মন-সংক্রান্তি

মনি হায়দার

নাহার এমনিতেই সুন্দরী। অফিসে যাওয়ার সময় হালকা সাজলে চোখ ফেরানো কঠিন। সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে ড্রয়িংরুমে ঢোকে। ড্রয়িংরুমে নিবিড়মনে পত্রিকা পড়ছে খালেদ। হাতে সিগারেট। মুখে আর নাকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি। নাহারকে দেখে পত্রিকা থেকে চোখ তোলে – অফিসে যাচ্ছো?
হ্যাঁ। তুমি কখন যাবে?
যাবো একটু পর। খালেদের কথায় হাসে নাহার। তুমি হাসছো কেনো? প্রশ্ন করে খালেদ। এই সাতসকালে আমি হাসির কী বললাম?
প্রতি-উত্তরে খালেদের কাছে বসে নাহার। তাকায় গভীর চোখে। হাত ধরে – খালেদ, তুমি আমাকে একটা সত্যি কথা বলবে?
তুমি জানো, আমি তো পারতপক্ষে মিথ্যা বলি না।
জানি, তুমি মিথ্যা বলো না। তবু জানতে চাই একটা বিষয়ে।
বলো।
তুমি বোধহয় চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছো, না?
খালেদ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে নাহারের দিকে। পত্রিকা রেখে দিয়েছে। বোঝার চেষ্টা করছে নাহারকে। মানুষ কতো জটিল জটিলতায় ভোগে – নাহার আর খালেদের এ-মুহূর্তটাই প্রমাণ। খালেদ বলতে পারছে না স্ত্রীর কাছে চরম সত্যটা। অথচ বলার জন্য কতোবার কতো প্রস্তুতি নিয়েছে। মনে মনে কথা সাজিয়েছে – বলবে, নাহার তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। না, তুমি ভয় পেয়ো না। আমার চাকরিটা নেই। একটা চাকরি গেছে আরেকটা পাবো। আমার অভিজ্ঞতা অনেক। অলরেডি অনেকগুলো অফিসে সিভি পাঠিয়েছি। দেখো – আগের চেয়ে ভালো একটা অফিসে চাকরি হবে আমার। মানুষের জীবনে দুঃসময় আসে, আবার কেটেও যায়। দ্বিধা-উৎকণ্ঠার কারণে বলা হয়নি। কিন্তু নাহার তো ঠিকই তার চাকরিহীনতার দিনকাল ধরে ফেললো।
কথা বলছো না কেনো?
আমি চাকরিটা ছেড়ে দিইনি। চাকরিটাই আমাকে ছেড়েছে নাহার।
কতোদিন হলো?
প্রায় দেড় মাস।
দেড় মাস! এতোটা দিন আমাকে জানাওনি কেনো? না জানিয়ে থাকলে কী করে? কেনো জানালে না? আমাকে তুমি রিলাই করো না? অনেকগুলো প্রশ্ন করে নাহার। মুখটা ভারি। সুন্দর সকালটা কেমন থমথম করছে দুজনার মাঝখানে। খালেদের মনে হলো – সে অপরাধী। প্রথম দিনই নাহারকে কথাটা বলা উচিত ছিল।
চুপ করে কেনো আছো? নুয়ে যাওয়া মুখ তুলে ধরে টলমল চোখের সামনে।
আমি তোমাকে বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। বারবার মনে হয়েছে – আমার চাকরি নেই বললে তুমি ভেঙে পড়বে। তুমি দ্বিধাগ্রস্ত হবে। আমি তোমাকে বলতাম আর একটা চাকরি পেলেই। তখন আর তোমার খারাপ লাগতো না।
আমার খারাপ লাগাটাই ভাবলে, আমাকে না বলে তুমি যে পালিয়ে বেড়াচ্ছো – তোমার কষ্ট হচ্ছে না? যেদিন থেকে তুমি অফিসে যাও না, আমি সেদিন থেকেই বুঝেছি – একটা কিছু ঘটেছে। কারণ, তুমি আগের মতো তাড়াহুড়ো করে অফিসে যাও না। আমার কাছে নাস্তার তাড়া দাও না। সেলে তোমার বন্ধুদের সঙ্গে টুকটাক কথা আমি শুনেছি। নতুন চাকরির জন্য আবেদন করেছো – জেনেছি। দুনিয়ার সবাইকে বলতে পারলে, কেবল আমাকে বললে না?
