মেজর করনেইলির বঙ্গদর্শন

সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ

মেজর জন করনেইলি রবার্ট ক্লাইভের বাহিনীর সৈনিক হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন পলাশীর যুদ্ধে। বাবাকে লেখা তাঁর একগুচ্ছ জার্নাল বা দিনপঞ্জি পাওয়া গিয়েছিল প্যারিসে গত শতকের মাঝামাঝি। সুইস বংশোদ্ভূত বাবাও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মেজর ছিলেন। লন্ডনের ফোলিও সোসাইটি ১৯৬৬ সালে জার্নালগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। আশ্চর্যের বিষয়, দেশে-বিদেশের কোনো ইতিহাসবিদ পলাশীর যুদ্ধ, নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবন বা ভারতে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন নিয়ে লেখালেখিতে এই উপকরণটি ব্যবহার করেছেন বলে মনে হয় না।

জন করনেইলির এই জার্নালগুলোর বিষয়কে তিনটি ভাগে উপস্থাপন করা যায়। এর প্রথম অংশে রয়েছে করনেইলির সেনাবাহিনীতে যোগদান থেকে শুরু করে মাদ্রাজে ইংরেজ-দুর্গে অবস্থান ও সেখান থেকে কলকাতায় আসা। দ্বিতীয় অংশ পলাশীর যুদ্ধ ও তৎপরবর্তী ঘটনা। তৃতীয় অংশে রয়েছে সে-সময়ের বঙ্গ এবং তার চারপাশ নিয়ে করনেইলির অবলোকন।

বঙ্গে আসার আগেই করনেইলি এ-অঞ্চলের সমৃদ্ধি ও সম্পদের কথা শুনেছিলেন। মনে হয় যে, ইউরোপে এর পূর্বেই বঙ্গের বৈভবের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলা অঞ্চলে কিছুদিন বাস করে করনেইলি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, বৈভবের এ-খ্যাতি বঙ্গের প্রাপ্য [করনেইলি এখানে deserve শব্দটি ব্যবহার করেছেন]। তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন যে, তাদের পরিচিত পৃথিবীর অর্থাৎ ইউরোপের খুব কম দেশের সঙ্গেই বঙ্গের ঐশ্বর্যের তুলনা করা যেতে পারে। তাঁর মতে, এর প্রধান কারণ তিনটি। প্রথমত, এ-অঞ্চলের মাটি অত্যন্ত উর্বর; ফলে এতে বিচিত্র ও প্রচুর ফসল হয়। দ্বিতীয়ত, এখানকার নদীগুলো বিশাল; ফলে জলের অভাব নেই। তৃতীয়ত, এখানে জনবসতি ঘন; ফলে জনসম্পদের অভাব নেই। করনেইলি অনুধাবন করেছিলেন যে, যদি এখানে সুশাসনের অভাব না থাকত এবং এর আবহাওয়া ইউরোপীয়দের জন্য প্রতিকূল না হতো তাহলে এটি বিশ্বের একটি সু-বসবাসের দেশ হতে পারত।

করনেইলির বিবরণে এ-অঞ্চল অত্যন্ত সুফলা। বঙ্গের গরিব মানুষরাও দুবেলা খেতে পারে এবং এতেই তারা সুখী। তারা অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং খাবারের অতিরিক্ত তেমন কোনো চাহিদা নেই। তিনি এ-অঞ্চলের উর্বরতাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘বিলাসী’ অভিধায়, যাতে বছরে তিনটি ফলন হয়। ফসলের মধ্যে তিনি চাল, গম ও ডালের কথা বিশেষভাবে উলেস্নখ করেছেন, যা এত পর্যাপ্ত যে, নিজেরা খাওয়ার পর তা বঙ্গে ইউরোপীয় বসবাসকারীদের জন্যও যথেষ্ট ছিল। সবুজে-শ্যামলে সুন্দর তৃণভূমিতে পশুচারণ করনেইলিকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। ইউরোপের মতো কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলাতে হয় না এদেশে; প্রকৃতিই যেন এদের শস্যভা-ার পূর্ণ করে রেখেছে।

জন করনেইলি বঙ্গে সে-সময়ের শাসনব্যবস্থার তীব্র নিন্দা করেছেন। তাঁর মতে, সুশাসন ও স্বাধীনতার অনুপস্থিতি এদেশের মানুষকে আয়েশে দিন কাটাতে দেয়নি। প্রাচ্যশাসকদের মনোভাব হচ্ছে প্রজাদের গোলাম করে রাখা; তাদের শাসন নিয়ন্ত্রণহীন, ফলে প্রজাকুল
নির্যাতন-নিষ্পেষণের শিকার হয়।

করনেইলি এদেশের শাসকদের চিহ্নিত করেছেন Moor অভিধায়। অভিধান অনুসারে Moor অর্থ কৃষ্ণবর্ণ ব্যক্তি – বিশেষভাবে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার। মুররা একসময় স্পেনসহ ইউরোপের একাংশ শাসন করত এবং তারা মুসলমান। পরে আরব মুসলমানরা ইউরোপে গেলে অনেকে মুরদের সঙ্গে নিজেদের পৃথক করে ভাবতে পারেনি। বঙ্গের শাসকরা সে-সময়ে ছিলেন উত্তর ভারত ও পারস্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু করনেইলির ইউরোপীয় অভিজ্ঞতা তাদেরকে ঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি। ফলে এদেশের শাসকদের তিনি মুর বলে অভিহিত করেন।

করনেইলির বিবরণে, মুররা দীর্ঘকাল ধরে এদেশ শাসন করছে; তারা অনেকাংশে স্বেচ্ছাচারী। বাংলা-অঞ্চল শাসন করেন একজন নবাব। তিনি এই বিসত্মীর্ণ অঞ্চলের সার্বভৌম শাসনকর্তা, যদিও মুঘল বাদশাই তাকে মনোনীত করেন। করনেইলির বঙ্গে বসবাসকালে এই নবাবরা এত ক্ষমতা ও সম্পদশালী হয়ে উঠেছিলেন যে, কার্যত তাঁরা দিলিস্নর আদেশ মানতে চাইতেন না। দিলিস্ন থেকে কর-সংগ্রহ করতে আসা কর্মচারীদের নবাবের পারিষদরা মারধর করেছে, এমন ঘটনারও উলেস্নখ করেছেন তিনি।

বঙ্গে সে-সময়ে আইন বলতে ছিল ঊর্ধ্বতন শাসকের ইচ্ছা বা ঘোষণা। করনেইলির অবলোকনে এই ইচ্ছা পরিচালিত হতো খেয়াল, সামর্থ্য ও আবেগ দ্বারা। ফলে রাজন্যবর্গ প্রজাদের ভালোবাসা পেত কদাচিৎ; রাজারা প্রজাদের ভালোবাসা প্রত্যাশাও করতেন না। শাসকদের কাজ ছিল উত্তম আবহাওয়ায় সৈন্যদল নিয়ে খাজনা আদায় করে নিয়ে আসা। এভাবে ভীতি সৃষ্টি করেই খাজনা আদায় করা হতো। যুদ্ধ করার চেয়ে খাজনা আদায়েই সেনারা বেশি ব্যস্ত থাকত।

করনেইলি লক্ষ করেছেন যে, দীর্ঘদিন এ-ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত থাকার ফলে রাজমহলে সন্দেহ ও অবিশ্বাস নিত্যনৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। এ-ধরনের পরিস্থিতিতে আরো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল হত্যার মাধ্যমে এর প্রতিকারের প্রচেষ্টা। সম্পদ ও ঐশ্বর্য অর্জনের ক্ষেত্রে যে-কোনো পন্থা অবলম্বনে রাজন্যরা পিছপা হতেন না। এক্ষেত্রে কোনো অন্যায় বা অভিযোগকেও আমলে নেওয়া হতো না। ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জনের চেষ্টা এঁদের অনেকেরই ধ্বংসের কারণ হয়েছে। অথচ এ-পরিণতি দেখেও কেউ সে-পথ থেকে সরে আসেননি। মুরদের এ-চেষ্টার পেছনে রয়েছে বিলাসবহুল জীবনযাপন। শৈশব থেকেই তারা এ-বিলাসের মধ্যে লালিত এবং তা অব্যাহত রাখার জন্য দরকার বিপুল অর্থ। যে-কোনো মূল্যে, এমনকি মৃত্যুর আশঙ্কার মধ্যেও এই অর্থ জোগাড়ে তারা ছিল মরিয়া।

