মুচকুন্দ দুবের লালন অন্তরঙ্গ কথোপকথন

আবুল আহসান চৌধুরী

লালন সাঁই লোকায়ত বাঙালির মরমি-চেতনার প্রতীক। বাউলের সাধনা-দর্শন-সংগীতের প্রধান ব্যক্তিত্ব লালন সাঁইকে নিয়ে ভিন্ন-ভাষাভাষীদের মধ্যেও আগ্রহ-সন্ধিৎসার পরিচয় মেলে ক্যারল সলোমন, মাসাউকি ও’নিশি, মাসাহিকো তোগাওয়া, ম্যান্ড্রিন উইনিয়স, ব্রাদার জেম্স, ফাদার মারিনো রিগন, দেবযানী চলিহা ও আরো কারো কারো রচনা ও অনুবাদে। এই তালিকায় আর-একটি নাম শামিল হতে পারে – তিনি হিন্দিভাষী কূটনীতিক, অধ্যাপক ও সাহিত্যসেবী মুচকুন্দ দুবে।
মুচকুন্দ দুবের জন্ম ভারতের বিহার রাজ্যের দেওঘরের জসিডিতে, ৩ নভেম্বর ১৯৩৩। জসিডি অবশ্য বিহার ভেঙে নতুন গঠিত ঝাড়খন্দ রাজ্যের অন্তর্গত। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি – তাই শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো অভাব-অনটনের মধ্যেই কেটেছে। আগাগোড়া মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৫০-এ দেওঘরের রাজেন্দ্র মিত্র হাইস্কুল থেকে জলপানি পেয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তারপরে উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত লেখাপড়া পাটনা কলেজে। এখান থেকেই ১৯৫২-তে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে অর্থনীতিশাস্ত্রে অনার্স নেন। বিএ (অনার্স) ও এমএ পাশের বছর যথাক্রমে ১৯৫৪ ও ১৯৫৬। এরপর অক্সফোর্ড ও নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে কিছুকাল পড়াশোনার সুযোগ পান। একসময় পিএইচ.ডি কোর্সেও ভর্তি হন, কিন্তু পেশাগত কারণে গবেষণার কাজ শেষ হতে পারেনি।
শেষ পরীক্ষা পাশের পরপরই পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন। শিক্ষকতা দিয়েই কর্মজীবনের সূচনা। প্রায় এক বছর (১৯৫৬-৫৭) ওই পাটনা কলেজেই অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। শিক্ষকতা-পেশায় ছেদ পড়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফল হয়ে কূটনীতিকের চাকরি গ্রহণের ফলে। মে ১৯৫৭-তে ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। শিক্ষানবিশি প্রশিক্ষণ নেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে এক বছরের জন্যে। দুবের প্রথম নিয়োগ তেহরানে ১৯৫৮-এর শেষদিকে ভারতীয় দূতাবাসে থার্ড সেক্রেটারি হিসেবে। এরপর নানা দেশে ও সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
ইরানে নিয়োগ-লাভ মুচকুন্দ দুবের জন্যে নানা অর্থে আশীর্বাদ হয়ে উঠেছিল। এখানে তিনি ফারসি ভাষা শেখেন – সেই সুবাদে ফারসি সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। রুমি-জামি-সাদি-হাফিজ-খৈয়াম – এইসব সুফিকবি তাঁর আত্মীয় হয়ে ওঠেন। পারস্যের সুফিকবিদের রচনা মূল ভাষায় পাঠ করে এক অভিনব মরমি-জগৎ আবিষ্কার করেন। এর আগেই অবশ্য ভারতের মধ্যযুগের মরমি সন্তকবি কবির-তুলসিদাস-রামানন্দ-রজ্জব-দাদূ-নানক তাঁর মনোজগতে এক গভীর মরমিভাব সঞ্চারিত করেছিলেন। পারস্যে এসে তা আরো গভীর হয়ে ওঠে। এরপর যখন বাংলাদেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্রদূত হিসেবে আসেন, তখন পরিচয় হয় বাংলার শ্রেষ্ঠ মরমি কবি বাউলসাধক লালন সাঁইয়ের সঙ্গে। মুচকুন্দ দুবের মরমি-মানস গড়ে উঠেছে তাই ভারতের সন্তকবি, পারস্যের সুফিকবি ও বাংলার বাউলকবির ভাব-ভাবনার সমন্বয়ে।
