মাহমুদুল হকের অনুর পাঠশালা : কুয়াশাধূসর সকালের কাব্য

আবু নোমান
মাহমুদুল হকের সমাজ-সংস্কৃতি বৈষম্যের মনস্তাত্ত্বিক গল্পের উপন্যাস অনুর পাঠশালা। কেউ বলেন কাব্যধর্মী, কেউ কাব্যাক্রান্ত। মাহমুদুল হকের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস এটি। এর মধ্যে পঞ্চমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছে বইটি। প্রথম প্রকাশের সাল ১৯৭৩। তখন এর নাম ছিল যেখানে খঞ্জনা পাখী। অবশ্য বইটি লেখা হয়েছে এরও অনেক আগে। ১৯৬৭ সালের জুলাইয়ে। বাবাকে উৎসর্গ করা হয়েছে উপন্যাসটি।
৯১ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি ১১টি অধ্যায়ে বিন্যসত্ম। উপন্যাসের আঙ্গিকগত বিবেচনায় মাহমুদুল হক তাঁর অনুর পাঠশালা নিয়ে বিসত্মর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, অন্তত কয়েকটি অধ্যায়ের সংক্ষিপ্ততা সে-কথাই বলে।
অনু উপন্যাসের নায়ক। কিশোর বয়সী অনুর বাবা হাইকোর্টের প্রভাবশালী উকিল। মা সংসারের এক অতৃপ্ত নারী। বাবা-মায়ের সম্পর্ক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতায় ভরা। বাবা খুনি ও পরনারীতে আসক্ত। তাই অনুর মা বাবার সংসার ছেড়ে যেতে চান। স্বাধীনভাবে চাকরি করার অভিপ্রায়ে সুদর্শন এক যুবক শিক্ষকের কাছে ইংরেজি শেখেন বাড়ির ওপরতলার নিভৃত এক কক্ষে। সারাদুপুর মা ইংরেজি শেখেন। আগে অনুকে যেমন সময় দিতেন, পরবর্তীকালে তা পারেন না।
অনুদের বিশাল বাড়ির পাশে বসিত্ম। সেখানে নিম্নশ্রেণির মানুষের বাস। তাই অনুর প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। কিন্তু অনুর মন ঘরে টেকে না। ছটফট করে, বেরিয়ে আসতে চায়; হতে চায় স্বাধীন, বন্ধনমুক্ত। উপন্যাসে যেভাবে বলা হয়েছে, ‘গরম হাওয়ার হলকা চোখে ছোবল মারে বলে এই সময় জানালায় দাঁড়ালেও অনুর তেমন ভাল লাগে না। ঝিমিয়ে পড়া ওলবড়ি গাছ, ঝলসানো কাক, ঘুঘু ও অন্যান্য পাখির ডাক, তপ্ত হাহা হাওয়া। সবকিছু গনগনে উনুনে পোড়া রুটির মত চিমসে গন্ধে ভরিয়ে রাখে। লামাদের বাগানে বাতাবি লেবুর ঝোপের পাশে আচ্ছন্ন ছায়ায় পাড়া-বেপাড়ার দস্যুরা পাঁচিল ডিঙিয়ে এই সময় ব্রিং খেলে, জানালায় দাঁড়ালেই সব দেখা যায়।’
বসিত্মর ঘটনাবলি অনুকে নাড়া দেয় ভীষণভাবে। ‘খুচরো খুচরো ঝগড়া, আলগা মারপিট, এইসব শুরু হয় এক এক সময়। … দিনের পর দিন সবকিছু প্রায় ধরাবাঁধা নিয়মে নির্বিবাদে চলতে থাকে।
দেখা যায় লামাদের বাগানের জলেশ্বর মালী আর মালীবৌকে। বাগানের দক্ষিণ কোণে তাদের বাঁশের একচালা ঘর। … সাধারণত ভরা হাঁ হাঁ নির্জন দুপুরে আলগা বুকপিঠে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে দু’জন। … মালীবৌয়ের বুক শাদা ধবধবে।’
আনমনে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর অনুর মনে তখন নানা ভাবনা। ভাবে, ওদের ঘরটি কী প্রশান্ত, ঠান্ডা-কুলকুলে। গাল পেতে শুয়ে থাকা যায়। অগোচরে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়া যায়।
