মানবিক বঙ্গবন্ধুর গণমুখী উন্নয়ন ভাবনার উৎস সন্ধানে

আগস্ট এলেই আমরা আমাদের অস্তিত্বের প্রতীক বঙ্গবন্ধুকে নানা আঙ্গিকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করি।এ-বছর আমরা তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করবো। সেই মহাযজ্ঞের প্রস্তুতি হিসেবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে এরই মধ্যে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস, তাঁর বহুমাত্রিক চিন্তা-চেতনার উৎসভূমি নানাদিক থেকেই খোঁজার চেষ্টা করা হবে এই সময়টায়। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা খোঁজার চেষ্টা করবো তাঁর সাধারণের পক্ষে দাঁড়ানোর উৎসসমূহকে। আমরা জানি তিনি সেই ছোটবেলা থেকেই সাধারণের কল্যাণচিন্তায় ও কর্মে নিবেদিত ছিলেন। তাই তাঁর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনের মূলমন্ত্রই ছিল এদেশের গরিব-দুঃখী মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তি কী করে নিশ্চিত করা যায়। একেবারে ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে দেশ পরিচালকের আসনে বসেও তিনি এদেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণকেই তাঁর উন্নয়নচিন্তায় অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ১৯৩৬ সাল। বয়স তাঁর মাত্র ষোলো। মাদারীপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর স্বদেশি আন্দোলনের একজন কর্মী হতে সচেষ্ট।

ইংরেজকে বিদায় করে স্বাধীনতা আনার স্বপ্ন দেখতেন। চোখের অসুখের কারণে লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে।১৯৩৭ সালে বাবার কর্মস্থল গোপালগঞ্জে মিশন স্কুলে ভর্তি হন। সে-বয়সেই তিনি তাঁর শিক্ষক কাজী আব্দুল হামিদের নেতৃত্বে গড়ে তোলেন ‘মুসলিম সেবা সমিতি’। উদ্দেশ্য গরিব ছাত্রদের সেবা করা।সেজন্যে আশেপাশের বাড়ি থেকে মুষ্টিভিক্ষার চাল ওঠাতেন। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। আমাকেই অনেক কাজ করতে হতো তাঁর সাথে। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তখন আমি এই সেবা সমিতির ভার নেই এবং অনেক দিন পরিচালনা করি। আর একজন মুসলমান মাস্টার সাহেবের কাছেই টাকা পয়সা জমা রাখা হত। তিনি সভাপতি ছিলেন আর আমি ছিলাম সম্পাদক।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ৯) ১৯৩৮ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে এসেছিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মিশন স্কুল পরিদর্শন করেন। সেখানেই তাঁদের আগমন উপলক্ষে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতা বালক শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁর সাংগঠনিক সামর্থ্য দেখে মুগ্ধ সোহরাওয়ার্দী তাঁকে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। ১৯৩৯ সালে কলকাতায় তাঁদের দেখা হলো। এভাবেই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। হলেন গোপালগঞ্জ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক। লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতি করতে থাকেন তিনি। ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ফের গেলেন কলকাতায়। সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়লো। ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হলেন। স্থানীয় মুসলিম লীগ সংগঠনেও তিনি বড় ভূমিকা রাখলেন। ১৯৪৩ সালে শুরু হলো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। লাখ লাখ লোক মারা যায়। সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে তিনি দুর্ভিক্ষকবলিত মানুষকে বাঁচানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলো লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। … দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোন দিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোন দিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম।’ এভাবেই তিনি মানুষের দুঃখদুর্দশা খুব কাছে থেকে দেখেছেন। গোপালগঞ্জেও দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য নানা সাংগঠনিক উদ্যোগ নেন। এই সময়টায় তিনি জমিদারদের অন্যায়-অত্যাচার স্বচক্ষে দেখে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। আর সে-কারণেই বিকল্প ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পক্ষে ছিলেন তিনি।