পেশাগত জীবনে মুচকুন্দ দুবে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেন। যেখানেই গেছেন সেখানকার মাটি-মানুষ-সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর গড়ে উঠেছে নিবিড় সম্পর্ক। তেহরানের পর ক্রমান্বয়ে কাজ করেছেন জেনেভায় কনস্যুলার জেনারেল, ভারতের পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রকের আন্ডার সেক্রেটারি-ডেপুটি সেক্রেটারি, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য (১৯৬৮-৭১), ডেপুটেশনে (প্রেষণে) জাতিসংঘের ইউএনডিপির (টঘউচ) প্রধান কার্যালয়ের ডিরেক্টর (১৯৭১-৭৬), দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রকের বাংলাদেশ ডিভিশনের জয়েন্ট সেক্রেটারি, বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার (সেপ্টেম্বর ১৯৭৯-অক্টোবর ১৯৮২), জেনেভায় ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় (১৯৮২-৮৫)। এরপর দেশে ফিরে এসে ১৯৮৫ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রকের অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি এবং ওই একই মন্ত্রকের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন এপ্রিল ১৯৯০ থেকে – এখান থেকেই অবসরে যান ৩০ নভেম্বর ১৯৯১।
অবসরগ্রহণের পর তাঁর কর্মজীবনের নতুন আর-এক পর্ব শুরু হয়। ১৯৯২-এর মার্চে দিল্লির জওহরলাল নেহ্রু ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন এবং একনাগাড়ে প্রায় আট বছর অধ্যাপনা-কাজে যুক্ত থাকেন। এখানে পঠন-পাঠনের পাশাপাশি এমফিল ও পিএইচ.ডি গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে (১৯৯৫ থেকে) পাশাপাশি ওহফরধহ ঃযরহশ ঃধহশ-এর সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৯৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ইউনেস্কোর এক্সিকিউটিভ বোর্ডের ভারতীয় সদস্য ছিলেন। সিকিম রাজ্যের প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের পদে ছিলেন দীর্ঘ দশ বছর (১৯৯৮-২০০৮)। আরেকটি গুরুদায়িত্ব বর্তায় তাঁর ওপরে বিহার সরকারের ঈড়সসড়হ ঝপযড়ড়ষ ঝুংঃবস ঈড়সসরংংরড়হ-এর চেয়ারম্যান হিসেবে (২০০৭-০৮)। এই কমিশনের রিপোর্ট সব মহলেই খুব প্রশংসা পায় এবং এর ফলে বিহারের স্কুল-পর্যায়ের শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু পরিমাণে হলেও গুণগত পরিবর্তন আসে। মুচকুন্দ দুবে প্রায় ৮৪ বছর বয়সেও তাঁর কাজের পৃথিবী থেকে ছুটি নেননি – এখনো জড়িয়ে আছেন নানা কর্মে – নানা সামাজিক-শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
এবারে মুচকুন্দ দুবের ব্যক্তিগত জীবনের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। ১৯৫৮ সালের ২৮ মে বাসন্তী মিশ্রর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। মিশ্র-পরিবার উড়িষ্যার অধিবাসী। তবে বাসন্তী দেবীর জন্ম পিতার কর্মস্থল উত্তরপ্রদেশে। পিতা কৃপাসিন্ধু মিশ্র ছিলেন আইসিএস অফিসার। বাসন্তী দেবী এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে এমএ পাশ করেন। সাহিত্য ও সংগীতে তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। দীর্ঘদিন উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা করেছেন। মুচকুন্দ দুবে যখন ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন, সে-সময়ে বাসন্তী দুবে প্রায় তিন বছর বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী ও প্রশিক্ষক সোহরাব হোসেনের কাছে নজরুলসংগীত শেখেন। মুচকুন্দ-বাসন্তীর দুই কন্যা : মধুমতী ও মেধা। মধুমতী আমেরিকার শিকাগো ইউনিভার্সিটির ইংরেজির প্রফেসর ও মেধা দিল্লিতে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত।
