়েন্ট ছিলাম না। আমরা তেলে সাফিশিয়েন্ট না, আমরা কাপড়ে সেলফ সাফিশিয়েন্ট না, আমরা খাবারে সাফিসিয়েন্ট না, আমাদের র-ম্যাটেরিয়াল কিনতে হবে, আমরা ওষুধে সাফিশিয়েন্ট না, আমরা কলোনি ছিলাম পাকিস্তানিদের। আমাদের কিছু প্রডিউস করতে হবে। সবকিছু বিদেশ থেকে আনতে হবে? কোথায় পাবেন বৈদেশিক মুদ্রা? আপনাদের প্রয়োজন বুঝতে হবে, ইনকাম করতে হবে। এই কাজ করতে হবে। ভিক্ষা করে, যে মানুষ ভিক্ষা করে, তার কোনো ইজ্জত থাকে না, যে জাতি ভিক্ষা করে তাদেরও ইজ্জত থাকে না। ভিক্ষুকের জাতির নেতৃত্ব করতে আমি চাই না। আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক এবং সেই জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। শৃঙ্খলা আনতে হবে।

আগে আত্মসমালোচনা করেন, আত্মশুদ্ধি করেন। তাহলে হবেন মানুষ। এ কি হয়েছে সমাজের? সমাজ যেন ঘুণে ধরে গেছে। এ-সমাজকে আমি চরম আঘাত করতে চাই। এই আঘাত করতে চাই, যে-আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানিদের। সেই আঘাত করতে চাই এ-ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থাকে।

আমি আপনাদের সমর্থন চাই। আমি জানি আপনাদের সমর্থন আছে। কিন্তু একটা কথা, এই যে নতুন সিস্টেমে যাচ্ছি আমি, গ্রামে-গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল কইরেন না, আপনাদের জমি আমি নেবো না, ভয় পাইয়েন না যে জমি নিয়ে যাবো, তা নয়। ৫ বৎসর প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটি করে কো-অপারেটিভ হবে প্রত্যেক গ্রামে-গ্রামে। এ কো-অপারেটিভে জমির মালিক জমিতে থাকবে। কিন্তু তার অংশ যে, বেকার প্রত্যেকটা মানুষ, যে মানুষ কাজ করতে পারে তাকে সেই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে এবং বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। আল্টিমেটলি ৬৫ হাজার ভিলেজে একটা করে কো-অপারেটিভ করা হবে, ৫ বৎসরের প্ল্যান নেওয়া হয়েছে। তাদের কাছে পয়সা যাবে, তাদের কাছে ফার্টিলাইজার যাবে, তাদের কাছে তেল যাবে, তাদের কাছে দাম যাবে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল, টাউটদের দল বিদায় দেয়া হবে। তা না হলে দেশ এগোনো যায় না। এজন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি আজকে, এ ৫ বৎসর প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে ৫০০ থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত কম্পালসারি কো-অপারেটিভ। আপনার জমির ফসল আপনি নেবেন। অংশ যাবে কো-অপারেটিভে, অংশ যাবে গভর্নমেন্টের হাতে। …

[এই ভাষণটির শেষাংশ রেকর্ডে পাওয়া যায়নি বলে অসম্পূর্ণ প্রকাশ হলো]।
[ওঙ্কারসমগ্র : বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের শ্রুতিলিপি, ঐতিহ্য, ২০১৭]

জুলিও কুরি শান্তিপদক পেয়ে ভাষণ

২০ নভেম্বর, ১৯৭২

আওয়ামী লীগ-আয়োজিত সংবর্ধনা সভা

উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, আজ আমাকে জুলিও কুরি শান্তিপদক প্রদান করেছে বলে আমারই দলের থেকে, আওয়ামী লীগের থেকে, সংবর্ধনা জানাচ্ছে। সত্য কথা বলতে কী, আমি এর যোগ্য কিনা আমি জানি না। তবে এ সম্মান আমার নয়, এ সম্মান লক্ষ লক্ষ শহিদ ভাইদের, শহিদ বোনদের, নির্যাতিত বোনদের, বাংলার দুঃখী মানুষের, সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণের, আমার মুক্তিযোদ্ধা ও পঙ্গু ভাইদের এবং দেশের সর্বসাধারণ মানুষের। এ সম্মান বাংলার জাগ্রত মানুষের, যারা সংগ্রাম করেছে শান্তির জন্য। শান্তি, শান্তির পথ ও সংগ্রামের পথ। শান্তি আনতে হলেও সংগ্রামের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমরা চাই, আমরা বিশ্বাস করি, শান্তিতে বাস করতে চাই,সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে চাই, পেট ভরে খেতে চাই, শোষণহীন সমাজ গড়তে চাই, দুনিয়া থেকে শোষণ বন্ধ হোক এটাই আমরা বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাস করি। আজ বিশ্বশান্তির প্রয়োজন। বাংলার মানুষ শান্তিতে অত্যন্ত বিশ্বাস করে। শান্তিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বাংলার নাম আছে। কিন্তু অত্যাচার, অবিচার, জুলুমের বিরুদ্ধেও বাংলার মানুষ দাঁড়াতে জানে। সে প্রমাণও বাংলার ইতিহাসে পাওয়া যায়। যুগ যুগ ধরে আমরা বাঙালিরা পরাধীন ছিলাম। আমরা শোষিত, আমাদের সম্পদ লুট করে নেওয়া হয়েছে। অনাচার, অবিচারে বাংলার মানুষ আজ ওষ্ঠাগত। দুর্ভিক্ষ, মহামারি, চারিদিকে হাহাকার। বাংলার সম্পদ লুট করে নিয়েছে শোষকরা। আমরা কাউকে শোষণ করতে চাই নাই, আমরা শোষিত হতে চাই নাই। আমরা শান্তিতে আমাদের সম্পদ ভোগ করতে চেয়েছি। কিন্তু বাংলা, বারবার সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমাদের ওপর আঘাত করেছে। আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করি এই জন্য যে, দুনিয়ায় শান্তি কায়েম হোক। আজ দুঃখের সঙ্গে আমাদের বলতে হয়, জানি না আমার মুখে এটা শোভা পায় কি না, কিন্তু দুনিয়ায় যারা আজ শক্তিশালী দেশ, যারা আজ অস্ত্র প্রতিযোগিতায় মত্ত, যারা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করছেন ধ্বংস করার, অস্ত্র তৈরি করার জন্য, তারা যদি এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা না করে এই সম্পদ যদি দুনিয়ার দুঃখী মানুষের জন্য ব্যয় করতো, তাহলে দশ বছরের মধ্যে দুনিয়াতে কোনো দুঃখী মানুষ না খেয়ে কষ্ট পেত না। তারা যখন বড় কথা বলেন, তারা যখন অস্ত্র প্রতিযোগিতা করেন, তারা যখন বড় বড় বোমা তৈরি করেন মানুষকে ধ্বংস করার জন্য এবং পাশে পাশে শান্তির কথা বলেন, তখন সত্যিই কষ্ট হয়। কারণ মানবজাতি দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন যুগে বাস করেছে, বাস করে। তাদের কৃষ্টি, তাদের সভ্যতা, তাদের ভাষা নিয়ে তারা বাস করতে চায়। তারা চায় দুনিয়াতে শান্তি। তারা শান্তিতে দেশকে গড়তে চায়। কিন্তু আজ দুনিয়ার বৃহৎ শক্তি যদি আজ সত্যিকারে মানুষকে ভালবাসতো, যেখানে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষ আজ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে, যেখানে লক্ষ কোটি মানুষ আজ পথের ভিখারি, যেখানে কোটি কোটি মানুষ আজ গৃহহারা, সর্বহারা, যেখানে যারা আজ অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অস্ত্র তৈরি করে অর্থ নষ্ট করেন, তারা যে-কথাই বলুন না কেন তারা বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাস করেন কি না আমি জানি না। কিন্তু আমরা যারা দুঃখী মানুষ, যাদের দেশের শতকরা আশিজন মানুষ আজ পেট ভরে খেতে পায় না, তারা আমরা দুনিয়ায় শান্তি চাই, তাদের সকলের কাছ থেকে সহযোগিতা চাই। যাতে আমাদের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারি, আমরা শান্তি কায়েম করতে পারি। আজ কী দেখতে পাই আমরা? আজ এখনো আফ্রিকাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অত্যাচার করে জাতীয় গণআন্দোলনকে দমন করে রাখতে চেষ্টা করছে। আজ দেখতে পাই আমরা মধ্য এশিয়ায় সেই জুলুম চলেছে। আজ দেখতে পাই আমরা সাউথইস্ট এশিয়ায় সেই জুলুম চলেছে। আমরা দেখতে পাই দাবা খেলার দুনিয়ায় সমস্ত বড় বড় শক্তির দ্বারা যার জন্য আমাদের অনেক দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে কোটি কোটি মানুষ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যুদ্ধ আমরা চাই না। দুনিয়ার সব সমস্যাই সমাধান করা যায় আলোচনার মাধ্যমে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে যদি আলোচনা করা যায়, এমন কোনো সমস্যা নাই যা আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধান করা যায় না। তবে কেন হানাহানি? তবে কেন অস্ত্রের প্রতিযোগিতা? তবে কেন শোষণ করার এ মনোভাব? যদি আজ কেউ মনে করে থাকেন, তাদের ভুল ভাঙবে এমন দিন আসবে। যখন মানুষ আজ জাগতে শিখেছে, মানুষ যখন আজ বুঝতে শিখেছে, মানুষ যখন তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। কোনো দেশ কোনো দেশকে চিরদিনের জন্য দখল করে, জুলুম করে শোষণ করতে পারে না। দেখা যায় দুনিয়াতে বড় বড় অনেক শক্তি আছেন, কারো বিরুদ্ধে আমি বলতে চাই না, কারো বিরুদ্ধে আমি নই। কারণ আমার বিরুদ্ধে যাওয়ার শক্তি বা কোথায়? আর তার বিরুদ্ধে আমি কী করতেই বা পারি? তবে এইটুকু বলতে পারি, যদি বিশ্ব দুনিয়ার মানুষ শান্তির জন্য পাগল হয়ে যায়, বিশ্ব দুনিয়ার জনমতকে ধ্বংস করার শক্তি কারো থাকে না। তাই বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে হবে। যাতে আমরা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। হানাহানি, দাঙ্গা, মারামারি, যুদ্ধ দুনিয়া থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে যাক। এইটাই আমরা কামনা করি।

আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, বক্তৃতা আমি করতে চাই না। বাংলার মানুষ শান্তির জন্য সংগ্রাম করে ত্রিশ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছে। বাংলার বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলার সম্পদ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে গেছে। তাদের বিরুদ্ধেও আমার কিছু নাই। তাদেরও বাংলার মানুষ ক্ষমা করতে রাজি আছে। তারাও সুখে বাস করুক আমরা চাই কিন্তু তাদের জ্ঞান ফিরে আসুক। তারা যে অন্যায় করেছে সেটা স্বীকার করুক। তারা দুঃখ প্রকাশ করুক। তারা অন্যায়, অবিচার, জুলুম করেছে সেটাকে তারা দুনিয়ার কাছে বলুক এবং তাদের মনের মধ্যে এটা যেন, তারা যেন আঘাত পায় যে অন্যায় তারা করেছে। খোদাও মাফ করবে, জনগণও মাফ করবে এবং বন্ধুত্বও কায়েম হতে পারে। কিন্তু সে অন্যায়কে যদি তারা বলে যে এটা ভালো, সে অন্যায়কে যদি তারা বলে যে এটা অন্যায় করা হয় নাই, আমরা ঠিক করেছি। যদি তারা বলে যে, আমরা যে হত্যা করেছি, আমরা যে লুট করেছি, আমরা যে নির্যাতন করেছি, আমরা যে মহিলাদের ওপর অত্যাচার করেছি, এটা আমরা ঠিকই করেছি, তাহলে দুনিয়ায় শান্তি ফিরে আসতে পারে না। দেশে দেশে বন্ধুত্ব হতে পারে না। তাই আমরা এশিয়াতে বাস করি। আমরা এশিয়াবাসী অনুন্নত। শান্তি আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন। শান্তি এ জন্য প্রয়োজন, আমাদের দেশ গঠনের কাজে প্রয়োজন। কোনো কোনো দেশ তাদের আয়ের শতকরা ষাট ভাগ, সত্তর ভাগ অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় করেন। অস্ত্র দিয়ে যে দেশ জয় করা যায় না তা তাদের বোঝা উচিত। অস্ত্র দিয়ে যে দেশকে অধিকার করে রাখা যায় না তা তাদের জানা উচিত। বাংলাদেশের মানুষ তা প্রমাণ করে দিয়েছে। বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তান অস্ত্র ব্যবহার করেছে বাংলার মাটিতে। কিন্তু বাংলার মানুষ নিরস্ত্র অবস্থায় তাদের মোকাবিলা করেছে এবং দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়াতে যে, সংঘবদ্ধ মানুষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আমি কোনোদিন বিশ্বাস করি না, আমার বাংলাদেশের মানুষও বিশ্বাস করে না যে, বন্দুকের নলই হলো শক্তির উৎস। আমরা বিশ্বাস করি জনগণই হলো শক্তির উৎস। এখানে আমাদের সঙ্গে অনেকের সঙ্গে পার্থক্য। তাই আমি আকুল আবেদন করবো আজ। আমি আমার বাংলাদেশের মানুষ সম্মানিত এবং গর্বিত মনে করি। যিনি শান্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। যে জুলিও কুরি পদক আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছে আমি আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে তাদের জন্য নিশ্চয়ই সেটা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করবো। কিন্তু সেটা আমার নয়। সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাপ্য। আমি তাদেরই একজন এবং তাদেরই একজন হিসাবে আমি মরতে চাই। তাদের পাশে পাশে থাকতে চাই। তাদের সাথে সাথে কাজ করতে চাই এবং তাদের জন্য জীবন দিতে চাই। তাই আমি আজ এই কথা দুনিয়ার যারা শক্তিশালী দেশ আছেন, যারা বিলিয়ন বিলিয়ন খরচ করছেন অস্ত্রের জন্য তাদের কাছে এই বাংলার মাটি থেকে, এই দুঃখী মানুষের পক্ষ থেকে, এই নির্যাতিত মানুষের পক্ষ থেকে, এই বুভুক্ষু মানুষের পক্ষ থেকে আকুল আবেদন জানাবো, আপনারা অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করুন। সাম্রাজ্যবাদী নীতি বন্ধ করুন। বর্ণবৈষম্য দূর করায় সহায়তা করুন এবং দুনিয়াতে শান্তি কায়েম করুন। এই আবেদনই আপনাদের কাছে আমি করবো। এই অর্থ যাতে আপনারা রক্ষা করেন। অস্ত্র প্রতিযোগিতা না করে যদি সে অর্থ এবং সম্পদ এ দুনিয়ার দুঃখী যে দেশগুলো আছে, যাদের সম্পদ একদিন আপনারা ছলে-বলে-কৌশলে জুলুম করে নিয়েছিলেন, তাদের জন্য ব্যয় করেন, তাহলে মনুষ্য সমাজ শান্তি পাবে এবং এ দুনিয়ায় একজন মানুষও না খেয়ে মরবে না এবং তাদের গায়ে কাপড় হবে, তাদের লেখাপড়ার বন্দোবস্ত হবে। তাই মানবতার খাতিরে, বিশ্ব মানবতার খাতিরে আমি আপনাদের কাছে আবেদন করবো অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করুন। অ্যাটম বোমার টেস্ট বন্ধ করুন। মরণাস্ত্র টেস্ট বন্ধ করুন। ওই সম্পদ দেশের দুঃখী মানুষের জন্য অন্য দেশে ব্যয় করুন। দেখবেন দুনিয়ায় অশান্তি কোনোদিন হবে না, দুনিয়ায় শান্তি ফিরে আসবে। তাই আমি আপনাদের সকলকে ধৈর্যচ্যুতি না করে আমার যে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশের শান্তি পরিষদ যে আছে যার সঙ্গে ১৯৫২ সাল থেকে বোধহয়, ’৫১ সাল থেকে আমি জড়িত ছিলাম, আজো জড়িত আছি, তাদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তারা বাংলাদেশে শান্তির আন্দোলন আরো গড়ে তুলুক। কিন্তু ওই শান্তি নয় যে শান্তি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীরা এখানে করে গেছিল। যখন শান্তি কমিটি বলা হয়, তখন বাংলাদেশের মানুষ আঁতকে ওঠে। কারণ ওই শান্তি কমিটি করে করে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে, বাংলার মানুষকে ধ্বংস করেছে। আমাদের সেই শান্তি পরিষদ শান্তি কমিটি নয়, এ ভুল যেন আপনাদের কোনো কাজে না হয়। এ শান্তি পরিষদ বাংলাদেশে বহুদিন থেকে ছিল। আমি ১৯৫২ সালে সাউথইস্ট এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনের পিকিংয়ে যে শান্তি সম্মেলন হয় সেখানে যোগদান করেছিলাম। দুঃখের বিষয়, যে শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেছিলাম ১৯৫২ সালে পিকিংয়ে, আজ আমার দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করলো, আমার দেশের মানুষ যুদ্ধ করলো, আমার দেশের মানুষ আত্মত্যাগ করলো, আমার দেশের ত্রিশ লক্ষ লোক শহিদ হলো, আমার দেশের দুই লক্ষ মা-বোন নির্যাতিত হলো, আমার দেশের এক কোটি লোক দেশছাড়া হয়ে বিদেশে গেল, আমার দেশের প্রায় দেড় কোটি লোক এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম থেকে পালিয়ে বেড়ালো। সেই সময় যখন আমার মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করতেছিল, যারা আজ মানুষের দুঃখের কথা বলে দাবি করেন, দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সেই চায়না আজ বাংলাদেশ যাতে জাতিসংঘে যোগদান করতে না পারেন, সেজন্য ভেটো দিয়েছেন। এজন্য তার বিরুদ্ধে আমি কিছু বলতে চাই না। তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী রাষ্ট্র। শুধু বলবো যে কথা মুখে বলেন, যে কথা দুনিয়াতে প্রচার করতে চেষ্টা করেন, সেটাই কাজে করুন। এটাই আবেদন করবো। এর বেশি বলতে আমি চাই না। অত্যন্ত শক্তিশালী দেশ। আমি একটা ছোট দেশ। অত বড় কথা আমার মুখে শোভা পায় না। নাও পেতে পারে। কিন্তু যে কোনো জালেমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার শক্তি বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের আছে এটা সকলের বুঝে নেওয়া দরকার।

আমরা বন্ধুত্ব কামনা করি প্রত্যেকটা দেশের সাথে। আমার পড়শী ভারতবর্ষ আমার বন্ধুরাষ্ট্র। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সন্ধি আছে। আমরা তার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবো না। তারা আমার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না এবং তারাও করেন না। আমরাও করি না। আমাদের সহযোগিতায় পাশে পাশে বাস করবো। এশিয়ার অন্যান্য দেশকেও আমরা বলবো, সাবকন্টিনেন্টের অন্যান্য দেশকেও আমরা বলবো – আমাদের সঙ্গে এসে বন্ধুত্ব করো। আমরা বন্ধু হয়ে বাস করতে চাই। অস্ত্র দেখায়া লাভ নাই। যেখান থেকে অস্ত্র পেয়ে কেউ যদি আবার মাথা তুলে দাঁড়াও, জাগ্রত জনগণকে তোমরা দাবায়া রাখতে পারবে না। আমরা সব ভুলেও বন্ধুত্ব কামনা করি। আমরা বন্ধুত্ব কামনা করি সাউথইস্ট এশিয়ার সমস্ত দেশের সঙ্গে। আমরা বন্ধুত্ব কামনা করি সাবকন্টিনেন্টের সমস্ত দেশের সঙ্গে। আমরা বন্ধুত্ব কামনা করি আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশের সঙ্গে। আমরা বন্ধুত্ব কামনা করি ল্যাটিন আমেরিকা, আমেরিকা, কানাডা, দুনিয়ার সমস্ত দেশের সঙ্গে। কারণ আমরা দুনিয়ার সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই। কিন্তু আমার দেশের বৈদেশিক নীতি পরিষ্কার। আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি Independent Neutral Non-allied Foreign Policy । আমরা বিশ্বাস করি সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব। কারো সঙ্গে আমাদের সংগ্রাম নয়। এই নীতিতে বিশ্বাস করেই আমরা এগিয়ে চলেছি। এই নীতিতে বাংলার মানুষ অটুট থাকবে। এ সম্বন্ধে কেউ নড়াচড়া করতে পারবে না। এ বিশ্বাস আমার আছে। বাংলার মানুষকে আমি জানি এবং চিনি। তাই বিশ্বশান্তি পরিষদ বাংলাদেশ শাখার আমার সহকর্মীরা যেভাবে কাজ করেছেন, তাদের আমি মোবারকবাদ জানাই। বিশ্বশান্তির জন্য যারা সংগ্রাম, কাজ করছেন দুনিয়াতে, অনেক দেশ যাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আছে, তাদেরও আমি মোবারকবাদ জানাই। যারা এখনো বিশ্বশান্তি বিশ্বাস করেন না, তারাও এগিয়ে আসুন – এটাই আমি আশা করি। সেই জন্য আজ আমি বলি দুনিয়ার কারো সঙ্গেই আমার দুশমনতা নাই। সকলের সঙ্গে বন্ধু হয়ে বাস করতে চাই। আমি আবার আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে, আমি বিশ্বশান্তি পরিষদকে মোবারকবাদ জানিয়ে, আমি বাংলার শান্তি পরিষদকে ধন্যবাদ জানিয়ে, আওয়ামী লীগ কর্মকর্তাদের আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে আপনাদের কাছে বিদায় নিতে চাই। তবে আমি শুনে সুখী হলাম বিশ্বশান্তি পরিষদ ঢাকায় একটা সভা করতে চান। আমি তাদের আমন্ত্রণ জানাই। বাংলার মাটি শান্তির জন্য। আপনারা নিশ্চয়ই এখানে সভা করতে পারবেন। সমস্ত সহযোগিতা আমাদের কাছ থেকে পাবেন। জনগণের কাছ থেকে পাবেন। আমি আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি।