এরপর মুসলিম লীগ রাজনীতির নানা উত্থান-পতন তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন। দাঙ্গাপীড়িত মানুষদের বাঁচানোর জন্যে তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে সুদূর আসানসোল গিয়ে ত্রাণশিবির খুলেছিলেন।এর আগে ১৯৪৬ সালে সিলেট গণভোটে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হলো। তিনি ফিরে এলেন পূর্ব বাংলায়। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আইন বিভাগে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গড়লেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। শুরু করলেন ছাত্ররাজনীতি। আর অংশগ্রহণ করলেন ভাষা-আন্দোলনে। ছাত্রলীগ গঠন করার পর ব্যাপক সাড়া পেলেন। পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাঁর এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পছন্দ করতো না। সর্বক্ষণ গোয়েন্দা লাগিয়ে রাখতো। সেই গোয়েন্দারাই যেসব প্রতিবেদন সরকারকে পাঠিয়েছেন সেগুলো থেকে বোঝা যায় যে, তিনি গণমানুষের স্বার্থকে কতটা গুরুত্ব দিতেন। এসব প্রতিবেদন নিয়ে ইতোমধ্যে দুই খণ্ড বই প্রকাশিত হয়েছে। আরো প্রকাশিত হবে। ভাষা-আন্দোলন ছাড়াও তিনি সাধারণ মানুষের জীবনমান সমস্যা এবং খাদ্য সংকট নিয়ে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন। সরকার তখন কর্ডন প্রথা চালু করেছিল। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কোনো খাদ্য যেতে পারবে না। তিনি লিখেছেন, ‘ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার লোক, খুলনা ও বরিশালে ধান কাটবার মরশুমে দল বেঁধে দিনমজুরি হিসেবে যেত। এরা ধান কেটে ঘরে উঠিয়ে দিত। পরিবর্তে একটা অংশ পেত। এদের ‘দাওয়াল’ বলা হতো। হাজার হাজার লোক নৌকা করে যেত। আসবার সময় তাদের অংশের ধান নিজেদের নৌকা করে বাড়ি নিয়ে আসত। এমনিভাবে কুমিল্লা জেলার দাওয়ালরা সিলেট জেলায় যেত। এরা প্রায় সকলেই গরিব ও দিনমজুর। প্রায় দুই মাসের জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে এদের যেতে হত। যাবার বেলায় মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সংসার খরচের জন্য দিয়ে যেত। ফিরে এসে ধার শোধ করত। দাওয়ালদের নৌকা খুবই কম ছিল। যাদের কাছ থেকে নৌকা নিত, তাদেরকেও একটা অংশ দিতে হত। যখন এবার দাওয়ালরা ধান কাটতে গেল কেউ তাদের বাঁধা দিল না। এরা না গেলে আবার জমির ধান তুলবার উপায় ছিল না। … যখন এরা দুই মাস পর্যন্ত ধান কেটে তাদের বুভুক্ষু মা-বোন-স্ত্রী ও সন্তানদের খাওয়ার জন্য, যারা পথ চেয়ে আছে, আর কোন মতে ধার করে সংসার চালাচ্ছে – কখন তাদের স্বামী, ভাই, বাবা ফিরে আসবে ধান নিয়ে, পেট ভরে কিছু দিন ভাত খাবে, এই আশায় – তখন নৌকায় রওয়ানা করার সাথে সাথে তাদের পথ রোধ করা হল। … শেষ পর্যন্ত সমস্ত ধান নামিয়ে রেখে লোকগুলোকে ছেড়ে দেয়া হল। এ খবর পেয়ে আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হল না। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করলাম।’ (ওই, পৃ ১০৩-১০৪)। এই প্রতিবাদ তীব্র হওয়ার পর সরকার সিদ্ধান্ত নিলেন ধান কাটতে দাওয়ালরা যেতে পারবেন। তবে ধান তাদের নিজ বাড়িতে আনতে পারবেন না। স্থানীয় গোডাউনে রেখে রসিদ নেবেন। সেই রসিদের ভিত্তিতে নিজ এলাকার গোডাউনে গিয়ে অধিকাংশ দাওয়ালই ধান পাননি। ফরিদপুরের দাওয়ালরা সরকারি হুকুম না মেনে নৌকা নিয়ে নিজ বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর লঞ্চ নিয়ে পুলিশ বাহিনী তাদের ধাওয়া করে ধরে ফেলে। ধান নামিয়ে নেওয়া হয়। সেই ধান বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। সরকারি গুদামে যায়নি। ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু দাওয়ালদের নিয়ে শোভাযাত্রা করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে গিয়ে দেনদরবার করেন। গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর এ-ধরনের প্রতিবাদের বিবরণ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, ১৯৪৮ সালের ৪ এপ্রিল ফরিদপুরের এস. এন. একাডেমিতে অনুষ্ঠিত জনসভায় বস্ত্র, খাদ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকটের কথা তিনি বলেছেন। অনুরূপভাবে ১৯৪৮ সালের ১ জুন অনুষ্ঠিত নরসিংদীর ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি দাবি করেন। একই সঙ্গে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করারও দাবি জানান।তাছাড়া তিনি গরিব মানুষের করের টাকায় প্রশাসনের উচ্চসারির কর্মকর্তা, মন্ত্রী, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারিদের উচ্চ বেতনের সমালোচনা করেন। খুলনায় একই বছর ১৩ ডিসেম্বর এক সভায় শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর দাবি করেন। ১৯৪৭ সালের ১৩ জুলাই অন্য আরেকটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে একটি লিফলেটের উদ্ধৃতি দিয়ে শেখ মুজিবকে ‘অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের’ পুরোধা বলে বর্ণনা করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলনের মূলে ছিল গরিব মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করা।

পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জিতে মন্ত্রী হিসেবেও তিনি পূর্ব বাংলার কৃষক, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরপর ওই মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়। তিনি ১৯৫৬ সালে শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে পূর্ব বাংলার উদ্যোক্তা শ্রেণির জন্যে বেশকিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ নেন। যেমন : প্রাদেশিক সরকারের হাতে আমদানি লাইসেন্স ইস্যু করার ক্ষমতা হস্তান্তর, প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক পাট, তুলা ও তৈরি পোশাকের মতো শিল্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ, পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) আমদানি-রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের একটি কার্যালয় এবং সাপ্লাই অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের মহাপরিচালকের একটি কার্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অন্তত ৫০ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) জন্য বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি তোলেন তিনি। জাতীয় চা বোর্ডের সভাপতি হিসেবেও তিনি চা-শিল্পের উন্নয়নে ইতিবাচক উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবনা অনুসারে ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি থেকে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ এদেশীয় কর্তৃপক্ষের হাতে আসার কথা। এসব অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্রটি ভালোভাবে বুঝতে পারেন। তাই তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, পনেরোশো মাইল ভৌগোলিক দূরত্বে অবস্থিত দুই অঞ্চলের জন্য ‘দুই অর্থনীতি’ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। পূর্ব বাংলায় জনসংখ্যার আধিক্য, কর্মসংস্থানের অভাব, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে শ্রমিকের আসা-যাওয়া প্রায় অসম্ভবের মতো কারণগুলোই এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূলে বলে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান। এর পাশাপাশি পূর্ব বাংলার অর্থনীতিবিদরাও ‘দুই অর্থনীতি’র ধারণাকে তথ্য ও যুক্তি দিয়ে সমর্থন জানান। সেই ধারণার আলোকেই বৈষম্যের মাত্রা বোঝার জন্য বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক কমিশন স্থাপনের দাবি জানান। তাঁর প্রস্তাবনা অনুসারে একটি অর্থনৈতিক কমিশন গঠন করাও হয়েছিল। ওই কমিশনে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাঙালি অর্থনীতিবিদরা কাজ করেন এবং বঙ্গবন্ধু যে-বৈষম্যের কথা এতদিন বলে আসছিলেন তারই প্রতিধ্বনি করেন। কিন্তু এই কমিশনের প্রতিবেদন দ্রুতই হিমাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং তা আর আলোর মুখ দেখেনি।