মুচকুন্দ দুবে পেশাসূত্রে বাংলাদেশে আসার আগেই মার্কিন মুলুকে থাকার সময়ে লালনের গান শুনে মুগ্ধ হন। বাংলাদেশে হাইকমিশনার হিসেবে যোগ দেওয়ার পর নতুন করে লালন সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। শিল্পী-দম্পতি অধ্যাপক আবু জাফর ও ফরিদা পারভীনের সহায়তায় বেশকিছু লালনের গান হিন্দিতে অনুবাদ করেন। সেই অনুবাদ প্রথম ছাপা হয় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আবুল আহসান চৌধুরীর লালন শাহ (১৯৯০) বইয়ে। পরে দুবে লালন সম্পর্কে ইংরেজিতে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধও রচনা করেন – তার বাংলা ভাষান্তর ছাপা হয় প্রথম আলো ও ভারত বিচিত্রা পত্রিকায়।
মেয়াদশেষে ঢাকা ছাড়লেও লালনের অনুবাদের কাজ কিন্তু তিনি ছাড়েননি। অনেক বছর ধরে, এমনকি অবসরজীবনেও, পরম নিষ্ঠা ও আগ্রহে সেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই হিন্দি অনুবাদ এখন বই আকারে দিল্লির সাহিত্য অকাদেমি থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। সেই কাজটির চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার জন্যে দুবে ঢাকায় এসেছিলেন গত বছরের (২০১৬) মার্চের মাঝামাঝি। তাঁর এই কাজে আমার কিছুটা সহযোগিতা করার সুযোগ ঘটে।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে আমার শিক্ষকপ্রতিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামানের ফোন পেলাম। তিনি জানালেন, ‘লালনের গানের হিন্দি অনুবাদের কাজে মুচকুন্দ দুবে ঢাকায় আসছেন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনায় বেঙ্গল সেন্টারে কাজটি হবে। দুবের সঙ্গে বসে তোমাকে এই কাজে সহায়তা করতে হবে কয়েকদিন।’ বিষয়টিকে কতখানি গুরুত্বের সঙ্গে আনিসুজ্জামান স্যার নিয়েছিলেন তা বেশ বোঝা যায় তাঁর মতো ব্যস্ত মানুষের বেশ কয়েকবার আমাকে ফোন করার ভেতর দিয়ে। স্যার ধারণা দিয়েছিলেন, তিন-চারদিন লাগতে পারে। আমি সময় কমিয়ে দুদিনেই কাজ শেষ করি। ২৪ মার্চ ঢাকায় পৌঁছে ২৫ ও ২৬ মার্চ বেঙ্গল সেন্টারের মনোরম পরিবেশে দুবে ও আমি দুজনে মিলে কাজটা করি। শুরু হতো সকাল দশটা-সাড়ে দশটায় আর শেষ হতো যখন তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে আসতো। সবধরনের সুবিধা নিশ্চিত করেছিলেন সেন্টার কর্তৃপক্ষ। আমাদের কাজের জন্যে সুন্দর একটি কক্ষের বরাদ্দ ছিল। আর চা-কফি-নাশতার দরাজ ব্যবস্থা ছিল। মাঝেমধ্যে বেঙ্গল সেন্টারের কর্ণধার আবুল খায়ের উঁকি দিয়ে যেতেন, কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জেনে নিতে। সুযোগ-সুবিধার জন্যে তীক্ষè নজর ছিল লুভা নাহিদ চৌধুরীরও। কালি ও কলম-সম্পাদক আবুল হাসনাত আমাদের কাজ শুরুর কয়েক দিন আগেই পত্রিকার ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশের কাজে কলকাতায় গিয়েছিলেন। ফিরে এসে মৃদু স্বরে জানতে চাইলেন, কাজ কেমন এগোলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা দুজন নিরিবিলি পরিবেশে কাজ করে যেতাম। কাজের ব্যাঘাত হবে বলে দুবে ফোনও ধরতেন না। সবার সঙ্গে দেখা হতো শুধু দুপুরের ভোজনপর্বের সময়ে। সেখানে মাঝেমধ্যে বিদেশি অতিথিও দু-চারজনকে পাওয়া যেত। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার খাবার-টেবিলেই কাজের খোঁজখবর নিতেন। দুবে সময় সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন, তাই ভোজনপর্বের সময়ে আলাপ সংক্ষিপ্ত করতেন। দুপুরের খাওয়ার পর চোখ বন্ধ করে চেয়ারে মাথা এলিয়ে সামান্য সময় বিশ্রাম নিয়েই আবার কাজ শুরু করতেন। কাজের ধারাটা ছিল চমৎকার। তিনি একটি একটি করে লালনের গান পড়ে যেতেন, আর মাঝে মাঝে কোনো সাংকেতিক শব্দের অর্থ বা গূঢ় তত্ত্বের ব্যাখ্যা জানতে চাইতেন। আমার সাধ্য-অনুযায়ী সেসবের ব্যাখ্যা-বক্তব্য দিলে দুবে তাঁর হিন্দি-অনুবাদের পাশে বা শব্দ দাগিয়ে তা লিখে নিতেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমার মত ও ব্যাখ্যাই তাঁর মনে ধরতো, দু-এক জায়গায় মতের অমিল হতো – তর্ক ও পালটা প্রশ্ন করতেন, তবে আমার কথা তাঁর কাছে যুক্তিসংগত মনে হলে অবশেষে তা মেনেও নিতেন। তাঁর অনুবাদ মূলানুগ হোক এ-ই তিনি চাইতেন, তত্ত্বের ব্যত্যয় বা বিচ্যুতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। একজন নিষ্ঠাবান অনুবাদকের লক্ষণ-বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা তাঁর মধ্যে পুরোপুরিই দেখতে পেয়েছি। জানালেন দিল্লির এক বইমেলা থেকে আমার সম্পাদিত লালনসমগ্র সংগ্রহ করেন, পদ-নির্বাচনে ও পাঠ-নির্ণয়ে মূলত এই সংকলনটির ওপরই নির্ভর করেছেন জেনে ভালো লাগলো। লালনের মতো গূঢ়-গুহ্য-মরমিপন্থার সাধকের পদাবলি অনুবাদে যে প্রস্তুতি, সন্ধিৎসা, জিজ্ঞাসা, নিষ্ঠা, ধৈর্য, প্রজ্ঞা ও মেধা প্রয়োজন, মুচকুন্দ দুবের মধ্যে তা যে পূর্ণমাত্রায় আছে সে-সাক্ষ্য আমি হলফ করে দিতে পারি। দুবের লালন-তরজমা হিন্দিভাষীদের মূলের স্বাদ অনেকখানিই দিতে পারবে বলে ধারণা করা যায়।
মুচকুন্দ দুবের মার্চের এই সফর ছিল পুরোপুরি লালন-পদাবলির অনুবাদের কারণে ও প্রয়োজনে। তাই তাঁর অবস্থানকালের প্রায় সবটুকু সময়ই তিনি খরচ করেছেন লালনের পেছনে। দুবের লালনচর্চার অনুষঙ্গে এবারের বাংলাদেশ সফরকে আরো প্রাসঙ্গিক ও স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে প্রথম আলো পত্রিকার পক্ষ থেকে দুবের লালন-বক্তৃতার আয়োজন করে। ২৭ মার্চ বিকেল চারটায় ঢাকার ধানমন্ডির বেঙ্গল গ্যালারিতে মুচকুন্দ দুবে ‘লালন ফকিরের সাধনা’ বিষয়ে বক্তৃতা দেন। প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে লালনের দুটি দৈন্য গান পরিবেশন করেন ফকির আবদুর রহমান। স্বাগত বক্তব্যে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান দুবের কর্মকীর্তির কথা তুলে ধরেন। আলোচনায় অংশ নেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক লোক-গবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ও অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী। প্রায় আধঘণ্টার বক্তৃতায় মুচকুন্দ দুবে লালন-প্রতিভার নানা দিক ও তাঁর লালন-অনুবাদের প্রসঙ্গ ও তার তাৎপর্য বিবৃত করেন। তাঁর বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এই রকম (প্রথম আলো : ঢাকা, ২৮ মার্চ ২০১৬) :
১. অবিভক্ত ভারতের সাধু-কবিদের শ্রেষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম লালন। তিনি এক মহান সমাজসংস্কারক। বিভিন্ন ধর্মের ঐতিহ্যের মূল বাণী খুবই সরল ভাষায় প্রকাশ করেছেন লালন। আর তা মানুষের মনে অক্ষয় দাগ রেখে গেছে। কেন হিন্দিভাষীরা এই মহামানবের অপূর্ব বাণী থেকে বঞ্চিত হবে?
২. লালন জাত-পাত, বর্ণ-সম্প্রদায়, উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ মানতেন না। আজকের পৃথিবীতে তিনি বিপুলভাবেই প্রাসঙ্গিক। মানব প্রজাতি যে এক, আমাদের নিজ নিজ দীনতা বিষয়ে সচেতন হওয়া যে উচিত, লালনের এ ধরনের বার্তার জন্য আজকের দুনিয়া আকুল। পৃথিবী এ কথা শুনতে চায়।
৩. সাহিত্যিক মূল্য ও সৃষ্টিশীল ভাবের সরল ও গভীর প্রকাশের অপার ক্ষমতা দেখিয়েছেন লালন। খুবই গভীর দর্শন তিনি যে সারল্যে প্রকাশ করেছেন, তা অনন্য। নিরক্ষর হলেও তিনি তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের একজন। তিনি তাঁর জনগণের মুখের ভাষা, মাটির ভাষাকে রতেœর মতো সুন্দর ও অমূল্য করে তুলেছেন।
