মধ্যরাতে মৃত্যুভাবনার জটিলতা

সেলিনা হোসেন

প্রচ- আতঙ্কে গভীর রাতে ঘুম ভাঙে শাওমত্মীর।

যে-স্বপ্নটা দেখে ওর ঘুম ভাঙে সে-স্বপ্নটা অত ভয়াবহ ছিল না, তবু ভয় পায়। স্বপ্নে ওর মা ওকে ডেকেছে। বলেছে, চলো আমরা অন্য কোথাও যাই।

ও জিজ্ঞেস করেছে, কোথায়?

মা উত্তর দেয়নি। মৃদু হেসে ওর হাত ধরেছিল।

ও বলেছে, আমি তোমার সঙ্গে যাব না মা। তুমি তো মরে গেছ। আমি তোমার সঙ্গে যেতে চাই না। তুমি আমার হাত ছেড়ে দাও।

তখন ও অনুভব করে, মায়ের মুঠিতে ওর হাত আটকে গেছে। ও আর ছাড়াতে পারে না। আমি এখনই মরে যাব কেন মা। আমি মরতে চাই না – এমন কিছু বলতে-বলতে ওর ঘুম ভেঙে যায়। অভ্যাসমাফিক ডান হাতটা বাড়াতেই দেখে বিছানা শূন্য। তখন ওর মনে পড়ে আজ ও বাড়িতে একা। অনুপম যশোর গেছে। যে অনুপম ওকে বলে, আমি তো পলাতক মানুষ নই। জীবনকে মোকাবিলা করার মতো সাহসী। গত বছর অনুপমের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে। এই পর্যন্ত ভালোই কেটেছে। স্বপ্নের আতঙ্ক থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ও বিছানার পাশের টেবিলে রাখা দুজনের বিয়ের ছবিটা হাত বাড়িয়ে টেনে নেয়। বেড-সুইচ জ্বালায়। ছবিটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে শাওমত্মী। দুজনে উচ্ছল ভঙ্গিতে হাসছে। প্রাণখোলা হাসি। গৎবাঁধা বিয়ের ছবি নয়। যদিও বিয়ের দিনের পোশাক পরে বিয়ের আসরে তোলা ছবি। ছবিটা দেখে ওর বান্ধবীরা বলে, অনুপম তোর চেয়ে সুন্দর।

মধ্যরাতে বিছানায় বসে ছবি দেখার মধ্যে কী থাকতে পারে সে-প্রশ্নে শাওমত্মী ঢোকে না। ও তন্ময় হয়ে ছবিটা দেখে। ভাবে, আজ বিছানায় অনুপম থাকলে ও কি এমন একটি কাজ করতে পারত? নাকি অনুপম ওকে করতে দিত? ছবিটা এত মূল্যবান হয়ে গেল কেন ওর কাছে? আসলে ছবিটা ওর ভয় কাটিয়ে দিচ্ছে। ও পরকাল থেকে ইহকালে ফিরে এসেছে। মৃত্যু-ভীতি ওকে তেমন করে আক্রান্ত করছে না। ও ছবিটা বুকে জড়িয়ে ধরে। নিজেকে বলে, আমিও পলাতক মানুষ নই। জীবনকে মোকাবিলা করার মতো সাহসী।

ও তখন ছবিটা আগের জায়গায় রেখে বিছানা থেকে নামে। রান্নাঘরে গিয়ে পানি খায়। কাজের মেয়ে লিপি মেঝেতে ঘুমুচ্ছে। বালিশে মুখ গুঁজে রেখেছে, যেন ও একটা উটপাখি। পিঠটা বাঁকানো, খানিকটা উপুড় হয়ে থাকার ভঙ্গি। বেশ লাগছে দেখতে। ও নিজে কখনো এমন ভঙ্গিতে ঘুমোয় না। ও কি লিপিকে ডাকবে? ওকে বলবে কি স্বপ্নের কথা? এই মধ্যরাতে লিপিকে ঘুম থেকে টেনে তোলা কি ঠিক কাজ হবে? ও যে স্বপ্ন দেখে ভয় পায় তার কী অর্থ আছে লিপির কাছে? নিজেকে শাসন করে শাওমত্মী। মাত্র একদিনের জন্য অনুপম যশোর গেছে, এর মধ্যে ওর মাথাটা এলোমেলো হয়ে যাওয়া সংগত নয়। শাওমত্মী শক্ত হওয়ার চেষ্টা করে। শোবার ঘরে এসে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকায়। কাঁটায়-কাঁটায় তিনটা বাজে। তাহলে তিনটা বাজার দশ মিনিট আগে ও স্বপ্নটা দেখেছে। এখন ও কী করবে? স্বপ্নটা ওকে আর

