মুল্লুকযাত্রা

এ  তো দরিয়া! গুণমনি বুঝতে পারে না কিছু, ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে থাকে। আর মগজে কীসব শব্দের আনাগোনা। বয়স বেড়েছে, এখন আর এত কথা জোড়া লাগাতে পারে না, খেই হারায়। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি গহিন আঁধারে, চিকচিক করে জেগে থাকা জল দেখে। কোনো কিনারা নেই বলেই ভেবে নেয় – এ-দরিয়া। এ এক ঝলক!

সীমান্তবর্তী পাহাড়ের চা-গাছের ভেতর দিয়ে বয়ে-যাওয়া সরু নালার অন্য প্রান্তে থাকা বিশাল বপুর দরিয়ার তার অদেখা গল্প। গুণমনি কি তা আর দেখেছে? তবু কোথা থেকে সে আজ এই ব্রহ্মপুত্রের পারে!

সিকান্দার গাজীর পাশে দাঁড়িয়ে টুলটিকরের বোরহানউদ্দীন। ঘন অন্ধকার, ভরা বর্ষায় পানির শব্দে বুক কেঁপে যায়, বোরহানউদ্দীনের চোখে পুত্রশোক। তার সঙ্গে আজ আছে তুর্কি সৈন্যের দল। ইসলাম খাঁর সৈন্যবাহিনী কোনো হিসাব ছাড়া যুদ্ধযাত্রা করে না। বহুদিন আগে থেকে প্রস্ত্ততি নিয়েছে তারা। এই দিনে যুদ্ধযাত্রা শুভ। তাই এই অমাবস্যার রাতে ব্রহ্মপুত্রের পারে যুদ্ধের সাজে সসৈন্য উপস্থিত সিকান্দার গাজী। ভরা বর্ষায় অমানিশায় সহসা বিভ্রান্ত তুর্কি সেনানীরা, তাদের বিভ্রান্ত চোখের ভেতর দিয়ে অগ্নিবাণ ছুড়ে দিয়েছে রাজা গৌড়গোবিন্দ।

আগরের গন্ধেভরা সিলেটকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বোরহানউদ্দীন। তাঁর ছেলে তৈমুর, শিশু বয়সেই কমলালেবুর স্বাদে মুগ্ধ হলো। আহা, টুলটিকর! কী জাদু এই শহরের। মহল্লার সবাই শিশু তৈমুরকে আদর করত, তার ছিল হলুদ চাঁদের বরণ। একবার এক ব্রাহ্মণ প্রতিবেশী শখ করে পৈতা পরিয়েছিল তৈমুরকে, দেখতে নাকি দেবতা ইন্দ্রের মতো! সে-কথায় বোরহানউদ্দীন খুব যে খুশি হয়ে ছিলেন তা নয়, বেগম কেবল পুলকিত ছিল। ছেলের সৌন্দর্যতুষ্টিতে সে বরাবরই আমোদিত হয়; কিন্তু সেসব আজ অতীত। এখন সে বিগত। পুত্রহত্যার প্রতিশোধ বোরহানউদ্দীনের হৃদয়ে তুফান তুলেছে। গৌড়গোবিন্দের অগ্নিবাণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া সৈন্যবাহিনীকে তিনি ফিরে আসার আহবান জানান। ব্রহ্মপুত্রের তীরে দাঁড়িয়ে এক হাতে তূণে রাখা তিরটি তুলে ধরেন বোরহানউদ্দীন, যার দক্ষিণ হস্ত কর্তন করেছে ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা রাজা গৌড়গোবিন্দ।