জয় বাংলা।

বিশ্ব শান্তি জিন্দাবাদ।

[ওঙ্কারসমগ্র : বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের শ্রুতিলিপি, ঐতিহ্য, ২০১৭]

বুদ্ধিজীবীদের এক সভায় ভাষণ

১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭২, চট্টগ্রাম

একটা কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যানের প্রয়োজন আছে। তা না হলে আজ এটা করলাম, কাল এটা করলাম, পরশু এটা করলাম, তাতে সমস্যার সমাধান হবে না। আগেও যা হয়েছে, এখনো তাই হবে। কিছু কিছু কাজ আরম্ভ করেছিল কিছু কিছু ডিপার্টমেন্ট। আমি বলেছি যে, এভাবে করলে বোধহয় ভালো হবে না। একটা ভাঙবো, একটা গড়বো – এভাবে হবে না। ওই কমিশন মানে, আমি তো কমিশনের ওপর নিজেই একটু বিরক্ত আছি। কমিশন মানে, কমিশন অর্থ হলো আগে ছিল ব্লাফ দেওয়া। যে কমিশন করে দেওয়া হয়, কমিশন রিপোর্ট দেয়, সরকার দেখেন, তারপর ওটাকে চাপায় রাখেন, তারপরে আর পাবলিশ করেন না, তারপর আর ওটার আর কাজ হয় না, সে উদ্দেশ্য নাই এবং আমি নিজেই, বলতে পারেন সে সম্বন্ধে আমার ব্যক্তিগত আমি নিজে ওর বিরুদ্ধেই বলি। আমি বলি যে, কমিশন-টমিশন বাদ দাও। তখন এডুকেশনকে এমন একটা, এমন একটা সিস্টেম এখানে করা হয়েছে, যে সিস্টেমে মানুষ পয়দা করার চেয়ে আমরা বোধহয় কেরানি পয়দাই বেশি করি এবং সে চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নাই।সেজন্য একটা পুরোপুরি প্ল্যান প্রয়োজন হয়ে পড়েছে যে, এডুকেশন সিস্টেমটাকে কীভাবে করা যাবে? সেজন্য একটা কমিশন গঠন করা হচ্ছে। আপনারা নিশ্চয়ই তা পছন্দ করবেন। যারা এদেশের মুরুব্বি আছেন, যারা গুণী-জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী আছেন, তাদের নিয়েই করা হবে। তারা সবকিছু গবেষণা করে যে রিপোর্ট দেবেন, আমরা সেটাকেই মানবার চেষ্টা করবো। যাতে একটা প্ল্যান ওয়েতে, এটাকে যদি আমরা পরিষ্কারভাবে একটা নতুন চিন্তাধারায় নতুন রাস্তার দিকে না নিয়ে যাই, তাহলে এদেশে মুক্তি আসা সম্ভবপর নয়। যতই চেষ্টা করি না কেন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি করতে, তার সঙ্গে যদি শিক্ষার যোগ না থাকে তাহলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কেন, কোনো নীতিই পরিপূর্ণ হয় না। আর দেশে যাতে অশিক্ষা দূর হয়, সাধারণ মানুষ শিক্ষা পেতে পারে এবং সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা হয় সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমরা কোনোদিকে নজর দিতে পারছি না। সত্য কথা বলতে কী আপনাদের কাছে, কারণ, কী করে আমরা নজর দেবো? আপনাদের কাছে তো আমাকে বলতে হবে না।ময়দানে বক্তৃতা করি, বা বাইরে বলি, সেটা নিশ্চয়ই সত্য কথা বলি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যে অবস্থাটা হয়েছে, সে-কথা আপনাদের আমার বোঝাতে হবে না। আপনারা ভালো করে জানেন। স্কুল-কলেজগুলোর যে অবস্থা ছিল সে অবস্থা আপনারা ভালো করে জানেন। আর যদি দশদিন পাকিস্তানি বাহিনী থাকত, তাহলে বোধহয় আমার বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশে থাকত না। যেভাবে প্ল্যানড্ ওয়েতে ওরা হত্যা করতে আরম্ভ করেছিল। না হলে এটা দুনিয়ার কোথাও দেখা যায় না আজ পর্যন্ত। যেটা আমি ফরেন ইন্টারভিউতে ওদেরকে বলেছি। সারেন্ডার করার মাত্র দু-তিনদিন আগে ঢাকা শহরে কার্ফু দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে ধরে এনে অমানুষিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। যে ডাক্তার তার চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। যে হার্ট স্পেশালিস্ট তার কলিজা কেটে বের করে হত্যা করা হয়েছে। যে জার্নালিস্ট তার আঙুলগুলো কেটে হত্যা করা হয়েছে। এটা কোনো দুনিয়াতেই নেই; মানে কত বড় বর্বর হতে পারে! আমি কোনোদিন দুনিয়ার ইতিহাসেও পড়ি নাই, আর জানিও নাই। এতকাল রাজনীতি করতেছি, রাজনীতির সাথে জড়িত, সমস্ত দেশের আন্দোলনগুলোতেও দেখেছি, পড়েছি এবং নিজেও তো আন্দোলনের সৃষ্টি। আন্দোলনের মধ্যে থেকেই আমার আজকে আমি এগিয়ে এসেছি। কারণ আমি বড়লোকের ঘরে জন্মগ্রহণ করে পলিটিক্স করে রাজনীতি করি নাই। আমি সবসময়ই রাজনীতি করেছি এবং সেটা ত্যাগের মাধ্যমে এবং হিম্মতের মাধ্যমে রাজনীতি করেছি। এ প্রবলেম সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট জানা আছে। কিন্তু এটা কোনো জায়গায় দেখা যায় নাই আজ পর্যন্ত দুনিয়ার ইতিহাসে। যে প্ল্যানড্ ওয়েতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা, যেটা ওরা গর্ব করে বলেছিল, মুজিবুর রহমান পাবে বাংলাদেশ। কিন্তু এমন করে রেখে যাবো যাতে বাংলাদেশ দাঁড়াতে না পারে। এত গর্ব করে বর্বর জেনারেলরা বলেছিল। এখন খবর পাইতেছি আরকি। বাংলাদেশ সোনার বাংলা দেখায়া দিব আমরা। ‘রেখে যাব না কিছু যে ও আইসা মজিবুর দাঁড়ায়। ও তো আসবে না, ওর ভবিষ্যৎ যারা আসবে তারাও যেন না করতে পারে।’ আমি এসে গেছি। খোদার রহমত। আপনাদের দশজনের দোয়া। না হলে আমিও জানতাম না যে আমি ফিরে আসবো। আমি প্রস্তুত ছিলাম। আমি চাই যে, যদি আমার মরতে হয়, আমি প্রস্তুত। কারণ আমার দেশের মানুষের মুখ কালি করে আমি মরতে চাই না।  অ্যাটলিস্ট ওরা ভবিষ্যতে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারবে, যাকে নেতা মেনেছিলাম, সে মাথা উঁচু করেই মৃত্যুবরণ করেছে। এখন আপনাদের প্রবলেম শুধু যে শিক্ষা প্রবলেম তা নয়। আমি আপনাদের কাছে কালকে বলেছি যে, কী বলবো আপনাদের কাছে! একটা সরকার চালাতে হলে, একটা দুনিয়া থেকে মাল আনতে হলে বৈদেশিক মুদ্রা দরকার। ’৪৭ সাল থেকে প্রায় বিশ বছর, আঠারো বছর পর্যন্ত বাঙালিরা শতকরা ৭০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে তখনকার দিনে এবং তার প্রত্যেকটি পয়সা শতকরা ৭০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে সরবরাহ করা হয়েছে। এক পয়সা আমি পাই নাই। শুধু এক পয়সা যে পাই নাই তা নয়। যে দেনাগুলো করে গেছে, যেটা আমাকে এখন চালাবার জন্য আমার প্রয়োজন, তাও অনেক নিচের দিকে। এগুলো শোধ করে আমাকে এক পয়সা জমা করে জোগাড় করতে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক ফুডের অবস্থা আপনারা জানেন। ঔষধ নাই, কাপড় নাই, কলগুলো শেষ করে গেছে। প্রত্যেকটা ইন্ডাস্ট্রিকে যা তাদের হাতে ছিল, আপনারা মনে করেন না যে ফেলে গেছে এগুলি। ওরা এক পয়সাও ফেলে যায়নি। ওরা সর্বস্ব টাকা, ব্যাংক ওদের হাতে ছিল। ওরা সঙ্গে সঙ্গে তা ওভারড্রফ্ট করে যা দাম তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা তারা নিয়ে চলে গেছে। এটাও আমার ওপর লায়াবিলিটিস। কারণ সরকার নিয়ে নিছে। সরকারের ওপর লায়াবিলিটিস পড়ছে। সেইগুলিকে চালানো, জাহাজ নাই, মাল আমি পৌঁছুতে পারছি না। ১৪ হাজার ট্রাকের মধ্যে ১০ থেকে ১২ হাজার ট্রাক পোড়ায়া দিয়ে গেছে। সে ট্রাকগুলো বিদেশ থেকে আনতে হবে। সমুদ্র জাহাজগুলোকে আপনার যা চলতো, সেগুলোকে ডুবায় দিয়ে গেছে। সেগুলো আনতে হবে। বলুন তো আমি কী করি? আপনারা যে আমাকে, রেল ভেঙে চলে গেছে। মাল সরাতে পারছি না। যতগুলো অ্যাডমিনিস্ট্রেশন করেছে, সেটা খালি নিয়েই শেষ করেছে। রেলওয়েটা লোকসানের ওপর চলছে। এই অবস্থার মধ্যে কী করতে বলেন? তবে এটা হলো সত্য কথা যদি একটা-দুটা বছর কোনোমতে কষ্ট করে চালানো যায়, বাংলার অর্থনীতি খারাপ হবে না। এটা সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত। আমার রিসোর্স আছে এবং ভবিষ্যতে আমি আয় করতে পারবো বৈদেশিক মুদ্রা, আমি আয় করতে পারবো। আমি ওই যে বললাম না যে পারবো। বন্ধুরাষ্ট্র আমাকে সাহায্য করতেছে। আমি তো বলেছি। অস্বীকার করলে নিমকহারামি করা হবে। স্বাধীনতার আগেই ভারত এবং তার প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার এবং তার জনসাধারণ আমার এক কোটি লোককে খাইয়েছে। স্বাধীনতার পরে যদি তার কাছে আমি ইমিডিয়েটলি কিছু সাহায্য না পেতাম, তাহলে সরকার একদিনও আমার বন্ধুরা চালাতে পারতো না আমি না আসা পর্যন্ত। কলাপস হয়ে যেত একদম। রাশিয়ার সাহায্য আসতেছে।আপনারা প্রবলেম বলছেন। শিক্ষকদের নিশ্চয়ই প্রবলেম আছে। আমি আপনাদের কাছে কোনো ওয়াদা করতে পারবো না। তবে যেটা চাই, গণমুখী শিক্ষা হওয়া প্রয়োজন। সেটা আমি বিশ্বাস করি এবং গণমুখী শিক্ষা হতে হলে প্ল্যান প্রোগ্রাম অনুযায়ী হওয়া প্রয়োজন এবং এ জন্যই কমিশন করা হয়েছে এবং কমিশন যারা আপনারা এর মধ্যেই দেখতে পেরেছেন যে, আমাদের কোনো দলমত নাই। কন্ট্রোভার্সি নাই। যারা সত্যি উপযুক্ত তাদেরই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর করতেছি, যারা উপযুক্ত তাদের কাছে পাঠাচ্ছি। কোনো রকমের কে আমার বন্ধু, কে আমার ভাই, কারণ যার সম্বন্ধে কোনো রকমের কোনো কোয়েশ্চেন নাই, তাদেরই আমরা পাঠাবার চেষ্টা করতেছি। যাদের ওপর দেশের শ্রদ্ধা আছে তাদের পাঠাবার চেষ্টা করতেছি। যাতে তারা একটা আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। কারণ আগে তো সব জায়গাতেই রাজনীতি চলে এসেছে। এর মধ্যে আমি রাজনীতি আনতে চাই না। কারণ এ সেক্টরে রাজনীতি না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এ জন্যই আপনারা সেখানে আছেন। তারপরও কন্ট্রোভার্সি আছে। দালালি যারা করেছে। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গায় জায়গায় প্রত্যেকটা ইনস্টিটিউশনে দালালি করেছে কিছুসংখ্যক লোক। আমার ওপর রাগ করবেন না। আমি তো খবর পেয়েছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-চারজন প্রফেসর বা যারা শিক্ষিত ছিলেন, তারা নিজে ডেকে আইনে এ সমস্ত লোককে হত্যা করেছে। তারাও তো বুদ্ধিজীবী ছিল। তারাও তো আপনাদের ডিপার্টমেন্টের ডক্টরেট ছিল। তারাও তো আপনাদের ডিপার্টমেন্টের একেকজন বড় বড় শিক্ষিত লোক ছিল। তারাও তো প্রফেসর, টিচার। বলুন, তাদের কী করবো আমরা?