বঙ্গে ইউরোপীয়দের বাণিজ্য ছিল একচেটিয়া। করনেইলির সময়ে অত্যন্ত সস্তায় নগদ টাকায় এরা নানা জিনিস কিনত এবং চড়া দামে সেগুলো ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। এর মধ্যে প্রধান ছিল সুতিবস্ত্র। নানা রকমের নানা নামের মসলিনের কথা উলেস্নখ করেছেন তিনি। তার চেয়েও বেশি প্রশংসা করেছেন ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে তৈরি সিল্কের ওপর নানা রঙের সুতো দিয়ে নিখুঁত নকশার কথা। অনেক সময় সোনা এবং রুপোর সুতোও ব্যবহার করা হতো। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে অবসর সময়ে এসব সুচিকর্ম করত বলে এর মজুরি ছিল অত্যন্ত কম। করনেইলির হিসাবে সে-মজুরি ইউরোপের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশেরও কম। এর নকশা আনা হতো ইউরোপ থেকে; ফলে ইউরোপের বাজারে এর চাহিদা থাকত। সুতিবস্ত্র ছাড়াও চাহিদা ছিল গন্ধক (saltpetre), আঠালো লাক্ষা (gumlac), আফিম ও নানা রকমের শস্যের। গন্ধক প্রধানত বন্দুকের বারুদে ব্যবহার করা হতো। এই বিবরণে নীলচাষ অনুলিস্নখিত। মনে হয়, নির্যাতনমূলক এই চাষ তখনো চালু হয়নি।

বঙ্গের মুদ্রাব্যবস্থা সম্পর্কে করনেইলির অবলোকন বিসত্মৃত ও গভীর। প্রতিবছর মুঘল সম্রাট সারা ভারতবর্ষের জন্য মুদ্রা ছাড়তেন। সিক্কা (sicca) টাকা নামে পরিচিত এই মুদ্রার মান ছিল তৎকালে দুই শিলিং দশ পেনির সমান। তবে বছর পার হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে এর মান কমে যেত। যেমন দ্বিতীয় বছরে প্রথম বছরের চেয়ে কম, তৃতীয় বছরে দ্বিতীয় বছরের চেয়ে কম ইত্যাদি। মুঘল সম্রাটের সিংহাসন আরোহণের সঙ্গে মিলিয়ে এসব মুদ্রায় বছর উৎকীর্ণ থাকত এবং তা চন্দ্র-বৎসর নয়,
সূর্য-বৎসর। আগের বা মৃত-সম্রাটের সময় ছাড়া মুদ্রাকে বলা হতো সোনাউত (sonaut)। মুদ্রায় ব্যবহৃত রুপোর মূল্য অনুযায়ী এর মূল্য নির্ধারিত হতো। সে-সময়ে অর্ধ-টাকা (আধুলি) ও সিকিরও প্রচলন ছিল। ষোলো আনায় এক টাকা ও বারো পাইয়ে এক আনার হিসাবও এই বিবরণে রয়েছে।

মুদ্রা হিসেবে কড়ির ব্যবহারের কথাও বলেছেন করনেইলি। সাধারণ মানুষের লেনদেনে কড়িই বহুল ব্যবহৃত মুদ্রা। এসব কড়ি আনা হতো মালদ্বীপ থেকে। আশিটির মতো কড়ির ওজন ছিল এক পাউন্ডের মতো। সাধারণত পঞ্চাশ-ষাট পাউন্ড কড়ির মূল্য ছিল এক সিক্কা টাকা। সে হিসাবে এক শিলিং সমান ছিল আনুমানিক ষোলোশো কড়ি।

বঙ্গে যে-জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যন্ত কম ছিল তার প্রমাণ হিসেবে করনেইলি এই মুদ্রাব্যবস্থার উলেস্নখ করেছেন। তাঁর বিবরণে, এক কড়ি দিয়েও বাজারে নানা রকমের সওদা পাওয়া যেত। আশি কড়ি দিয়ে ভূরিভোজন সম্ভব ছিল। গৃহপরিচারক বা চাকরের বেতন ছিল দু-সিক্কা টাকা। তা দিয়ে তাদের পুরো পরিবারের ভরণপোষণ চলে যেত।

করনেইলি এখানকার মুসলমানদের যেমন মুর (Moor) বলেছেন, হিন্দুদের বলেছেন ঘেন্টু (Gentoo)। সম্ভবত দেবদেবীর মূর্তির পুজো করে বলে তাদের এমন নাম দেওয়া হয়েছে। তিনি তাঁর পুরো বিবরণীতে একবারো মুসলমান বা হিন্দু শব্দ ব্যবহার করেননি; বৌদ্ধদের কোনো উলেস্নখও এতে নেই। বঙ্গীয় জনসংখ্যার মধ্যে খ্রিষ্টধর্মের প্রসারও তখন ঘটেনি বলেই মনে হয়; যদিও শ্রীরামপুরসহ খ্রিষ্টীয় মিশনগুলো এর আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মুর ও ঘেন্টু উভয় সম্প্রদায়ের ধনীদের দাম্ভিকতা ও প্রতিপত্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতাকে করনেইলি বদ্-অভ্যাস (vice) বলে নিন্দা করেছেন। তাঁর অবলোকনে এসব মানুষ যখন কোনো পদ বা পদবি লাভ করে তখন কুচকাওয়াজসহ নানা জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়। তারা এর অর্থ সংগ্রহ করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। অনেক সময় ওই অর্থ সংগ্রহের জন্য নির্যাতনও করা হয়। করনেইলির মতে, পদ-পদবিধারীদের জৌলুসের অর্থ জোগান দিতে দরিদ্র মানুষরা আরো দারিদ্রে্যর মধ্যে পতিত হয়। আরো মজার ব্যাপার, ইউরোপ থেকে আসা বণিকরাও এর অনুসরণে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন শুরু করে। সমকালে ইংরেজ সিভিলিয়ানরাও এর অনুসরণ করে। তাদের মধ্যে যাদের সংগতি কম তারা এমনকি কলকাতার বাইরে গিয়েও ওই ঠাঁট বজায় রাখতে চেষ্টা করে। সম্ভবত এভাবেই
‘মফস্বল-সংস্কৃতির’ বিকাশ ঘটেছিল।

পদবি লাভ এবং তার উদ্যাপনের ব্যাপারটি ছিল আরো হাস্যকর। করনেইলি স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, এর পুরো বিষয়টিই সম্পূর্ণ অমত্মঃসারশূন্য। উদাহরণ হিসেবে বার্মার পেগু অঞ্চলের রাজা কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে লেখা একটি চিঠির ইংরেজি অনুবাদ দিয়েছেন তিনি। তাতে পেগুর রাজা নিজেকে অন্তত দশটি অঞ্চলের অধিরাজ বলে চিহ্নিত করে তারপর নিজের নাম লিখেছেন। এর পাশাপাশি তিনি কর্নেল এডলারক্রনকে লেখা নবাব সিরাজউদ্দৌলার একটি পত্রও উদ্ধৃত করেছেন। ১৭৫৫ সালের ৯ জুন লেখা এ-পত্রে এডলারক্রনকে নবাব ‘Thunder bolt war’ বলে প্রশংসা করেছেন এবং কর্নেলের সাহসিকতা ও সদ্-আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে একটি উপাধিতে ভূষিত করেছেন। উপাধি প্রদানের রীতি অনুযায়ী নবাব ফারসিতে উৎকীর্ণ একটি সিলমোহর প্রেরণ করেছেন, যাতে নবাবের স্বাক্ষর আছে।

