ভুবনায়নের এক অজানা কাহিনি

কার্তিক লাহিড়ী

অনীশ শুরুই করতে পারছে না কোনো লেখা, মাথায় গিসগিস করছে একগাদা প্লট, বিষয়, চরিত্র, ঘটনা, কাকে ধরে কাকে ছাড়বে, একটাকে ধরতে গেলে আরেকটা টপকে চলে আসে সামনে, সেটাকে কব্জা করতে গেলে আরেকটা, অনীশ নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে, তাকে তো লিখতে হবে অন্তত দু-তিনটে, কিন্তু করবে কী? এই যদি অবস্থা হয় তখন হাল দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না, সামনে পড়ে আছে সাদা পাতা, একটা অাঁচড়ও পড়েনি সেখানে, অথচ –

ওই অথচ তাকে পাগল করে দেবে শেষমেশ, কিছু একটা করতেই হবে, না লিখলে কথার খেলাপ হয়ে যাবে সে যেটা মোটেই সহ্য করবে না, করতে পারে না, এক কথার মানুষ অনীশ অথচ –

এখন সে কথা রাখতে পারছে না মোটে, আগে যে গল্পের মাল-মশলা খুঁজে খুঁজে হয়রান হতো, এখন একের পর এক  গল্প, চরিত্র, প্লট দরজা ধাক্কাচ্ছে কলমের ডগায় বেরিয়ে আসার জন্য, বেরিয়ে আসতে চাইছে হুড়মুড়িয়ে, কোনো একটাকে বাঁধতে পারছে না পাতার উপর, পাতা তেমন সাদাই পড়ে আছে এবং কলমও খোলা, অথচ

আবার অথচর খপ্পরে পড়ার আগে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়, অনীশ কোনো নামিদামি লেখক নয়, সে লিখে থাকে ছোটোখাটো পত্র-পত্রিকায়, ওইসব পত্রিকাই তার লেখার তাগিদ বাঁচিয়ে রেখেছে, এখন কথার খেলাপ হলে…, বুক কেঁপে ওঠে উদ্বেগে, এরপর যদি আর না চায় তারা? অনীশ সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে, নাহ, লিখতেই হবে, এমন সংকল্প নিয়ে কলম তুলে নেয় তেজে, কিন্তু কাগজে কলম ছোঁয়াতে গিয়ে ধন্ধে পড়ে, কোনটা লিখবে, কোনটা? হুড়হুড়িয়ে একের পর এক গল্প, বিষয় ইত্যাদি চলে আসতে থাকে কলমের ডগায়, আর সে দেখে

সাদা কাগজ হিজিবিজিতে ভরে গেছে, চোখ ফেটে জল ঝরে পড়তে চায় তখন, কী করবে এখন? হয়তো এই হচ্ছে তার লেখক জীবনের অন্তিম লগ্ন, এরপর কী করবে সে? একটা  চাকরি আছে যদিও, সেই চাকরির ঘানি টেনে টেনে আর পাঁচজনের মতো একসময় রিটায়ার করবে, পেনশন যা পাবে তাতে চলে যাবে ছোট্ট সংসার, ব্যস, অথচ

অথচ কত কী ভেবে রাখে অনীশ, সে আর পাঁচজনের মতো মাছিমারা কেরানীর জীবনযাপন করতে জন্মায়নি, তার বাইরে একটা কিছু করতে চেয়েছিল, লিখবে, লিখে কিছু দিয়ে যাবে মানুষকে, আর সেই সুবাদে ছোটো কাগজে লিখেও একটা জায়গা করে নেবার চেষ্টা করে, সম্পাদকরা তাকে কিছুটা মান্য করতেও শুরু করেন, যেজন্য সে লেখার ডাক পেত সিরিয়াস পত্রিকার সম্পাদকদের কাছ থেকে, এখনও পেয়েছে, অথচ –

দীর্ঘশ্বাস পড়ে অনীশের, এবার বোধহয় সে-পালা শেষ হতে চলেছে, এতদিন খুঁজে এসেছি গল্প, বিষয়, আর এখন রাশি রাশি গল্প, বিষয়ের মধ্যে ডুবে থেকে একটাও কিছু লিখতে পারছি না, হয়তো সব লেখকের জীবনে এমন সময় আসে, আমিই বা সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হতে যাবো কেন?

