মাহমুদুল হকরে অশরীরী : ঘুম ও আচ্ছন্নতা

স্মৃতি যেন এক সুপ্ত সমুদ্র; নিস্তরঙ্গ, শান্ত; কিন্তু তার নিদ্রার গভীরে সুদীর্ঘকাল নিস্পন্দ হয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া অতীত, আনন্দমুখরিত শৈশব, আলোড়িত প্রেম, অতল দুঃখের পলিমাটি। ঘুমের অতলান্তিক অন্ধকারে তলিয়ে থাকলেও হারিয়ে যাওয়া এইসব রৌদ্রছায়াময় গোপন সুখ-দুঃখের সমুদ্র প্রায়শ আলোড়িত করে আমাদের বর্তমান। অন্তর্গত চৈতন্যের বিপুল অনুভবরাশি ও সংবেদন লুপ্তপূজাবীথির পত্রপুষ্পরাশির মতো দুঃখের বেদিতে তার পূজা সমাপন করে। এসব অদৃশ্য ও অন্তঃপাতি স্মৃতিপুঞ্জ দ্বিধা-থরথর হৃদয়ের ঐশ্বর্যে উন্মেষিত করে সময়সন্ধিপথে ব্যক্তির অপসৃত মনোলোকের অনুভব-উপস্থিতির শিল্পকৌশল রচনা করেন মাহমুদুল হক, প্রায়শই তাঁর গল্প-উপন্যাসে এই সৃজনদ্যোতনা অনুসৃত। স্মৃতিরন্ধ্রে অনুভূতির তীব্র সংবেদ তাঁর কথাসাহিত্যের সময়-পরিসর, প্রতিবেশ-পরিস্থিতি চিহ্ন অঙ্কিত করে শাসিত হয় বর্ণ ও বর্ণান্তরের চিত্রময় দৃশ্যকল্প। অশরীরী উপন্যাসের কাহিনিপুঞ্জও স্মৃতির স্বতঃশ্চল অনুভবগুচ্ছ সময়ের পরিসরে উল্লম্ফিত। স্মৃতিলোকের সঙ্গে কাহিনি আবর্তিত সময়যাপনের রয়েছে অনেকার্থ দ্যোতনাময় সম্পর্ক। মিখায়েল বাখতিন যাকে বলেছেন ‘দ্বিবাচনিকতা’। একদিকে কেন্দ্রীয় চরিত্রের মনোলোকের স্মৃতিভারাতুর অনুভূতিগুচ্ছ, অন্যদিকে যাপিত সময়-পরিস্থিতি চিহ্নের সুগভীর আচ্ছন্নতা পরস্পরিত এবং সমান্তরাল। মনোলোক ও বাস্তব সময়-প্রতিবেশতাড়িত মুক্তিযুদ্ধকালের ঘটনা এ-উপন্যাসে যেন সংকেত-সঞ্চালিত। মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন এবং খেলাঘর উপন্যাসদুটিও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। এ দুটি উপন্যাসের চাইতে অশরীরীর আঙ্গিকগত পার্থক্য হলো চেতনাপ্রবাহের ধারাবাহিক সংক্রাম, যেটি মূলত কেন্দ্রীয় চরিত্র আম্বিয়ার ‘মানসিক আচ্ছন্নতা’র অনুপুঙ্খ অন্তর্বয়ন।
বাখতিনের মতে, দ্বিবাচনিকতা হলো উপলব্ধির নিরন্তর নির্মাণ, মানবিক সত্তার যথার্থ অস্তিত্ব রূপায়ণের জন্য অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির স্তর থেকে স্তরান্তরে যাত্রা। তাঁর মতে, দ্বিবাচনিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া অনুযায়ী চেতনার ভিত্তি হলো অপর সত্তার বোধ। এই অপরতা(otherness) অর্থ সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো উপস্থিতি নয়, কেননা আপাত-দূরত্ব নিরাকৃত হয় গভীরতর ঐক্যের উপলব্ধিতে। অর্থাৎ তাঁর মতে, মানবসত্তার মৌল স্বরূপ দ্বিবাচনিক, সত্তা মানে সম্পর্কের নতুন বিন্যাস Ôself can never be a self-sufficient contructÕ জীবন ও জগতের সঙ্গে অবিরাম সম্পর্ক নির্মাণ, ভেঙে ফেলা এবং পুনর্নির্মাণ। সত্তা ও অপরতার এই সম্পর্ক মূলত সমান্তরাল, সময় ও পরিসরের বিকাশক্রমে (বাখতিন যাকে বলেছেন ‘ক্রনোটোপ’ ( chronotope) এই সম্পর্কের মধ্যে সঞ্চারিত হয় কখনো অভিন্নতা, আবার কখনো বৈপরীত্য। আপন অস্তিত্বের সঙ্গে তখন নির্মিত হয় আপাত-দূরত্ব, স্থানান্তর বা বিনিময়যোগ্য পরিসরে নিজের নিভৃত সত্তার সঙ্গে বহিরঙ্গ অস্তিত্বের একান্ত সংলাপ সৃজন করে। যতক্ষণ এই স্থানান্তর বা বিনিময় সম্পাদিত না হয়, ততক্ষণ তা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে না। সত্তা তাই দ্বিবাচনিকতার আবহে সঙ্গ ও নিঃসঙ্গতা, অস্তিত্ব ও নিরস্তিত্বের দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করতে চায়। অশরীরী উপন্যাসের আম্বিয়ার বিরাজমান অস্তিত্বের সঙ্গে দূরত্ব যেমন নির্মিত হয়, তেমনি মনোলোকে স্মৃতির স্থানান্তরে সে হয়ে ওঠে অধিকতর নিঃসঙ্গ। শেষ পর্যন্ত সে অস্তিত্ব-পরিস্থিতির দ্বান্দ্বিক প্রান্ত অতিক্রম করে জাগ্রত হয় আপন সত্তায়।
