মাজহারুল ইসলাম : চলে যাবার পর

সৈয়দ শামসুল হক

সংগীতের মতো গগন-অভিমুখী নয়, না কাব্যের মতো হৃদয়গামী, নৃত্যের মতো চক্ষু-অভিসারী; স্থাপত্য সেই এক সৃজন যার ভিত্তি অনিবার্যভাবে মাটিতেই প্রোথিত; – এবং একমাত্র এই এক শিল্প, বাস্তবে যার ভেতরেই আমরা বাস করি। এমতো এই সৃজন-মাধ্যমের অসাধারণ এক কল্পহাত, বাংলার পোড়া ইটের নন্দন-আবিষ্কারক, খোলা আকাশকে ভবনের জন্যে প্রকৃত উপরি-আচ্ছাদন করে তোলার শিল্প-বিধাতা, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম আজ এই মর্ত ছেড়ে দিব্যলোকে।
তাঁর পদচিহ্ন এখন নীলিমায় অংকিত হচ্ছে; সেখানে শ্রাবণ-বর্ষার মেঘদল কী অসীম গম্ভীরতায় অবিরাম সৌধ গড়ছে, অস্থির তারা বাংলার জননিবাসের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে; মেঘলোকের ওই সৌধকীর্তি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে তিনি ছিলেন; মেঘ বৃষ্টি বর্ষণ করছে, যেন তার সৌধসকল গলে গলে পড়ছে; আমরাও অশ্র“পাত করছি; আমি তাঁর স্বাক্ষর-সৃষ্টি চারুকলা বিদ্যাপীঠের ভবন সমুখে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছি।
মেঘদলের ওই গম্ভীরতা আমি অনুভব করতাম তাঁর সাক্ষাতে। সহাস্য হতে তাঁকে খুব কমই দেখেছি, যাঁরা দেখেছেন তাঁদের মতো সৌভাগ্যবান আমি নই। দীর্ঘদেহী, বাঙালির গড় উচ্চতা তাঁর নয় – কি দেহে কি কাজে; গৌর এবং সুপুরুষ, বীর্যবান এবং স্বল্পভাষী – বাঙালির পক্ষে সাধারণ শ্যামকান্তির মিশেল অবয়ব তাঁর নয়, বাঙালির কথাপ্রবণতা ও উচ্ছ্বাসও তাঁর জন্যে নয়; এমনকি মিষ্টভাষীও তিনি নন – যতবার তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি – মাত্রই কয়েকবার, – যেন ঈষৎ অসহিষ্ণু মতামত প্রকাশে, কিন্তু পর্যবেক্ষণে নিপুণ, সিদ্ধান্তে মৌলিক, উচ্চারণে বেতোয়াক্কা – এই-ই আমি তাঁকে পেয়েছি। মন আর মুখমধ্যে আড় তাঁর ছিলো না; রাজনীতিতে যে কিছুকালের জন্যে ভিড়েছিলেন, এ-দেশে একজন রাজনীতিকের পক্ষে জরুরি ওই আড় তাঁর ছিল না বলেই অনুমান করি, এ-ভূমিকায় তিনি অগৃহীতই থেকে যান এবং নীরবে একদা সরে দাঁড়ান।
আমার প্রথম যৌবনে – গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের সেই প্রথমার্ধ – যখন চারদিকে আপসকামিতা, মতিচ্ছন্নতা, উদভ্রান্তি আর লক্ষ্যহীনতা, নৈরাজ্য কেবল রাজনীতিতেই নয়, শিল্পেও; কেবল তারই মধ্যে মাত্রই কয়েকজন নিঃসঙ্গ দাঁড় টেনে চলেছেন বাংলার ধমনী-নদীতে – বিশেষ করে সাহিত্যে, চিত্রকলায়, সংগীতে – তাঁদের ভেতরে স্থাপত্যে একমাত্র তিনিই – মাজহারুল ইসলাম; – এমন মানুষ চোখে না পড়ে পারে? খুব কাছে যেতে ইচ্ছা করতো, যেন তাঁর কাছে গেলেই কোনো না কোনোভাবে সমৃদ্ধ হবো – ব্যক্তিগতভাবে যেমন হতাম ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, আবদুল