মার্কেজের সাক্ষাৎকার

ভূমিকা ও অনুবাদ : আন্দালিব রাশদী 

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য নতুন করে নির্মাণ করেছেন – এই বক্তব্য মানতে রাজি নন চিলির কথাসাহিত্যিক ইসাবেল আয়েন্দে। তিনি মনে করেন, মার্কেজের হাতে সমকালীন বিশ্বসাহিত্য পুনর্নির্মিত হয়েছে। মার্কেজের অনেক অনুবাদকের একজন এডিথ গ্রসম্যান বলেন, ‘তিনি যা লিখেছেন তার সবই সোনা।’

বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য যাঁদের হাত ধরে জেগে উঠেছে তাঁদের অন্যতম প্রধান পাবলো নেরুদা, হোর্হে লুই বোর্হেস, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, মারিও বার্গাস য়োসা এবং কার্লোস ফুয়েন্তেস। কবিতায় এক অনতিক্রম্য উচ্চতায় পাবলো নেরুদার অবস্থান; নিজস্ব সাহিত্য ভাবনা ও শৈলীতে গোটা সাহিত্যবিশ্বকে প্লাবিত করে রেখেছেন মার্কেজ; অনতিক্রম্য তিনিও তবে তাঁর অনুগত পাঠকসংখ্যা আর সকলকে ছাড়িয়ে।

কিউবার ঔপন্যাসিক আলেয়ো কার্পেন্তিয়ার ১৯৪৯ সালে যে ম্যাজিক রিয়ালিজমের কথা বলেন, তা প্রতিষ্ঠিত করেন এবং জাদু ও বস্ত্তর সমীকরণে উদ্ভূত নতুন ঢেউ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে দেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ।

মার্কেজ সাহিত্যকর্মের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন – এই সত্যটি অন্তত মার্কেজের জন্য তেমন গুরুত্ব বহন করে না, পুরস্কার তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেনি, মার্কেজকে পুরস্কৃত করতে পেরে সুইডিশ অ্যাকাডেমি সম্মানিত হয়েছে।

কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল স্যানতোজ মার্কেজের শতবর্ষের নির্জনতার রেশ ধরে বলেছেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কলম্বিয়ান মার্কেজের মৃত্যু দিয়ে গেল হাজার বছরের নৈঃসঙ্গ্য এবং বিষণ্ণতা।

ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক আয়ান ম্যাকউইন বলেছেন, মার্কেজের মতো একজন লেখক পেতে হলে ডিকেন্স পর্যন্ত ফিরে পেতে হবে – বিশাল জনগোষ্ঠীকে শাসন করার মতো অসাধারণ ক্ষমতা আর কারো নেই।

ইসাবেল আয়েন্দে মার্কেজের লেখায় খুঁজে পেয়েছেন তাঁর স্বদেশ, তাঁর মহাদেশ, তাঁর মানুষ এবং মানুষের ছন্দ।

পিটার এইচ স্টোনের নেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি ১৯৮১-র শীত সংখ্যা প্যারিস রিভিউতে প্রকাশিত হয়েছে। মেক্সিকো সিটির সান অ্যাঞ্জেল ইনে সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়।

পিটার : টেপ রেকর্ডার ব্যবহার করলে আপনি কেমন বোধ করবেন?

মার্কেজ : সমস্যা হলো, যখনই জানবেন সাক্ষাৎকার রেকর্ড করা হচ্ছে তখনই ভাবভঙ্গি বদলে যাবে। আমার বেলায় আমি সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিরক্ষামূলক মনোভাব দাঁড় করিয়ে দিই। সাংবাদিক হিসেবে সাক্ষাৎকারের সময় টেপ রেকর্ডারের ব্যবহার এখনো আমরা শিখিনি বলে আমার ধারণা। আমি মনে করি, সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে কোনো ধরনের নোট না নিয়ে দীর্ঘ কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া। তারপর কথোপকথনের স্মৃতি থেকে এটাকে লিখে ফেলা, হুবহু একইরকম শব্দে প্রকাশ করতে হবে এমন নয় – যে-ধারণার সৃষ্টি হয়েছে তা প্রকাশ করা। আরেকটি উপকারি পদ্ধতি হচ্ছে নোট নেওয়া আর সাক্ষাৎকারদাতার প্রতি অনুগত থেকে এর ব্যাখ্যা করা। যা আপনাকে ফাঁসিয়ে দেবে তা হচ্ছে যন্ত্রটি সাক্ষাৎকারদাতার প্রতি অনুগত নয়, আপনি যখন সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে বোকামি করে ফেলবেন টেপ রেকর্ডার তাও ধারণ করে ফেলবে। সেজন্যে যখন টেপ রেকর্ডার থাকে আমি সচেতন হয়ে যাই যে, আমার সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে; আর যখন যন্ত্রটি থাকে না আমি অবচেতনে এবং সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে কথা বলে যাই।

পিটার : আপনার কথায় কিছুটা অপরাধী বোধ করছি, তবে এ-ধরনের সাক্ষাৎকারে রেকর্ড করার প্রয়োজন সম্ভবত রয়েছে।

মার্কেজ : যাকগে আমি যা বলেছি তার উদ্দেশ্য আপনাকে প্রতিরক্ষার দিকে ঠেলে দেওয়া।

পিটার : সাক্ষাৎকার নিতে আপনি কখনো টেপ রেকর্ডার ব্যবহার করেননি?