৪. ভারতের লালনকে প্রয়োজন, ভারতের বৈচিত্র্যে বিভক্ত সমাজ লালনের জন্য অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশে লালন যেমন জাগ্রত, সেভাবে ভারতে এমনকি বিশ্বেও লালন ছড়িয়ে পড়বেন বলে আমি বিশ্বাস করি। লালন হিন্দি ভাষায় অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে যাবেন, এটাই এখন আমার ইচ্ছা।… আমি চাই লালন বাংলাদেশে যেভাবে পুনর্জীবিত হয়েছেন, সেভাবে ভারতে ও বিশ্বে তাঁর শ্রোতার সংখ্যা অনেক গুণ বাড়–ক।

দুই
যতদূর মনে পড়ে, মুচকুন্দ দুবেকে প্রথম দেখি ১৯৮২ সালে, মাসটা মার্চ – দোলপূর্ণিমায় লালন-উৎসবের সময় কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় এসেছিলেন। দু-চারটে কথা হয়েছিল মাত্র, কোনো অন্তরঙ্গ মুহূর্ত রচিত হয়নি। তাঁর সেই স্বল্প সময়ের সফরের লক্ষ্য ও উপলক্ষ ছিল সম্ভবত লালনই। তারপর দীর্ঘ ব্যবধানে দেখা হয় ঢাকায়, ততদিনে তিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন; যোগ দিয়েছেন অধ্যাপনার কাজে দিল্লির জওহরলাল নেহ্রু ইউনিভার্সিটিতে। ঢাকায় এসেছিলেন বোধহয় ১৯৯৯-এর ফেব্রুয়ারিতে। সে-সময়ে একদিন একাডেমির একুশের বইমেলায় আসেন। সেদিন একুশের আলোচনাসভায় আমার প্রবন্ধ পড়ার পালা ছিল। অনুষ্ঠানশেষে একাডেমির মহাপরিচালকের ঘরে চা-চক্রে অংশ নিতে বসে আছি। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, এমন সময় মুচকুন্দ দুবে সেখানে এলেন। মনে পড়ে, কবি আসাদ চৌধুরী আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন – ওই লালনকে জড়িয়েই। খুবই ব্যস্ত ছিলেন, তবু ওই লালনের টানেই কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো – দেখলাম, আমার বইয়ে যে ওঁর লালনের গানের হিন্দি অনুবাদ জুড়ে দিয়েছি, সে-কথা তিনি জানেন। জিজ্ঞেস করায় উনি বললেন, লালনের অনুবাদ এগিয়ে চলেছে – আরো কিছু গানের তরজমা এরই মাঝে করে ফেলেছেন।
এর সতেরো বছর পর আবার দেখা হলো ঢাকার বেঙ্গল সেন্টারে, সেও ওই লালনের গানের হিন্দি-অনুবাদের সুবাদেই। সকাল-সন্ধ্যা একনাগাড়ে কাজ করে দুদিনেই তা শেষ হলো। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, ওঁর একটি সাক্ষাৎকার নেবো কাজের ভেতর থেকে সময় বের করে। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় আমাদের কাজ শেষ হলো। আমার প্রস্তাবটা পাড়লাম তাঁর কাছে। তিনি মৃদু হেসে ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিলেন। বিরতিহীন কাজের ফলে হয়তো কিছুটা ক্লান্তি নেমেছে তিরাশি বছরের এই মানুষটির দেহে। সামান্য সময়ের জন্যে চোখ বুজে শরীরটা একটু এলিয়ে দিলেন চেয়ারে। দু-এক মিনিট পরেই সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘হ্যাঁ, তাহলে শুরু করা যাক।’
মুচকুন্দ দুবের মাতৃভাষা হিন্দি, পঠন-পাঠন-পেশার কল্যাণে ইংরেজিতে খুবই দড়। এর পাশাপাশি শিখেছেন ফারসি, সংস্কৃত ও বাংলা – এই তিনটি ভাষা। বাংলা শেখার পেছনে ছিল এই ভাষার সাহিত্যের আকর্ষণ, আর পেশার কারণেও হয়তো কিছুটা। বাংলা বেশ ভালোই রপ্ত করেছেন – লিখতে-পড়তে-বলতে বেশ সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ। তাই আমাদের কথোপকথন বাংলাতেই শুরু হলো মূলত লালনকে কেন্দ্র করেই। এই আলাপ যন্ত্রে ধারণ করার সুযোগ ছিল না, তাই কাগজে লিখে নিতে হলো। লিখিত প্রশ্নোত্তরশেষে দুবে স্বাক্ষর করলেন তাঁর মাতৃভাষা হিন্দিতে। দিনটি ছিল আমাদের স্বাধীনতা দিবস। হিন্দির পরে ইংরেজিতে সই করে তারিখ দিয়ে তার নিচে লিখলেন ‘ওহফবঢ়বহফবহপব উধু’, উযধশধ – এদেশের স্বাধীনতার মহান দিনটির কথা ভোলেননি বাংলাদেশপ্রেমী মুচকুন্দ দুবে।

লালনমগ্ন দুবের সঙ্গে আলাপ শুরু হলো এইভাবে :
আবুল আহসান চৌধুরী : শ্রদ্ধেয় প্রফেসর মুচকুন্দ দুবে, লালনের দেশে আপনাকে স্বাগত।
মুচকুন্দ দুবে : ধন্যবাদ।
আহসান : মনে হয় বেশ কিছুকাল পরে বাংলাদেশে এলেন। এবারের সফরের উপলক্ষটা কী?