জঙ্গল আর চা-গাছের সরু নালি থেকে হঠাৎ কোথায় এসে পড়ে গুণমনি! দরিয়ার পারে সে তো কোনোদিন যাই নাই। আর ওই যে হাতকাটা বোরহানউদ্দীন, তাঁকে সে চেনে না। কবে যেন কেবল শুনেছিল, কত শতবছর আগে লোকটি সিলেট শহরকে ভালোবেসে ঘর বেঁধেছিল। এই শহরের একটা আলাদা প্রেম আছে, তা কি গুণমনি জানে না? কত কত বছর আগে তার বাপ আর বাপের বাপও তো এই শহরের প্রেমে ছুটে এসেছিল। এই মাটির প্রেম, মাটিতে সোনার খোঁজ কত জনে পেয়েছিল! সেই খোঁজেই তো সব হলো এই বাগান-কুলিপাড়া-সাহেবঘর। আর তাই তো গুণমনির জন্ম এই চা-বাগানে। যদিও কোনো সোনা আজো খুঁজে পেওয়া গেল না।

এসব কথা আজকাল খুব মনে পড়ছে গুণোর। কদিন ধরে চাতালে বসে রাতের আড্ডা জমে। রাবার বাগানের শ্রমিকরা যেমন আসে, তেমনি শহুরের কিছু ছোকরা বাবুর দল। তারাও দেখি এসে সেই বাপ-ঠাকুরদার গপ্পো করে!

শহুরে বাবুর কাছেই কেবল গুণমনি এসব শোনে না; সে নিজেও তো জানে, কেমনে জানে? এক-একটা ছায়াগাছের বয়সই বা কত? এই পাড়ায় তার মতো বুড়ো কি আর আছে? কিন্তু ওই যে  ছেলে-ছোকরারা কথাগুলো বলে, তা তো সে বোঝে না। কেবল কুহক মনে হয়।

ভগ্ন-পুত্রশোকে কাতর বোরহানউদ্দীন ব্যর্থতায় এক হাতে বুক চাপড়ায়। তার চোখের জলে আরো জলের পুত্র হয়ে ওঠে ব্রহ্মপুত্র। কিন্তু সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের কোনো পুত্রশোক নয়, পরাজয়ে তাঁর ক্রোধ অন্যরকম রূপ ধারণ করে। কৌশলী আর ধাতস্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাঁর, নানা অনুসন্ধানে তিনি তাঁর ভাগিনা সিকান্দার গাজীকে প্রেরণ করলেন এক আধ্যাত্মিক পুরুষের কাছে, যে আধ্যাত্মিক মানুষটি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন, এবং সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য পবিত্র আরব দেশের মাটি নিয়ে ছুটে এসেছেন এই ভূমে!

চা-বাগানে শহুরে লোকজন নতুন করে আসছে, গুণমনি জানে ওরা কেন লুকিয়ে লুকিয়ে আসে; কিন্তু এখনো গুণ বোঝে না, শহুরে ছেলেগুলো আসলে কী চায়? এতদিন পাড়ার সবাই গুণমনির কাছে কিস্সা শুনতে আসত, এখন আসে না। আর আসবেই বা কেমনে? সে নিজে কি আর এখন গপ্পো করে? সে-ও তো ওই চ্যাংড়া পোলাপানের কথাগুলো হাঁ করে গিলে, রাবার বাগানের হরিহর কেমন হইহই করে গান গাওয়া শিখছে! কী এক কালো মানুষের গান। হাতুড়ি নিয়ে নাকি রেললাইন বানিয়ে ফেলল লোকটা। কিন্তু এমন গান গুণ কোনোদিন বাঁধতে পারল না! তার বাপ আর ঠাকুরদা যে হাতা-কাস্তে হাতে জংলা কেটে, জোঁকের মুখে থুতু ছিটিয়ে এমন বাগান গড়ল, তা কি আর সে গানে বাঁধতে পারল?