তাড়া করছে না। ও মায়ের কথা ভাবতে শুরু করে। ক্যান্সারে মারা যাওয়ার আগে মা ওকে বলেছিল, তোমার জন্য গয়না বানিয়ে রেখে গেলাম। বিয়ের দিন যত্ন করে পরবে। মনে করবে মা তোমার কাছেই আছে। দুঃখ করবে না। কাঁদবে না।

এখন ওর কান্না পাচ্ছে। ও দুহাতে চোখ মোছে। বলে, মা তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি অনুপমকে ছেড়ে এখনই তোমার কাছে যেতে পারব না। আমার ভীষণ বেঁচে থাকার সাধ।

শাওমত্মী জানালা খুলে দেয়। পাঁচতলার ওপরে বাড়ি। দুটো মাত্র ঘর। ও জানালার শিকে মুখ ঠেকালে শীতল স্পর্শ ওর অনুভূতি সিণগ্ধ করে দেয়। ও ওপর থেকে শহরটা দেখে। এত রাতেও রাস্তায় গাড়ি চলাচলের শব্দ। কোনটা ট্রাক, কোনটা পুলিশের গাড়ি ও গতি শুনে বুঝতে পারে। দু-একটা ছোট গাড়িও যাচ্ছে। রাতের নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে ছড়িয়ে যায় শব্দ। সে-শব্দ শাওমত্মীর কানে এসে লাগে অন্যরকমভাবে। কীভাবে? শাওন্তীর মনে হয় অনুপমের কণ্ঠের আর্তনাদের মতো। যেদিন ও সন্ত্রাসীদের গুলি খেয়েছিল সেদিন অচেতন অনুপমের কণ্ঠে গোঙানির শব্দ ছিল। ঠিক অবিকল সেই শব্দটা মধ্যরাতকে ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়ে ঘূর্ণির মতো ঘুরছে। তখন স্বপ্ন নয়, বাস্তবের আতঙ্কে শিউরে ওঠে শাওমত্মী। ও জানালা বন্ধ করে দেয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ওর কপালে ঘাম জমে। চিবুকের ঘাম থুতনির সঙ্গে লেপ্টে যায়। ঘামকে নিজের মতো বইতে দিতে থাকে। ওর মনে হয় ফ্যানের বাতাস ওর কাছে আসতে পারছে না।

ও ওর সেজো-বোনকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করতে দেখেছিল নয় বছর বয়সে। ঘরের দরজার সামনে ভিড় করা আত্মীয়স্বজনদের ফাঁক গলিয়ে ও ঢুকে গিয়েছিল ঘরে। কাঁদেনি। চিৎকার করেনি। কেবল অপার বিস্ময় ছিল দুচোখ জুড়ে। মানুষ কি এভাবে মরতে পারে? সেজো-আপা তোমার কী হয়েছিল? মরলে কেন?

