মাছ ও মনসা

তিলোত্তমা মজুমদার

সেই আমাদের কালচিনির বাড়ি। আকাশে ঘন মেঘ, যেন কোনোদিন আর দেখতেও পাবে না কেউ তার নীল। এত মেঘ কবে সব ঝরে জল হবে? একশ দুশো পাঁচশো বছর? বৃষ্টি চলেছে আজ দশদিন। আকাশে যখন-তখন হিজিবিজি বিদ্যুৎ। ঠিক যেন অতিকায় বান মাছ লম্ফ দিয়ে পার হচ্ছে এক শহর থেকে আরেক শহর। ওরা গ্রাম ভালোবাসে। তাই গাঁয়ের জলে-মাটিতে থাকে। শহর পেরোতে গেলেই উড়ন্ত হয়ে যায়। মাকে এ-কথা বলতেই মা বললেন, ‘এর মাথাডি খারাপ হইছে।’ আমি বলি,
‘বিশ্বাস করো। শহরের বাজারে কীভাবে ওদের রাখে তুমি জানো না। এইটুকু
লোহার গামলি, তাতে পুরো শরীর টান করতে পারে না মাছগুলো। মাথা
নাড়তে গেলে লেজ ঠেকে যায়।’
‘তুমিও তো গামলায় ভইরা রাখসো। কী না জানি পুখুর দিসো অগোরে।’
গামলায় বান মাছেরা খলবলিয়ে ওঠে। সম্ভবত মায়ের বক্তব্যের সমর্থনে। আমার প্রতি অভিযোগ কিংবা আমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও হতে পারে। আমার মন খারাপ হয়ে যায়। কেন অভিযোগ করবে ওরা? আমি তো ওদের ভালোবাসি।
চারিদিকে জল থইথই করছে। কতদিন হলো গোবর দিয়ে আঙিনা নিকোনোর বালাই নেই মায়ের। আঙিনার পশ্চিমদিকে যে উঁচু কংক্রিটের পাঁচিল ছিল, তা আর দেখছি না। এমনকি পাঁচিলের পর আমাদের সবজি বাগান ছাড়িয়ে ছোট গলি আর গলি পেরিয়েই মিলিদিদিদের বাড়ির প্রাচীর, সেও কংক্রিটের, এই বর্ষায় সেও একাকার। আমাদের মতো ওদেরও পাঁচিলটা, এমনকি রান্নাঘরটা পর্যন্ত বর্ষার জলে চিনির দানার মতো গলে গেছে। কেউ বিশ্বাস করবে না। বলবে, কংক্রিট কি মাটি, যে গলবে? যুক্তিসহ প্রশ্ন। কিন্তু চোখের সামনে দেখছি এই ছিল, এই নেই। উবে যাওয়া কিংবা গলে যাওয়াই একমাত্র সম্ভব।
পাঁচিলের জাযগায়, উঠোনের জায়গায়, বাগানের জায়গায় এখন বর্ষার জমা জল। আম-কাঁঠালের গাছগুলো অতি সিক্ততায় নেতিয়ে পড়েছে। তাদের ডালপালা ঝুঁকে পড়েছে জমা জলের ওপর। মেঘেরই মতো সে-জলের রং। যেন বর্ষার ঘন কালো মেঘ জলে গুলে দিয়েছে কেউ। বাতাসের অভিঘাতে কাঁঠালপাতাগুলো উলটেপালটে প্রদর্শন করছে তাদের পিঠ। কী অদ্ভুত সাদাটে। কিংবা, একটু পরিণত পাতায় হালকা ইটের রং। পাতার ওপরকার সবুজ মসৃণতা পিছনে একটুও নেই। ঘন কালো মেঘের প্রেক্ষাপটে এই সাদাটে ভাব, আরো স্পষ্ট।
পাতার সম্মুখের সত্যের সঙ্গে পশ্চাতের সত্যের এতখানি তফাৎ দেখে হাত-পা হিম হয়ে আসে আমার। এমন আতঙ্ক, যার কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
পথে-ঘাটে কোনো কোনো মানুষের চোখ দেখলে আমার এমন হয়। সেই সব চোখে জীবিত বান মাছের দৃষ্টি নেই।