ছাদে যেতে অনুর ইচ্ছা হয়, কিন্তু সেখানেও বাধা। লামাদের এত সুন্দর বাগানে যেতে পারে না অনু, বারণ রয়েছে। মনটায় তার তীব্র দহন, যন্ত্রণাক্রান্ত। সেগুলো অনুর পছন্দের বিষয়। অথচ মা বলেছেন, ‘ঐসব হাঘরে ইতরদের সঙ্গে তোর অনেক তফাৎ। … তোর সবকিছু সাজে না। ভাল না লাগলে রেকর্ড বাজিয়ে শুনবি। ছবি আঁকা আছে, গল্পের বই পড়া আছে, ঘরে বসে যা ইচ্ছে করতে পারিস, কেবল টোঁ-টোঁ করে ঘোরা চলবে না।’
এই পরিসরে অনুর কিশোর হয়ে-ওঠার গল্প লেখক প্রাণবন্ত বর্ণনা করেছেন।
‘একসময় সারাদিন মেকানো নিয়ে পড়ে থাকতো সে; মেকানোর পর টিকিটের অ্যালবাম। ডাকটিকিটের পর এলো বই পড়ার নেশা। তারপর ছবি আঁকা। ‘আফ্রিকার জঙ্গলে’, ‘অভিশপ্ত মমি’, ‘মিশমীদের কবচ’, ‘ছিন্নমস্তার মন্দির’ খুবই প্রিয় বই ছিলো এই কিছুদিন আগেও। এখন ভালো লাগে ‘আম আঁটির ভেঁপু’। বালিশ ভিজে যায়।’ ধীরে ধীরে অনু বয়সে ও মনে-মননে বড় হতে থাকে।
বাবা-মা দুজন তাঁদের নিজস্ব ভুবনের বাসিন্দা। অনুর প্রতি তাদের ভ্র‍ুক্ষেপ নেই। অনু একা বাড়িতে বন্দিজীবনের এক তীব্র যাতনা-ঘৃণা নিয়ে বেড়ে ওঠে। তার নিজের কাছে মনে হয়, সে একটা মসত্ম বাড়ির খোলের মধ্যে বন্দি। আঠারো-উনিশটা ঘর নিয়ে পুরনো বিশাল দোতলা এই বাড়ির ছাদ এত উঁচু মনে হয় যেন এর ওপর কোনো আকাশ নেই। নিঃশব্দ এই বাড়ির ভেতরে সবাই একা একা। মায়ের জগৎ হচ্ছে বাড়ি সাজানো এবং অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে নিজের ভেতরের তীব্র ইচ্ছাগুলো না-পাওয়ার বেদনায় একসময় ধীরে ধীরে ফ্রিজের ঠান্ডা বোতলের মতো ঘেমে ওঠে, গুমরে উঠতে থাকে অনু – ‘মা কোনো এক মরা নদী’। ইচ্ছেরা সব জলেশ্বর মালী। ইচ্ছেরা সব এক-একটা চন্দনের পুরনো কৌটো। কত কী ভাবে!
অনুর মা বাড়ির পরিচর্যায় ব্যসত্ম থাকেন। একই ধরনের সৌন্দর্য মনকে সবসময় আলোড়িত করে না। মা সে-কথায় একশ ভাগ বিশ্বাসী। অ্যাকোয়ারিয়ামগুলোয় নিত্যনতুন বিচিত্র মাছের প্রয়োজন। আগের মতো মেথিলিন বস্নুতে মাছগুলোকে নিয়মিত চোবানো হয় না। ‘… সোর্ডটেল আর বস্ন্যাকমলি বাচ্চা পাড়ছে আর গপাগপ গিলছে, এ্যাঞ্জেল ফিশ মরে যাচ্ছে একের পর এক।’ মায়ের সার্বক্ষণিক চিন্তা এই বিষয়গুলো নিয়ে।
অনু তার বাবাকে সহ্য করতে পারে না। তার বাবাকে সে ভাবে, আসত্ম একটা শয়তান। প্রথমে ভয় করতো, তারপর ঘৃণা। বাবাকে অনেক দূরের মানুষ বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে অনুর বাবা তার মাকে এসে বলে, ‘একটা শক্ত খুনের আসামীকে বেকসুর খালাস করিয়ে এলুম।’ – কথাগুলো শোনার পর তার বাবাকে খুনি বলে মনে হয়।
অনুর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রুচিরও পরিবর্তন হতে থাকে। বড় হওয়া ও রুচির স্বাদ বদলানো মাহমুদুল হক অল্প কয়েকটি বাক্যে বলে দিয়েছেন। ‘… দুপুরেও অনু অনেকক্ষণ ছটফট করতে করতে একসময় আগের দিনের মতোই আবার ফরাশে ঘুমিয়ে পড়লো। স্বপ্ন দেখলো লামাদের বাগানে আমগাছের মগডালে পা ঝুলিয়ে বসে লালপেড়ে শাড়ি পরা মা। গলার ওপর থেকে কেটে বাদ দেয়া, সেখানে একটা কাসেত্ম।
