মার্কেজ : সাহিত্যের দৃশ্যশিল্পী

ইমতিয়ার শামীম

অনেক বছর আগে, আমাদের সময়ে এসে সহজলভ্য ও গুরুত্ববিস্মৃত হয়ে পড়বে বলে  যে-বছর পেনিসিলিন আবিষ্কৃত হচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা হচ্ছে, তেমন এক বছরে কলা কোম্পানির গণহত্যার আতঙ্ক ছড়ানো আরাকাতাকায় গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের জন্ম হয়েছিল। পেছনে বাগানওয়ালা, ভ্যাপসা গরমের রাতে রজনীগন্ধার ঘ্রাণে ভরে ওঠা এবং পরবর্তীকালে পুরনো ও বিশাল মনে হওয়া মৃত আত্মীয়দের দীর্ঘশ্বাসে ভরে থাকা সেই বাড়ির ১৯৮৫ সালে তোলা ছবি দেখতে দেখতে আমরা এখন উপলব্ধি করতে পারি তাঁর কল্পনাশক্তি কত প্রখর, স্মৃতিসত্তা কত শক্তিশালী যে, কী অনায়াসে তিনি তাঁর লেখনী দিয়ে অসংখ্য নারীতে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারেন ওই বাড়িটিকে এবং আমাদের মনে এই প্রত্যয়ও তৈরি করতে পারেন, পুরুষ বলতে সেখানে ছিলেন কেবল শৈশবের তিনি আর তাঁর নানা গৃহযুদ্ধের তপ্ত স্মৃতিতে ঋদ্ধ কর্নেল মার্কেজ। জীবনের উপান্তে এসে স্মৃতিকথন লিখতে গিয়ে মার্কেজ প্রথমেই মনে করেছেন সেই বাড়িটিকে – মনে করেছেন তাঁর মাকে, যিনি এসে তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন বাড়িটি বিক্রি করে দিতে। কিন্তু শেষ বয়সে এসে লিখলেও যখনকার কথা তিনি লিখেছেন, তখনো তিনি তরুণ ছিলেন এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, ঠিক ওই সময়টাতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন – লেখক হবেন। আইনশাস্ত্র অধ্যয়নের মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতের প্রসন্নতা সুনিশ্চিত করার সমস্ত সম্ভাবনা নষ্ট করে ফেলার উপযোগী এমন একটি সিদ্ধান্ত তাঁর বাবাকে ব্যথিত করেছিল, ক্রুদ্ধ করেছিল; বোধহয় মাকেও – যদিও তিনি পুরো ব্যাপারটি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন পিতার আকাঙ্ক্ষার অজুহাতে। ততদিনে জীবনের অনেক কিছুই তাঁর জানা হয়ে গেছে, জানা হয়েছে ক্ষুধার্ত হয়েও বিনিদ্র থাকার যন্ত্রণা, জানা হয়েছে নারীদের সংস্পর্শে কী করে ‘পিঁয়াজের জুস’ বেরিয়ে আসে পুরুষের উন্মত্ত শরীর থেকে। বলা যায়, তিনি যে কেবল লেখার মধ্যে দিয়েই অমরত্ব পেতে পারেন, সেটিও তিনি জানতে পেরেছিলেন এবং তাই অমন একরোখা একটি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি যে বলেছেন, মৃত্যু আসে বয়সের ভারে নয়, মৃত্যু আসে বিস্মরণের মধ্যে দিয়ে, তা যেন তাঁর ওই জেনে-যাওয়ারই একবাক্যে উচ্চারিত দীর্ঘ ইতিহাস। যে-কর্নেল নানার সান্নিধ্যে তিনি শৈশব থেকে বড় হয়ে উঠতে থাকেন, যে-নারীর সান্নিধ্যে তিনি মৃত আত্মাদের দীর্ঘশ্বাস শুনতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, সেইসব নারী-পুরুষ বারবার ফিরে এসেছে তাঁর জাদুবাস্তবতাঘেরা লেখাতে। তিনি কিছু বিস্মৃত হননি, তাই তাঁর কোনো মৃত্যুও ঘটেনি, কেননা তিনি জানেন, জীবনে কী-সব ঘটেছে, সেসবের কোনো কিছুতেই কিছু যায়-আসে না, জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হলো তিনি কীভাবে সেসব মনে করছেন, মনে রাখছেন। যা কিছু মানবিকতার পক্ষে, মানুষের উদ্বোধনের পক্ষে সেসবই মার্কেজ মনে রেখেছেন এবং লিখেছেন অক্লান্তভাবে, যতক্ষণ না তা পাঠযোগ্য হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়।