পুলিশ লাশ নামানোর সময় পুলিশকেই ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে হয়েছিল। পুলিশ ছাড়া কে আর অমন যত্ন করে লাশ নামাতে পারত? ও তখন চিৎকার করে কেঁদেছিল। একজন ওর মাথায় হাত রেখে বলেছিল, কাঁদিস না খুকি। দুঃখ নয়, খুব যন্ত্রণা হয়েছিল ওর।

এসআই অনুপম যেদিন ওর হাত ধরে বলেছিল, শাওন্তী চলো প্রতিজ্ঞা করি একসঙ্গে থাকব, সেদিন ও প্রথমে আত্মহত্যার দৃশ্য দেখতে পেয়েছিল।

ও অনুপমকে বলেছিল, ভালোবাসা ছাড়া একসঙ্গে থাকব? অনুপম থমকে গিয়ে বলেছিল, তুমি এমন আঁতকে উঠেছ কেন? আমি তো প্রতিজ্ঞা করছি ভালোবাসার জন্যই।

আমরা কেউ আত্মহত্যা করব না তো?

দৃশ্যটি তোমাকে ভীষণ ভাবায়, না?

হ্যাঁ,  কখনোই মুছতে পারি না। যখন-তখন সামনে ভেসে ওঠে।

বড় হয়ে তো জেনেছিলে, কী হয়েছিল তোমার সেজো-আপার?

ভালোবেসে প্রতারিত হয়েছিল।

অনুপম হা-হা করে হাসতে-হাসতে বলেছিল, যে-জীবনের জন্য প্রতিজ্ঞা করে, সে প্রতারক হতে পারে না।

শাওমত্মী ওদের ছবিটার দিকে তাকায়। ওর মনে হয় দুটি বিষণ্ণ নীলপাখি। সেই পাখির পালকের রং অনবরত বদলাচ্ছে। খয়েরি, কালো, ময়ূরকণ্ঠী, লাল – সবগুলো মিলেই কি একটা রং হয়েছে? তাই মনে হচ্ছে শাওমত্মীর। রঙের জটিলতা ওকে ঘাবড়ে দেয়। তখন অনুভব করে ওর বুক বেয়ে ঘাম নামছে। মৃত্যুভাবনার কি কোনো রং থাকে? যেদিন অনুপম ওর বিছানায় নেই সেদিনই মধ্যরাত ওর সামনে মৃত্যু-গহবর হয় কেন? অসমসাহসী অনুপম অনেকবার কর্তব্যরত অবস্থায় সন্ত্রাসীকে কিংবা হাইজ্যাকারকে জাপটে ধরেছে। হয়তো সে-সময়ে ওর কোমরের পিস্তল খোলার সময় হয়নি। তার জন্য অপেক্ষাও করেনি অনুপম।

ওকে ভয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে ও শাওমত্মীকে জড়িয়ে ধরে গভীর আবেগে চুমু খেয়ে বলেছে, আমি তো একটা স্বপ্ন নিয়ে কাজ করি। একটুও ঘাবড়িয়ো না। ঠিকই সব বিপদ পেরিয়ে আসব।

মধ্যরাতে শাওমত্মীর মনে হয় বিপদ পার হওয়া কী? সেটা কি পিঠের চামড়া ফুটো করে গুলি বেরিয়ে যাওয়া? তারপর হাসপাতালের বিছানায় পড়ে ভুতুড়ে কণ্ঠে গোঙানি ছড়িয়ে দেওয়া? নাকি বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় অস্ত্র? যে যত অস্ত্র ঠুকতে পারে সে তত নিরাপদ?

শাওমত্মী আলোর দিকে তাকায়। হ্যাঙারে অনুপমের ইউনিফর্ম ঝোলানো। মহানগরের পুলিশের ইউনিফর্ম। ও দৃষ্টি ঘোরায়। ইউনিফর্মটাকে ভয় পায় ও। সন্ত্রাসীরা ওই পোশাকটাকে ভালো চেনে। বিশেষ করে সীমান্তের চোরাচালানিরা। যশোরে কী কাজে গিয়েছে, সে-কথা অনুপম বলেনি শাওমত্মীকে। যাওয়ার সময় ও অনুপমকে বলেছে, সাবধানে থেকো।

অনুপম শার্ট পরতে-পরতে বলেছে, আমি তো আমার পিঠের কালো দাগ মুছে ফেলতে পেরেছি। সন্ত্রাসীর দেওয়া আঘাতের চিহ্ন আমার গায়ে থাকে না।

শাওমত্মী ওর দীপ্ত-মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারেনি, দাগটা তোলা যায়নি। গেড়ে বসে আছে।

চুপ করে গেলে যে?

