মনোলোকের শব্দভাষ্য

সৌমিত্র শেখর

বাংলাদেশের গদ্যসাহিত্য এখন বেশ সুসংহত আর গতিপ্রাপ্ত; মনন আর মেজাজে লেখককুলও পূর্বাপেক্ষা অপেক্ষাকৃত ঋদ্ধ। একসময় কাব্যচর্চাতেই আমাদের লেখকদের আগ্রহ বেশি দেখা গেছে। এ নিয়ে টিপ্পনীও কম হয়নি। একজন কবি তো নিজের কবিতাতেই জুড়ে দিয়েছিলেন এই তীব্র শেস্ন­ষ : ‘কাব্যের দেহে কুষ্ঠ ধরেছে, কবিতা হয়েছে বাসি,/ বাংলাদেশে কাকের চাইতে কবির সংখ্যা বেশি।’ এই পঙ্ক্তিদ্বয় অস্বীকার করে বিতর্ক নিশ্চয়ই চলে। তবে গদ্যসাহিত্য নিয়ে এমন কোনো কথা ওঠেনি, আমার জানামতে। তার মানে এই, আমাদের দেশে গদ্যসাহিত্যচর্চা অতিপলস্ন­বিত হয়নি কখনো। সম্প্রতি তরুণদের মধ্যে গদ্যচর্চা বেড়েছে; এটি আশার  কথা। তাঁরা গল্প, উপন্যাস এমনকি নাটক রচনায় মনোনিবেশ করছেন। এসব গদ্যসাহিত্য বিষয়গৌরবে যেমন অনুরাগী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে, তেমনি লেখকের করণকুশলতায়ও আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। উপরন্তু যুক্ত হয়েছে দর্শনের সন্নিবেশ। ‘দর্শন’ ছাড়া তো কোনো সৃষ্টি হতে পারে না! দর্শন আগেও ছিল, তবে সে-দর্শন কাঠামোগত রূপের বাইরে। এখন আধুনিক বা সাম্প্রতিক বিশ্বদর্শনের সচেতন প্রয়োগের ব্যাপারটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। উত্তরাধুনিকতার এ-যুগে বিশ্বদর্শনের ছোঁয়ায় আমাদের সাহিত্যশিল্পও নবরূপ লাভ করছে। এতে আমাদের শিল্প-সাহিত্য অঞ্চলের গ– পেরিয়ে আন্তর্জাতিক হওয়ার দাবি করছে মনে মনে। এ যেন মাটির নিচে থাকা পরিপুষ্ট বীজের মধ্যস্থিত অঙ্কুরের মাথা তুলে সূর্যালোকে আসার আকুতি। এত কথা লিখলাম সম্প্রতি একটি খুদে উপন্যাস পাঠ করে – ইংরেজিতে যাকে নভেলেট বলে। এর নাম পান্নাবিবি; লিখেছেন তাশরিক-ই-হাবিব। এই গদ্যরচনাতেও আছে সেই বীজস্থিত অঙ্কুরের মতো সবুজ দুই পাখা নিয়ে মাথা তুলে নতুন সূর্যের আলোয় উড়ে যাওয়ার ইচ্ছে।

পান্নাবিবিতে একেবারে ভিন্ন মেজাজ পাঠকের সামনে! মোটেই অপরিচিত গল্প নয় এটি; কিন্তু পরিবেশনাটি একেবারে পৃথক। কেউ একে আপাতভাবে
‘বিড়াল-কাহিনি’ও বলতে পারেন। তবে জনান্তিকে বলে রাখা ভালো, লোককথার বিড়ালের গল্প নয় এটি। এটি মনস্তত্ত্বের অন্তর্গত বোধতাড়িত শব্দভাষ্য; চিন্তার ভেতরের চিন্তাসার। একটি ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী জীব, বিড়াল, এ-উপন্যাসের কেন্দ্রে অবস্থিত। বিড়াল নেই তো উপন্যাসটিও নেই! বিড়াল নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা রচনার সন্ধান মেলে এবং সেগুলোর সবই আকর্ষণীয়। মার্কিন কবি ও ছোটগল্পকার এডগার অ্যালান পো থেকে আরম্ভ করে বাঙালি কথাকার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় – অনেকেই বিড়ালকে কেন্দ্র করে লিখেছেন। শামসুর রাহমানের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে বিড়াল নিয়ে। আপাতত মনে করি সেটি : মুক্তিযুদ্ধকালে লেখা তাঁর কাব্যগ্রন্থ বন্দী শিবির থেকেতে ‘পূর্বলেখ’ তিনি শুরু করেছেন এভাবে : ‘দীর্ঘ সবুজ ঘাসে আলস্য পোহাচ্ছে এক সাদা বেড়াল। চারদিক বিষণ্ণ স্তব্ধতায় নিঝুম। দেড় মাস আমরা কেউ ছিলাম না আর এরই মধ্যে উঠোনের ঘাসগুলো এত ডাগর হয়ে গেছে; ফুলের চারাগুলোও বেড়ে উঠেছে অনেকখানি, মনে হলো। সাদা বেড়ালটাকে আগে দেখিনি। মনের মধ্যে নানা ছবির আনাগোনা; টুকরো টুকরো, এলেবেলে সব ছবি, কখনো পরপর সাজানো, কখনো সম্পূর্ণ পারম্পর্যহীন। দেড় মাসে আমি এক আলাদা মানুষ হয়ে গেছি। মাথার চুলে পাক ধরেছে, জীবন-মৃত্যুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি গেছে বদলে। এক ধরনের খাপছাড়া ঔদাস্য যেন আমাকে দখল করে নিয়েছে, অথচ জীবনতৃষ্ণাও দুর্মর।

