ভাষা ও ভাষা-পরিকল্পনা

রহমান হাবিব

 

আবদুর রহিম ‘বাংলাদেশের ভাষা-পরিকল্পনা’  বিষয়ে তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ভাষাপ্রেমী। বাংলা বানানের কথা (১৯৯৮) নামে তাঁর একটি বই আছে। ভাষার প্রতি অন্তর্দৃষ্টি এই লেখকের অনেক দিনের। তাঁর রচিত সাহিত্য-সমালোচনার বই যেমন রয়েছে, তেমনি উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন। কিন্তু মূলত তাঁর নিবিষ্টতা ভাষাবিজ্ঞানের প্রতি। তাঁর ভাগ্যও ভালো, ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক দানিউল হকের মতো শিক্ষককে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে পেয়েছিলেন। গবেষকের তত্ত্বাবধায়কও একজন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ।

লেখক ১৯৯৯-২০০০ শিক্ষাবর্ষে পিএইচ.ডি রেজিস্ট্রেশন করে ডিগ্রি পান ২০০৪ সালে। ২০১৪ সালের মধ্যে তাঁর উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ ও সমালোচনাসহ

আট-দশটি বই বেরিয়ে গেলেও তাঁর থিসিসটি তিনি বের করেন ২০১৭ সালে। থিসিসে তিনি নতুন কিছু তথ্য সংযোজন করেছেন। বইটির অধ্যায়-বিভাজন লক্ষ করলে বোঝা যায়, সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত চিন্তাসমন্বয়ে বইটি রচনার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

ভাষা-পরিকল্পনা সম্পর্কে ডেভিড ক্রিস্টাল তাঁর A First Dictionary of linguistics and phonetics গ্রন্থে যে-সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেটিকে খুব গুরুত্ববাহী মনে করি বলে ড. মোরশেদের ভূমিকা থেকে তা উদ্ধৃত করছি : Language planning is a term used in sociolinguistics to refer to a systematic attempt to solve the communication problem of a community by studying the various languages or dialects it uses and developing a realistic policy concerning the selection and use of different languages.

ভাষা-পরিকল্পনা আসলে মানুষের ভাষিক যোগাযোগ সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা। ‘ভাষায় বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে এবং এসব সমস্যা সমাধানের জন্য

উত্তম-সিদ্ধান্ত গ্রহণকে ভাষা-পরিকল্পনা বলা হয়। ভাষা বলায় এবং লেখায় পরিবর্তন আনয়ন করা যায় এবং ভাষার সুবিবেচিত পরিবর্তনই ভাষা পরিকল্পনা।’

(বাংলাদেশের ভাষা-পরিকল্পনা,   ঢাকা, অবসর, ২০১৭, পৃ ৪-৫)

ভাষা-পরিকল্পনা সম্পর্কে লেখকের কতিপয় সিদ্ধান্ত স্মর্তব্য :

১. জাতীয় পর্যায়ে ভাষার সমস্যাবলি সমাধানের লক্ষ্যে ভাষা-পকিল্পনা করা হয়।

২. ভাষার সম্পদসমূহের উন্নয়ন সাধন কিংবা ভাষার সুচিন্তিত পরিবর্তন সাধন করা ভাষা-পরিকল্পনার লক্ষ্য।

৩. ভাষা-পরিকল্পনায় রাজনীতিক এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতে পারে।

৪. ভাষিক যোগাযোগ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কোনো ভাষার ফাংশন বা ভূমিকা পরিবর্তনকেও ভাষা-পরিকল্পনা বলা হয়।             (ওই, পৃ ৮)

ভাষার কর্পাস প্ল্যানিং (CP) বলতে কোনো ভাষার বানান, পরিভাষা, উচ্চারণ প্রমিতকরণ, ব্যাকরণ-অভিধান প্রণয়ন, নতুন বর্ণের অভিযোজন ইত্যাদিকে বোঝানো হয়।

ভাষার স্ট্যাটাস প্ল্যানিংয়ের (SP) সংজ্ঞা লেখক নিম্নোক্তভাবে দিয়েছেন : কোনো রাষ্ট্রের এক ভাষার সঙ্গে অন্য ভাষার বা ভাষাসমূহের অবস্থানগত সম্পর্ক বা মর্যাদা নির্ধারণ করা কিংবা বলা যায় রাষ্ট্রের প্রত্যেক ভাষার ভূমিকা নির্ধারণ করাকে status planning বলে।

‘বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি : একটি সমাজ-ভাষা-বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক বলেছেন, সমাজ ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যেহেতু বাংলাদেশে দ্বিভাষিক (bilingual) ও বহুভাষিক (multilingual)পরিস্থিতি বিদ্যমান, সে-কারণে বাংলাদেশে বিদ্যমান ভাষাগুলোর ব্যবহারকারীদের মধ্যে কোড নির্বাচন, কোড সরণ, কোড মিশ্রণ ও কোড পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। মৃণাল নাথের একটি সংজ্ঞা লেখক কোড-মিশ্রণের ব্যাপারে নিম্নোক্তভাবে ব্যবহার করেছেন : বাক্যালাপে বা কথা বলার সময় এক ভাষার সঙ্গে অপর ভাষার ব্যাকরণগত বিভিন্ন স্তরে যে সংগতিপূর্ণ মিশ্রণ ঘটে, তাকেই