মুচকুন্দ : অন্য কোনো কারণ তেমন নেই। এবারে বাংলাদেশে এসেছি লালন ফকিরের যে-গান আমি হিন্দিতে অনুবাদ করেছি, সেই সম্পর্কে আলাপ-আলোচনার জন্য। সেটিই মূল কাজ, আর সেইসঙ্গে হয়তো পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হবে।
আহসান : আচ্ছা, এই যে লালনের গান অনুবাদ করছেন, লালন নিয়ে প্রবন্ধও লিখেছেন, – তো লালনের নাম প্রথম কবে শুনলেন আর লালন সম্পর্কে আগ্রহই বা জাগলো কী করে?
মুচকুন্দ : আমি তখন নিউইয়র্কে। একটা এলপি রেকর্ড হাতে এলো ‘ঋড়ষশংড়হমং ড়ভ ইবহমধষ’ নামে। সেখানে লালনের দুটো গান ছিল : ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’ ও ‘মিলন হবে কতদিনে, আমার মনের মানুষেরি সনে’। এই গানদুটো শুনে খুব ভালো লাগে – মুগ্ধ হয়ে যাই আর লালনের গান সম্পর্কে আমার আগ্রহ জাগে। তারপর একসময় বাংলাদেশে আমার পোস্টিং হলে আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। লালনগীতির সবষড়ফু, সুর ও অর্থ আমাকে খুব রসঢ়ৎবংংবফ করলো। লালনবিশারদ অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের সঙ্গে ঢাকায় আমার পরিচয় হয়। ওঁর সঙ্গে কথা বলে আমি অনেককিছু জানতে পারি। খুব উৎসাহও দিয়েছেন আমাকে। তারপর আলাপ হয় লালনগীতির নামকরা শিল্পী ফরিদা পারভীন ও তাঁর স্বামী আবু জাফরের সঙ্গে। ফরিদার গান অনেক শুনেছি – আমার বাড়িতেও গানের আসর বসেছে তাঁকে নিয়ে। এরপর ১৯৮২-তে আমি ছেঁউড়িয়ার লালনের উৎসবে গিয়ে খাঁটি বাউলের কণ্ঠে লালনের গান শুনি। বাংলাদেশে থাকার সময়েই ১০-১২টি লালনের গানের হিন্দি অনুবাদ করি। আবুল আহসান চৌধুরী তাঁর লালনের বইয়ে সেই হিন্দি অনুবাদের কয়েকটি প্রথম প্রকাশ করেন। ফরিদা পারভীন পাঁচটি হিন্দি গান ক্যাসেট করেন।
আহসান : বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার পর লালন-অনুবাদের কী হাল হয়?
মুচকুন্দ : নানা কাজের চাপে তারপর অনেকদিন আর অনুবাদের কাজে হাত দিতে পারিনি। তবে কয়েক বছর পরপর যখনই ঢাকায় আসার সুযোগ হতো, তখন লালনের গান শুনতাম। আবার ফিরে গিয়ে অনুবাদের কাজ করতাম। এইভাবে প্রায় ৩৫-৩৬ বছর ধরে লালনের গান অনুবাদ করে চলেছি। এ-কাজ তো খুব কঠিন, এ তো আর সাধারণ অনুবাদের মতো নয়। জটিল সব তত্ত্বকথা রূপক দিয়ে প্রকাশিত, এ-ধরনের রচনা এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করা খুবই দুরূহ। ভাব আর অর্থ বুঝতে বুঝতেই অনেক সময় চলে যায়। যা-হোক আমার সাধ্যমতো অনুবাদ করেছি। এখানে এসেছি ভরহধষ করার জন্য। ফিরে গিয়েই সধহঁংপৎরঢ়ঃ ৎবধফু করবো। দিল্লির সাহিত্য অকাদেমি লালনের একশ গান নিয়ে হিন্দি অনুবাদের বই বের করবে। বইটার কী নাম দেব তা এখনো ঠিক করিনি। এ-বছরের (২০১৬) শেষদিকে বইটি বের হতে পারে, এমন আশা করা যায়।
আহসান : আপনার হিন্দিতে লালন-অনুবাদের নমুনা পেলে আমরা খুশি হবো।
মুচকুন্দ : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি প্রথম লালনের যে-গানটি অনুবাদ করেছিলাম ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, সেই গানটিই তাহলে সবার জন্য পেশ করি :
পিঁজ্ড়ে কে ভিতর অন্চিনা পান্ছি
ক্যায়সে আয়ে যাই
পাকাড় পাতা তো মন্্ বেড়ি
লাগাতা উস্্কে পাঁই ॥
আট কুঠরি ন’দুয়ার হ্যায় আট্্কা
বিচ্্ বিচ্্ মে ঝরোকা কাটা
উস্্কে উপার ছদর কোঠা
র্ফ্ আিয়নামহাল্্ তায় ॥
কপাল্্ কা ফের না হোতা আজ
পান্ছি কা হোতা না ইয়ে বের্ভ্
াপিঁজড়া তোড়্ পান্ছি মেরা
কিস্্ জাগা উড়– যাই ॥
মন্্ তু ঝে রহি পিঁজড়ে কি আশা
পিঁজ্্ড়া জো তেরা কাঁচ্চে বাঁশ কা
একদিন পিঁজড়া গিরে গা নিচে
ফকির লালন কাহে রোই ॥
আহসান : আচ্ছা, লালনের বাইরে আর কোনো কিছু কী অনুবাদ করেছেন?
