মেট্রো ও মন্থন

তিলোত্তমা মজুমদার
মেট্রোরেলে আপনাকে স্বাগত। এই পরিশীলিত উচ্চারণ শোনার জন্য আমি বহু বছর অপেক্ষা করেছিলাম। গর্ভে প্রবেশ এবং গর্ভ ফাটিয়ে বেরিয়ে আসার দৈনন্দিন স্বাদ যারা পায় – তাদের অঞ্চল থেকে আমি ছিলাম অনেক দূরে। বাড়ি থেকে কর্মালয়ে যেতে আমাকে পেরোতে হতো নদী, সাগর, মরুভূমি, তারকা সমন্বিত হোটেল। সেইসব বহুতল হোটেলের মাথায় জমে থাকা মেঘপুঞ্জের কাছে, প্রখর গ্রীষ্মের দাহে কতবার জল চেয়েছি আমি, পাইনি এক ফোঁটা। বরং, সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফেরার পালা, একটি জাহাজ পাওয়ার আগে, একটি নৌকা পাওয়ার আগে, দু-চারটি মরুভূমির উট পৌঁছার আগেই, হোটেলের তারকারাজি থেকে আবির্ভূত হতো জ্বলন্ত কামুক মানুষ। বলত ‘লিফট চাই?’ ইশারা করত চোখ দিয়ে ঠোঁট দিয়ে জিভ দিয়ে। হাতের আঙুল দিয়েও। আমার অপরাধ, ভূগর্ভস্থ রেলের সন্নিহিত এলাকায় আমি বাস করি না। তাই আমি ব্রত রেখেছিলাম। সুতো বেঁধেছি দরগায়। শিখ ভিক্ষুক আমি কখনো দেখিনি। কিন্তু সন্ত দেখেছি অনেক। প্রার্থনা জানিয়েছিলাম তাঁদের কাছে। হে করুণাময়, আমাকে দাও সেই বর, যাতে আমার বাড়ির পাশ দিয়েও যায় মেট্রোরেল।
অবশেষে ঈশ্বর মেহেরবানি করে ময়দানবকে ফের পাঠালেন মর্ত্যভূমিতে। এক প্রবীণ নদী বয়ে যেত আমাদের বাড়ির কাছ দিয়ে। তাছাড়া ফাঁকা জায়গা আর নেই বললেই চলে। কেবল বাজার, কেবল বাড়ি, কেবল বসতি। গায়ে গা লাগানো। ঘিঞ্জি। ময়দানব অতএব, ওই নদীর বুকেই বড় বড় স্তম্ভ বসিয়ে এক স্তম্ভ থেকে অপর স্তম্ভকে জুড়তে লাগলেন রেলের লাইন দিয়ে। এই স্তম্ভিত জনপদ দেখতে লাগল তাঁর ক্রিয়াকলাপ। তাঁর স্তম্ভন। খনন। উত্তোলন। একদিন, চিমটে দিয়ে গর্ভ থেকে মানবক বের করার মতো সে বাইরে নিয়ে এলো ভূগর্ভ রেলকে। চালিয়ে দিলো স্তম্ভের উপরিস্থ লৌহপথে। তাই দেখে সে কী হাততালি! থামতেই চায় না। আমি ছাতে দাঁড়িয়ে দেখলাম, পরিষ্কার আকাশ, তারই নীলের সঙ্গে মিশে গিয়েছে মেট্রোরেল ইস্টিশনের ছাউনি। নীল রং তার। টিন নয়। অন্য এক বস্তু। আজকাল খুব ব্যবহার হচ্ছে। পুরু, অর্ধস্বচ্ছ, রঙিন। পেট্রোবস্তুর উপজাত কিছু বলেই মনে হয়। দেখে-শুনে পুলক এলো মনে। ঈশ্বর আমার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। কে