মহাকাশযান কেন ভরশূন্য?

মহাকাশ নিয়ে আমাদের সবারই এক ধরনের কৌতূহল রয়েছে। আমার ধারণা, সাধারণ মানুষকে মহাকাশ ভ্রমণের যে অংশটি সবচেয়ে বেশি চমৎকৃত করে সেটি হচ্ছে মহাকাশযানে মহাকাশচারীরা ভরশূন্য অবস্থায় ঘুরে বেড়ান। টেলিভিশন কিংবা ইন্টারনেটের কল্যাণে আমরা সবাই কখনো-কখনো মহাকাশযানে মহাকাশচারীদের ভেসে বেড়াতে দেখেছি।

মজার কথা হচ্ছে, মহাকাশযানে কেন মহাকাশচারীরা ভরশূন্য হয়ে যান এবং কেন সেখানে তারা ভেসে বেড়াতে পারেন – সেটা নিয়ে কিন্তু সাধারণ মানুষের এক ধরনের ভুল ধারণা আছে। কাউকে যদি মহাকাশে ভরশূন্য হওয়ার কারণটা জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে অবধারিতভাবে বেশিরভাগ মানুষই বলবে, মহাকাশ যেহেতু অনেক উঁচুতে তাই মাধ্যাকর্ষণ বল কমতে-কমতে প্রায় শূন্য হয়ে গেছে, সে-কারণেই ওখানে কোনো ওজন নেই! এই উত্তরটি শুধু ভুল নয়, ডাহা ভুল!

স্কুলে ছেলেমেয়েদের মহাকর্ষ বল শেখানো হয়। নিউটনের মহাকর্ষ বলের সূত্র থেকেই তারা জানে যে, মহাকর্ষ বল দূরত্বের বর্গের অনুপাতে কমে, অর্থাৎ দ্বিগুণ দূরত্বে সরে গেলে বল কমবে চারগুণ – চারগুণ দূরত্বে সরে গেলে কমবে ষোল গুণ। কাজেই আমরা ইচ্ছে করলে একটা মহাকাশযানে মাধ্যাকর্ষণ বল কতটুকু হবে সেটা খুব সহজে অনুমান করতে পারি।

পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে পৃথিবীপৃষ্ঠের দূরত্ব হচ্ছে প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার। পৃথিবীকে ঘিরে যে-মহাকাশ স্টেশনটি বহুদিন থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং যেখানে বহুদিন থেকে মহাকাশচারীরা একেবারে ভরশূন্যভাবে বসবাস করছেন, সেই মহাকাশ স্টেশনটির উচ্চতা  পৃথিবীরপৃষ্ঠ থেকে আনুমানিক চারশো কিলোমিটার। সেখানে মাধ্যাকর্ষণ কত হবে, যদি তা অনুমান করতে চাই তাহলে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে কতদূরে সেটা জানতে হবে, ছোটখাটো যোগ-বিয়োগ করেই আমরা বের করে ফেলতে পারব যে, মহাকাশ স্টেশনটি পৃথিবী পৃষ্ঠের তুলনায় মাত্র সাত শতাংশ বেশি দূরে। মাধ্যাকর্ষণ বল যদি দূরত্বের সঙ্গে সমানুপাতিক হারে কমতো তাহলে ওজন কমতো মাত্র সাত শতাংশ। কিন্তু যেহেতু এটি দূরত্বের সঙ্গে বর্গের হারে কমে তাই ওজন কমে প্রায় চৌদ্দ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থর্াৎ ৬০ কেজি ওজনের একজন মানুষ যদি মহাকাশ স্টেশনের সমান উচ্চতায় হাজির হয় তাহলে তার ওজন মাত্র ৭ কেজি কমে হবে ৫৩ কেজির কাছাকাছি! ৬০ কেজি ওজনের মানুষের যদি নিজেকে ৫৩ কেজি মনে হয় সেটি মোটেও ভরশূন্য নয় – সেটি বিশাল ওজন! কাজেই মহাকাশযানে মহাকাশচারীরা যে ভরশূন্য পরিবেশ অনুভব করেন সেটি মোটেও উচ্চতার জন্য নয় – এখানে অন্য কিছু ব্যাপার আছে। সেটি কী?

পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসররা বিষয়টা তাদের মতো করে ব্যাখ্যা করতে পারবেন কিন্তু আমরা ইচ্ছে করলে অন্যভাবে খুব সহজেই এটা বুঝতে পারব। উঁচু বিল্ডিং থেকে লিফটে নামার সময় ঠিক শুরম্নতে আমরা এক মুহূর্তের জন্যে একটুখানি হালকা অনুভব করি – এই বিষয়টা নিশ্চয়ই অনেকে লক্ষ করেছে। (আমাদের দেশি নাগরদোলা নিচে নামার সময় সেটি আরো অনেক তীব্রভাবে অনুভব করা যায়।) এটি কিন্তু শুধু কাল্পনিক অনুভব নয় – তখন আমরা সত্যি-সত্যি হালকা হয়ে যাই। যদি লিফটের দড়ি ছিঁড়ে পুরো লিফটটা একেবারে মুক্তভাবে নিচে পড়তে পারত (খোদা না করম্নক!) তাহলে সেই সময়টুকু আমরা পুরোপুরি হালকা কিংবা ভরশূন্য হয়ে যেতাম। মহাকাশযানে মহাকাশযাত্রীরা যখন ভরশূন্য পরিবেশে এক গস্নাস পানি ঢালেন সেই পানি নিচে না পড়ে তাদের সামনে ভাসতে থাকে কিংবা ঝুলতে থাকে। মুক্তভাবে পড়তে থাকা একটা লিফটের ভেতরে যদি এক গস্নাস পানি ঢেলে দিই তাহলে আমরা হুবহু একই ব্যাপার দেখব। পানিটা নিচে না পড়ে আমাদের সামনে ভেসে আছে। কারণ আসলে আমরা যে-বেগে নিচে পড়ছি পানিটাও সেই একই বেগে নিচে পড়ছে – কাজেই আমাদের তুলনায় সেটা স্থির। লিফটের দড়ি ছিঁড়ে মুক্তভাবে পড়তে দিয়ে তার ভেতরে ভরশূন্য পরিবেশ তৈরি করার আইডিয়াটা যত সহজই হোক না কেন, সেটা কেউ কখনো চেষ্টা করে দেখেনি। কারণ আগে হোক, পরে হোক শেষ পর্যমত্ম লিফটটা মাটিতে আঘাত করবে এবং তখন ভরশূন্য পরিবেশের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার জন্যে কেউ আর ফিরে আসবে না! তবে পড়মত্ম লিফটের ভেতরে ভরশূন্য পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা কেউ না করলেও বড় পেস্নন দিয়ে সেটা নিয়মিতভাবে করা হয়। পেস্নন হওয়ার কারণে সেটাকে বিপজ্জনকভাবে খাড়া নিচের দিকে পড়তে হয় না – সামনের দিকে উড়তে-উড়তে নিচের দিকে পড়তে পারে। বেশ খানিকটা নিচে নেমে এলে আবার ওপরে উঠে আবার পুরো প্রক্রিয়াটা শুরু করতে পারে। বিজ্ঞানী স্টিফান হকিংয়ের এরকম ভরশূন্য পরিবেশে যাওয়ার খুব শখ ছিল, তাই তাকে যখন নেওয়া হয়েছিল সেটি সম্পর্কে সারা পৃথিবীর মানুষই জানে!

যারা ধৈর্য ধরে এতটুকু পড়ে এসেছে তারা সবাই নিশ্চয়ই একটু অধৈর্য হয়ে ভাবছে, আমি ধান ভানতে কেন শিবের গীত গাইছি? মহাকাশযানে মহাকাশচারীরা কেমন করে ভরশূন্য হয়ে যায়, সেটা ব্যাখ্যা করার কথা ছিল। সেটা না বলে আমি সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, মুক্তভাবে পড়তে থাকলে ভরশূন্য হয়ে যায়। মহাকাশযান তো মুক্তভাবে পৃথিবীতে পড়ছে না, সেটা পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে, তাহলে সেখানে কেন মহাকাশচারীরা ভরশূন্য?

আমি এখন যেটা বলব সেটা শুনে অনেকে চমকে উঠতে পারে। যদিও আমরা জানি কৃত্রিম উপগ্রহ বা মহাকাশ স্টেশন পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। আসলে সেটা কিন্তু মুক্তভাবে পৃথিবীতে পড়ছে!

পৃথিবীপৃষ্ঠে সেটা আছড়ে পড়তে পারছে না। কারণ নিচে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে সেটা একইসঙ্গে সামনেও এগিয়ে যাচ্ছে – কাজেই গোলাকার পৃথিবীর নাগালে সেটা কখনোই আসতে পারছে না। যদি কোনো কৃত্রিম উপগ্রহকে বা মহাকাশ স্টেশনকে থামিয়ে দেওয়া যেত তাহলে সেটা টুপ করে পৃথিবীতে এসে পড়ত। (চাঁদকে থামিয়ে দিলেও সেটা ‘ধুম’ করে পৃথিবীতে পড়ত! পৃথিবীকে থামিয়ে দিলে সেটা ‘ধড়াস’ করে সূর্যতে পড়ত!)

যাদের মনে এখনো সন্দেহ আছে তাদের জন্যে আরো একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ধরা যাক পৃথিবীটা গোলাকার নয়, ধরা যাক পৃথিবীটা বিশাল একটা সমতল এবং পৃথিবীর ওপরে যে-কোনো কিছুকে এই সমতল পৃথিবী খাড়াভাবে নিচে টানছে। এখন যদি অনেক ওপর থেকে একটা লিফট কিংবা ক্যাপসুল ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে সেই লিফট কিংবা ক্যাপসুলের ভেতর যারা আছে তারা নিচে আঘাত করার আগের মুহূর্ত পর্যমত্ম একটা পরিপূর্ণ ভরশূন্য পরিবেশে থাকবে – যেটা আমরা আগেই বলেছি এবং ব্যাখ্যা করেছি। এখন ক্যাপসুলটা ছেড়ে দেওয়ার সময় যদি এটাকে পৃথিবীর ভূমির সমান্তরাল দিকে একটা ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে কী হবে?