আমি বারান্দার কিনারে দাঁড়িয়ে আছি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। পাশে মা। সেই কাঠের জলচৌকির ওপর বসে আছেন। পিঁড়ির থেকে অল্প উঁচু, মেঝেয় জল থাকলেও এতে বসা যায়। জলের চৌকিদারি করে বলেই জলচৌকি কিনা কে জানে। আবার শোয়ার ব্যবস্থা যে কাষ্ঠাসনে, তারও নাম চৌকি। তার সঙ্গে চৌকিদারির সম্পর্ক নেই সম্ভবত। চতুষ্পদ বলেও চৌকি হতে পারে।
ভাষা স্পষ্টভাবে বোঝাতে সক্ষম, স্পষ্টভাবে বোঝাতে অসমর্থ। এই বৈপরীত্য ভাষার শক্তি, না দুর্বলতা, আমি জানি না।
গামলায় বান মাছ খলবল করে। লেজের ঝপাটে জল ছিটকে লাগে জলচৌকিতে। এতে বসতেন আমার ঠাকুরদাদা। এতে বসেই হাত-মুখ প্রক্ষালন করতেন। সামনের আঙিনায় গম ধুয়ে রোদ্দুরে শুকোতে দিয়েছেন মা, জলচৌকিতে বসে হাতের লাঠি উঁচিয়ে কাক তাড়াচ্ছেন ঠাকুরদাদা। স্নানের সময় হলেই গোসল নিমিত্ত মা তাঁর পায়ের কাছে এনে রাখতেন লাল রঙের লাইফবয় সাবানের টুকরো আর সর্ষের তেল। সারাবছর।
ভাত খাওয়ানো, পায়ে তেল মালিশ করে দেওয়া, মলমূত্র ধৌত করার যাবতীয় সেবাযত্ন ঠাকুরদাদার মা-ই করতেন। বাবা নন। অথচ ঠাকুরদাদা আমার বাবারই পিতা। আর এইসব সেবাযত্নের কারণে লোকে, কেন জানি না, আমার বাবারই প্রশংসা করত। বলত সুপুত্তুর। বলত, বাপের কী যত্নই না করে।
সেসব আগেকার কথা। এখন ঠাকুরদাদার জলচৌকিতে মা বসে আছেন। একটানা বিলাপ করছেন তাঁর সন্তানদের নিয়ে। প্রথম থেকে ধরেছেন। বিচার-বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, তাঁর কোনো সন্তানই তেমনটি হয়নি, যেমন তাঁর ইচ্ছা ছিল। আমার পালা এখনো আসেনি। মায়ের অন্য সন্তানেরা এখানে অনুপস্থিত। তারা কেউ এমনকি আমার মতো বান মাছ ভালোবাসে না। মা কি আমার সামনেই আমার সমালোচনা করবেন?
ওহো! আমার সমালোচনা ভালো লাগে না। একজনেরই মধ্যেকার ভালো ও মন্দ কী আশ্চর্য বিপরীত। আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি কাঁঠালপাতার সম্মুখ ও পশ্চাতের ভিন্নসত্য দর্শনের মতোই।
মায়ের বিলাপের থেকে অন্যমনস্ক হতে আমি আকাশের দিকে দেখছিলাম। কোথাও কোনো বর্ষার গান বাজছিল না। কেবল বারান্দায় রাখা প্লাস্টিকের গামলায় মাছের খলবলানি। মাছের ভাষা, মাছের গান, মাছের আর্তনাদ – প্রকৃতপক্ষে ওই খলবলানির অর্থ কী বোঝার জন্য আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে মাছের দিকে নিয়ে যাচ্ছি – আর আঙিনায় দৃষ্টি পড়ল। কী বিরাট! কী আশ্চর্য! আঙিনার জলে তার দীর্ঘ পেশল রুপোলি শরীর। দুলছে। ফুলছে। ফেনা তুলছে। আঙিনার দৈর্ঘ্য তার পক্ষে অকুলান হওয়ায় নিজের শরীরকে সে ভাঁজ করে আটিয়ে নিয়েছে এমন – যেন এক অচেনা আজব। আমি চিৎকার করি – মা! ওটা কী?