সে দাঁড়িয়েছিল গাছের ঠিক নিচে। ওপর থেকে মা তার গায়ে থুথু করে থুতু দিলো। দাউ দাউ করে শরীরে আগুন ধরে গেল। … দমকা হাওয়া। হৈহল্লা হৈহল্লা হৈহল্লা -।’ এভাবেই অনুর যুবক হয়ে ওঠা।
উপন্যাসের জন্য কাহিনি অপরিহার্য। অনুর পাঠশালায় যে-কাহিনি, সেটি উচ্চমধ্যবিত্তের বৈভবের মিথ্যে দাপট এবং নিম্নবিত্ত অনার্যের ক্ষয়িষ্ণুতার আলেখ্য। এর মাঝে উঠে এসেছে উচ্চমধ্যবিত্তের ভড়ংপনা-হ্যাংলামি এবং নিম্নবিত্তের আত্মমর্যাদার এক সূক্ষ্ম-সৌকর্য পর্দার আবরণ। এই কাহিনির গভীরতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহবান লেখকের। ‘কোনো একদিন ঝনঝনে থালার মত দুপুরে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে একটা পাখি দারুণ চিৎকার করে উঠলো; কানে বাজলো, এসো অনু – এসো।’
অনু বেরিয়ে পড়ল মাকে লুকিয়ে। বসিত্মর শিশু-কিশোরদের সঙ্গে তার মেলামেশা শুরু হলো। ওদের কারো নাম ফকিরা, কারো নাম টোকানি, গেনদু, লাটু, ফালানি, মিয়াচাঁন এবং আরো অনেক। অনু তার মার্বেলগুলো তাদের দেয়। ভাব-ভালোবাসা তৈরি হয়। কিন্তু রুচিতে তাদের পার্থক্য-ভেদ-বিভেদ থাকেই। মাহমুদুল হক এই বিভেদকেও এঁকেছেন তাঁর কাব্যিক এক অসাধারণ কুশলতায়।
‘মিয়াচাঁন চিকন গলায় গান জুড়লো –
নাহে নোলক কানে ঝুমকা
মাইয়া একখান বডে
নদর গদর চলে মাইয়া
ফুশুর-ফাশুর রডে।’ – কী সহজ-সরল উপস্থাপনা।
‘হি হি করে হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে ধরে বললে, ‘এলাগ ছেরিগ দুদে বান্দনের জামা! আয়না মিয়াচাঁন তরে লাগায়া দেহি!’
এভাবেই উচ্চমধ্যবিত্তের শুচিতাবোধের আবহে বেড়ে ওঠা কিশোর অনু নিম্নশ্রেণির ভেতরে থাকা সহজাত খিসিত্ম-খেউড়, যৌনতা ও হাস্য-কৌতুকের মুখোমুখি হয়।
এর মধ্যে চামারপাড়ার কিশোরী সরুদাসীর সঙ্গে পরিচয় হয় অনুর। সরুদাসী পেয়ারা খেতে খেতে এই ছেলেদের সামনে দিয়েই যায়। গেনদু ও মিয়াচাঁন ওর হাত থেকে পেয়ারা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালায়। সরুদাসী তাদের দিকে ঢিল ছুড়ে গালাগালি দিতে এবং কাঁদতে থাকে। অনুর সামনেই ঘটে ঘটনাটি। অনু পেয়ারা কিনে দিতে চাইলে সরুদাসী খুশি হয়। পেয়ারা না পেলে মিছরি হলেও চলবে বলে জানায় সরুদাসী।
সরুদাসীকে এ-উপন্যাসের নায়িকা বলা যেতে পারে। তার বাবা মুচি, মা ধাইগিরি করে। বয়সে প্রায় সমতুল্য হলেও অত্যন্ত বাকপটু ও যৌনতা বিষয়ে বেশ পাকা। বোঝা যায় এ-জ্ঞান পেয়েছে তার মায়ের কাছ থেকে। সে একটির পর একটি অশস্নীল কথা বলতে থাকে অবলীলায়। অনু নিশ্চুপ থাকে। সরুদাসীর কাছে তাকে অনেক অনভিজ্ঞ ও বোকা মনে হয়। মিছরি কিনতে গিয়ে সে অনুকে সাবধান করে, যেন সতর্ক থাকে। কিনে আনলে বলে, দোকানদার রতিরঞ্জন পসারি তাকে বেছে বেছে খারাপ মিছরি দিয়েছে। দোকানদারের সততা সম্পর্কে তার মন্তব্য হচ্ছে – ‘ভালো বাছতে পারিসনিরে, হুঁশো পেয়ে ঠকিয়ে দিয়েছে। আমি যদি যেতুম তাহলে আর ফাঁকিবাজি চলতো না। … বেহায়ার রাজা আশপাশের ধুমসী চাকরানী ছুঁড়িগুলোর মাথা ওই-ই তো খাচ্ছে। জামা তুলে গা দেখালে দুটো বাতাসা, গায়ে হাত দিতে দিলে তেল-সাবান, কম নচ্ছার ওটা। … আমার কাছে কিন্তু পাত্তা পায় না, হু। আমাকে কি বলে জানিস? বলে তুই এখনো এক বাতাসা, দু বাতাসার যুগ্যি হস নি।’