মার্কেজ : সাংবাদিক হিসেবে আমি কখনো ব্যবহার করিনি। আমার খুব চমৎকার একটি টেপ রেকর্ডার আছে, এটা কেবল গান শুনতে ব্যবহার করি। তবে সাংবাদিক হিসেবে আমি কখনো সাক্ষাৎকার নিইনি। আমি রিপোর্ট করেছি, প্রশ্ন আর উত্তরের সাক্ষাৎকার কখনো নয়।

পিটার : জাহাজডুবিতে বেঁচে যাওয়া একজন নাবিকের সঙ্গে আপনার একটি বিখ্যাত সাক্ষাৎকারের কথা শুনেছি।

মার্কেজ : এটা প্রশ্ন আর উত্তর নয়। নাবিক আমাকে তার অভিযানের কাহিনি শুনিয়েছে, আমি তার কথা দিয়ে উত্তম পুরুষে লিখে গেছি, যেন নাবিক নিজেই লিখছে। লেখাটি যখন ধারাবাহিকভাবে খবরের কাগজে প্রকাশিত হতে শুরু করল – প্রতিদিন এক পর্ব করে টানা দু-সপ্তাহ, তার নামেই ছাপা হয়েছে, আমার নামে নয়। কুড়ি বছর পর এটি যখন পুনঃপ্রকাশিত হলো লোকজন খুঁজে বের করল আমিই লিখেছি। আমার ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড প্রকাশিত হওয়ার আগে কোনো সম্পাদকই বুঝতে পারেননি লেখাটি ভালো।

পিটার : আমরা যখন সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছি, এত বছর উপন্যাস রচনার পর আবার সাংবাদিক হতে কেমন লাগবে? ভিন্ন অনুভব থেকে কিংবা ভিন্ন দৃষ্টিতে কাজটি করবেন?

মার্কেজ : আমি বরাবরই নিজেকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছি, আমার আসল পেশা হচ্ছে সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতায় আমার যা পছন্দ হয়নি তা হচ্ছে চাকরির শর্তাবলি। তাছাড়া পত্রিকার স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আমার চিন্তা ও পরিকল্পনাকে সাজাতে হতো। একবার ঔপন্যাসিক হিসেবে কাজ করার পর এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের পর আমি এখন আমার কাছে আকর্ষণীয় এবং আমার ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয় বেছে নিতে পারি। যে-কোনোভাবেই হোক একটি মহত্তর সাংবাদিকতার সুযোগ পাওয়া আমি সবসময়ই উপভোগ করব।

পিটার : আপনার কাছে মহৎ সাংবাদিকতার কাজ কোনটি?

মার্কেজ : জন হার্সের হিরোশিমা একটি অসাধারণ কাজ।

পিটার : এখনকার এমন কোনো কাহিনি কি আছে যা নিয়ে কাজ করতে আপনি বিশেষভাবে পছন্দ করবেন?

মার্কেজ : এমন অনেক রয়েছে, অনেকগুলো নিয়ে আমি লিখেছিও। আমি পর্তুগাল, কিউবা, অ্যাঙ্গোলা এবং ভিয়েতনাম নিয়ে লিখেছি। আমি পোল্যান্ড নিয়ে লিখতে চাই। আমার ধারণা এখন সেখানে যা ঘটছে আমি হুবহু বর্ণনা করে যেতে পারব। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা হতো। পোল্যান্ডে এখন প্রচন্ড শীত, কিন্তু আমি যে আরামপ্রিয় সাংবাদিক।

পিটার : আপনি কি মনে করেন উপন্যাস এমন কিছু করতে পারে যা সাংবাদিকতা করতে পারে না?

মার্কেজ : একটুও না, আমি মনে করি একটু পার্থক্যও নেই। উভয়ের উৎস এক, রসদ এক, সম্পদ ও ভাষা এক। ড্যানিয়েল ডেফোর দ্য জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার একটি মহান উপন্যাস আর হিরোশিমা সাংবাদিকতার একটি শ্রেষ্ঠ কাজ।

পিটার : সত্য বনাম কল্পনার ভারসাম্য রক্ষা করতে সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিকের ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব রয়েছে কি?

মার্কেজ : সাংবাদিকতায় একটি ঘটনা যদি মিথ্যে হয় তাহলে তা সমস্ত কাজটিকে প্রভাবিত করবে। পক্ষান্তরে উপন্যাসের একটি একক ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে তা গোটা কাজটিকে বৈধতা প্রদান করবে। পার্থক্য সেখানেই, তার তা লেখকের প্রতিশ্রুতিতে নিহিত। যতক্ষণ মানুষকে বিশ্বাস করিয়ে যেতে পারে একজন ঔপন্যাসিক, ততক্ষণ যা চান লিখে যেতে পারেন।

পিটার : কবছর আগে একটি সাক্ষাৎকারে মনে হয়েছে, আপনি বিস্ময়ের সঙ্গে আপনার পেছনের সাংবাদিক-জীবনের দিকে তাকিয়েছেন – তখন এত দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে পারতেন?