পলাশীর যুদ্ধের পর মীরজাফর কর্নেল ক্লাইভ ও তার সহযোগীদের যে-মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করেছিলেন তার মধ্যে ছিল একটি নাট্য-প্রদর্শনী। করনেইলি এর একটি চমকপ্রদ বর্ণনা দিয়েছেন। নাটকটি কয়েকটি অঙ্কে বিভক্ত ছিল : দুই অঙ্কের মধ্যবর্তী সময়ে ছিল জমকালো নৃত্যের ব্যবস্থা। নাটকটির উদ্দেশ্য ছিল অসৎ-অভ্যাস (vice) ও মূর্খতাকে ব্যঙ্গ করা। তবে এর উপস্থাপনা ছিল অত্যন্ত অমার্জিত ও রূঢ়। করনেইলি মন্তব্য করেছেন যে, এ-ধরনের উপস্থাপনার ফলে নাটকটি দেখে মূর্খতার প্রতি বিরাগের চেয়ে নিজের মধ্যে ইতর-প্রবৃত্তি জাগরণের সম্ভাবনাই বেশি। তবে নাটকটির উদ্দেশ্য মেজরকে আকৃষ্ট করেছিল, যার বাণী ছিল – স্তাবকতায় কর্ণপাত করবেন না। ‘অল্প-ভাগ্যবান’ ও স্বল্পশিক্ষিত মানুষ যখন উচ্চবর্গের মানুষকে অনুসরণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে তখন তা যে কতটা হাস্যাস্পদ হয়, নাটকে তাও উদ্ভাসিত। মনে হয় যে, নাটকটি ছিল বাংলা প্রহসনের পূর্বসূরি এবং সমকালীন সমাজের এক রকমের সমালোচনাও এর মধ্যে ছিল। নতুন নবাবকে শিক্ষা প্রদান বা সচেতন করার প্রয়াসও এর মধ্যে ছিল বলে করনেইলির মনে হয়েছে।

নাটকের বিবরণে দেখা যায়, দুটো চরিত্র সাধারণ পোশাকে অবতীর্ণ – তারা পরস্পরের অতিথি। প্রথম পরিচয়ে তারা এমনসব আনুষ্ঠানিকতা করে, যা স্পষ্টতই উচ্চবর্গের হাস্যকর নকল। এরপর আবির্ভাব ঘটে একজন ভাঁড়ের, যিনি পূর্বোক্ত দুজনকে তোষামোদ করতে থাকেন এবং বিনিময়ে তাদের পাগড়ি দুটো উপহার পান। তাতে ভাঁড়ের তোষামোদ আরো বেড়ে যায়। আর অতিথিদ্বয় একের পর এক পরনের বসন দান করতে করতে প্রায় উলঙ্গ হয়ে যান। করনেইলি লক্ষ করেন যে, এতে নাটকের দর্শকদের মধ্যে উপস্থিত ষাট-সত্তরজন নারী অত্যন্ত বিব্রতবোধ করছেন।

নাটকটি কোন ভাষায় পরিবেশিত তা করনেইলি উলেস্নখ করেননি। এটি যদি অন্তত মিশ্র বাংলা ভাষায়ও হয়, তাহলেও আমাদের নাটকের ইতিহাসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; উর্দু, ফারসি বা হিন্দুস্থানিতে হলেও এর অন্যরকমের গুরুত্ব রয়েছে। ভাষা অবোধ্য হলেও পাত্রপাত্রীদের আচরণ ও মুখভঙ্গি ছিল অত্যন্ত বাঙ্ময়, যাতে কথা না বুঝলেও করনেইলি এর ভাবার্থ বুঝতে পারছিলেন। এরপরও ইংরেজ সৈনিকদের জন্য আরো কয়েকটি নাটকের আয়োজন করা হয়। রাজন্যবর্গ আসলে প্রতি সন্ধ্যাতেই এরকম বিনোদনে মশগুল থাকতেন। তবে বিনোদনের ধরন ও মান দেখে করনেইলির মনে হয়েছে যে, মুররা যথেষ্ট সংস্কৃতিবান নয়।

এই বিলাস ও ভোগবাদিতার বিপরীতে সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য করনেইলিকে পীড়িত করেছিল। উর্বর জমিতে বিপুল ফসল ফলাতো দেশের কৃষকরা; কিন্তু ভাগ পেত তার সামান্য। ফলে দু-মুঠো খেয়ে কষ্ট ও ক্লেশের মধ্যে তাদের জীবনযাপন করতে হতো। শস্যের দাম অত্যন্ত কম হওয়া সত্ত্বেও খাওয়ার পর তাদের কোনো উদ্বৃত্ত থাকত না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বা অন্য কোনো কারণে একবার ফসল নষ্ট হয়ে গেলে কৃষকদের দুর্গতির সীমা থাকত না। অনাহারে মৃত্যুর ঘটনাও বিরল ছিল না। খাবার জোগাড়ের জন্য সমত্মান বিক্রির ঘটনা পর্যন্ত ঘটত। মাত্র আড়াই শিলিংয়ের বিনিময়ে সমত্মান বিক্রির এক ঘটনা করনেইলি উলেস্নখ করেছেন। এসব দেখে তাঁর মনে হয়েছে যে, প্রকৃতি এদেশের সামনে যে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল তা কৃষককুলের কোনো কাজে লাগেনি।

নাটক দেখা ছাড়া আরো কিছু বিনোদনের খবর রয়েছে করনেইলির বৃত্তান্তে। এর একটি বাঘ-হরিণ ক্রীড়া। মেজর উলেস্নখ করেছেন যে, এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বাঘ ভয়ংকর। এরা প্রথম নরমাংসের স্বাদ পেত বনের পাশের নদীতে চলাচলকারী নৌকায় ঘুমন্ত মাঝিদের রক্ত-মাংস খেয়ে। একবার নরমাংসের স্বাদ পেলে তারা মানুষখেকো হয়ে উঠত। এরপর নদীতে নৌকা দেখলে তারা সাঁতরে গিয়ে মাঝিকে আক্রমণ করত।

এরকম একটি চিতাবাঘকে চোখে কাপড় বেঁধে মাঠের একপ্রান্তে রাখা হতো; অন্য প্রান্তে থাকত একটা হরিণ। চোখের কাপড় খুলে দিলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিকারি চিতাটি পেটে ভর দিয়ে ও হামাগুড়ি দিয়ে হরিণের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করত। চিতাকে দেখে হরিণ দ্রম্নত দৌড় দেওয়া মাত্র সেও দ্রম্নত পিছু নিত। কথায় আছে – বাঘের একলাফ বাইশ হাত, হরিণের তেইশ হাত। হরিণ পালিয়ে যেতে পারলেও চিতা মাঠের কোনায় ফিরে আসত। ধরতে পারলেও হরিণকে দিয়ে পেটভরে আহার করে নিত চিতা। মনে হয়, চিতা ও হরিণের দৌড়ের প্রতিযোগিতা ছিল এই ক্রীড়ার মুখ্য বিষয়।

সাধারণের মধ্যে বনবিড়াল দিয়েও এ-ক্রীড়ার আয়োজন করা হতো। করনেইলি এ-জন্তুটির নাম লিখেছেন Shy goose এবং বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে – সাধারণ বিড়ালের দ্বিগুণ আকারে এদের কান লম্বা এবং লোমগুলো অনেকটা পাখির পালকের মতো। এটি খাটাশও হতে পারে। এতে শিকার হিসেবে ব্যবহার করা হতো ছাগলছানা, খরগোশ বা কুক্কুট।