সরুদাসীর এইসব কথা অনু মগ্ন হয়ে শোনে ও ভাবতে থাকে। সরুদাসী অনুর সুন্দর মুখশ্রী ও চালচলনকে পছন্দ করে। বলে, ‘তুই ওইসব হা-ঘরে ছোটোলোক ছেলেদের সাথে খুব মাখামাখি করিস, নারে? কুটোকাটাগুলো সব পচা জাতের, তোর ঘেন্না করে না? তুই কতো ভালো! কতো সুন্দর! আমি যদি তোর মতো হতে পাত্তাম।’
কথাগুলো নিশ্চয় ভালো লাগে অনুর। অনুর ভালো লাগে সরুদাসীকে। সরুদাসীর কথা বলার ধরন, পাকা গিন্নির মতো আচরণ আর ঝকঝকে দাঁতগুলো। সরুদাসীর প্রশংসায় অনুর নিজের মধ্যেও স্বাতন্ত্র্যবোধ জেগে ওঠে। একসময় মিশুক অনু বলে, ‘আমি ঘেন্না করি ওদের! ওরা লোভী হ্যাংলা।’
সরুদাসী আশেপাশের পাড়ার অনেক গোপন খবর রাখে। সেগুলো সে অনুকে শোনায়। ‘চারমানবাবুর ছোটো মেয়েটার না বিয়ে না হতেই পেট হয়েছে। … মাকে বলে কিনা পেট ফেলে দিতে পারলে পঁচিশ টাকা দেবে। … ইশ, কী উঁচু নাকই না ছিল ছুঁড়িটার।’ কথা বলতে বলতে একসময় বৃষ্টি শুরু হয়। দৌড়ে তারা একটি দোকানের ঝাঁপ ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে। দোকানের ভেতর কেউ নেই। সরু আর অনু। সরু অনেক কথা বলতে থাকে। অনু কখনো কখনো বিব্রত হয়। আবার মজাও পায়। যেমন, ‘সরুদাসীর পরণে শাড়িছেঁড়া ফালি লুঙ্গির মতো জড়ানো। গায়ে ঘটির মতো ফোলাহাতা ছিটের বস্নাউস, যার একটাও বোতাম নেই, নাভির উপরে গিঁটমারা। কোমরে কড়িবাঁধা লাল ঘুনসি। ভিজে কাপড়ে ছুটতে গিয়ে পিছনের দিকে খানিকটা ফেঁসে গিয়েছিল। সরুদাসী ছেঁড়া জায়গায় হাত রেখে হঠাৎ মুখ কালো করে তিরস্কারের সুরে বললে, ‘তুই কী অসভ্যরে, হাঁ করে আমার পাছা দেখছিলি বুঝি এতোক্ষণ?’
সরুদাসীর খেলার সাথি বিশুয়ালাল, হরিয়া। তাদের কথা অনুকে শোনায় সে। হরিয়া তার সঙ্গে কী গু-ামি করে তা-ও সে বলে অনুকে। সরু আরো বলে, ‘তোকে সব শিখিয়ে দেবো। বাবুদের বাগানে কাঁটামুদি আর ভাঁটঝোপের ভেতর আমার খেলাঘর পাতা আছে, সেখানে তোতে আমাতে মাগ-ভাতার খেলা খেলবো। আমি মিছিমিছি চান সেরে ন্যাংটো হয়ে কাপড় বদলাবো, তুই চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকবি। … তুই মিথ্যে মিথ্যে রাগ করবি। বলবি, মেয়েটা কেঁদে কেঁদে সারা হলো সেদিকে
খেয়াল হলোন নচ্ছার মাগীর, মাই দিতে পারিস না, এইসব। … খেয়ে-দেয়ে দুজনে পাশাপাশি শোবো। তুই রাগ করে চলে যাবি। তারপর মিছিমিছি তাড়ি খেয়ে মাতলামি কত্তে কত্তে এসে আমাকে রানডি মাগী ছেনাল মাগী বলে যাচ্ছেতাই গাল পাড়বি।’
অনু বকাবকি করতে রাজি হয় না। তখন সরু বলে, ‘দূর বোকা! খিসিত্ম-বিখিসত্ম না করলে, মেরে গতর চুরিয়ে না দিলে, তোর মাগী ঠিক থাকবে নাকি?’