এরপর সামরিক শাসন জারি হলো। বঙ্গবন্ধু চলে গেলেন জেলে। জেল থেকে বের হয়ে এই অর্থনীতিবিদ ও কিছু সরকারি কর্মকর্তার সহায়তা নিয়ে তিনি তৈরি করলেন ‘ছয় দফা’। দুই অর্থনীতির ধারণাকে রাজনৈতিক গতি দেওয়ার জন্যই তিনি এই ছয় দফা আন্দোলনকে বেগবান করেছিলেন। দুই অঞ্চলে স্ব-স্ব উদ্যোগে শিল্পায়ন, মুদ্রানীতি, বৈদেশিক মুদ্রানীতি, সুদের হার নীতিসহ এমন কিছু দাবি এই ছয় দফায় যুক্ত করেছিলেন তিনি, যা কার্যত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবির পর্যায়েই পড়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি অভিজনরা তাঁর এই আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করে এবং তাঁকে জেলে আটকে রাখে। একপর্যায়ে দেশদ্রোহের মামলাও দেয় তাঁর বিরুদ্ধে। গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা ঊনসত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁকে মুক্ত করে। মুক্ত হয়েই তিনি দল গোছাতে শুরু করেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাঁর দল নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়। এটা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের তিনিই একমাত্র বৈধ মুখপাত্র। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের এলিটরা তাঁর নেতৃত্ব মানতে রাজি ছিলেন না। তাই এমন বিপুল বিজয় সত্ত্বেও তিনি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হন। ৭ মার্চ ডাক দেন মুক্তির। এরপর শুরু হয় গণহত্যা। ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তাঁকে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁর নেতৃত্বেই চলে মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে নতুন দেশের পরিচালনার দায়িত্ব নেন। শুরু হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির নয়া সংগ্রাম।

এদেশের কৃষক, শ্রমিক, নিম্নমধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের জন্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। তাই তারা ভাবেন, এদেশটি আরো কত আগেই না অন্তর্ভুক্তি উন্নয়নের স্বাদ পেত, যদি না বঙ্গবন্ধুকে হঠাৎ এমন করে চলে যেতে না হতো। যদিও তাঁর সুকন্যা পরবর্তী পর্বে এসে গরিব-দুঃখীর দুঃখ মোচনের নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, তবু মাঝখানে অনেকগুলো বছর হারিয়ে গেছে জাতির জীবন থেকে। আর ওই সময়ে গরিব-বিদ্বেষী যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সেসব পরিবর্তন করে স্বদেশকে ফের বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে ফিরিয়ে আনা মোটেও সহজ ছিল না। এখনো রয়ে গেছে অনেক চ্যালেঞ্জ। সব আবর্জনা দূর করে সমৃদ্ধির পথে স্বদেশকে এগিয়ে নেওয়া মোটেও সহজ নয়। আর দ্রুত বেড়ে ওঠা অতিধনীদের কারসাজি এড়িয়ে সাধারণের কল্যাণে নিবেদিত থাকাও বেশ কষ্টসাধ্য। এমনি এক বাস্তবতায় আমরা স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি-কৌশলকে। স্পষ্টতই বঙ্গবন্ধুর প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল এদেশের গরিব-দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা। এ-কারণে আমরা দেখতে পাই সেই ছোট্টবেলা থেকেই এবং পরবর্তীকালে তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে এটি প্রতিধ্বনিত হয়েছে।যেখানে গিয়েছেন সেখানেই উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন মানুষের উন্নয়নের কথা। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের মাঝে বরাবরই প্রস্ফুটিত হয়েছে এটি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার পান এদেশের সাধারণ জনগণ। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের মুখে হাসি ফোটাতে এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে তিনি বিরাট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। উন্নয়ন দর্শনে তিনি প্রথমেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে উদ্যোগী হন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন, সংবিধান প্রণয়ন, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) পুনর্গঠন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্যে প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, মদ, জুয়া, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধকরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড পুনর্গঠন, নতুন ১১ হাজার প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ মোট ৪০ হাজার প্রাথমিক স্কুল সরকারিকরণ, দুস্থ মহিলাদের কল্যাণে নারী পুনর্বাসন ব্যবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফসহ প্রায় ৩০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ, কৃষকদের মাঝে দেড় লাখ গাভি ও ৪০ হাজার সেচপাম্প বিতরণ এবং ব্যাপক কৃষি উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়ার জন্যে ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার’ প্রবর্তন করেন। এছাড়া বিনা/ স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক-বীমার ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও সেসব চালুর মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান, সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বন্ধ শিল্পকারখানা চালুসহ একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