তিনশো এগারোজন আওলিয়া, নাকি তার চেয়েও বেশিসংখ্যক? এতসব মনে থাকে না, হজরত শাহজালালের সিলেট যাত্রার অভিযাত্রীর সঠিক সংখ্যা মনে করতে অনেকেরই কষ্ট হয়। সে তো সাতশো বছরেরও পুরনো গল্প, সেই গল্পও শুনতে বসে এই বাগানের কুলি-কামিন। গুণমনি শোনে, রাবারবাগানের শ্রমিকরা শোনে আর দু-চারজন গৃহস্থ কৃষক। সবাই রাতের আঁধারে বসে শোনে। তিনশো নাকি সাড়ে তিনশো, তিনশো ষাট বা তিনশো এগারো – কারো কারো মাঝে এই সংখ্যা নিয়ে তর্ক চলে, তবু জানে এই সংখ্যাটা এখন নিক্তি দিয়ে গুনে সুধরানো জরুরি নয়, জরুরি হচ্ছে হজরত শাহজালালের সিলেটযাত্রা। হাতে করে আরব দেশের মাটি, দিল্লির জোড়া কবুতর আর সেই কাফেলা। মানুষের মনে দুঃখ ঘন হলে, একবার শোনা গল্প তারা আবার শুনতে বসে। গল্পের মধ্যে ডুবে গেলে সুখ হয়, স্বপ্ন হয়। গল্পের মধ্যে মানুষ নিজের পুনর্জন্ম খোঁজে।

সবাই এটা জানতে পারে যে, সে-সময় বোরহানউদ্দীন হজরতের পায়ে পড়েছিল পুত্রহত্যার বিচার চেয়ে। সুলতান শামসুদ্দীনও ততদিনে তার যথার্থ অনুসন্ধানের প্রান্তসীমায়, জ্যোতিষীর গণনা শেষ। সে-গণনায় এটা নিশ্চিত যে, আওলিয়া-দরবেশ ছাড়া রাজা গৌড়গোবিন্দকে পরাস্ত করা অসম্ভব।

সব ভিন্ন অনুসন্ধানকারীর যাত্রাপথ ছিল এক। তারা সিলেটের পথে ধাবিত। কেউ প্রতিশোধ নিতে, কেউবা সত্য প্রতিষ্ঠা করতে। সবাই জানতে পারে, হজরত শাহজালাল বোরহানউদ্দীনকে সাহায্যের অঙ্গীকার করেন। সিকান্দার গাজী এই আধ্যাত্মিক পুরুষের শক্তিতে বিশ্বাস রাখেন, নিজ সৈন্যবাহিনীকে নির্দেশ দেন এই কাফেলায় যোগ দিতে।

কিন্তু ভরাবর্ষায় গৌড়গোবিন্দর ক্ষমতার কথা তাদের অজানা নয়। ব্রহ্মপুত্রের পানিকে এ-রাজা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ফেলে! এভাবে শত্রম্নদের আগেও ঘায়েল করেছে সে। শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যে তুর্কি সৈন্যদলকে সে অগ্নিবাণে পরাস্তও করেছে। তাই সবার মাঝে যেমন আধ্যাত্মিকতার ওপর বিশ্বাস, তেমনি বিগত অভিজ্ঞতায় ভয় বিদ্যমান। সবার মাঝে দ্বিধা স্পষ্ট।

