মুখোমুখি তরুণ সান্যাল

সুশীল সাহা

শীতের এক নিশুতি সন্ধ্যায় অশীতিপর কবি অধ্যাপক সমাজসেবক তরুণ সান্যালের মুখোমুখি হয়েছিলাম। কথোপকথনের দীর্ঘ সময়জুড়ে উঠে এসেছিল তাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশের কথা। ওই দেশের জন্মলগ্নের নানা ঘাত-সংঘাতের দোলাচল প্রসঙ্গে স্বভাবতই উঠে এলো তাঁর লেখা কবিতার কথা।

এপারে ওপারে বড় ধোঁয়া, অন্ধকার

বজ্রপাত, বিদ্যুতের কৃপাণে বিচ্ছিন্ন দৃশ্য…

মুখগুলি চিনেও চিনি না দীর্ঘবেলা

ঝড়ের আড়ালে কারা

ক্রোধে লাল সূর্যের চাকায় ঘুরে যায়,

অন্ধকার ঘিরে এলে

লণ্ঠনের ধোঁয়া, লালে

জীবনের নৈবেদ্য সাজায়?

 

আমার অপার বাংলা

দেবী প্রতিমার দীর্ঘ চোখের আলস্যে ঘুম ভেঙে যায়

মুখগুলি দৃশ্যহীন, মধ্যরাতে

একা পানসী ভাসানো বৈরাগ্যে

কোন অশ্রুময়তায়

অন্ধতায়

লাবণ্যনীহার ভার একা অঙ্গে ধরা যায় না বলে

পাকাধান ভেজা পাটে

দূরের বাঁশির সুরে

মনে হয়

অশ্রুত বিষাদ, শ্যামলিমা, এই

বিধ্বস্ত প্রতিমা বাংলাদেশ

সুশীল সাহা : ১৯৭১-এ রচিত আপনার ‘বাংলাদেশ’ নামাঙ্কিত কবিতায় উঠে এসেছে নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্মলগ্নের কথা। সেখানকার মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং সংগ্রামের কথা। এক অপার ভালোবাসায় আপনি রচনা করেছেন ওই দেশের হয়ে ওঠার এক বিশ্বাস্য চিত্র। এই ভালোবাসা ও সহমর্মিতা আপনি কীভাবে অর্জন করলেন? কীভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিলেন?

তরুণ সান্যাল : আমার জন্ম পাবনা জেলার শাহজাদপুর থেকে দেড় মাইল দূরের ‘পোরজনা’ গ্রামে ১৯৩২ সালের ২৯ অক্টোবর। পনেরো-ষোলো বছর বয়সে দেশত্যাগ করেছিলাম দেশভাগের সেই উত্তাল সময়ে। তারপর স্থান থেকে স্থানান্তরে নানা কারণে গেলেও শৈশবের সেই স্মৃতিমাখা জন্মভূমির কথা আমার সত্তার মধ্যে চিরজাগ্রত হয়ে ছিল। বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক নোয়াম চমস্কি বলেছেন, মাতৃগর্ভ থেকে প্রাক-কৈশোর পর্যন্ত শিশু যা জানতে পারে তাই-ই হয়ে ওঠে তার সারাজীবনের চেনাজানার ভূমিকা। আমার সেই চেনাজানার জগতে আমার জন্মভূমি, আমার গ্রাম, ছেড়ে আসা স্বদেশ এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। তাই ওই দেশের কথা আমি কখনোই ভুলিনি। আমার চিন্তাচেতনায় চিরজাগরূক ছিল ওই দেশ। তাই যখন ১৯৭১-এ পাকিস্তানের অপশাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার অনুপুঙ্খ ছবি আমার মানসপটে উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়েছিল। কীভাবে যেন আমিও যুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সঙ্গে। তাই ‘বাংলাদেশ’ নামের ওই কবিতায় ধরা পড়েছে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের ছবি।

সুশীল সাহা : কিন্তু আপনি তো ওই সময় বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছিলেন। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?