স্বল্পসময়ের মধ্যে বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সাফল্য। স্বাধীনতালাভের এক বছরের মধ্যেই দেশ পুনর্গঠনে বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ, পুরো দেশবাসীকে এ-কাজে উজ্জীবিতকরণ এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর নেওয়া পদক্ষেপসমূহ আশাতীত সাফল্য অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল ব্যবস্থার উন্নয়ন, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার পুনর্গঠন, দক্ষ পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন, উত্তর-দক্ষিণ শীতল রাজনৈতিক মেরুকরণে দেশকে ‘জোটনিরপেক্ষ – সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বৈরিতা নয়’ নীতিতে প্রতিষ্ঠিত করা, পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়ন, আদমশুমারি ইত্যাদি কর্মপ্রয়াসে বঙ্গবন্ধু উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন স্বদেশকে। তাঁর শোষণহীন সমাজ গঠনের স্বপ্নের জমিনের বড় অংশ জুড়েই ছিল বাংলাদেশের কৃষক। সারা বাংলাদেশের হৃদয়কে এক করার নিরলস প্রচেষ্টায় তিনি কৃষকদের চাওয়া-পাওয়াকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। গরিবহিতৈষী বঙ্গবন্ধু সেজন্যেই স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কৃষকদের দিকে নজর দেন। তিনি সবসময় বলতেন, ‘আমার দেশের কৃষকেরা সবচাইতে নির্যাতিত।’

কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্যে তিনি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। উন্নত বীজ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কৃষক-শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। পঞ্চাশের দশকে তাঁকে দেখেছি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে কৃষকের পক্ষে কথা বলতে, ষাটের দশকে দেখেছি ছয় দফা আন্দোলনে তাদের স্বার্থসংরক্ষণে সোচ্চার হতে। আর স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দেখেছি সর্বক্ষণ কৃষক-অন্তঃপ্রাণ বঙ্গবন্ধুকে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ২৮ অক্টোবর ১৯৭০-এর ভাষণেও এদেশের কৃষক-সমাজের অধিকার সংরক্ষণের কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করানোর পর বঙ্গবন্ধু যে-ভাষণ দেন তাতে কৃষকদের জন্যে অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দল ক্ষমতায় যাওয়ার সাথে সাথেই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেবে। আর দশ বছর পর বাংলাদেশের কাউকেই জমির খাজনা দিতে হবে না।’

