তাকে এখন খিদিরপুরের দিকে যেতে হবে। যেজন্য এসেছে এ-ঘটনার শুরু হয়েছে অনেক অনেক বছর আগে। একটা হ্যাপা। বলতে গেলে বড় হ্যাপাই আজ পোহাতে হচ্ছে দীপ্তকে। এটা সে ইচ্ছা করেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। না নিলেও পারতো। কাউকে সে বলেনি। বলার কথাও নয়। সাত-আট দিন আগে কলকাতায় এসেছে একটা ব্যবসায়িক কাজে। দীপ্ত ঢাকায় একটা বায়োমেডিক্যাল রিএজেন্টের ফার্ম চালায়। তাই মাঝেমধ্যে তাকে কলকাতা, মুম্বাইয়ের বায়োমেডিক্যাল যন্ত্রপাতি ও রিএজেন্টের কোম্পানিগুলির অফিসে আসতে হয়। অবশ্য এলসি করে বাংলাদেশ থেকেই। তারপরও আসতে হয়। এসে হোটেলেই থাকে। আত্মীয়স্বজনের বাসায় ওঠে না। ব্যবসায়িক কাজে এসে অন্যের বাসায় ওঠা ঠিক নয়। লোকজন বলবে খরচ বাঁচানোর জন্য এসেছে। তারপরেও কোনো কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের বাসায় দেখা করতে যায়। গেলে হাতে করে যথেষ্ট পরিমাণ ভেট নিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ থেকে চলে আসা ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা করে। একটু-আধটু ফুর্তিফার্তাও করে। বউ এটা জানে না। বউয়ের কাছে সে ব্যস্ত মানুষ। কিছুটা কঠিন ধরনের। কিন্তু আজ যে মিশনে সে বের হয়েছে তার হদিস কেউ জানে না। কেউ শুনলে হাসবে, এমনটাই মনে হয় দীপ্তর। তাই সে আজ কোনো বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে আসেনি। এমন কোনো মূল্যবান গুরুত্বপূর্ণ কাজে আজ সে আসেনি। এখন তার কাছে সময় মানে টাকা। তারপরও এসেছে। আজ সে একজন তাৎপর্যহীন মানুষকে দেখার জন্য এসেছে। তার মুখটাও এতদিনে দীপ্তর কাছে অর্থহীন হয়ে গেছে। সময়টা তো কম নয়। প্রায় কুড়ি বছর। তারপরও কিছু কিছু ক্ষণ করোটি থেকে মুছে যায়নি। একদিন-দুদিন তো নয় অনেক কয়টা বছর তারা কাছাকাছি ছিল। মহল্লার মধ্যেই বাড়ি। আর তাছাড়া ওই মানুষটা ছোট বোনের বান্ধবী। বেণি দোলানো বয়স থেকেই শিপ্রা দীপ্তদের বাড়ি আসতো। দীপ্ত শুধু তাকিয়ে থাকতো ওর দিকে।
দীপ্তদের মফস্বল শহরের বাড়ির পাশে নদী ছিল। সময়ে-অসময়ে বন্ধুরা মিলে ঝাঁপিয়ে পড়তো নদীতে। কাটতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা এবং অবধারিতভাবে প্রায়ই জ্বরে ভুগতো তারা। তখন বাসায় সহানুভূতির চাইতে বকাঝকাই জুটতো বেশি। সেটা স্কুলে পড়ার সময়। এমনি এক জ্বরের সময় দীপ্ত একা ঘরে শুয়ে ছিল। হঠাৎ করে ছোট বোন ঢুকেছিল এ-ঘরের খাটের তলায় রাখা অ্যালুমিনিয়ামের একটা গামলা নিতে। সম্ভবত দীপ্তর মা গামলাটা নিয়ে যেতে বলেছিলেন। দীপ্ত খাটে শোয়া। সঙ্গে শিপ্রা। ছোট বোন বাসন্তী বললো, দাদা, এখন সাবু খাবি কি না মা তোকে জিজ্ঞেস করতে বলেছে।
শিপ্রা দীপ্তর দিকে তাকিয়ে থাকে। দীপ্ত সে-চোখে দেখতে পেয়েছিল মায়া, সহানুভূতি আর আকুলতা। শিপ্রা বাসন্তীকে জিজ্ঞেস করে, দীপ্তদার কী হয়েছে?