স্যরি! গলাটা ভেঙে যায় খালেদের। আমি সত্যিই দুঃখিত। হাত ধরে নাহারের – হঠাৎ করেই অফিসটা বন্ধ হয়ে গেলো তো, একেবারে টালমাটাল হয়ে গেছি। আবারো বলছি, স্যরি।
মাথার এলোমেলো চুল আরো এলোমেলো করে নাহার লিপস্টিক মাখা ঠোঁট নামিয়ে আনে খালেদের ঠোঁটে। রঙিন লিপস্টিকে খালেদের ঠোঁট লেপ্টে যায়। পুরো শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। হাত ধরে নাহারের। নাহার কপট রাগ দেখায় – অফিস আছে। চট করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার কাছে যায় – তুমি বসো আমি আসছি।
অনেকদিন পর খালেদ ড্রয়িংরুমে নিজেকে সমুদ্রের পারে আবিষ্কার করে। সমুদ্রের উত্তাল হাওয়ায় হাওয়ায় তার মন-শরীর ভীষণ তোড়ে বেজে উঠছে। খেয়াল করে – অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে নাহারের সঙ্গে শারীরিক সংরাগও হয়নি, যা অকল্পনীয়। অথচ ঘটেছে। না ঘটে উপায়ও ছিল না – নাহার আর নিজের চাকরির টাকায় সংসার চলে যাচ্ছে চমৎকারভাবে। জমানো টাকা-পয়সা তেমন নেই। পনেরো বছরের সংসারে একটা ছেলে একটা মেয়ে। ছেলেটা বড়। পাভেল পড়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। মাসের বেতন, গাড়ি ভাড়া, বইপত্র, বাসার শিক্ষক মিলিয়ে প্রচুর খরচ। মেয়ে সুখী এখনো স্কুলে যেতে শুরু করেনি। বাসায় পড়ে। গ্রামের বাড়িতে মাকে টাকা দিতে হয়। মাস শেষে হাতে কিছুই থাকে না। জানে – এই জীবন নিরাপদ নয় অথচ কিছু করারও ছিল না। সেই নির্দিষ্ট জীবনযাত্রাও যখন থেমে যাচ্ছে, ভয়ে, অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠেছে।
প্রথম সপ্তাহ খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছে। চাকরি নেই তো কী – সকালে উঠে বের হয়েছে। আসলে গেছে বন্ধুদের অফিসে। জানিয়েছে – চাকরি দরকার। কেউ কেউ আশ্বাস দিয়েছে। কেউ একেবারে উলটো আচরণ দেখিয়েছে; মুখে প্রশ্নবোধক হাসি ধরে প্রশ্ন করেছে – এই বয়সে চাকরি গেছে? কী করেছিলে বাছাধন?
আমি কিছুই করিনি। তিনজন পার্টনারের অফিস – ওরা শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে।
বেশ তো যারা কিনেছে, তাদের সঙ্গে যোগ দে। ল্যাঠা চুকে গেলো।
ওরা পুরনোদের নেবে না। নতুন রিক্রুট দিয়ে অফিস চালাবে।
খালেদ বুঝেছে – বন্ধুরা বিশ্বাস করেনি। বন্ধুরাই যখন বিশ্বাস করছে না, তখন নাহার কীভাবে নেবে? নাহার অসম্ভব বাস্তববাদী মেয়ে। হিসাব করে পা ফেলে। দ্বিধা আর সংকোচের কারণে নাহারের কাছে বলা হয়নি; কিন্তু নাহার বুঝে গেছে ঘটনার প্রথম দিকেই। আসলে স্বামী-স্ত্রীর মনের ও শারীরিক মিথস্ক্রিয়ায় নিঃশব্দেও অনেক গল্প তৈরি হয়ে যায়। স্ত্রী তো – সন্তানের মা।
ড্রয়িংরুমে ঢোকে নাহার, খুব কাছে এসে দাঁড়ায় খালেদের – তুমি কি তোমাকে দেখেছো আয়নায়? কেমন হয়েছে তোমার চেহারা? দাড়ি কাটো না কেনো? এই নাও টাকা – খালেদের হাতে টাকা তুলে দেয়, দাড়ি কেটে সুন্দর জামা-কাপড় পরে বাইরে যাও। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দাও। পুরুষ মানুষদের কী বাসায় সব সময় মানায়? বিকেলে বড় আপার বাসায় বেড়াতে যাবো – নাহার ময়ূরের পালক দুলিয়ে চলে যায়। খালেদ হাতে এক হাজার টাকার পাঁচটি নোট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হচ্ছে দুনিয়াটা সত্যি সুন্দর। ভেতরটা পরিশুদ্ধতার স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। সামান্য পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে নাহার, কিন্তু মনপ্রাণ সুর তুলে নাচছে। হিসাব করা টাকায় টান পড়লে কারো মনে ভালো থাকে না। সুখের বিলম্বিত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুমের বাইরে আসে খালেদ।