মা পাত্তাই দিলেন না। বিলাপে বাধা পড়ায় বড়ই বিরক্ত। বলেন, ‘মাছ ভাইসা আইছে। জলে জলে সাগর হইছে। নদী-নালা একাকার।’
মাছ! অত বড়! অমন শরীর ভাঁজ করতে পারা? পুস্তকে আর মাছে কোনো তফাৎ থাকবে না? আমি ফের চেঁচাই – মাছ নয় মা! দেখো!
ঠিক তখনই সে মাথা তোলে। বিশাল মাথা চৌকো বরফি। চোয়ালের দুপাশে কালো সরলরেখা। দুই চোখ লাল। পাইথনের জাত, নাকি অ্যানাকোন্ডা? সিনেমায় দেখেছিলাম। না না। নিজেকে একটু পালটে-পুলটে সেই হুমদোই হয়তো, যে আমাকে খেতে চেয়েছিল, আমি রাজি না হওয়ায় আমাকে জ্বালাতন করত রাতদিন! হাতের কড়ে আঙুলটা অন্তত দাও। বলত সে। অতঃপর, হতাশার থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হওয়ায় ইদানীং চোঙা ফোঁকাই তার কাজ।
অকস্মাৎ সেই জীব তার ধড় প্রলম্বিত করে। আরো আরো। ফণা নেই। শূন্যে দোদুল্যমান তার শরীর ঝাঁপ দেয় মাছের গামলায়। চোখ বিস্ফারিত করে দেখি – এই বুঝি খেয়ে ফেলল মাছগুলি। ও আমার সাধের বান মাছ!
না। খেল না সে। খাবার চেষ্টাই করল না। শুধু গালে গাল ঘষে দিলো। চুমু খেল। সুদীর্ঘ আঠালো জিভ দিয়ে চেটে দিচ্ছে গা আর প্রত্যেকবার লেহনের পর ভুসভুস ধোঁয়া উঠছে, যাতে, আমি জানি, কার্বাইড মেশানো।
আমার কাশি পেল। কাশতে কাশতে বুক চেপে ধরলাম। মা আমার হাত ধরে টান দিলেন – পালা! আমাগোরে খাইব।
ঘরবাড়ি ফেলে পালাচ্ছি। সদর খোলা। প্রিয় জিনিসগুলি অরক্ষিত। একটু একটু করে জমানো সম্পদ আত্মসাৎ করে নিচ্ছে আজব জানোয়ার। শুধু প্রাণ হাতে করে পালাচ্ছি। কিন্তু কতদূর যাব? নিজের ঘর ফেলে, বাড়ি ফেলে, উঠোন আর উনুনের অঙ্গারগুলি ফেলে সহজে কি যাওয়া যায়?
মা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমায় তিরস্কার করেন – ‘কতবার তরে কইছি বাইম মাছ খাইস না। মাছ নাকি? ও হইল গিয়া সাপ। দ্যাখস না কেমুন গাও পাকায়? অর টানেই সাপডা আইছে। দ্যাখ কমুন চুমা খায়।’
‘মা, বান মাছ খেতে আমি ভালোবাসি। যদি তা মাছ না হয়, সাপ হয়, তবু ভালোবাসি। ওদের একটাকে টুকরো টুকরো করে কাটো। পেঁয়াজ রসুন দিয়ে রাঁধো ওকে। সবক’টার পেটে ডিম আছে। বড় বড় টুকরো করে গরগরে রাঁধো, মা।’
‘হ! ডিমাল বাইমরে খাইবা না আমার মাথা খাও। তর বাইমের লালচ আমারে ঘরছাড়া করল। আমার সংসার গেল। দ্যাখ, ঘরে ঢুইকা পড়সে। যা। বাইমগুলারে ছাইড়া দিয়ায়। অগোরে লইয়া যাক!’