বলে, ঈশ্বর তেমনই এক বিষয় যাঁর দাঁত নেই চোখ নেই নখ নেই! অভিলাষ পূর্ণ হলে ঈশ্বরে আস্থা বাড়ে, বিজ্ঞাপনে প্রদর্শিত পণ্যের মতো। আমারও বাড়ল। দেখলাম, সফল ও পরিশ্রান্ত ময়দানব স্বর্গে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। রাজনৈতিক দলগুলো যে যার ধ্বজা হাতে অপেক্ষা করছিল। কেউ একবার কফি খেতেও ডাকল না তাঁকে। দেখলাম, সুন্দরী রূপসী স্বর্বেশ্যারা সোনার রথে করে ময়দানবকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নিজের দেশে। কেউ আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। কেউ পায়ের কাদা ঘষে তুলে দিচ্ছেন। কেউ সর্বাঙ্গ আন্দোলিত করা নৃত্যে তাঁর মনোরঞ্জন করছেন। বুঝলাম, দানবে আর দেবতায় তফাৎ করা হচ্ছে না স্বর্গে। সুরাসুর একাকার হয়ে গেছে। মুখের কাছে দুহাত এনে ডেকে বললাম – ‘ওগো পুংশ্চলী, স্বর্গনটিনী, পুংস্কামা, প্রেষণী, স্বর্গঘুস্কি, ঢেমনিদেবীগণ। তা হলে কি স্বর্গে এখন জাত পাত বর্ণবিভাজন বৈষম্য বলে কিছু নেই। একেবারে স্বর্গীয় সমানাধিকার ও সমসম্মান প্রতিষ্ঠিত?’
স্বর্বেশ্যাগণ দয়া করে দেখলেন আমাকে। অতঃপর হাঃ হাঃ করে খানিক হেসে বললেন, ‘স্বর্গে কোনোকালেই বিষম অধিকার ছিল না এমনি আমরা বলে থাকি। আজো তাই বলছি। বর্ণবৈষম্য বলেও কিছু হয় না। তবে হ্যাঁ। বর্ণসচেতনতা বলে কিছু আছে বটে, আর সেখানেই স্বর্গীয় সাম্যের জয়।’
‘সে কীরকম?’
‘বহু যুগ আগেকার সুরাসুর বিদ্বেষ ভুলে এখন অসুর-দানব শ্রেণিকে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ সম্মান। বিশেষ সুবিধা। তাঁদের উচ্চ মান, উচ্চ স্থান।’
‘ক্ষমতা?’
‘ক্ষমতায়নের বিষয়টায় আমরা, স্বর্গঘুস্কি, স্বর্গপ্রেষণীগণ খানিক উদাসীন। তাই ঠিক বলতে পারব না।’
এবার হাঃ হাঃ হাসার পালা আমার। তাঁরা বললেন, ‘হাসছ কেন?’
বললাম, ‘জাত-পাতের চিহ্ন অদ্যাবধি স্বর্গেও জারি আছে তাহলে? ঘোচেনি?’
‘ঘোচানোর প্রয়োজন কী! বাড়তি সম্মান ও সুবিধা দুই-ই যখন দেওয়া হচ্ছে।’
‘বিনয় দিয়ে যেমন ব্যঙ্গ করা যায়, তেমনি অতিরিক্ত সম্মান ও সুবিধা দিয়েও অসম্মান করা যায়। একদা কী ছিলে, এই পরিচয় মুখ্য হয়ে উঠলে, বর্তমানের মুকুট নি®প্রভ লাগবেই।’
‘তা কেন?’
