মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

আনিসুজ্জামান

খবরটা, মনে হয়, পড়েছিলাম মর্নিং নিউজে। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে কারাবাসের দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের সদ্যনিযুক্ত প্রভাষক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নিয়োগ বাতিল হয়ে গেছে। তিনি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহদ্বারে বুকে ট্রে ঝুলিয়ে সিগারেট বিক্রি করছেন এবং এই চলমান দোকানের নাম দিয়েছেন ‘শেলী’জ ওন শপ’।

প্রায় সন্ধের দিকে দৃশ্যটা দেখতে গেলাম। কলাভবনের গেটের সামনে তাঁর চারপাশে ছোটোখাটো জটলা। অনেকেই তাঁর গ্রীবাদেশ থেকে ঝুলন্ত ট্রেতে রাখা সিগারেট কিনছে। আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, ‘আমার নাম আনিসুজ্জামান। আমি নেয়ামাল বাসিরের সহপাঠী।’

তখন আমরা জগন্নাথ কলেজে আইএ প্রথম বর্ষের ছাত্র। সহপাঠী নেয়ামাল বাসির একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জেলে গিয়েছিল এবং শেলী ভাইয়ের সঙ্গে এক প্রকোষ্ঠে বন্দি ছিল। জেল থেকে সে ছাড়া পেয়ে উঠেছিল আমাদের বাড়িতে, যে-মেসে সে থাকত, কোনো কারণে তখন তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার কাছ থেকেই মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ওরফে শেলী ভাইয়ের সঙ্গে তার বন্দিজীবনের বৃত্তান্ত শুনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেলী ভাইয়ের নিতান্ত অস্থায়ী নিয়োগ ঘটেছিল তাঁর কারাজীবনের পরে। তাঁর মতো পূর্বাপর মেধাবী ছাত্রের পক্ষে এই নিয়োগলাভ ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু আইনভঙ্গকারী জেলখাটা যুবকের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে সরকার তাদের অসন্তোষের কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গোচরে আনে। বিভাগীয় অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুল হালিম সেকথা শেলী ভাইকে জানান। শেলী ভাই বলেন, তাঁর কারণে বিভাগের অধ্যক্ষ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চান্সেলর বিব্রত হোন, তা তিনি চান না। তিনি পদত্যাগপত্র দাখিল করেন।

তারপরও বিষয়টা নিয়ে মৃদু পদত্যাগ করার তাগাদা অনুভব করেন তিনি। তার ফলেই ‘শেলী’জ ওন শপ’।

রাজনীতির প্রতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান যে তেমন আকর্ষণ বোধ করেছিলেন, তা নয়। তাঁর আইনজীবী পিতা ছিলেন মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুরে মুসলিম লীগের একজন স্থানীয় নেতা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে তিনিও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। দল বদলে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে তিনি বছরের শেষে রাজশাহীতে এসে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিলেন। ততদিনে শেলী ভাইও প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আই এ পাশ করে রাজশাহী কলেজে চলে আসেন ইতিহাসে অনার্সের ছাত্র হয়ে। এখানে থাকতেই ১৯৪৮ সালে তিনি ভাষা-আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট হন। রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহ্র বক্তব্য শেলী ভাইয়ের আঞ্চলিক আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বপ্নকে বড়োরকম আঘাত দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগ স্থাপিত হয়েছিল।

ইতিমধ্যে শেলী ভাইয়ের পরিচিতি গড়ে উঠেছিল একজন নেতৃস্থানীয় ছাত্র হিসেবে। ১৯৫০-৫১ শিক্ষাবর্ষে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র-সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁর বন্ধু জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী হয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু মুসলিম লীগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগের সমর্থক ছাত্রেরা একযোগ হয়ে যাওয়ায় নির্বাচিত সংসদের বাজেট পাশ হয়নি। ফলে বিধান-অনুযায়ী সংসদকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন লাভ করেছিল। ২০ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি হয়ে গেলে যে-কয়েকজন ছাত্র তার প্রতিবাদে ফজলুল হক মুসলিম হলের পুকুরপাড়ে বসে গভীর রাতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে মত দেন, তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। আর ছিলেন জিল্লুর রহমান (পরে রাষ্ট্রপতি), আবদুল মমিন, মোহাম্মদ সুলতান, গাজীউল হক, আনোয়ারুল হক খান ও এম আর আখতার। হয়তো আরো কেউ কেউ ছিলেন। কীভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে, সে-সম্পর্কে তাঁদের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়-প্রাঙ্গণের সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত এবং দশজন করে দল বেঁধে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক পেরিয়ে রাস্তায় ওঠার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। দশজনের প্রথম অথবা দ্বিতীয় দলের নেতৃত্ব দেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।

