মুরশিদ : দিগন্তের সঙ্গে সমান্তরাল

ইমতিয়ার শামীম
একাত্তর ছিল খান সারওয়ার মুরশিদের একান্ত বিশ্বাস, যে-‘বিশ্বাস একদিনে আসেনি : তা তৈরি হয়েছে ধীরে ধীরে ব্যক্তিক এবং সামষ্টিক অভিজ্ঞতার চাপে।’ জীবদ্দশায় একটি বই-ই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর, কালের কথা নামের সে-বইয়ের সূচনা লেখাটি তিনি শুরু করেছেন সে-বিশ্বাসকে ব্যক্ত করার মধ্যে দিয়ে। যে-ব্যক্তিত্ব মুরশিদের মধ্যে দিয়ে মূর্ত হয়েছে তা মূলত একাত্তর নামক বিশ্বাসের ব্যক্তিত্ব; তিনি তাকে চর্চা করেছেন, লালন করেছেন, প্রকাশ করেছেন মৃত্যু-অবধি। ওই ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিল কেবল ব্যক্তি-অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে নয়, বরং যে-কোনো জাগরণের ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটে, ঠিক তেমনিভাবেই – পর্যায়ক্রমিক রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে, যে-আন্দোলনের সঙ্গে ব্যক্তিও লীন হয়ে থাকে, যে-আন্দোলন দানা বাঁধতে বাঁধতে ব্যক্তিবিকাশের শর্ত হয়ে ওঠে, ভিত্তি তৈরি করে। একাত্তরের এবং একাত্তরকালীন মানুষের বা এই জনপদের জনগোষ্ঠীর একটি ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছিল, মুরশিদের ভাষায় বলতে গেলে, ‘…ক্রমে ক্রমে যার বিভিন্ন স্তর হল ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়, যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি, যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতিগ্রহণ, একষট্টিতে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন, পঁয়ষট্টিতে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের শিক্ষা, ৬ দফার দাবি, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচন-বিজয়ী আওয়ামী লীগের সঙ্গে, ইয়াহিয়া-ভুট্টোর প্রতারণা।’
মুরশিদকে এই ব্যক্তিত্ব থেকে আলাদা করা যায় না, যদিও তার উচ্চতর সাংস্কৃতিক প্রকাশভঙ্গি আজীবন তাঁকে গড়পড়তা মানুষের ওই ব্যক্তিত্ব থেকে আলাদা করে রেখেছে। একই ব্যক্তিত্ব গঠনপ্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেও তিনি আলাদা হয়ে পড়েছিলেন, কেননা, তিনি একাত্তরকে ক্রিটিক্যালি দেখেছিলেন, দেখার সৎসাহস দেখিয়েছিলেন। যেমন, বেঁচে থাকার জন্যে একবার নিজেকে খুব অপরাধী মনে করেছিলেন তিনি – তাও সেই একাত্তরেই এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে দেখে আসার অল্প পরেই তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে। অপরাধের সেই দুঃসহ স্মৃতির ঊর্ধ্বে এখন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের যাঁরা রূপকার ছিলেন, খান সারওয়ার মুরশিদ ছিলেন তাঁদেরই নিকটতম সহযোগী Ñ কাজ করেছেন প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে। কিংবা তারও আগে, যদি ফিরি আরও পেছনে, খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি একজন তরুণ শিক্ষক হিসেবে খান সারওয়ার মুরশিদকে, তা হলে আমাদের নিশ্চিত করেই মনে পড়বে নিউ ভ্যালিউজের কথা। সেক্যুলার-ডেমোক্রেটিক সমাজ আর তার শিল্পসাহিত্য ও ধ্যানধারণার একটি ভিত্তি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তিনি আর সবাইকে নিয়ে, নিউ ভ্যালিউজ ছিল তারই প্লাটফর্ম। ১৯৪৯ সালে তাঁর সম্পাদনায় শুরু হয় এর প্রকাশনা, অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত এ-পত্রিকাটি টিকে ছিল ১৯৬৫-৬৬ অবধি আর এর লক্ষ্য ছিল তেমন এক ভাবাদর্শ চর্চা করা যা সেক্যুলার ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্রের ভিত্তি দাঁড় করাবে। ভাষা-আন্দোলন