– আরে জ্বর। দেখতে পাচ্ছিস না? চল। দাদা মাকে কী বলবো? বাসন্তী অ্যালুমিনিয়ামের গামলা ততক্ষণে খাটের তলা থেকে বের করে ফেলেছে।
– আমি এখন খাবো না।
– আচ্ছা, বলে বাসন্তী বান্ধবীকে নিয়ে চলে যায়।
ওরা চলে যাওয়ার পর দীপ্ত একটা শূন্যতা অনুভব করে। কিসের সেটা কিছুটা আন্দাজ করে। শিপ্রার কথা মনে পড়ছে! দীপ্ত তখন স্কুলের শেষ দিককার ছাত্র। সে দেখেছে ইদানীং শিপ্রাকে দেখলে তার মনে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। কিসের আনন্দ তা সে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারে না। কিন্তু তার জন্য আরো বিস্ময়কর ঘটনা অপেক্ষা করছিল। পরদিন দুপুরবেলা শুয়ে আছে খাটের ওপর। জ্বরটা একদিনেই ছেড়ে গেছে। তারপরও শুয়ে আছে। পাশের বাড়ির বিশু হঠাৎ করেই ঢুকে পড়ে দীপ্তর ঘরে। বিশুর বয়স সাত-আট। ডানপিটে ছেলে। সে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, দীপুদা দীপুদা শিপ্রাদিদি তোমাকে এই লেবুটা খেতে দিয়েছে। বলে একটা কাগজিলেবু দীপ্তর বিছানায় ফেলে দৌড়ে বেরিয়ে যায়।
দীপ্ত হা! সে লেবুটা হাতে নেয়। একবার দেখেই বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলে। লেবুটা পাঠালো কেন?
এরপর কয়েকদিন আর শিপ্রার দেখা পায়নি। সাতদিনের মাথায় আবার ছোট বোনের সঙ্গে শিপ্রা দীপ্তদের বাসায় আসে। দীপ্ত একলা পেয়ে জিজ্ঞেস করে, লেবু পাঠিয়েছিলি কেন?
শিপ্রার আগাপাশতলা নড়ে ওঠে। সে মাটির দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়, লেবু খেলে জ্বর কমে। এটুকু বলেই সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
লেবু খেলে জ্বর কমে! দীপ্ত হাসে। এই পিচ্চি মেয়েটা জানলো কোথায় ‘লেবু খেলে জ্বর কমে’। আবার জ্বর কমার জন্য তাকে লেবু এনে দিয়েছে। তারপর তো দিন গড়িয়েছে। কিন্তু ‘লেবু খেলে জ্বর কমে’ এটা কিন্তু একটা স্থায়ী বাক্যবন্ধ হয়ে গেল দীপ্তর জীবনে। ছোট বোন বাসন্তীর সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার সময় শিপ্রা দীপ্তদের বাসায় আসতো। দীপ্ত তখন প্রায়ই বলতো, লেবু খেলে জ্বর কমে। শিপ্রা খুবই লজ্জা পেত। দীপ্ত অত ভালো ছাত্র ছিল না। সে তখন স্থানীয় কলেজে ইতিহাসে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। শিপ্রা তখন সবে কলেজে উঠেছে। ছোট বোনকে নিতে দীপ্তদের বাসায় আসে প্রতিদিন। দীপ্ত প্রায়ই ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতো, লেবু খেলে জ্বর কমে। শিপ্রা শুধু লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসতো। সময় সময় রাগও করতো খানিকটা। সবার সামনে লজ্জা দেওয়ার মানে হয় না। সেই কবে ছোটবেলায় কবে কী বলেছিল তা নিয়ে এখন ক্ষ্যাপানোর কোনো মানেই হয় না। কিন্তু একদিন ঘটনা ঘটেছিল অন্য। এ-মফস্বল শহরে রাস্তাঘাট দুপুরবেলায় একটু নীরবই থাকে। এ-সময় লোকজন ভাতঘুমে যায়। এরকম একটা দিনে কলেজ থেকে আসার পথে দীপ্ত আর শিপ্রার একা দেখা হয়ে যায়। সঙ্গে দীপ্তর বোন বাসন্তী ছিল না। সেদিন কেন জানি শিপ্রাকে দীপ্তর দেখে বেশ চঞ্চল মনে হয়েছিল। শিপ্রা কাছে আসতেই দীপ্ত দেখলো শিপ্রার মুখটা হাসি হাসি। সেই হাসিটা আরো ছড়িয়ে পড়লো। দীপ্তকে দেখে হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বললো, লেবু খেলে জ্বর কমে। দীপ্ত অবাক, আরে এটা তো এতদিন শিপ্রাকে ক্ষ্যাপানোর জন্য সে-ই বলতো! দীপ্ত শুধু বলে, তাই নাকি?