দেড় মাসে হাতের সামান্য টাকা শেষ খালেদের। দুজন বন্ধুর কাছ থেকে ধার করেছে বিশ হাজার টাকা। বাসা ভাড়ার টাকা, বাড়ির টাকা, বাজারের টাকা, পাভেলের স্কুলের টাকা – শালার দুনিয়াটাই টাকাময়। টাকাই দুনিয়া। পায়ে পায়ে টাকা। রাস্তায় নামলেই টাকা। বাসায় বসে থাকলেও টাকা – একটা ভালো সিগারেটের দাম দশ টাকা। একবেলা খেতে একটা লোকের কতো খরচ পড়ে? বাসায় থাকলে তো পাগল হয়ে যাবো – ভাবে খালেদ। কাজের ভেতরে থাকলে মানুষের মস্তিষ্ক সচল থাকে। বাজে ভাবনায় আক্রান্ত হতে পারে না।
দুপুরে বাসা থেকে বের হয়ে রিকশায় মতিঝিলে যাচ্ছে খালেদ। রিকশায় যেতে যেতে ভাবে সে – চারপাশে কতো মানুষ দামি গাড়িতে যাচ্ছে। একটা বিলাসবহুল গাড়িতে একজন মাত্র মানুষ। একটা গাড়ির দাম বিশ লাখ টাকা, ত্রিশ লাখ টাকা। কোনো কোনো গাড়ির দাম কোটি টাকারও বেশি। কারা এতো টাকার মালিক? টাকা আসে কোত্থেকে? শুনছে খালেদ – এই বাংলাদেশে কেউ কেউ বেতন পায় চার লাখ টাকা, পাঁচ লাখ টাকা। সঙ্গে গাড়ি-বাড়ি তো আছেই। এই ঢাকা শহরে একেক জনের বাড়ির দাম কোটি কোটি টাকা। গুলশান-বনানী গেলে মনে হয়, এই দেশে আমি আগন্তুক। ধরে ওরা আমাকে মারবে – হঠাৎ হাসি পায় খালেদের। মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। কী সব ভাবনা মাথার ভেতরে কিলবিল করে।
রিকশা ভাড়া দিয়ে রায়হানের অফিসে ঢোকে। রায়হান সিটে নেই। পিয়ন ওকে বসতে বলে, স্যার এমডির রুমে গেছে। আপনি বসেন।
বসতে না বসতেই আসে রায়হান – কী খাবি? চা না কফি?
কফি।
দুকাপ কফির অর্ডার দিয়ে রায়হার তাকায় – সকালে শামীম এসেছিল।
কোন শামীম? বাট্টু শামীম?
হ্যাঁ। তোর জন্য খুব দুঃখ করেছে।
তাই?
হ্যাঁ। বলেছে, এই মাঝ বয়সে চাকরি না থাকা বড় বিড়ম্বনার। তোর জন্য চাকরির খুব চেষ্টা করেছে। আমাকেও তোর হয়ে রিকোয়েস্ট করেছে।
সত্যিই ওর মনটা খুব নরম। আমার বাসায়ও এসেছিল গত সপ্তাহে। যাওয়ার সময়ে জোর করে আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিল। আমি নিইনি। বলেছি লাগলে জানাবো – বলতে বলতে কফিতে চুমুক দেয় খালেদ।
দে, হাত বাড়ায় রায়হান।
কী দেবো?
বায়োডাটা আনিসনি? তোকে ফোনে কতোবার বললাম – উষ্মা রায়হানের কণ্ঠে।
হাসে খালেদ – এনেছি, এই নে – পকেট থেকে একটা খাম বের করে বাড়িয়ে দেয় রায়হানের দিকে।
খামটা রাখে ড্রয়ারে রায়হান – দোস্ত, তোকে একটা রিকোয়েস্ট করতে চাই।
একটা রিকোয়েস্ট তো? কর।
খামটা রেখেছি ড্রয়ারের সামনে, যাতে খুললেই চোখে পড়ে। আমি আমার অফিসে তো চেষ্টা করবোই, বাইরেও করবো। কিন্তু তুই মাঝে মাঝে আমাকে ফোনে মনে করিয়ে দিবি। নানা কাজে ব্যস্ত থাকি, বুঝতেই পারছিস – কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করে রায়হান।
আমার প্রয়োজনেই আমি করবো। আপাতত আমার তো কোনো কাজই নেই। বাসায় বসে ফোনে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা আর সিভি ড্রপ করা ছাড়া।
খালেদ, তোর কি সত্যি টাকার দরকার নেই? এই দুর্মূল্যের বাজারে চলছিস কেমন করে? প্রায় তিন মাস তো হলো চাকরি ছাড়া তুই।
তোদের মতো বন্ধু থাকতে চিন্তা কী আমার! আর এখন আমাকে চালাচ্ছে তোর ভাবি।
তাই?