করনেইলি এদেশীয় মুরদের বহিরাগত হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। তাঁর মতে, ঘেন্টুরাই এদেশের আদি অধিবাসী। তারা মূলত মূর্তিপূজারি এবং যার যার বর্ণ অনুযায়ী তাদের পৃথক পৃথক দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। ঘেন্টুরা পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমান, তবে জীবনযাপনে সরল। এদেশের
কৃষিকাজ ও ক্ষুদ্রশিল্পে তারাই প্রধান শ্রমিক। এদের পারিবারিক বন্ধন ছিল অত্যন্ত দৃঢ় এবং খেয়াল, স্বভাব বা যুক্তির কারণেও তারা কখনো মা-বাবার অবাধ্য হতেন না। এই পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে তারা অত্যন্ত পবিত্র মনে করতেন। সমত্মানের প্রতি পিতা-মাতা ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বশীল। যৌথ পরিবারের সব চাহিদা সবাই যৌথভাবেই পূরণ করতেন। ঘেন্টু নারী-পুরুষরা ছিল সুন্দর; তাদের বসনও সুরুচিপূর্ণ। দেশীয় সরলতা ও নিষ্পাপ স্বভাব তাদের সুখী করেছিল। করনেইলি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, ঘেন্টুরা তাদের বিজেতাদের চেয়ে ভালো মানুষ ছিল।

ঘেন্টুদের পারিবারিক জীবনেরও প্রশংসা করেছেন এই ইংরেজ সৈনিক। মুররা যেখানে যত খুশি স্ত্রী গ্রহণ করতে পারত এবং সামর্থ্য থাকলে এর সঙ্গে উপপত্নী যুক্ত করতেও বাধা ছিল না, সেখানে ঘেন্টুরা এক স্ত্রী নিয়েই খুশি থাকত। মনে হয় যে, হিন্দু কুলীনদের বহুবিবাহের ভয়াবহ রূপ তাঁর চোখে পড়েনি। আবার এই বহুবিবাহ প্রথা ব্রাহ্মণদের বাইরে তেমন প্রচলিত না থাকার ফলেও এমন অবলোকন হতে পারে। তবে বাল্যবিবাহের বিষয়টি তাঁর চোখ এড়ায়নি। তিনি উলেস্নখ করেছেন যে, ঘেন্টুরা
আট-নয় বছরের মেয়েকে বিয়ে করত; অনেক সময় কন্যার বয়স তার চেয়েও কম থাকত। বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কনে স্বামীর মায়ের সঙ্গে ঘুমুতেন। বয়ঃপ্রাপ্ত হলে ঘটা করে অনুষ্ঠান করা হতো এবং তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক শুরু হতো। স্বামীর মৃত্যুর পর সহমরণে না গেলেও বিধবারা দ্বিতীয়বার বিয়ে করত না।

ঘেন্টুদের সঙ্গে মুরদের খাবারের পার্থক্য সম্পর্কেও করনেইলি মন্তব্য করেছেন। ঘেন্টুরা ষাঁড় বা গরুকে পবিত্র মনে করে এবং এর মাংস খায় না। ঘেন্টুরা মদ্যপান করে না। মদ্যপান করলে ধর্মীয় আচার অনুসারে তাদের সমাজচ্যুত করা হতো এবং পুনরায় সমাজে ফিরে আসার জন্য কঠিন প্রতিবন্ধকতা ছিল। করনেইলি অন্তত মদ্যপান করে বেসামাল অবস্থায় কোনো ঘেন্টুকে দেখেননি। অন্যদিকে শকট টানার জন্য ব্যবহার করলেও গরুর মাংস ছিল মুরদের প্রিয়। এদেশের ষাঁড়/ বলদ প্রধানত শাদা রঙের এবং ইউরোপীয় ষাঁড়ের চেয়ে বড়। মাংসের দামও বেশি। ধর্মে ঘোষিতভাবে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মুরদের অতিরিক্ত মদ্যাসক্তিতে বিস্মিত হয়েছেন এই মেজর।

ঘেন্টুদের খাবারের মধ্যে দুধের প্রাধান্য ছিল। পানীয় হিসেবে তারা পানি ও দুধ উভয়ই পছন্দ করত। ঘন দুধের ক্ষীর (palm toddy?) ও মশলামাখানো ভাত তাদের প্রিয় ছিল। এটি দই এবং পোলাও হতে পারে। প্রতিদিন তারা অন্তত একপোয়া পরিমাণ ননী খেত। করনেইলির মতে, ঘেন্টুরা আসলে তাদের পূর্বপুরুষদের সরল খাবারের ধরনটাই চালু রেখেছিল।

মুরদের জনপ্রিয় পানীয় ছিল শরবত। তাদের খাবার অনেকটা ইউরোপীয় বা খ্রিষ্টানদের মতোই; তবে তারা শূকরের মাংস ঘৃণার সঙ্গে পরিহার করে থাকে। ষাঁড়-বলদের মাংসের সঙ্গে খাসির মাংস ছিল অত্যন্ত উপাদেয়। মুরগির মাংসও প্রচলিত ছিল। এসব মাংস যথেষ্ট সেদ্ধ করে রান্না করা হতো; খেতেও ছিল সুস্বাদু। ইউরোপে প্রচলিত তরিতরকারির মধ্যে মটরশুঁটি, বাঁধাকপি, ফুলকপি ও নানারকমের ডাল এখানেও সুলভ ছিল। ফলের মধ্যে আমের অতুলনীয় শ্রেষ্ঠত্ব তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন।

মাছের মধ্যে তপসে মাছের (Mango Fish) বিশেষ প্রশংসা করেছেন এই ইংরেজ সৈনিক। তাঁর বর্ণনামতে, যখন আম পাকে অনেকটা সে-সময়েই নদীতে এই মাছ পাওয়া যায়। এর সুগন্ধি অত্যন্ত উপাদেয় এবং স্বাদ রুচিকর। করনেইলি বলেছেন যে, এমন সুস্বাদু মাছ তিনি কখনো খাননি।

টেবিলে পরিবেশিত খাবার পরিমাণে ও পদের বিবেচনায় ছিল বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। মাংস, মাছ, তরিতরকারির কোনো অভাব এতে থাকত না। করনেইলির মতে, বাংলা অঞ্চলের খাবার ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় শ্রেয়।

বাংলাদেশের আবহাওয়া সম্পর্কেও বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে করনেইলির বৃত্তান্তে। এখানে শীত ও গরমের পরিবর্তন হতো পালাক্রমে। মে মাসের গরম ছিল সহনীয়। জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস ছিল কার্যত বর্ষাকাল; একদিকে বজ্রবিদ্যুৎ; অন্যদিকে প্রচ- গরম। তবে বৃষ্টি মাঝেমাঝেই শীতল আমেজ এনে দিত। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস গরম সত্ত্বেও তুলনামূলক ভালো।

নভেম্বর থেকে ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত বেশ ঠান্ডা। ঘন কুয়াশাঘেরা শীতকালের দুপুরের পরিবেশ ইউরোপীয়দের জন্য মনোমুগ্ধকর। সন্ধ্যার শীত বেশ কনকনে। শীতের শিশির থেকে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ত। এই অসুখ অনেক সময় ছিল সংক্রামক এবং ইউরোপীয়রা এতে বেশি আক্রান্ত হতো। শীতের প্রথম দিকে রোগ-বালাই বেড়ে যেত। এ-সময়ে জলাধারা গুলোতে জমে থাকা বৃষ্টির পানি শুকাতে শুরু করে; সূর্যালোকও পাওয়া যায় না। তৃণভূমি ও গাছগাছালির মধ্যে যেসব ইউরোপীয়র বসতি, তারা এ-সময়ে নানা রোগে আক্রান্ত হতো। তবে সমুদ্র থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে রোগের প্রকোপ কম থাকত।

ফেব্রম্নয়ারির শেষদিক থেকে মে পর্যন্ত এখানে উত্তর-পশ্চিমা বায়ুপ্রবাহ প্রবাহিত হয়। প্রচ- বাতাস, বৃষ্টি ও বজ্রপাত মিলে এ-সময়ের আবহাওয়া ভয়াবহ। তবে এর ফলেই বাতাস রোগ জীবাণুমুক্ত হয় এবং সংক্রামক রোগ চলে যায়। করনেইলি সম্ভবত ঘূর্ণিঝড়ের সময়টার ভয়াবহতার কথাই বলতে চেয়েছেন।