বন্দিদের আদালতে হাজির করা হলে তাঁরা বলেছিলেন, ১৪৪ ধারা জারি করা হয় অন্যায়ভাবে, আমরা সেই অন্যায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছি। এঁরা সকলে মুক্তি পান ১১ মার্চে। তারপর শেলী ভাইয়ের নিয়োগলাভ ও পদত্যাগ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কিছুদিন তিনি শিক্ষকতা করেন সিরাজগঞ্জ কলেজে। সরকারের অসন্তোষের ভয় না করে অধ্যক্ষ খান বাহাদুর আবদুর রহমান খাঁ তাঁকে নিয়োগ দেন জগন্নাথ কলেজে। ততদিনে আমরা টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে গেছি।

ঢাকা থেকে তখনি নবপর্যায়ে সওগাত প্রকাশিত হচ্ছে হাসান হাফিজুর রহমানের দায়িত্বে। হাসান একটা প্রবন্ধ চেয়ে আনেন শেলী ভাইয়ের কাছ থেকে – সমকালীন য়ুরোপীয় রাজনীতি ও ভাষা-সমস্যা নিয়ে। সম্ভবত তৃতীয় সংখ্যায় তা ছাপা হয় পত্রিকার শুরুতে। সে-লেখার সম্মানী বাবদ পঁচিশ টাকা বরাদ্দ করেন হাসান – কিন্তু কর্তৃপক্ষের হাত গলে টাকাটা শেলী ভাইয়ের হাতে পৌঁছোয়নি। ক্ষুব্ধ শেলী ভাই অনেকদিন পর্যন্ত আর কোথাও লেখালিখি করেননি।

সওগাত অফিস থেকে একদিন বেলাবেলি ফিরছি নবাবপুর রোড ধরে। দেখি, নিখুঁত স্যুট-টাই-শোভিত শেলী ভাই রায়সাহেব বাজারের দিক থেকে কলেজের দিকে যাচ্ছেন, হাতে একটা নারকেলের হুঁকো। সবিনয়ে জানতে চাই, হুঁকো কেন? স্মিতহাসি হেসে তিনি বলেন, ‘কামরুজ্জামান সাহেবের পাইপের জবাব।’

জগন্নাথ কলেজের গণিতের শিক্ষক কিউ কিউ জামান সাদা খদ্দরের পাঞ্জাবি-পাজামা-টুপি পরতেন, কিন্তু ভালো তামাক খেতেন পাইপে। স্যুট-পরা শেলী ভাই নারকেলের হুঁকো খেয়ে তার জবাব দেবেন। তাঁর রসবোধের প্রশংসা না করে পারা যায় না।

কিউ কিউ জামান পরে রাজনীতিতে যোগ দেন, যতদূর মনে পড়ে, আওয়ামী লীগেই, কিন্তু তেমন কিছু করতে পারেননি।

একটা বৈদেশিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বৃত্তি পেয়ে শেলী ভাই চলে যান বেলিয়ল কলেজে – ইতিহাসে অনার্স পড়তে। ততদিনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রি নিয়েছেন। এবার অক্সফোর্ডের ডিগ্রি নিয়ে লিঙ্কনস ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে আসেন। যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে – ইতিহাস ও আইনের শিক্ষকতায়। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় ফিরে এসে আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন হাইকোর্টে এবং সেইসূত্রে, একজন মুহুরির পরামর্শে, Law of Requisition (১৯৬৬) নামে একটি চটি বই লেখেন। সেটাই তাঁর প্রথম বই। পরে ইংরেজিতে আরো বই লেখেন তিনি, কিন্তু সে-প্রসঙ্গে আমরা যাব না।

সবাইকে চমকে দিয়ে ১৯৭৪ সালে তিনি প্রকাশ করেন যথাশব্দ – ‘বাংলাভাষার প্রথম ভাব-অভিধান’।  জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর অনুরোধে কলকাতায় শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়কে বইটা পাঠান সংকলয়িতা। তিনি সেটা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গোচরে আনেন। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বার্ষিক সম্মিলনীর সভাপতির ভাষণে সুনীতিকুমার সোল্লাসে বলেন :