বুঝলি রায়হান, মানুষ বিপদে পড়লে চেনা মানুষকে আরো নিবিড়ভাবে চেনা যায় – নাহারের ঘটনা খুলে বলে। শেষের দিকে গলা ধরে আসে খালেদের – আমি বুঝিনি, নাহার আমাকে এমনভাবে অনুভব করে। আমার চাকরি চলে গেছে কিন্তু নাহারকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি।
শুনে আমার ভালো লাগছে খালেদ, ভাবি তোর পাশে দাঁড়িয়েছে।
দুই বন্ধু একসঙ্গে অফিস থেকে বের হয়ে শাহবাগে এসে আড্ডা দেয় রাত আটটা পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে কতো দিন-রাত এই শাহবাগে কেটেছে। সেসব সময় কোথায় হারিয়ে গেছে? হঠাৎ রায়হান হাত ধরে খালেদের – দোস্ত, অনেক দিন বারে যাই না। যাবি?
যেতে পারি কিন্তু –
আরে শালা কিন্তু কী? আমার কাছে টাকা আছে। আর বেশি খাবো না, গুনে গুনে দু পেগ গলায় ঢালবো। সঙ্গে মাংসভুনা। দারুণ জমবে। চল।
বলছিস যখন, তখন চল।
যেতে যেতে রায়হান বলে, বাংলামোটরের মোড়ে নতুন একটা বার হয়েছে, ইউরোপিয়ান স্টাইলে। গেলে মজা পাবি। সুন্দরী মেয়েরা গান গায়।
নাচে না?
নাচে তবে এখানে নয়, শেরাটনে, র‌্যাডিসনে।
দুজনে দুই দুই করে চার পেগ পান করেছে পাসপোর্ট। সঙ্গে মাংসভুনা। রাত দশটার দিকে বারের বাইরে আসে। দুই বন্ধু দুটো সিগারেট ধরিয়ে রিকশায় ওঠে। রাস্তাঘাট ফাঁকা। লম্বা দমে সিগারেট টানছে খালেদ। অনেকদিন পর সন্ধ্যাটা মনোরম লাগে খালেদের। না রে শালা, জীবন একটা প্রজাপতি।
মানুষের জীবন বাস্তুহারার জীবন। সুন্দর সময় মানুষের জীবনে খুব কম আসে। আসলেও খুব ক্ষণস্থায়ী থাকে সুখের সময়টুকু। খালেদের ওই সুখের বিমূর্ত সময়টুকু ছিল তুলনামূলকভাবে খুব কম। যদিও সে ভেবেছিল – সময় কেটে যাবে এভাবেই। কিন্তু মানুষ ভাবে এক রকম ঘটনা, ঘটে অন্যরকম। চার মাস পার হয়ে পাঁচ মাস – খালেদের কোথাও চাকরি হচ্ছে না। দু-একটা জায়গা থেকে অফার যে পায়নি, তা নয়। পেয়েছে কিন্তু ব্যাটে-বলে হচ্ছে না। বেতন ভালো না। আগের অফিসের চেয়ে কম বেতনে কোথাও ঢুকতে চায় না। বন্ধুরা যে আশ্বাস দিয়েছিল, ক্রমে ফিকে হয়ে আসছে। প্রিয় বন্ধুরা এখন যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে। টাকা ধারও হয়েছে অনেক। লাখ টাকার বেশি। সারাদিন বাসায় বসে থাকে আর টিভি দ্যাখে। একই অনুষ্ঠান বারবার দ্যাখে। নিজের ওপর বিরক্ত লাগছে। সারা দুনিয়াটা এখন ছোট্ট ড্রয়িংরুমের ভেতরে আটকে গেছে। পাভেল বিরক্ত হচ্ছে। বাবা টিভি দখল করলে ওর প্রিয় রেসলিং দেখতে পারে না। সুখী দেখতে পারে না কার্টুন। সংসারের সব টাকা নাহারই দিচ্ছে। এমনকি খালেদের সিগারেট কেনা, শেভ করার খরচও নাহারের কাছ থেকে নিতে হচ্ছে। খালেদ বুঝতে পারছে – সংসারের বাতাস উলটো বইছে। বাজারের টাকা নাহারই দিচ্ছে। শুক্রবার – ছুটির দিন ছিল তিক্ততায় ভরা একটা দিন। সকালে নাহার ব্যাগ দিয়ে বলে – বাজার করে আনো। বাসায় বাজার নেই। নাহারের ঠান্ডা নিস্পৃহ গলা। চোখের দৃষ্টিতে পাথর। মনে হচ্ছে দৃষ্টিতে কোনোদিন পলক পড়েনি।
ব্যাগ তো দিয়েছে, টাকা দেয়নি। নাহার সব জানার পরও এমনটা কেনো করলো? মানে ও হাঁপিয়ে উঠেছে? আর পারছে না। খালেদের মনে হলো, ওর গালে নাহার কালো কালিতে তিক্ততার ছবি আঁকছে। হাতে ব্যাগ নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে থাকে চুপচাপ। প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট পর নাহার এসে দাঁড়ায় দরজায় – খালেদ, বলো তো আমি এখন কী করি? সংসারটা তো আমার একার নয়, তোমারও। একা তো আর পারছি না।
খালেদ দাঁড়ায় – নাহার, তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো, আমি তো চাকরির জন্য কতো চেষ্টা করছি। কিন্তু পাচ্ছি না। পুরো পরিস্থিতিটা আমার কাছে অসহ্য লাগছে।
এইটা কোনো কথা হলো? তুমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ভালো ছাত্র। আজকাল কতো ছেলেমেয়ে চাকরি পাচ্ছে, আর তুমি?