আজকে আমার যা মনে হয়, বেয়াদবি মাফ করবেন, বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চয়ই শ্রদ্ধা করি, কিন্তু সাধারণ একটা মানুষ অন্যায় করে, সেটাকে ক্ষমা করা যায়। বুদ্ধিজীবীর নামে যারা এ সমস্ত কেলেংকারি করেছে তাদের কি ক্ষমা করা যায়, আপনারা মনে করেন? আজ আমার দেশের গরিব কৃষক, গরিব শ্রমিকরা কিন্তু বেইমানি করে নাই। আমরা সাদা কাপড় পরা ভদ্রলোকরা বেশি বেইমানি করেছি এবং সাদা কাপড় পরা ভদ্রলোকদের খুশি করা যায় না কোনো জীবনে। তাদের দাবির শেষ নাই। গ্রামের লোক কিন্তু জানে যে কিছুই নাই। তারা কিন্তু বিরক্ত করে না। করে আমাদের সাদা কাপড় পরা তথাকথিত ভদ্রলোক বাহিনীর লোকেরা। তাদের ত্যাগও কম এবং তারা সবসময় বেশি বেশি যে পাওয়ার আছে তার দিকেই দৌড় দেয়। ওই ইয়াহিয়া খানের দরজার কাছে যে লোকগুলোকে দেখেছি, শেখ মুজিবরের দরজার কাছে সে লোকগুলো আসতে চেষ্টা করে। সেদিক দিয়ে আমাদের হুঁশিয়ার না হলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। আপনারা হুঁশিয়ার না হলে আপনাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।

আর আপনাদের আরেকটা জিনিস অনুরোধ করবো আমি। যে রাজনীতি ছাত্ররা করে, আন্ডার ডেভেলপমেন্টে পড়ে থাকে, সত্যি কথা। সেদিকে যদি কন্সট্রাক্টিভ কিছু করে, তাকে গ্রহণ করা, নিশ্চয়ই আমরা করবো। আপনারাও তাদেরকে সহযোগিতা করবেন। কিন্তু যদি সেখানে আত্মঘাতী আন্দোলন শুরু হয়, তাহলে স্বাধীন দেশের মঙ্গল হতে পারে না। আমি ছাত্র আন্দোলন বহুদিন করেছি। যে জিনিসটা সংগ্রামের মধ্যে না আসে, ত্যাগের মধ্যে না আসে, সে জিনিসটা কোনোদিন মানুষ উপভোগ করতে পারে না এবং বুঝতেও পারে না। আমরা স্বাধীনতা পাওয়ার পরে যাদের কাছে স্বাধীনতা আসল, তারা ছিল ব্রিটিশের খান বাহাদুর, ব্রিটিশের দালাল, তারা বসে গেল এই দেশের ক্ষমতায়। আর পাশের রাষ্ট্র ভারতবর্ষে দেখেন, যারা সংগ্রাম করে দশ বছর, পনেরো বছর, বিশ বছর জেল খেটে, পণ্ডিত নেহরুর মতো লোকও তেরো বছর জেল খেটে এসে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিল। সে মতিলাল নেহরুর ছেলে। তাদের সেখানে একটা ত্যাগের, ভীষণ ত্যাগ ছিল এবং সাধনা ছিল। যার মাধ্যমে তারা এসে পড়ে আজকে সেখানে সরকার চালাচ্ছেন। আর আমার এখানে হয়েছিল কী? এ খান বাহাদুর হবে, না হয় নবাবজাদা হবে? না হয় পীরজাদা হবে, না হয় খান হবে? তারাই ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব করে এ দেশের সর্বনাশ হয়েছে। আপনাদের কাছে আমি, আমার বেয়াদবি আপনারা মাফ করবেন। আমার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যেও সবাই ফেরেশতা নন এবং তারাও এদেশের বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করার পেছনে অনেকে রয়েছেন এবং তারা রীতিমত সাথে যোগ দিয়েছে। সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। সেজন্যই আপনাদেরকেও একটু হুঁশিয়ার থাকতে হবে এবং মেহেরবানি করে ওই যে জিনিসটা বলতে চেয়েছিলাম, ছাত্রদের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টি করে নিজের যাতে প্রমোশনের চেষ্টা না করা হয়, সেটাই বাঞ্ছনীয় হবে। এতে ভবিষ্যতে নিজেরও মঙ্গল হয় না, দেশেরও মঙ্গল হয় না। আমি আপনাদের উপদেশ দিতে চাই না। আপনারা জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী। আপনাদের উপদেশ দেওয়া আমার শোভা পায় না। আমি একজন সাধারণ মানুষ। আমি কী করে দেবো? কিন্তু আমার প্রাক্টিক্যাল নলেজ আছে বলেই আমি বলছি এ কথাগুলো। সেজন্যে আমি বলি যে আপনারা যে প্রবলেম বলেছেন, আপনাদের কিছু নাই। প্রবলেমের সীমা নাই। বলুন তো কোন প্রবলেমটা নাই? আগে আপনাদেরকে জিজ্ঞাসা করি, ফার্স্ট প্রবলেমটা কী বলুন তো আপনারা? আমার এক নম্বর প্রবলেম হলো, যে যাতে মানুষ না খেয়ে না থাকে। খাদ্য সমস্যা অত্যধিক ভয়াবহ। ফ্যাক্টরির কাজ আরম্ভ করে দিয়েছি। যে আপনাদের বলতে হবে। শিক্ষক সম্প্রদায় আর ছাত্রদের নিয়ে আমার যা ব্যক্তিগত মত, আমি অবশ্য জানি না যে, বোধহয় আমি সাজেশন দিব কমিশনের কাছে যে বছরে এক মাস দু-মাস গ্রামে কাজ না করলে, একটা মাঠ সৃষ্টি না করলে, গ্রামের দিকে যদি আমরা না চলে যাই, তাহলে হবে না। শিক্ষকদের গ্রামে কাজ করতে হবে। এটা আমার ব্যক্তিগত মত। এখন পর্যন্ত কমিশন কী করবে আমি জানি না। যে শিক্ষক সাহেবদেরও গ্রামে যাইয়া বছরে এক মাসের জন্য গ্রামে কাজ করতে হবে। ছাত্রদের নিয়াই সেখানে যেয়ে কাজ করতে হবে। না হলে আজকে যে সৃষ্টি হয়েছে গ্রাম আর শহরের এটাকে দূর করতে হবে এবং গ্রামকে চিনতে হবে। যে ঘরে জন্মগ্রহণ করেছি, যে বাপের খেয়েছি, আমরা অনেকে বোধহয় যারা লেখাপড়া শিখেছি প্রায়ই আমরা ধান বেচে, পাট বেচে লেখাপড়া শিখেছি। আমি তো ভাই ধান বেচার ছেলে। হ্যাঁ। ধান বেচে আমরা লেখাপড়া শিখেছি। আমরা কিছু ভুলে যাই। বাপ-মাকেও কিছুটা ভুলি সন্দেহ নাই।

বাপ-মাকেও মাসে কোনো সময় দরকার হইলে ৫০ টাকা, ১০০ টাকা দিলাম আর, শহরে বাড়িঘর নিয়া আরাম কইরা গাড়ি নিয়া স্ট্যান্ডার্ডে বাস করি। কিন্তু বাপের লুঙ্গির পরিবর্তন হয় নাই। সেজন্য যে গ্রাম থেকে মানুষ হয়েছেন সে গ্রামকে ভুলে শহরমুখী আপনারা হয়ে গেছেন। কিন্তু গ্রামমুখী যদি আপনারা হতে পারেন, ইনকারেজ করতে পারেন, দেশের মঙ্গল তাড়াতাড়ি আসবে। সেদিকে আপনাদের নজর দেওয়া দরকার। কারণ আপনারা ভবিষ্যৎ বংশধর পয়দা করবেন। আমিও চাই যে আপনারা ভবিষ্যৎ বংশধর পয়দা করেন এবং সে ভবিষ্যৎ বংশধর পয়দা করার সঙ্গে সঙ্গে যারা পয়দা করেছে, তাদের দিকেও যেন একটু নজর থাকে। এটিই আমার আবেদন আপনাদের কাছে। ***

