মরানদীর উপাখ্যান ও সময়ের ক্লিষ্ট ছবি

পাভেল চৌধুরী
অচল ঘাটের আখ্যান
মঞ্জু সরকার
চন্দ্রাবতী একাডেমি
ঢাকা, ২০১৭
৩০০ টাকা

একেবারে উপন্যাসের শেষভাগে ইতালিফেরত বসিরের সঙ্গে দুলালির বিয়েটা হয়ে গেলেই যেন ভালো ছিল। পাঠক স্বস্তি শুধু নয়, একটা পূর্ণতার স্বাদ পেত; কিন্তু সেটা হলো না। নানা ঘটনার ঘূর্ণিপাকে যে-সম্পর্ক প্রায় পরিণতির প্রান্তে পৌঁছেছিল কোনো এক অনির্দেশ্য কারণে সেই সম্পর্ক যেন পাঠককে হতাশ করে একেবারে ছিন্ন হয়ে গেল। যদিও এই ঘটনার মধ্য দিয়ে পাঠকের ভাবনার জগৎটা বিসত্মৃত হতে পারল আর জন্ম হলো অনেক জিজ্ঞাসারও। দশ বছর আগে গ্রামের উপদ্রব ‘ফোর টোয়েন্টি বসির’ গ্রাম থেকে উধাও হয়েছিল। তারপর থেকে তাকে নিয়ে নানা কল্পকাহিনি ছড়িয়েছিল এলাকায়। দশ বছর পর গ্রামে ফিরে সে চমকে দিয়েছিল সবাইকে। ততদিন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পর সে স্থিত হয়েছে ইতালিতে, অবস্থাও ফিরেছে। গ্রামে ফিরে খাজা ডাকাতের মেয়ে দুলালিকে তার ভালো লেগেছিল। দুলালিও তাকে অপছন্দ করেনি। শৈশবে অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া যৌন সম্পর্ক তাদের ভালো লাগার ন্যূনতম ভিত্তি দিয়েছিল, একটু অপরাধবোধ বা দায়বদ্ধতাও যে সে-কারণে বসিরের মনে কাজ করেনি এমন নয়; কিন্তু খাজা ডাকাতের মেয়ে দুলালিকে সুদর্শনা যুবতী বললেই এখন আর সবটুকু বলা হয় না। খাজা ডাকাত দীর্ঘদিন জেলে থাকলে দুলালি দোকান চালিয়ে সংসার সামলেছে, গ্রামের মানুষের নানা ধরনের ঘোরপ্যাঁচ দুরভিসন্ধির মোকাবেলা করেছে আর এসব কর্মকা–র মধ্য দিয়ে তার মধ্যে জন্ম নিয়েছে স্বকীয়তা, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। বসিরের দেওয়া বিয়ের প্রস্তাবে দুলালি কিছু শর্ত দিয়েছিল, বসিরের জন্য যা মেনে নেওয়া অসাধ্য ছিল না, বসির মেনেও নিয়েছিল; কিন্তু তারপরও সম্পর্কটা পরিণতি পেল না। বসির পালিয়ে গেল গ্রাম থেকে, দশ বছর আগে সে যেমন পালিয়েছিল। আসলে পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবেলা করে মানুষ গঠিত হয়। তিস্তাপারের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দুলালি গঠিত হয়েছিল।
সে-পরিস্থিতির সঙ্গে বসিরের পারতপক্ষে কোনো সম্পর্ক ছিল না। দশ বছরের ইতালির জীবন বসিরকে বৈভব দিয়েছে, নিরাপত্তা দিয়েছে ঠিকই কিন্তু দুলালির মতো
ঘাত-প্রতিঘাতে বেড়ে ওঠা মেয়েকে ধারণ করার সামর্থ্য সে কোথায় পাবে? তাই দুলালিকে বিয়ে করার নিজের দেওয়া প্রস্তাবকে নিজেই উপেক্ষা করে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার কোনো উপায় ছিল না।
তথাপি মঞ্জু সরকার-লিখিত উপন্যাস অচল ঘাটের আখ্যানকে নিছক প্রেমের উপন্যাস বলা যাবে না। উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতটা বড়, বিসত্মৃত। একটা জনপদের মানুষের