অনুপমের আদুরে কণ্ঠ। শাওমত্মী তবু কথা বলে না। অনুপম নিজেই বলে, মন খারাপ?

শাওমত্মী মাথা নাড়ে।

আমি তো যাব আর আসব।

মধ্যরাতে যাব আর আসব শব্দদুটো চিতায় কাঠফাটার মতো আর্তনাদ ওঠায়। শাওমত্মীর বুক ধড়ফড় করে। ও দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়। চোখে সরষেফুল। ঘরটায় অন্ধকার, যদিও বাল্বটা দিব্যি আলো ছড়াচ্ছে। কে যেন ওকে বলে, ঘুমুবে না শাওমত্মী। আর কত রাত জাগবে?

অনুপম নেই যে।

তাতে কি? তুমি ঘুমাও।

অনুপম না থাকলে আমার ঘুম আসে না।

চেষ্টা করে দেখো না ঘুম আসে কিনা।

এই এক বছরে অনুপমকে ছাড়া আমি ঘুমোইনি।

শাওমত্মী, জীবন খুব নিষ্ঠুর।

আমাকে বাজে কথা শুনিও না। বাজে কথা শুনতে আমার খুব খারাপ লাগে।

ও ঘুরে দাঁড়ায় জানালার দিকে। জানালাটা আবার খুলে দেয়। একঝলক ঠান্ডা বাতাসে ও সিণগ্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় গাড়ির শব্দ নেই। মনে পড়ে এমন নিঃশব্দ রাত ওর জীবনে আসেনি। এই রাত কি গান শোনার রাত? ও ক্যাসেট পেস্নয়ারের দিকে এগিয়ে যায়। কালো রঙের যন্ত্রটাকে হঠাৎ ওর একটি অস্ত্রের মতো লাগে। নাকি ওটা কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য? যে-কোনো সময়ে ওটা বিস্ফোরিত হতে পারে। শাওমত্মী ক্যাসেট পেস্নয়ারের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবে, এটা অস্ত্র হলে ও অনুপমের বিকল্প ভাবতে পারত।

ওকে বলত, আমি কি তোমাকে ছুঁয়ে দেখব অনুপম?

না। যে-কোনো কিছুর মধ্যে আমাকে খুঁজবে না।

শাওমত্মীর চোখে জল টলটল করে। এ-বড় দুঃসহ মধ্যরাত। অনুপমহীন মধ্যরাত যেন ওর জীবনে আর কখনো না আসে – এটা ভাবার সঙ্গে-সঙ্গে ছোট ক্যাসেট পেস্নয়ারটা ও বুকে জড়িয়ে ধরে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলে খান-খান হয়ে যায় মধ্যরাতের স্তব্ধতা।

তখন বেনাপোল সড়কে জিপ নিয়ে ছুটছে অনুপম। একদল চোরাচালানিকে ধরতে হবে। মাঝরাস্তায় দুদল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে। গুলিবিনিময় হয়। একটি মাত্র বুলেট বেরিয়ে যায় অনুপমের পাঁজর ভেদ করে। রাস্তার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে যায় ও।

ক্যাসেট পেস্নয়ারটা জায়গামতো রেখে শাওমত্মী নিজের ওপর রেগে ওঠে। এই মধ্যরাতে এসব ভাবনার কোনো মানে হয় না। ও দ্রম্নতপায়ে বাথরুমে আসে। বেসিনের আয়নায় নিজেকে দেখে। আশ্চর্য, ওর গালে একটা কালো দাগ, যে-রকম দাগ পিঠে বয়ে বেড়াচ্ছে অনুপম। ও গালের দাগের ওপর হাত রেখে বলে, আমি তোমার মতো সাহসী। জীবনকে মোকাবিলা করতে ভয় পাই না।