মুচকুন্দ : হ্যাঁ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি অনুবাদ করেছি। আর আমার খুব প্রিয় কবি বাংলাদেশের শামসুর রাহমানের প্রায় চল্লিশটি কবিতা অনুবাদ করেছি। এর কিছু কিছু পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে।
আহসান : লালনের গানের এই যে হিন্দি অনুবাদ করলেন, এর উদ্দেশ্য ও তাৎপর্যটা কী?
মুচকুন্দ : হিন্দিতে লালনের অনুবাদ হলে ভাবের দিক দিয়ে হিন্দিসাহিত্য সমৃদ্ধ হবে। আর ধীরে ধীরে অন্যান্য ভারতীয় ভাষাতেও লালনের গানের অনুবাদ হবে বলে আশা করি।
আহসান : লালনের সঙ্গে কি কবির-রজ্জব-তুলসিদাস-রামানন্দ এসব সন্ত ও সাধককবির তুলনা করা যায়?
মুচকুন্দ : আমি খুব ভালো করে কবির ও তুলসিদাস পড়েছি। লালনের সঙ্গে কবিরের খুব মিল আছে। আর তুলসিদাসের সঙ্গেও এঁদের তুলনা করা চলে। এঁদের ও লালনের লড়াই ছিল প্রায় একই রকমের – প্রধানত জাতপাতের বিরুদ্ধে।
আহসান : কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে আপনি লালনে মুগ্ধ?
মুচকুন্দ : লালনকে এক মহৎ কবি হিসেবে দেখি। লালনের গানের উপমা-রূপক-ছন্দ-শব্দচয়ন নবংঃ ঢ়ড়বঃৎু-র নিদর্শন বলা যায়। লালনগীতির মাধুর্য, মানবীয় দর্শন, কাব্যসৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে।
আহসান : এবারে আপনার লালন-অনুবাদের ধরন সম্পর্কে জানতে চাই।
মুচকুন্দ : আমি লালনগীতির ভাবানুবাদ করতে চাইনি, মূলানুবাদই করেছি। মূলের স্বাদ দেওয়ারই চেষ্টা করেছি। সেই কারণে আমার অনুবাদে একটু সময় লেগেছে বেশি।
আহসান : রবীন্দ্রনাথের ওপরে লালনের প্রভাব পড়েছে বলে কি মনে করেন?
মুচকুন্দ : অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের ওপর লালনের প্রভাব পড়েছে। গীতাঞ্জলির অনেক গানে – তাঁর জীবনদর্শনে লালন তাঁকে প্রভাবিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ধারণায় – ‘খধষড়হ রং ঃযব শরহম ড়ভ ঃযব ইধঁষং’ – সবচেয়ে বড়ো মরমি – শ্রেষ্ঠ বাউল।
আহসান : এই হিংসা-দ্বন্দ্ব-নৈরাজ্য-অশান্তির কালে লালনকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মুচকুন্দ : লালন মানবপ্রেমের যথার্থ সন্দেশবাহক। দুনিয়ায় যুদ্ধ চলছে, হিংসা চলছে, মানুষ মরছে, ধর্মের নামে মানুষ মারছে, – এসব দিক দিয়ে দেখলে লালন শান্তির প্রেরণা হতে পারেন। মানবপ্রেমের উৎকর্ষ সাধন হতে পারে লালনের দর্শনের মাধ্যমে।
আহসান : লালনের গানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
মুচকুন্দ : লালনের গানের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল। সুফিকবি জালালউদ্দিন রুমিকে নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় যে-ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে – চেতনা জেগেছে, লালনকে নিয়েও এমন হবে।
আহসান : অনুবাদের জন্য লালনের কোন ধরনের গানকে প্রাধান্য দিয়েছেন – বেছে নিয়েছেন?