[ওঙ্কারসমগ্র : বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের শ্রুতিলিপি, ঐতিহ্য, ২০১৭]

প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন

১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪, ঢাকা

মাননীয় সভাপতি, অভ্যর্থনা পরিষদের সভাপতি, সম্মেলনে আগত বিদেশি অতিথিগণ, উপস্থিত কূটনৈতিক প্রতিনিধিবৃন্দ এবং সমাগত সুধীমণ্ডলী,

শহীদস্মৃতিবিজড়িত পবিত্র ভাষা-আন্দোলনের মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। এই সম্মেলনে আমি প্রথমেই একুশের ভাষা-আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। বাংলাদেশের স্বাধিকার ও সার্বিক মুক্তির জন্য যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাঁদেরও আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।

বন্ধুগণ, অমর একুশের কথা ভাবতে গেলেই আমার মনে অনেক স্মৃতি এসে ভিড় জমায়। যে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে আপনারা সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করছেন, সেই বাংলা একাডেমি এদেশের দুর্জয় জনতার মাতৃভাষার সংগ্রামে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের জ্বলন্ত সাক্ষ্য বহন করছে। বাংলা ভাষার দাবিতে আমাদের আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ। সেদিনের স্বৈরাচারী সরকার আমাদের মাতৃভাষার দাবিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য নির্মম নির্যাতনের আশ্রয় নিয়েছিল। কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ এবং লাঠিচার্জে আহত হয়েছিল শত শত ছাত্র-জনতা। ঐদিন সকালেই বিক্ষোভ-মিছিল থেকে অন্যান্য সহকর্মীর সাথে আমাকেও গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় নির্যাতন ও কারাযন্ত্রণা। কিন্তু কোনো শক্তিই কখনো সত্যের পথ থেকে আমাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। যাই হোক, তারপর এলো বায়ান্নর সেই রক্তাক্ত ফাল্গুন। তখন আমি জেলখানায়। জেল থেকে চিকিৎসার জন্য আমাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মানিক মিয়া নামক জনৈক পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টরের সাহায্যে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করি। আমার সঙ্গে পরামর্শ করেই তাঁরা ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেন। এবং তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেই আমি ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করি অনশন ধর্মঘট। সেই অনশন ধর্মঘট আমি চালিয়ে যাই ২৭শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আমার সেদিনের বন্ধুরা হয়তো সেটা আজো মনে করতে পারবেন। আমাদের সেদিনের সেই আন্দোলন জয়যুক্ত হয়েছিল। একুশের রক্তরাঙা পথ বেয়েই বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং স্বাধিকার চেতনা ধীরে ধীরে এক দুর্বার গতি লাভ করে।

স্বাধীনতার পর বাংলা একাডেমির উদ্যোগে আমার দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীরা এই প্রথম একটি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। এই মহতী প্রচেষ্টা যে খুবই সময়োপযোগী হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। দীর্ঘকালব্যাপী নানা শোষণ এবং বঞ্চনার ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে আজ আমরা দরিদ্র, ক্ষুধার্ত ও নানা সমস্যায় জর্জরিত। এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্যও আজ আমরা অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে এবং দেশ গড়ার কাজে লিপ্ত রয়েছি। কিন্তু আমরা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিক থেকে দরিদ্র নই। আমাদের ভাষার দু’হাজার বছরের একটি গৌরবময় ইতিহাস আছে। আমাদের সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। আজকে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মর্যাদাকে দেশে ও বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

সুধী বন্ধুরা আমার,

আমি জানি আমাদের মুক্তি আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মী, মেহনতি মানুষ, কৃষক-শ্রমিক এবং ছাত্র-তরুণদের পাশাপাশি দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীরাও সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, রক্ত দিয়েছেন। বিশ্বের স্বাধীনতা-লব্ধ জাতিগুলোর মধ্যে আমরা এদিক থেকে গর্ব করতে পারি যে, আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম হাতে হাত ধরে অগ্রসর হয়েছে। আজকে যখন দেশ স্বাধীন হয়েছে, তখন সাহিত্যিক, শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীদের কাছে আমার প্রত্যাশা আরো অধিক। যাঁরা সাহিত্য সাধনা করছেন, শিল্পের চর্চা করছেন, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সেবা করছেন, তাঁদেরকে দেশের জনগণের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র রক্ষা করে অগ্রসর হতে হবে। দেশের জনগণের চিন্তা-ভাবনা, আনন্দ-বেদনা এবং সামগ্রিক তথ্যে তাঁদের জীবন-প্রবাহ আমাদের সাহিত্যে ও শিল্পে অবশ্যই ফুটিয়ে তুলতে হবে। সাহিত্য-শিল্পে ফুটিয়ে তুলতে হবে এদেশের দুঃখী মানুষের আনন্দ-বেদনার কথা। সাহিত্য-শিল্পকে কাজে লাগাতে হবে তাঁদের কল্যাণে। আজ আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতির শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে, আপনাদের লেখনীর মাধ্যমে তার মুখোশ খুলে ধরুন; দুর্নীতির মূলোচ্ছেদে সরকারকে সাহায্য করুন। আমি সাহিত্যিক নই, শিল্পী নই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, জনগণই সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনোদিন কোনো মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না। আমি সারাজীবন জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সংগ্রাম করেছি, এখনো করছি, ভবিষ্যতেও যা কিছু করব, জনগণকে নিয়েই করব।

সুধী বন্ধুরা,

আপনাদের কাছে আমার আবেদন, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি যেন শুধু শহরের পাকা দালানেই আবদ্ধ না হয়ে থাকে, বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তরের কোটি কোটি মানুষের প্রাণের স্পন্দনও যেন তাতে প্রতিফলিত হয়। আজকের সাহিত্য সম্মেলনে যদি এসবের সঠিক মূল্যায়ন হয়, তবে আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হব।

সুধীমণ্ডলী,

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে আজ সমস্যার অন্ত নেই। আমাদের আর্থিক অনটন আছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুঃসহ অভাব আছে, কিন্তু আমি মনে করি, সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমাদের মূল্যবোধের অভাবই আজ সবচেয়ে পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে। এই অভাব জাতীয় জীবনে যে সংকটের সৃষ্টি করছে, তা অবিলম্বে রোধ করা দরকার। আমি বিশ্বাস করি, দেশের সাহিত্যিক, শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী, শিক্ষাব্রতী ও বুদ্ধিজীবীরা এই সংকট উত্তরণে এবং জাতীয় মূল্যবোধের উজ্জীবনে ও সুকুমারবৃত্তির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আজকে সময় এসেছে, যখন প্রত্যেককে আত্ম-বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে, নিজের নিজের ক্ষেত্রে তাঁরা দেশের কল্যাণে সেই দায়িত্ব ও ভূমিকা কতটা আন্তরিকভাবে পালন করছেন। দেশ ও জাতি আজ তাঁদের নিকট এই দাবি জানায়।

একটি সুষ্ঠু জাতি গঠনে শিল্প, কৃষি, যোগাযোগ ব্যবস্থা বা অন্যান্য সর্বক্ষেত্রে যেমন উন্নয়ন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন চিন্তা ও চেতনার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা। আমি সর্বত্রই একটি কথা বলি – সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। সোনার মানুষ আকাশ থেকে পড়বে না, মাটি থেকেও গজাবে না। এই বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্য থেকে তাঁদেরকে সৃষ্টি করতে হবে। নবতর চিন্তা, চেতনা ও মূল্যবোধের মাধ্যমেই সেই নতুন মানুষ সৃষ্টি সম্ভব। মানবাত্মার সুদক্ষ প্রকৌশলী দেশের সুধী সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষাব্রতী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতসেবী। আমি আজকের এই সাহিত্য সম্মেলনে আপনাদের সোনার মানুষ সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। এই সম্মেলনে বন্ধু রাষ্ট্রসমূহ থেকে অতিথি হিসেবে যাঁরা যোগ দিয়েছেন এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যাঁরা এখানে সমবেত হয়েছেন, তাঁদের সবাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমি এই সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সম্মেলন উদ্বোধন করছি।

জয় বাংলা। ***

[বাংলা একাডেমি থেকে প্রাপ্ত]

কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের ভাষণ

৪ ডিসেম্বর, ১৯৭৪, ঢাকা

মাননীয় সভাপতি, কমরেড …, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যবৃন্দ, উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী, ভদ্রমহিলাগণ এবং আমাদের বিদেশ থেকে আগত অতিথিবৃন্দ, আপনারা আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনারা আমাকে সুযোগ দিয়েছেন আপনাদের কংগ্রেসে দুকথা বলার জন্য সেজন্য সত্যিই আমি আপনাদের আবার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। আজ স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে আপনারা আপনাদের কংগ্রেস করতে পারছেন। পঁচিশ বৎসরের আন্দোলনে আপনাদের সাথে আমার ব্যক্তিগত এবং আমার সহকর্মীদের যারা আমার সঙ্গে কাজ করেছেন তারা আমরা দেখেছি যে, কী দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে কী অত্যাচার-অবিচার সহ্য করে আপনাদের কাজ করতে হয়েছে। কারাগারে বন্দি ছিলাম। যতদিন ছিলাম দেখেছি শত শত কর্মী কমিউনিস্ট পার্টির বছরের পর বছর কারাগারের মধ্যে বন্দি অবস্থায় রয়েছে। আমাদের সহকর্মী আওয়ামী লীগ বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত পার্টির কর্মীরা বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি রয়েছে। কোনোদিন আপনাদের সুযোগ দেয়া হয় নাই। আপনাদের কাজ করার সুযোগ দেয়া হয় নাই। আপনাদের পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করে আপনাদের কর্মীদের ওপর অত্যাচার করেছে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে করুণ ইতিহাস। প্রগতিশীল যে কোনো দলের লোক হলে তাদেরকে অত্যাচার-অবিচার, জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। বোধহয় ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগের কমিশনে যখন গভর্নমেন্ট হয়েছিল তখন বোধহয় কমিউনিস্ট পার্টি সূর্যের আলো দেখেছিল, আর কোনোদিন সূর্যের আলো পায় নাই। আজ আপনারা স্বাধীন, বাংলাদেশের বুকে আপনাদের কংগ্রেস হয়েছে। এ স্বাধীনতার সংগ্রামে আপনারা দান করেছেন, আপনাদের পর্যায়ে প্রার্থীরা হয়েছে, বাংলার মানুষের পথে দাঁড়িয়ে আপনারা সংগ্রাম করেছেন, এখানে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। আমি জানি, বস্তুত আমি জানি যে, অনেক সময় ১৯৬২-৬৩ সাল তার আগে, অনেক সময় রাতের অন্ধকারে যখন জেল থেকে বের হয়ে এসেছি, তখন গোপনে কমরেড মণি সিংহের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে অনেকবার।