জীবন-সংস্কৃতি-অস্তিত্বের সংগ্রাম এসবই তাঁর উপন্যাসের অধীত বিষয়। শুধু এইটুকু নয়, অকস্মাৎ মানুষ-সৃষ্ট প্রাকৃতিক পরিবর্তন সেই বিশাল জনপদের মানুষের জীবনপ্রবাহ কীভাবে বিপর্যস্ত পরিবর্তিত করে তারও পরিচয় এ-উপন্যাস থেকে পাওয়া যায়।
মানুষে মানুষে ভাঙা-গড়ার গল্প বলতে গিয়ে লেখক মঞ্জু সরকার অচল ঘাটের আখ্যান উপন্যাসে যে-বিশাল পরিপ্রেক্ষিত পাঠকের সামনে তুলে ধরেন, সেটা এই জনপদের মানুষের জন্য একটা নতুন অভিজ্ঞতা। উপন্যাসের আকার ছোট কিন্তু ব্যাপ্তি বিরাট। হাজার বছর ধরে বয়ে চলা তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ আকস্মিকভাবে রুদ্ধ হওয়ায় এ-অঞ্চলের বিপুল মানুষের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির যে-পরিবর্তন হয় তার অনুপুঙ্খ পরিচয় মেলে এই উপন্যাসে।
তিস্তাপারের ঠ্যাংভাঙা ঘাটকে ঘিরে কাহিনির বিস্তার। তফের ঘাটিয়াল ছিল ঠ্যাংভাঙা ঘাটের মালিক। সমাজে তার প্রভাব ছিল ব্যাপক, প্রতিপত্তিও। সেই ঘাটের মালিক এখন তার নাতি মহির মেম্বার। ঘাটের আদি অবস্থা এখন নেই; কিন্তু ঘাট যেন আধিপত্যের প্রতীক। মহির মেম্বারেরও আধিপত্য ব্যাপক। সে বিপুল বিষয়সম্পত্তির মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখে, এলাকার চেয়ারম্যান হতে চায়, এমপি হওয়ার চিন্তাও যে তার মাথায় নেই এমন নয়। চারটে স্ত্রী নিয়ে বিশাল পরিবার ছিল তফের ঘাটিয়ালের। তার সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। সে-আকাঙ্ক্ষাও তার ছিল না। তার নাতি বর্তমান ঘাটিয়াল মহির মেম্বার তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বিসত্মৃত করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে শুধু চায় এমন নয়, আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রের উন্নয়ন কার্যক্রমেও অংশ নিতে চায়। মহির মেম্বারের ছোট গোছান পরিবার; কিন্তু লাম্পট্য তার জীবনের অংশ। নদীপাড়ের বালি তুলে বিক্রি করা তার অন্যতম ব্যবসা, তাতে নদীর ক্ষতি যাই হোক। নদীকেন্দ্রিক জীবনে নদীর প্রতি যাদের ভালোবাসা তারা মহিরের এই ব্যবসাকে মেনে নিতে পারে না। নদীপাড়ের বাসিন্দা গপ্পু বুড়োর অভিমত – ‘বালুচর থাকলে তবু নদী জাগার আশা থাকে। উজান থেকে পানির ঢল আসলে নদী আবার জাগব। কিন্তু বালু উঠায় নিতে থাকলে বর্ষার পানি নাইমা নদী ক্রমে খাল বিল হইব, তিস্তার কত সোঁতা যে বালু না থাকায় হাইজা মইজা খাল বিল হইছে।’
বিপুলসংখ্যক চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে এ-উপন্যাসে। তাদের অতীতের ঠিকুজি এসেছে, এসেছে বর্তমান পেশার বৈচিত্র্যময় পরিচিতি। একটা সময়কে ধরতে চেয়েছেন লেখক আর সেই সময়কে ধরতে গিয়ে অতীত এসেছে; অতীতের মানুষগুলো শুধু নয়, যে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষগুলো নির্মিত হয়েছে তার পরিচয়ও মেলে এই আখ্যানে। তফের ঘাটিয়াল, খাজা ডাকাত, নজির চেয়ারম্যান, রহিমুদ্দিন এমপি, বাংটু