তরুণ সান্যাল : হ্যাঁ, ওই সময় বাংলাদেশকে নিয়ে আমি অনেকগুলো কবিতাই লিখেছিলাম। নয় মাসের যুদ্ধপর্বে সক্রিয়ভাবেই আমি ছিলাম ওখানকার আপামর মানুষের পাশে। এটা আমার মুখের কথা নয়। আমি তখন স্কটিশ চার্চ কলেজের অগিলভি হোস্টেলের সুপার। তখন নকশাল যুগ। আর আমার কলেজের অনেক ছাত্রই ওই রাজনীতির দিকে ঝুঁকেছে। হোস্টেল ভরে গিয়েছিল বাংলাদেশের শরণার্থী দিয়ে। প্রতিদিন কত মানুষ, কত নতুন নতুন খবর আসত। নিত্য তার মুখোমুখি হতাম আর লিখতাম একটার পর একটা কবিতা। সেই সময়কারই একটা কবিতা ‘তোমার কাছেই’।

কবিতাটা পুরোই শোনাচ্ছি। পুরোটা শুনলে বোঝা যাবে বাংলাদেশ নিয়ে আমার তখনকার মনোভঙ্গি।

তোমার কাছেই দাবি করছি আমার মুক্তি আমার আকাশ

দাবি করছি পাখপাখালি

চরের বালি

বা ঘাস ফড়িং

মনে পড়ে কি তোমার ছিল পড়ার বইয়ের বাইরে আভাস

রাখালি বাঁশি টান গেরাপি

মেঘের ঝাঁপি

চাঁদবাঁকা শিং।

এখন আমার ঘরের চাবি কেই-বা ভাঙে কে ঘুম ভাঙায়

রাঙা শাড়িটি নিংড়ে দিতে

পুব নদীতে

শুশুকটি ভুস?

ঝপ দিল ঝাঁপ পানকৌড়ি? পিঠ উল্টে শুকনো ডাঙায়

গাবের মলম নৌকো মাখে

বা হাঁক ডাকে

হাটের মানুষ?

তোমার কাছেই সোনার অমোঘ শান্তি স্বস্তি পাওয়ার

রাংতা মুকুট তীর-ধনুকে

স্মৃতির মুখে

দিন গড়ালো

এখন দাবি অথৈ নীলায় ঘাস ঝিলমিল শিশির হাওয়ায়

ধানপাকা রোদ টুপ চুঁয়ে যায়

কলমিলতায়

বেগনি আলোয় –

 

কিন্তু আমার দুঃখ এবং সুখের মধ্যে ঝড়নোয়া ঝাড়

উল্টে পাল্টে আ বাংলাদেশ

হা বাংলাদেশ

বুক ভরালো\

সুশীল সাহা : আপনি তো ওই সময়েই লিখেছিলেন –

শান্ত দিঘি ভাঙা ঘাট

মা আমার বাংলাদেশ

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ফলা মাজে।

তরুণ সান্যাল : হ্যাঁ, ‘মা আমার বাংলাদেশ’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলাম তখন। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশ কোনোরকমে উঠে দাঁড়াচ্ছে তখন। আমি লিখেছিলাম –

সদ্যোজাত বাছুরের টলমল দাঁড়ানো দেখে

স্নেহার্দ সে বিশালাক্ষী,

প্রতিরক্ষা তীক্ষ্ণ শিঙে গম্ভীর হাম্বায়

মা আমার বাংলাদেশ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাদ মোছে তারই

ও-কি মরচে জ্বলে যাওয়া অঙ্গারকুসুম

খর খঙ্গে ঝকমকায়, ওকি

করশান শুদ্ধ তরবারি!

সুশীল সাহা : ১৯৭১ থেকে আরেকটু পেছনে চলে যাই। ১৯৪৭-এ ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে বঙ্গ বিভাগের মতো নির্মম ঘটনা ঘটেছিল। আজ এতদিন পরে সেই সময়কার এই অন্যায় ও অবিচারের কী মূল্যায়ন করবেন?