কারাগারে নির্জন প্রকোষ্ঠে যখন ছিলাম তখনো অনেককে আপনাদের কংগ্রেসের সঙ্গে বছরের পর বছর আমাদের কাটাতে হয়েছে, আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছি। আপনাদের জানবার বুঝবার সুযোগ পেয়েছি। আপনারা স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করেছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। যে ইতিহাস কংগ্রেস প্রধান বললেন, বিদেশি শত্রুদের সহায়তায় পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদীরা বাংলার বুকে যে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিল নাইবা বললাম আপনারা ভালো করেই জানেন। আমার মাঝে মাঝে দুঃখ হতো, আপনারা মনে অসন্তুষ্ট হবেন না যে, যারা আজকে আপনারা এখানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য – সদস্য আছেন তাদের বলতে চাই না, যে ততোদিন আমি এই সমস্তর যে মালিক আর আপনাদের আত্মানুকূল যারা আপনাদের পিছনে দাবি করছে তারা বিদেশি শত্রুদের সাহায্য নিয়ে শোষককুলের সেবা দিয়ে আমাদের স্বাধীনতাকে বানচাল করার চেষ্টা করছিল। তাদের খেলা আজো বন্ধ হয় নাই। শত্রুকে আমরা চিনি, শত্রুকে আমরা জানি, সাম্রাজ্যবাদকে আমরা চিনি, সাম্রাজ্যবাদকে আমরা জানি, শোষকদের আমরা চিনি, শোষকদের আমরা জানি। তাদের চেহারা আমাদের সামনে পরিষ্কার ছিল। কিন্তু এদের চিনতে কষ্ট হয়। যারা প্রগতির নামে, যারা সমাজতন্ত্রের নামে, যারা গণতন্ত্রের নামে প্রগতিকে আঘাত করে, সমাজতন্ত্রকে আঘাত করে, জাতীয়তাবাদকে আঘাত করে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে আঘাত করে ওদের চিনতে আমাদের কষ্ট হয়। বলতেই হয় সবচেয়ে বড় শত্রু যে কোনো দেশের বিপ্লবী আন্দোলনে, স্বাধীনতার সংগ্রামের সময় আমরা দেখতে পেয়েছি যে, যখন আপনারা সংগ্রামে এগিয়ে গেছেন ২৫শে মার্চ মাস, যখন আমি ডাক দিয়েছিলাম স্বাধীনতার জন্য আপনারা সব কিছু ভুলে গিয়ে বাংলার মানুষ আপনারা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতার সংগ্রামে। তখনো তারা প্রগতির নামে দেশের ভিতরে থেকে পাকিস্তানের দালালি করতে দ্বিধাবোধ করে নাই। আমি জানি না মাঝে মাঝে আমার চোখে কনফিউশন এসে যায়, যে মার্কসবাদ, লেনিনবাদ বলে, শোষকগণ বলে শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বাধীনতাকরণ প্রক্রিয়া বানচাল করতে চায় তারই সবচেয়ে বড় শত্রু না সাম্রাজ্যবাদ যে চিনতে পায় সেই বড় শত্রু, মাঝে মাঝে আমার মধ্যে কনফিউশন এসে যায়। আজ স্বাধীন দেশের স্বাধীন মাটিতে আপনারা কংগ্রেস করেছেন, করছেন, আপনাদের কর্মপন্থা আপনারা গ্রহণ করবেন। আপনারা যে সমস্ত … আমি কথা বলতে চাই না, কংগ্রেসপ্রধান বলেছেন যে, স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং তার পরের, পূর্বে যে, আমরা একটা কলোনি ছিলাম এবং স্বাধীনতার সময় শত্রুরা আমাদের ক্ষতি করে যায় তাতে স্বাধীনতার পরে আমাদের কী কী কষ্ট এবং আমাদের দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করতে হচ্ছে তা আপনারা জানেন, তা আপনারা বোঝেন। আপনাদের আমি এজন্য মোবারকবাদ জানাই যে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের যে, তারা সমস্ত বিপদ সংকেত বুঝতে পেরে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য এবং যে প্রগতিশীল নীতি আমরা গ্রহণ করেছি তাতে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন এজন্য আমি তাদের মোবারকবাদ জানাই।

স্বাধীনতা অর্জন করা কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করা তার চেয়ে কম কষ্টকর নয়। স্বাধীন হওয়ার পরে রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের পরে দেখা গেছে দুনিয়াতে যে, কুচক্রী মহল দূরে থাকে না। তারা দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করে এবং কাউন্টার রিভলিউশন বলা হয় যা তারা করে থাকে। পাকিস্তানের এবং দেশি-বিদেশি শোষকচক্র এদেশের পৃষ্ঠে বসে থাকে নাই তারাও চেষ্টা করছে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। তারাও দেশের মধ্যে অভাবে রয়েছে, দেশের মধ্যে অভিযোগ রয়েছে, মানুষ এক দুঃখী মানুষ খাবার পায় না, কৃষক আজ দুঃখী। চুয়ান্ন হাজার স্কয়ার মাইল, বাংলাদেশের অভাব-অভিযোগ রয়েছে। আমরা সে সমস্ত শুনেছিলাম, … ২৪ বৎসর পাকিস্তানের গোলাম ছিলাম। তার পরে আমাদের ধ্বংসস্তূপ। স্বাধীনতার পরে যারা বিপ্লবের পরে ২৪ বছরের ইতিহাস দেখেন … ইতিহাস দেখেন যেগুলো আপনারা ইস্ট জার্মানির ইতিহাস দেখেন। এমনকি আপনারা ওয়েস্ট জার্মানির অবস্থা দেখেন, জাপানের অবস্থা দেখেন, দেখেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের পরে বা যুদ্ধের পরের অবস্থা কী হয়। আমাদের অবস্থাও কোনো অংশে ভালো ছিল না। খারাপ খারাপ। লক্ষ লক্ষ আমাদের বেকার, ধনীদের সংখ্যা আমাদের কম, কলকারখানা আমাদের এখানে করা হয় নাই। দুনিয়া থেকে সবকিছু আমাদের বাজার থেকে কিনে আনতে হয়। এরপরে আমাদের লোকদের রক্ষা করতে হবে দুর্বৃত্তের হাত থেকে। সে জন্য আমাদের অনেক কিছুই করতে হয়। তবে কথা হলো, এই সুযোগে বিদেশি চক্র মাথায় ওঠার চেষ্টা করে। এই জন্যই আমি বলি যে, আজকে আমি ডাক দিয়েছিলাম, আওয়ামী লীগ, যে পার্টি সংগ্রাম করেছে, যে পার্টি নেতৃত্ব দিয়েছিল তার সঙ্গে ন্যাপ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি যা … ভূমিকা পালন করেছেন দেশের সংগ্রামে যোগদান করেছেন তারা। সংঘবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতাকে রক্ষা করা এবং দেশের দেশ গঠনের কাজে অগ্রসর হওয়াকে কর্তব্য মনে করে আমি ডাক দিয়েছিলাম। আপনারা সকলে আমার ডাকে সাড়া দিয়েছেন সেজন্য আপনাদের আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং অভিনন্দন জানাচ্ছি।

আর রাজনীতি আমরা ঘোরা পথে রাজনীতি একটু কম বুঝি। যেটা বিশ্বাস করি সেই পথ অবলম্বন করেছি। এটা শুধু আমার বিশ্বাস নয় যে, পার্টির আমি প্রেসিডেন্ট ছিলাম আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে।আজ আপনাদের সামনে আমরা শাসনতন্ত্র দিয়েছি এর মধ্যে কোনো গোলমালের কথা সেখানে নাই। আমরা চারটে নীতির ওপরে নির্ভর করে চারটে নীতিকে আমরা মেনে নিয়েছি। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ। আমি আনন্দিত এ জন্য আপনাদের আবার ধন্যবাদ দিই, যে আপনারা চার নীতিতে বিশ্বাস করে দেশ গঠনের কাজে অগ্রসর হয়েছেন সেজন্য অভিনন্দন না দিয়ে পারি না। আমাদের বৈদেশিক নীতি পরিষ্কার, আমরা … বিশ্বাস করি। আমরা দুনিয়ার দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াই। আমরা বেআইনিভাবে অত্যাচারিত লোকের সাথে আছি, আমরা ভিয়েতনামের অত্যাচারিতদের পিছনে – সাথে আছি। আমরা আরব দেশের দুঃখী মানুষের পাশে আছি। কারণ আমরা দুঃখী। আমরা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে স্বাধীনতা এনেছি। যেখানে যে দেশের দুঃখী মানুষ তার স্বাধীনতা তার ছেলেরা সংগ্রাম করে বাংলার মানুষ বাংলার সন্তান তাদের সাথে থাকবে। তাদের সন্তানদের তারা সাহায্য করবে।

আমরা কারো সঙ্গে দুশমনি করতে চাই না। আমরা ছোট দেশ। আমরা নন এলাইন … বিশ্বাস করি। আমরা সাউথ-ইস্ট এশিয়ার একটা দেশ। আমরা … সাবকন্টিনেন্টাল সাউথ এশিয়াতে আছি।

আমাদের দেশের দিকে অনেকের নজর থাকে। আমরা কারো নজরে পড়তে চাই না। আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাস করি। আমাদের ব্যাপারে কেউ হস্তক্ষেপ করুক আমরা সেটা চাই না। আমরা কারো ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। এটা আমাদের নীতি পরিষ্কার।আজ দুনিয়াতে অনেক কথা অনেকে বলে থাকেন, কিন্তু আমি যেটা মনে করি আরেকটা কনফারেন্সে আমি যা বলেছিলাম, যে, দুনিয়া দুইভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। একটা শোষক, আরেকটা শোষিত। শোষিতের পক্ষে যারা থাকে আর শোষকের পক্ষে যারা থাকে তারা কে, তারা কারা, সে কথা দুনিয়ার মানুষ জানে আমাকে আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। সে জন্য আমি মনে করি, যে আমাদের পথ একদম পরিষ্কার এবং আমরা সেই রাস্তা ধরে চলছি। সমাজতন্ত্র আমাদের প্রয়োজন। সমাজতন্ত্র না হলে এই দেশের দুঃখী মানুষের বাঁচবার উপায় নাই। আমরা শোষণহীন সমাজ চাই, আমরা সম্পদের সুষম বণ্টন চাই।