মার্কেজ : উপন্যাসই হোক কি সাংবাদিকতা, আগের মতো লিখে যাওয়া আমার জন্য খুব কষ্টকর। আমি যখন সংবাদপত্রে কাজ করতাম, যা লিখেছি তাতে প্রতিটি শব্দ নিয়ে তেমন সচেতন ছিলাম না, কিন্তু এখন সচেতন। আমি যখন বোগোটায় এল স্পেকতাদর পত্রিকায় কাজ করতাম, আমাকে সপ্তাহে অন্তত তিনটা বড় লেখা দিতে হতো। প্রতিদিন দু-তিনটে সম্পাদকীয় নোট, এছাড়া আমি চলচ্চিত্র-সমালোচনা লিখতাম। রাতে সবাই যখন চলে যেত, আমি রয়ে যেতাম আর উপন্যাস নিয়ে বসতাম। ছাপাখানার লাইনোটাইপ মেশিনের শব্দ আমার ভালো লাগত, বৃষ্টির শব্দের মতো মনে হতো। মেশিন থেমে গেলে আমি নৈঃশব্দ্যের মধ্যে পড়ে থাকতাম, আমি আর কাজ করতে পারতাম না। এখন সে-তুলনায় আমার লেখালেখি অনেক কম। এখন কাজের দিনগুলোতে সকাল নটা থেকে দুপুর দুটো বা তিনটে পর্যন্ত কাজ করে লিখতে পারি বড়জোর চার পাঁচ লাইনের একটি ছোট অনুচ্ছেদ। পরদিন দেখা যায় এটা আবার ছিঁড়ে ফেলছি।

পিটার : এই পরিবর্তন কেন এলো – আপনার লেখা উচ্চপ্রশংসিত সে-কারণে, না কোনো রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি থেকে?

মার্কেজ : দুটো থেকেই। আমার মনে হয়, আমার কল্পনারও বাইরে এমন বিপুলসংখ্যক পাঠকের জন্য লিখছি – এই ধারণা আমার ওপর এক ধরনের সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ববোধের সৃষ্টি করে। এর সঙ্গে অহঙ্কাকারও যোগ হয় – এ-লেখার মান যেন আগের লেখার চেয়ে কমে না যায়।

পিটার : আপনি কেমন করে লিখতে শুরু করেন?

মার্কেজ : অাঁকাঅাঁকি করে। কার্টুন এঁকে। লিখতে বা পড়তে শেখার আগে আমি বাড়িতে ও স্কুলে কমিক অাঁকতে শুরু করি। ব্যাপারটা খুব মজার, যখন হাইস্কুলে পড়ি, লেখক হিসেবে আমার বেশ খ্যাতি ছিল। তখন পর্যন্ত আসলে আমি কিছুই লিখিনি। কোনো প্যামফ্লেটই হোক কিংবা কোনো আবেদনপত্র লেখার দায়িত্ব আমার ওপরই পড়ত। কারণ আমাকে মনে করা হতো লেখক। যখন কলেজে ঢুকি, বন্ধুদের তুলনায় আমার সাহিত্যের ভিত ছিল বেশ শক্ত, সাধারণভাবে আমার সাহিত্যপাঠের প্রেক্ষাপটটি বড়।

বোগোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি নতুন বন্ধু ও পরিচিতের সংখ্যা বাড়াতে শুরু করি, তারাই আমাকে সমকালীন লেখকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। একরাতে আমার এক বন্ধু ফ্রানৎস কাফকার একটি ছোটগল্পের বই পড়তে দেয়। আমি যেখানটায় থাকতাম সেই বোর্ডিং হাউজের কক্ষে ফিরে এসে দ্য মেটামরফসিস পড়তে শুরু করি। প্রথম পঙ্ক্তিটি বলতে গেলে আমাকে বিছানা থেকে ছুড়ে ফেলে। আমি বিস্মিত হই। গল্পের প্রথম পঙ্ক্তি এরকম : ‘সেই সকালে অস্বস্তিকর এক স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে গ্রেগর সামসা নিজেকে আবিষ্কার করল বিছানার ওপর রূপান্তরিত এক অতিকায় কীট হিসেবে।’ যখন এই পঙ্ক্তি পড়ি আমার মনে হলো, কখনো এরকমভাবে লেখার অনুমোদন কেউ পেয়েছে কিনা আমার জানা নেই। যদি জানতাম, তাহলে অনেক আগেই আমি লিখতে শুরু করতাম। আর তখনই আমি ছোটগল্প লিখতে বসে গেলাম। এর সবই পুরোপুরিভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক গল্প, কারণ এগুলো আমার সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। গল্পগুলো বোগোটার এল এসপেকতাদর পত্রিকার সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত হতে থাকে এবং তা এক ধরনের সাফল্যও লাভ করে। কারণ তখনো কেউ কলম্বিয়ায় এ-ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক গল্প লিখতে শুরু করেনি। তখন যা লেখা হতো তার সবই গ্রামীণ ও সামাজিক জীবন নিয়ে। আমার প্রথম দিককার গল্পগুলো প্রকাশিত হতে শুরু করলে, বলা হলো আমার ওপর জয়েসিয়ান প্রভাব বয়েছে।

পিটার : সে সময় আপনি কি জয়েস পড়েছেন?

মার্কেজ : আগে কখনো জয়েস পড়িনি। সুতরাং ইউলিসিস পড়তে শুরু করলাম। আমি প্রথমে কেবল স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত সংস্করণ পড়লাম। তারপর ইংরেজিতে এবং চমৎকার ফরাসি অনুবাদে ইউলিসিস পড়ার পর মনে হলো স্প্যানিশ অনুবাদটি বড্ড বাজে ধরনের। আমার লেখালেখির জন্য চমৎকার একটি কৌশল শিখলাম – অন্তর্গত স্বগতোক্তি। পরে এ-কৌশলটি আমি ভার্জিনিয়া ওলফের লেখায়ও পেয়েছি। তিনি কৌশলটিকে জেমস জয়েসের চেয়েও ভালোভাবে ব্যবহার করতে পেরেছেন। পরে জেনেছি অন্তর্গত স্বগতোক্তি রচনার মূল আবিষ্কারক একজন অজ্ঞাতপরিচয় লেখক, তাঁর বইয়ের নাম Lazarillo de Tormes.