আহাদ, শওকত ওসমান, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, মুনীর চৌধুরী, আবুল হোসেনের সান্নিধ্যে; হয়েছিও মাজহারুল ইসলামের উপস্থিতি সন্নিধানে – যতটা না কাছে গিয়ে, তার অনেক অধিক তাঁর কাজের সাক্ষাতে এবং তাঁর কাজের ভেতরে প্রবেশ করে – হয়তো সাধারণের জন্যে কোনো ভবনে, যেমন ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিংবা পারিবারিক বাসভবনে, যেমন শিল্পপ্রেমিক আবুল খায়ের লিটুর গুলশানের বাড়িতে।
লিটুর বাড়িতে বাহির আর ভেতর কখন কোথায় মিলিয়ে গেছে, এক হয়ে গেছে কোঠা ও অঙ্গন, দেয়াল ও নীলিমা, দৃষ্টি পাচ্ছে স্বচ্ছতার নির্বিঘœ আরাম, মন বলছে কোঠাবন্দি নই, আদিম মানুষের মতো খোলা নীল ও অপার সবুজের ভেতরেই তো! প্রথম যেদিন লিটুর বাড়িতে যাই – বিস্ময়ে আপ্লুত হয়ে যাই। একেই কি বলে বাড়ি! চার দেয়ালের বন্দিশালা এ তো নয়! এ যে মুক্তির আমন্ত্রণে আহ্বান করছে।
দেয়াল থেকে ভবনকে মুক্ত করা – আক্ষরিক অর্থে নয়, অনুভবের দিক থেকে – এটাই মাজহারুল ইসলামের সকল স্থাপত্য-কল্পনার চাবি বলে আমি দেখতে পাই। দেখতে পেয়েছি লিটুর বাড়িরও অনেক আগে – সেই কবে, প্রথম যেদিন ঢাকার চারুকলা বিদ্যাপীঠের সম্পূর্ণ অবয়বের সমুখে দাঁড়াই এবং ভেতরে প্রবেশ করি; ভেতরেও নয়, ওই যে এক হয়ে যাওয়া ভেতর ও বাহির, আমি যেন নতুন এক মাত্রার ভেতরে নিজেকে আবিষ্কার করি। সেই পথ ও প্রাঙ্গণের এক হয়ে যাওয়া, সেই নীলিমা ও আচ্ছাদনের ভেতরে বিভিন্নতা রহিত হয়ে যাওয়া! – সবিশেষ থমকে দাঁড়াই এই বিদ্যাপীঠের সমুখের গোলঘরের পাশেই সিঁড়িটিকে দেখে। সিঁড়ি, সে তো চিরকালের পার্শ্বকামী – ছাদ-আচ্ছাদিত, প্রায় অন্ধকার এবং প্রয়োজনেরই মাত্র। কিন্তু এ কী! এ যে আচ্ছাদনহীন, উন্মুক্ত, নিরাবলম্ব প্রায়, যেনবা ওপাশের গাছটির মতোই প্রকৃতির সৃজন এ-সিঁড়ি। এই প্রথম আমি – সম্ভবত আমরা তখনকার সকলেই এই প্রথম – আবিষ্কার করে উঠি এক মৌলিক স্থাপত্যশিল্পীকে, যিনি তাঁর ডিজাইন বোর্ডে সূর্যের আলো আর আকাশের মুক্তিকে ইট-সিমেন্টে বাঁধনের মতো প্রতিভা ধরেন।
বাঁধন শব্দটি অগত্যা ব্যবহার করেছি; আসলে মুক্তিই। মুক্তি! রবীন্দ্রনাথের সেই গানটির কথা মনে পড়ে :
আমায় মুক্তি যদি দাও বাঁধন খুলে
আমি তোমার বাঁধন নেব তুলে।
– এ যেন বাংলার আকাশ ও আলোরই গেয় গান, গাইছিলো কতকাল, কিন্তু মাজহারুল ইসলামের মতো এমন তাৎপর্য পূরিত নিবিড় স্বরে সে-গান আর কেউ কখনো শোনেনি। ওই চারুকলা বিদ্যাপীঠের স্থাপনাটিকে আমি মাজহারুল ইসলামের স্বাক্ষর-কাজ বলে জানি ও এরই ভাবমণ্ডলে ফেলে আমি তাঁর সকল কাজ দেখি। এমনকি যে-কাজটি তিনি নিজে করেননি, তাঁরই করবার কথা ছিল – আমাদের সংসদ ভবন, যার নির্মাণ-সৃজনের আমন্ত্রণ পেয়েও বরাতটি তিনি তুলে দেন লুই কানের হাতে, ডেকে আনেন মার্কিন মুলুক থেকে; – এই সংসদ ভবনের কাজটিতেও আমি গোয়েন্দা-শনাক্ত করতে পারি যে, মাজহারুল ইসলামের কল্পনা-প্রতিভা নিশ্চয়ই লুই কানকে উদ্দীপ্ত করেছে ও পথসংকেত দিয়েছে।