 আমাদের সহকর্মী ভাইরা, আপনাদের কাছে কথা আছে। সমাজতন্ত্রের রাস্তা সোজা রাস্তা নয়। সমাজতন্ত্র করতে হলে যা দরকার আমরা পয়দা করতে পেরেছি কিনা এ সমস্ত আলোচনার প্রয়োজন আছে। আজকে আমাদের সে জন্য … পয়দা করতে হবে। কিন্তু সমাজতন্ত্রের রাস্তায় আমরা যে পদক্ষেপটা নিয়েছি এ থেকে আমরা পিছাতে পারি না। সমাজতন্ত্রের শক্ররা সমাজতন্ত্রের নামে যাকে ইংরেজিতে বলা হয় যাকে অ্যাডভ্যানচারিজম বলা হয়। তারা আজ দেশের মধ্যে মাথা তোলার চেষ্টা করছে বিদেশিদের সাহায্যে। কিন্তু তারা ভুল করেছে, বাংলাদেশ অত্যন্ত ছোট। বাংলার মানুষ অত্যন্ত জাগ্রত। বিদেশের অর্থ, বিদেশের অস্ত্রে বাংলাদেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে বাংলার মানুষ কীভাবে তার প্রতিবাদ করতে হয় তা জানেন এবং তার প্রমাণ তা নিশ্চয় ভবিষ্যতে পাবে। তাদের ফিলোসফি কোত্থেকে পেয়েছে আমি জানি না। এ ফিলোসফিতে কোনোদিন দুনিয়ায় বিপ্লব হয় নাই। এটা ডাকাতি হতে পারে। এরা খুনি হতে পারে। রাতের অন্ধকারে একজনের গলা কাটতে পারে। রাতে একজনের বাড়িতে ডাকাতি করতে পারে। রাতে দেখা যাচ্ছে অ্যাটাক করতে পারে। তাতে বিপ্লব হয় না। এটা কলোনিজম। এরা দুনিয়া থেকে পচে গেছে। এদের ফিলোসফি ফেল করে গেছে। তারপরেও যে কোত্থেকে বুদ্ধি পেয়েছে কোন প্রগতিশীলদের কাছে বুদ্ধি পেয়েছে সেটা তাদের আমি নাই বা বললাম। কিন্তু সেই বুদ্ধিতে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে তার ভবিষ্যৎ ইতিহাস আমি বলতে পারি না। তবে বাংলার মাটিতে সুবিধা হবে না আমার মনে হয়। কারণ, এই মাটিতে আমি তো বহুকাল রাজনীতি করেছি। এই মাটি আমি চিনি। আমি তাদের কাছে ছাত্র ইউনিয়নের সভায়ও বলেছি, এখনো বলছি, ও পথ ভালো না। বিপ্লব এভাবে হয় না। দেশের জনগণকে বাদ দিয়ে বিপ্লব হয় না। বাংলার কৃষক মজদুরকে বাদ দিয়ে দেশের কৃষক মজদুরকে বাদ দিয়ে বিপ্লব হয় না। কোটি কোটি টাকা খরচ করে ঘরে বসে আলোচনা করলে বিপ্লব হয় না। বিপ্লব করতে হলে তার রাস্তা আছে। যে রাস্তা অনেক কঠিন রাস্তা এবং অনেক দিনের প্রয়োজন হয়। একদিনে হয় না। ২৫শে মার্চ আনতে ২৫ বৎসর সংগ্রাম করতে হয়েছে। এক দিনে আসে নাই। যারা জানেন ইতিহাস, যারা দেখেছেন ইতিহাস, যারা পড়েছেন ইতিহাস তারা জানেন যে, বিপ্লব করতে হলে কী করণীয় প্রয়োজন হয়। রাতের অন্ধকারে কাঁধে অস্ত্র জোগাড় করে চোরের মতো ঘরে প্রবেশ করিয়া গলা কাটিলেই বিপ্লব করা যায় না।

তারা ডাকাত বা খুনি হয়। যাক সেসব কথা, পরিষ্কার কথা, আমরা সোশ্যালিজমের দিকে যাবার, সোশ্যালিজম এত সোজা না। আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি যাতে ভবিষ্যতে দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়। সে পদক্ষেপ নিয়ে আমরা অগ্রসর হয়েছি। বাধা আমাদের আসবে। যাদের কাছ থেকে আমরা সম্পদ নিয়েছি যারা এখানে সম্পদ ফেলে গেছে তাদের দালালরা বিদেশি শত্রুরা তারা আজকে চেষ্টা করছে আমাদের এই সমাজতান্ত্রিক ইকোনমিকে বানচাল করার জন্য। যাতে সাবোটাজ হয়। যাতে প্রোডাকশন কম হয়। যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, মানুষের কষ্ট হয়। আপনাদের করতে হবে, আপনাদের নজর দেয়া। কারণ সমাজতন্ত্র আজকে করতে হলে শ্রমিক শ্রেণিকে এগিয়ে আসতে হবে এবং শ্রমিক শ্রেণিকে মোর ডিসিপ্লিনড হতে হবে। বাংলার কৃষক কিন্তু অত্যন্ত ভালো। বাংলার কৃষকদের আপনারা বুঝাতে পারেন তারা চায় যত পয়দা করতে হয় তার সুযোগ-সুবিধা পেলে তারা পয়দা করবে এবং তারা এগিয়ে এসেছে। তাদের নেতৃত্ব দিতে হবে আপনাদের সকলকে। যাতে বাংলার মানুষ বাংলার কৃষক আজকে আর শোষিত না হয় এবং তাদের সম্পদে তাদের সম্পদ তারা ভোগ করতে পারে এবং যাতে তাদের সম্পদ সুষম বণ্টন হয় সেদিকে আপনাদের নজর দিতে হবে। আমি বিশ্বাস করি বাংলার কৃষক আপনাদের সাথে থাকবে আপনাদের সংগ্রামে। বাংলার শ্রমিক তাদের দোষ দিয়ে লাভ নাই। বাংলার শ্রমিকদের দোষ দিয়ে যারা বক্তৃতা দেয় শুনি একমত নই। আমি নিজে দেখেছি নিজে কারখানায় গিয়ে, আমি নিজে তাদের সাথে মিশে দেখেছি, তারা কাজ করতে চায়। আমি আপনারা অসন্তুষ্ট হবেন না, আমি সোজা কথা বলি যদি কিছুসংখ্যক আমার দেশের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর যারা আছেন তারা আর কিছু শ্রমিক নেতারাই গোলমাল সৃষ্টি করেন, শ্রমিকদের আমি দোষ দিবার পারবো না।

এই দিকে আমার খেয়াল রাখতে হবে। আশা রাখতে হবে, তারা কাজ করতে চায়। তারা উৎপাদন করতে চায়। তারা বাঁচতে চায়, তারা বুঝতে চায়। তো তাদেরও ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন আছে, সেদিকে আপনাদের নজর দিতে হবে। সোশ্যালিজমের রাস্তা এত সোজা নয়। এ বড় কঠিন রাস্তা। আর যেখানে, আমি সেদিন বলেছিলাম বোধহয় ছাত্র ইউনিয়নের সভায় যে, সোশ্যালিজম যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেই সোভিয়েত ইউনিয়নও আজ কত বৎসর হয়ে গেছে সোশ্যালিজমে পৌঁছতে পারে নাই। এখনো ঘাত-প্রতিঘাতে অগ্রসর হচ্ছে, নতুন নতুন তাদের পন্থা নিতে হচ্ছে। এটা তো সোজা রাস্তা নয়। এ রাস্তা কঠিন রাস্তা। আর আপনারা সাড়ে ৭ কোটি লোক ২০০ বৎসর সোয়া ২০০ বৎসর গোলাম, যুদ্ধে আপনাদের শেষ হয়ে গেছে, বিশ মাসের মধ্যে সমস্ত কিছু পেয়ে যাবে যারা আশা করে তারাও পাগলাগারদে বাস করছে, যারা ভরসা করে তারাও পাগলাগারদে বাস করছে, যারা ওয়াদা করে তারাও পাগলাগারদে বাস করছে। কারণ এত তাড়াতাড়ি কিছুই দেবার ক্ষমতা আমাদের নাই। আমাদের হাতে চাল নাই। আমরা একটা সিস্টেম নিয়েছি, যে সিস্টেমে আমাদের কোনো অসুবিধা হতো না যদি সোশ্যালিজম না দিতাম। আজকে আমরা হুকুম দিয়ে দিতাম সব চালাও, সব করো – দেখতেন কী অবস্থা হতো, কোনোদিন জমা হতো না। কিন্তু যে অবস্থা যাচ্ছে তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের কী করতে হতো? যদি আমরা বিপ্লবের পরে, যদি এখানে এসে শোষকগোষ্ঠীর হাতে দিয়ে দিতাম সমস্ত অর্থনীতি তাহলে এখানে আবার আমাকে আবার কী জানি কয় বিপ্লব করতে হতো। তাতে উপায় ছিল না। কিন্তু যখন আমাকে আঘাত করতে হয়েছে, বুঝে-শুনে আঘাত করেছি। না এদের আর লুটতে দেয়া যাবে না। চাবিকাঠিটা হাতে নিয়ে নিতে হবে। ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, ইন্ডাস্ট্রি, ইমপোর্ট, এক্সপোর্ট যতদূর পারা যায় হাতে নিয়ে নাও। কষ্ট হবে, দুঃখ হবে, এক্সপেরিয়েন্স নাই। আমাদের কী জানি কয় ক্যাডার নাই। কষ্ট হবে কিন্তু, মানুষের কষ্ট হবে ভবিষ্যতে, একদিন অদূরভবিষ্যতে সোশ্যালিজমের ফল আজকে ভোগ করা যায় না। ১০ বৎসর, ২০ বৎসর, ২৫ বৎসর পর ভোগ করা যায়। এই যে মানুষকে বুঝতে হবে যারা সোশ্যালিজমে বিশ্বাস করে যারা সমাজতন্ত্র বিশ্বাস করে, না বুঝলে উপায় নাই। সোজা রাস্তা হয় না। সেজন্য সে-পথ আমাদের ছাড়তে হবে এবং আমরা বাঙালি, আমরা বাংলা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। এ সম্বন্ধে কিন্তু নাই। আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি, আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র অর্থ লাইসেন্স নয়। আদর্শের বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষমতা কারো নাই। নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষমতা নাই। যখন শাসনতন্ত্রে আমাদের চারটা স্তম্ভ রয়েছে তার বিরুদ্ধে কখনো কথা বলার ক্ষমতা নাই। একদিকে সমাজতন্ত্রের কথা বলবো, আরেক দিকে সাম্প্রদায়িকতার কথা বলবো। একদিকে বিশ্বশান্তির কথা বলবো, আরেক দিকে গোপনে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে হাত মিলাব বুঝি না ভাই।

আমি খুব কনফিউজড হয়ে যাই, এ আমি বুঝি না। আমার কাছে মাথার মধ্যে আপনারা বড় বড় ফিলোসফাররা আছেন, বড় বড় নেতারা আছেন, অনেক পড়ালেখা করেছেন, আপনারা বুঝতে পারেন, আমি অতোখানি বুঝি না। আমি সোজা বুঝি যে সাম্প্রদায়িক আর সমাজতন্ত্র পাশাপাশি পথ চলতে পারে কেমন করে আমি জানি না। আমি শিখি নাই। আমার রাজনীতি জীবনে আমার শিক্ষা হয় নাই এ পর্যন্ত। আমার সহকর্মীদেরও হয় নাই। আপনাদের আজ সমাজতন্ত্রের কথা বলবে আর সাম্প্রদায়িকতার কথা বলবে বাংলার মাটিতে আমি মনে করি আপনাদের সকলেরই উচিত। কারণ, আমাদের দেশের মানুষ ধর্মভীরু। তাদের ওই স্লোগান দিয়া বলে নাই স্লোগান দিয়া কিছুটা তাদের-ই করা যায়। তাদের খারাপ পথে নেয়া যায়। যখন দেখে যে কোনোমতে মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারছে না তখন তারা সাম্প্রদায়িক স্লোগান দেয়া আরম্ভ করে।