স্মৃতি-আক্রান্ত এবং মনোলোকে মানসভ্রমণের নেপথ্য কারণ সম্ভবত মাহমুদুল হকের প্রায় প্রতিটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্রের মধ্যবিত্ত মানসিক সংবেদ, নিষ্ক্রিয়তা এবং জীবন-পরিসর থেকে অপস্রিয়মাণতা। যদিও এসব চরিত্রের মনোজাগতিক আপাত-দূরত্ব অপসৃত হয় গভীরতর ঐক্যের উপলব্ধিতে। বাখতিনের মতে, মানবসত্তার এই মৌল স্বরূপ হলো দ্বিবাচনিক। অর্থাৎ সত্তার সম্পর্ক নির্মাণের নতুন বিন্যাস, পুনর্নির্মাণ। আম্বিয়া চরিত্রের অন্তর্বয়ন এই বিন্যাসের সমীকরণ। সে দায়হীন, ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের গ্লানিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক; অর্থাৎ চাকরিসূত্রে একটি সংবেদনশীল চর্চার মধ্যে তার জীবনযাপন, কিন্তু সে আশ্চর্যরকম নিষ্ক্রিয়; বিস্ফোরণোন্মুখ তরঙ্গসংকুল সময়ের সংশ্রববিচ্ছিন্ন। অথচ মুক্তিযোদ্ধা মন্টু ও বিপুলের মতো তাকেও হারাতে হয়েছে জীবনের সমূহ সুখ ও সম্ভাবনা। কেবল যুদ্ধাক্রান্ত দেশ সম্পর্কে নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও সে ‘গোঁজামিল দেয়া আলস্য-জর্জর পলকা-সমাধানের তলায় নীরবে মাথা পেতে দেয়াই নিজের পরম দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে’ মনে করেছে। স্ত্রী তাহেরা সংসারের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে লংকাকাণ্ডের সূচনা করলেও সমস্ত অভিযোগের বিপরীতে সে সর্বদা নরম মেজাজে, হেসে, ছেলেমানুষি ভেবে খুঁজে নিয়েছে সরল মীমাংসার পথ। কিন্তু আম্বিয়ার অন্তঃচৈতন্যের এই নীরব, নিষ্ক্রিয়, উদ্যমহীন, প্রতিবাদহীন সারল্য সংসারে সুখ বয়ে আনতে পারেনি, নিয়ে এসেছে অনিবার্য ভাঙনের গ্লানি; এমনকি দেশে যখন যুদ্ধের ভয়াবহতা সকলকে দিশেহারা, দুশ্চিন্তাব্যাকুল, উদ্ভ্রান্ত ও উৎকেন্দ্রিক করে তুলেছিল তখনো তাহেরা নিজের একরোখা জিদ বজায় রেখেছে। সন্তানের বন্ধন তাদের মিলনের সুতোয় বাঁধতে পারেনি। এরকম শান্ত নিষ্ক্রিয় আম্বিয়া পাকিস্তানি আর্মির টর্চার সেলে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে যাবতীয় মানবিক অনুভূতির ভোঁতা অন্ধকারে নিমজ্জিত, ভীত, বাকরুদ্ধ। এমনকি মন্টুর সঙ্গে কথা বলতেও সে ছিল দ্বিধান্বিত ও শঙ্কিত। সেই আম্বিয়া উপন্যাসের শেষে তার আকণ্ঠ নিষ্ক্রিয়নিমজ্জিত চৈতন্য থেকে ক্রমশ উন্মোচিত হয়। টর্চার সেলে নিয়ে আসা নতুন মুক্তিযোদ্ধা বিপুলের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার সঙ্গে কথা বলে, জানতে চায় আটকের কারণ। এবং শেষ দৃশ্যে হত্যা করা বাঙালির লাশ মাটিচাপা দেওয়ার জন্য তাকে গর্ত খুঁড়তে বলা হলে, আমরা লক্ষ করি – আম্বিয়া উপলব্ধি করে, মৃত্যুবরণ এর চেয়ে শ্রেয়।
টর্চার সেলে অচৈতন্যপ্রায় আম্বিয়ার স্বল্পতর সময়যাপনই এই উপন্যাসের কালপরিসর, আর অবশিষ্ট গল্পাংশ নিরূপিত হয়েছে আম্বিয়ার প্রগাঢ় ও অন্তর্লীন মানসিক আচ্ছন্নতা-আক্রান্ত স্মৃতিপটে। কেননা শরীরের প্রতিটি প্রত্যঙ্গ নির্যাতনে নিষ্পেষিত হলে আম্বিয়া নিমজ্জিত হয় অতলান্তিক আচ্ছন্নতার কালো অন্ধকারে। তবু হয়তো অস্তিত্বের অপরিমেয় ও অন্তর্লীন শক্তি তাকে ধীরে ধীরে জাগ্রত করে বোধ ও স্মৃতিসঞ্চালিত জীবনপরিসরে :
আচ্ছন্নতা কি মনোরম!