শুরু হওয়ার পরপরই এমন একটি পত্রিকার প্রকাশনা – দুয়ের মধ্যে কোনো প্রত্যক্ষ সংযোগ না থাকার পরও – ছিল অর্থবহ, কেননা পাকিস্তানের পশ্চাৎমুখী রাষ্ট্রাদর্শের বিকল্প অনুসন্ধানের এই প্রচেষ্টা ভাষা-আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী প্রভাবকে একটি শক্তিশালী ভিত্তি পেতে সহায়তা করেছিল। প্রসঙ্গত বলা যায়, এ-পত্রিকাতেই প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৫৭ সালে অধ্যাপক আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহ্সান-রচিত বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত নামের বইটির সমালোচনা, মুুরশিদের নিজের ভাষাতেই বলতে গেলে, যেটি ছিল ‘একটি অতিরিক্ত তিরস্কার পূর্ণ সমালোচনা’। লিখেছেন তিনি, ‘হার্ভাড থেকে মুনীর, ঢাকা থেকে জ্যোতির্ময় এবং আকবর উদ্দীন সে সমালোচনার প্রতিবাদ করেন। জ্যোতির্ময়ের জবাবটি প্রকৃতিস্থতা, পরিমিতি ও তথ্যনিষ্ঠার একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত – যার জন্য আজ এত কাল পরেও আমি কৃতজ্ঞ বোধ করি।’
কালের কথা  বলতে গেলে খান সারওয়ার মুরশিদের জীবনচিন্তার মিনিয়েচার। মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং সাহিত্য – এই পাঁচ পর্বে বিভক্ত এ-বই যেন মুরশিদের জীবনের বিন্যাস। স্বাধীনতার স্মৃতি থেকে শুরু করে লেখকের জীবিকা ও প্রকাশনার সমস্যা – এমনই বিচিত্র ওই বিন্যাস। জীবনের পরম এক বিশ্বাস দিয়ে, একাত্তরের কথা দিয়ে তিনি তাঁর গ্রন্থ শুরু করেছেন, একাত্তরকে ক্রিটিক্যালি দেখতে শিখিয়েছেন। সেটি ছিল একটি জনগোষ্ঠীর সকল মানুষের একই সমতলে এসে দাঁড়ানোর সময়, মানবিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে সবার রঙে রং মেশানোর সময়। মুরশিদের নিজের জীবনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে জনগোষ্ঠীর আর সবার সঙ্গে মিলে একই সমতলে গিয়ে দাঁড়ানোর জীবন। আবার দ্বিধাদ্বন্দ্ব না থাকলেও কখনো-কখনো তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণেই হয়তো মনে হতো সমকালীনতার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আকাক্সক্ষা থেকে খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছেন, যদিও তিনি থাকতেন মননে, আসলে একই সমান্তরালে। দ্বিধাদ্বন্দ্বের সেই আত্মস্বীকারোক্তি অবশ্য তিনি নিজেই বয়ান করেছেন পরবর্তীকালে তাঁর লেখনীতে। যেমন বলা যায়, ষাটের দশকে সামরিক শাসনামলে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনকালের কথা, এমনকি একাত্তরের কথাও। রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনকালে হাল ধরতে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। নিজে উদ্যোগ নেননি – অকপটেই বলেছেন তিনি, দুই তরুণ ছাত্র এসেছিল তাঁর কাছে, বলেছিল তারা রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন করবে, যার কমিটিতে সভাপতি হিসেবে থাকবেন বিচারপতি মুর্শেদ। বলেছিল তারা, খান সারওয়ার মুরশিদকেও থাকতে হবে ওই কমিটিতে, কেবল থাকলেই চলবে না, দায়িত্ব নিতে হবে সম্পাদকের। পরে মুরশিদ জেনেছিলেন, বিচারপতি মুর্শেদের সঙ্গে আলোচনার আগেই তারা তাঁর নাম ব্যবহার করেছিল, যাতে মুরশিদকে রাজি করানো যায়। মুরশিদ অবশ্য প্রথমেই রাজি হননি। একদিন সময় নিয়েছিলেন। অনেক পরে তিনি নিজেই সেই পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন, ‘প্রশ্ন উঠতে পারে, একদিন পরে কেন রাজি হলাম? এ বয়সে সত্যটাই বলা উচিত – আমার প্রথম চিন্তাটা ছিল, যে-রাজনৈতিক পটভূমিকায় ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে তা বেশ গোলমেলে, প্রতিকূলতা যথেষ্ট আছে, কাজটি সম্পাদন করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে কি না? সেজন্য বাড়িতে এসে স্ত্রীর সাথে কথা বললাম। মনে হলো আমার তো পারা উচিত। সুতরাং রাজি হয়ে গেলাম।’ বিষয়টি লক্ষ করার মতো – একদিন সময় নিয়ে তিনি বাড়ি এসে কথা বলেছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে। দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল এ যেমন সত্য, তেমনি এও সত্য, শেষ পর্যন্ত তিনি তা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। আর সেক্ষেত্রে তাঁকে সহায়তা করেছেন তাঁর স্ত্রী। স্ত্রীর সঙ্গে কঠিন সব বিষয়ে মতবিনিময়ে তাঁর দ্বিধা ছিল না, স্ত্রীও ছিলেন তাঁর চিন্তার একান্ত সহযোগী – মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন আধুনিক। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পথেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে এগিয়ে যেতে তাঁর সহায়ক ছিলেন স্ত্রী। স্মরণ করেছেন তিনি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন পিতৃশহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, সেখান থেকে তিতাস নদী পেরিয়ে ভারত সীমান্তের কাছাকাছি শিঙ্গার বিলে কবি সানাউল হকের খালি বাড়িতে। কিন্তু, বর্ণনা করেছেন তিনি, ‘পনের দিনের দিন অপরাহ্ণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিরস্ত্র মানুষের ওপর যখন আকাশ থেকে নির্মমভাবে গুলি বর্ষিত হলো আর আমি তা তিতাসের ওপারের নিরাপদ দূরত্ব থেকে চেয়ে চেয়ে দেখলাম, অসুস্থ ছেলেমেয়েদের দিকে তাকালাম, আমার স্ত্রীর কাণ্ডজ্ঞানসমৃদ্ধ কিছু বিদ্রুপ আমাকে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল যে, রোমান্টিক পঙ্গুত্বের চাইতে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পার হয়ে যুদ্ধ প্রচেষ্টায় কোনো উপযুক্ত ভূমিকা খুঁজে নেওয়া অধিকতর সম্মানজনক। সেই সন্ধ্যায় অন্ধকার সামনে রেখে সীমান্ত পার হলাম এবং তৃপ্তিকর কাজও খুঁজে পেয়েছিলাম।’
কিন্তু এরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর সেসব থেকে উত্তরণের আখ্যানগুলোকে নিরীক্ষণের বাইরে রেখেও বলা যায়, একাত্তর সম্পর্কে মুরশিদ ক্রিটিক্যাল  ছিলেন এবং ওই অবস্থানও তিনি অর্জন করেছেন তাঁর বিশ্বাসকে প্রগাঢ় করতে গিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সুকৃতিগুলোর কথা বলার পর তিনি তাঁর প্রশ্নকে উত্থাপন করেছেন নির্মোহ দৃষ্টি থেকে : ‘পরবর্তীকালে কখনো কখনো আমার মনে এ-প্রশ্ন জেগেছে, অনুপস্থিত নেতা নিজেও কি সঠিক উপলব্ধি করেছিলেন দৈহিকভাবে উপস্থিত না থেকেও তিনি ন’মাসের যুদ্ধে কত বড় অবদান রেখেছিলেন? প্রসঙ্গত যদি তিনি তা উপলব্ধি করতেন আওয়ামী লীগের মুজিবনগর অধ্যায়ের প্রতি তিনি একটু যথার্থ কৌতূহল এবং ঔদার্য দেখাতে সক্ষম হতেন। এর ফলে ইতিহাস হয়তো একটু অন্যরকম হতে পারতো, কিছু অমঙ্গলের হয়তো জন্ম হতো না, হলেও ভ্রƒণেই তা নিহত হতো।’ মূলধারা ’৭১ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েও লিখেছেন তিনি, ‘যে কোনো ঐতিহাসিকের পক্ষে শেখ মুজিবের মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিতির স্বল্পকালীন ফলাফল এবং দীর্ঘকালীন ফলাফল সম্পর্কে না ভেবে উপায় নেই;…।’ তিনিও তা বারবার ভেবেছেন, যদিও অনুক্ত রেখেছেন, যতটুকু ব্যক্ত করেছেন তা আসলে অন্য কারো আলোচনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন, উপলব্ধি করেছিলেন তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে এবং যেনবা স্বগতোক্তির মতো তিনি বারবার মনে করেছেন তাজউদ্দীনের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাকে। মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত অবিসংবাদিত এক নেতা আর উপস্থিত এক প্রায়-নিঃসঙ্গ নেতার রাজনৈতিক সম্পর্কের যে-উপলব্ধি ও বোধ তার মধ্যে আমরা যে জেগে উঠতে দেখি, তা আমাদের মনেও এক মহাকাব্যিক বেদনার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। আঁদ্রে মালরোর সঙ্গে তাঁর কথোপকথন থেকে জানতে পারি, মুরশিদ তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মুজিব পারবেন তো একটি নতুন রাষ্ট্র তৈরি করতে?’ তখন তো কেবল ১৯৭৩, তখনই কেন তিনি এই প্রশ্ন করেছিলেন? অনুপস্থিত নেতার প্রবাসী সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নিস্পৃহতা থেকেই কি এমন একটি প্রশ্নের ঘূর্ণি জেগেছিল মুরশিদের মনে, আর তাঁর যে-বিদগ্ধতা তা তাঁকে উৎসাহিত করেছিল মালরোর কাছ থেকেই এ-প্রশ্নের উত্তর শুনতে? কেননা তাঁর চারপাশের গড়পড়তা মানুষ এর জবাবে কী বলবেন, তা তাঁর জানাই ছিল! মালরো তাঁকে এর উত্তর দিয়েছিলেন ত্রিকালজ্ঞের মতো, ‘অবশ্যই, যদি না আপনারা শিক্ষিতরা, বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে মেরে ফেলেন। এদেশের মধ্যবিত্ত সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা নেতিবাচক সমালোচনায় পটু এবং সময়ের আগেই মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকেন।’
মালরোর অনুমান ঠিক হয়েছিল। খান সারওয়ার মুরশিদের ভাষায়, ‘মুজিবনগরের বিভিন্নমুখী দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলার পরিবেশে তাজউদ্দীনই বোধহয় একমাত্র ব্যক্তি যাঁর মনে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের একটা সুশৃঙ্খল উপলব্ধি ছিল, বিশেষ করে ভবিষ্যৎটা কেমন হওয়া উচিত তার একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল।’ কিন্তু এই ‘স্পষ্ট ধারণা’ আদৌ কি সংক্রমিত হয়েছিল কখনো শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে? একদিকে সময়ের আগেই মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে সিদ্ধহস্ত মধ্যবিত্ত সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা, অন্যদিকে অনুপস্থিত নেতার মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের পরিভ্রমণ সম্পর্কে নিস্পৃহতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ঠেলে দিয়েছিল মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডির দিকে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক গবেষণার ইঙ্গিত আমরা মুরশিদের স্বীকারোক্তি থেকে পাই সেগুলোর অন্যতম কয়েকটি বোধকরি, যুদ্ধকালীন ও পরবর্তীকালে মন্ত্রিসভার দলীয় চরিত্র অক্ষুণœ রেখেও সর্বদলীয় সহযোগিতার কাঠামোতে জাতীয় পুনর্গঠনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা; প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে মুজিববাহিনী ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমর্থনের প্রয়োজনে জাতীয় মোর্চা গঠনের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য; বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে চিন্তার পার্থক্য ও দ্বন্দ্ব; বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্বের রাজনৈতিক-সামরিক সীমাবদ্ধতা এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মূল সামরিক পরিকল্পনা বাংলাদেশ কমান্ডের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার মতো জটিল ও বিতর্কিত ঘটনা; এবং যুদ্ধের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ‘মধ্যপন্থী’ বিবেচিত শেখ মুজিবুর রহমান কী করে ‘নভেম্বরে  পাকিস্তানি-মার্কিনিদের দ্বারা পাতা ফাঁদ’ অতিক্রম করেছিলেন ইত্যাদি।