বিপ্লবী ভাইরা আমার, দুঃখ হয় সেখানে আমার তথাকথিত বিপ্লবী ভাইরা আমার। সেজন্য আপনারা মাফ করবেন। বলেছিলাম যে, আপনারা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, বাঙালি কমিউনিস্ট পার্টির আপনারা সদস্য। আপনারা কমিউনিস্ট পার্টির মনোপলি আপনাদের নাই বলে মনে হচ্ছে আমার। কারণ এত কমিউনিস্ট পার্টি গোপনে গোপনে এত কমিউনিস্ট আর এত সোশ্যালিস্ট পার্টি আর এত প্রোগ্রেসিভ পার্টি হয়ে গেছে যে মুসিবতে পড়ে গেছি আমরা। হ্যাঁ, তবে আমরা এটুকু বুঝি যে আপনাদের সঙ্গে আমাদের নীতির মিল আছে। আমরা সোজাসুজি একপথে চলছি সেই জন্য আপনাদের আমরা শ্রদ্ধা করি। কিন্তু, আমার মনে হয় জনাব মার্কসের মার্কসবাদ বিপদে পড়ে গেছে।

যে তাকে নিয়ে আপনারা আমরা এমন টানাটানি শুরু করে দিয়েছি যে তার কোনো আর সীমা নাই। কত যে মার্কসবাদী বাংলাদেশে হয়েছে তার কোনো সীমা নাই। এ গ্রুপ, ও গ্রুপ, ও গ্রুপ, এ থিওরি ও থিওরি, আবার মধ্যে কংগ্রালাজিম আবার সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র আবার বিদেশি শক্তির সঙ্গে স্বাধীনতায় আঘাত করার চেষ্টা। আমরা বিপদে পড়ে গেছি, বুঝতে পারি না বলে কনফিউজড হয়ে যাই। তবে এখন চিনতে পেরেছি এ জন্য যে, আপনারা যখন পরিষ্কার চার স্তম্ভ সমর্থন করেছেন, … আপনারা সোশ্যালিজম করছেন তখন মনে হচ্ছে যেন তারপরে যারা সোশ্যালিস্ট কান্ট্রি যারা সোশ্যালিজম করেছে তারা যখন আমাদের দিকে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে দুর্দিনেও দাঁড়িয়েছিল আজো দাঁড়াইছে, সেদিকে আপনার দেখে একটু ভালো ভালো মনে হয়। এর মধ্যে আপনারাই বোধ হয় একমাত্র রেজিস্ট্রেশন পেতে পরেন। আমি মাঝে মাঝে একটু কনফিউজড হয়ে যাই।

যাই হোক আপনাদের ফিলোসফির ব্যাপার। আপনারা ফিলোসফি করেন আমার আপত্তি নাই। তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমরা অতো ফিলোসফি বুঝি না। সোজা কথা বুঝি, সোজা কাজ করি, সে পথে চলছি। আপনাদের আমি মোবারকবাদ জানাই সেই জন্য আপনারা আছেন। কিন্তু আমার প্রচুর দুঃখ হয়, ভারতের বিরুদ্ধে আমি কথা বলবো। কেন ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলবো। ভারতের নাম নিয়ে তারা স্লোগান দিচ্ছে। আমি কেন ভারতের কথা বললে মানুষ শুনবে সেজন্য ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। খুব দুঃখ হয় আমার এ কথায় যে ভারত আমার প্রতিবেশী। কালকে খবরের কাগজে দেখলাম এ কয়েকদিন আগে পার্লামেন্টে উত্তরে ভারত গভর্নমেন্টের উত্তরে বলা হয়েছে যে, প্রায় সাড়ে তিনশত কোটি টাকা আমার বাংলাদেশের মানুষ যখন পাকিস্তানের মাইরের চোটে টিকতে না পেরে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল সাড়ে তিনশো কোটি টাকার সম্পদ তাদের খাওয়াতে হয়েছে ভারতবর্ষকে। যে জন্য আজকে ভারতবর্ষ আজকে সাফার করছে।আজ আট লক্ষ টন খাবার বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার পরে দিয়েছে। তারা আমার বন্ধুরাষ্ট্র, তারা আমার দুর্দিনের বন্ধু। আজকে আমি এ-কথা আমি আমেরিকার বন্ধুত্ব চাই, আমি ফ্রান্সের বন্ধুত্ব চাই। আমি গ্রেট ব্রিটেনের বন্ধুত্ব চাই। আমি জাপানের বন্ধুত্ব চাই। আজ আমি দুনিয়ার সব দেশের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ভারত আমার বন্ধু, তার বিরুদ্ধে আমার কথা বলতে হবে। সোভিয়েত আমার বন্ধু, তার বিরুদ্ধে আমার প্রপাগান্ডা করতে হবে। সে-কথা আমি বুঝতে পারি না। আমার বন্ধু আমার বন্ধু পুরানো ভালো, শাড়ি নতুন ভালো। কী বলেন? মাফ করবেন।

বন্ধুত্ব আমি চাই, সেটা আমার বন্ধু। আমি সবার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। আমি আমেরিকার সাহায্য নিয়েছি। আমাকে দাও, সোভিয়েতও আমেরিকার সাহায্য নিয়েছিল বিপ্লবের পরে। আমি সবার সাহায্য নিচ্ছি সাহায্য দাও আমাকে। আমি আমার দেশ গড়তে চাই। সবার সাথে বন্ধুত্ব চাই। আমার ফরেন পলিসি … ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফরেন পলিসি। আমার বন্ধুত্ব নষ্ট করার চেষ্টা করলে সেখানে আমার বন্ধুত্ব রাখবো, বন্ধুত্ব আমার থাকবে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব আমি করতে চাই। কারো সাথে আমি দুশমনি করতে চাই না। এ হলো আমার বাংলাদেশ সরকারের পলিসি। কিন্তু আজকে একদল লোক হয়েছে তাদের স্লোগান হলো ওই একটা, যে আমরা কারো পকেটে চলে গেছি আমরা সোভিয়েতের পকেটে চলে গেছি, আমরা ভারতের পকেটে চলে গেছি, যে দেশ ৩০ লক্ষ লোকের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে সে দেশ কারো পকেটে যেতে পারে না সেটা মনে রাখা দরকার।

আমি আজ পর্যন্ত দেখি নাই যে আমার বন্ধুরা আমাদের কোনো কাজে এসে কোনোদিন ইন্টারফেয়ার করেছে সেটা আমি দেখি নাই। আমরা বন্ধুত্ব সকলের সঙ্গে চাই। সকলের সঙ্গে দুনিয়ার সব কান্ট্রির সাথে বন্ধুত্ব চাই। আমরা নন-অ্যালায়েন্স ফরেন পলিসিতে বিশ্বাস করি। আমাদের পলিসি ক্লিয়ার। এর মধ্যে কিন্তু-ফিন্তু নাই কিন্তু। কিন্তু তারা আজকে বাংলাদেশের মধ্যে আপনার ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা তো অন্য কিছু নয়। কমিউনিজম সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা, আর কিছু না। আপনারা কি মনে করেন যে বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা হবে। আমার বাংলার মানুষ সাম্প্রদায়িক নয়। বাজে কথা। এরা ভুলে গেছে যে, পাকিস্তানিরা দুনিয়ার যত সাম্প্রদায়িক ভাষা ছিল সব ভাষা ব্যবহার করে তার পরে অস্ত্র এনে তারপর সৈন্য এনে বাংলার মানুষকে দাবাতে পারে নাই। বাংলার মানুষকে ভুল পথে নিতে পারে নাই। তাদের ফিলোসফি ভুল হয়ে যাবে। এখন তো শুধু বক্তৃতা করবি, পাকিস্তানি অস্ত্র তো পাবি না। পাকিস্তানের সৈন্য তো পাবি না। আর চায়না থেকেও এরোপ্লেনে করে অস্ত্র তো আনবে না। তাহলে তাদের সুবিধা হবে না সাম্প্রদায়িকতা করে, ও-রাস্তা ছেড়ে দাও ভাই, ও-রাস্তা খারাপ। সাম্প্রদায়িক মানুষ সংকীর্ণ মানুষ, নিচু মানুষ। কোনো প্রকৃতিকে বিশ্বাস করতে পারে না। এজন্য সাম্প্রদায়িকতা বাংলার মাটি থেকে মুছে ফেলতে হবে। কেননা, আমরা তো সেটা বলি না। যখন আমরা বলি আমরা সেক্যুলার আমরা সেক্যুলার কান্ট্রি। যখন আমরা বলি ধর্মনিরপেক্ষতা। তখন তো আমরা বলি যে প্রত্যেকে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ আমরা বলি। তো আমরা তো বলি প্রত্যেকটা মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার আছে। তাদেরকে আমরা বাধা দিবো না, মুসলমান তাদের ধর্মকর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম পালন করবে, খ্রিষ্টান তার ধর্মকর্ম পালন করবে, বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম পালন করবে, তারা করবে। কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। একজনের ধর্মে অন্যজন হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এটা আমাদের ক্লিয়ার আছে। সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। সেজন্য আমার, ভাইয়েরা আমার, আমি বক্তৃতা করছি বেশি সময়, আজকে আমার বাংলার মানুষ দুঃখী। মানুষ বাংলাদেশে অভাব- অভিযোগের অভাব নাই। আমাদের সবকিছুই আজকে আমাদের নতুন করে গড়তে হবে। আমরা সেজন্য আজকে আমাদের বাংলার যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলার কৃষক-ছাত্রকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলার মজদুরকে এগিয়ে আসতে হবে। বাংলার বুদ্ধিজীবীকে এগিয়ে আসতে হবে। নতুন শপথ নিয়ে নতুনভাবে দেশকে গড়ার। কারণ, যে রাস্তা আমাদের পরিষ্কার রাস্তা, আমরা সমাজতন্ত্রে পৌঁছতে চাই। কঠিন রাস্তা যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, জাতীয়তা বিশ্বাস করে, ধর্মনিরপেক্ষতা বিশ্বাস করে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের কাজে অগ্রসর হোক সেটা আমি কামনা করি। আপনাদের এই কংগ্রেস সাফল্যমণ্ডিত হোক এই কামনা করে আপনাদের ধন্যবাদ জানিয়ে আমি বিদায় নিলাম।*** [ওঙ্কারসমগ্র : বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত ভাষণের শ্রুতিলিপি, ঐতিহ্য, ২০১৭]