অনু শোনে সবকিছু হাবার মতো। অনর্গল কথা বলা সরু নিজেই আশ্চর্য রূপময় এক জগৎ যেন। অনুর কাছে সরুর গল্প বলার ভঙ্গি, হাত-পা নাড়া, ঠোঁট উলটানো, চোখ বড় বড় করে তাকানো সবকিছুর সঙ্গেই কোমলতা জড়িয়ে আছে। একসময় অনুর বাকপটু রানিফুফুর সঙ্গে তুলনা করে সরুদাসীর।
সরুদাসীর বাবা মুচি। মুচি পেশার ওপর অগাধ শ্রদ্ধা তার। জুতো সেলাই প্রসঙ্গে সরুর মত হচ্ছে, ‘ক’টা লোক ঠিকমতো জুতো সেলাই কত্তে পারে, … শ্রীনাথ জ্যাঠা তো সকলের মুখের ওপর পষ্ট করেই বলে। বলে কাজের কী জানিস তোরা, ফাঁকি মেরে কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে কাজ করছিস, একে জুতো সেলাই বলে না, গোঁজামিলের কাজ, জোচ্চুরি করে পয়সা নিচ্ছিস, জুতো সেলাই অতো সহজ নয়, … সব কাজই কঠিন, তাকে ভালোবাসতে হয়, নিজের মাগী করতে হয়, মাগী করলি তো ধরা দিলো, তোর যে মাগী সে তোরই জানা। পায়ের জুতো পায়েই থাকবে মাথায় উঠবে না কখনো – স্রেফ গোঁজামিল দিয়ে চালা, এই যদি তোর মনের কথা হয়, তাহলে শিখবিটা কেমন করে। পায়ের সেবা করলেই মাথা পাবি, মাথার মধ্যেই সব, মাথার মধ্যে বিশ্ব।’ কথাগুলোয় সরুদাসীর একধরনের চরিত্র ফুটে ওঠে। কথাগুলো সে বললেও এর অর্থ সে নিজেই জানে না। একসময় সে অনুকে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা বিশ্ব মানে কি রে?’ প্রত্যেক মানুষই তার সমাজ-সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার সহযাত্রী। সরুদাসীও বিচ্ছিন্ন নয়। তার পূর্বপুরুষের পেশা জুতো সেলাইয়ের কিংবা মায়ের ধাই পেশার প্রতি তার যে অকপট শ্রদ্ধাবোধ তা-ও এ-পাঠশালারই শিক্ষা।
বাকপটু সরু কথা বলার এক পর্যায়ে অনু তাকে বিয়ে করতে রাজি কিনা জানতে চায়। অনু বিব্রত হয়, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। তখন সরু বলে, ‘… আমরা তো আর বাবুজাতের মেয়েদের মতো চোখকানের মাথা খেয়ে বেহায়াপনা কত্তে পারিনে। বুক উইঢিবির মতো উঁচু করে, পাছা দুলিয়ে, রঙ-চঙ মেখে অন্যদের বোকা বানিয়ে মন ভাঙানো আমাদের ভেতরে নেই বাপু। আমরা যা – তাই!’ একপর্যায়ে সরুদাসী দোকানের ভেতরে চৌকিতে পাশাপাশি গলা জড়িয়ে শুয়ে থাকার প্রস্তাব দিলে অনু বলে আজ থাক আর একদিন হবে।
ভয় করছে কিনা সরুদাসী জানতে চাইলে অনু বলে, তার গায়ে আঁশটে গন্ধ এবং নোংরা।
সরুদাসী তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। ঝগড়া বাধায় অনুর সঙ্গে। বৃষ্টির মধ্যে চেলাকাঠ নিয়ে পরস্পর পরস্পরকে তাড়া করে। বাড়ি ফিরে আসে অনু। জ্বরে পড়ে কিছুদিন। আবার বের হয় বসিত্মর বন্ধুদের উদ্দেশে। গেনদু-মিয়াচাঁনদের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের সাহচর্য আগের মতো চমৎকৃত করে না। তাদের বিভিন্ন ধরনের গল্পে সে আকৃষ্ট হয় না আগের মতো। ‘ওরা এক একজন একে অপরকে আড়াল করে ঝোপ-ঝাড়ের নিচে মাটিতে কোথাও ঘুঘুতে ডিম পেড়েছে কিনা তাই ঢুঁড়তে বের হয়, কখনো মোহরের ঘড়া পাওয়া যাবে এই আশায়। নিচে মোহরের ঘড়া না থাকলে ঘুঘু কখনো মাটিতে ডিম পাড়ে না, ওরা তা জানে; তলে তলে ভাগ্যকে বদলাতে সকলেই উদগ্রীব।’
উপন্যাস রচনার উদ্দেশ্য সম্ভবত এখানেই বেশি টের পাওয়া যায়। টোকানির নির্মম দারিদ্র্য দেখে অনু সহানুভূতিশীল হয়ে সাহায্য করে। সরুদাসীকে মনে মনে খুঁজতে থাকে, পায় না। সরুদাসীর মান ভাঙাতে ইচ্ছে করে অনুর। চামারপাড়া সেও তো কোথায় জানা নেই অনুর। ভয়ও করে।