সংসদ ভবনটিকে আকাশ থেকে পাখির চোখে কখনো আমরা দেখেছি কি? – অন্তত আলোকচিত্রে। যদি দেখে থাকি, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের চোখে পড়বে চারদিকে জলবিস্তারের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি; মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর সমতল থেকে যে-ভবনটিকে ভূমিস্থির দেখি, আকাশ থেকে যখন দেখি তখন আমাদের কী অনুভব হয়? – ভবনটি ভাসছে! – যেন বাংলার প্রতি বছরের সেই বাস্তবতা, প্লাবিত দেশ, আমাদের মনোজগতের মধুর-বিধুর জলছলছল একটি ছবি, জনজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে নানা বাস্তবতা ও প্রতীকতায় ওই জলরাশি, আর তার ভেতরেই যেন সংসদ ভবন নয়, আমাদেরই গণতন্ত্রচর্চার মহান একটি কুটির, আকাশের মেঘ ধূসরতা গায়ে মেখে ভেসে আছে। বাংলার জনপদে কুটির ও দালানবাড়ির এহেন জলনিমগ্নতা, আমি নিশ্চিত মার্কিন মুলুকের লুই কানের মতো স্থপতি, তা তিনি বিশ্বের বিশ শতকের দশজন শ্রেষ্ঠ স্থপতির একজনই হোন না কেন, তাঁর পক্ষে বাংলার ওই বন্যা সমাগমের সনাতন চিত্রের ভেতরে সংসদ ভবনটিকে কল্পনা করা কখনই সম্ভব হতো না, যদি না মাজহারুল ইসলামের মতো বাংলাকে অন্তর দিয়ে, ইতিহাস দিয়ে, কল্পদৃষ্টি দিয়ে দেখা একজন বাঙালির পরামর্শ ও প্রবর্তনা থাকতো।
বাংলাকে কাব্যিকরঞ্জনে নয়, তার সকল বাস্তবতায় – ইতিহাসের ও প্রকৃতির – করোটিতে রেখেছিলেন মাজহারুল ইসলাম। বাংলার আকাশ ও রৌদ্রের সম্পাতকে তিনি স্থাপত্যে ঠাঁই দিয়েছেন, তেরোশো নদী ও বাৎসরিক বন্যা-প্লাবিত বাংলাদেশকে তিনি ইট ও সিমেন্টের সৃজনে ঠাঁই দিয়েছেন। বাংলার উদার দিগন্তবিস্তৃত সবুজকে তিনি হত্যা করেননি মূঢ় ও প্রস্তুরীভূত অট্টালিকা তুলে, বরং সেই বিস্তারকে তিনি তাঁর নির্মাণের আবশ্যিক উপাদান করে তুলেছেন।
প্রকৃতির প্রতি মাজহারুল ইসলামের এই দৃষ্টি, এবং আরো গভীরে, তাঁর ইতিহাসচেতনা তাঁকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছে; – এই ইতিহাস রাজনীতির হয়েও বা হয়েই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর স্থাপত্যরচনায়। আমরা একের পর এক বাংলার ঐতিহ্যবিমুখ ঔপনিবেশিক শক্তির নিগড়ে বাঁধা থেকেছি কয়েক শতাব্দী – নিকট কালেই প্রথমে ব্রিটিশ, তারপর পাকিস্তানের। আমাদের কি চোখে পড়বে না? – মাজহারুল ইসলামের চোখে পড়েছে – ঔপনিবেশিক আমলের ভবনগুলোর স্থাপত্য আসলেই কী ছিল; ছিল, ঘন পুরু দেয়াল, সংকীর্ণ জানালা, প্রকৃতিবিরুদ্ধ জমাট রক্তের অনুরূপ বর্ণালেপ, ভারগ্রস্ত সব নিরেট অট্টালিকার পর অট্টালিকা – যেন কারাগারই আসলে!