শিপ্রা মাটিতে চোখ রেখে শুধু মাথা নাড়ে, হু।
এবার দীপ্ত একটু চুপ থেকে বলে, ঠিক আছে কথাটা মনে রাখিস। নড়চড় যেন না হয়।
শিপ্রা এবার দীপ্তর চোখে তার আয়ত চোখ দুটি রেখে গভীর প্রত্যয়ে বলে, ঠিক আছে।
তারপর দুজনের মুখই হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সেদিন থেকে দীপ্ত আর শিপ্রার পৃথিবীটা বদলে গিয়েছিল। এত মানুষের ভিড়ে তাদের জন্য আরেকটা ছোট্ট পৃথিবীর দরকার হয়ে পড়েছিল। সে-সময় সেটা দুজন মিলে তৈরি করে নিয়েছিল। এটা কেউ টের পায়নি। শুধু বাসন্তী খানিকটা। বাসন্তী শিপ্রার ভাবগতিক দেখে বলে ফেলেছিল, কী ব্যাপার আমি যেন একটা কিসের আত্মীয় আত্মীয় গন্ধ পাচ্ছি তোর গা থেকে?
শিপ্রা মুখে একটা আলাভোলা টাইপ ভাব এনে বলে, কী বলছিস?
বাসন্তী মাথা নাড়ে, উহু কিছু একটা হচ্ছে। হোক তাতে আমার আপত্তি নেই, তবে আমাকে কেউ কিছু বলবে না, এটা খুবই খারাপ।
শিপ্রা ভাজা মাছ উল্টে খেতে না পারার ভঙ্গিতে বলে, কী জানি তোর মনের মধ্যে কী আছে তা আমি জানি না।
বাসন্তী এবার জোর দেয়, আমার মনের মধ্যে না। সম্ভবত তোর মনের মধ্যে।
শিপ্রা ঠোঁট উল্টায়, কী জানি কী বলছিস।
বাসন্তী নাছোড়বান্দা, দেখ তুই আমার ছোটবেলার বান্ধবী। তুই আমাকে কেন শত্রু ভাবছিস?
শিপ্রা এবার কাত হয়, আমি তোকে শত্রু ভাবি কে বললো?
– বলতে হয়? কাজকর্মে বোঝা যায়। যে মেয়ে তুই আমার কাছে একটা কথা না বললে তোর পেটের ভাত হজম হয় না আর তুই এখন আমাকে শত্রু ভেবে বসে আছিস?
– ভাই তুই পরিষ্কার করে বল, শিপ্রা মন খারাপ করে বলে।
বাসন্তী এবার একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি জামার ভেতর থেকে বের করে বলে, এটা কী?
শিপ্রা অবাক, আরে এটা তুই কোত্থেকে পেলি?
– দাদার বালিশের নিচ থেকে।
শিপ্রা এবার বাসন্তীর গলা জড়িয়ে ধরে, মাফ চাই।
– যা মাফ করলাম। কবে থেকে?
– ছোটবেলা থেকে।
– সত্যি?
– হু।
– তাহলে মাথাটা তোমার আগেই গেছে?