সমাজে সকলের নিজ নিজ পছন্দ-অপছন্দ রয়েছে। এটি কখনো আরোপিত নয় – যেমন সত্য, তেমনি কিছু বিষয় কমন বিবেকবিরুদ্ধ এবং পালনকালে অন্যের স্বার্থের ক্ষতিও হয়। কিন্তু কে তা ভাবে? মাহমুদুল হকের এ-উপন্যাসে অনুর বাবা-মায়ের চরম দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ এবং কলহের বিষয়টি এসেছে। কোনো বিষয়ে একে অপরের মতকে সামান্য ছাড় দিতে চায় না। উচ্চমধ্যবিত্তের এটি চিরন্তন দ্বন্দ্বের নমুনা বলা যায়। অনুর বাণী খালা ও তার ছেলেমেয়ে মন্টু-মঞ্জু-গোর্কি একদিন অনুদের বাসায় বেড়াতে আসে। অনুর সঙ্গে তাদের পছন্দ-অপছন্দ ও রুচিবোধের পার্থক্য লেখক তুলে ধরেছেন এই অংশে। উচ্চমধ্যবিত্তের ঘেরাটোপে বসবাস করেও তার খালাতো ভাইবোনদের রুচিবোধের সঙ্গে অনুর
রুচির পার্থক্য অনেক। মন্টু-মঞ্জু-গোর্কি যেখানে সিডি-পপ-বিটল, টিভি ইত্যাদি বিনোদনে আকণ্ঠমান, অনু তখন জ্ঞানের বিভিন্ন
শাখা-প্রশাখায় বিচরণে সাবলীল-স্বাচ্ছন্দ্য। বাণী খালাও নিজ আভিজাত্য ও বিদেশ ভ্রমণের বড়লোকি গল্প প্রচারে ব্যসত্ম। সেখানেও এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ‘শুধুমাত্র ইস্ত্রিকরা দামি কাপড়ের মড়মড়ে ভাঁজ অতিকষ্টে বজায় রাখার জন্যেই ওরা এই পৃথিবীতে এসেছে।’
অনুর বাবা বাণী খালাকে তার উকিলজীবনের বিচিত্র গল্প শোনাতে লাগলেন। একপর্যায়ে মায়ের উষ্মা প্রকাশ ও তা ধীরে ধীরে ঝগড়ায় রূপ নিল। বাণী খালা চলে গেলেন। খালা চলে যাওয়ার পর অনুর বাবা তার বিধবা বোন রানিফুফুকে ঢাকায় নিজের কাছে নিয়ে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। এ-বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন। অনুর মা এতে আপত্তি জানিয়ে অশস্নীল কিছু কথা বললেন। এর আগে তাকে ডেকেও আসেনি এখন কেন আসতে চায়? জিজ্ঞাসা অনুর মায়ের। বাবা যুক্তি দিলেন, এর আগে তার মনের শক্তি ছিল একা থাকতে পারবে সাহস ছিল। এখন হয়তো নেই। কিন্তু অনুর মায়ের ধারণা, মনের জোর নয়, এতদিন রূপের বহর ছিল, রূপের দেমাগ ছিল, বরং সে-সময় এলে ওর অসুবিধাই হতো। এখন ওসবে ভাটা পড়েছে। ‘… আর ও নচ্ছার মাগীও কম যায় না, থেকে থেকে যেন চাগিয়ে উঠছে …’
বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখতে থাকে অনু। একপর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মায়ের ড্রেসিং টেবিল থেকে ক্রিস্টালের একটা ভারি শিশি হাতে বাবার কপালে ছুড়ে মারে। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। ‘দু’হাতে অনুকে আগলে রাখে মা। বাবা অনুকে দেখলেন, ক্রুদ্ধ কিংবা দুঃখিত, অনু তাকাতে পারে না …’
অনুর মনোস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়াগুলো উপন্যাসের এই অংশ থেকেই শুরু হয়েছে বলা যায়। কাব্যিক এবং মনস্তাত্ত্বিক।
অনুর পাঠশালার গল্প ও ভাষা নিয়ে অনেকেই অনেক ধরনের মন্তব্য করেছেন। উপন্যাসের গল্পের মধ্যে সুস্থির ভাব নেই, কিংবা অতৃপ্তিকর বলে কেউ কেউ সমালোচনা করলেও ভাষা সম্পর্কে সকলেই উঁচু ধারণা পোষণ করেছেন।