তবে এই প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও দরিদ্র জনসাধারণের টিকে থাকার সাফল্য মেজরের দৃষ্টি এড়ায়নি। এর কারণ হিসেবে সারাবছর সূর্যালোকের উপস্থিতি এবং গাছগাছালিতে ভরা উপকূলের কথা তিনি উলেস্নখ করেছেন। তিনি তুলনা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, উত্তর ইংল্যান্ডের যত লোক শীতে কষ্ট পায় তার চেয়ে এদেশের দরিদ্রদের কষ্ট কম। এদেশের মানুষের গড় আয়ুও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে কম নয়।

করনেইলির ভাষায়, নদী এদেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এ-অঞ্চলের সব নদীই গঙ্গা থেকে উৎসারিত। গঙ্গার উৎসমুখ সমুদ্র থেকে প্রায় চারশো মাইল ওপরে; তবু সমুদ্রের কাছাকাছি এসেও এর বিসত্মৃতি দু-মাইলের কম হবে না। গঙ্গার শাখা-নদীর সংখ্যা বহু এবং এগুলো নানা পথে সমুদ্রে পড়েছে। যেসব স্থান দিয়ে এই শাখাগুলো প্রবাহিত হয়েছে তার নামের সঙ্গে মিলিয়ে নদীর নাম রাখা হয়েছে। যেমন হুগলির পাশ দিয়ে প্রবাহিত শাখার নাম হুগলি নদী। সমুদ্রের কাছাকাছি হুগলি নদীর বিসত্মৃতি প্রায় চোদ্দ মাইল। এটি সাগর থেকে প্রায় দুশো মাইল ওপরে উৎপন্ন এবং এই পথে ছয়শো কামানবাহী জাহাজ পর্যন্ত চলাচল করতে পারে। অন্যান্য নদীর
বিসত্মৃতিও বিশাল। ফলে বড় বড় জাহাজ ও নৌকায় পণ্য পরিবহন এখানে সহজ। ওই অঞ্চলে বাণিজ্যের প্রসারের এটিও একটি কারণ।

গঙ্গা অত্যন্ত বিসত্মৃত ও গভীর নদী। এর স্রোতপ্রবাহ যথেষ্ট ও জোয়ার-ভাটা হয় ঘন ঘন। নদীটির দুই তীর সাগর-নিকটবর্তী স্থানে অত্যন্ত খাড়া ও বালুকাময়। ফলে এখানে জাহাজ চালানো বেশ বিপজ্জনক। ইউরোপীয় বণিকরা এখানে এসে জাহাজ চালানোর জন্য অভিজ্ঞ বাঙালি নাবিকদের ভাড়া করত। তীরের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে জাহাজ উলটে যাওয়া ছিল নিশ্চিত; তবে বাঙালি নাবিকরা এই বিপদ এড়ানোর ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছিল। নিরাপত্তার জন্য বালুকাময় চর ও তীরে বয়া নোঙর করা থাকত। এত সাবধানতার পরও এ-অঞ্চলে জাহাজডুবির ঘটনা প্রায়ই ঘটত বলে করনেইলি উলেস্নখ করেছেন।

নদীবহুল এদেশে নৌকা যেমন যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল, তেমনি বিত্তবানদের একটি প্রিয় শখও ছিল নৌকাভ্রমণ। বলিয়াস (boliahs) নামে নৌকা চালাত একই সঙ্গে বিশজন দাঁড়ি; অনেক সময় বৈঠা বাইত এর চেয়েও বেশি মাঝি। এসব নৌকার লেজের দিকে আচ্ছাদিত অংশে তিন-চারজন শুয়ে থাকতে পারত। নৌকার হালচালক মাঝি ও আচ্ছাদিত অংশের মাঝখানে একজন নর্তক/ নর্তকী আরোহীদের মনোরঞ্জন করত। বৈঠার সঙ্গে কতগুলো ছোট ছোট ধাতব আংটা জুড়ে দেওয়া হতো। ফলে বৈঠার তালে তালে যে শব্দ হতো তা নৃত্যের যন্ত্রসংগীতের অভাব পূরণ করত। সর্পাকৃতির কতকগুলো নৌকা ছিল, যাতে লম্বালম্বি ত্রিশজন ও পাশাপাশি পাঁচজন দাঁড়ি-মাঝি বসতে পারত। কখনো কখনো দাঁড়ির সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হতো। অত্যন্ত দ্রম্নতগতির এই নৌকাগুলোতে মাঝি-মাল্লার বাইরে দুজনের বেশি আরোহী থাকত না বললেই চলে। অশান্ত স্রোতে এই চিকন নৌকাগুলো প্রায়ই উলটে যেত। জুলাই মাসে এরকমের শত শত নৌকা পাটনা থেকে মুর্শিদাবাদ আসত নবাবকে খাজনা দেওয়ার আরোহী নিয়ে। বিভিন্ন রঙের কাপড়ের ওপর সোনালি-রুপালি অ্যামব্রয়ডারি করা পাল তুলে ও পতাকা লাগিয়ে একসঙ্গে ঝাঁকবেঁধে যখন নৌকাগুলো চলত তখন এক চমৎকার শোভার সৃষ্টি হতো। নৌকাগুলোর পাটাতন ঢাকা থাকত রঙিন শতরঞ্জি দিয়ে।

মুরদের এসব নৌকার ধরন ও আকৃতি সামান্য পরিবর্তন করে ইউরোপীয়রা তৈরি করে বজরা। তাতে দুটো ক্ষুদ্র কক্ষ থাকত – একটি শোবার ও একটি থাকার। শান্ত স্রোত ছাড়া এগুলো চলাচল করতে পারত না; সামান্য বাতাস বা ঢেউ এগুলোর বিপদ ডেকে আনত। তবে ইউরোপীয় বণিকরা এসব বজরা দিয়েই বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করত।

এ-অঞ্চলের কয়েকটি জীবজন্তুর বিবরণও করনেইলির জার্নালে পাওয়া যায়। এর মধ্যে তিনি গঙ্গানদীর কুমিরের কথা বিশেষভাবে উলেস্নখ করেছেন। এর দাঁতওয়ালা মুখটি এত বড় যে, একজন মানুষের অর্ধেক শরীর একবারেই গিলতে পারে। নখাকৃতির চারটি ছোট পা দিয়ে কুমির বেশ জোরেই হাঁটতে পারে। তাদের পিঠের আঁশ বেশ শক্ত; বাঁশ-লাঠি ইত্যাদি দিয়ে কুমিরকে সহজে ঘায়েল করা যায় না। এরকমের একটি কুমির একবার কর্নেল ক্লাইভকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। কুমিরটি ছিল প্রায় বিশ ফুট লম্বা এবং বেশ প্রশস্ত।

এখানকার সাপগুলো বেশ বড়। এগুলো অনেক সময় একটি পুরো খরগোশ বা কয়েকটি মুরগি গিলে ফেলতে পারে। তবে এদের চলার গতি অত্যন্ত ধীর, তাই মানুষকে তাড়া করতে পারে না। তিনি সম্ভবত অজগর সাপের কথা বলছিলেন। এরকম প্রায় আঠারো ফুট দৈর্ঘ্যের একটি সাপ তিনি একবার নিজেও দেখেছেন।

আরো একটি বিরল জন্তুর কথাও রয়েছে করনেইলির বৃত্তান্তে। বঙ্গ অঞ্চলে তিনি এ-জন্তুর প্রাচুর্য লক্ষ করেছেন। এর গা থেকে সুগন্ধ আসে। কোনো তরল পদার্থ বা এর আধারের পাশ দিয়ে এ-জন্তু চলাচল করলে তরলও সুগন্ধিতে ভরে যায়। এ-গন্ধ দীর্ঘস্থায়ী এবং অনেকটা কস্ত্তরী বা মৃগনাভির মতো। প্রাণীটি দেখতে ইউরোপীয় ইঁদুরের মতো; তবে এর চোখ ক্ষুদ্রাকৃতির এবং লেজ ছোট। করনেইলি এর নাম দিয়েছেন muskrat। সম্ভবত রাডিয়াড কিপলিংয়ের Jungle Book-এর Muskrat থেকে করনেইলি নামটি নিয়েছেন। প্রসঙ্গত কিপলিং প্রাণীটিকে Musk rat লিখলে মুদ্রণ প্রমাদে তা Muskrat হয়ে যায়। এটি উদ্বিড়াল জাতীয় প্রাণী – ভোঁদড় বা বেজি হতে পারে। গন্ধগোকুল নামে এর পূর্বপরিচিতি থেকে বলা যেতে পারে যে, একসময় হয়তো প্রাণীটির গায়ে প্রবল সুগন্ধ ছিল।