তাকিয়ে দেখি সেকালের যে-কোনো রেলস্টেশন, ডাকঘর, ডাকবাংলো, কর্মচারীদের বাসস্থান-সারি কি আদালত ভবনের দিকে; মানুষকে চারদিক থেকে বন্দি করবার, তাকে শ্বাসরুদ্ধকর কুঠুরিতে আবদ্ধ করবার এমতো নির্মাণ আর কোথাও দেখতে পাবো না। ব্রিটিশ রাজত্বকালে পূর্ত বিভাগের উদ্ভাবিত এই নকশা উত্তরাধিকারসূত্রে পায় পাকিস্তানিরা এবং তারাও বাংলাদেশে তাদের পূর্ত বিভাগে ম্যাকোনেল সাহেবের মতো ইংরেজকে প্রধান পদে বহাল রাখে; শুধু ইংরেজ বহাল রাখাই নয়, সেইসঙ্গে একদা ইংরেজের কারাগারতুল্য স্থাপনা রচনাও অব্যাহত থাকে; উপাদান ও সময়-বাস্তবতার কারণে সেসব ভবন হয়তো ইংরেজের আমলের মতো দর্শনধারী হয় না, অন্তর্গত রূপে কারাগারই থেকে যায়।
মাজহারুল ইসলাম এ থেকে মুক্ত করে আনেন স্থাপত্যকে – সেই পাকিস্তানি নব্য ঔপনিবেশিক কালেই; দেয়ালকে তিনি ব্যবহার করেন নির্মাণের ঊর্ধ্বভর-সহনেরই জন্যে কেবল, জানালাকে প্রশস্ত করেন রৌদ্রের অবাধ উদার সম্পাতসম্ভব করতে, বহিরাঙ্গনকে তিনি আমন্ত্রণ জানান স্থাপনার অভ্যন্তরে; আমরা মুক্তির নিঃশ্বাস অনুভব করি – এই প্রথম, এত শতাব্দীর কারাগারে বাস করে ওঠার পর। সেই বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকেই বাঙালি গ্রথিত হচ্ছিল মুক্তির আকাক্সক্ষায়, অগ্রসর হচ্ছিল স্বাধীনতার দিকে, আর, সেই আকাক্সক্ষার অমৃত প্রসারিত করতলে তখন ধারণ করছিলেন আমাদেরই কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গায়ক এবং স্থপতিদের মধ্যে প্রথম ও তখন একমাত্র মাজহারুল ইসলামই। তিনি বাঙালির সেই মুক্তিকামিতার অনুবাদ করেছেন তাঁর ডিজাইন বোর্ডে, রচনা করেছেন তাঁর স্থাপত্য সৃজনে। আমাদের স্থাপত্যকলায় মাজহারুল ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান এইটিই – মুক্তির সুবাতাস।
সেই ঔপনিবেশিককালেই করা মাজহারুল ইসলামের কাজগুলোর সমুখে দাঁড়িয়ে আজ দেখতে পাই তিনি মুক্তিকে কীভাবেই না সঞ্চারিত করেছিলেন আমাদের ভেতরে; রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি, যা তখন বলে উঠতে পারিনি বা এমন স্পষ্ট করে অনুভব করতে পারিনি :
আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির  গান।
আজ বাঙালি স্বাধীন ও সার্বভৌম; মুক্তির এই সুবাতাসে শ্বাস গ্রহণ যখন করছি, ইচ্ছা করছে মধুসূদনের প্রয়াণের পর বঙ্কিমচন্দ্র যা বলেছিলেন, আজ ঈষৎ পরিবর্তিত করে বলি : সুপবন বহিতেছে দেখিয়া পতাকা উড়াইয়া দাও, তাহাতে নাম লিখো মাজহারুল ইসলাম।
তাঁর প্রিয় একটি উপাদান ছিল মাটি পোড়া ইট; মাটি পুড়িয়েই তো পোড়া মাটির পাটাচিত্র – বাঙালির নিজস্ব এক চিত্রকলা, সেই পালযুগ থেকে। আজ যখন মাজহারুল ইসলাম পৌঁছে গেছেন দিব্যলোকে – আর, আমাদের স্মৃতিলোকে – বাংলার নিসর্গলোকে – নতুন প্রজন্মের স্থপতিদের ডিজাইন বোর্ডে, আজ যখনই আমি পোড়া মাটির ইট দেখছি মাজহারুল ইসলামকৃত ভবনগুলোর প্রলেপবর্জিত দেয়ালের পর দেয়ালে, আমি তাঁর মুখ দেখে উঠছি – ওই তো তিনি! – স্থাপত্যে মাজহার-যুগের পাটাচিত্রে এখন তিনি অমর অংকিত॥