বাসেদ, ফোর টোয়েন্টি বসির, খাজা ডাকাতের মেয়ে দুলালি, স্ত্রী হালিমা, ঝগড়ি মালেকা, তার বাবা ভদু, স্বামী ঘরজামাই মাছুয়া মোমিন – এরকম সব চরিত্র – নদী শুকিয়ে যাওয়ায় যাদের পেশার পরিবর্তন হয়েছে, হাজার বছরের চলমান জীবনযাত্রায় ছেদ পড়ে যাওয়ায় এক নতুন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে তাদের। মঞ্জু সরকারের দৃষ্টি বহুকেন্দ্রিক। মানুষের মনের গভীরে প্রবেশ তার লক্ষ্য, যে-কারণে একই মানুষ পরিবেশ-পরিস্থিতির নিরিখে কত ভিন্নধর্মী আচরণ করতে পারে বা করে সেই পরিচয় তাঁর লেখায় পাওয়া যায়। অর্থাৎ মানুষকে তিনি দেখেন বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে আর এই দেখার মধ্য দিয়েই তিনি দাঁড় করান তাঁর চরিত্রদের। আমাদের সমাজে নারীরা দুর্বল। শারীরিকভাবে যেমন, তেমন পুরুষদের নানাবিধ আধিপত্যের কারণেও। প্রাস্তিক নারীদের অস্তিত্বের সংগ্রাম নিরন্তর।
অভাব-অনটন-লোভ-প্রলোভন ইত্যাদির পাকে তাদের চরিত্র যে টাল খায় না এমন নয়, তবে তাদের দুশ্চরিত্র বা দুর্বৃত্ত বলা যাবে না। খাজা ডাকাত জেলে থাকাকালে তার সহায়-সম্বলহীন স্ত্রী হালিমা খাজা ডাকাতের মুক্তির শর্তে প্রভাবশালী দুর্বৃত্ত মহির মেম্বারের কাছে সমর্পণে সম্মত হলেও চূড়ান্ত মুহূর্তে যেন স্বকীয়তায় ভাস্বর হয়ে ওঠে, দৃঢ়তার সঙ্গে সে প্রত্যাখ্যান করে মেম্বারকে। দুলালি বা ঝগড়ি মালেকার ক্ষেত্রেও চরিত্রের এই ঋজুতার পরিচয় পাওয়া যায়, যা একান্ত তাঁদের স্বভাবগত, আরোপিত বা স্ব-কপোলকল্পিত নয়। প্রাস্তিক নারী, অস্তিত্বের সংগ্রামে যাদের অংশগ্রহণ প্রত্যক্ষ, তাঁদের চরিত্রের এই বিশেষ দিক লেখক তুলে ধরেন বিশ্বস্তভাবে।
খাজা ডাকাত এই উপন্যাসের একটি বিশেষ চরিত্র। ছোটবেলা থেকেই সে ছিল ডানপিটে। নেতৃত্বের গুণ ছিল তার। খাজার বাবার নাম ছিল নাজিম লাঠিয়াল। ‘মাঝারি গেরস্ত হয়েও নিজের হাল বলদ নিয়ে সম্পন্ন চাষি ছিল নাজিম লাঠিয়াল।’ ঘটনাচক্রে খাজা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়, তবে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সে মুক্তিযোদ্ধা ছিল না, যদিও দেশের মাটিতে সে যুদ্ধ করেছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এক ভিন্ন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় সারাদেশে। নিয়ম-শৃঙ্খলার অভাব, লুটপাট, দখলদারি ইত্যাদি ঘটনার মধ্যে থেকে সামাজিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটা নতুন শ্রেণির উদ্ভব হতে থাকে। খাজা হয়ে ওঠে ডাকাত। নানা অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠে খাজার দুর্ধর্ষ ডাকাতদল। ‘উজানে ইন্ডিয়ার বর্ডার অঞ্চল থেকে ভাটিতে তিস্তা ব্রহ্মপুত্র এবং ব্রহ্মপুত্র যমুনার মোহনা পেরিয়েও বিসত্মীর্ণ নদী পথে’ খাজার দলের ডাকাতির দৌরাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে। খাজা