এখন ভাঁজ ভেঙে যাচ্ছে আচ্ছন্নতার, পাটে-পাটে খুলে যাচ্ছে; অপস্রিয়মাণ অন্ধকার একটি-একটি করে তার সব আবরণ খসিয়ে নিচ্ছে।
পাম্পের মটর পোকার মতো উঁ-উঁ করে ডেকে চলেছে, ঘরের ভেতরে দেয়াল, চারটে কোণ, সবই এখন স্পষ্ট দেখা যায়।
অপস্রিয়মাণ অন্ধকার সময়সন্ধিপথে স্মৃতিজাগরিত আম্বিয়ার পারিবারিক ও সামাজিক পরিম-লে রয়েছে বাঙালি মধ্যবিত্তের যাবতীয় সংকট, দ্বিধা, ভাবালুতা ও দোলাচলতা – অর্থ, নারীলিপ্সা, চাকরি, আত্মপ্রতিষ্ঠা, ঠুনকো আত্মসম্মান, স্থূল সংস্কৃতিচর্চা, রাজনৈতিক সংশ্রব এড়িয়ে চলা এবং কূট দুরভিসন্ধির মধ্যে সংসারজীবন নিরানন্দময় করে তোলার মতো বিবিধ বৈশিষ্ট্যচিহ্ন। আম্বিয়া এই স্থূল বাঙালি মধ্যবিত্ত। অবশ্য সে প্রতিনিয়তই চেয়েছে নিরুদ্বেগ, নির্দ্বন্দ্ব ও নিশ্চিত স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন; কিন্তু সামঞ্জস্য রক্ষায় সে সীমাহীনভাবে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার নেপথ্যে রয়েছে সময়-পরিস্থিতি ও বাস্তবের প্রতিকূলতার চেয়ে আম্বিয়ার ব্যক্তিস্বভাবের উদ্যমহীনতা, কা-জ্ঞানশূন্যতার নির্দ্বান্দ্বিক কার্যকারণ। কিন্তু অস্তিত্ব সময়নিরপেক্ষ নয়, এমনকি পরিসরও সময়শূন্য নয়। তাই ব্যক্তিসত্তার সময়পরিসরে সংযোজিত হয় ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, দর্শন এবং অপরাপর বোধের নির্যাস। বাখতিন যেমন মনে করেন, চেতনার ভিত্তি হলো অপরতা, আম্বিয়াও এই অপর সত্তাবিচ্ছিন্ন কোনো উপস্থিতি নয়। আমরা উল্লেখ করেছি – আম্বিয়ার মনোলোক ও বাস্তব সময়-প্রতিবেশতাড়িত ঘটনা যেন সংকেত-সঞ্চালিত। যেমন, আম্বিয়া-তাহেরার সংসারের জটিলতা, যেন তা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বাঙালি জাতির সম্পর্কের বৈপরীত্য। টর্চার সেলে আম্বিয়ার অভিজ্ঞতা :
আম্বিয়া জানে তার নিজের গায়ে এসবের কোনো ছিটেফোঁটা গন্ধ নেই, না থাকলেও ন্যায়বিচার আশা করার মতো মানুষের খোঁয়াড় এটা নয়, নিপীড়নের ব্যাপারে বাছবিচার এখানে অমূলক। ধ্বংসাত্মক কোনো পরিকল্পনার সঙ্গে তার কোনো সংশ্রব থাকলে হয়তো নির্যাতনের মাত্রাটা দু’কাঠি বাড়তো, না থাকলে যে অব্যাহতি পাবে এমন আশা করাও অন্যায়। অন্তত একটা অপরাধে সে অপরাধী, সে বাঙালি।
‘দেশের বিস্ফোরণোন্মুখ রাজনৈতিক পরিস্থিতি’, যা বর্তমান এবং স্মৃতি-উদ্ভাসিত ব্যক্তিগত সাংসারিক জীবনপ্রবাহ, অর্থাৎ অতীতের সময়পরিসর, পরস্পরিত ও একটি অন্তর্লীন সুরের দ্বিবাচনিক শিল্পপ্রকৌশলে সংক্রমিত। ঘটনার উল্লম্ফন ও আকস্মিকতায় আম্বিয়া-তাহেরার বিয়ে এবং পরবর্তী সংসারপরিসরের সংকটবিদ্ধ অস্তিত্ব বিপ্রতীপের সংকেতায়িত প্রান্ত। তাহেরা একরোখা, অনমনীয়, অমার্জিত, নিষ্ঠুর – পশ্চিমা সামরিক শাসকগোষ্ঠীর প্রতিরূপ। অন্যদিকে আম্বিয়া ‘নির্জীব আনুগত্যে’ সমস্ত অত্যাচার মেনে নিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনাকাক্সক্ষায়। তার স্মৃতিলোক আলোড়িত করে উঠে আসা ভাবনাতরঙ্গে উচ্চকিত আপামর বাঙালির মানসঅভীপ্সা :
রোগই হোক, স্বভাবই হোক, দোষ ছিল তাহেরার; কিন্তু বারবার কেন সে পাশ কাটিয়ে গেছে। এর যে একটা সমাধান দরকার, যা হয়েছে অনেক হয়েছে, আর বাড়তে দেয়া যায় না, উদ্যোগ নিতে হয় এবার, কখনোই সে এভাবে ভেবে দেখেনি।

দুই