কী করবো বলো নাহার, আমি এ-পর্যন্ত ত্রিশটি চাকরির জন্য সিভি পাঠিয়েছি। কয়েকটায় ইন্টারভিউ দিয়েছি। এতোদিন ধৈর্য ধরেছো, আর কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরো, প্লিজ।
আমি ধৈর্য ধরলেই তোমার চাকরি হবে?
নিকৃষ্টমানের এই জেরা খালেদের মাথায় আগুন লাগিয়ে দিতে চায়। বলতে চায় – নাহার, আমি তোমার মুখে হাসি দেখার জন্য, তোমার প্রেম পাওয়ার জন্য টাকা দুহাতে উড়িয়েছি। তুমি যখন যা বলেছো, তাই করেছি। প্রতি সপ্তাহে চায়নিজ খেয়েছি। বাসায় একশ পিস শাড়ি আছে, যার কোনোটির দাম পাঁচ হাজার টাকার নিচে নয়। তোমার জন্য তোমার খালাতো ভাইকে বিদেশে পাঠাবার সময়ে দুই লাখ টাকা দিয়েছি। আমার এই বিপদের দিনে সেই টাকাও ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে একটি কথাও বলছো না। এখন কয়েকটা মাসের জন্য তুমি আমাকে করাতে কাটছো? আমাকে রক্তাক্ত করছো? কিন্তু খালেদ কিচ্ছুই বলে না। হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের প্রবহমান মানুষের স্রোত দেখে আর বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো কখনো দাঁড়িয়ে থাকলেও ভালো লাগে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থেকে বাইরের মানুষের চলাচল দেখে খালেদের মনে হচ্ছে – পৃথিবীটা সুন্দর। অথচ ভেতরে ভেতরে জ্বলে যাচ্ছে খালেদ।
এই নাও টাকা! হাতের মুঠোয় দলামুচি করা পাঁচশো টাকার একটা নোট রুমের বাতাসে উড়িয়ে দেয় নাহার। টাকাটা ফ্যানের বাতাসে গোঁত্তা খেতে খেতে সোফার ওপর বসে কয়েক সেকেন্ড, সেখান থেকে আর এক গোঁত্তায় সোফার নিচে চলে যায়। মায়ের সঙ্গে সঙ্গে সুখীও এসেছিল। দৌড়ে এসে সোফার নিচে থেকে টাকাটা তুলে খালেদের হাতে দেয় – বাবা, বাজার আনো। এক অব্যক্ত হাহাকারে খালেদের চোখদুটো ঝাপসা হয়ে যায়। নিজেকে কোনোভাবে সামলে টাকাটা নিয়ে দরজা পার হয়ে যায়।
শোন, ডাকে নাহার – এভাবে চলতে থাকলে আমি বাপের বাড়ি চলে যাবো।
থমকে দাঁড়ায় খালেদ। পলক মাত্র, আবার হাঁটতে থাকে বাজারের দিকে। বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে – এই জীবনের নাম কী গিলোটিন? এভাবে, এতো অপমানের সঙ্গে বাঁচা যায়? না বেঁচে উপায় কী? কী করতে পারে সে একজন খালেদ আক্তার? সে কী একা? না – সঙ্গে আছে স্ত্রী, আর নির্দোষ দুটি পবিত্র মুখ – পাভেল, সুখী। এদের রেখে কোথায় যাবে সে? বাজার থেকে ফিরতে একটু দেরিই হয়। বাজারটা রেখে চুপচাপ বসে থাকে ড্রয়িংরুমে। আবার দরজায় এসে দাঁড়ায় নাহার – সারাদিন এই রুমে কী চাও? বেডরুমে যাও। পাভেলকে একটু টিভি দেখতে দাও।