গুণমনি শহরের শিক্ষিত ছেলেপেলেকে খুব যে চেনেটেনে তা নয়। সে তাদের কেবল মে দিবসের দিনই দেখতে পেত। কত কত গান আর বক্তৃতায় মুখর সেসব মুখ। কিন্তু এই যে কয়েকদিন এত আনাগোনা, এত গল্প। এমনকি গুণমনিদের সিলেট আগমনের গল্পও তাদের মুখেই শোনা যাচ্ছে! বহুদিন এমন করে তাদের গল্প অন্য কেউ বলেনি। নিজেদের কথা অন্যের মুখে শুনতে ভালো লাগে, মানুষের বিশ্বাস জাগে। তবু গুণমনি মনে হয় – তারা যা বলছে তা সত্যি কিনা, সে-নিশ্চয়তা দেবে কে? এতকালের বয়সে গুণমনি কোনোদিন শোনেনি যে, এমন শহুরে জীবন আর চা-বাগানের কুলি-কামিনদের জীবন এই চাকাতেই পিষ্ট হচ্ছে! এ কেমন কথা! তাদের সঙ্গে কুলিকামিনদের যায় নাকি? এই যে বাগানের বাবুরা, এত বছর ধরে একসঙ্গে আছে, তাতেও তো বাবুপাড়া আর কুলিপাড়া কোনোদিন এক হয় না। তেলের মতো, জলের মতো যার যার মতো ভেসে থাকা, এক আর হলো কই? আর এসব চ্যাংড়া পোলাপান বলে কিনা তাদের মতো এই কুলিকামিনরা? কোনো কালে একটা গাছের মাথা নোয়ায়নি, গুণমনির বাপ জানে, চিনে-জোঁক কেমন রক্তচোষা! রাতে শেয়ালের পেটে শিশুসন্তান হারানো দীপেন  মুণ্ডা জানে, সেই কষ্ট কোঁচড়ে রেখে বউটা তার থলিভর্তি চা-পাতা নিয়ে ফেরে।

চা-গাছের শক্ত শেকড় তাদের আটকে রেখেছে ঘন কালো এই ছোট দেহে, কোনোদিন এই ছায়াগাছ ছেড়ে রোদ্দুর পোহায় না জীবন। অথচ তারাও নাকি একদিন দলবেঁধে এসেছিল এই জংলায়। সে-কথা গুণমনি জানে, পানির আকাল, খরার আর মরার দেশ ছেড়ে তার বাপ আর বাপের বাপ একদিন কোম্পানির গাড়িতে চড়ে বহু পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। গুণমনির ঠাকুরদা কইতো ফাঁকি দিয়া তাদের এই রাজ্যে আনছে ব্রিটিশ। কোনো বীরভূম নাকি বিহারের এক ধূসর অতীত তাদের ডেকে ফেরে। সে-জীবনে পানিহীন মরুর চোখে মরীচিকার স্বপ্নে ভেসে উঠেছিল সোনা, সোনার ঝিলিক নাকি এক মারাত্মক জিনিস। মানুষরে পাগলা কুত্তার মতো তাড়িয়ে নেয়। তেমনি জীবনের লোভে তাদের পূর্বপুরুষ ছুটে এসেছিল। আর তাদের দালাল যদুরাম, শেষ পর্যন্ত ঠাকুরদা আর তার দোষ দিত না। সোনা না হোক, এই চা-বাগান তো তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। বাপ অবশ্য বলত মেরেছেও তো ম্যালা।

বাপ-ঠাকুরদার রাগ তখন ওই ব্রিটিশদের ওপর, সাহেবরা যখন চাবুক হাতে দাঁড়িয়ে থেকে জংলা কাটিয়েছে, নিজেদের হাসি-তামাশা পর্যন্ত করতে দেয়নি, মাথা নোয়ায়ে রেখেছে। পেটে মাত্র একবেলা অন্ন পড়েছে। বাগান আর কুলিপাড়ার খুপরি ছাড়া তারা কি আর কিছু চিনত! রোগে ওষুধ পায়নি। সাপে কাটে, ম্যালেরিয়ায় মরে, মড়ক লাগে কত মানুষ মরে তবু বাগান গড়া বন্ধ নেই। প্রাণ থাকতে তাদের ছুটি মেলেনি।

এই গুণমনিরা এখন এই পাকা সড়ক ধরে শহরের যায়, সেই শহরের রাস্তা চিনতে চিনতে গুণমনির বাপেরও তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছিল। আজ ওই রাস্তা ধরে একদল শহুরে মানুষ এসে বলল, চল আমরা তোরা একলোক, আর তারা দৌড়ে যাবে?