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে যে-সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো – ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি-অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, কৃষি-যন্ত্রপাতি সরবরাহ – জরুরিভিত্তিতে বিনামূল্যে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে অধিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্যে ধানবীজ, পাটবীজ ও গমবীজ সরবরাহ করা হয়। দখলদার পাকিস্তানি শাসনকালে রুজু করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি দেওয়া হয় ও তাঁদের সকল বকেয়া ঋণ সুদসহ মাফ করে দেওয়া হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে রহিত করা হয়। ধান, পাট, তামাক, আখসহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে ন্যূনতম ন্যায্যমূল্য বেঁধে দেওয়া হয়। গরিব কৃষকদের বাঁচানোর স্বার্থে সুবিধাজনক নিম্নমূল্যের রেশন-সুবিধা তাদের আয়ত্তে নিয়ে আসা হয়। বঙ্গবন্ধু-প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সামাজিক ন্যায়বিচার ও দারিদ্র্য নিবারণের তাগিদে কৃষি-উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের পর্যায়ে আনা হয়। ওই সময় দেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ছিল ৩৫ শতাংশ। বিরাজমান খাসজমির সঙ্গে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণযোগ্য জমির সরবরাহ বৃদ্ধির জন্যে বঙ্গবন্ধু পরিবারপিছু জমির সিলিং ১০০ বিঘা নির্ধারণ করে দেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্যস্বাধীন দেশের খাদ্যঘাটতি ছিল প্রাথমিক হিসাবে ৩০ লাখ টন। তাৎক্ষণিক আমদানির মাধ্যমে এবং স্বল্পমেয়াদে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি-উপকরণ সরবরাহ করে এবং কৃষিঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টনের ফর্মুলা নির্ধারণে অত্যন্ত জোরদার উদ্যোগ নেন। এর ফলে ভাটির দেশ হিসেবে গঙ্গার পানির ৪৪ হাজার কিউসেক হিস্যা পাওয়ার সম্মতি তিনি আদায় করেন।১৯৬৮-৬৯ সালে ১১ হাজার শক্তিচালিত পাম্পের স্থলে ১৯৭৪-৭৫ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজারে। এর ফলে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ লক্ষ একরে উন্নীত হয়। বাংলার কৃষককে সারে ভর্তুকি দিয়ে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধু। গঙ্গার প্রবাহ থেকে অধিক পানিপ্রাপ্তি, সেচ ব্যবস্থার প্রসার, উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত খাসজমিপ্রাপ্তি এবং মূল্য সমর্থনমূলক সচেতন ও কৃষকদরদি নীতির ফলে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির যে-ধারা সূচিত হয়েছিল তারই ফলে আজ কৃষিক্ষেত্রে শক্তিশালী ধারা বজায় রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই ধারাকে আরো বেগবান করেছেন।

কৃষি ও কৃষকের উন্নতি, বিশেষ করে অধিক ফসল উৎপাদন, সেই সঙ্গে উৎপাদিত কৃষিপণ্য কৃষকরা যাতে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে পারেন সেদিকে বঙ্গবন্ধুর সুদৃষ্টি ছিল। সদ্যস্বাধীন দেশে কৃষি-উৎপাদনের প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির সরবরাহ খুব বেশি না থাকলেও এগুলোর প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন। কৃষিকাজের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সেচ, সার, বীজ ইত্যাদি ব্যবহারে কৃষকদের নিজেদের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাতে বলতেন। জেলা-গভর্নরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন কৃষি ও কৃষকদের প্রতি নজর দেওয়ার জন্যে। তিনি বিশ্বাস করতেন, কৃষিই যেহেতু এদেশের জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস, সেহেতু কৃষির উন্নতিই হবে দেশের উন্নতি।

’৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবসে বেতার টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী। পুরাতন সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। অবাস্তব তাত্ত্বিকতা নয়, আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের বাস্তব প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পুরাতন সামাজিক কাঠামোকে ভেঙ্গে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে। শোষণ ও অবিচারমুক্ত নতুন সমাজ আমরা গড়ে তুলব। এবং জাতির এই মহাক্রান্তিলগ্নে সম্পদের সামাজিকীকরণের পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচির শুভ সূচনা হিসেবে আমার সরকার উল্লিখিত বিষয়গুলো জাতীয়করণ করেছে।

১. ব্যাংকসমূহ (বিদেশী ব্যাংকের শাখাগুলো বাদে), ২. সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানিসহ (বিদেশী বীমা কোম্পানির শাখাসমূহ বাদে), ৩. সকল পাটকল, ৪. সকল বস্ত্র সুতাকল, ৪. সকল চিনিকল, ৫. অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌ-যানের বৃহদংশ, ৬. ১৫ লক্ষ টাকা মূল্যের তদূর্ধ্ব সকল পরিত্যক্ত ও অনুপস্থিত মালিকানাভুক্ত সম্পত্তি, ৭. বাংলাদেশ বিমান ও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে সরকারি সংস্থা হিসাবে স্থাপন করা হয়েছে এবং ৮. সমগ্র বহির্বাণিজ্য রাষ্ট্রীয়করণের লক্ষ্য নিয়ে সাময়িকভাবে বহির্বাণিজ্যের বৃহদংশকে এই মুহূর্তে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।’