হঠাৎ হাসি পায় খালেদের – আরে বাবা, আমি কী কুফা? যেখানেই যাই, ঝামেলা লেগেই থাকে। খালেদের বিষণœ মুখে হাসি দেখে অবাক নাহারও। সর্বহারা লোকটা হাসে কীভাবে? ভেতরে কি কোনো গ্লানি নেই? নেই ক্লান্তি? বিবমিষা? নিজের এই পরিস্থিতির জন্য কষ্ট হয় না? ভাবতে ভাবতে রুম থেকে বের হয়ে যায়। মাসকয়েক ধরে বেডরুমে রাতে ঘুমায় ঠিকই কিন্তু মানুষের মতো নয়, স্বামীর আভিজাত্যে তো নয়ই, ঘুমায় একজন অপরাধীর মতো। নিঃশব্দে, চুপেচুপে। নাহার কথা বলে না প্রায়ই। টুকটাক কথা হয় – কোথাও যাবে? চাকরির কোনো খবর আছে? নিজেরই ঘর, স্ত্রী, খাট, আলমারি, সোফাসেট, ডিনারের সেট, আলনা, জামা-কাপড়, জুতো – কতো! কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানে মনে হচ্ছে এসব ওর কিছু নয়। বাসায় আছে পরিত্যক্ত ময়লা রুমাল নয়তো এক টুকরো রুটির উপেক্ষায়। নাহার পালটে গেছে, নাহারের চোখের দৃষ্টি পালটে গেছে।
ঘটনার শুরুর দিকে নাহারের মানবিক আচরণে মুগ্ধ ছিল খালেদ। সকালে অফিসে যাওয়ার সময়ে আদর করে যেতো। পকেটে টাকা গুঁজে রেখে বলতো – সারাদিন বাসায় থেকো না। বাইরে ঘুরে এসো। খালেদ আনমনে হাসতো আর ভাবতো – মনে হচ্ছে আমিই নাহারের বউ। ও আমার স্বামী; কিন্তু বসে থাকেনি। নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছে একটা চাকরির জন্য। এখন মনে মনে পস্তাচ্ছে – কম বেতনের চাকরির একটা নিলেও ভালো হতো। বাসার এই বিষাক্ত কারাগার থেকে মুক্ত থাকা যেতো। সংসারে কিছু আয়ও হতো। নাহার এখন সকালে উঠে ড্রেসআপ করে নিঃশব্দে চলে যায়। একটা টাকাও রেখে যায় না। মাঝে মাঝে লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বলে – তুমি যাচ্ছো?
হ্যাঁ। কিছু বলবে? হ্যাঁয়ের পরে কিছু বলবে – এই শব্দ দুটোও নাহার বলতে চায় না, পনেরো বছরের সংসারজীবনে অনুভবের মিথস্ক্রিয়ায় এটুকু বোঝে খালেদ। উপায়হীন হয়ে শব্দ দুটো উচ্চারণ করে নাহার, অনেকটা আনমনে। যেন খালেদ শুনতে না পায়।
মুখ অন্যদিকে ঘোরায় – একটা জরুরি কাজে বাইরে যাবো। কিছু টাকা রেখে যেও।
না তাকিয়ে বুঝতে পারে, নাহার কঠিন শীতল চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কারণ, পায়ের শব্দ নেই। নীরবতা কতো পাশবিক হতে পারে, ঘৃণা কতো তিক্ত হতে পারে সকালের এই মুহূর্তে প্রমাণ রেখে যায় খালেদের হৃৎপিণ্ডে। নাহার ফোঁস-ফোঁস শব্দে ব্যাগ খুলে টেবিলের ওপর টাকা রেখে চলে যায়। খালেদ উঠে পায় একটি একশ টাকার নোট। নোটটা ওকে দেখে মুখ ভেংচায়, শালা ইতর বউয়ের টাকায় চলিস, তোর লজ্জা করে না?
দাঁত ব্রাশ করতে করতে জবাব দেয় খালেদ – এই শালার একশ টাকার নোট, আমার বউয়ের টাকায় আমি চলি তাতে তোর কী? তোর বাপের চৌদ্দগোষ্ঠীর কী? গত পনেরো বছর আমি কী আমার বউকে চালাইনি? এখন না হয় একটু বিপদে পড়েছি –
এখন না হয় একটু বিপদে পড়েছি! পালটা ভেংচায় একশ টাকার পুরনো নোটটা – তোর বউ কতো বেতন পায়, যেখানে দুজনের বেতনে চলতো, এখন সেখানে একজনের বেতনে সংসার চলে, বুঝেছিস?
বুঝবো না কেনো? ভালোই বুঝি। আর সেই জন্য তো কোনো আজেবাজে খরচ করি না। খরচের ভয়ে বাসায় বসে থাকি। যাতে খরচ না লাগে।
বাবা? পেছনে এসে দাঁড়ায় পাভেল।
কী?