ডাকাত প্রথাগত ডাকাত হলেও তার মধ্যে কিছু মানবতা ছিল। রিলিফের মাল সে চেয়ারম্যানের কবল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিল। যথারীতি খাজা ডাকাত ধরা পড়লে তার দশ বছরের জেল হয়। জেলে বসেও খাজা ডাকাত দল গোছায় আর ডাকাতির পরিকল্পনা করে; কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে এসে পরিবারের সদস্য স্ত্রী-মেয়েদের চাপে সে আর পুরনো পেশায় ফিরে যেতে পারেনি। স্ত্রী হালিমা, মেয়ে দুলালি, হুমকি দেয় যে, পুরনো পেশায় ফিরলে তারা সবাই বিষ খাবে। ছোট মেয়ে শেফালি বলে, ‘আমি বিষ খাব না, খাইলে পেট বিষাবে খুব। তার চাইতে গলায় ফাঁসি দিয়া মরব।’ এর থেকে লেখকের সূক্ষ্ম রসবোধেরও পরিচয় পাওয়া যায়।
কিন্তু খাজার সামনে তখন এক নতুন পরিস্থিতি, নতুন সমাজবিন্যাস। মহির মেম্বার এলাকায় নব্য প্রভাবশালী। তার বিভিন্ন ব্যবসা। খাজাকে হাত করার জন্য সে নানা ধরনের লোভনীয় প্রস্তাব দেয়। যাত্রাগান, জুয়ার কারবারে খাজাকে অংশীদার করার জন্য গ্রামের মসজিদের ইমাম ইনতাজ মুন্সি মারফত প্রস্তাব
পাঠায়। যদিও এসব অনৈতিক কাজে খাজা উৎসাহ পায় না, বিশেষ করে কারো অধীনতা ছিল তার চরিত্রবিরুদ্ধ। সে সাফ জানায়, ‘কারো দালালি করার জন্য খাজা ডাকাতের জন্ম হয় নাই মুন্সি। যা করার আমি স্বাধীনভাবে করবো।’ স্বাধীনভাবেই খাজা জেলে থাকাকালে তাদের যে-ব্যবসা ছিল, ঠ্যাংভাঙা ঘাটে দোকানদারি, সেই দোকানদারিতে মনোনিবেশ করে। কিন্তু মহির মেম্বারের সঙ্গে তার মানসিক বিরোধ ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই বিরোধ যে নেতৃত্বের এমন নয়। খাজা আসলে মহির মেম্বারের অনৈতিক উত্থানকে মেনে নিতে পারে না। ‘নানা রকম ধান্দাবাজির ব্যবসা করে টাকা কামানোর লাইন ধরতে সবাইকে টেক্কা দিয়েছে মহির মেম্বার।’ এই ধান্দাবাজি যে শুধু টাকা কামানোর ক্ষেত্রে এমন নয়, তার চারিত্রিক স্খলনেরও নানা ধরনের পরিচয় এরই মধ্যে স্পষ্ট হতে থাকে।
মহির মেম্বার আসলে সাম্প্রতিক সময়ের প্রতিনিধি। টাকা, ভোগ, আত্মকেন্দ্রিকতা এসবের বাইরে তার আর কিছু বিবেচ্য নেই। খাজা ঘটনাচক্রে ডাকাত হয়ে উঠলেও সে এক ধরনের ধারাবাহিকতার ফল। মানবিকতা নৈতিকতা তেজস্বিতা ইত্যাদি তার চরিত্রের ভূষণ। জেল থেকে বের হওয়ার পর পরিবারের সদস্যদের চাপে নিজের অনিচ্ছায় তাকে যেতে হয় শ্বশুরবাড়ির গ্রাম মুকসুদপুরে, কানা পিরের কাছে। সে যেন ডাকাতি ছেড়ে অন্য পেশায় সফল হতে পারে এ-ব্যাপারে দোয়া চাইতে। সব শুনে কানা পির একটা টুপিতে ফুঁ দিয়ে খাজাকে দেয় সার্বক্ষণিক পরে থাকার জন্য, যেন শয়তান তার ওপর ভর করতে না পারে। বেশ কিছুদিন পর, ততদিনে খাজার কাছে এলাকার পরিস্থিতি পরিষ্কার হয়েছে, গাঁয়ের মসজিদের ইমাম ইনতাজ মুন্সির ধর্মের ব্যবসা, মহির মেম্বারের ক্রমবর্ধমান সামাজিক প্রভাব, রাজনীতি আর নানা ধরনের ধান্দাবাজি, পানির অভাবে তিস্তা শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদির সঙ্গে বেমানান খাজা হাঁটুপানির ক্ষীণ সোঁতায় পরিণত হওয়া তিস্তা নদী পার হওয়ার সময় মাথা থেকে টুপিটা পানিতে পড়ে যায় ‘ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে ভেসে যায় সাদা টুপিটা। খাজা দেখেও এটা আর তুলতে চেষ্টা করে না। বরং নৌকার পালের মতো ওটাকে ভাসতে দেখে মজাই লাগে, মাথাটা তাঁর অনেক পরিষ্কার হালকা মনে হয়।’ খাজার মাথার টুপিকে কেন্দ্র করে লেখকের এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পাঠকের মনে প্রতীকী অর্থ তুলে ধরে, ভিন্ন ব্যঞ্জনারও জন্ম দেয়।
এই উপন্যাসের একটা শক্তিশালী চরিত্র মাছুয়া মোমিন। যদিও উপন্যাসে তার উপস্থিতি সংক্ষিপ্ত। সে অলস, স্ত্রী ঝগড়ি মালেকার অনুগত। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সে তার পেশা হারিয়েছে। একদিন স্ত্রীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের ফলে কাজের সন্ধানে সে গ্রাম ছাড়ে। এর মধ্যে মহির মেম্বারের সঙ্গে খাজা ডাকাতের অপ্রকাশ্য মানসিক বিরোধ চরমে ওঠে। এই বিরোধের মূল কারণ মহির প্রতি খাজা ডাকাতের অনানুগত্য। খাজা ডাকাতের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে মহির মেম্বার। মোমিনের ছেলে টুকু খাজা ডাকাতের দোকান থেকে মোবাইল চুরি করে ধরা পড়লে সে ডাকাতি-মেজাজে টুকুকে দু-হাতে তুলে ছুড়ে মারে। এই ঘটনায় মহির মেম্বার খাজার বিরুদ্ধে শিশু-নির্যাতনের মামলা সাজায়। এরই মধ্যে ছেলের কথা শুনে মোমিন গ্রামে ফিরে আসে। কিন্তু নানা প্রলোভন আর চাপ থাকা সত্ত্বেও খাজা ডাকাতের বিরুদ্ধে মামলা দিতে সে অস্বীকার করে। ‘মোমিনের সাফ জবাব, দোষ করলে শাসন করার রাইট সবারই আছে।’ মোমিনের দৃঢ়তার কারণেই খাজার বিরুদ্ধে মহির মেম্বারের চক্রান্ত সফল হতে পারে না।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, এরই মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স প্রায় অর্ধশতাব্দী হতে চললো। এই সময়কালের অধিকাংশ সময় দেশটা যেমন গোলমেলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়েছে, তেমনি সামাজিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা গেছে, যার উপস্থিতি বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে প্রায় নেই বললেই চলে। এই উপন্যাসে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি এমনভাবে একীভূত হয়েছে যে, একটা থেকে আরেকটা কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। মহির মেম্বারের ক্রমবর্ধমান যে প্রভাব সেখানে দেখা যাচ্ছে, জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক বাড়ছে না, বরং নানা ধরনের অনৈতিক উপায়ে তার বাড়ছে অর্থসম্পদ আর রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক। পক্ষান্তরে খাজা ডাকাত; সে দুর্বল অর্থনৈতিকভাবে, রাষ্ট্রযন্ত্রও