গুণমনি ভাবতে পারে না। তার তো কোনো কালেই এমন শক্তপোক্ত কথা লাইনে লাইনে সাজিয়ে কওয়ার অভ্যাস নেই। শুক্র পারে, মেয়েটা যত বড় হচ্ছে তত কথায় কথা সাজানো শিখচ্ছে। গুণ তো কেবল কিস্সা শোনাত, সাজের সময়, বাগান থেকে ফিরে সবাই যখন গা এলিয়ে বসত, তখন সে কেবল কিস্সা কইত। তা কখনো কখনো খেই হারানো গল্পের মতো, বিচ্ছিন্ন। শুরু হয় তো শেষটা আর নেই। কোনো গল্পের শেষটা জানে শুরুটা আর স্মরণে নেই। গুণমনি এমনই। এই চা-বাগানে গুণমনি নিজেই একটা গল্প।

গুণ যখন কিস্সা কয়, তখন তা আর গল্পে থাকে না, আস্তে আস্তে তা যেন নিজের জীবনের কথা হয়ে যায়! সবই ঘুরেফিরে তার কথা, বাপের কথা কিংবা ঠাকুরদার কথা। দলবেঁধে যারা একসঙ্গে এসেছিল তাদের কথা, আসতে আসতে পথে যারা গেল, বাগান গড়তে যাদের প্রাণ গেল, তাদের সবার গল্প এই চা-বাগানের জীবনেরই গল্প। তা এসব তো তাদের জীবনে ঘটে-যাওয়া কথা। মা গুণমনির কিস্সা থেকে জন্ম নেওয়া আজকের এই গুণমনি, তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এ তো মা গুণমনির পুনর্জন্ম, দেহটা কেবল সে নতুন পেয়েছিল। সে-কথা জেনে জেনে বড় হতে থাকা জীবন তার। এই বয়সে আর মাথায় এসব নিতে পারে না। সেই কবেকার জীবনের সঙ্গে গুণকে বেঁধে দিয়েছিল ঈশ্বর! মা গুণমনি কয়ে কয়ে যারে বড় করল, সেই মায়ের দেহে অনেক ক্ষত, অনেক কিস্সা। এসব চ্যাংড়া পোলাপান সেই কিস্সা জানে না। তারা কেবল হাতুড়ি-গাঁইতি চেনে, তারা কেবল শোষক নামটি জানে। শোষণ কারে কয় তা কি আর জানে? গুণমনি জানে, তার দেহের প্রতিটি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে সে জানে শোষণের কত কত ধাপ। তবু সে শুনেছে রাবারবাগানের বীরেন শিক্ষিত ছেলে, তাঁর শুক্র তো কেবল স্কুল গেছে, শেষও করেনি। তাতেও আজ শুক্রটা কেমন কথা কইতে শিখেছে। কিন্তু গুণ তো জন্ম-জন্মান্তরের জানা, দুই জীবন দিয়ে সে জেনেছে। তা আর স্কুলে গিয়ে শেখা না, তা আর অক্ষরে অক্ষরে জানা না। গল্পে গল্পে জীবন! তাই ভয় করে, ভরসা পায় না। সুন্দর অক্ষরের মতো ভাষা শুনে শুনে মায়া জাগে, তবু বিশ্বাস জাগতে কষ্ট হয়। বিশ্বাস করেই তো এই সিলেটে এক জন্মে সে এসেছিল, তা সে তো ঠকেই ছিল।

কত কত বছর আগের কথা! গুণমনি কিছু মনে করতে পারে না, অথচ সে শুনেছে, শুনে শুনে চোখের তারায় সে কতবার দেখে নিয়েছে সেই যাত্রা। সারাজীবন তো সে সেই যাত্রার মধ্যেই আছে। একদিন তার মুল্লুক আর আজকের মুল্লুক তো আর এক নাই। সেই যে তার আগের জন্ম, যে-জন্মের কথা পাড়ার লোকে কইতো, যেই জন্মের ঋণ শোধ করতেই আবার সে এসেছে, সেই জীবনটা এক লাইনে স্বপ্নের মতো জেগে থাকে গুণমনির চোখে।