ওইদিন তিনি আরো বলেন, ‘সম্পদের বণ্টনব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে। এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতম উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ করছিল, সেটা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্যে আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি। আজ আমরা বিশ্ব সভ্যতার এক ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত। একটি নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্নে আমরা বিভোর, একটি সামাজিক বিপ্লব সফল করার প্রতিশ্রুতিতে আমরা অটল, আমাদের সমস্ত নীতি – আমাদের সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টা এ কাজে নিয়োজিত হবে। আমাদের দুস্তর পথ। এ পথ আমাদের অতিক্রম করতেই হবে।’

তবে শুরুতে রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্পায়নের ভিত্তি সুদৃঢ় করলেও ধীরে ধীরে তিনি ব্যক্তিখাতের বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির দিকে মনোযোগী হন। তাই ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. এ. আর. মল্লিক উল্লেখ করেন যে, ‘পুঁজি বিনিয়োগে বেসরকারি উদ্যোক্তাদিগকে যথাযথ ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য এবং বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিকল্পে, সরকার চলতি অর্থবৎসরের শুরুতে বেসরকারী পুঁজি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ২৫ লক্ষ হইতে ৩ কোটি টাকায় উন্নীত করেন এবং বেসরকারী খাতে কয়েকটি নতুন শিল্প গড়িয়া তোলার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে।’ (বাজেট বক্তৃতা, ১৯৭৫-৭৬, পৃ ৫)। তাছাড়া ১৩৩টি পরিত্যক্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়, ৮২টি ব্যক্তিমালিকানায় ও ৫১টি কর্মচারী সমবায়ের কাছে বিক্রি করা হয়।এভাবে তাঁর জীবদ্দশাতেই শিল্পায়নকে ‘ডিরেগুলেট’ করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই প্রক্রিয়া বেগবান হয়। ধীরে ধীরে ব্যক্তিখাত শিল্পায়নের মূল চালিকাশক্তিতে আবির্ভূত হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত ব্যক্তিখাতনির্ভর হলেও তাকে সহায়তার জন্যে জ্বালানিসহ মেগা অবকাঠামো খাত সরকারি বিনিয়োগেই গড়ে উঠেছে। সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ ঘিরেই দেশে উল্লেখ করার মতো প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হচ্ছে। সর্বশেষ অর্থবছরে আমরা ৮.১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি।চলতি অর্থবছরে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ৮.২০ শতাংশ। শুধু প্রবৃদ্ধি নয়, এদেশের বঞ্চিতজনদের জন্য ব্যাপক অংকের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। অতিদরিদ্রের হার আগামী কয়েক বছরেই কমিয়ে পাঁচ শতাংশের আশেপাশে আনার ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সবার জন্য পেনশন কর্মসূচি চালু করার পরিকল্পনাও তাঁর রয়েছে। প্রবাসী কর্মীদের সবাইকে জীবন বীমার আওতায় আনার তোড়জোড় চলছে। মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে গরিব-দুঃখী সবাই এখন ব্যাংকিং লেনদেন করতে পারছেন। ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে স্বস্তি। বড় বড় অবকাঠামোর উন্নয়নের ফলে জনজীবনে আরো স্বস্তির সুযোগ বাড়বে বলে আশা করা যায়।মধ্যবিত্তের জীবন চলা এখনো বেশ চাপের মুখেই রয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রেখে সবার জন্য গুণমানের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ আরো বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে সেজন্যে চাই সার্বিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। রাজনৈতিক ও সামাজিক শান্তি বজায় রাখা গেলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জয়যাত্রা নিশ্চয় অব্যাহত রাখা যাবে। আর তাহলেই বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবেন।

লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।