ঘেন্টুদের ধর্মীয় আচার পালনের নানা দৃশ্য ফুটে উঠেছে করনেইলির বিবরণীতে। এখানকার তীর্থস্থানগুলোতে বিশাল ভবন নির্মাণের অর্থ ও মজুর সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিপুল আয়োজন ও সাফল্যে অবাক হয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি তাঁর চোখে পড়েনি। তীর্থস্থানের মধ্যে বিশাখাপত্তম থেকে দুশো মাইল দূরে জগন্নাথের মন্দিরের কথা পৃথকভাবে উলিস্নখিত হয়েছে। বাংলা অঞ্চল থেকে অনেক দূর হওয়া সত্ত্বেও জীবনে অন্তত একবার ঘেন্টুরা জগন্নাথ মন্দিরে যায়। জগন্নাথ মন্দিরে প্রতিদিন অন্তত বিশ হাজার লোকের খাবার পরিবেশিত হয়। এর আয় দিয়ে মন্দিরের পুরোহিতরা ভালোভাবেই জীবন নির্বাহ করতে পারেন।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল দেখে এই ইংরেজ সৈনিকের মনে হয়েছে যে, ধর্মীয় আচার পালনের ক্ষেত্রে বঙ্গ অঞ্চলের ঘেন্টুরা কট্টর। এ-অঞ্চলের ব্রাহ্মণদের কৃচ্ছ্রসাধন পার্শ্ববর্তী এলাকার তুলনায় বেশি। এরা কোনো প্রাণীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে না। এক ধারার যোগী-সন্ন্যাসী প্রকৃতপক্ষে নগ্ন থাকে। ঘেন্টুরা এদেরকে ভক্তি ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সাধারণে বিশ্বাস যে, এদের আশীর্বাদে অনেক বন্ধ্যা নারী সমত্মান লাভ করেছে।

বঙ্গ অঞ্চলের বিচিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অবাক হয়েছেন করনেইলি। এর মধ্যে চড়কের উৎসবকে তিনি বিশিষ্ট বলেছেন, যদিও চড়ক শব্দটি ব্যবহার করেননি। তাঁর বিবরণ অনুসারে, নগরের পাশে কোনো খোলা মাঠে দলে দলে মানুষ জড়ো হয়। মাঠের মধ্যে কয়েকটি খুঁটি পোঁতা হয়, যার উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। খুঁটিকে কেন্দ্র করে চারদিকে ঘুরতে পারে এমন কয়েকটি আংটা প্রত্যেক খুঁটিতে সংযুক্ত থাকে। আংটাগুলোর একপাশে প্রায় অর্ধফুট লম্বা কয়েকটি লোহার বড়শি সাঁটানো থাকে; এর বিপরীত দিকে থাকে ভারী লোহা বা পাথর। একজন ভক্ত বড়শিগুলো পিঠের চামড়ার সঙ্গে গেঁথে নেয়, আর অন্যদিকে লোহা বা পাথর নিচের দিকে টানতে থাকলে বড়শিবিদ্ধ মানুষ ক্রমশ ওপরে উঠে শূন্যে ঝুলতে থাকে। প্রায় বিশ ফুট ওপরে তুলে তাকে তিন-চার মিনিট শূন্যে ঘোরানো হয়। এরপর নিচে নামিয়ে তার ক্ষতস্থানে হলুদ ইত্যাদি লাগিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয়। করনেইলির বিস্ময়, এই যন্ত্রণার মধ্যেও ভক্ত কোনো চিৎকার করে না; তার মধ্যে যন্ত্রণার কোনো চিহ্নও দেখা যায় না। এভাবে একের পর এক ভক্ত এই আচারে অংশ নেয়, যতক্ষণ না সন্ধ্যা হয়। ভক্তরা মনে করে যে, এতে দেবতা প্রসন্ন হন এবং অতীতের পাপমোচন ঘটে। তবে এই ইংরেজ সৈনিকের মনে হয়েছে যে, এটি নিছক ধর্মীয় উন্মাদনা।

সে-সময়ে প্রচলিত সতীদাহের বিবরণও রয়েছে করনেইলির জার্নালে। করনেইলি স্বচক্ষে কোনো সতীদাহ দেখেননি; তবে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনেছেন। সতীদাহের জন্য তখন নিকটবর্তী ইংরেজ সেনাবাহিনীর অধিনায়কের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হতো। করনেইলির অত্যন্ত পরিচিত একজন ইংরেজ অধিনায়ক সতীদাহের একটি অনুমতি দেন এবং নিজে এটি প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর বর্ণনাটি করনেইলি লিপিবদ্ধ করেছেন।

প্রায় দু-মাইল দূর থেকে নদীতীরে একটি শব আনা হয়েছে। শবটি আনুমানিক দুই ফুট উঁচু কাঠখড়ির সত্মূপের ওপর শায়িত। সদ্যবিধবা স্ত্রীলোকটি ছিল মধ্যবয়সী। অধিনায়ক তার মধ্যে কোনো নেশাগ্রস্ততার লক্ষণ দেখেননি। তিনি শান্তভাবে তার চারদিকে বসা নিকটজনদের সঙ্গে কথা বলছিলেন; তার মুখশ্রী শান্ত ও সৌম্য। তিনি ইংরেজ অধিনায়ককে একগুচ্ছ ফুলও উপহার দিলেন। এরপর স্ত্রীলোকটি স্বামীর পাশে চিতায় শুয়ে পড়লেন; তার হাত দুটো মাথার নিচে। উপস্থিতরা তাদের শরীরের ওপর আরো কিছু কাঠখড়ি বিছিয়ে দিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দিলো। ওই অগ্নিকু–র মধ্যে শুয়ে স্ত্রীলোকটি তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন, যতক্ষণ না তার শরীরে আগুন লেগেছে। অধিনায়ক লক্ষ করেছেন যে, স্ত্রীলোকটি একবারো কাঁদেননি; এমনকি আগুন লাগার পরও গোঙাননি। তার চারপাশের নিকটজনদেরও কোনো হা-হুতাশ করতে দেখা যায়নি। অধিনায়ক একবার পুরো ব্যাপারটি থামানোর কথাও ভেবেছিলেন। কিন্তু স্ত্রীলোকটির দৃঢ়তা ও উপস্থিতদের অনুভূতিতে আঘাত লাগার আশংকায় সাহস পাননি।

স্বচক্ষে সতীদাহ না দেখলেও করনেইলি এক সতীর জীবন্ত-সমাধিতে প্রবেশ দেখেছেন। একদিন তিনি জানতে পারেন যে, কলকাতার কাছেই এক সতী জীবন্ত-সমাধিতে প্রবেশ করবেন। ঔৎসুক্য নিয়ে কয়েকজন সঙ্গীসহ করনেইলি সেটা দেখতে যান। নদীর তীরে কয়েকজন নারী গাছগাছালি দিয়ে আগুন জ্বেলে শীত নিবারণ করছিল। সদ্যবিধবা নারীটির বয়স চলিস্নশের কাছাকাছি; একটি পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে সে শান্তভাবে তাদের মধ্যে বসে ছিল। জীবন্ত-সমাধির আসন্নতার মুখেও তার মধ্যে কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি। করনেইলিরা স্ত্রীলোকটিকে নিজেদের সাধ্যমতো নিবৃত করার চেষ্টা করে। তাকে এমনও বলা হয় যে, অন্তত একদিনের জন্য এ-কাজ স্থগিত করলে তাকে মোটা অঙ্কের অর্থ দেওয়া হবে। কিন্তু স্ত্রীলোকটি শান্তভাবে জানায় যে, স্বামীর মৃত্যুর পর তার বেঁচে থাকা অর্থহীন। বরং আজ রাতেই সে পরলোকে স্বামীর সঙ্গে মিলিত হতে চায়। জোর করে থামানো বিপজ্জনক ভেবে করনেইলিরা চুপ করে যান।