তরুণ সান্যাল : আমার মনে আছে দেশভাগের পরে বাবা বলতেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান টিকবে না’। দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলার সম্পন্ন হিন্দুরা দলে দলে চলে আসে ভারতে। দেশের একটা বড় অংশ বুদ্ধিজীবী তার মধ্যে ছিল। বাবা বলতেন, একটা বাড়ি বানাতে যা খরচ হয় তারচেয়ে অনেক বেশি খরচ হয় একজন ডাক্তার, উকিল বা ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করতে। আমার ধারণা, বঙ্গ বিভাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে যে বুদ্ধিজীবী সমাজের সংকট তৈরি হয়েছিল সেটি পূরণ করতে তাঁদের বহু কষ্ট করতে হয়েছে। ক্ষুদিরাম, সূর্য সেনের নতুন মুখাবয়ব পেয়েছিল ভাষা-আন্দোলন তথা স্বাধিকারের লড়াই। তাই-ই ক্রমে জন্ম দিয়েছিল ১৯৭১। বঞ্চনা আর অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল বাঙালি। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে ১৯৭১ তাই এক যুগান্তকারী ঘটনা।

সুশীল সাহা : এবার আপনার কাছ থেকে ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানব।

তরুণ সান্যাল : সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। ’৭১-এর সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। কিন্তু আমরা জানি অত্যন্ত অন্যায়ভাবে জনগণের রায়কে উপেক্ষা করেছিল তদানীন্তন সামরিক সরকার। ক্ষমতা হস্তান্তর তো দূরের কথা, নির্বিচারে তারা পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে গণহত্যা শুরু করে। ইতিহাসের সে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। কিন্তু অসম সাহসে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণেরা প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। প্রথম থেকেই এ-যুদ্ধকে সমর্থন করেছিল ভারত। মনে পড়ে, পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের দু-একজন এই যুদ্ধকে মেনে নেয়নি। এমন বিতর্ক ওখানকার নেতৃবৃন্দের মধ্যেও ঘটেছিল। আজ মনে পড়ে, এখানকার রাজ্যেশ্বর রাও, রমেশচন্দ্র, ভবানী সেন, সোমনাথ লাহিড়ী, ভূপেশ গুপ্ত প্রমুখ বাংলাদেশের ওই লড়াইকে জাতীয় মুক্তি বলে ঘোষণা করেছিলেন। একটি সভায় রাজ্যেশ্বর রাও বলেছিলেন, ‘একটা লুঙ্গি পরো, একটা গেঞ্জি পরো, বাংলাদেশে ঢুকে পড়ো, যুদ্ধ করো – অস্ত্রের অভাব হবে না।’ আমি ওই সময় পরিচয় পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক ছিলাম। স্কটিশ চার্চ কলেজের অগিলভি ছাত্রাবাসের অধ্যক্ষ ছিলাম। ওই ছাত্রাবাসটি নকশালপন্থীদের বলে নানা খ্যাতি বা অখ্যাতি ছিল। চীনের ফরমান অনুযায়ী এই যুদ্ধকে তারা সমর্থন করেনি ঠিকই কিন্তু আমার অনুরোধে তারা বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল। প্রায় এক বছরে দেড় দুই হাজার শরণার্থী ছিল এখানে। এর মধ্যে অনেক নারী ও শিশু ছিল। আমার স্ত্রী ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছার মেয়ে। তিনি তাঁর গয়না বন্ধক রেখে বা বিক্রি করে ওইসব বিপন্ন শিশু, নারী ও বুদ্ধিজীবীদের খাদ্য, ওষুধ ও পোশাক কিনে দিয়েছিলেন।

সুশীল সাহা : তখন ওখানকার অনেক নামি মানুষ তো এসেছিলেন আপনার কাছে। তাঁদের কয়েকজনের কথা যদি বলেন।