‘ছেড়ে দেব? বান মাছ সব ছেড়ে দেব? আমার প্রিয় খাদ্য! আমার অধিকার! আমার একান্ত নিজস্ব গামলা ও মাছ!’
‘কইতাসি বাইম মাছ সাপের জাইত। কেমুন চুমা খাইল। জাইতভাইরে লইতে আইছে।’
‘কোনো হানাদার রবাহুত হয়ে আমার বাড়িতে ঢুকে পড়বে, ঘরবাড়ির দখল নিয়ে নেবে জাতভাইকে চুমু খাবার উছিলায়, আর আমি আমার সব স্বত্ব, সব অধিকার ছেড়ে দেবো? কিছুতেই না মা।’
‘আগে বাইচা থাক। প্রাণডারে রাখলে সব হইব আবার।’
‘বিনা যুদ্ধে ছেড়ে দেব মা? সব?’
‘তরা কেউ আমার কথা শুনিস না।’
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পাংশু হয়ে যাচ্ছেন মা। আমার কষ্ট হয়। বলি – না হয় আমি বান মাছগুলো ছেড়ে দিলাম মা। কিন্তু ও কি সত্যি আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে? আমার সন্দেহ হয়।
মায়ের চোখ দিয়ে জল পড়ে। মা জানেন, হানাদারেরা শর্ত মানে না, যুক্তি মানে না, ঔচিত্য পরিহার করে। যাকে জাতভাই বলে চুমু খায়, তাকেও নাশ করে।
বাইরে থেকে দেখতে পাচ্ছি, সাপটা এখন আমাদের শোয়ার ঘরে। বিষাক্ত তীর তাক করছে আমাদের দিকে। ঘরছাড়া করেও হয়নি। বাড়ির ত্রিসীমানায় থাকতে দেবে না। এইবার হত্যা করবে। সে হাঁ করে। হাঁ মুখে অতল অন্ধকার।
মাকে বলি, ‘গীতামাসির বাড়ি চলে যাও মা। আমি লাঠি আনতে যাচ্ছি।’
‘কুনখানে যাইবা?’
‘হেঁতালের ডাল আর মনসার আশীর্বাদ।’
‘সাপের রক্তে অাঁইশটা গন্ধ। যাইতে চায় না।’
‘আমি তোমাকে চার বোতল ফিনাইল আর ছ-বোতল ডেটল এনে দেব মা।’
‘মারামারির দরকার কী? খেদাইয়া দে।’
‘এরপরও?’
‘হেন্তাল পাইলে আর মনসারে ডাকলে তর শক্তি বাইরা যাইব। তহন ক্ষমাই পরম ধর্ম।’
‘আমাদের অধিকার?’
তুমুল বৃষ্টি নামল। মা দ্রুত ঢুকে গেলেন গীতামাসির বাড়ি। আমি চিৎকার করলাম – ‘মা!’
এক ডজন ফিনাইল। দু’ডজন ডেটল। ওডিকোলন এক বাক্স!
মা ফিরে দেখলেন একবার। ক্ষমা দেখল ক্ষমাহীনতার দিকে।
মা বললেন, ‘ডাক দিও।’
আমরা দু’জনেই জানি, অধিকার হরণ কিংবা অধিকার রক্ষা – কারণ যা-ই হোক, কোনো হত্যার গন্ধই যায় না। লেগে থাকে। কটু, অাঁশটে, নাছোড় লেগে থাকে দেয়ালে, মেঝেতে, গায়ে, পায়ে, হাতে আর মাথায়।