শবটি নদীর তীরে মাটির ওপর রাখা হয়েছিল; তার পাশেই সমাধির গর্ত। বিধবা নিমগ্নচিত্তে কয়েক মিনিট শবের সামনে বসে থাকলেন। এরপর ওখানে চার-পাঁচটি প্রদীপ জ্বেলে দেওয়া হলো। একটি মাটির থালায় কিছু চাল ও কলা মিশিয়ে নেওয়া হলো। তখন একজন ব্রাহ্মণ কিছু আবৃত্তি করলেন; স্ত্রীলোকটি তার পুনরাবৃত্তি করলেন। এরপর শবটিকে স্নান করিয়ে কয়েকটি অগ্নি-প্রজ্বলিত খড়ি-হাতে স্ত্রীলোকটি তিনবার শব-প্রদক্ষিণ করলেন। তার হাঁটু পর্যন্ত নদীতীরের কাদায় ডুবে যাচ্ছিল; তার মধ্যেও করনেইলি স্ত্রীলোকটির দৃঢ় পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছিলেন। পুরোহিত আবার কিছু আবৃত্তি করলে বিধবা আবার তার পুনরাবৃত্তি করলেন। এরপর বিধবা স্বামীর দাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলেন এবং শবটি সমাধিতে ঠেলে দেওয়া হলো। তার অনুসরণে বিধবা নিজেই সমাধির মধ্যে ঢুকে গেলেন; তার মুখম-ল ছিল সৌম্য ও দৃঢ়; কোনো দ্বিধা বা উদ্বেগের চিহ্ন তাতে দেখা যায়নি। সমাধির ওপর প্রথম মাটিচাপা দিলো তাদের বারো বছরের ছেলে; এরপর উপস্থিতরা মাটি দিতে থাকল এবং দ্রম্নত সমাধির ওপরটা মাটিতে ঢেকে গেল। উপস্থিত কয়েকজন ক্ষণিকের জন্য কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিন্তু করনেইলিরা জীবন্ত-সমাধিতে প্রবেশকারী স্ত্রীলোকটির কোনো কান্না বা চিৎকার শুনতে পাননি।

করনেইলি তাঁর বঙ্গ-অঞ্চলে বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন যে, সতীদাহ অথবা জীবন্ত সমাধিতে প্রবেশ – এর কোনোটাতেই বিধবাদের বাধ্য করা হতো না। তবে কোনো বিধবা একবার সতী হবেন বলে ঘোষণা দিলে তা পরিবর্তন করে তার পক্ষে ঘরে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না। পরিবার তাকে আশ্রয় দিত না; সমাজ তাকে জাতিচ্যুত করত। সমাজ সতীদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখত এবং মনে করা হতো যে, তারা দেব-দেবীদের প্রিয়জন। জীবন্ত সমাধির এই বিবরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কেননা আমাদের ইতিহাসে সতীদাহের অনেক বর্ণনা পাওয়া গেলেও জীবন্ত-সমাধির বিবরণ চোখে পড়ে না। আবার সতীদাহ হতো বিধবাদের বাধ্য বা প্ররোচিত করে, এমন ধারণার সঙ্গেও মেলে না।

ঘেন্টুদের কয়েকটি বর্ণ শবদেহ পোড়ায়ও না; সমাধিতেও দেয় না। মৃতের দেহ তারা নদীতে ফেলে দেয়। প্রথমে এগুলো পচে কিছু দুর্গন্ধ হয়। তবে অল্পদিনের মধ্যে শেয়াল, শকুন ও চিলের ঝাঁক পুরো শবটিই খেয়ে ফেলে। এভাবে পশুদের দ্বারা পরিবেশ রক্ষা পায়।

স্বামীকে বিষপান করানোর একটি প্রথারও উলেস্নখ করেছেন করনেইলি। তবে এর কোনো বিসত্মৃত বিবরণ দেননি। তিনি মন্তব্য করেছেন যে, কুসংস্কার ও আচার-বিশ্বাস একত্র হলে তা মনকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, মানুষ দৃঢ়তা ও সাহসের সঙ্গে এ-ধরনের অপকাজ করে ফেলে। তিনি অবাক হয়েছিলেন এই ভেবে যে, প্রাণহীন দেবমূর্তি এখানকার মানুষকে এমনভাবে প্রভাবিত করতে পারে; অথচ জ্ঞানের আলোক তা পারছে না।

দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের নদীতীরে রেখে আসার একটি প্রথারও বর্ণনা রয়েছে এই বৃত্তান্তে। যেসব রোগী দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরও সুস্থ হচ্ছিলেন না তাদেরকে আত্মীয়-স্বজনরা প্রথমে গঙ্গায় নিয়ে স্নান করাত। তারপর মুখের মধ্যে একগাদা কাদামাটি পুড়ে তাকে নদীতীরে রেখে আসত। সাধারণের বিশ্বাস ছিল যে, গঙ্গার জল খেয়ে রোগী আরোগ্য লাভ করলে সে হেঁটে বাড়ি ফিরে আসবে। অন্যথায় গঙ্গাতীরে তার জীবন-অবসান হবে। করনেইলির অভিজ্ঞতায় এভাবে রোগীরা কদাচিৎ সুস্থ হতো; কিন্তু তাতে এ-প্রথা বন্ধ হয়নি। এরকম কয়েকজন রোগীকে অবশ্য ইউরোপীয় ডাক্তাররা নদীতীর থেকে উদ্ধার করে সুস্থ করেছেন।

বঙ্গ-অঞ্চলের চারটি নগরের বর্ণনা রয়েছে মেজর জন করনেইলির বৃত্তান্তে। এর মধ্যে মুর্শিদাবাদ প্রধান। তবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবাদারের প্রসঙ্গ এতে নেই; করনেইলির বর্ণনায় তা নবাবদের নগর। এই বর্ণনায় মুর্শিদাবাদ অত্যন্ত নোংরা নগর; নবাবের প্রাসাদও নোংরা। বিশাল এই প্রাসাদটি পরপর সাজানো অনেকগুলো নিচু [একতলা?] ঘরের সমাহার; এর সামনে কাচারিঘর। দালানগুলোতে স্থাপত্যের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই; এমনকি এগুলোর মধ্যে গঠনগত কোনো সংগতিও নেই। তবে দালানের বাইরের বাগানগুলো মার্জিত ও সুরুচির পরিচায়ক। রাজন্যবর্গ তাদের পরিবার নিয়ে বাগান বা উদ্যানেই অধিকাংশ সময় কাটান। আগত অতিথিদের আপ্যায়নও করা হয় এখানে। দালানগুলোর চারদিক খোলামেলা; বাইরে যথেষ্ট আলো ও বাতাস চলাচলের ফলে ভেতরের ঘরগুলো শীতল। কিন্তু কক্ষগুলো কারাগারতুল্য। করনেইলির বিবরণ অনুযায়ী, এই কক্ষগুলোতে নর-নারীর বিবাহবহির্ভূত দৈহিক সম্পর্ক স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। নবাব-পরিবারের পুরুষরা এটাকে তাদের অধিকার মনে করতেন এবং এতে বাধা দিলে সংঘাতে লিপ্ত হতে দ্বিধা করতেন না।

মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠজনদের করনেইলি শনাক্ত করেছেন ‘আলীর গোত্রের মানুষ’ বলে; ‘শিয়া’ অভিধা তিনি ব্যবহার করেননি – সম্ভবত এই অভিধার সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন না। করনেইলি মন্তব্য করেছেন যে, ওরা অলস ও আয়েসি এবং অধিকাংশ সময় ইন্দ্রিয় বিলাসে আসক্ত।