অশরীরী উপন্যাসের পরবর্তী কাহিনির সময় ও পরিসরের গ্রন্থিসমূহ রূপায়ণের শিল্পসূত্র লক্ষণীয়, বাখতিন যাকে বলেছেন ক্রনোটোপ। এর সূচনাংশেই স্মৃতির অনুপুঙ্খ থেকে বাস্তবে – ‘তারপর দুম করে নেমে এলো মিলিটারি ক্র্যাকডাউন, পঁচিশে মার্চের রাত’ এবং তার পরবর্তী ঘটনা আমাদের অবিদিত নয়। মাহমুদুল হক আম্বিয়ার অভিজ্ঞতার ছদ্মপ্রচ্ছদে তুলে এনেছেন ক্র্যাকডাউন-পরবর্তী ঢাকা শহরের কয়েকটি এলাকা এবং পার্শ্ববর্তী দু-একটি অঞ্চলের ওপর অতর্কিতে সংঘটিত হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের খ-চিত্র। সময় ও পরিসর এখানে বিমূর্ত কোনো ধারণা নয়, এবং চরিত্রাবলির ওপর তাদের প্রভাবও সুস্পষ্ট। পাত্র-পাত্রীদের নিজস্ব অণুবিশ্বে ঘটমান বাস্তবতার প্রভাব থেকে যায় পরবর্তী সময়-পরিসরে। কাজেই আঙ্গিক বা নির্মাণশৈলীর (structure) বিবেচনাতেও অশরীরী উপন্যাসে ক্রনোটোপের ভূমিকা ভেবে দেখা যেতে পারে।
আচ্ছন্নতার ভেতর স্মৃতির অদৃশ্য অন্তর্বয়ন, বাস্তব থেকে স্মৃতিলোকে প্রত্যাবর্তন এবং পুনরায় স্মৃতি থেকে বাস্তবের অভিজ্ঞতালোকে ফিরে আসা – এই আবর্তন-প্রত্যাবর্তন দ্বিবাচনিকতা সূত্রে গ্রথিত। টর্চার সেলে নির্মম নির্যাতনে রক্তাক্ত অস্তিত্বের প্রগাঢ় আচ্ছন্নতার অন্তঃপ্রবাহে আম্বিয়ার স্মৃতিলোকে মূর্ত হয়েছে ভীতসন্ত্রস্ত, পলায়নপর জনস্রোত, মৃত মানুষের গলিত লাশ, আগুনে পোড়া ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ঢাকা শহর এবং এরই মধ্যে কাহিনির অন্তর্স্রোতে উঠে এসেছে ষাটের দশকের প্রগতিশীল রাজনৈতিককর্মী কথাসাহিত্যিক শহীদ সাবের, দিশেহারা পতিতাপল্লির নারীরা। সম্পূর্ণ উপন্যাসেই রয়েছে এসব কাহিনিস্রোতের স্মৃতিচালিত মনোকথনময়তা। যেটুকু স্মৃতিসঞ্চালন-বহির্ভূত বাস্তব তা হলো টর্চার সেল, মন্টু-বিপুলের আত্মত্যাগ ও প্রকৃতিজগতের দু-এক টুকরো অস্ফুট শব্দ। এই অস্ফুট শব্দই এখানে ‘অপর’। যে-শব্দের ক্ষীণ অস্তিত্বের সংস্পর্শে জাগরিত হয় আম্বিয়ার চেতনা ও সত্তা। আম্বিয়া চেতন-অচেতনের আপাত-দূরত্ব অতিক্রম করে উপস্থিত হয় গভীরতর সত্যে :
মানসিক তন্দ্রা কিংবা আচ্ছন্নতার ভেতরে কখনো-কখনো সামান্য একটা শব্দও কতো জরুরি; এই যেমন টুপ করে একটা শব্দের ফোঁটা পড়লো, সেটা মানে দাঁড়ালো ‘আম্বিয়া তুমি -’ তুমি আছো বলেই শব্দটা তোমার কানে গেছে। তাহলে কান আছে। কান আছে, চোখ আছে, নাক আছে, ঠোঁট আছে, মাথা আছে, আছে অনেক কিছুই।
বাখতিনের দ্বিবাচনিকতায় বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের অথবা বর্তমানের সঙ্গে অতীতের যোগাযোগ, সম্পর্ক বা চেতনার স্থানান্তর বা বিনিময় চলে নিরবচ্ছিন্নভাবে। এই সম্পর্কের নিজস্ব কাঠামো সামাজিক ও দার্শনিক প্রক্রিয়াকে সচল রাখে। কেননা, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক পরিসর ক্রমাগত রূপান্তরিত হচ্ছে। আর সম্পর্ক হলো সামাজিক ঘটনাপ্রবাহের সাংগঠনিক কাঠামো, যাকে সময় ও পরিসরের নানান বর্গের মধ্যে বিন্যস্ত হতে হয়। অশরীরী উপন্যাসের কথাবয়ন অনবরত এই সময় ও পরিসরকে অতিক্রম করেছে। টর্চার সেলে ধরে আনা মুক্তিযোদ্ধা মন্টুর কথাবয়নে যেন আমরা তৎকালীন বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষ করি। দেশবিভাগের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক বা নেতিবাচক যা-ই হোক না কেন, পরবর্তী স্বল্প সময়েই বাঙালি