এই বইখানি বাঙ্গলা ভাষায় একটি বড় অভাব বহুলভাবে পূরণ করিল। বাঙ্গলা ভাষা, শব্দকোষ, সাহিত্য প্রভৃতি সব দিকেই বহু অনুসন্ধান ও গবেষণা হইয়াছে, ভাল অভিধানও বাহির হইয়াছে এবং আরও হইতেছে। কিন্তু ইংরেজী Thesaurus-এর মত বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বিচারশৈলী অনুসারে, বিভিন্ন প্রকারের দ্যোতনার শব্দের বিশেষ কার্য্যকর অভিধান ছিল না। বাঙ্গালী সাহিত্যিক ও সাহিত্যরসিকের পক্ষে যথাশব্দ অভিধানখানি এইরূপ একখানি অপরিহার্য্য পুস্তক-রূপে এখন দেখা দিল।

এমন সিদ্ধিলাভের পর কাউকে আর পেছনে তাকাতে হয় না, তাঁকেও হয়নি। কিন্তু আত্মতুষ্টি তাঁর স্বভাবে নেই। তাই দেখি, দ্বিতীয় সংস্করণে যথাশব্দকে ঢেলে সাজিয়েছেন তিনি। প্রথমে যেখানে ছিল শব্দের ছটি শ্রেণিবিভাগ, প্রায় দু-দশকের ব্যবধানে সেখানে হয়েছে আটটি শ্রেণিবিভাগ এবং অন্তর্গত পরিবর্তন হয়েছে নানাভাবে। তারপরও তিনি আরো অদল-বদলের কথা ভেবেছিলেন, বিশেষ করে, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ব্যবসায় ক্ষেত্রের যেসব নতুন শব্দ আমাদের প্রাত্যহিক ব্যবহারে চলে এসেছে, সেসব শব্দের অন্তর্ভুক্তির কথা।

অভিধান-জাতীয় গ্রন্থ সংকলন করে, মনে হয়, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালে হাইকোর্টের বিচারক নিযুক্ত হওয়ার পরেও সে-কাজ চলে অব্যাহত গতিতে।  কোরানসূত্র (১৯৮৪) এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কোরানের সঙ্গে সূত্র শব্দটি যোগ করতেও সাহস লাগে। তিনি সেই সাহস দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও অধিক পরিশ্রম করে নিজের আরবি-জ্ঞানের সঙ্গে কোরানের একাধিক ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ মিলিয়ে এই কোরান-অভিধান তিনি সংকলন করেন। এর ফলেই সম্ভবপর হয়েছিল কোরানের সরল বঙ্গানুবাদ (২০০০) প্রকাশ করা। এটি হয়তো তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থ। তিনি নিজে ছিলেন গভীরভাবে ধর্মবিশ্বাসী। সুতরাং কোরানসূত্র তাঁর কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত ছিল না। শুধু স্বধর্মে নয়, অন্য ধর্মেও যে তিনি কৌতূহলী ছিলেন, তার পরিচয় ধরা রইল যার যা ধর্ম (২০০৯) বইতে। এটিও অভিধানের মতো ভুক্তি ধরে লেখা। সকল ধর্ম সম্পর্কে একখানি বইতে এত তথ্যের সমাবেশ বোধহয় বাংলাভাষায় আর নেই।

তাঁর অভিধান-জাতীয় বইয়ের অন্য নিদর্শন বচন ও প্রবচন (১৯৮৫) এবং মিত্রাক্ষর (২০০০)। প্রথমটির বিষয় নামকরণের মধ্যেই নিহিত আছে, দ্বিতীয়টি হলো অন্ত্যমিল-অভিধান। এই               দু-ক্ষেত্রেই তাঁর আকর্ষণ ছিল। তাঁর কোনো কোনো বইয়েরও নামকরণ হয়েছে বচন ও প্রবচন-অনুযায়ী। যেমন, তেরই ভাদ্র শীতের জন্ম (১৯৮৬)। যথাশব্দেও আমরা লোকপ্রচলিত অনেক শব্দ ও বচনের ব্যবহার দেখেছি। আর তাঁর মনে কবিতা-রচনার যে-বাসনা কাজ করতো তারই পরিচয় বহন করে তাঁর              অন্ত্যমিল-অভিধান সংকলনের প্রয়াস।