মার্কেজের জীবনের ওই পর্বই আমরা খুঁজে পাই তাঁর লেখা হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুডে, যে-উপন্যাসের শুরুতেই ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড়িয়ে গুলির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে কর্নেলের মনে হয় অনেক বছর আগে বাবার সঙ্গে প্রথম বরফ আবিষ্কারের কথা। মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ পেতে চলেছেন তিনি, এরকম একসময়ে বরফ আবিষ্কারের কথাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। অনেক পরে মার্কেজ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, জীবনভর একটি কাহিনিই লিখেছেন তিনি, আর তা হলো একাকিত্বের কাহিনি এবং এমন একাকিত্ব মানুষের আসে কেবল ভালোবাসাহীনতা থেকে। বুয়েন্দিয়া পরিবারে একাকিত্ব ছিল, কেননা সেখানে ছিল ভালোবাসাহীনতা। পুরো বইয়ে, মার্কেজ নিজেই বলেছেন, গোটা একশ বছরের নিঃসঙ্গতার আখ্যানে একমাত্র বুয়েন্দিয়া হলেন টিকিদার অরেলিয়ানো, যাঁর মধ্যে ভালোবাসার রূপ-রস খুঁজে পাওয়া যায়। যেন তিনি আমাদের আসলে বলতে থাকেন নিঃসঙ্গতাকে উজিয়ে ভালোবাসার জন্মকথা, মানুষের বাসভূমি পত্তনের ইতিকথা। বরফ আবিষ্কারের কথা মনে হওয়ার পর আমাদের আরো জানা হয়ে যায়, কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার বাবা হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া ছিলেন প্রচন্ড উদ্যমী আর অভিযানপ্রিয় মানুষ, বারবার বিজ্ঞানের সুযোগ-সুবিধাগুলো ভোগ করার প্রয়াসে সে লোকজনকে নিয়ে বারবার বসতি স্থাপন করে বিভিন্ন এলাকায়; কিন্তু তার স্ত্রী উরসুলা একসময় তার এই গোপন স্বভাব বুঝে ফেলে এবং মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করে কারো ঠাঁইনড়া মতিগতিকে প্রশ্রয় না-দিতে। মানুষজনের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে শেষমেশ হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া কর্কশ কণ্ঠে ঘোষণা করে, তাহলে তারা একাই যাবে অন্য কোনোখানে। উরসুলা তার জন্ম নেওয়া ছেলেটির কথা স্মরণ করিয়ে দিলে হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া জানান দেয়, তাদের কোনো আত্মীয়স্বজন এখনো এখানে মারা যায়নি এবং মাটির তলায় আপনজনদের কেউ ঠাঁই না নেওয়া পর্যন্ত ওই জায়গার মাটির ওপর কারো অধিকার জন্মায় না। তখন ধীরস্থির কণ্ঠে উরসুলা জানিয়ে দেয়, তাহলে সে নিজেই মরতে রাজি, তাদের বাদবাকি সবার থিতু হওয়ার স্বার্থে। এইভাবে উরসুলার মৃত্যুকাঙ্ক্ষা প্রকাশের মধ্যে দিয়েই বোধকরি মানুষ অভিজ্ঞান পায় স্বদেশের মৃত্তিকার এবং পরবর্তীকালে ল্যাটিন আমেরিকার উপন্যাসের এত বিশ্বপ্রিয়তার কারণ হিসেবে মার্কেজকেও আমরা স্বীকার করতে দেখি, তাদের উপন্যাসের জাতীয়তাবাদী মেজাজের কথা। মার্কেজের শৈশব সম্পর্কে কোনো ধারণা ছাড়াই আমরা এ-বই একটানে পড়ে যেতে পারি বটে, কিন্তু তাঁর শৈশবের স্মৃতিগুলো জানা থাকলে আমাদের পাঠের অভিজ্ঞান চিত্রিত হতে পারে আরো বিচিত্র বিভাতে।

জাদুবাস্তবতার লেখক, – এভাবেই আমরা শনাক্ত করি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে; যদিও মার্কেজের আগে থেকেই জাদুবাস্তবতা সাহিত্যের একটি শক্তিশালী ধারা হিসেবে দেখা দেয় লাতিন আমেরিকায় এবং হুয়ান রুলফো ও কার্লোস ফুয়েন্তেস প্রমুখের সাহিত্য উর্বর করে তোলে সে-ধারাকে। কিন্তু এ-ও অনস্বীকার্য, জাদুবাস্তবতাকে উৎকর্ষতার চরম শিখরে নিয়ে যান গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এবং এক্ষেত্রে লাতিন আমেরিকার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থাও