‘আমাদের পুরীধামে যখন জগন্নাথের রথ নামে পথে, তখন অনেককাল আগে সেখানে রাজা ছিল এমন বংশের একজন আজো দেবসেবার প্রাথমিক অধিকারটুকু পায়। কিছু লোক তার অতীত গৌরব কল্পনা করে তাকে সম্ভ্রমের চোখে দেখে, তারপর বর্তমান ব্যবস্থায় তার রাজত্বহীনতার কথা ভেবে তাকে করুণা করে। আর ভাবাবেগ কম, এমন কিছু লোক ভাবে, রাজা! ছোঃ! ঢাল নেই তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দার! এই দু’পক্ষই লোকটার বর্তমান নাম ধাম পরিচয় শিক্ষা পদমর্যাদা নিয়ে আগ্রহী নয়। অতি মানের প্রকোপে লোকটার বর্তমান থেকেও নেই। একই সঙ্গে সে অতীতের গৌরব এবং অগৌরব। আবার দামু চামার বলে একজন মুচির কাজ করত। আমার জুতোতেই সে অনেক পেরেক মেরেছে। তার ছেলে অত্যন্ত মেধাবী, তার সঙ্গে তপঃশীলি হওয়ায় সারাজীবন সে যত বৃত্তি পেল নিজের মেধায়, লোকে সেগুলো ‘কোটা’ ভাবতে লাগল। এমনকি সে যখন ডাক্তারি শাস্ত্রে উঁচু মাপের সাফল্যের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে নিকটবর্তী ‘ক্লিনিকে’ বসতে লাগল, লোকে বলতে শুরু করল, মুচির পো, সে আবার অসুখ সারাবে কী! যেন মুচিত্বর উত্তরাধিকারে সে কেবল জুতো সারাতেই সমর্থ।’
‘যাই। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
‘তাহলে তোমরাও অতিসম্মানিত স্বর্বেশ্যাই আছ তো?’
‘আমরা স্বর্বেশ্যাগণ চিরকালই সম্মানিত। দেব, দানব, মহাঋষিগণ আমাদের রূপে নৃত্যে গীতে কামমায়াজালে মোহিত হলেই আমাদের সার্থকতা। একটা কথা বলে যাই। জাতি ধর্ম বর্ণ শ্রেণিবিহীন সমাজ যারা স্বপ্ন দেখে – তারা কল্পস্বর্গের অধিবাসী। বিভেদ ছিল। আছে। এবং থাকবে। বিভিন্ন রূপে। বিচিত্র মর্মে। এক বিভেদ ঘুচে যাবে, অন্য বিভেদ আসবে। উচ্চাবচতাই মহাবিশ্বের ধর্ম। সে সামতলিক নয়।’
তাঁরা উড়ে গেলেন। যাওয়ার আগে ময়দানব বললেন, ‘যেমন আমি কোনোদিন বিশ্বকর্মা হতে পারব না।’
ময়দানব অসুরদের কারুশিল্পী, যেমন দেবতাদের বিশ্বকর্মা।
যিনি ময়দানবের পা মুছিয়ে দিচ্ছিলেন, বললেন, ‘অত ভাবার দরকারই বা কী? ভালো থাকতে পারলেই হলো।’
বললাম, ‘কাকে বলে ভালো থাকা?’
স্বর্গরথ আকাশে বিন্দু হয়ে গেছে। দেখি, ছেঁড়া মলিন পোশাক পরা একদল বাচ্চা মরা নদীতে ডিঙি নামিয়ে মাছ ধরা মাছ ধরা খেলছে। এই ডিঙি কোনোদিন আর বেয়ে যেতে পারবে না। ছোট পরিসরে, ক্রমশ পাঁক লাগা জলে ঘুরে ঘুরে বেড়াবে। স্তম্ভের পর স্তম্ভ বসিয়ে ময়দানব নদীটিকে খণ্ড খণ্ড করে কেটেছে।
এই কি আমি চেয়েছিলাম, আমার ভালো থাকার মেট্রোরেল? এই কি আমি চেয়েছিলাম? আমার সুখের জন্য খণ্ডিত হবে নদী, ভেবেছিলাম কি আমি? তাহলে এই কি নিয়ম জগতের, একজনকে ভালো রাখতে গেলে আরেকজনকে মারতে হয়?