জাতিকে সূচনা করতে হয়েছিল অস্তিত্বের লড়াই, কিন্তু একটি সুসংগঠিত আন্দোলন-সংগ্রাম অগ্নিতপ্ত হয়ে উঠতে অতিক্রম করতে হয়েছে দুই দশক। এর নেপথ্যের কার্যকারণসূত্র (অর্থনৈতিক শোষণ, বিপুল জনগোষ্ঠীর এই উর্বর ভূখণ্ডেবাণিজ্যের বিস্তার ও বাজার সৃষ্টি এবং কতিপয় ব্যক্তির দ্বারা তা কুক্ষিগত করা) অনুধাবনের জন্য আম্বিয়া চরিত্রটিকে লক্ষ করা প্রয়োজন। আমরা উল্লেখ করেছি সে নিষ্ক্রিয়, উদ্যমহীন। কিন্তু এই আপাত নিষ্ক্রিয়তার নেপথ্যে তার ছদ্মঅভিজ্ঞতার যে বিবরণ মাহমুদুল হক তুলে এনেছেন তা তৎকালীন বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মনস্তত্ত্বকেই প্রতিফলিত করে :
দেশের বিস্ফোরণোন্মুখ রাজনৈতিক পরিস্থিতির চুলচেরা হিসেবের
মাথাব্যথা না থাকলেও ভয়াবহ উৎকল্পনায় কখনো-কখনো তার গা শিউরে উঠতো ঠিকই। যতোদূর সম্ভব সে গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। মানুষের অভাব নেই দেশে, তার মতো এমন দু’একজন আধমরা নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখলেও কোনো কিছু যাবে আসবে না, আগেই ধরে নিয়েছিল আম্বিয়া। আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে একটা গোটা দেশ, তার জাতি, প্রতি মুহূর্তেই এমন তরঙ্গ-সঙ্কুল যে উদ্বেগকাতর না হয়ে কারো কোনো উপায় নেই। কেবল তারই কোনো কিছুর দায়ভাগ ছিল না, ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের গ্লানিতে সে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল, যেন প্যাচপেচে কাদায় জুবড়ে আছে, কিছুতেই মাথা তোলা সম্ভব নয়।
অবশ্য অধিকাংশ বাঙালির ওপর এই দায় চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। কেননা, যুদ্ধের মতো কোনো সশস্ত্র সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র এবং সর্বোপরি অপ্রস্তুত জনগোষ্ঠীর পক্ষে কেবল দেশপ্রেমকে সম্বল করে কীভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্ভব? – এ-প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে। তথাপি, কেবল দেশপ্রেমের আবেগকে সম্বল করেই, অস্বীকার করার উপায় নেই, ক্র্যাকডাউনের পরপরই যে স্বল্পসংখ্যক দুঃসাহসী, অপরিণামদর্শী মুক্তিকামী বাঙালি সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আত্মাহুতি দিয়েছিল, মন্টু-বিপুল তাদেরই প্রতিনিধি। এবং এদের অধিকাংশেরই কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না। মন্টু কথা বলতে পছন্দ করে, টর্চার সেলের পরিবেশে, উলঙ্গ-বিধ্বস্ত আম্বিয়া, বাইরে পাকিস্তানি আর্মির সতর্ক পাহারা এবং প্রতিনিয়ত হত্যার বিভীষিকা তাদের তাড়িত করলেও সে কথা বন্ধ করেনি। ভীতসন্ত্রস্ত আম্বিয়াকে দেখে তার মনে হয়েছে ‘একজন নির্ভেজাল প্রভুভক্ত নাগরিক’। তাই সে বলে, ‘তা কি ফায়দাটা পেয়েছেন আপনি তাতে? কই রেহায় তো পেলেন না? ভেবেছিলেন গায়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে মানুষ বুঝে তারপর মারবে ব্যাটারা, ভপ্! শালারা ময়দানে নেমেছে হোলসেল সøাটার করার জন্য, বোঝেন না কেন!’ সত্যিই আম্বিয়া তখন উপলব্ধি করেনি, তার সত্তা জাগ্রত হয় আরো ক্ষতি স্বীকারের পর, কিন্তু মন্টু ঠিকই বুঝেছিল। আর তার উপলব্ধির কথাবয়নে আমরা আবিষ্কার করি শোষিত-নির্যাতিত সেই মাতৃভূমির কী করুণ ও নির্মম সত্য রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে :
দ্যাখ শালারা দুনিয়ার দিকে চোখ তুলে একবার তাকিয়ে দ্যাখ; তা দেখবে না, চোখে ঠুলি লাগিয়ে দিনের পর দিন একটা বাসি মড়াকে আগলে বেড়াচ্ছে কেবল। চোটপাট কতো, শালাদের সবই বিখ্যাত, সবই এশিয়ার সেরা; সদরঘাটের বাকল্যান্ড বাঁধও এশিয়ার সেরা, পোস্তগোলার আটাকলও এশিয়ার সেরা। আবে গা-ু, এশিয়ার আর কদ্দুর দেখেছিস, সদরঘাটের বাকল্যান্ড বাঁধ দিয়ে এখনো শালার দুনিয়া মেপে চলেছিস, আহাম্মকের দল! স্রেফ ভাঁওতাবাজি দেশটাকে করে তুলেছে একটা সারগাদা, আঁস্তাকুড়; এক এক শালা আসবে আর দেশটাকে তার বাপদাদার জমিদারি বলে মনে করবে, শালাদের বস্তাপচা ফতোয়া শুনতে শুনতে কানমাথা ঝালাপালা হয়ে গেছে মানুষজনের।
লক্ষণীয় যে, টর্চার সেলে মন্টুর উপস্থিতিও ছিল স্বল্পতর সময়ের জন্য। মন্টুর সঙ্গে আম্বিয়ার কথাবয়নও উঠে এসেছে স্মৃতিরন্ধ্রপথে। নিজের অনুভূতি কোনোদিনই প্রখর ছিল না বলে আম্বিয়ার ধারণা, তবু আশ্চর্য যে, ‘এখানে (টর্চার সেলে) আসার পর থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে যাবতীয় অনুভূতির ধার মরে গেছে।’ আম্বিয়ার এই অনুভূতি নিতান্তই শারীরিক। শরীরী অনুভূতি ও বোধ ক্রমশ লুপ্ত হয়ে অতলান্তিক আচ্ছন্নতার মৃদু ও অস্ফুট তরঙ্গে জাগ্রত হয় তার সুপ্ত সত্তার ভেতরের সংগুপ্ত সত্তা, সমাজসংসার ও সময়-পরিসরের আটপৌরে মানবজীবনের নিভৃতে লুকানো গভীর উপলব্ধি। উপরিস্তরের ‘অনুভূতির ধার মরে’ মনোরম আচ্ছন্নতার ভেতর এক ভিন্নতর মানবচৈতন্য ও সত্যের সংকেত এ কারণে অশরীরী।

তিন
অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির স্তর থেকে স্তরান্তরে যাত্রার কথান্যাস রূপায়ণসূত্রে অশরীরী দ্বিবাচনিক। কাহিনি-বর্ণনায় মাহমুদুল হকের অশরীরী মনোকথনময় চেতনাপ্রবাহরীতির সংশ্লেষে দ্যোতিত। কিন্তু মনোকথনময় চেতনাপ্রবাহে স্বতঃশ্চল স্মৃতির আবর্তনে মানবসত্তা উন্মোচন ও শরীরের উপরিকাঠামোর গভীরে প্রোথিত চৈতন্যের ভিন্নতর মানবসত্যে পৌঁছানোর জন্য মাহমুদুল হকের শব্দনির্বাচন প্রতীকী তাৎপর্যে উপনীত। অশরীরী উপন্যাসের গল্পাংশ সূচিতই হয়েছে ‘মানসিক তন্দ্রা কিংবা আচ্ছন্নতা’র ভেতর মানবচৈতন্যের উন্মোচনে। এ-উপন্যাসে, লক্ষণীয়, ‘আচ্ছন্নতা’ এবং ‘ঘুম’ ও ঘুম-অনুষঙ্গবাহী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে বারবার। শব্দদুটি এ-উপন্যাসে কখনো ব্যবহৃত হয়েছে শারীরবৃত্তীয় অর্থারোপে, কিন্তু প্রায়শ তা প্রতীকার্থে উজ্জ্বল ও ব্যঞ্জনাময়। যেমন :
রাত্রে ঘুম হয় না ভয়ে, তবু চোখ বন্ধ করে মড়ার মতো পড়ে থাকি। এক-একদিন কানের পাশে মুখ নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে ও বলতে থাকে – তোকে খুন করবো, তোর রক্ত খাবো। ধড়ফড় করে উঠে বসি, দেখি ও ভালোমানুষের মতো ঘুমুচ্ছে।
এক-আধদিন নয়, নিত্য-রোজ। ওর ঘুম আমি খুব ভালো করেই চিনি। মনে করে আমি বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছি। ইচ্ছে করে ও আমাকে এইভাবে ভয় দেখায়, তারপর ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে।