ক্যাপসুলের ভেতর যারা আছে তারা কোনো পার্থক্য টের পাবে না, কিন্তু আমরা যারা বাইরে আছি তারা দেখব এটা খাড়া নিচে না পড়ে আরেকটু দূরে গিয়ে মাটিতে আঘাত করবে। যদি আরো জোরে ধাক্কা দিয়ে ছুড়ে দেওয়া হয় তাহলে ক্যাপসুলটা ঠিক একই সময় পড়ে আরো দূরে গিয়ে মাটিতে আঘাত করবে। ক্যাপসুলের ভেতরে যারা আছে তারা প্রতিবারই সেই সময়টাতে ভরশূন্য পরিবেশ অনুভব করবে।

সত্যিকারের গোলাকার পৃথিবীতে এই একই বিষয়গুলো করলে কী হবে? ওপর থেকে ছেড়ে দিলে সমতল পৃথিবীর মতো ‘টুপ’ করে নিচে এসে পড়বে এবং যারা ক্যাপসুলের ভেতরে আছে তারা মাটিতে আঘাত করার পূর্বমুহূর্ত পর্যমত্ম ভরশূন্য পরিবেশ অনুভব করবে। পৃথিবীপৃষ্ঠের সঙ্গে সমামত্মরাল দিকে একটা ধাক্কা দিলে এবারে একটু ভিন্ন ব্যাপার ঘটবে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তিটা এবারে খাড়া নিচের দিকে নয়, গোলাকার পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে। ক্যাপসুলটা সে-কারণে পৃথিবীটা ঘুরে অনেক দূরে গিয়ে আঘাত করবে। যত জোরে ধাক্কা দেওয়া হবে পৃথিবীটা ঘিরে তত দূরে আঘাত করবে, কিন্তু আঘাত করার পূর্বমুহূর্ত পর্যমত্ম ক্যাপসুলের ভেতরে যারা আছে তারা যেহেতু মুক্তভাবে নিচে পড়ছে সেজন্যে ভরশূন্য পরিবেশ অনুভব করবে।

আমি কী বলার চেষ্টা করছি, সেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সবাই অনুমান করতে পারছে। ক্যাপসুলটা ছেড়ে দেওয়ার আগে আমরা যদি ভূমির সঙ্গে সমামত্মরাল দিকে যথেষ্ট জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে দিই তাহলে ক্যাপসুলটা গোলাকার পৃথিবীর মাটিতে আঘাত করতে না পেরে পুরো পৃথিবীটাই একবার পাক খেয়ে চলে আসতে পারে এবং এরপর থেকে সেভাবেই পৃথিবীটা ঘিরে ঘুরতে শুরম্ন করে দিতে পারে। ভেতরে যারা আছে তারা মনে করবে এটা মুক্তভাবে নিচে পড়ছে এবং সেজন্যে ভেতরে ভরশূন্য! কৃত্রিম উপগ্রহ বা মহাকাশ স্টেশনে ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটে।

যারা স্কুলে একটু-আধটু পদার্থবিজ্ঞান পড়ছে তারা একটু চেষ্টা করলেই অংক করে বের করে ফেলতে পারবে, বিষয়টা ঘটানোর জন্যে গতিবেগ কত হওয়া দরকার। (ঘণ্টায় প্রায় ত্রিশ হাজার কিলোমিটার) সেই প্রচ- গতিবেগে বাতাসের ঘর্ষণে সবকিছু পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে, তা না হলে আমরা দেখতে পেতাম ভরশূন্য পরিবেশ দেখার জন্য আমাদের মাথার ওপর দিয়েই প্রচ- গতিতে পেস্নন উড়ে যাচ্ছে! এখন সেটি করা সম্ভব শুধু মহাকাশে, যেখানে বায়ুম-ল নেই বলে বাতাসের ঘর্ষণও নেই!

একটা মহাকাশযান কিংবা কৃত্রিম উপগ্রহকে কক্ষপথে বসানোর জন্য তাকে যথেষ্ট গতিবেগ দিয়ে শুরম্ন করে দিতে হয়। মুক্তভাবে কিছু যদি পড়তে থাকে সেটিকে পড়তে দেওয়ার জন্য কিন্তু আর কোনো শক্তি দিতে হয় না! জ্বালানি খরচ করতে হয় না। তাই কক্ষপথে একটা উপগ্রহ বসে যাওয়ার পর কিন্তু সেটাকে আর জ্বালানি পুড়িয়ে রকেট দিয়ে ঠেলে নিতে হয় না। সেটি নিজে নিজেই ঘুরতে থাকে। অনমত্মকাল!

তা না হলে চাঁদটাও নিশ্চয়ই একদিন থেমে যেত। কিংবা পৃথিবীটাও। তাহলে কী ঝামেলাই না হতো! (চাঁদে কিংবা পৃথিবীতে আমাদের ওজন আছে কারণ তাদের বিশাল ভর, সেগুলো মহাকাশযানের মতো হালকা নয়।)