ভূমিকা রাখে। মার্কেজের সমসময়ে ও পরেও অনেকে তাঁদের সাহিত্যচর্চায় জাদুবাস্তবতাকে অবলম্বন করেছেন, এক্ষেত্রে অনায়াসেই মনে করা যেতে পারে ইসাবেল আয়েন্দে কিংবা বেন ওকরির কথা। কিন্তু তাদের সে-চর্চা কেবল জাদুবাস্তবতার প্রবাহকে বিস্তৃত করেছে, প্রবহমান রেখেছে এবং ধারাটিকে রক্ষণশীল করে তুলেছে, নতুন কোনো মাত্রা যোগ করতে পারেনি তাতে। প্রত্যয়গতভাবে জাদুবাস্তবতার চর্চা শুরু হয় জার্মানির শিল্পকলাতে, কিন্তু চারিত্রিকভাবে যদি আমরা বিবেচনা করতে যাই, তাহলে হয়তো বলতে হবে, জাদুবাস্তবতার সাহিত্য জন্ম নিয়েছে বাংলা ভাষার সাহিত্যে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী কিংবা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেশ কিছু লেখা আছে যেগুলো এরকম বিবেচনার শক্তিশালী ভিত্তি। এরকম মনে করা যেতেই পারে, বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুন্ডলার জাদুবাস্তবতা স্বভাবতই প্রাথমিক স্তরের, কিন্তু তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সতীনাথ ভাদুড়ীর স্পর্শ পাওয়ার পরও যে এ-জাদুবাস্তবতা ক্রমবিকাশের পথে এগোয়নি, তার অন্যতম কারণ বোধকরি দেশজ ভাষানির্ভর সাহিত্য বিকাশের ফলে ভারত উপমহাদেশে নৃতত্ত্ব আর কথাসাহিত্য শেষ পর্যন্ত এক হতে পারেনি এবং নৃতাত্ত্বিক সাম্রাজ্যবাদ এখানে চূড়ান্তভাবে বিকশিত হতে পারেনি। এনলাইটেনমেন্টের মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে যে নৃতাত্ত্বিক চিন্তাধারার শুরু, ক্রমে তার স্থিতি ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণার একটি বিষয় ও আধুনিক বিজ্ঞান হিসেবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ জুড়ে সদর্পে শিকড় স্থাপনের কাজে সক্রিয় ছিল নৃতাত্ত্বিক সাম্রাজ্যবাদ। এটি ছিল এমন এক সময় যখন পশ্চিমা দেশগুলো তাদের চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালায় প্রাক্-শিল্পায়িত সময়ের পশ্চিমবহির্ভূত বিশ্বকে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার। বাংলা সাহিত্যে এর শিকড় যে বিস্তৃত হয়নি, তার কারণ শুধু জাতীয়তাবাদী ও জাতীয় মুক্তি-আন্দোলনের প্রাবল্য নয়, ভাষাভিত্তিক সাহিত্যের ধারাবাহিক বিকাশও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে, লাতিন আমেরিকার কিংবা আফ্রিকার কথাসাহিত্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিকশিত হয়েছে নৃতত্ত্ব আর সাহিত্যের মিথস্ক্রিয়ায়। আর এই প্রক্রিয়াই সেখানে জাদুবাস্তবতা নামের প্রপঞ্চ সৃষ্টির ভিত্তিভূমি হিসেবে কাজ করেছে। সমস্ত ঔপনিবেশিক সাহিত্যেরই যাত্রাপথ হওয়ার কথা ছিল জাদুবাস্তবতার দিকে। কিন্তু ভারতবর্ষ তা থেকে মুক্তি পায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও নিজস্ব বর্ণমালাসম্পন্ন ভাষাভিত্তিক বিবিধ সংগঠন ও সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে। নৃতত্ত্ব আর সাহিত্যের যৌগিকত্ব সৃষ্টির আগেই অ্যাকাডেমিক বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে সাহিত্য ও নৃতত্ত্ব এখানে অপেক্ষা করতে থাকে সচেতন (এবং হয়তো বা কৃত্রিমও) জাদুবাস্তবতার জন্যে। অন্যদিকে নৃতত্ত্ব ও সাহিত্যের বিচ্ছেদ লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় বেশি বছরের নয় – আর এর শুরু তাদের ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষা দখল করার মধ্যে দিয়ে। এরকম বিচ্ছেদ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভাষাকে দখল ও আত্তীকৃত করে নেওয়ার প্রচেষ্টা একটি বড় ভূমিকা রাখে। এতদিন ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রে ইংরেজরা বিভিন্ন ভাষাভাষীকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মূলত নিজেদের ভাষাকেই সমৃদ্ধ করেছে। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় স্প্যানিশ এবং ইংরেজদের ঔপনিবেশিকতা বিভিন্ন ভাষাভাষীর লেখ্য ভাষার অপমৃত্যু ঘটায়, না হয় জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনাকেই হত্যা করে। স্বভাবতই এসব অঞ্চলের সাহিত্যিকরা ভাষিক আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন দখলদারদের বা সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষার (বিশেষত ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষার) মধ্যে। যতদিন না তারা এ-দুটি ভাষা ব্যবহারের কৌশল ও বিন্যাসকে লাতিন আমেরিকান ও আফ্রিকান করতে সমর্থ হননি, ততদিন প্রপঞ্চ-প্রকল্প হিসেবে জাদুবাস্তবতা শক্তিশালী ভিত খুঁজে পায়নি, উহ্য থেকেছে এর স্বকীয়তা। মার্কেজের কৃতিত্ব এখানেই, তিনি সেই স্বকীয়তাকে শক্তিশালী ভিত্তি দিয়ে গেছেন। আমাদের সময়ের এমন কোনো সাহিত্যিককে খুঁজে পাওয়া কঠিন, মার্কেজের সাহিত্য যাকে প্রভাবিত না-করুক, আলোড়িত করেনি। ‘লাতিন আমেরিকায় আমরা একটাই উপন্যাস লিখছি’ – মার্কেজের এই কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে             তাই আমরা কার্লোস ফুয়েন্তেসকে পরবর্তীকালে বলতে শুনি, এ-উপন্যাসের কলম্বিয়ান অধ্যায়টি লিখছেন মার্কেজ, কিউবান অধ্যায়টি লিখছেন কারপেন্তিয়ের, আরহেন্তাইন্ অধ্যায়টি লিখছেন হুলিও কোরতাসার ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিশবাসের দিক থেকে মার্কেজ ছিলেন সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল, যদিও তাঁরই একসময়ের ঘনিষ্ঠ ও পরবর্তীকালে দূরে সরে যাওয়া সাহিত্যিক বন্ধু মারিও ভার্গাস য়োসা বলেছেন, মার্কেজের লেখা আর রাজনীতির গুণগত মান একরকম নয়; তারপরও বলতে হয়, আমাদের সমসময়ে তিনিই একমাত্র সাহিত্যিক যিনি সরাসরি প্রভাবান্বিত করার ক্ষমতা রাখতেন, এমনকি পৃথিবীর সেরা সেরা অনেক রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিককে। মার্কেজের সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হওয়ার কোনো সরলীকৃত ব্যাখ্যা দাঁড় করানো খুবই কঠিন। কেননা তাঁর বাবা ছিলেন একজন কনজারভেটিভ বা রক্ষণশীল, অন্যদিকে মা বেড়ে উঠেছিলেন লিবারাল বা উদারতাবাদী আবহে, কেননা তাঁর নানা কর্নেল মার্কেজ ছিলেন কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধের লিবারালপন্থী সংগঠক ও যোদ্ধা। ১৮১৯ সালে স্পেন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর কলম্বিয়াকে এগোতে হয় এক শতাব্দীকাল দীর্ঘ কখনো তীব্র,  কখনো-বা মন্থর গৃহযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে। এ দুদলের মধ্যে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল ‘এক হাজার দিনের যুদ্ধ’ (১৮৯৯-১৯০২)। সংশয়হীনভাবেই বলা চলে, এ-যুদ্ধের আগে-পরের আখ্যান ও পারিবারিক সম্পৃক্তিই তাঁকে হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড লেখার শক্তি জোগায়। আর জন্মও নিয়েছিলেন তিনি সেই কর্নেল নিকোলাস রিকার্দো মার্কেজ মেজিইয়ার ঘরেই, ১৯২৭ সালের ৬ মার্চে, যিনি ছিলেন