তার পক্ষে নেই। একটা নির্দিষ্ট সময়কালকে প্রত্যক্ষভাবে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মঞ্জু সরকারকে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে অন্যতম সফল পথিকৃৎ বললে ভুল বলা হবে না। ছোট ছোট শিরোনামে লেখা এই উপন্যাস। বিষয়কে নির্জলা উন্মুক্ত করার প্রয়োজনে অনেক সময়ই লেখক ‘সরকার বাড়ির সাংবাদিক’ হিসেবে নিজেই কাহিনিতে উপস্থিত হয়েছেন, যা উপন্যাসকে নতুন আঙ্গিক দিয়েছে।
দুপুরে সপরিবার খাওয়ার সময় স্ত্রী হালিমার কাছ থেকে বসিরের বিদেশ যাওয়ার খবর শুনে খাজার মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। যদিও মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বসিরের সঙ্গে দুলালির বিয়ে হোক এ-আকাঙ্ক্ষা তার প্রবলভাবেই ছিল, আবার সংশয়ও যে ছিল না এমন নয়। কিন্তু রাতে একান্তে স্ত্রী হালিমা নৈমিত্তিক সাংসারিক নানা কথার মধ্যে স্বামীর কোনো সাড়া না পেয়ে ভাবে ‘ঘুমাল নাকি? অনুচ্চারিত প্রশ্নসহ তাঁর কপালে হাত রাখে। সে-রাতে খাজা ডাকাতের চোখ উছলান গরম অশ্রুর ছোঁয়া পেয়ে চমকে ওঠে সে। কি হইল! কাঁদছে কেন মানুষটা?’ খাজা ডাকাতের এই কান্না যে শুধু মেয়ে দুলালির ভবিষ্যৎ ভাবনায় পিতৃহৃদয়ের ব্যাকুল বেদনার বহিঃপ্রকাশ এমন নয়; এই কান্না আসলে শুকিয়ে যাওয়া তিস্তা, মহির মেম্বারের অনৈতিক উত্থান, নিজের ক্রমবর্ধমান অসহায়ত্ব, সর্বোপরি সম্ভাবনাহীন ভবিষ্যৎ ইত্যাদির সম্মিলিত প্রতিফল।
এমতো পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, সামনের মানুষ কারা? সে কি রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থগৃধণু মহির মেম্বারের মতো অনৈতিক আত্মসর্বস্ব মানুষেরা? নাকি খাজা ডাকাত, দুলালি, মেছুয়া মোমিন প্রমুখের মতো প্রাস্তিক মানুষ, স্বভাবগতভাবেই মানবিক আর নৈতিক ঋজুতা যাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য? এ-প্রশ্ন পাঠককে না ভাবিয়ে পারে না।
মঞ্জু সরকারের গদ্যের একটা লোকজ ভঙ্গি আছে। যে-ভঙ্গি শুধু নাগরিক কৃত্রিমতাকে পরিহার করে না, ভাষায় একধরনের গতিও সঞ্চার করে। যে-কারণে নানা বিচিত্র প্রসঙ্গ আর বিসত্মৃত প্রেক্ষাপট সত্ত্বেও পুরো উপন্যাস কোথাও ঝুলে পড়ে না। এতদসত্ত্বেও উপন্যাসের বিসত্মৃত প্রেক্ষাপট আর একটু বর্ধিত কলেবর দাবি করে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর স্বাধীন বাংলাদেশে খাজা ডাকাতের ডাকাত হয়ে ওঠার কারণ আর্থ-রাজনৈতিক প্রশ্নে খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও পাঠকের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয় না।
সব মিলিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে এই উপন্যাস গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বললেই সবটুকু বলা হবে না, নানা কারণে খুব প্রয়োজনীয় বলেও বিবেচিত হবে বলে আশা করা যায়।