মুর্শিদাবাদ শহরটি পাঁচ মাইল দীর্ঘ ও দুই মাইল প্রশস্ত। ঘনবসতিপূর্ণ এ-শহরটিতে সাধারণ মানুষের বাসগৃহগুলো খুপরির মতো; কিছু কিছু কুটির। অঞ্চলের প্রধানরা (chiefman) অবশ্য দালানে বাস করেন। নগরের অধিবাসীরা নতুন বসতির জন্য দূরে যেতে চাইত না। যুদ্ধ বা অন্য কোনোভাবে লোক ক্ষয়ও হতো না। মাঝে মাঝে যেসব যুদ্ধ হতো তা ছিল ক্ষণস্থায়ী এবং প্রায় রক্তপাতহীন। এসব মিলিয়ে বসতি ও জনসংখ্যা উভয় দিক থেকেই মুর্শিদাবাদ অত্যন্ত ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছিল।

ইউরোপীয়রা তাদের সব বাণিজ্যকেন্দ্র ও বসতি গড়ে তুলেছিল নদী তীরবর্তী অঞ্চলে। এর মধ্যে কলকাতা ছিল প্রধান। শহরের আয়তন, বাণিজ্যের পরিধি, জাঁকালো দালানকোঠা – সব মিলিয়ে কলকাতা ছিল অন্য শহরগুলো থেকে অনেক বড়। উজ্জ্বল আলো, জাঁকজমক, বিলাস প্রভৃতির জন্য কোম্পানির বণিকদের যে-খ্যাতি তা কলকাতাতে মূর্ত হয়েছিল। বণিকদের লক্ষ্য ছিল বিলাসী জীবন; উপনিবেশ স্থাপনের মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটও ছিল তাই। বাণিজ্য ও বিলাসে ইংরেজরা ক্রমশ ওলন্দাজ ও ফরাসিদের অতিক্রম করেছিল।

কলকাতার প্রান্তে ইংরেজদের প্রধান দুর্গ ফোর্ট উইলিয়াম। এটি একটি চতুষ্কোণ-স্থাপনা; তবে ভেতরে সৈন্যদের সুসংহত অবস্থানের জন্য অনুকূল নয়। দুর্গের বাইরে দেয়াল ঘিরেই দেশীয়দের ঘরবাড়ি। গত নবাবি-আক্রমণে এসব স্থাপনা থেকে দুর্গে আঘাত করা হয়েছিল। এই আক্রমণে দুর্গসহ পুরো কলকাতা শহর বিধ্বস্ত হয়েছে। এমনকি বিশাল বলরুমসহ কোম্পানি-প্রধানের (গভর্নর) জন্য তৈরি প্রাসাদও বিধ্বস্ত হয়েছে। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের সৈন্যরা এ-আক্রমণকালে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। ইংরেজদের প্রতি আক্রমণকারীদের ঘৃণা এত প্রবল ছিল যে, তারা গভর্নর-প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের উপকরণ দিয়ে একই স্থানে একটি মসজিদ তৈরি করে।

পলাশীর যুদ্ধের পর অবশ্য কলকাতা পুনর্নির্মাণের কাজও চলছিল। করনেইলির বর্ণনামতে, তখন ধীরে ধীরে কলকাতার বিপর্যস্ত চেহারা বদলে যাচ্ছে। শহর থেকে এক মাইল দূর ধরে একটি দেয়াল তোলা হচ্ছিল। নদীপথে যাতে কেউ শহর আক্রমণ করতে না পারে, তার জন্যই ওই ব্যবস্থা। তবে দেয়াল নির্মাণে অত্যন্ত ধীরগতির সমালোচনা করেছেন করনেইলি।

হুগলি শহর কলকাতার চেয়ে প্রাচীন। করনেইলির বিবরণ মতে, হুগলি মুর ও দেশীয়দের শহর এবং প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। তাঁর মতে, প্রাচ্যের বিলাসী জীবনযাত্রার উত্তম উদাহরণ হচ্ছে হুগলি। বাণিজ্যের মাধ্যমে পৃথিবীর নানা জায়গার জিনিসপত্র হুগলিতে আসত। এসব ক্রয় এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রেও হুগলিবাসীর জুড়ি ছিল না। কলকাতা-আক্রমণের প্রতিশোধ হিসেবে ইংরেজরা হুগলি আক্রমণ করে সর্বাত্মক লুণ্ঠন চালায়। তবে করনেইলির অবস্থানকালেই হুগলির পুনর্নির্মাণ চলছিল। হুগলির নদীমুখ থেকে চলিস্নশ মাইল ওপরে চিনচুড়া (chinsurah)। ওখানে ওলন্দাজদের একটি চতুষ্কোণ দুর্গ আছে। বলা যায় যে, দুর্গটির প্রান্তে গিয়ে হুগলি শহর শেষ হয়েছে। সে-হিসেবে হুগলি শহরের আয়তন কলকাতার চেয়ে বেশি।

চিনচুড়া থেকে কলকাতার পথে মাইলদুয়েক গেলেই চন্দননগর। এটি মূলত ফরাসি-বসতি। এখানেও ফরাসিদের একটা চতুষ্কোণ দুর্গ রয়েছে এবং দুর্গ হিসেবে তা বেশ শক্ত। দুর্গের চারদিকে অস্ত্রশস্ত্রের দোকান। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন ও কর্নেল ক্লাইভ বেশ কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ ও চার হাজার সৈন্য নিয়ে চন্দননগর আক্রমণ করেছিলেন। অর্থাৎ এখানে ইংরেজদের শক্তি ছিল পলাশীতে তাদের বাহিনী থেকে অনেক বেশি। তারপরও দুর্গ ও চারপাশের অস্ত্রের দোকান থেকে ভালো প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল। করনেইলি আশ্চর্য হয়ে লিখেছেন যে, নবাবের আক্রমণের সময় ফোর্ট উইলিয়াম থেকে কেন এমন প্রতিরোধ গড়া যায়নি! ইংরেজদের আলস্য ও অবহেলাকেই তিনি এজন্য দায়ী করেছেন। ইংরেজ আক্রমণে অবশ্য চন্দননগর দুর্গ, তার চারপাশের দোকান ও হুগলির সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়।

মেজর জন করনেইলি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল দেখেছেন। তাতে একরকম সমেত্মাষ ও আনন্দও প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, যা দেখেছেন তা সারাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করাও সমীচীন মনে করেননি তিনি। তিনি অত্যন্ত সতর্কভাবে এ-ও বলেছেন যে, শুধু শহর দেখে কোনো দেশ সম্পর্কে মন্তব্য করা যথাযথ নয়। তাঁর অবলোকন অনুসারে, বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে পাপও এক শহর থেকে আরেক শহরে অভিবাসন নেয়। ফলে বড় শহরগুলো পাপে পূর্ণ।

করনেইলির উপসংহারমূলক মন্তব্যসমূহে তাঁর গভীর বিবেচনাবোধের পরিচয় আছে। তিনি মন্তব্য করেছেন যে, মানব প্রজাতির বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে প্রথা ও আচরণে কত-না পার্থক্য! অথচ তার মধ্যেও অন্তর্নিহিত মিলের অভাব নেই। স্থান ও কালের ভেদে মানুষে মানুষে পার্থক্য থাকলেও সবাই কল্যাণ ও হিত চায়; গুণের প্রশংসা করে এবং দোষকে ঘৃণা করে। সার্বভৌম এক স্রষ্টায় সবাই বিশ্বাস করে, বুকে ধারণ করে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

কলকাতা, পলাশী, মুর্শিদাবাদ, চন্দননগর মিলে রাজকীয় সেনাবাহিনীর মেজর জন করনেইলির বঙ্গবাস মাত্র ছয় মাস – মার্চ ১৭৫৭ থেকে সেপ্টেম্বরের শুরু পর্যন্ত। ওই যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে বাংলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখার সুযোগও ছিল সীমিত। তার মধ্যেও করনেইলির জার্নালে আঠারো শতকের বাংলার যে কয়েকটি রেখাচিত্র পাওয়া যায়, ইতিহাস ও সমাজচিত্রের উপকরণ হিসেবে তা অত্যন্ত মূল্যবান। r