একাত্তরে, নির্বাসনের দিনগুলোতে, মুরশিদের যে-কয়টি বই প্রিয়পাঠ্য ছিল, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ এবং প্রাচীন অ্যাংলোস্যাক্সন কবিতার বই। ম্যাকবেথ পড়ার মধ্যে দিয়ে তিনি অনুভব করতেন ইয়াহিয়ার নৃশংসতা, কদর্যতা; অন্ধকারের সেই জগৎকে অবলোকন করতেন তিনি, ক্ষমতায় মদমত্ত খুনি ও অপহরকরা চেষ্টা করছে সব মানুষকে একত্রিত করে কালো গহ্বরে জিইয়ে রাখার, অন্যদিকে, তাঁর রাষ্ট্রহীনতার, গৃহহীনতার অনুভূতি একাকার হয়ে যেত হতাশায় আকীর্ণ অ্যাংলোস্যাক্সন চারণ কবির কবিতার সঙ্গে, ওই কবিতার অনিশ্চিত সমুদ্রযাত্রার হাহাকার সংক্রমিত হতো তাঁর মধ্যে। অন্ধকারের ভীতি আর অনিশ্চিত যাত্রার আর্তি তিনি তার আগে কখনই অনুভব করেননি এতো তীব্রভাবে। এই অনুভূতিজাগানিয়া সাংস্কৃতিক বোধ থেকে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, একাত্ম হয়েছেন একাত্তর নামক বিশ্বাসের সঙ্গে। ধর্মনিরপেক্ষতার সাধক ছিলেন তিনি, একজন সত্যিকারের সেক্যুলার মানুষ হিসেবে তিনি মনে করতেন, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ সব ধর্মকে উৎসাহিত করা নয়, বরং তার অর্থ হলো রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম থেকে ধর্মকে, ধর্মবিশ্বাসকে বিচ্ছিন্ন, বিযুক্ত করা। একাত্তরকে কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের বিশ্বাস করে তোলা না গেলে যে বাংলাদেশ এগোতে পারবে না, একাত্তরকে অমন বিশ্বাসের স্তরে উন্নীত করতে গেলে যে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিয়োগ করতে হবে – এই সত্য তিনি অর্জন করেছিলেন তাঁর প্রাত্যহিক জীবনসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে, জনগোষ্ঠীর মুক্তির সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। একাত্তর নামের বিশ্বাসকে তিনি ধারণ করেছিলেন সংস্কৃতি হিসেবে, আমৃত্যু তিনি ওই সংস্কৃতির চর্চা করে গেছেন।
ওই বিশ্বাস ও সংস্কৃতি চর্চার বিভিন্ন দিক খুঁজে পাওয়া যায় মুরশিদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যবিষয়ক লেখাগুলোর মধ্যে। ওই বিশ্বাস ও সংস্কৃতি থেকেই তিনি জেনেছিলেন, একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা আর সুবিচারকে এক ও অভিন্ন হতে হবে। তাঁর কাছে স্বাধীনতা তখন অর্থহীন হয়ে ওঠে, যখন তা সুবিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। স্বাধীনতার পর মুরশিদ যখন উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন বিশেষত তাঁর আগ্রহেই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল আঁদ্রে মালরোকে, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দিতে চেয়েছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কিংবা স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের মতোই একজন যোদ্ধা হিসেবে। সমাবর্তনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আঁদ্রে মালরো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি রচিত হয়েছে ন্যায় ও মুক্তির জন্য – যাঁদের স্মৃতিসৌধ সুবিচার ও স্বাধীনতার বিজয়-অর্চনা।’ এই বক্তব্য তাঁকে সুবিচার ও স্বাধীনতাকে অভিন্ন করে দেখার দিকে প্রাণিত করে। কিন্তু খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি উপলব্ধি করেন, সুবিচার ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে বাংলাদেশে। প্রথমে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পারিবারিক সদস্যদের হত্যাকাণ্ড বিচারের ক্ষেত্রে ঘোষিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি ও পরে দালাল আইন বাতিলের মধ্যে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করার ঘটনা থেকে তিনি তীব্রভাবে উপলব্ধি করেন, দূরত্ব বাড়ছে সুবিচার ও স্বাধীনতার এবং তাই কি সুবিচার, কি স্বাধীনতা দুটোই হারিয়ে যাচ্ছে স্বাধীন দেশ থেকে। স্বাধীনতা ও সুবিচার ক্রমশ পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল, মুরশিদ এমনিতেই নিভৃত ছিলেন – এরকম পরিস্থিতিতে তিনি আরও নিভৃত হয়ে উঠতে থাকেন। কিন্তু যত নিভৃতেই যান না কেন, থেমে থাকেননি তিনি। নেপথ্যের পুরুষ ছিলেন তিনি, জনপ্রিয়তার মোহ ছিল না তাঁর, ছিল না সবার সামনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দেওয়ার মায়া। কিন্তু দুঃসময়ে তিনি বেরিয়ে এসেছেন নির্ভুল ঋজু হয়ে, সকলের সঙ্গে দাঁড়িয়েছেন একই কাতারে, আশ্বস্ত করেছেন আমাদের – তিনিও আছেন আমাদেরই সঙ্গে। যেমন, ১৯৮৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্মেলনে। নিতান্তই অ্যাকাডেমিক এক ঘটনা, কিন্তু তাঁর উপস্থাপিত সেমিনারপত্রে উঠে এসেছিল সেই রাষ্ট্রকথন, যা তিনি অর্জন করেছেন অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে একাত্তরে, অনুশীলনের মধ্যে দিয়েই যা তাঁর কাছে পরিণত হয়েছিল একান্ত বিশ্বাসে। ওই সেমিনারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুরশিদ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘জ্ঞান ও তত্ত্বের পরীক্ষাগার এবং প্রয়োগক্ষেত্র হলো সমাজ এবং শেষ পর্যন্ত এ দুটো জিনিস জীবন বা ইতিহাস নিরপেক্ষ নয়।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক আচরণের সঙ্গে একাধিক অর্থে যুক্ত এক বিরাট মানব গোষ্ঠীর রাষ্ট্রিক পরিণতি ও জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার প্রশ্ন।’
সব মিলিয়ে প্রচণ্ড এক রাজনৈতিক মানুষই ছিলেন খান সারওয়ার মুরশিদ। তাই তাঁর কাছে বাংলাদেশের সংকট হিসেবে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল কেবল ‘পাকিস্তান মানসিকতার রাষ্ট্রীয়করণ’ই নয়, বরং/এবং এর বিরাজনীতিকীকরণ। তিনি এই বিরাজনীতিকীকরণের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন; বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে দিয়েও যে বিরাজনীতিকীকরণের ইঙ্গিত দেখা দিয়েছিল, বোধকরি তা নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। সামরিক বাহিনীকে তিনি কখনই জনগণের প্রবৃদ্ধির বা উন্নয়নের চালিকাশক্তি মনে করেননি। সামাজিক সম্পদের নিয়ন্ত্রক শ্রেণির সঙ্গে এই রেজিমেন্টেড শক্তির সম্পৃক্ততা ও গণসমর্থনহীনতাকে তিনি বিবেচনায় নিয়েছিলেন খুব গুরুত্বের সঙ্গে। স্থায়ী সেনাবাহিনী ও সামরিক ছাউনি যে অনুৎপাদনশীল খাত, এ-সম্পর্কে তাঁর কোনো দ্বিধা ছিল না। এরিক নর্ডলিঙ্গারের সামরিক শাসনাধীন পশ্চিমের বাইরের ও না-কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ সংগত কারণেই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তাঁর। তাঁর মনোযোগ কেড়েছিলেন কোস্টারিকার নেতা ফিগুয়েরেস। নর্ডলিঙ্গারের ব্যবহৃত ফিগুয়েরেসের ১৯৬৬ সালের দেওয়া একটি ভাষণের উদ্ধৃতিকে তিনিও উদ্ধৃত করেছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সম্মেলনে উপস্থাপিত নিবন্ধে : It is time for Costa Rica to return to her traditional position of having more teachers than soldiers. Costa Rica and her people and her government always have been devoted to democracy and now practise their belief by dissolving the army because we believe a national police force is sufficient for the security of