ময়দানবের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে শোরগোল তুলল ধ্বজাধারীরা। এ-দল বলে মেট্রোরেল আমাদের কীর্তি, ও-দল বলে আমাদের। বিবাদ চলছে। দাবি চলছে। সাফল্যের মহিমা নিয়ে দৌড় চলছে। এরই মধ্যে প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিবর্গকে সম্মানজনক উপহার দেওয়া হলো এক-একটি ইস্টিশান। ভাগ্যিস এসবই তাঁদের প্রতি মরণোত্তর সম্মান, যদি জীবিত থাকতেন তাঁরা, যদি শুনতেন আজ মহানায়ক উত্তমকুমারে ধর্ষণ হয়েছে, কবি সুভাষে শ্লীলতাহানি, শহীদ ক্ষুদিরামে এক ব্যক্তির পকেট কাটা গিয়েছে, সূর্য সেনে ভিড় ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে পদপিষ্ট হয় এক শিশু, গীতাঞ্জলিতে মরণঝাঁপ দিলেন এক অজ্ঞাতপরিচয় যুবক, তাঁর পকেটে একটি চিরকুট মিলেছে। তাতে লেখা – তুমি আমাকে আর চাও না। তাই…! জীবিতাবস্থায় এসব দেখলে শুনলে তাঁদেরও বুকপকেটে নিশ্চিতভাবে পাওয়া যেত এমনই সব চিরকুট। তাতে কী লেখা থাকত?
এবং এক দুপুরে, ছুটির দুপুরে, সুনসান কবি নজরুলে এক যুবক গুলি করল অপর এক যুবককে। যে মারল সে ফেরার হয়ে গেল। যে মরল, তার নিথর রক্তাক্ত শরীর লাশকাটা ঘরে চলে গেল। কোনো কবি তাকে নিয়ে কবিতা লিখল না।
পরদিন আপিস যাওয়ার সময় দেখলাম, গ্রানাইটে বাঁধানো মসৃণ কবি নজরুল প্লাটফর্মের বুকে রক্ত শুকিয়ে কালচে। ডুমো মাছিরা মহোল্লাসে চেটে নিচ্ছে তা। পরিষ্কার করা হয়নি কেন? জল ছিল না? লোক নেই? নাকি সময় নেই রক্ত মোছার! লাল রঙের এই তরল, এই আঁশটে গন্ধের শোণিত, প্রাণবাহী এই রুধির ধারা, দেহ থেকে বেরোনো মাত্র ভয়ংকর ও বীভৎস – এই বোধ মানুষের চলে গিয়েছে। এতো হানাহানি, খুনোখুনি, মারামরি করতে করতে রক্তমাখা হাত কিংবা প্লাটফর্ম ধুতে ফিনাইল ডেটল কিচ্ছুই আর লাগে না।
তিন ঘণ্টাও লাগল না এই খুন ভুলে যেতে। প্লাটফর্মের রক্ত আরো শুকিয়ে উঠল। মনে তার রেশ রইল না। অতি কাম্য মেট্রোরেলের ভিড় তপ্ত ঘর্মাক্ত কিন্তু সুখী গমনাগমনে আমি তৃপ্ত থাকলাম।
সারাদিনের কাজের শেষে পা রাখলাম, ইয়ে, মানে, আমাদের গড়িয়া বাজারের বুকে, মানে সেই কবি নজরুলের প্লাটফর্মে। অভ্যাসবশত কিছু লোক প্লাটফর্মের কোণে পানের পিক ফেলল, একজন প্রস্তাব করার উদ্যোগ নিতে অপর একজন তাকে বারণ করল এমন কাজ করতে, আর এই নিয়ে বচসা বেধে গেল। কজন মিচকে সুস্থ সবল ব্যক্তি খলনায়কের মতো হাসতে হাসতে গিয়ে দাঁড়াল লিফটের দরজায়, যা কিনা শুধুমাত্র অসুস্থ ও বৃদ্ধদের জন্য।