মুচকুন্দ : অনুবাদের জন্য প্রধানত লালনের ভক্তি ও মানবতাবোধের গানই গ্রহণ করেছি। সব ধর্মের ওপরে তাঁর যে-গান আছে – ইসলাম ও হিন্দুধর্মের নানা বিষয় নিয়ে যে-গানগুলো আছে তা নিয়েছি। জাতপাত, জাতিভেদের সমস্যার বিপরীতে লালন গানের মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়েছিলেন, সেই গানগুলোও আমি নিয়েছি।
আহসান : লালনকে নিরক্ষর গ্রাম্যসাধক বলা হয়; কিন্তু তাঁর গানে পরম প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে – প্রগাঢ় তত্ত্বজ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায়। কী বলবেন এ-সম্পর্কে?
মুচকুন্দ : লালনের গানে সব ধর্মের আইনকানুন ও রীতিনীতির পরিচয় আছে, অনেক গুপ্ত-জ্ঞানের কথা আছে। একজন অশিক্ষিত মানুষ কী করে যে এগুলো জানলেন, তা ভেবে অবাক হই।
আহসান : লালনের গানকে কি কবিতা বলা যায়?
মুচকুন্দ : আমি এর জবাব আগেই দিয়েছি। আবারো বলি, লালনের গানকে নিশ্চয়ই কবিতা বলা যায়। শুধু কবিতা নয়, উৎকৃষ্ট কবিতাই বলা যায় – বলা উচিত।
আহসান : লালন আজকের দিনে কতটা প্রাসঙ্গিক?
মুচকুন্দ : লালনকে সব ধর্মের – ধর্মনিরপেক্ষতার এক বিশাল মঞ্চ হিসেবে জানি, যেখানে আপনাকে পাই অন্যের মধ্যে, অন্যকে পাই আপনার মধ্যে।
আহসান : আপনার অনুবাদ নিয়ে আর কি কিছু বলার আছে?
মুচকুন্দ : আমার অনুবাদ কোনো ভারতীয় ভাষায় লালনের গানের প্রথম অনুবাদ। আমি মূল পাঠ যা আছে তা সধরহঃধরহ করবো। হিন্দিতে ওঁর গান গাওয়া যাবে আমার অনুবাদের মাধ্যমে। এসব করতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো। ভূমিকায় লালনের ছোট জীবনী লিখবো ও গান বিশ্লেষণ করবো। অনুবাদের প্রতিটি গানে ফুটনোট দেব, যাতে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হয়।
আহসান : লালন ও অন্যান্য বিষয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মুচকুন্দ : ইচ্ছে আছে হিন্দিতে লালনের জীবনী লিখবো। আগ্রহ আছে, যদি বেঁচে থাকি তবে লিখবো। শামসুর রাহমানের কবিতার হিন্দি অনুবাদ বই হবে। তারপর সময় মিললে আরো কিছু কাজ করবো – সেগুলো মাথায় আছে। আপাতত লালনের অনুবাদ নিয়েই আছি – বই না বের হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই।
আহসান : একজন ভারতীয় হিসেবে মৈত্রী ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লালনের ভূমিকাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মুচকুন্দ : বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর ক্ষেত্রে লালন অনেক প্রাণবন্ত ও সফল ভূমিকা পালন করতে পারেন। লালনের গান ভারতের মানুষের অন্তর জয় করেছে এবং করবে।
আহসান : আপনার প্রিয় ও প্রাসঙ্গিক লালনের কোনো বাণী দিয়ে বক্তব্য শেষ করলে খুশি হবো এবং তা দুই দেশের মানুষের কাছে একটি মেসেজ হয়েও থাকবে।
মুচকুন্দ : আচ্ছা, তবে বলি – সুর লাগিয়ে গাইতে তো পারবো না – তাই মুখেই বলি :
জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা।
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সব দেখি তা-না না-না ॥
যখন তুমি ভবে এলে
তখন তুমি কী জাত ছিলে
কী জাত হবা যাবার কালে
সেই কথা কেন বল না ॥
ব্রাহ্মণ-চ-াল চামার-মুচি
এক জলে সব হয় গো শুচি
দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তো কারেও ছাড়বে না ॥
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়
লালন বলে জাত কারে কয়
এই ভ্রম তো গেল না ॥
আহসান : অসময়ে এতটা সময় দেওয়ার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।
মুচকুন্দ : আপনাকেও ধন্যবাদ।