– হু।
এবার দুজনে হাসতে শুরু করে।
কিন্তু বিষয়টা অত সহজভাবে গড়ায়নি। কিছুদিন পর দীপ্তদের সংসারে ঝড় উঠলো। অভাবের ঝড়। উপায়হীনতার ঝড়। বাজারে দীপ্তদের যে ওষুধের দোকানটা ছিল সেটা এবার দোকান মালিক ভেঙে ফেলবে। পুরো মার্কেটটাই আধাপাকা ছিল। এবার সেটা ভেঙে ছয়তলা বিল্ডিং বানাবে। নিচে দোকান থাকবে, তবে পুরো বিল্ডিং তৈরির পর আবার নতুন করে চুক্তিপত্র করতে হবে দোকান করার জন্য। যেন হঠাৎ বজ্রপাত হলো। দোকান বন্ধ।
আয়-রোজগারও একেবারে বন্ধ। সে-ঝড়টা সামাল দিতে গিয়ে দীপ্তকে তার এক আত্মীয়ের সায়েন্টিফিক জিনিসপত্রের দোকানে ঢাকার হাটখোলাতে গিয়ে চাকরি নিতে হলো। কয়েক বছরে দীপ্ত বেশ গুছিয়ে নিয়েছিল। মনোযোগ দিয়ে চাকরি করে ব্যবসাটার অস্থিমজ্জা ভালো করেই চিনে নিয়েছিল। আত্মীয় তখন তার ওপরেই বেশ ভরসা করতে শুরু করেছেন। আত্মীয়ের দুই ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। তারা আর ফিরবে না। বাবাকে বলেছে ওসব বেচে দিয়ে ছেলেদের কাছে চলে যেতে। দীপ্তর স্বপ্নটা তখনো শিপ্রাকে ঘিরে। কিন্তু শিপ্রার বাবা হঠাৎই সিদ্ধান্ত নেন তারা ভারতে মাইগ্রেট করবেন। দীপ্তর তখন কিছু করার নেই। সংসার তার কাঁধে। তার আরো সময় প্রয়োজন।
দেশের বাড়ি এসে দেখে শিপ্রারা চলে গেছে। শুধু ছোট বোন বাসন্তী জানালো, যাওয়ার দিন খুব করে কেঁদেছিল।
– আমার কথা কিছু বলেছে?
– বলেছে, মাফ করে দিতে।
– আমাকে জানাতে পারতো।
– কী হতো জানালে? বাসন্তী জানতে চায়।
দীপ্ত চুপ করে থাকে। আসলেই কী হতো জানালে। কীইবা করতে পারতো?
সেসব দিন চলে গেছে। শুধু দিন নয়। বছরের পর বছর চলে গেছে। যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। ফিকে হয়ে গেছে সব। শুধু মাঝেমধ্যে লোক মারফত সামান্য কিছু খবর পাওয়া যেত। শিপ্রার বিয়ে হয়ে গেছে। ওর বাবা সেখানে গিয়ে ব্যবসা দিয়েছেন নতুন করে এবং সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কারণ তার পুরনো জুয়া খেলার অভ্যাসটা ছাড়তে পারেননি। প্রায় অর্ধাহার-অনাহারের একদিনে শিপ্রাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় এক মাঝবয়সী লোকের সঙ্গে। মিনিট্রাক চালায়। আর ট্রাক নিয়ে রাস্তায় নামলে একটু নেশা না করলে তো চলে না। রোগশোক লেগেই থাকতো মানুষটার। তবে লোকটা নাকি কোনো গণ্ডগোল পাকাতো না। বাসায় এসে ভাত খেত আর কাজে চলে যেত। তারপর একদিন একটা ছেলে আর বউকে রেখে স্ট্রোক করে মরে গেল। এটুকুই আপাতত গত আড়াই যুগের শিপ্রার ইতিহাস। এসবই ইদানীং জেনেছে ফেসবুক বের হওয়ার পর। সব খবরই দিত ছোট বোন বাসন্তী। খিদিরপুরের ঠিকানাটাও জোগাড় করে দিয়েছে