ভিড়ের গায়ে গা লাগিয়ে চলন্ত সিঁড়িতে দাঁড়ালাম। পাঞ্চগেট পেরিয়ে বহির্গামী জনতা স্তম্ভিত ও নিশ্চল। থমকে দাঁড়িয়েছে হঠাৎ। বিমূঢ় অবস্থায় একপাশে সরে এলো সব। এবারে দেখলাম। কালচে লাল থকথকে রক্ত। কোনো উদাসীন মাড়িয়ে গিয়েছিল। কিছুদূর অবধি লেগে আছে রক্তমাখা জুতোর ছাপা। আশেপাশে পানপরাগের ফয়েল, খৈনির ছেঁড়া মোড়ক, বিড়ি-সিগারেটের টুকরো, কারও খোঁপা থেকে খুলে পড়া নকল ফুলের স্তবক। ময়দানব সুন্দর গড়ে, সুন্দর বজায় রাখার শিক্ষা দেয় না। আমরা যেখানে দাঁড়াই, যেখানে থাকি, যেখানে খাই – সেখানেই আঁস্তাকুড়, আবর্জনার ধাবা, সেখানেই বধ্যভূমি। কে না জানে, বধ্যভূমিতে রক্তপাত স্বাভাবিক।
আমিও স্বাভাবিকভাবে রক্তের পাশ কাটিয়ে গেলাম।
হঠাৎ আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করল। আমি স্বেদাক্ত হলাম। অনতিকম্পিত হলো আমার শরীর। থমকে দেখলাম আমার কালো নরম জুতো, যা আমার চরণ দুটিকে রাখে সুখী ও সুরক্ষিত। দেখলাম আমার হালকা নীল জিন্স। মনে হলো, ওই তো, ওই তো রক্তে মাখামাখি পা আমার, ওই তো ছিটে লেগে আছে জিন্সে। আঁশটে গন্ধে ছেয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ আমার, যেন এইমাত্র আমারই পায়ের তলায় সংঘটিত হলো বীভৎস হত্যাকাণ্ড!
রক্তের মানচিত্র থেকে আমি পালাতে চাইলাম।
অথচ, সঠিকভাবে হিসাব করলে ছড়ানো থকথকে রক্ত আর আমার দুটি পায়ের মাঝে ছিল অন্তত দু-ফুটের পরিচ্ছন্ন ব্যবধান। ছড়ানো-ছিটানো রক্তের থেকে আমি চিরকাল দূরে দূরে। কলেজে দুই দল পরস্পরের মুখ মাথা ফাটিয়ে দিত যখন, আমি পাঠাগারে অঙ্ক কষতাম। গুলিগোলার সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে আমি কোনোদিন হেঁটে যাইনি। এমনকি মুক্তিসংগ্রামের কী দুর্ভিক্ষের চলচ্ছবি দেখতে বসেছি আইসক্রিম চাটতে চাটতে। এতকাল, আপাদমস্তক, রক্তপাত অথবা সংক্রামক জীবাণুমুক্তই আমি ছিলাম।
মাত্র তিন সপ্তাহ আগে এই স্টেশনে একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে গিয়েছে খোলাভাবে, দিনদুপুরে। একদিনের বাসি কালচে শুকনো রক্ত তার, আমি দেখেছি। কিন্তু আজ রক্তটা টাটকা। যেন এখুনি কারও খুলি ফাঁক হয়ে গলগলিয়ে বেরিয়েছে। যেন এখনো গরম। কুকুরের দল এখনো লেহন করার সুযোগ পায়নি। যদি পায়! যদি পেয়ে যায়! মানুষের রক্তস্বাদ আপামর কুকুরদের যদি মানুষখেকো করে তোলে! হায়! তার আগেই আমি পালাতে চাই। টের পেতে থাকি, গরম রক্তজড়িত আতঙ্ক উত্তেজনা অনেক – অনেক বেশি তীব্র!
আমার স্বর অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। বিকৃত, কর্কশ, খোনা। আমি চেঁচাই, ‘কী হয়েছে? এখানে কী হয়েছে? আবার খুন?’