পিটার : প্রথমদিকে আপনাকে প্রভাবিত করেছেন এমন কজনের নাম বলবেন কি?

মার্কেজ : ছোটগল্পের প্রতি আমার যে বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি সেখান থেকে আমাকে যারা বের করে নিয়ে এসেছিলেন, তারা হচ্ছেন আমেরিকার লস্ট জেনারেশনের লেখক। আমি অনুধাবন করি, তাদের সাহিত্যের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক রয়েছে, যা আমার ছোটগল্পে নেই। তারপর এমন একটি ঘটনা ঘটে যা এই মনোভাবের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৯ এপ্রিল ১৯৪৮ এটা ছিল বোগোতাজো, রাজনৈতিক নেতা গেইতান গুলিবিদ্ধ হন এবং মানুষ উন্মত্তের মতো বোগোটার রাস্তায় নেমে আসে। যখন খবরটা আমার কানে আসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ডিং হাউজে আমি দুপুরের খাবারের জন্য তৈরি হচ্ছি। আমি দৌড়ে সেখানে যাই। ততক্ষণে গেইতানকে ট্র্যাক্সিতে তুলে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি যখন বোর্ডিং হাউজে ফিরে আসি, রাস্তায় নামা লোকজন তখন বিক্ষোভ শুরু করেছে, দোকানপাট লুট করছে, ভবনে আগুন দিচ্ছে। আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দিই। সেদিন বিকেল ও সন্ধ্যায় আমার বোধোদয় হয়, কোন ধরনের দেশে আমি বসবাস করছি আর এর মোকাবেলায় আমার ছোটগল্প তুচ্ছ। পরবর্তীকালে যখন আমাকে জোর করে, আমি যেখানে আমার শৈশব কাটিয়েছি, সেই ক্যারিবীয় অঞ্চলের বারানকুইলায় পাঠানো হয়। আমি বুঝতে পারি, এ-জীবনই আমি যাপন করেছি, এ-জীবনই আমার চেনা, আর আমি এ নিয়েই লিখতে চাই।

১৯৫০ বা ১৯৫১-র দিকের আরেকটি ঘটনা আমার সাহিত্যের প্রবণতাকে প্রভাবিত করল। মা বলল, তার সঙ্গে আমাকে আরাকাটাকায় যেতে হবে, সেখানেই আমার জন্ম। আমার জীবনের প্রথম বছরগুলো যে-বাড়িতে কাটিয়েছি সে-বাড়িটি বেচে দিতে হবে। আট বছর বয়স পর্যন্ত এখানেই ছিলাম। এখন আমার বয়স বাইশ বছর। কোনো কিছুরই তেমন পরিবর্তন ঘটেনি; আমার মনে হলো আমি আসলে গ্রামটাকে দেখছি না, যেন এখান থেকে অভিজ্ঞতা নিচ্ছি, যেন আমি গ্রামটাকে পড়তে শুরু করেছি। মনে হলো আমার যা কিছু অভিজ্ঞতা সবই এখানে লিখা হয়ে গেছে আর আমার করণীয় হচ্ছে সেখানে বসে পড়া আর এতক্ষণ যা পড়ছিলাম তা নকল করে তুলে নিয়ে আসা। বস্ত্তত তার সবই উঠে এসেছে সাহিত্যে। সেই বাড়িঘর, সেই মানুষ, সেই স্মৃতি। তখন পর্যন্ত আমি ফকনার পড়েছি কিনা নিশ্চিত নই, তবে ফকনারেরই একটি কৌশল আমাকে দিয়ে আমি যা দেখেছি লিখিয়ে থাকতে পারে। গ্রামের আবহাওয়া ক্ষয় ও উষ্ণতা আমি ফকনারের লেখায় যেমন পেয়েছি, এখানেও একই রকম অনুভব করেছি। এটা কলা চাষের অঞ্চল। ফল কোম্পানির বহু আমেরিকান-অধ্যুষিত এ-জায়গা একই ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যেমনটি আমি পেয়েছি গভীর দক্ষিণাঞ্চলের লেখকদের রচনায়। সমালোচকরা আমার ওপর ফকনারের প্রভাবের কথা বলেছেন, আর আমি এটাকে দেখছি কাকতালীয় ঘটনা হিসেবে। আমি যে-কাঁচামাল পেয়েছি এবং তা নিয়ে যেভাবে এগিয়েছি, একই ধরনের কাঁচামাল পেলে ফকনারও এভাবেই এগোতেন।

সেই গ্রাম সফর সেরে এসে আমি লিখতে বসি আমার প্রথম উপন্যাস লিফ স্টর্ম। আরাকাটাকায় আমার সে-সফর থেকে বোধোদয় হলো, আমার শৈশবে যা কিছু ঘটেছে তার একটি সাহিত্যমূল্য রয়েছে – এতদিনে আমি তা বুঝতে পারছি। সে-মুহূর্তে আমি লিফ স্টর্ম লিখি। আমি বুঝতে পারি যে, আমি লেখক হতে চাচ্ছি। কেউ আমার লেখক হওয়া আটকে রাখতে পারবে না। আমার জন্য একটি পথই খোলা থাকল – পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখক হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। তখন ১৯৫৩ সাল; ১৯৬৭ সালে যখন লেখার জন্য প্রথম রয়্যালটি পাই, ততদিনে আমার আটটি বইয়ের পাঁচটি লিখা হয়ে গেছে।

পিটার : আপনি কি মনে করেন শৈশবের গুরুত্ব ও অভিজ্ঞতা অস্বীকার করে, প্রথমদিকে আপনি যেমন করেছিলেন, বিষয়কে বুদ্ধিবৃত্তিক করে তোলার প্রবণতা তরুণ লেখকদের মধ্যে একটি সাধারণ ব্যাপার?