গুণমনিই সেই বৃদ্ধ নারী। শতবর্ষী চা-গাছের মতো যে এই গহিন পল্লিতে জেগে থাকে। সুদূর চোদ্দো পুরুষের ভিটার নির্মম আর সত্য গল্পের ঝুড়ি নিয়ে আগত চা-শ্রমিকের শিশুকে ইতিহাস শোনায়। জানায় কোথায় ছিল তাদের মুল্লুক। সেই গুণমনি যার পেছন পেছন একদিন নিজ মুল্লুকে ফিরে যাওয়ার জন্য হেঁটেছিল শত শত কুলিকামিন। তারা কি জানত কোন সে-পথ? কেবল শুনেছিল চাঁদপুরে স্টিমারে করে যাওয়া যায়? ওমনি ফেলে-আসা ভিটার টানে ছুটেছিল সবাই, আহা মেঘনা নদী। মা গুণমনিই নাকি কুলিকামিনদের পথ দেখায়, হাঁটে মুল্লুকের পানে। সেই যাত্রা সফল হয়নি। আহারে, মেঘনার জল! এখনো সে-দরিয়ার জলে রক্তের দেখা মেলে। সে কত বছর আগেকার কিস্সা। ব্রিটিশ শাসন, দেশে নাকি এক উত্তাল সময়। সেই ঢেউ তারা জানে না, কেবল জানে বন্দি চা-বাগান থেকে মুক্তির আশায় তারাও স্রোতের মতো বেরিয়ে পড়েছিল।

আজো গুণমনির চোখে মেঘনা মানে বিস্তর জলরাশি নয়, রক্তের স্রোত! গোর্খা সেনারা শত শত কুলিকামিনের পথ আগলে দাঁড়াল। বোকা চোখে চেয়ে-থাকা শত শত কুলিকামিন! পাখি শিকারের মতো নির্বিচারের গুলি চালাল খাকি পোশাকের মানুষ! আহা রে, পাখির মতো প্রাণ! ঝরে ঝরে মেঘনা লাল স্রোতে ভাসে। গুণমনির শোনা কিস্সা এসব, গুণমনির শোনানো কিস্সা এসব। তাও যেন চোখে দেখা, এ জ্ঞাতিগুষ্টির রক্তের টান। গুণমনির চোখ ঝাপসা, এত সহজ নয় মুলস্নকযাত্রা! বহু বছর কেটে গেছে তবু গুণমনির মনে হয় এত সহজ নয় মুল্লুক রক্ষা!

কিন্তু তুর্কি সৈন্যরাও ভাবেনি, পিরবাবা এত সহজেই পরাস্ত করবে রাজা গৌড়গোবিন্দকে। আওলিয়ার কী কেরামতি! একটা জায়নামাজে বসে সে পার হয়ে গেল ব্রহ্মপুত্র! সে তো পরিক্ষীত, দীক্ষা অর্জনের পরই সে ভারতবর্ষে যাত্রা শুরু করেছিল। বাবা শাহজালাল তো সোনার খোঁজে নয়, মাটির খোঁজে ছুটে এসেছিলেন এই ভূমে।

সহসা ঘুম ভেঙে যায় গুণমনির। কোথায় ব্রহ্মপুত্র। এতো কালাগুল। যেন শত বছরের ঘুম পেড়িয়ে জেগে উঠে সে, স্বপ্নের সবটুকু মনে পড়ে না। জেগে উঠলে গুণমনি কেবল মনে করতে পারে, বাবা শাহজালাল সোনার খোঁজে নয়, মাটির খোঁজে এসেছিলেন! r