কেউ জবাব দিলো না। আমি দ্রুত পায়ে দুটি অপেক্ষমাণ রিকশার দিকে এগোলাম। একটি আমার চাই। চাই-ই। আরো কতজন একইভাবে রিকশাগুলো পাওয়ার চেষ্টা করল। আমি কাউকে লেঙ্গি মারলাম। কনুই দিলাম মুচড়ে। কাউকে বললাম, ‘তোমার বউয়ের কাছে দুপুরে লোক আসে।’ একজন ভারী সুন্দরী মেয়ে, তার কানে কানে বললাম, ‘তোমার প্রেমিকের এইডস আছে কিনা খোঁজ নাও।’ তারা ব্যথায়, যাতনায়, অপমানে, সন্দেহে আর্তনাদ করতে লাগল। জীবনের দৌড় এরকমই। হুবহু। এক চুল ভুল নেই। আমি জয়লাভ করলাম এবং অবাধে রিকশায় উঠলাম।
রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত রক্ত কীসের ওখানে? ওই মেট্রোর দুয়ারে? আবার খুন?’
সে প্রথমে বলল জানে না। আমি তাকে লোভের টোপ দিলাম। কিছুদিন আগে আমার পদোন্নতি হয়েছে। কে না জানে, পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নৈতিকতার রকমফের অত্যন্ত বাস্তবোচিত। তাকে বললাম, ‘ভাই আমার খুচরো নেই। তোমায় পাঁচ টাকার জায়গায় পঞ্চাশ টাকাই দেব।’
সে বলল, ‘অসুখ ছিল। বমি করেছে।’ প্যাডেলে জোরে চাপ দিয়ে বলল আরো, ‘হঠাৎ বসে পড়ল। তারপর শুয়ে পড়ল। তারপর বমি করল। বমির ওপরই শুয়ে ছিল।’
বমি করেছে! রক্তবমি! অত! সে কি কোনো যুবক ছিল? নাকি বৃদ্ধ! বাবুগোছের? নাকি ভিখিরি?
অসুখ মাখানো রক্তপাতের পাশ দিয়ে আমি এসেছি। আমার সারাশরীরে কি সংক্রমণ হয়নি? পৃথিবীর যাবতীয় রক্তপাতই কি সংক্রমণের সম্ভাবনা বহন করে না? আমার নরম পদসুখকর জুতো জোড়াকে কি আর বিশ্বাস করা যায়?
আমার চোখে ভেসে উঠল এক রোগা স্বাস্থ্যহীন যুবক। তার ময়লাটে জামায় প্রথম তিনটে বোতাম নেই। পাতলুন অতীব তালিবান। তার সঙ্গে অসহায় বোকাটে আনপড় ষোলো বছর বয়সী বউ। যার চোখ, মুখাপেক্ষী হওয়া আর হজম করা ছাড়া অন্য কিছু শেখেনি। হয়তো স্বামীর অসুখ সারাবে বলে যাচ্ছিল।
আমি স্পষ্ট দেখলাম যুবকটিকে এলিয়ে পড়তে। দু’হাতে ভর দিয়ে বমি করছে। পেট, নাকি ক্লোমশাখা, নাকি হৃৎপিণ্ড ফাটিয়ে, চিড়ে, ফালাফালা করে তুলে আনছে যত পাপ, যত পুণ্য, যত ঘৃণা, যত প্রেম, যত অবহেলা, যত যতœ, যত অত্যাচার, যত প্রতিবাদ এবং প্রতিবাদের নিষ্ফলতা! সব, সব ওই থকথকে কালচে, বিষময় রক্ত রক্ত আর রক্ত!
যুবক কি মারা গেছে? মেট্রো আরোহণের আগেই মারা গেছে?
রিকশাচালক নিশ্চুপ।
আচ্ছা, আমি, ওই রক্ত, কোনো রমণীর কেন ভাবছি না?
কালচে চটচটে অসুস্থ রক্ত মানেই কি তা পুরুষের?