মার্কেজ : তা নয়, প্রক্রিয়াটি উল্টোভাবে ঘটে; তবে আমাকে যদি কোনো তরুণ লেখককে উৎসাহ দিতে হতো, তার জীবনে যা ঘটেছে তা-ই লিখতে বলতাম। একজন লেখকের জীবনে যা ঘটেছে তিনি তা লিখছেন বা যা পড়েছেন, কিংবা শুনেছেন তা লিখছেন, এটা খুব সহজেই বোঝা যায়। পাবলো নেরুদার কবিতার একটি পঙ্ক্তি – ‘আমি যখন গান গাই, ঈশ্বর আমাকে আবিষ্কার করা থেকে বিরত রাখুন।’ যে-বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে আমোদিত করে, তা হচ্ছে আমি সর্বোচ্চ প্রশংসা পেয়েছি আমার কল্পনানির্ভর কাজে – আবার আমার সমগ্র লেখায় একটি পঙ্ক্তিও নেই যার ভিত্তি বাস্তবতায় প্রোথিত নয়। সমস্যা হচ্ছে, ক্যারিবীয় বাস্তবতাই চরমতম কল্পনা-সদৃশ।

পিটার : এ-সময় আপনি কাদের জন্য লিখছেন? কারা আপনার পাঠক?

মার্কেজ : আমার যেসব বন্ধু-স্বজন আমাকে সাহায্য করেছে, তাদের বই ধার দিয়েছে এবং আমার লেখালেখি নিয়ে যাদের প্রবল উৎসাহ লিফ স্টর্ম তাদের জন্য লেখা। সাধারণভাবে আপনিও কারো না কারো জন্য লেখেন। আমি যখন লিখছি আমিও সচেতন থাকি যে, এই বন্ধু এটা পছন্দ করবে, অন্য বন্ধু ওই অনুচ্ছেদ বা অধ্যায়টি পছন্দ করবে – সবসময়ই সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির কথা ভেবেছি। শেষ পর্যন্ত সব বইই লিখা হয়েছে বন্ধুদের জন্য। কিন্তু ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড লেখার পর আমি এখন আর বলতে পারছি না, লাখ লাখ পাঠকের মধ্যে কার জন্য লিখছি। এটা আমাকে বিচলিত করে এবং দমন করে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন – লাখ লাখ চোখ আপনার দিকে তাকিয়ে আছে, আর তারা কী ভাবছে তা আপনার জানা নেই।

পিটার : আপনার গল্প-উপন্যাসে সাংবাদিকতার প্রভাব কেমন?

মার্কেজ : আমি মনে করি, প্রভাবটা পারস্পরিক। ফিকশন আমাকে সাংবাদিকতায় সাহায্য করেছে – একে সাহিত্যমূল্য দিয়েছে। সাংবাদিকতা ফিকশন রচনায় আমাকে সাহায্য করেছে। কারণ এটাই আমাকে বাস্তবতার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কিত করেছে।

পিটার : লিফ স্টর্ম লেখার পর এবং ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড লেখার আগে আপনার শৈলীর অনুসন্ধানকে কেমন করে বর্ণনা করবেন?

মার্কেজ : লিফ স্টর্ম লেখার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, গ্রাম ও শৈশব নিয়ে লেখালেখি আসলে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে পালিয়ে থাকার নামান্তর। আমার একটি ভ্রান্ত ধারণা ছিল – আমি চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবেলা না করে এ-ধরনের নস্টালজিয়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকছি। আর এ-ব্যাপারটা সে-সময়কার, যখন সাহিত্য ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে দেদার আলোচনা চলছে। আমি এ দুটোর মধ্যে ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করে চলেছি। আমার ওপর প্রভাব ছিল ফকনারের, এখন হেমিংওয়ের। আমি লিখলাম নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল, ইন ইভিল আওয়ার এবং বিগ মামা’স ফিউনারেল – প্রায় সবগুলোই একই সময়ে লিখিত এবং প্রতিটি বইয়েই একই ধরনের কিছু সাধারণ বিষয় রয়েছে। লিফ স্টর্ম এবং ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড যে-গ্রামের প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে, এগুলোর ঘটনা ঘটেছে ভিন্ন গ্রামে। এ-গ্রামে কোনো জাদু নেই। এটি সাংবাদিকতাভিত্তিক সাহিত্য। কিন্তু আমি যখন ইন ইভিল আওয়ার লিখে শেষ করলাম, দেখলাম আমার সব ধারণা আবারো ভুল হয়েছে। আমি তখন আবিষ্কার করলাম আমার শৈশব নিয়ে যা লিখেছি তা-ই বেশি রাজনৈতিক ধরনের; আমার দেশের বাস্তবতার মোকাবেলায় আমি যা ভেবেছি, এ-লেখা তার চেয়ে বেশি কার্যকর। ইভিল আওয়ারের পর পাঁচ বছর আমি কিছুই লিখিনি। আমি কী করতে চাই সে-সম্পর্কে বরাবরই আমার একটা ধারণা ছিল, কিন্তু তাতে একটা কিছুর অভাব ছিল – তা কি আমি করতে পারিনি?  একদিন সে-সঠিক সুরটি আমি আবিষ্কার করি আর সেটিই ব্যবহার করি ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড উপন্যাসে। এই সুরের ভিত্তি ছিল আমার দাদির গল্প বলার শৈলীতে। তিনি এমনসব গল্প বলতেন, যা মনে হতো অতিপ্রাকৃতিক এবং কাল্পনিক; কিন্তু তিনি পুরোপুরি স্বাভাবিকভাবে গল্পগুলো বলে যেতেন। শেষ পর্যন্ত আমি যখন আমার ব্যবহার্য সুরটি আবিষ্কার করে ফেললাম, আমি আঠারো মাস ধরে লিখে চললাম। আমি প্রতিদিন লিখেছি।