the country. এবং লেখাই বাহুল্য, ওই আনন্দসংবাদের উল্লেখ করতে ভোলেননি তিনি তাঁর সে-নিবন্ধে যে, ফিগুয়েরেস যাতে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে না পারেন সেজন্যে স্থানীয় অলিগার্কির রক্ষক এবং পৃষ্ঠপোষক কোস্টারিকার সেনাবাহিনী সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিল এবং দুপক্ষের বিরোধের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ঘটেছিল, কোস্টারিকা রাষ্ট্রটিতে সেনাবাহিনীর পুরোপুরি বিলোপ হওয়ার মধ্য দিয়ে। জর্জ অরওয়েলের একটি কথা তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিল : ‘আমাদের অবস্থা এত খারাপ যে খুব স্পষ্ট কথারও পুনরাবৃত্তি করতে হয়।’ এ কথার সূত্র ধরে তিনি সেই সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আপনাদের আয়োজিত ‘গণতন্ত্র এবং বিকাশ’-এর আলোচনায় তাই আমি এই সরল এবং পুরনো কথাটাই বলতে চাই যে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র এবং অকর্তৃত্বপরায়ণ, ননঅথরিটেরিয়ান, সাম্যের দিকে অগ্রগতিকেই আমি উন্নয়ন বলে বিশ্বাস করি।’ ১৯৯১ সালের নির্বাচনী ফলাফল তাঁকে বিস্মিত করেছিল; এতই বিস্মিত যে, তিনি ‘মুখর প্রাণের এই দীর্ণ বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধই লিখেছিলেন। তাতে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ওই নির্বাচন শুধু অবাধ এবং নিরপেক্ষ হওয়ার কারণেই নয়, ফলাফল ও নির্বাচক বা ভোটারদের মনোভাবের যে-প্রতিফলন তাতে ঘটেছে তাও বিস্ময়কর। যে-জনগোষ্ঠী একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, সে-জনগোষ্ঠী কি তবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিল? এ-প্রশ্নের উত্তর তিনি খোঁজার চেষ্টা করেছেন শুধু একাত্তরে বিশ্বাসী একজন হিসেবে নয়, সামাজিক বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও, এমনকি সংগঠকের অনুভূতিও তাঁর মধ্যে জেগে উঠতে দেখেছি আমরা একসময়, যখন তিনি সরাসরি বলেছেন, ‘হঠাৎ বাংলাদেশি’ এবং ‘প্রাক্তন ইহজাগতিকতাবাদী’দের আবির্ভাব ঘটতে শুরু করেছে; নতুন এই পরিস্থিতি নতুন এক দায়িত্বও নিয়ে এসেছে, যা পালন করার জন্যে তাড়াতাড়ি আমাদের শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে ‘প্যাঙ্গলসীয়’ ভাব।
মুরশিদের রাজনৈতিকতাকে ঢেকে রেখেছিল তাঁর সাংস্কৃতিক সত্তা, তাঁর সাহিত্যবোধ এবং নিভৃতি। বায়ান্ন থেকে তাঁর নতুন যাত্রা শুরু হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একাত্তরই তাঁর বিশ্বাস হয়ে ওঠে। বিশ্বাসের এই নির্মিতিকেও তিনি ব্যবচ্ছেদ করেছেন নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। বাঙালি মুসলমান যে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার জাগরণের অংশীদার হতে পারেনি, তার কারণ কি কেবল তাদের আধুনিক বিশ্ব ও চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা? কেবল এ-কারণকেই মুরশিদ যথেষ্ট মনে করতেন না, তাঁর কাছে আরো মনে হয়েছে, বাঙালি মুসলমানদের একটি বড় ও প্রভাবশালী অংশের বাংলা ভাষাকে অস্বীকার করাও একটি কারণ। একদিকে বিশ্বচিন্তার ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতারও অধিক সংকীর্ণতা, অন্যদিকে দেশজ সংস্কৃতি অনুশীলনের বদলে প্রত্যাখ্যানের ধারাকে তারা ক্রমশ শক্তিশালী করে তুলেছে এবং তাকে রাজনৈতিকও করে তুলেছে। বাংলার জাগরণ বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে, ঋদ্ধ হয়েছে ওই রাজনৈতিকতাকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে। বাংলায় বাঙালি মুসলমানের যে-জাগরণ, তাতে তিনি দেখেছেন আইরিশদের জাগরণের ছায়া – আয়ারল্যান্ডেও ইউরোপীয় রেনেসাঁস সম্পন্ন হয়েছিল, তাঁর ভাষায় ‘বিলম্বিত তরঙ্গে’, এবং সেটিও সম্ভব হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর সংঘবদ্ধ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ফলে, গৃহযুদ্ধের দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যেও ইয়েট্স, বার্নার্ড শ’, জয়েস, সিংগ, লেডি গ্রেগরির মতো সৃজনশীলদের সৃষ্টিশীলতার কারণে।