অনুর মনের মধ্যে তোলপাড় ঝড়ধ্বনি। নিসাড় হয়ে পড়েছিল, মাথা তুলতে কিংবা চোখ খুলতে পারেনি। পারেনি রাত-দিনের ব্যবধান পর্যন্ত অনুধাবন করতে। জ্বর-গায়ে ঘুমঘোরে স্বপ্নে আইনস্টাইনকে খুঁজে বেড়িয়েছে পৃথিবীময় পাগলের মতো। মাথার মধ্যে সুপ্ত অবিস্ত‍ৃত চিন্তাগুলো পাখা মেলেছে স্বপ্নের মধ্যে। কখনো আইনস্টাইনকে খুঁজছে অনু, কখনো লামার মৃত মামার সঙ্গে দেখা হলো। আইনস্টাইনের কাছে অনু পৃথিবীর মাস্ত্তলের খোঁজ জানতে চাচ্ছে। আইনস্টাইন বললেন, ‘সর্বনাশ, তার গায়ে যে টাটকা রক্ত! ধূর্ত কাকের ঝাঁক মাস্ত্তলের উপর বসে, মানে মাস্ত্তলের উপর বসে আহার সন্ধান করছে! তোমার একজোড়া নৌকায় সূর্যের ডিম দু’টি ঠুকরে ঠুকরে খাবে, অন্ধ হয়ো না! … এইমাত্র ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আইনস্টাইনকে – ঘোষণা করে দাও, বজ্রাঘাত হানো! এইমাত্র ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আইনস্টাইনকে – ঘোষণা করে দাও, দাবানল জ্বালো!’ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, ওগো দয়া করো, ওগো দয়া করো; এদের কোনো ধর্ম দীর্ঘনিশ্বাস বলে আজো আমায় ডাকলো না।’
কখনো সরুদাসীকে দেখলো অনু, সেই ঝরঝর বৃষ্টি, দোকানের ঝাঁপতাল, গন্ধ, বাবার গল্পের বিষয়, আইফেল টাওয়ার স্বপ্নের মধ্যে বিক্ষিপ্ত রংছটায় উজ্জ্বল করে তুলেছেন লেখক। যেন পাঠকও স্বপ্ন দেখছে। অনেকেই বলেন কাব্যিক বা কাব্যাক্রান্ত অথবা মনোস্তাত্ত্বিক। আসলে এখানেই মাহমুদুল হক অনন্য-অসাধারণ।
সরুদাসী কি অনুর কাল্পনিক নায়িকা – এ-প্রশ্ন চলে আসে লেখকের বর্ণনাভঙ্গিতে। অথবা এমনও হতে পারে, লেখকের শিশুমন অতিক্রান্ত সময়ের স্রোতে প্রবাহিত হয়নি এরপর। লেখক বারবার ফিরে যাচ্ছেন শিশুসময়ের বর্ণিল কষ্টের দিনগুলোর মাঝে। সরুদাসীকে খুঁজে বের করতেই হবে অনুর – এ-প্রত্যয় কি শুধুই কল্পনা? এখানেও লেখক এক মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার অবতারণা করেছেন। ইতোমধ্যে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে অনু। মানসিকভাবে তো বটেই।
‘অসুখের পর থেকে নিজের বদল দেখে নিজেই চমকে যাচ্ছে। নিজের কাছেই কত অচেনা এখন। মা কোনোদিন পালাতে পারবে না এ বাড়ি ছেড়ে, সবই মিথ্যে প্রবোধ ছিল এতদিন। তাকে পালাতে হবে একাই। আর সেই জন্যই কপাল খুঁড়ে, পৃথিবী খুঁড়ে, আলো নিংড়ে নিংড়ে যেমন করেই হোক সরুদাসীকে তার খুঁজে বের করতেই হবে।’
কিশোর বয়সে দেখা সরুদাসীকে খুঁজতে বের হয়েছে অনু। চেনা পথের স্মৃতি তাকে অনেকটা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করল। ‘স্পষ্ট মনে আছে অনুর ঝাঁপ ঠেলে ঢুকবার সময় এই গাছটা পলকের জন্য তার চোখে পড়েছিল সেদিন, কিন্তু ঢেউটিনের ছাউনি দেওয়া সেই চালাঘর দোকানটা কোথাও খুঁজে পেল না সে।’ শেষমেশ একটি ছেলে সরুদাসীকে চিনিয়ে দেবে বলে এগিয়ে এলো। কিন্তু এ কোন সরুদাসী? দীর্ঘ সময় খুঁজতে থাকা সরুদাসীর যে-অবয়ব অনুর কল্পনায় খেলা করছিল এ যে সে সরুদাসী নয়। ‘উঠোনের একপাশে ইন্দারার খুব কাছাকাছি হাড্ডিচর্মসার এক বুড়ি ক্ষুদ কাঁড়িয়ে কাঁকর আলাদা করছে; শনের নুড়ির মতো চুল, একটাও দাঁত নেই, আর ঘরের বারান্দায় একজন শীর্ণকায় থুত্থুড়ো বুড়ো শাদা ধবধবে ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল নেড়ে বিভোর হয়ে একমনে পাখোয়াজ বাজাচ্ছে। … ছেলেটা বললে, এই তো সরু চামারনী!’ আর হরিয়া, সেই শিশুকালে সরুদাসীর সঙ্গে গু-ামি করে বেড়াত যে, সে-ই এখন তার স্বামী। তার পাশে ঝাঁকড়া শাদা চুলের ওই শীর্ণ বৃদ্ধই হরিয়া।
উপন্যাস এখানে শেষ হলেও যেন চিন্তার শুরু হয়ে গেল পাঠকের এখান থেকেই। এ কী করে সম্ভব! লেখক কী বোঝাতে চাইলেন?