আগামী মাসে আমার স্কুলের বেতন, গাড়ির ভাড়া দিতে হবে তোমাকে। মা বলেছে – আমার খরচ দিতে গেলে সংসার চলবে না।
আগামী মাস তো, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা করো না।
ওকে, পাভেল চলে যায়।
একশ টাকায় কিছুই হবে না। কয়েকটা জায়গায় যেতে হবে। দূরসম্পর্কের এক মামা আছে, কোনোদিন খবর রাখেনি। শুনেছে একটা গ্র“প অব কোম্পানির ডিএমডি। বসে মহাখালী। সেখান থেকে যাবে মিরপুর – এক বন্ধুর গার্মেন্ট কারখানায়। কবির বলেছে, যদি গার্মেন্টে চাকরি করিস, আমার দরজা খোলা। তোকে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে রাখবো।
এতোদিন গার্মেন্টে মেয়ে শ্রমিকদের ওপর নির্মম শোষণের কারণে খালেদ যেতে চায়নি; কিন্তু এখন আর উপায় নেই। যেতেই হবে। অন্যের কষ্ট দেখলে চলবে না, নিজের কষ্ট কেউ দেখছে না। কিন্তু নাহারের দেওয়া একশ টাকায় কিচ্ছুই হবে না। গোসল সেরে প্যান্ট-শার্ট পরে নাহারের আলমারি খোলে। জানে কাপড়ের ভেতরে টাকা আছে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও যায়। বেশ কয়েকটা পাঁচশো টাকার নোট। একটা নোট পকেটে কেবল রেখেছে পেছন থেকে সুখী জিজ্ঞেস করে – কী করো বাবা?
মুহূর্ত মাত্র, জমে পাথর হতে হতে ফিরে তাকায় – কিছু না মা। আমার মোবাইলটা খুঁজছিলাম।
হাসে সুখী, তোমার মোবাইল তো তোমার হাতে।
মেয়ের সঙ্গে একটা নাটকীয় মুহূর্ত আনার চেষ্টা করে খালেদ। সুখীকে কোলে নিয়ে বাসার বাইরে আসে। দোকান থেকে আইসক্রিম কিনে দেয়। আদর করে অনেক। মেয়ের ছোট্ট চোখের দেখাকে ভুলিয়ে দিতে চায় বাবা। কোলে নাচাতে নাচতে বলে – বিকেলে আসার সময়ে তোমার জন্য অনেক চিপস আনবো মামণি।
আচ্ছা। ঘাড় দোলায় সুখী।
সারাদিন কাজ শেষ করে রাত নটার দিকে বাসায় ফেরে খালেদ। বাসায় এসে নিত্যদিনের মতো গোসল সেরে বসেছে ড্রয়িংরুমে। আজকের দিনটা মোটামুটি ভালোই গেছে। দূরসম্পর্কের মামা আফসার হোসেন তো খুবই খাতির করলো। এতোদিন দেখা না করার জন্য বকাবকি করে বললো, তুমি তো জানো না খালেদ, তোমার মা আমাকে কতো আদর করেছে। কতোদিন বুবুকে দেখি না। কেমন আছে বুবু?
ভালো আছেন। কথা বলবেন?
দাও তো –
ফোনে ধরিয়ে দিলে মা আর আফসার মামা প্রায় আধা ঘণ্টা কথা বলেছে। সিভি রেখে এসেছে। বলেছে, আগামী এক মাসের মধ্যে জয়েনের ব্যবস্থা করে দেবে। আজকের ঘটনা খেতে খেতে বলবে নাহারকে। নাহার আর বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় যেতে বলেছে আফসার মামা। নিশ্চয়ই নাহার অনেক অন্ধকারে আজ একটু হলেও আলো দেখতে পাবে। আর শরীরটাও চনমন করছে – কতোদিন উপোস সে। মনে পড়ে লালনের গান – হাতের কাছে ভরা কলস তবু তৃষ্ণা মেটে না… গানটা কী এরকম? গান ওর খুব প্রিয় কিন্তু গানের কলি মনে থাকে না। মনে মনে গানটাকে মনে করার চেষ্টা করছে খালেদ, দরজায় এসে দাঁড়ায় নাহার। একেবারে অচেনা এক নাহার। চোখে-মুখে কদর্য ঘৃণার তরঙ্গ – ছিঃ, শেষ পর্যন্ত বউয়ের টাকা চুরি করলে? তাও আবার নিজেরই একরত্তি মেয়ের সামনে? এই বয়সে মেয়েটার চোখে দেখতে হলো – ওর বাপ একটা চোর?