অনীশ ভাবতে পারছে না আর, হতাশায় হতাশায় একশেষ হয়ে যেতে থাকে, এর থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা নেই নাকি কোনো? লেখাই তো জীবনের একমাত্র পথ হতে পারে না, কত লোক কতভাবে নিজেকে প্রকাশ করে, সকলেই লেখক হয় না, তাই তো…

ভেবে অনেকটা হালকা হয়, লিখতে পারছি না, তাতে কি অন্য কিছু করতে পারি, মনে মনে বল সঞ্চয় করতে থাকে, চেষ্টা করতে হবে এই জাল থেকে বেরিয়ে আসার, পঙ্গু যদি গিরি লঙ্ঘন করতে পারে চেষ্টায় তাহলে না পারার কি আছে?

অনীশ ভাবতে থাকে, কিন্তু দিশা খুঁজে পাচ্ছে না কোনো, কী করতে পারে সে? একবার ভাবে, বসার ঘরে গিয়ে টিভি দেখতে বসবে, আবার ভাবে, একটা হালকা বই টেনে নিয়ে না-পারার টেনশনটাকে কমাবে, দোটানায় পড়ে কী করবে ভাবার আগেই পা বাড়ায় বসার ঘরের দিকে, বসার ঘরে পা দিতেই মীরা বলে ওঠে, দাদা খুব মিস করলি, এইমাত্র শেষ হয়ে গেল

কী মিস করলাম?

আবার নষ্টনীড় নামে একটা বাংলা ছবি দেখাচ্ছিল এতক্ষণ

আবার নষ্টনীড়? মানে? অনীশ অবাক হয়ে তাকায়

আরে বাবা একটা বাংলা ছবি, আজকাল তো হামেশাই হচ্ছে, নতুনভাবে পুরনো জিনিস তুলে ধরা, যেমন নষ্টনীড় নিয়ে ছবি করলেন সত্যজিৎ রায় – চারুলতা, সেই চারুলতাকে নতুনভাবে ফুটিয়ে তুললেন আরেক পরিচালক নষ্টনীড় ২০১১ নামে, আবার সেই গল্পের আদলে হাল আমলের সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে করা হলো আবার নষ্টনীড়, দেবদাসও তো কতবার হলো হিন্দি আর বাংলায়, মীরা হাসে, এটাই এখন সিনেমার নতুন ট্রেন্ড বলতে পারিস

মানে?

পুরনোকে নতুনভাবে আজকের মতো দেখানো

অনীশ তীক্ষ্ণভাবে তাকায় মীরার দিকে, তাতে মীরা একটু থতমত খেয়ে বলে, আমার কথা বিশ্বাস না হলে বীরেশদাকে জিজ্ঞেস করিস, বীরেশদা অনেক খবর রাখে সিনেমার

মীরার কথা শেষ হবার আগেই অনীশ বলে ওঠে, হুররে! তুই একটা দারুণ জট ছাড়িয়ে দিলি আমার

জট? মীরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, তখন

অনীশ এক মুহূর্ত নষ্ট না করে নিজের ঘরে চলে আসে, সিনেমায় যদি রি-মেক হতে পারে, তবে সাহিত্যেই হবে না কেন? পুরনোকে নতুনভাবে আজকের মতো করে তোলা, দ্যাটস্ ইট্, আমিও একটা পুরনো গল্প বা বিষয়কে প্রাসঙ্গিক আজকের মতো করে দেখাতে পারি, এতক্ষণের অস্থিরতা হঠাৎ স্থির হয়ে যাচ্ছে, একগাদা বিষয়, গল্প মাথায় গিসগিস করা যত কিছু লহমায় হাওয়া হয়ে যাচ্ছে কোথায়, আর অনীশও বুকে বল ফিরে পাচ্ছে, একটা গল্প, তাকে নতুন সাজে নতুনভাবে আজকের আলোয় উপস্থিত করতে হবে, ব্যস্…

অনীশ দারুণ হালকা বোধ করতে থাকে এখন, যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে এইমাত্র, এত হালকা বোধ করেনি কখনো, তখনি মনে পড়ে এখন সামনে রয়েছে একটি মাত্র কাজ – গল্পবাছা

 