পিটার : তিনি কেমন করে ‘ফ্যান্টাস্টিক’কে স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করতেন?

মার্কেজ : সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার মুখমন্ডলে উদ্ভাসিত অভিব্যক্তি। গল্প বলার সময় তিনি তাঁর অভিব্যক্তি একটুও বদলাতেন না। গল্প শুনে সবাই অবাক হতো ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড লেখার প্রাথমিক প্রয়াসে আমি গল্পটাকে নিজে বিশ্বাস না করেই বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি আবিষ্কার করলাম, আমি যে-গল্প বলতে চাই তা আমাকে আগে বিশ্বাস করতে হবে এবং আমার দাদি যেভাবে সে-গল্প বলতেন, সে-অভিব্যক্তি ধরে রেখে আমাকে সেই গল্পগুলো লিখতে হবে : পাথুরে অভিব্যক্তিতে।

পিটার : আপনার সেই কৌশল বা সুরে কিছুটা সাংবাদিকতাধর্মী প্রকাশ রয়েছে। আপাদদৃষ্টিতে ‘ফ্যান্টাস্টিক’ – কল্পকথার এত নিখুঁত বিস্তৃতি প্রদান করেন যে, এগুলোর একটি নিজস্ব বাস্তবতা সৃষ্টি হয়ে যায়। এটা কি আপনি সাংবাদিকতা থেকে আহরণ করেছেন?

মার্কেজ : এটি সাংবাদিকতার একটি চাতুরী যা আপনি সাহিত্যেও প্রয়োগ করতে পারেন। যেমন ধরুন : যদি বলেন, হাতিরা আকাশে উড়ছে, কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু যদি বলেন চারশো পঁচিশটা হাতি আকাশে উড়ছে, তাহলে মানুষ হয়তো আপনাকে বিশ্বাস করবে। ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড এ-ধরনের বহু বর্ণনায় ভরপুর। ঠিক এই কৌশলটিই আমার দাদি ব্যবহার করতেন। বিশেষ করে গল্পের একটি চরিত্রের কথা আমার মনে পড়ে, যেখানে চরিত্রটিকে ঘিরে রেখেছে হলুদ প্রজাপতি। যখন আমি খুব ছোট আমাদের বাড়িতে একজন বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি আসতেন। আমি তার ব্যাপারে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠি। কারণ মিস্ত্রি একটি হলুদ বেল্ট সঙ্গে নিয়ে আসতেন আর এই বেল্ট দিয়েই বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে নিজেকে ঝুলিয়ে কাজ করতেন। আমার দাদি বলতেন, যতবার মিস্ত্রি এসেছে বাড়িটা ভরে রেখে গেছে হলুদ প্রজাপতিতে। আর আমি যখন এ-বিষয়টি নিয়ে লিখতে যাই, আমি আবিষ্কার করি, যদি প্রজাপতিগুলোকে হলুদ না বলি, তাহলে কেউ বিশ্বাস করবে না। রেমেদিওস দ্য বিউটির স্বর্গযাত্রা নিয়ে যখন লিখতে বসি, এটা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে আমার অনেকটা সময় কেটে যায়। একদিন একটি বাগানে গিয়ে দেখি, সে-বাড়ির একজন মহিলা নিত্যদিনের মতো কাপড় ধুতেন এবং শুকোবার জন্য বাতাসে সেগুলো ছড়িয়ে দিতেন। সেখানে প্রবল বাতাস। তিনি একই সঙ্গে বাতাসের কাছে অনুযোগ করতেন, বাতাস যেন তার কাপড় উড়িয়ে নিয়ে না যায়। আমার মনে হলো, যদি তার চাদরগুলো রেমেদিউস দ্য বিউটির জন্য ব্যবহার করি, তা হলে সুন্দরীর স্বর্গারোহণ ঘটবে। এভাবেই আমি ঘটনাটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে চেষ্টা করি। লেখার বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রত্যেক লেখকের সমস্যা। যতক্ষণ বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যায়, যে কেউ যা কিছু লিখে যেতে পারেন।

পিটার : ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউডের অনিদ্রা মহামারির উৎস কী?