আম্বিয়ার স্মৃতিরন্ধ্রপথে জেগে ওঠা একমাত্র বোন আঞ্জুমের জীবনের করুণ গল্পে ‘ঘুম’ যেন সমগ্র কাহিনির অন্তর্স্রোতে অস্তিত্বপরিস্থিতির নিয়ন্ত্রক। পুকুরে ডুবে মৃত্যুবরণ করে আঞ্জুম। টর্চার সেলে আম্বিয়ার আঘাতজর্জরিত আচ্ছন্নতার মধ্যে বোনের স্মৃতি তার আতঙ্কিত, অনিশ্চিত ও শ্বাসরুদ্ধ সময়সংবেদে অস্তিত্বপ্রশ্নে সংকটময়। তার নিদ্রা ভঙ্গ হলে ‘দুর্জ্ঞেয় আশঙ্কায় রাত্রির ঘুটঘুটে অন্ধকার বিভীষিকা হয়ে ওঠে। আতঙ্কে, অনিশ্চয়তায়, হীনমন্যতায় প্রতিটি মুহূর্ত এমন শ্বাসরুদ্ধকর যে, আম্বিয়ার মনে হয় এরকম দগ্ধে-দগ্ধে যন্ত্রণা পোহানোর চেয়ে দুম করে অপঘাতে মরাও অনেক উপাদেয়।’ ঘুম এখানে ‘মরা’, অর্থাৎ মৃত্যুর সমার্থক। কিন্তু এই মৃত্যু-অনুভূতি অন্তর্সত্তার শরীরীবোধে ঘুমের স্থানিক পরিচয় এবং তা শরীরীসংবেদনার বাইরে বিস্তৃত হওয়ার অনুভবে রূপান্তরিত হয়েছে সামগ্রিকতায়। এখানে ‘আচ্ছন্নতা’ এবং ‘তন্দ্রা’ শব্দদুটিও মনোযোগ দাবি করে। কেননা, আচ্ছন্নতা বা তন্দ্রা যতটা শারীরিক, ততটাই সংবেদিত শরীরী বোধে। ভারতীয় দার্শনিক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর সাবজেক্ট অ্যাজ ফ্রিডম (Subject As Freedom) গ্রন্থে যেমন বলেছেন ÔThe bodily feeling is but the felt bodyÕ (শারীরিক সংবেদনা সংবেদিত শরীর ছাড়া আর কিছু নয়। – দ্র. অরিন্দম চক্রবর্তী) যেমন :
আচ্ছন্নতা কি মনোরম, দিনের আলো এখন তার খোসা ছাড়িয়ে ছোট্ট একটা লিচুর মতো গালে পুরছে। তন্দ্রার ভেতরে খুব ভালো থাকে আম্বিয়া; এ পর্যন্ত জীবনযাত্রার নামে যতো আবর্জনা স্তূপাকার করেছে দিনের আলোয় তাতে ঝাঁকে-ঝাঁকে কাক এসে বসে, পায়ের নোখ দিয়ে আঁচড়ায়। তন্দ্রা ছুটে গেলেই সাঁড়াশির মতো তাকে চেপে ধরে আতঙ্ক। এটা এমনই একটা জায়গা, যেখানে জীবনের সব সার্থকতা ধুলোয় গড়াগড়ি খায়।
কিন্তু মৃত্যু প্রাণচিহ্নহীন। মৃত্যুর অন্ধকার অন্তঃপুর থেকে ফেরার কোনো সুযোগ নেই। উল্লেখ করেছি, ঘুম মৃত্যুর সমার্থক, যদিও এ দুটি জ্ঞানই প্রত্যক্ষ বস্তু। ঘুম প্রত্যক্ষের বিষয়বস্তু একটি হর্ষ বা আনন্দের বোধ (পাভলভের মতে, নিদ্রা মস্তিষ্কের কোষগুলোকে ক্লান্তি থেকে রক্ষা করে), মৃত্যু প্রত্যক্ষের একটি বিষাদময় মনোবিজ্ঞান। কিন্তু ঘুম এমনই প্রত্যক্ষের জ্ঞান, যা কেবল শরীরী সংবেদনার একটি বিশেষ স্তর। শরীর তত্ত্ববিদ আইভান প্রেত্রোভিচ পাভলভ (১৮৪৬-১৯৩৬) পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন, নিদ্রা যখনই আসে, তখন আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সর্বোচ্চ অংশ ও মধ্যমস্তিষ্ক বাধ অবস্থায় উপনীত হয়। নিদ্রাকে তিনি বলেছেন ‘পরিব্যাপ্ত বাধ’। তাঁর মতে, ‘অভ্যন্তরীণ বাধ এবং নিদ্রা হল একই জিনিস, একই প্রক্রিয়া।’ অভ্যন্তরীণ এই ঘুম – যেটি, বলা যেতে পারে, মূলত পাকিস্তানি সামরিকজান্তার নির্মম শোষণ, পৈশাচিক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ – এই অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত অস্তিত্বপরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য ঘুম নয়, ঔপন্যাসিক প্রত্যাশা করেছেন জাগরসত্তা :
এক একটা রাত কি নিদারুণ দীর্ঘ। ঘুমের জন্য আম্বিয়ার তেমন মাথাব্যথা নেই, বরং জেগে থাকার অভ্যেসটাকেই সে ভালোমতো রপ্ত করতে চায়, ঘুমের ঘোরে একটা কিছু হয়ে গেলে সে টেরও পাবে না। ঢাকা এখন মৃতের শহর। কোনো চিহ্নই নেই প্রাণের। পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলেই মনে হয় – যাক এ লোকটি তাহলে এখনো বেঁচে আছে। একদিন শোনে অমুক নেই, একদিন শোনে তমুক লোকটির মাথার খুলি উড়ে গেছে; এইসব শোনে, তারপর সেই লোকটির কথা মনে আসে। পরিচিত সকলের নামই প্রায় ভুলে যেতে বসেছে আম্বিয়া।