বাছাইয়ের কাজ যত সহজ মনে হয়েছিল, কাজে নেমে দেখছে এ কাজের চেয়ে বরং আগের অবস্থা ভালো ছিল অনেক, তখন অনেক বিষয়, চিন্তা-ভাবনা, প্লট, চরিত্র ব্যতিব্যস্ত করে তুললেও তাতে বহু মৌলিক জিনিস ছিল, যা কব্জা করতে পারলে দারুণ হতো, এখন আফসোস করে লাভ নেই, কারণ সেগুলো মাথা থেকে হাওয়া হয়ে গেছে কোথায়, তার একটি কেন আধখানা বা সিকিভাগও মনে নেই আর, অতএব

এখন বাছাইয়ের কাজে মন দিতে হবে, তবে এই কাজও সে অনেকখানি হালকা করে ফেলেছে, তালিকা থেকে সে প্রথমেই বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে বাদ দিয়ে রাখে, এঁদের গল্প-উপন্যাস নিয়ে নানাভাবে নানা সময়ে অনেক কাজ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তবু কি বোঝা হালকা হয়? যাঁদের লেখার কথা মনে পড়ে বিশেষ করে যেসব লেখা, তার কথা ভাবতে গিয়েও মন খুঁতখুঁত করতে থাকে, এসব লেখা নিয়েও সিনেমা, নাটক ইত্যাদি হয়েছে বিস্তর, তাহলে?

আরো গল্প-উপন্যাস ঢুঁড়তে থাকে অনীশ, হাতের কাছে যা পায় একবার চোখ বুলিয়ে নেয়, নাহ্, যা সে খুঁজছে, তেমন একটাও পায় না। ফের সে আগেকার লেখাগুলোই পড়তে থাকে, বিফল হয়। এর চেয়ে তার আগের অবস্থাই ভালো ছিল, অস্থির না হয়ে, যদি একটু ধৈর্য ধরে কাগজ-কলম নিয়ে বসে থাকত, তবে একটা হিল্লে হয়ে যেত নিশ্চয়ই, কিন্তু তখন অপেক্ষা করতে করতে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, হতাশ হয়ে যখন ভেঙে পড়ছে প্রায় তখন মীরার কথায় একটা নতুন দিশা পায়, অথচ –

সেই দিশাও তো তাকে পৌঁছে দিতে পারছে না সঠিক লক্ষ্যে, হাল ছেড়ে দিয়ে যখন লেখা ছেড়ে দেবো দেবো করছে, তখন হঠাৎই মনে হয় সৃজনশীল লেখক ছাড়াও অনেক লেখক আছেন, যাঁদের লেখা তালাশ করা যেতে পারে, ভেবেই সে টেনে নেয় একটা বই – বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ প্রথম খন্ড \ শিক্ষা, তা দেখে  হতাশই হয়, তবু উলটে যায় একে একে কথামালা নীতিবোধ চরিতাবলি জীবনচরিত বোধোদয় ইত্যাদি ইত্যাদি, বই বন্ধ করার মুখে নজরে পড়ে বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ,

কৌতূহলবশে পাতা উলটিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ে দ্বিতীয় ভাগের শেষ লেখা দশম পাঠের ‘চুরি করা কদাচ উচিত নয়’ শিরোনামের উপর, তার ঠিক নিচে লেখাটি আরম্ভ হয়েছে এইভাবে ‘না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়, চুরি করা বড় দোষ। যে চুরি করে, তাহাকে চোর বলে।’ অনীশ পুরো লেখাটা দ্রুত পড়ে লাফিয়ে ওঠে উল্লাসে, হুররে! এরকম একটা গল্পই চেয়েছিলাম, তারপর সঙ্গে সঙ্গে লেখাটার গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো লিখে ফেলে নম্বর দিয়ে দিয়ে :

১. একদা, একটি বালক বিদ্যালয় হইতে, অন্য এক বালকের একখানি পুস্তক চুরি করিয়া আনিয়াছিল।

২. …বালকের পিতা মাতার মৃত্যু হয়। তাহার মাসি লালন-পালন করিয়াছিলেন।

৩. তিনি বুঝিতে পারিলেন, ভুবন ওই পুস্তকখানি চুরি করিয়া আনিয়াছে।

৪. ভুবনের শাসন বা ভুবনকে চুরি করিতে নিষেধ করিলেন না।

৫. ইহাতে ভুবনের সাহস বাড়িয়া গেল। যতদিন বিদ্যালয়ে ছিল, সুযোগ পাইলেই চুরি করিত। এইরূপে ক্রমে ক্রমে সে বিলক্ষণ চোর হইয়া উঠিল।