ছোট বোন। কিন্তু দীপ্তর ইতিহাস একেবারে বিপরীতে উজানে বয়ে গেছে। যেখানে চাকরি নিয়েছিল, সেই আত্মীয় চলে গেছে অস্ট্রেলিয়ায় তার ছেলেদের কাছে। নামমাত্র মূল্য ধরে ব্যবসাটা হাতে তুলে দিয়ে গেছে। টাকাটাও একবারে দিতে হয়নি। আস্তে আস্তে কিস্তিতে শোধ করে দিয়েছে। শুধু একটা শর্ত ছিল, দোকানের নামটা যেন না বদলায়। কারণ ব্যবসাটা তার মায়ের নামে ছিল। মোহিনী বায়োকেমিক্যালস। সেই আত্মীয়ও মারা গেছে বছর দশেক আগে। দীপ্ত নামটা পাল্টায়নি। তারপর বিয়ে করেছে। তার একটা সুন্দরী বউ হয়েছে। দশ বছরের ছেলে আছে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে।
কীভাবে বেঁচে আছে শিপ্রা, দেখতে কেমন হয়েছে খুব জানতে ইচ্ছা করে। বহুদিন ধরে খোঁচাচ্ছিল এরকম একটা ইচ্ছা। আজ সেই সন্ধানেই বের হয়েছে।
এসপ্লানেড থেকে একটা ট্যাক্সি নিল। খিদিরপুর ডক রোডে এসে নামলো। না নামলে লোকজনকে বারবার জিজ্ঞেস করতে পারবে না। যদিও ঠিকানাটা আছে। এদিককার পরিবেশ দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। চারদিকে একটা লোককে জিজ্ঞেস করতে সে বললো, ওই জগন্নাথ মন্দিরের আশপাশ দিয়ে হবে। দেখুন সামনে গিয়ে। এবার সে চিন্তা করলো, ফোন করলে কেমন হয়? ফোন নম্বরটা সহজেই সে ফোনের হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বের করে নিতে পারবে। যদিও কোনোদিন ফোন করা হয়নি। দরকারও হয়নি। যা ধুয়েমুছে গেছে তা ঝালাই করে কী হবে? এমনটাই ভেবেছিল। কিন্তু কিছু একটা তাকে পিছু ছাড়েনি। হঠাৎ ফোন পেয়ে কী ভাববে? না বলেকয়ে হঠাৎ আসাটাই বা কেমন হলো? ওর বাসায়ই বা কে আছে? জানে জামাইটা মারা গেছে। কিন্তু এখন আর ফিরে যাওয়ার মানে হয় না। দীপ্ত ফোন করে রাস্তায় দাঁড়িয়েই। ফোনে রিং হচ্ছে। দীপ্তর হৃৎপিণ্ডটা ধুকপুক করতে শুরু করেছে। ধরেছে। ওপার থেকে প্রশ্ন আসে, হ্যালো, কে? সেই গলার স্বর, একটু ঘুমঘুম ভাব। দীপ্ত রহস্য করে উত্তর দেয়, লেবু খেলে জ্বর কমে।
– কে? কে? তারপর একটু নিস্তব্ধতা। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ে, তুমি … তুমি … দীপ্তদা! কোথা থেকে বলছো? কলকাতা এসেছো? কবে আসছো। আমাদের এদিকে এসো। দেখে যাও আমাকে। আমার অবস্থা। কোথায় তুমি? বাসন্তীর সঙ্গে তো আমার কথা হয়। তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছি। শুনেছি তুমি ঢাকায় আছো। অনেক ভালো আছো। ছোটবেলার ‘আপনি’ সম্বোধন এতদিনে ধুলায় মিশে গেল।
দীপ্ত এবার শিপ্রার কথার স্রোতে বাধা দিয়ে বলে, ফোনেই সব কথা সেরে ফেলবি? আমি খিদিরপুরে এসেছি তোকে দেখতে।
শিপ্রা এবার নিজেকে সংবরণ করে বলে, কোথায় তুমি?