উদারতাবাদী, যোদ্ধা, প্রাণশক্তিতে ভরপুর এবং শৈশব থেকেই শিশু মার্কেজের সুখ-দুঃখের সঙ্গী, গল্পবলিয়ে সঙ্গী। আরাকাতাকা নামের সেই শহরটাতে মার্কেজের জন্ম নেওয়ার আগেই জমে উঠেছিল কলার বাজার, দিগন্তস্পর্শী কলার বাগানের পাশ দিয়ে দুপাশে ধুলো উড়িয়ে প্রতিদিন সকাল ১১টায় শহরটায় ধীরে ধীরে এসে পৌঁছতো একটি রেলগাড়ি। যদিও শহরটার আবহাওয়া ছিল গরম, কিন্তু গাড়িটি ছিল পুরোপুরিই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। কেননা, তাতে করে চলাফেরা করতেন কলা-কোম্পানির কর্মকর্তারা। কিন্তু কণ্ঠে বিদ্বেষ জড়িয়ে তাদের মার্কেজের কর্নেল নানা ডাকতেন ‘আমেরিকান’ বলে। যদিও গণহত্যার পর এই কলার বাজার ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে থাকে, কিন্তু মার্কেজের জন্মের সময়েও তা নেহায়েত ফেলনা ছিল না। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, তাঁর মা লুইসা ছিলেন এমন একটি শহরের সেরা সুন্দরীদের একজন। কর্নেল নিকোলাস রিকার্দো মার্কেজ মেজিইয়ার কন্যা ছিলেন তিনি, আর কর্নেল ছিলেন তেমন একজন যিনি অংশ নিয়েছিলেন গৃহযুদ্ধে লিবারাল বা উদারতাবাদী হিসেবে, যুদ্ধ করেন সমুদ্রঘেঁষা অঞ্চলে কিংবদন্তির নায়ক, উদারনৈতিক জেনারেল রাফায়েল ইউরাইব ইউরাইবের নেতৃত্বে। লাল জামা পরে আর লাল ঝান্ডা উড়িয়ে তাঁরা যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন গ্যারিবল্ডির আদর্শ ও ফরাসি বিপ্লববাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে। তাঁর একাগ্রতা আর বীরত্বই তাঁকে খ্যাতিমান করে তোলে এবং সবখানেই তিনি হয়ে ওঠেন সম্মানিত। অথচ এই শহরটিতেই কি-না টেলিগ্রাফ অপারেটরের চাকরি নিয়ে এসেছিলেন গ্যাব্রিয়েল এলিজিও গার্সিয়া – না এসে উপায়ও ছিল না তাঁর, ডাক্তারি পড়ার আশায় তিনি ভর্তি হয়েছিলেন কার্তেহেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু পড়ার খরচ কুলিয়ে ওঠা দূরে থাক, বেঁচে থাকার খরচ জোগাড় করাই কঠিন ছিল তাঁর পক্ষে। তাই তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন প্রশাসনিক চাকরিতে। গার্সিয়ার বাড়ি ছিল বলিভারে। আর বলিভারের লোকজন সম্পর্কে কর্নেলের ধারণাও তেমন প্রীতিকর ছিল না। বলিভারের লোকজন মানেই ঢিলেঢালা, গ্রাম্য – যারা কি-না কর্নেল নিকোলাস মার্কেজের বংশধারার পুরোপুরি ‘অযোগ্য’। তাছাড়া রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে সারাজীবন সংগ্রাম করা কর্নেলের পক্ষে রক্ষণশীল দলের গার্সিয়াকে কন্যার বর হিসেবে মেনে নেওয়াও ছিল এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। তারপরও গার্সিয়া ও লুইসার বিয়ে হয় এবং জন্ম নেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, পরিবারে ও বন্ধুদের বৃত্তে যিনি গ্যাবো হিসেবেই বেশি পরিচিত এবং যাঁর জন্ম উপলক্ষে বিয়ের পর থিতু হওয়া জলদুস্যদের আড্ডাখানা হিসেবে পরিচিত পুরনো শহর রিওহাচা থেকে কর্নেলের অনুরোধে আরাকাটাকায় ফিরে আসতে হয় সুন্দরী লুইসাকে।

হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড লিখে পুরোপুরি বিখ্যাত হওয়ারও অনেক পরে মার্কেজ লেখেন লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা – যার অন্যতম উপজীব্য তাঁর বাবা ও মায়ের এই গভীর, শ্বাসরুদ্ধকর ও উত্তেজনাময় প্রেমকাহিনি। তবে এমন বাবা-মায়ের সংস্পর্শে শৈশবে-কৈশোরে বেড়ে ওঠেননি মার্কেজ। কেননা, প্রেমের বিয়ে করে পরিবারের সঙ্গে যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়, সেসবের পীড়ন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে লুইসা তাঁর প্রথম সন্তান গ্যাবোকে জন্ম হওয়ার পরেই রেখে যান তাঁর বাবা-মায়ের কাছে। মার্কেজ পরে অনেকবারই জানিয়েছেন, ওই বাড়ির একগাদা নারীর মধ্যে একমাত্র পুরুষ। আর সমস্ত বাড়িতে ছিলেন দুজন মাত্র পুরুষ – যাঁর একজন কর্নেল, অপরজন তাঁর শিশু নাতি গ্যাবো। গ্যাবো যত বড় হতে থাকেন, ততই নিবিড় বন্ধুতায় জড়িয়ে পড়েন বৃদ্ধ কর্নেল নিকোলাস মার্কেজের সঙ্গে। গ্যাবোকে শুনিয়ে শুনিয়ে কর্নেল বলে চলেন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও জীবনযাপনের মায়াবী দীর্ঘ গল্প। এই বাড়ির পরিবেশের অনেক কিছুই পরবর্তীকালে জায়গা খুঁজে নিয়েছে তাঁর লেখা হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুডে। এ-লেখায় তিনি আসলে চেয়েছেন, তাঁর বাল্যকালের নিজস্ব জগৎটিকে সাহিত্যের নিরিখে স্মরণ করতে। যেমনটি আমরা জানতে পেরেছি লিভিং টু টেল অ্যা টেল থেকে, নানার বাড়ি বিক্রি করতে মায়ের সঙ্গে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন এককালের সরগরম রেলস্টেশনটিকে জনশূন্যরূপে। ভ্যাপসা গরম আর অবহেলা মিলে যেন এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে শহরটিকে। বেশ খানিকক্ষণ পরে তাঁরা খুঁজে পেয়েছিলেন মায়ের এক পুরনো বন্ধুকে। কিন্তু কেউই বোধহয় কাউকে চিনতে পারেননি এবং একজন আরেকজনের ক্লান্ত, ধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত চেহারার আড়ালে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন বহু আগের কোনো সুন্দরী সুহাসিনীকে। কিন্তু মায়ের কণ্ঠস্বর চিনিয়ে দেয় তাঁকে এবং সেলাই মেশিনের পাশ থেকে উঠে আসেন বয়স্ক সেই নারী, ‘কমাদর’ বলে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকেন। ‘ওখানেই জন্ম হয় আমার প্রথম উপন্যাসের, ওই পুনর্মিলনের মধ্যে দিয়ে’ – বলেছেন মার্কেজ। বলেছেন, এ-বাড়িতে যাঁরা বসবাস করতেন ‘সুখ ও উন্মাদনার মধ্যে পার্থক্য কী তাঁরা জানতেন না’ – যা থেকেই আমাদের জানা হয়ে যায়, উপন্যাসের চরিত্রগুলোও কেমন হবে। এ-বইয়ের কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া নামের কিংবদন্তিতুল্য চরিত্রটি আসলে জেনারেল রাফায়েল ইউরাইব ইউরাইবের। দক্ষিণ আমেরিকার বহু দূরের এক বসতি মাকোন্দোর পত্তনকারী এই বুয়েন্দিয়া পরিবারের পাঠ নিতে নিতে ইতিহাস আর ফ্যান্টাসি একাকার হয়ে যায়, বাস্তবতা আর স্বপ্নজগৎ মিলেমিশে যায়, হলুদ মেঘের নিচে জমে ওঠে গণহত্যার চাপা ক্রন্দন। যে-বছর তিনি এই উপন্যাস আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন, সে-বছরেই কি-না হয়েছিল প্রথম সফল হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট – প্রতীকী অর্থে বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ নিঃসন্দেহে। কেননা, ওই বছর থেকে পৃথিবীর তাবৎ পাঠকের হৃদয়ও যাত্রা করেছে নতুন এক ডাঙার দিকে। লিফ স্টর্ম নামের যে-বইটি তিনি লিখেছেন ১৯৫৫ সালে, সেটিকে সরাসরি নাকচ করে না দিলেও সেটি যে তাড়াহুড়োয় লেখা, তা স্বীকার করতে কখনোই দ্বিধা করেননি তিনি। ওই তাড়াহুড়োর কারণও বলে গেছেন তিনি, বয়স তখন কম হওয়ার পরও তাঁর মনে হয়েছিল, জীবনে বোধহয় আর কখনোই তাঁর লেখা হবে না এবং সেজন্যে ইংরেজ ও মার্কিনি তাবৎ সাহিত্যিকের কাছে থেকে তিনি যে-জ্ঞানবিদ্যা ও ধারণা অর্জন করেছিলেন, সেসব দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন উপন্যাসটিকে। এ-উপন্যাসের প্রকাশক পাওয়ার জন্যে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল পাঁচ-পাঁচটি বছর, কিন্তু তিনি অর্জন করেছিলেন এমনসব অভিজ্ঞতা, যা তাঁকে লেখক হিসেবে সুস্থির করেছে। যেমন, লিফ স্টর্ম লেখার সময় তিনি মনে করতেন, উপন্যাস হলো ‘বাস্তবতার কাব্যিক রূপান্তর’ এবং সেটি লেখার ক্ষেত্রেও ওই ধারণারই প্রতিফলন ঘটেছে। কলম্বিয়ায় যখন তীব্র ও রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক নিপীড়ন চলছে, সেসময় এ-বই বাজারে আসে এবং তা তাঁর বন্ধুদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাঁরা তখন এর সমালোচনা করেন এই বলে যে, এ-উপন্যাস পুরোপুরি অক্ষম এবং তা না পারে কোনো কিছু উন্মোচিত করতে, না পারে কোনো তিরস্কার জানাতে। এই সমালোচনা মার্কেজকে দুর্বল করে দিয়েছিল, তিনি সত্যিই ভাবতে শুরু করেছিলেন, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে আরো সক্রিয়ভাবে তাঁর জড়িত হওয়া উচিত। কিন্তু আরো পরে তিনি অনুভব করেন, তাৎক্ষণিক ওই উত্তেজনাপূর্ণ ভাবনা নয়, বরং তাঁর পূর্বভাবনাই সঠিক – যদিও তাঁর একটি  রাজনৈতিক অঙ্গীকারও রয়েছে, সমাজতন্ত্রের প্রতি রাজনৈতিক অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু কখনোই তিনি চাননি তাঁর সাহিত্যকে ‘অঙ্গীকারের সাহিত্য’ কিংবা ‘সামাজিক প্রতিবাদের সাহিত্য’ করে তুলতে।

এর ফলে যা দাঁড়িয়েছে, মার্কেজের উপন্যাস ও গল্পে যে জাদু ও পৌরাণিক দিক রয়েছে, তার পেছনের বাস্তবতা অনেকেই অনুভব করেন না, বাস্তবতার যে-রূপান্তর ঘটেছে, তা অনেকেই উপলব্ধি করেন না। কিন্তু লাতিন আমেরিকার দৈনন্দিন জীবন থেকে মার্কেজ দেখেছেন, অসাধারণ সব উপকরণ বাস্তবতাকে উর্বর করে চলেছে। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি তাঁর সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী প্লিনিও অ্যাপুলেইও মেন্দোজকে বলেছিলেন আমেরিকার অভিযাত্রী এফ ডব্লিউ আপ দ্য গ্রাফের দৃষ্টান্তের কথা। আমাজানের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতাময় অভিযানের একপর্যায়ে তিনি উপনীত হয়েছিলেন একটা বলকানো নদী ও এমন এক জায়গায়, যেখানে মানুষের কণ্ঠস্বরেও মুষলধারে বৃষ্টি নামে। এক নৃতাত্ত্বিক সাম্রাজ্যবাদই যেন আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, যখন তিনি আমাদের জানান, তাঁর ওপরকার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাবের কথা – সাহিত্যিক বা অন্য কোনো প্রভাবের চেয়েও শক্তিশালী তাঁর সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক পরিচয়যুক্ত ক্যারিবিয়ান প্রভাবের কথা, যা তাঁকে শিখিয়েছে বাস্তবতার প্রতি ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে এবং পারলৌকিকতাকে দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে, যে-ক্যারিবিয়ান সাহিত্যের প্রথম ঐশ্বর্য দ্য ডায়েরি অব ক্রিস্টোফার কলম্বাস! সংগত কারণেই লেখক হওয়ার প্রস্ত্ততিপর্বে তাঁর জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন তাঁর নানিমা, যাঁর কথনরীতিই হয়ে ওঠে মার্কেজের লিখনরীতি। দৃশ্যজ চিত্রকল্প মাথায় নিয়ে লিখতে বসেন তিনি এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে লেখার শুরুর বাক্যটি, যেন সেটিই নির্ধারণ করে দেবে পুরো লেখার ভবিষ্যৎ। অন্যকথায় বলা যায়, সাহিত্যকেও তিনি করে তুলেছেন দৃশ্যশিল্পের