৬. কিছুকাল পরে, ভুবন চোর বলিয়া ধরা পড়িল।

৭. বিচারকর্তা ভুবনের ফাঁসির আজ্ঞা দিলেন।

৮. তখন ভুবনের চৈতন্য হইল।

৯. মাসি নিকটে গেলে পর, … দাঁত দিয়া তাঁহার একটি কান কাটিয়া লইল।

১০. যখন আমি প্রথম চুরি করিয়াছিলাম, তুমি জানিতে পারিয়াছিলে। সে-সময়ে যদি তুমি শাসন ও নিবারণ করিতে, তাহা হইলে আমার এ-দশা ঘটিত না। তাহা করো নাই, এ জন্য তোমার এই পুরস্কার।

গল্পটাকে এভাবে দাঁড় করিয়ে অনীশ মনে মনে বেশ খুশি, কারণ এর ফলে মূল গল্পের বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার নিজস্ব অভিপ্রায়টি বের হয়ে আসছে, সে বুঝতে পারছে চুরির সঙ্গে চোরের যেমন সম্পর্ক আছে, চোরের সঙ্গে অভিভাবকেরও তেমন একটা সূক্ষ্ম সম্পর্ক আছে, ভুবনের কথায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তার মানে অভিভাবক যদি ঠিকঠাক তাকে শাসন করতে পারত, তবে ভুবনের পরিণতি তেমন না-ও হতে পারত, অভিযুক্ত হতে পারেন তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করার জন্য, জনৈক কারো বেলায় যদি এ-নিয়ম খাটে, তবে দেশ ও দশ যাঁরা পরিচালনা করেন তাঁরাও একই অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন, তবু

সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনীশ আরেকবার পড়ে দেখতে চায় গোটাটা, কিন্তু ‘ভুবন ওই পুস্তকখানি চুরি করিয়া আনিয়েছে’ এই পর্যন্ত পড়ে থেমে পড়ে, গল্পের নায়কের নাম ভুবন, অবাক কান্ড, এত নাম থাকতে ঈশ্বরচন্দ্র এই ভুবন নামটা বেছে নিলেন কেন? এর তাৎপর্য কী?

ভুবন, ভুবন, নামটি মনে মনে আওড়ে হঠাৎই অনীশের মনে হয়, ভুবন মানে তো পৃথিবী জগৎ বিশ্ব, এই নামটা বাছার মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো তাৎপর্য ছিল, নাকি এমনই এমনই তিনি ভুবন নামটি দিয়েছিলেন ওই ছেলেটির?

অনীশ ভাবতে থাকে, ভুবন নামের তাৎপর্য বের করতে হবে, এবং ভুবনের কাজকর্মের গতি-প্রকৃতি

ভুবন চুরি করে, ক্রমে চোর হয়ে ওঠে, তার মানে, অনীশ ভাবতেই থাকে, ভুবন ও চুরির মধ্যে সম্পর্ক বের করতে হবে, এর মধ্যেই নিহিত আছে গল্পের প্রাসঙ্গিকতা, অনীশ ভেবে ভেবে কূল পায় না, তবু ভাবতে থাকে, হঠাৎই সে লাফিয়ে ওঠে, আরে তাই তো, ভুবনের কৃত কাজ এখন ভুবনময় ছড়িয়ে পড়েছে, যেদিকে তাকানো যায় দেখা যায় কেবল চুরি ছিনতাই ঘুষ ইত্যাদি ইত্যাদি

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কি তখনই জেনে গিয়েছিলেন, ভুবনের কৃত কাজ একদিন ছড়িয়ে পড়বে ভুবনময়?

অনীশ উত্তেজনা বোধ করে দারুণ, আর মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে লিখে ফেলে – ভুবন থেকে ভুবনায়ন

হ্যাঁ, এই হবে তার নতুন লেখার শিরোনাম, ভুবনের কাজ এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়ে থাকছে না, এই কাজ গ্রাস করে ফেলেছে দুনিয়ার নানা স্তর, তা দেখানোই হবে লেখার বিষয় – গল্প-উপন্যাসের,

অনীশ টেনে নেয় কাগজ-কলম আরো কাছে লেখার জন্য  তখন…