এসব সৃষ্টিশীলতাকে মুরশিদ গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। ইয়েট্স তো তাঁর ওপর এতো প্রভাব ফেলেছিল যে, তিনি তাকে নিয়ে একাধিকবার লিখেছেন। শিক্ষাচিন্তা ও সাহিত্যের অধ্যয়ন মুরশিদকে একই সঙ্গে সংবেদী ও বিদগ্ধ যুক্তিমনস্ক সমালোচক করে তুলেছে। তাই তিনি অনায়াসে আমাদের তার এই মত বলতে পেরেছেন যে, ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ‘কবিগুরু’ হতে পারেন, কিন্তু নিশ্চিতই ‘গুরুদেব’ নন।’ রবীন্দ্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর জোর দিয়েছেন তিনি – যে-দৃষ্টিভঙ্গি ভক্তিবাদী নয়, বরং সেক্যুলার। কবি শামসুর রাহমানকেও অনুভব করেছেন তিনি, কেবল হৃদয় দিয়ে নয়, তার সৃজনশীলতার মর্ম খুঁড়ে-খুঁড়ে এবং জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন লিখিতভাবে, লিখেছেন রশীদ করিমের উপন্যাস নিয়েও। আবার আমাদের তিনি পরিচিত করেছেন প্রায় অপরিচিত পোল্যান্ডের কবি তাদেয়ুস রুজেভিচের সঙ্গে। অনুবাদ করেছেন তাঁর কয়েকটি কবিতাও। ভাষান্তরের মধ্য দিয়ে অনুভূতি অপর এক অনুভূতিও অর্জন করে, এই সত্য যদি মানি, তাহলে মুরশিদের হৃদয়ের কবিতাও আমাদের দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। আমরা বুঝতে পারি, আমাদের চারপাশের পতনকে, একাত্তরের বিশ্বাসের পতনকে, রাজনীতির পতনকে তিনি অনুভব করেছিলেন কবিতার সমার্থক শক্তি দিয়েও :
কোনো এক কালে
মানুষ খাড়া নিচে পড়ত
কিংবা খাড়া উপরে উঠত
আজকাল আমাদের পড়া
দিগন্তের সঙ্গে সমান্তরাল
মুরশিদের মৃত্যু ঘটেছে, যেন একটি কালেরই অবসান ঘটেছে। জন্ম নিয়েছিলেন ১৯২৪ সালের ১ জুলাইয়ে, মৃত্যু হলো ২০১২ সালের ৮ ডিসেম্বরে। এর মাঝে কখনো তিনি সংগঠক, কখনোবা ছাত্র, কখনো শিক্ষক, কখনো আবার কূটনীতিক – এমনকি ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত গণআদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত যে গণতদন্ত কমিশন, সেখানেও ছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগে আমরা তার সর্বশেষ দীপ্ত নৈতিক উপস্থিতি লক্ষ করেছি আমাদের দুর্লভ সব প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন আগলে রাখার আন্দোলনে। যে-বিশাল কর্মযজ্ঞে তিনি জড়িত থেকেছেন এবং যে-নিভৃতি নিয়ে তিনি পৃথিবীর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক জ্ঞানভাণ্ডারের আস্বাদ নিয়েছেন সেই কর্মযজ্ঞ ও নিভৃতি তাকে খুব বেশি লিখতেও দেয়নি। ব্যক্তির স্মৃতির মধ্য দিয়ে, রাষ্ট্র ও রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তের ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টার মধ্য দিয়ে, তার শিক্ষাচিন্তা ও সাংস্কৃতিক বোধের বিচ্ছুরণের মধ্যে দিয়ে তিনি ক্রমপ্রকাশিত। মুরশিদের জীবনকে, সাংস্কৃতিক সত্তাকে কিংবা তাঁর মৃত্যুর বেদনাকে আমরা সহসাই বুঝতে পারছি না, পারবও না। তাঁর মৃত্যুর বেদনা উপলব্ধি করতে আমাদের বোধকরি অপেক্ষা করতে হবে আরো বহু-বহু দিন। তাঁর মৃত্যুকে আমরা এখন পর্যন্ত অনুভব করছি, মোটা দাগে বলতে গেলে, ব্যক্তিক স্মৃতি দিয়ে; কিন্তু মুরশিদ আমাদের শুধু ব্যক্তিক স্মৃতি নন – তিনি আমাদের বিশ্বাসের স্মৃতি, সাংস্কৃতিক স্মৃতি।