উনিশশো একাত্তরের মে মাসের মধ্যসীমায় দেড় মাস পরে ঢাকায় ফিরে এসে আমাদের বাড়ির উঠোনের দীর্ঘ সবুজ ঘাসে সাদা বেড়ালটাকে দেখে আমার প্রেতায়িত মনেও ক্ষণিকের জন্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে গিয়েছিল। চারিদিকের চরম তা-বের প্রতি উদাসীন এ-প্রাণীটিকে বিশ্রাম করতে দেখে কেন জানি একটা আশ্বাসের স্পর্শ পেলাম। এই আশ্বাসের বড় প্রয়োজন ছিল আমার।’ এই বিড়াল কিন্তু আশার প্রতীক হয়ে এসেছে কবির কাছে। কবির মন যেখানে ‘প্রেতায়িত’, সেখানে বিড়াল ‘আশ্বাসে’র প্রতীক। কিন্তু তাশরিক-ই-হাবিবের লেখায় বিড়াল ঠিক উলটো রূপব্যঞ্জনায় এসেছে। তাঁর পাত্রপাত্রীর মন ছিল স্নিগ্ধ; বিড়াল তাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। শামসুর রাহমানের বিড়াল সাদা কিন্তু তাশরিকের বিড়াল কালচে এবং এর চোখদুটো পান্নার মতো সবুজ। কেয়া ও হাসিব দম্পতির জীবনে বিড়াল-প্রভাব তাদের অস্থির করে তোলে। এই খুদে উপন্যাসের দ্বিতীয় বাক্যেই বিড়ালের আগমন। এরপর বিড়াল আর তাদের পিছু ছাড়ে না। কখনো শিশুর মতো কান্না, কখনো পরিচিতের মতো ধ্বনি সৃষ্টি, কখনো অশরীরীর মতো নিঃশব্দ বিচরণে পান্নাবিবি পাঠকমনে সন্দেহ জাগায়। প্রায় দশ হাজার বছর আগে বিড়াল বন্যপ্রাণী থেকে গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে বসবাস করতে শুরু করেছে বলে প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন। মানুষের খুব কাছে, এমনকি শোবার সাথি হিসেবেও এই প্রাণীর তুলনা নেই। অত্যন্ত আরামপ্রিয় ও আরামপ্রদেয় এ-প্রাণী বহু মানুষের সঙ্গী হিসেবে এখনো আছে। পাশ্চাত্যে তো বিড়ালসাথি মানুষ আছেই, আমাদের সমাজেও এর দৃষ্টান্ত মেলে প্রচুর। একটি নয়, একাধিক বিড়াল পোষার উদাহরণ পাওয়া যাবে অনেক। কিন্তু বিড়াল একই সঙ্গে গৃহ ও বহিরঙ্গীয় বিচরণে ভিন্ন রূপ নিতে পারে। পান্নাবিবি ঠিক তেমনি বিড়াল, যা শুধু গৃহেই তৃপ্ত থাকে না, বাইরেও বিচরণ করে; আবার শুধু বাইরেই থাকে না, গৃহেও প্রবেশ করে। তাশরিকের খুদে উপন্যাসে এভাবে ঘরে-বাইরে করতে করতে হ্যালুসিনেশনের সৃষ্টি হয় : ‘রিডিংরুমের লাইট জ্বালানো বলে আধঘণ্টা পর হাসিব এখানে আসে। যা ভেবে ভয় পাচ্ছিল, ঠিক তাই। পাপোশের ওপর কয়েকটা লোম পড়ে আছে। বিড়াল ডিপথেরিয়া ছড়ায়, এটা ওর অজানা নয়। কিন্তু এখন এগুলোতে হাত দেওয়া ঠিক হবে না ভেবে ও বিছানায় আসে। এ-রুমের জানালার পর্দাগুলো টেনে দিতে গিয়ে ম্যাও ম্যাও শব্দ শুনে ও চমকে ওঠে। ওর মনে হয়, ঠিক ওর পেছনেই পান্নাবিবি দাঁড়িয়ে ওকে ডাকল। কিন্তু পেছনে ফিরে ও বিড়াল দেখতে পায় না। এবার ওর মনে হয়, জানালার বাইরে কোথাও চিকন সুরে কেউ কাঁদছে। ওর সারা গা ঝিমঝিম করে ওঠে। কান খাড়া করে ভাসমান অন্ধকারে চোখ চালিয়ে নিথর দেয়াল, ওপারের গাছপালার থমথমে অবয়ব ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকায় এক সময় আবার দুটো বিড়ালের অস্থির গোঙানি ভেসে আসে। মগবাজারে থাকতে ছাদে দাঁড়িয়ে ও যে-দৃশ্য দেখেছিল, সেটাই কি তবে জানালার ওপাশে আবার অভিনীত হচ্ছিল?’ এই জিজ্ঞাসার উত্তর শেষ পর্যন্ত মেলে না। কেয়া আর হাসিবের বিয়ের পরপরই একটি সন্তান না হওয়া কি বিড়ালপ্রীতি বা অপ্রীতির কারণ? অবশেষে তো তাদের সন্তান হয়েছিল। কিন্তু পান্না-কালু দম্পতির ধবধবে ছানাটার অপঘাত-মৃত্যুও ঘটেছিল। এ মৃত্যুই কি আর একটি মরণের ডঙ্কা বাজায়? এখানেই হিসাবের গরমিলটা। বিড়ালের ‘বাচ্চা’ আর মানুষের ‘বাচ্চা’ জন্মের সময় ও প্রত্যাশার বিস্তর ফারাক। কেয়া আর হাসিবের মনের অন্তরায় নিজেদের একমাত্র সন্তান নোটনকে নিয়ে যে-আগ্রহ, পান্নাবিবির ছানা সে-আগ্রহ তৈরি করে না নিশ্চয়। কিন্তু এই খুদে উপন্যাসটি একটি ভিন্ন মেজাজ এনে দেয়, যখন হাসিব নিজ সন্তানের চোখে পান্নাবিবির অস্থির আভা প্রতিবিম্বিত হতে দেখে এবং লুক্কায়িত ছুরির প্রতি স্বীয় হস্তপ্রসারণ থেকে নিবৃত্ত হয়। এখানেই বিড়ালছানা আর নোটনের অভিন্ন অসিত্মত্ব যেন প্রকাশ পায় – একে হয়ে ওঠে অন্যের প্রতীক। তাশরিক তাঁর খুদে উপন্যাস শেষ করেছেন এভাবে : ‘ঘুমের ঘোরেই নোটন একবার মিষ্টি হেসে ওর (হাসিব) দিকে স্থির দুই চোখ মেলেছিল। ওর চোখের তরল সবুজ মণি থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসা আভা পরক্ষণেই ঘুমের দেশে মিলিয়ে যায়।’ একটি ম্যাজিক্যাল সমাপ্তি; কিন্তু পরিসমাপ্তি যে তা বলা যাবে না। এখান থেকে উপন্যাসটি আবার শুরুও হতে পারে, যেমন এটি শুরু হয়েছিল এমনই একটি প্রেক্ষাপটে : মাঝরাতে হাসিবের কক্ষে চুপিসারে ঢুকে পড়েছিল এক বিড়াল। উপন্যাসের শেষে পান্নাবিবি আর ওর ছানাটি যে লাফ দিয়ে নেমে গেল, ওরা যে আবার আসবে না, সে-নিশ্চয়তা দেবে কে? এভাবে চলতেই থাকবে। আসলে এ এক মনোরাজ্যের গল্প – মনের বনে ভূত। বিড়ালের অসিত্মত্ব যতটা বাস্তবে, তার চেয়ে মনোগতভাবে অনেক বেশি। মানবমনের বিশেষ অবস্থার কথকতাই দর্শনের আধারে যথাযথ শব্দবন্ধে এখানে তুলে ধরেছেন তাশরিক-ই-হাবিব। তাঁর গদ্য সুখপাঠ্য, আবেশময় আর অনুভবসঞ্চারী। একটি দৃষ্টান্ত দিই : ‘কার্তিকের হিমেল রাতে চারদিক যেন নিঃশব্দে জমে আছে। শিশির-মাখানো কনকনে আমেজ হাওয়াহীন শূন্যতায় ছড়ানো। গাছের ছায়ায় মিশে থাকা অন্ধকার হলদে সোডিয়াম আলোতে ভীতিকর চেহারা পেয়েছে। ফটফট শব্দ করে কী যেন সাঁই করে দেয়ালের ওপাশের ঝাঁকড়া গাছগুলোর ডালের ওপর দিয়ে উড়ে গেল।’ এমন চিত্রময়তা ছড়িয়ে আছে উপন্যাসটির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়, যা পড়তে আনন্দের ঘোর লাগে।

সব মিলিয়ে পান্নাবিবি নিছক বিড়ালকাহিনি মাত্র নয়; এটি ভাবনার উপন্যাস, এটি ভাষার উপন্যাস। ভাবনা ও ভাষার রসায়নে পান্নাবিবি পাঠকের প্রত্যাশার তূণে আর একটি বাণ-সঞ্চয় নিশ্চয়। বাংলাদেশের গদ্যসাহিত্যে সাম্প্রতিক যে-নবালোকের অভ্যুদয় তাশরিক-ই-হাবিব তারই একজন নবীন উদ্গাতা; তাঁকে স্বাগতম। r