এই তো জগন্নাথ মন্দিরের ভেতরের দিকে ঢুকে একটা গলিতে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে একটা দোকান, নামটা হলো, মিতা মিষ্টিঘর।
– ঠিক আছে একদম কাছাকাছিই এসেছো। ওখানেই দাঁড়াও। আমি আসছি তোমাকে নিয়ে যেতে।
দীপ্ত ‘মিতা মিষ্টিঘর’ থেকে কেজি দেড়েক সন্দেশ কেনে। পাশের ফলের দোকান থেকে দু-কেজির মতো ফলও কিনে নেয়। তারপর হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই শিপ্রা এসে হাজির হয়। দীপ্তকে দেখে শিপ্রার মুখে একটা অত্যুজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে পড়ে। সামনে এসে হেসে ফেলে। কিন্তু চোখের কোনায় জল চিকচিক করে। তারপর হাতের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে, এসব কী করেছো!
– আরে না, কিছু না। তোকে দেখতে এলাম।
– এত জিনিস কেন কিনেছো? আমরা মা-ছেলে দুজন মাত্র।
– থাক।
– চলো। কিনেই যখন ফেলেছো, দাও, আমার হাতে দাও।
– না, আমিই নিই। তুই চল।
দীপ্তর মন বিষাদে ছেয়ে যাচ্ছে। সেই গলার মাদকতাময় ঘুমঘুম স্বর আর বড় বড় চোখ ছাড়া কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই। অপুষ্টিতে ভোগা মুখে চোখদুটো যেন আরো বেশি বড় দেখাচ্ছে।
হাত-পা কাঠি কাঠি। মাথার চুল উঠে গিয়ে কপালটা বড় হয়ে গেছে। একেবারেই ছন্নছাড়া অবয়ব।
যতই ভেতরে ঢুকতে লাগলো ততোই এঁদোগলি তস্যগলিতে ভরপুর। কালো কালো ছোট ছোট আধাপাকা ঘরদুয়ার। দুপাশে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। মানুষজনের চেহারাসুরত কেমন যেন ঘোরালো রকমের। দীপ্তর একটু ভয় ভয়ই করতে লাগলো। এখানে থাকে! অথচ এই মেয়েদের বাসায় পাড়ার মধ্যে প্রথম টেলিভিশন এসেছিল। দীপ্তও একদিন দেখতে গিয়েছিল। এক গলি থেকে আরেক গলিতে ঢুকতে ঢুকতে শিপ্রা অনবরত কথা বলে যাচ্ছিল। দীপ্তর বাসার সবার কুশল জিজ্ঞেস করছিল। তারপর যে গলিতে গিয়ে থামলো সেটার মাথায় একটা নড়বড়ে টালির ঘর। জানালো, তার স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়ির সবাই যার যার মতো করে বাড়ির জায়গা ভাগ করে নিয়ে শিপ্রা আর তার ছেলের জন্য যৎসামান্য ঘরের অংশ ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু দেয়াল তুলে দিয়ে একেবারে পৃথক করে দিয়েছে। কোনো রকমে মাথা নুইয়ে ঘরে ঢুকলো। চারদিকে ভ্যাপসা গন্ধ। একটা ঘরকেই ভাগ করে দুটো বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। একটা খুবই ছোট আরেকটা একটু বড়। যেটাতে একটা বড় চৌকি পাতা রয়েছে। সেখানে ছেঁড়া তোষক পাতা। চিটচিটে বালিশ রাখা। শিপ্রা সপ্রতিভভাবেই বলে, দেখো তোমার ‘লেবু খেলে জ্বর কমে’ কেমন আছে। তারপর হাসে। দীপ্ত হাসে না। হাসি আসে না। দীপ্তর মনে তখন সেই চাঁদপুর। চাঁদপুরের জ্বরের দিনগুলি। রোয়াকে দাঁড়িয়ে থাকা দুই বেণি দোলানো কিশোরীর ছবি। হাসপাতাল রোডের একাকী দুপুর। যেখানে শিপ্রা প্রথম বলেছিল, ‘লেবু খেলে জ্বর কমে।’
শিপ্রা আবার হাসে, বসো। তোমার চকির ওপরই বসতে হবে। আর কোনো জায়গা নেই। কী ভাবছো? এটা আমি কোথায় এসে পড়লাম?