পাথরের মতো ঝিম মেরে যায় খালেদ। নাহ, তার কিচ্ছু বলার নেই। সব সময় বলতেও নেই। নাহারের বলার সময়। বলুক। প্রাণ খুলে বলুক। না বললে ওর কষ্ট বাড়বে। বলে বলে একটু হালকা হোক। আমি তো তলিয়ে গেছি, যাই না হয় আর একটু।
জানো, এতো কষ্টের মধ্যে ওই টাকা লুকিয়ে রেখেছি? বাসায় দুটো বাচ্চা আছে। হঠাৎ যদি ওদের অসুখ হয়, তখন কোথায় যাবো? কার কাছে হাত পাতবো? সেজন্য পাঁচ হাজার টাকা রেখে দিয়েছি। সেই টাকা থেকে তুমি টাকা নিয়েছো? তোমার বিবেকে একটু বাধলো না? আমি তোমার মতো একটা নিকৃষ্টমানের চোরের সঙ্গে এক বিছানায় আছি, ভাবলেও আমার শরীর গুলিয়ে উঠছে। ছিঃ ছিঃ …। চলে যায় নাহার।
সারাটা রাত নিঃশব্দে বসে থাকে খালেদ ড্রয়িংরুমের সোফায়। রাত জাগতে ওর ভালো লাগে না। কোনোদিন রাত বারোটা পর্যন্ত জাগেনি। রাত বাড়লে চোখ দুটো ঘুমে ঢুলুঢুলু করে। শরীর ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো দুলতে থাকে। সেই খালেদ সারারাতে এক বিন্দু ঘুমায়নি। ঘুমাবে কী করে? ঘুম চোখে না আসলে? সারারাত ড্রয়িংরুমে হেঁটেছে আর সিগারেট টেনেছে। শেষ সিগারেট টানা শেষ, ফজরের আজানের শব্দ ভেসে আসে। খালেদ দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ায়। মিষ্টি হাওয়ার একটা ঝটকা লাগে চোখে-মুখে- নাকে। অদ্ভুত প্রশান্তিতে শরীরমন জুড়িয়ে যায়। খালেদ বাসার বাইরে পা বাড়ায়।
সকালে নাহার অফিসে যাওয়ার সময় ঘৃণায় তিক্ততায় ড্রয়িংরুমের দিকে তাকায়ওনি। চলে গেছে। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে পাভেলের কাছে শুনেছে – সারাদিনে বাসায় আসেনি খালেদ।
যাবে আর কই? দিনে না আসুক রাতে ঠিকই আসবে।
রাত বারোটায় যখন ফিরলো না, তখন পাভেলকে দিয়ে ফোন করায় নাহার; কিন্তু সেল বন্ধ। নাহারের অভিমানী মন আরো ক্রুদ্ধ হয় – লোকটা ভেবেছি কী? তাকে খুঁজতে বের হবো আমি? অসম্ভব। মনে মনে বলে, কোথায় আর থাকবে? রাতটা কাটলে সকালে আসবে। কিন্তু সকালেও আসে না খালেদ। দুপুরেও না। বিকেলেও না। সন্ধ্যায়ও না। রাতেও না। নাহারের ভেতরের কুহক কু ডাকতে শুরু করেছে। মনে পড়ছে – শেষ দিনের কথাগুলো। এক ধরনের অপরাধবোধ দানা বাঁধতে থাকে মনের গহিনে – ওই কথাগুলো না বললেও পারতাম। টাকাটা নিয়েছে ওর দরকারেই। একজন পুরুষ মানুষ বাইরে যাবে – মাত্র একশ টাকা নিয়ে? আমি আরো দুশো টাকা রেখে গেলেও তো পারতাম। আরেকটু সহিষ্ণু কেন হলাম না? তাহলে আলমারির টাকা নিতে হতো না। আর মেয়েটার সামনে …। অনেকভাবে নিজেকে বোঝায় নাহার। ফিরে আসার পর ক্ষমা চাইবে। মানুষটা এতোদিন আমার কতো আবদার মিটিয়েছে, আমি সামান্য পাঁচ-ছয় মাসে এমন হয়ে গেলাম?
তিন দিন তিন রাত পরও যখন খালেদ ফিরে আসে না, কোনো খবরও দেয় না, নাহার ততদিনে বুঝে গেছে আর ফিরবে না। পাভেল আর সুখীকে নিয়ে বসে থাকে ড্রয়িংরুমে। আত্মীয়স্বজন এসেছে – তারা পত্রিকায় নাহারের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। চার দিন চার রাত শেষ। ফিরে আসে না খালেদ। শোকে বিধ্বস্ত বাসায় অরো তিন দিন পর একটি খ্যাতনামা বহুজাতিক কোম্পানি থেকে আসে একটি চিঠি। নাহারের সামনে চিঠিটি খোলে পাভেল। খালেদের একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছে বহুজাতিক কোম্পানি থেকে, সিনিয়র সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বেতন চল্লিশ হাজার…।