তাঁর রবীন্দ্রচর্চার প্রথম নিদর্শনও পাই অর্থপূর্ণভাবে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি-সংকলনে। রবীন্দ্র-প্রবন্ধে সংজ্ঞা ও পার্থক্য বিচার (১৯৬৮), মাতৃভাষার সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৩), রবীন্দ্র-রচনার রবীন্দ্র-ব্যাখ্যা (১৯৮৬), রবীন্দ্র-বাক্যে আর্ট, সংগীত ও সাহিত্য (১৯৮৬) – এসবই গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর মতো, কিন্তু সে-পুজোর সামগ্রী আহরণ করা খুব সামান্য ব্যাপার নয়। গভীর অধ্যয়ন ও কঠোর পরিশ্রম ছাড়া এমন কাজ করা যায় না। পরে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর নিজের কথা শোনার সুযোগ আমাদের হয়েছে – কবি তুমি নহ গুরুদেব (১৯৯৭), একজন ভারতীয় বাঙালির আত্মসমালোচনা (২০০০), রবীন্দ্রনাথের আইনি ভাবনা (২০০২) এবং অগ্রন্থিত বহু প্রবন্ধে। রবীন্দ্রনাথকে ভারতীয় বাঙালি বলে অভিহিত করায় ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ ছিল। আসলে তিনি বলতে চেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে নিজের বাঙালি সত্তার চেয়ে ভারতীয় পরিচয় বড়ো ছিল, বাঙালিত্বের গৌরববোধ তাঁর নিশ্চয় ছিল, কিন্তু ভারতীয়তাকে তিনি গৌণ করতে চাননি। রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারার বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি অনেক লিখেছেন, বিশেষ করে তাঁর পল্লি-পুনর্গঠন-চিন্তা এবং কৃষিজীবীদের কল্যাণ-চিন্তা নিয়ে। তিনি খুবই চমৎকৃত হয়েছেন এদেশে ইংরেজ-প্রবর্তিত আইন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণায় এবং সে-বিষয়ে তাঁর শ্লেষোক্তিতে। নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে তাঁর ভাবনার পরিচয় আমরা পাই উন্নত মম শির (২০০৫) গ্রন্থে, তবে স্বীকার করতে হবে যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর যতটা মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল, নজরুল তা করেননি।

রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বাংলাভাষার প্রতিষ্ঠার দাবিতে যিনি অন্যায্য আইন অগ্রাহ্য করে কারাগারে গিয়েছিলেন, সারাজীবনই তিনি ভাষার মর্যাদার জন্যে লড়াই করে গেছেন। ১৯৯৫ সালে তিনি যখন বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন, তখন সুপ্রিম কোর্টে তাঁর অভ্যর্থনার জবাবে তিনি আদালতে বাংলাভাষা প্রয়োগের পরিসর যে সংকীর্ণ, তা নিয়ে দুঃখ করেছিলেন। জাতীয় জীবনে মাতৃভাষার সর্ববিধ স্থান কামনা করে যেসব কথা তিনি বলেছিলেন, তারই সংকলন আমরা কি যাবো না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে (১৯৯৬), বাংলার সংগ্রাম এখনও অসমাপ্ত (১৯৯৭) এবং প্রথমে মাতৃভাষা পরভাষা পরে  (২০০৪)। তবু তিনি সচেতন ছিলেন যে মাতৃভাষা-প্রেম আমাদের চিত্তে যেন কোনো সংকীর্ণতা এনে না দেয়। প্রধানত এই বোধ সঞ্চার করতেই লিখিত হয় একুশে ফেব্রুয়ারি সকল ভাষার কথা কয় (১৯৯৬)।

আইন ও বিচার তাঁর পেশাগত ক্ষেত্র। সেখানেও তাঁর রচনার শুরু অভিধান-শ্রেণির সংকলন বাংলাদেশ সংবিধানের শব্দ ও খন্ডবাক্য (১৯৯৭) দিয়ে। পরে তিনি আর আমি মিলে             আইন-শব্দকোষ (২০০৬) নামে বাংলায় একটি আইন-অভিধান সংকলন করি মূলত বিদেশি আনুকূল্যে। আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর ভাবনার পরিচয় পাওয়া যাবে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা (১৯৯৭), সরকার, সংবিধান ও অধিকার (১৯৯৯), সাফদেলের মহড়া (২০০৪), দায়মুক্তি (২০০৫), জাতিধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য মানবাধিকার (২০০৭) প্রভৃতি গ্রন্থে।