– না না। তোর ছেলে কোথায়? দীপ্ত চকির ওপরই বসে।
– আমার ছেলে? ও গেছে টিউশনি করতে। ক্লাস এইটে পড়ে। ওয়ান-টুয়ের কয়েকটা বাচ্চা পড়ায়। বস্তি তো, টাকা-পয়সা ঠিকঠাকমতো দিতে পারে না। আমি ওই সামনে গুলের কারখানার পাঁচ-ছয়জন ছেলের রান্না করে দিই। তাতে কিছু টাকা আসে। চলে যায়।
– চুপ কর শিপ্রা। আমি কি এসব জানতে চাইছি? দীপ্ত মনে মনে ভাবে, শিপ্রা কি তার সহানুভূতি চাইছে?
শিপ্রা জোরে হেসে ওঠে, তোমার কাছে আর আমার লাজলজ্জা কীসের?
দীপ্ত একটু অপ্রতিভ বোধ করে, অভাব মানুষের সব ধ্বংস করে দেয়।
শিপ্রা বলে, বসো। তোমার জন্য ফল কেটে আনছি।
– রাখ, এসবের দরকার নেই।
– তাহলে একবারে ভাত দিই?
দীপ্ত আঁতকে ওঠে, আরে না না।
– কেন? কারখানার ছেলেদের জন্য বেশি করেই রাঁধি। আমরা মা-ছেলে খেয়েও রাতের জন্য থেকে যায়। কী ছোটলোক বলে খাবে না? শিপ্রা আবার হেসে ওঠে।
দীপ্তর মনে হয় আজ শিপ্রা ওকে হাসতে হাসতে কুচিকুচি করে কাটার প্ল্যান করছে। দীপ্ত এবার ধমক দেয়, এদিকে আয় কথা বলি। খাওয়া পরে হবে।
– আসছি।
একটু পরই প্লেটে তারই আনা ফল কেটে নিয়ে আসে শিপ্রা। এক হাতে প্লেট আরেক হাতে একটা প্লাস্টিকের জগ। বলে, নাও হাতটা ধুয়ে নাও।
ফলের প্লেটটা চকির ওপর রাখে। দীপ্ত শিপ্রার হাত থেকে জগটা নিয়ে বাইরের দাওয়া থেকে হাত ধুয়ে আসে। তারপর আবার চকির ওপর বসে। এমন সময় একজন খ্যাংড়া কাঠি চেহারার লোক আসে। পায়ের জুতো আর গায়ের জামা দেখে আন্দাজ করে লোকটা নেহায়েত গরিবগুরবো নয়। এসেই শিপ্রাকে ডাক দেয়, শিপ্রা এই যে কটা আম এনেছি। রাখো। মিঠুনকে দিও।
শিপ্রা বাইরে বেরিয়ে এসে আমের একটা পোঁটলা লোকটার কাছ থেকে নেয়। লোকটাকে বলে, আমার এক দাদা এসেছে। লোকটা একবার দীপ্তর দিকে তাকিয়ে চলে যায়। শিপ্রা এসে আবার চকির ওপর দীপ্তর মুখোমুখি বসে। দীপ্তর এবার খুব ইচ্ছা হয় শিপ্রাকে একটা কষে চুমু দেয়। আজীবনের একটা ইচ্ছা পূরণ করে নেয়। কিন্তু শিপ্রা এরই মধ্যে বলে, এটা কে জানো? আমার দেবরের বন্ধু। মোটামুটি পয়সা আছে। আমাকে খুব সাহায্য করে। মিঠুনের স্কুলের বেতন জমলে দেয়। অসুখে-বিসুখে দেখে।
– দেবরের বন্ধু!
– হু। আর কিছু জানতে চাও?
– নাহ ।
– আমি বলি, তোমার কাছে আমার কিসের লাজলজ্জা? জানতে চাও না লোকটা এমনি এমনি উপকার করে কি না? নাহ, এই দুনিয়ায় কেউ স্বার্থ ছাড়া কিছু করে না। মিঠুন যখন স্কুলে থাকে তখন এই লোকটা আমার ঘরে আসে। দীপ্তর মনে হয় এবার সত্যিই শিপ্রা তাকে স্বজ্ঞানে খুন করে ফেললো। শিপ্রা মাথা নিচু করে আছে। তার চোখ দিয়ে নহরের মতো জল বেরিয়ে এসে চকির ময়লা তোষকটার উপর পড়তে থাকে। দীপ্ত বজ্রাহতের মতো বসে থাকে। একটু পর সামলে শিপ্রা বলে, খাও।
দীপ্ত ধাক্কাটা সামলানোর জন্য বসেই থাকে। শিপ্রা এবার চোখ মুছে বলে, খুব ঘিন্না হচ্ছে তাই না?