তরুণ সান্যাল : হ্যাঁ, ওখানকার অনেক নামী মানুষ আমার কাছে এসেছিলেন। শওকত ওসমান, রণেশ দাশগুপ্ত, সুনীল মুখোপাধ্যায়, ড. আনিসুজ্জামান, মাযহারুল ইসলাম, আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা আরো কত মানুষ! আমার কোয়ার্টারটি ছিল তখন বাংলাদেশের শরণার্থীদের অতিথিশালা।

সুশীল সাহা : শুনেছি এই যুদ্ধে আপনি নিজেও সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। সেটা কীভাবে?

তরুণ সান্যাল : সেই ব্যাপারটা এখন আর বলতে বাধা নেই। সম্ভবত গোপালপুর অন সি দিয়ে এক জাহাজ এলএমজি এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হস্তক্ষেপ ছাড়া সেটা সম্ভব ছিল না। শান্তিময় রায় আমাকে দিয়ে সেটা আনিয়েছিলেন। পরে জেনেছিলাম করতোয়া-যুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা ওই অস্ত্র দিয়ে পাকবাহিনীকে পরাস্ত করেছিল। আমাকে পশ্চিমবঙ্গের মিত্রশক্তির সাব-কমিটির আহবায়ক করা হয়। ফলে যুদ্ধ চলাকালীন আমাকে প্রায় প্রত্যেক সীমান্তেই যেতে হয়েছিল। কতবার যে কত সীমানা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেছি! উলুধ্বনি শুনে বুঝতাম সেটা হিন্দুপ্রধান এলাকা। আর যাঁরা ভারতের মাটি চুম্বন করত, বুঝতাম তারা মুসলমান। ওই সময়ে আমি ‘মাটি’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলাম। তার খানিকটা অংশ পড়ছি –

প্রত্যাশায় বৃষ্টি হয়? মাঠ রুক্ষ ফাটা হাত

অঞ্জলি সাজালে বৃষ্টি আসে?

এবড়ো থেবড়ো জমি, ধুলো ওলোটপালট

কোন দক্ষিণের হাওয়ায় উদোম

এবং নয়ানজুলি বেয়ে নেমে গেছে ঘাস, দাম,

হলদে কচুরিপানায় পরিণাম

দিনক্ষণ চলে যায় অশ্লেষা-মঘায় বারবেলায়

রবিবার বহে যায় অন্য এক শনিবারে

জলের ঢলক নোনা গাঙে

নামগুলি বহে যায় পিতামহ থেকে পৌত্রে

এমনি করে ঢেউ ওঠে ভাঙে

শালতির উপরে কার পায়ে সোনা জ্বলে

আউসে আমনে

বাংলাদেশ

সুশীল সাহা : বাংলাদেশ কিন্তু আপনার এই অবদানের কথা ভোলেনি। বহু বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে ওখানকার সরকার কিন্তু এখানকার অনেক বুদ্ধিজীবী শিল্পী ও সংগঠনকে সম্মানিত করেছে, যারা প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এই সম্মানে আপনিও সম্মানিত হয়েছেন। সরকারি অতিথি হয়ে ঘুরে এসেছেন। কেমন হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা?

তরুণ সান্যাল : অত্যন্ত আনন্দময় সেই অভিজ্ঞতা। মুজিবকন্যার আতিথ্যে, আপ্যায়নে আমি অভিভূত। কিন্তু, বহু পরিচিত মুখের দেখা মেলেনি। তাঁরা ইহজগৎ ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকেই মিরপুরের মাটিতে বিলীন হয়ে গেছেন। আমিও যদি তাঁদের মতো মিশে যেতে পারতাম মাটিতে! আজো তাই মনে মনে ভাবি –

আকাশে তো লিখে রাখি নাই

উড়িবার ইতিহাস

তবু উড়েছিলুম, এই মোর বিশ্বাস।‑