স্বদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে নানাসময়ে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা সংকলিত হয়েছে বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক (১৯৯৬), জাগো ওঠো দাঁড়াও বাংলাদেশ (২০০০), চাওয়া-পাওয়া ও না-পাওয়ার হিসেব (২০০১), স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন ও বোবার স্বপ্ন (২০০২), বিষণ্ণ বিষয় ও বাংলাদেশ (২০০৩), কত ভাগ্যে বাংলাদেশ, কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ (২০০৬), স্বাধীনতার দায়ভার (২০০৭), উদয়ের পথে আমাদের ভাবনা (২০০৮), বাজার ও অদৃশ্য হস্ত (২০০৮) প্রভৃতি গ্রন্থে।

ইতিহাস তাঁর একান্তই নিজের বিষয়। এক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে কৃতিত্বপূর্ণ কাজ গঙ্গাখদ্ধি থেকে বাংলাদেশ (১৯৮৫)। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত এই ক্ষুদ্রাকার পুস্তকটি বাংলার ইতিহাসবিষয়ক এক অসাধারণ রচনা। এত সহজ করে, এত অল্পপরিসরে, বাংলার সমগ্র ইতিহাস ধরে রাখার এমন প্রয়াসের আর কোনো নজির আমার জানা নেই। এর দ্বিতীয় সংস্করণে বাংলাদেশ সম্পর্কে বহু দরকারি তথ্য এতে সংযুক্ত হয়েছে, তবে তা নিয়ে স্বতন্ত্র বই হলেই, আমার মনে হয়, বেশি উপযুক্ত হতো। তারপর তিনি সংকলন করেন বাংলাদেশের তারিখ, প্রথম (১৯৯৮)) ও দ্বিতীয় (২০০৮) খন্ড – বাংলাদেশের ইতিহাস-সম্পর্কিত এক অপরিহার্য তারিখ-অভিধান। এক্ষেত্রে তাঁর অপর গ্রন্থ বং বঙ্গ বাঙ্গালা বাংলাদেশে (১৯৯৯) সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।

এসবের বাইরেও তাঁর অনেক বই রয়েছে। ১৯৯৬ সালের পরে তাঁর রচনার বান ছুটে গিয়েছিল। তার আগে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ও প্রধান বিচারপতির কর্তব্যপালনের পরে তিনি নিয়েছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব। অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে সে-দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। ওই অল্প সময়ের মধ্যেও দেখা দিয়েছিল জাতীয় সংকট। বিচক্ষণতার সঙ্গে তাও মোকাবেলা করেছিলেন তিনি। সে-সময়ের কথা বলা আছে তাঁর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ভার (২০১০) গ্রন্থে, তবে তাতেও সবটুকু বলা নেই। ব্যক্তির নৈতিক শক্তি যে কায়িক সাহসও জোগায়, তার পরিচয় তখন পেয়েছি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ শেষ করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন লেখালেখিতে। আগে লোকজনের ডাকে সাড়া দিতে পারতেন না। এবারে সভা-সমিতিতে যোগ দিয়ে ভাষণ দিলেন, পত্রপত্রিকার পাতায় লিখলেন, বই বের করতে লাগলেন একের পর এক। ঢাকার বাইরে কোথাও ডাক পড়লে তার আশেপাশে ঘুরে দেখার শখ মেটালেন, যেমন চট্টগ্রাম শহরে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যাওয়া। ওই বয়সে চীনা ভাষা শিখতে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে। বাড়ি বদলে গুলশানে আসায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে চীনা ভাষার চর্চা অব্যাহত রাখলেন, তবে সেই ভাষাশিক্ষার পর্ব শেষ হয়নি। ভাষাশিক্ষার আগ্রহ ছিল তাঁর বরাবর। ছেলেবেলায় আরবি শিখেছিলেন, স্কুলে পড়েছিলেন উর্দু। স্কুলে থাকতেই হঠাৎ রুশ ভাষা শিখতে আগ্রহী হন, তবে তা বেশিদূর এগোয়নি। অক্সফোর্ডে গিয়ে ফরাসি শিখেছিলেন, চর্চার অভাবে তাতে খানিক মরচে ধরে গিয়েছিল।

শুধু ভাষা নয়, জীবনের নানাদিকেই তাঁর উৎসাহ ছিল অপরিসীম। তিনি প্রকৃতই জীবনরসিক ছিলেন। আর ছিলেন উদার। মাতৃভাষাকে ভালোবেসে অন্য ভাষার মর্যাদা দিতে তিনি ছিলেন অকুণ্ঠ। নিজ ধর্মে নিষ্ঠ হয়ে অন্য ধর্মের বিষয়ে ছিলেন বদান্য। বাংলাদেশকে স্বদেশ জেনেও তিনি ছিলেন বিশ্বনাগরিক।