কিন্তু দ্বিবাচনিকতা হলো উপলব্ধির নিরন্তর নির্মাণ, অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির স্তর থেকে স্তরান্তরে যাত্রার সূত্রে মানবিক সত্তার উন্মোচন। ঘুম এবং আচ্ছন্নতা এই উপন্যাসের সময় ও পরিসরকে একটি মানবিক অস্তিত্বপরিস্থিতিতে উত্তীর্ণ করেছে। ঘুম মৃত্যু, ধ্বংস, হত্যাযজ্ঞের সমার্থক। আচ্ছন্নতা মনোরম, স্মৃতিকল্পাশ্রিত। এবং প্রকৃতি-শুশ্রƒষায় স্মৃতিকল্পাশ্রিত এই আখ্যানে ঘুম ও আচ্ছন্নতার জাগর উপলব্ধি ও অনুভূতি মানবসত্তার ভেতরে সংগুপ্ত সত্তাকে মানবিক স্তরে উপনীত করেছে :
আন্দাজ তার ঠিকই। দূরে নদী। ধাতব পাতের মতো মাঝে-মাঝে চকচক করে উঠছে, দু’ভাগে ঘিরে ফেলেছে অন্ধকারকে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, কেবল ঝিল্লিরব। ঝিল্লিরব ছাড়া কোনো দৃশ্য নেই। ঝিল্লিরব ছাড়া কোনো বেদনা নেই। ঝিল্লিরব ছাড়া কোনো স্মৃতি নেই। কোনো স্মৃতি নেই, স্মৃতির বেদনা নেই, বেদনার হাড় নেই, বেদনার মাংস নেই, ঝিল্লিরব ঝিল্লিরব-ঝিল্লিরব ঝিল্লিরব –
আম্বিয়ার পাছায় একটা লাথি পড়লো ধপাস করে, ‘কোদাল মার শালা, কোদাল মার!’
গর্ত থেকে উঠে আসে আম্বিয়া। আচ্ছন্নতা কি মনোরম, মনে তোলপাড় করে একথা। আচ্ছন্নতা কি মধুর! সারা শরীর উৎকর্ণ হয়ে বলে – আমাকে আচ্ছন্নতা দাও, আমাকে আচ্ছন্নতা দাও!
হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাত জোড় করে আম্বিয়া বললে, ‘আমাকে গুলি করে মারুন -’

চার
প্রশ্ন উঠতেই পারে, আম্বিয়া-তাহেরার ব্যক্তিগত জীবনের কথান্যাসের প্রাধান্যের কারণে এ-কাহিনির সময়পরিসরের প্রতি ঔপন্যাসিক অনিবার্য দায়বোধকে অস্বীকার করেছেন, রাষ্ট্র ও জাতির মর্মন্তুদ সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহত্তর জীবনের রূপবৃত্তান্ত হয়ে উঠতে পারত উপন্যাসটি, মাহমুদুল হক সেদিকে দৃষ্টিপাত করলেন না। কিন্তু সেখানে বিকল্প প্রশ্নও থেকে যায়, তা হলো, আমরা পাঠক বা সমালোচক হিসেবে একটি উপন্যাসে কী চাই, কতটুকু চাই?
অশরীরী উপন্যাসের কথাবয়ন ও অন্তর্বয়নে ঔপন্যাসিক সন্দর্ভের এমন একটি গদ্য ও বিকল্প আদল নির্মাণ করলেন, যার স্বতঃস্ফূর্ত প্রবহমানতাই ধীর-মন্থরভাবে আধেয়কে স্পষ্ট করে তোলে। হত্যা করা বাঙালিদের লাশ পুঁতে ফেলার জন্য গর্ত খুঁড়তে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে আম্বিয়ার আত্মজাগরণ। অপ্রস্তুত ও অপ্রশিক্ষিত জাতির ওপর যুদ্ধের ভয়াবহতা চাপিয়ে দেওয়ার সেই অমানিশাকালে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিভীষিকার মধ্যে বাঙালির এই আত্মজাগরণই বাস্তব। আলস্য, মেরুদ-হীনতা, উদ্যমহীনতা, নিস্পৃহতা ত্যাগ করে বাঙালি জাতিসত্তার এই জাগর চৈতন্যই মাহমুদুল হক নির্মাণ করেছেন তাঁর ব্যতিক্রমী গদ্যে।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১. দেহ গেহ বন্ধুত্ব ছটি শারীরিক তর্ক, অরিন্দম চক্রবর্তী, অনুষ্টুপ, কলকাতা, ২০১১।
২. মানব মন ও মনোবিজ্ঞান, কে. প্লাতোনভ, সম্পাদনা অরুণ দাশগুপ্ত, বিংশ শতাব্দী, কলকাতা, ২০০২।
৩. বাখতিন : তত্ত্ব ও প্রয়োগ, তপোধীর ভট্টাচার্য, পুস্তক বিপণি, কলকাতা,
১৯৯৬।