মার্কেজ : ইডিপাস দিয়ে শুরু, প্লেগ নিয়ে আমি সবসময়ই আগ্রহী ছিলাম। মধ্যযুগের প্লেগ নিয়ে আমি অনেক পড়াশোনা করেছি। আমার প্রিয় একটি বই ড্যানিয়েল ডেফোর দ্য জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার্স – অনেকগুলো কারণের একটি হচ্ছে ডেফো ছিলেন একজন সাংবাদিক, যার লেখা পড়ে মনে হয় তিনি কল্পলোকের কাহিনি বলছেন। অনেক বছর ধরে আমার মনে হয়েছে, ডেফো লন্ডনে প্লেগ যেভাবে দেখেছেন সেভাবেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আমি দেখলাম এটি আসলে একটি উপন্যাস, কারণ লন্ডনে যখন প্লেগের প্রাদুর্ভাব হয় তখন ড্যানিয়েল ডেফোর বয়স সাত বছরেরও কম। প্লেগ বরাবরই আমার কাছে ফিরে ফিরে আসা একটি বিষয় – বিভিন্ন অকরণে। ইভিল আওয়ারে পুস্তিকাগুলো প্লেগ। অনেক বছর ধরে আমি ভেবেছি, কলম্বিয়ার রাজনৈতিক সহিংসতার অধিবিদ্যার ধরন প্লেগের মতোই। ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউড লেখার আগে ‘ওয়ান ডে আফটার স্যাটারডে’ নামের একটি গল্পে আমি সব পাখি মেরে ফেলার জন্য প্লেগের আশ্রয় নিয়েছিলাম। ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউডে ইনসমনিয়া প্লেগ – অনিদ্রা মহামারি সাহিত্যের একটি চাতুরী হিসেবে ব্যবহার করেছিলাম – এটা নিদ্রা মহামারির ঠিক উল্টোপিঠ। শেষ পর্যন্ত সাহিত্য ছুতারগিরি ছাড়া আর কিছু নয়।

পিটার : আপনার এই সাদৃশ্য বর্ণনার আরো কোনো ব্যাখ্যা দেবেন কি?

মার্কেজ : সাহিত্য ও ছুতারগিরি দুটোই খুব কঠিন কাজ। টেবিল তৈরি করার মতোই একটি শক্ত কাজ লেখালেখি। দুটোতে আপনাকে বাস্তবতা নিয়ে কাজ করতে হয় – কাঠের মতো শক্ত একটি উপাদান। দুটোতেই রয়েছে কৌশল ও চাতুরী। এর সঙ্গে খুব সামান্য জাদু ও প্রচুর পরিশ্রম জড়িত। (মার্শেল) প্রুস্তের মতো আমিও মনে করি এটা হচ্ছে দশভাগ অনুপ্রেরণা আর নববই ভাগ ঘাম। আমি কখনো ছুতারগিরি করিনি, তবে এ-কাজের আমি ভীষণ ভক্ত, এ-কাজটি আপনার জন্য করার মতো কাউকে কখনো পাবেন না।

পিটার : ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সিলিচিউডে বানানা ফিভার – কলাজ্বরের বিষয়টি কী? তার কতটা ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির কীর্তির ওপর ভিত্তি করে রচিত?

মার্কেজ : বাস্তবতার খুব কাছাকাছি কলাজ্বরের বিষয়টি প্রধান করা হয়েছে। অবশ্য এটা সত্য, যেসব বিষয় ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয়, তা প্রতিষ্ঠা করতে আমি সাহিত্যের কৌশল ব্যবহার করেছি। যেমন চত্বরে গণহত্যার বিষয়টি সম্পূর্ণ সত্য, কিন্তু আমি যখন সাক্ষ্য ও দলিল-দস্তাবেজ ভিত্তি করে লিখলাম – আসলে  যে- সাতজনের মৃত্যু হয়েছে, তা কখনো বের করা সম্ভব হয়নি। আমি তিন হাজার সংখ্যাটি ব্যবহার করেছি – এটা অতিরঞ্জিত। কিন্তু আমার শৈশবস্মৃতিতে আমি দেখতে পাই একটি দীর্ঘ, অতি দীর্ঘ ট্রেন, সম্ভবত কলাভর্তি, কলাচাষ অঞ্চল ত্যাগ করছে। আসলে তিন হাজার মৃতদেহ এই ট্রেনে থাকতে পারে, তাদের সমুদ্রে ফেলার জন্য নিয়ে চলেছে। কিন্তু এটা সত্যিই অবাক করা ব্যাপার, তারা এখন স্বাভাবিকভাবে কংগ্রেসে এবং পত্রপত্রিকায় তিন হাজার নিহতের কথা বলছে। আমার সন্দেহ, আমাদের ইতিহাসের অর্ধেকই একই কায়দায় প্রণয়ন করা হয়েছে। অটাম অব প্যাট্রিয়ার্কে এক নায়ক বলেছে, এটা এখন সত্য না হলেও কিছু এসে যায় না। কারণ ভবিষ্যতে কোনো না কোনো সময় এটা সত্যে পরিণত হবে। আগেই হোক কি পরে, মানুষ সরকারকে না করে লেখকদের বিশ্বাস করে।

পিটার : তা লেখকদের অত্যন্ত শক্তিশালী করে তোলে, তাই না?