অন্তর্গত, দৃশ্যজ স্মৃতিনির্ভরতা থেকে দাঁড় করিয়েছেন তাঁর সাহিত্যকল্প। নানিমার কাছ থেকে শোনা গল্পের মধ্যে দিয়ে পাওয়া গোপন বার্তাটিই তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে কাফকার মেটামোরফোসিস পড়ার পরে। খুব বেশি লেখেননি মার্কেজ, কিন্তু লিখেছেন বিশ্বস্ততার সঙ্গে, আস্থার সঙ্গে। গল্প লেখা শুরু করার পর সংশয়াচ্ছন্ন হলে তা ছিঁড়ে ফেলতেন তিনি – কেননা, গল্পকে তিনি মনে করতেন কংক্রিটের মতো, উপন্যাসের মতো যাকে ইটের পর ইট রাখার মতো করে সাজানো যায় না, তাই খানিকটা পালটেও ফেলা যায় না পছন্দ না হলে। সাহিত্য আর সাংবাদিকতাকে আলাদা করে দেখেননি তিনি কখনো। প্যারিস রিভিউয়ের এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ড্যানিয়েল ডিফোর দ্য জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার  যেমন একটি মহৎ উপন্যাস, তেমনি হিরোশিমা হলো সাংবাদিকতার একটি মহৎ নিদর্শন। ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অনেক আগে থেকেই তিনি তাঁর পাঠক হিসেবে পান পাবলো নেরুদা, কার্লোস ফুয়েন্তেসের মতো সাহিত্যিকদের। কিউবায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নায়ক ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গেই কেবল নয়, তাঁর সখ্য ছিল এমন আরো একাধিক রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে যাঁরা ক্যারিবিয়ান ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনে ও নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বিভিন্ন সময়ে। পানামার লৌহমানব ওমর টোরিওস, ভেনিজুয়েলার কার্লোস আন্দ্রেজ পেরেজ, কলম্বিয়ার আলফোনসো লোপেজ মিচেলসন কিংবা নিকারাগুয়ার স্যান্ডিনিস্টরাই কেবল নয়, ঘনিষ্ঠতা ও আড্ডার পরিধি তিনি বিস্তৃত করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিল ক্লিনটন অবধি। প্রথমবারের নির্বাচনী প্রচারণায় নামার পর বিল ক্লিনটনের একটি অন্যতম ঘোষণা ছিল, হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড তাঁর পড়া সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস। মার্কেজ তখনো ক্লিনটনের সঙ্গে পরিচিত হননি, তিনি ক্লিনটনের এ-বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত ক্যারিবিয়ানদের ভোট টানার একটি কৌশল হিসেবে। কিন্তু অনেক পরে ক্লিনটনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, আড্ডায় বসে মার্কেজ নিশ্চিত হন যে, বইটিকে সত্যিই তিনি গ্রহণ করেছেন হৃদয় দিয়ে।

হলুদকে ভালোবাসতেন মার্কেজ, প্রিয় ছিল হলুদ প্রজাপতি, মনে করতেন এটি তাঁর ভাগ্যরং – তাঁর ঘরে তাই থাকতো হলুদ ফুল। এই বিশ্বাস কিংবা কুসংস্কার, যা-ই বলা হোক না কেন, এতই তীব্র ছিল যে লিখতে বসে কলম না এগোলে তিনি হলুদ ফুল দেখে নিতেন। আর কী আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কলম ভাষা খুঁজে পেত। গত ১৭ এপ্রিল এই হলুদ ফুল পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে, মার্কেজ আর কখনোই লিখবেন না আমাদের জন্যে। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে মার্কেজ হয়তো হারিয়ে গেলেন আমাদের দৃশ্যজগৎ থেকে; কিন্তু যেমনটি তিনি নিজেই লিখেছিলেন, মৃত্যু তো বয়সের ভারে নয় – মৃত্যু আসে বিস্মরণের মধ্যে দিয়ে; আর তিনি কি কখনো বিস্মৃত হবেন আমাদের সাহিত্যস্মৃতি থেকে, যতই বয়সী হয়ে উঠুক বিশ্বসাহিত্য? সেদিক থেকে ধরতে গেলে মার্কেজের মৃত্যু কখনোই হবে না।