মাহমুদুল হক সরুকে নিয়ে যে-মায়াজগৎ নির্মাণ করেছেন তা অনুমিত হয়। তবে কিশোরী সরুদাসী, না বৃদ্ধা? কোনটি মায়া – এ-প্রশ্ন চলতে থাকবে চিরদিন। হয়তো লেখক এ-প্রশ্নের অবতারণাই করতে চেয়েছেন। বিমূর্ত ভাবনার সন্নিবেশন। কিন্তু এগুলো
প্রকৃতি থেকে, জীবন থেকে প্রত্যক্ষ অর্জন। চারপাশে অসংখ্য ঘটনার হলাহল কোলাহলের মাঝে নায়ক কিশোর অনু এক নিঃসঙ্গ ভাবনার পথিক।
এটি কি শুধুই মুগ্ধতা? শুধুই শিল্পের জন্য শিল্প? মাহমুদুল হক এ-প্রশ্নকে দাঁড় করিয়েছেন সভ্য সমাজের বিবেক বরাবর।
ধনী-দরিদ্রের পোশাকি ও চিন্তার যে-পার্থক্য মাহমুদুল হক স্বভাবসুলভ অঙ্কন করেছেন তাকে আমরা কী বলব?
কী সংলাপ, কী ঘটনা পরম্পরা, আবেশ-আবহ নির্মিতি সবখানেই অকৃত্রিম এক হৃদ্যতার ছোঁয়া উপন্যাসের ভাষাকে করেছে দুর্নিবার। সমাজের উচ্চ-নিম্ন-শ্রেণির মানুষের মধ্যে যেমন বৈপরীত্য, তেমনি একই শ্রেণির মানুষের মধ্যেও ভিন্নতা। পছন্দে, রুচিশীলতায়। বাণী খালার সন্তানদের সঙ্গে অনুর মানসিকতার ভিন্নতা, গেনদু, মিয়াচাঁন টোকানির সঙ্গে সরুদাসীর মানসিকতার ভিন্নতা সমাজে যেন এক বৈচিত্র্যেরই সন্নিবেশন। এ-সমাজ, মানুষ, বৈপরীত্য-বৈচিত্র্য,
শ্রেণি-মানুষ-ব্যক্তির বৈপরীত্যে চাওয়া-পাওয়ার ভিন্নতা এই-ই অনুর পাঠশালা, শিক্ষালয়।
একই সঙ্গে শিল্প, স্বপ্ন, কল্পনা, মনসত্মত্ত্ব ও বাসত্মবতার সমন্বয় এবং দায়বদ্ধতা সম্ভবত খুব বেশি লেখকের লেখায় আমরা দেখতে পাই না। সম্ভবও নয়। মাহমুদুল হক এজন্যই অনন্য। সমাজকে নিয়ে শিল্পের যে-গভীরতায় পৌঁছানো যায়, মনোজগতের দেয়াল স্পর্শ করে লক্ষ্যের সান্নিধ্যে পৌঁছানো সম্ভব, তা বোধহয় মাহমুদুল হকই প্রমাণ করলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কিংবা হাসান আজিজুল হক যে-দৃশ্যকে চপেটাঘাতে বজ্রপাত তুলেছেন, মাহমুদুল হক সেখানে পাপড়ির সুষমায় রাঙিয়েছেন কুয়াশাধূসর ফেননিভ এক ধবল আসত্মরণে। ভাষার মুগ্ধতা, চিত্রকল্প, কাব্যসমৃদ্ধি, ভাষার নির্মিতি, ভাঙা-গড়া ও বর্ণিলতা মাহমুদুল হকের লেখার বৈশিষ্ট্য। অনুর পাঠশালা তারই এক সুসমন্বয়।