মার্কেজ : হ্যাঁ, আমিও তা অনুভব করি। এটা আমার মধ্যে বড় ধরনের দায়িত্ববোধ জাগায়। আমি সাংবাদিকতার একটি কাজ করতেই পছন্দ করব। যে-ঘটনাটি হবে সত্য ও বাস্তব আর যা মনে হবে ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচিউডের মতো ফ্যান্টাস্টিক। আমার বয়স যতই বাড়ছে আর অতীতের বিষয় যতই মনে পড়ছে, আমি ততই অনুধাবন করছি সাহিত্য ও সাংবাদিকতা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।

পিটার : অটাম অব প্যাট্রিয়ার্কে যেমন ঘটেছে – বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে একটি দেশ তার সমুদ্র ছেড়ে দিয়েছে, সে-সম্পর্কে কী বলবেন?

মার্কেজ : হ্যাঁ, তা তো ঘটেছেই। এটা ঘটেছে এবং আরো বহুবার ঘটবে। দ্য অটাম অব প্যাট্রিয়ার্ক সম্পূর্ণভাবে একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ, আসল ঘটনার বাধার সম্ভাবনাসমূহ খুঁজে বের করা সাংবাদিক ও উপন্যাসিকের কাজ এবং একই কাজ ভবিষ্যৎদ্রষ্টার। সমস্যা হচ্ছে অনেকেই বিশ্বাস করেন আমি কল্পকথার লেখক, যেখানে আমি আসলে বস্ত্তবাদী মানুষ এবং যা আমি সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা হিসেবে বিশ্বাস করি, তা-ই লিখি।

পিটার : এটা কি কাল্পনিক – ইউটোপিয়ান?

মার্কেজ : ইউটোপিয়া শব্দের মানে বাস্তব কিংবা আদর্শ কিনা আমি নিশ্চিত নই। তবে আমি মনে করি, আমি যা লিখি তা-ই বাস্তব।

পিটার : দ্য অটাম অব প্যাট্রিয়ার্কের চরিত্রগুলো, যেমন ধরুন একনায়কের চরিত্রটি, তা কি সত্যিকারের কোনো চরিত্রের ওপর নির্মিত? এই চরিত্রটির সঙ্গে ফ্রাঙ্কো, পেরেন এবং ত্রুহিলোর মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

মার্কেজ : সব উপন্যাসেই চরিত্র হচ্ছে একটি কোলাজ। আপনার জানাশোনা কিংবা পড়া বিভিন্ন চরিত্রের একটি কোলাজ। গত শতকের (ঊনবিংশ) এবং এই শতকের প্রথম দিককার ল্যাটিন আমেরিকান একনায়কদের সম্পর্কে যা কিছু পাওয়া যায় আমি তার সবই পড়েছি। একনায়কতন্ত্রের অধীনে যারা বাস করছিলেন, আমি তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি অন্তত দশ বছর ধরে          এ-কাজটি করেছি। আর চরিত্রটি কেমন হবে, যখন সে-সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণা হয়েছে, তখন আমি কী পড়েছি বা কী শুনেছি তা ভুলে যেতে চেষ্টা করেছি – যেন বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো পরিস্থিতির ওপর নির্ভর না করে আমার নিজস্ব আবিষ্কারটি করে যেতে পারি। একসময় আমার মনে হলো, একনায়কের অধীনে আমি কখনো কোথাও বসবাস করিনি। আমি ভাবলাম, আমি যদি বইটি স্পেনে গিয়ে লিখি, তাহলে প্রতিষ্ঠিত একনায়কের অধীনে বাস্তব অবস্থা কেমন তা জানা যাবে। কিন্তু আমি দেখলাম ফ্রাঙ্কোর একনায়কতন্ত্রে স্পেনের পরিস্থিতি ক্যারিবীয় একনায়কতন্ত্র থেকে ভিন্ন। বইটি লেখার কাজ প্রায় এক বছর বন্ধ রইল। মনে হচ্ছিল কিছু একটা বাদ পড়ে গেছে – কিন্তু তা যে কী বুঝতে পারিনি। রাতারাতি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার জন্য সবচেয়ে ভালো হবে ক্যারিবিয়ায় ফিরে যাওয়া। সুতরাং আমরা সবাই কলম্বিয়ার বারানকিলায়ে চলে এলাম। আমি তখন সাংবাদিকদের কাছে একটি বিবৃতি দিয়েছিলাম, যা তারা ভেবেছিল কৌতুক। আমি বলেছিলাম, পেয়ারার গন্ধ কেমন ভুলে গেছি, সেজন্য ফিরে আসছি। আসলে আমার দরকার ছিল বইটি শেষ করার মতো ফুরসৎ। আমি ক্যারিবীয় দেশগুলোতে ভ্রমণে বের হলাম। এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে ভ্রমণের সময় আমি এমনসব উপাদান পেলাম যার ঘাটতি ছিল আমার উপন্যাসে।

পিটার : আপনি প্রায়ই নির্জনতার শক্তির থিম ব্যবহার করে থাকেন।

মার্কেজ : আপনার যত বেশি ক্ষমতা থাকবে, কে আপনার কাজে মিথ্যে বলছে এবং কে বলছে না, তা বের করা তত কঠিন হয়ে উঠবে। আপনার ক্ষমতা যখন নিরঙ্কুশ হবে বাস্তবতার সঙ্গে আপনার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না – আর এটাই হচ্ছে সবচেয়ে জঘন্য নির্জনতা। একজন শক্তিশালী ব্যক্তি, যিনি একনায়ক, তাকে ঘিরে রাখে বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ এবং এমনসব মানুষ যাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য তাকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করা; সবকিছুই সংঘবদ্ধভাবে তাকে বিচ্ছিন্ন করতেই করা হয়। (আংশিক অনূদিত)