কোড মিশ্রণ বলা হয়।     (ওই, পৃ ৩০)

‘বাংলাদেশে ভাষাসমূহের মর্যাদা পরিকল্পনাস্বরূপ ও পরিধি’ শীর্ষক তৃতীয় অধ্যায়ে মর্যাদা পরিকল্পনাকে মূলত দুটো প্রধান ভাগে তিনি বিভক্ত করেছেন :

এক. বাংলাদেশের শিক্ষায় ভাষা-পরিকল্পনা।

দুই. বাংলাদেশের প্রশাসনে ভাষা-পরিকল্পনা।

‘বাংলাদেশের শিক্ষায় ভাষা-পরিকল্পনা’ শীর্ষক তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সমাজের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক সম্পর্কে এসকে ভার্মার একটি গুরুত্বপূর্ণ

উদ্ধ ‍ৃতি লেখক ব্যবহার করেছেন Language is central to the whole process of education and in the principal means of Cultural Transmission.       (ওই, পৃ ৪৩)

বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে অভিজাততন্ত্রের ভাষা যেহেতু ইংরেজি এবং গণতন্ত্রের তথা সাধারণের ভাষা যেহেতু বাংলা – তাই এতে ভাষা-সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা, ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষা ও বাংলা মিডিয়াম শিক্ষার মধ্যে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার সুষম সমন্বয় না ঘটাতে পারলে আমার মনে হয় না এই

ভাষা-সংকটের সমাধান কখনো হবে।

‘বাংলাদেশের প্রশাসনে ভাষা-পরিকল্পনা’ শীর্ষক উপ-পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে : বাংলাদেশের নিম্ন আদালতগুলোতে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হলেও উচ্চ আদালতে এখনো ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হয়। আইনকে জনগণ-দখলে আনতে বাংলা ভাষায় আইনি রায় দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই বলে আমার মনে হয়।

‘বাংলাদেশে ভাষাসমূহের অবয়ব পরিকল্পনা’ শীর্ষক চতুর্থ অধ্যায়ে মূলত বাংলা বর্ণমালা, বানান, উচ্চারণ, পরিভাষা, অভিধান ও ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে। প্রমিত উচ্চারণ নির্মাণ করা কিংবা কোনো ভাষার উচ্চারণকে প্রমিত করা ভাষার অবয়ব পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্তি।

‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের ভাষা-পরিস্থিতি ও ভাষা-পরিকল্পনা’ শীর্ষক ষষ্ঠ অধ্যায়ে মূলত চাকমা, মারমা, রাখাইন, ত্রিপুরা, মণিপুরি, গারো, সাঁওতাল প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষিত হয়েছে। মূল ভাষা বাংলা হলো বাংলাদেশের মেজরিটি লোকের ভাষা। আদিবাসীদের ভাষা হলো মাইনরিটির ভাষা। সুখের বিষয়, বাংলাদেশে মেজরিটি ও মাইনরিটি ভাষার মধ্যে দ্বন্দ্ব নেই। তবে রাষ্ট্রীয় ও এনজিওগতভাবে মাইনরিটি ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের ব্যাপক অন্তরঙ্গ পরিচর্যা সৃষ্টি হওয়া জরুরি বলে মনে করি।

‘বাংলাদেশের ভাষা-পরিকল্পনাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা’ শীর্ষক সপ্তম অধ্যায়ে বাংলা একাডেমি, বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ভাষা সমিতি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভাষা-পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ভূমিকার স্বরূপ বিশ্লেষিত হয়েছে।

‘ডায়গ্লসিয়া ও বাংলাদেশের ভাষা-পরিকল্পনা’ শীর্ষক অষ্টম ও সর্বশেষ অধ্যায়ে মূলত উচ্চ পরিবৃত্তি  (ঐ) অর্থাৎ সাধুরীতি এবং নিম্ন পরিবৃত্তি (খ) বা চলিতরীতির আলোচনা স্থান পেয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিসন্দর্ভসমূহও চলিতরীতিতেই সম্পাদিত হয়। ভাষার গতিশীল সাবলীলতার স্বাচ্ছন্দ্যের কারণেই তা সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করি।

বাংলাদেশে বাংলা ভাষার অবয়বগত বা উপাদানগত বিষয়, যেমন – প্রমিত বানান, উচ্চারণ, প্রতিবর্ণীকরণ, পরিভাষা ও ব্যাকরণের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যেমন মতভেদ আছে, তেমনি আদিবাসীদের ভাষার অবয়বগত ও অবস্থানগত সমস্যাও প্রত্যক্ষযোগ্য। এগুলোর উদারনৈতিক ভাষাতাত্ত্বিক ও জাতিতাত্ত্বিক সমাধান বিনির্মাণ দেশপ্রেমের স্বার্থেই জরুরি হয়ে পড়েছে। এই ভাষিক-পরিকল্পনা-সংকটের সমাধানকল্পে অধ্যাপক আবদুর রহিম ১৯৭১ থেকে ২০১৬ সাল অবধি ভাষিক-পরিস্থিতির যে সুবিন্যস্ত পরিপ্রেক্ষিত উপস্থাপন করেছেন, তাতে বাংলাদেশের ভাষা-পরিকল্পনার একটি প্রসারী পথকে তিনি সফলভাবে বিস্তৃত করেছেন। এজন্য তিনি ধন্যবাদার্হ।