দীপ্ত মাথা নাড়ে, না না। এটার জন্য তুই দায়ী না। আমি তোকে মোটেই দোষ দিচ্ছি না।
শেষ পর্যন্ত দীপ্ত শিপ্রার বাসায় অন্যের জন্য রান্না করা ভাতও না খেয়ে পারলো না। অনেক কথা হলো। ওর বোনেদের কথা। বাবার কথা। মায়ের মৃত্যুর কথা। তার দুর্দশার কথা। তারপর একসময় দীপ্ত বললো, তোকে আমি কিছু টাকা দিয়ে যাই? খুব বেশি নেই সঙ্গে, ধর হাজার পাঁচেক।
– কেন ? এই যে আমি তোমাকে সময় দিলাম বলে? ওই লোকটাও দেয়। সে অবশ্য শুধু কথা বলে না।
দীপ্ত এবার ধমকের সুরে বলে, চুপ কর।
শিপ্রা বলে, টাকা লাগবে না। আমার অভাব তো একদিনের নয়। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। তুমি আমাকে দেখতে এসেছো, আমার আর কী চাই? এটা আমার বাকি জীবন মনে থাকবে। আর কিন্তু আসবে না।
– কেন? দেখতে মন চাইলে?
– না। আমি বলছি আর আসবে না। তুমি অনেক ভালো মানুষ, কেন এই নরকে আসবে? আসবে না। আর আসবে না। বউদি-ছেলেকে নিয়ে ভালো থাকো। আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। এখনো ভালোবাসি। আমি চাই তুমি ভালো থাকো।
– আচ্ছা দেখি।
– কোনো দেখাদেখি নেই। আবার এলে ওই লোকটাকে আমি ডেকে আনবো। তোমার সামনে কিন্তু লোকটার সঙ্গে …
দীপ্ত অবাক চোখে শিপ্রার দিকে তাকিয়ে থাকে। শিপ্রা দীপ্তর হাত ধরে বলে, তোমার কাছে আমার লজ্জা কীসের? সবই তো বললাম। আমার অনুরোধ, আর এসো না এখানে।
দীপ্ত চুপ করে থাকে। শিপ্রা একটু হেসে বলে, লেবু খেয়ো, লেবু খেলে জ্বর কমে।
দীপ্তর আরেকবার ভেতরে ক্ষরণ হয়। এ সাধারণ কথাটা কোনো একদিন এমন দুঃখের ভার বয়ে নিয়ে আসবে, সে কল্পনাও করেনি। দীপ্ত ওঠে।
বস্তির ঘরের দাওয়ায় নেমে দীপ্ত আরেকবার শিপ্রার দিকে তাকায়। দীপ্তর চোখ জল চিকচিক করছে।
– তুমি কাঁদছো কেন? এ দুঃখ তো আমার। আমার কপালে লেখা ছিল … শিপ্রা দীপ্তর দিকে তাকিয়ে বলে।
– আমি কাঁদছি আমার অক্ষমতার জন্য। আমি তো তোর এ দুঃখের ভার নিতে পারলাম না।
এ-কথায় শিপ্রা শুধু হাসে। এমন মলিন হাসি দীপ্ত জীবনেও দেখেনি। তারপর পচা গন্ধওলা প্যাঁচপ্যাঁচে কালো রঙের কাদার গলি পেরিয়ে বাস ধরার জন্য দীপ্ত হাঁটা ধরে বড় রাস্তার দিকে। পেছনে পেছনে শিপ্রা আসতে থাকে। দীপ্ত হঠাৎ ঘুরেই পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব শিপ্রার চিবুকটা ধরে দু-আঙুলে টিপে দেয়। বলে ওঠে, তুই ছিলি আমার মহুয়া বনের পাখি … থাকবি।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.