মেহেরজান

চোখের আড়াল হতে না হতে পদ্ম এমন বদলে যাবে, পদ্ম ওরফে পার্লির মা মেহেরজান যদি আগে আন্দাজ করতে পারত! পরের ঘটনা আগে জানার উপায় নেই; তবু ভাবে যদি জানত, অন্তত একটা ইশারাও মিলত, তাহলে কি দিনের পর দিন চুলমুঠি টেনে মাটিতে আছড়ে মুগুরছেঁচা দিত! কিল, লাথি-উষ্টা, ডালঘুটনির বাড়ি। লম্বা, ঘন কোঁকড়া চুল – ধরার সুবিধা বলে শুরুতেই হাতদুটো চুল পাকড়ে ফেলত। মারধর হজম করার তাকত ছিল গায়ে; তবে চিলস্নাত, চিল্লিয়ে খিসিত্ম করতেও ছাড়ত না। বেশিক্ষণ না – রাগ হোক, মার খাওয়ার কষ্ট হোক, ভুলে যেতে সময় লাগত না। এতে মেহেরজানের রোখ আরো চাপত। মেরে হাতে সুখ পেত না। মরে না ক্যান, বিলাইর জান। মুখে হরহামেশা বললেও মন থেকে বলত – এ কী করে হয়! আজকাল এরকমই ভাবে মেহেরজান।

এবার পদ্মর পাঠানো টাকার পরিমাণ বেশি। একুশ হাজার সাতশো হয়ে কিছু খুচরাও। বরাবর মাসে মাসে যা পাঠায় তাতে বাংলা টাকায় দশ-এগারো হয়। এবার যে বেশি পাঠাল, ফোনে তো কিছু বলল না। দিনতিনেক আগে শেষ ফোন। কথা বেশি বলেনি, টাকা পাঠাচ্ছে, মেহেরজান যেন ব্যাংকে সুকুমার স্যারের কাছে গিয়ে খোঁজ করে, বলেই পরে কথা বলবে বলে লাইন কেটে দিয়েছিল। খোদা হাফেজ, ভালা থাইকো, দুয়া কইরো – এসব কথার কথা ফোন ছাড়ার আগে বরাবর বললেও সেদিন বলেনি। হয়তো ডিউটির টাইম, বা হতে পারে তার ম্যাডামের পার্লি পার্লি ডাক শুনে খাস আরবি জবানে জবাব দিতে দিতে ছুটে গেছে।

মেয়ের নামটাও মেহেরজানের মনে থাকে না। সারাক্ষণ মনের মধ্যে পদ্ম পদ্ম। ফোনে যখন কথা হয়, মেহেরজান সোহাগ করে পদ্মসোনা ডাকে, পার্লি আপত্তি করে না। তবে একবার মনে আছে – বলেছিল, পদ্মরে ভুলতে পারতেছ না, ঠিকাছে মন চায় ডাইকো। ডাকনাম ইলু বিলু কতকিছুই অয়, কিন্তু আমার গুডনেম মানে ভালা নাম মনে রাখবা পার্লি আক্তার। পাসপুটের নাম। আর ভোটার আইডি যে করছিলাম, কেরামত হারামি দুই মাস ঘুরাইয়া চাইর হাজার টেকা দালালি খাইলো, ওইখানেও নাম পার্লি, পার্লি আক্তার। আরো আছে, ব্যাংকে সুকুমার স্যার অ্যাকাউন্ট খুইলা বই দিলো, নাম একই। তুমি আমারে পদ্ম কইতে চাও কও, মাইনষ্যেরে গুডনেম বলবা। বলবা আকিকা কইরা এই নাম রাখছো।

বুক তড়পায় মেয়ের কথায়। পদ্ম আকিকার কথা বলতে পারল! জন্মানোর পর তো যায়-যায় অবস্থা। তিন-চার মাস বসিত্মর পাতানো খালা জয়তুনবুড়িই পালল, কী মনে করে যে পদ্ম ডাকত সে-ই জানে। আর মেহেরজানের নিজেরও তখন বাঁচা-মরার ঠিক ছিল না। তোরাব আগে থেকেই ভাগার তালে ছিল; যেই দেখল ঘরের এমন হাল – একে বাচ্চা, মেয়ে বাচ্চা, তার ওপর বউ মরোমরো, বাঁচে যদি, বাসাবাড়ির কাম-কাজ ধরার ভরসা কম – সে তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে, মানে বেপাত্তা হতে দেরি করেনি। আকিকা করে নাম রাখতে হয় এ-খবর তাহলে পদ্ম জানে! নিজের তার আকিকা হয়নি, নামও রাখা হয়নি, তারপরও বাচ্চার নাম রাখতে আকিকার মতো ঘটনার খবর পদ্ম জানে না – কী করে হয়! পদ্ম কি আগের পদ্ম আছে!

সুকুমার স্যার বলল, কী গো, মেয়ের রোজগার সব শেষ করে দিবা নাকি? বিদেশে খাটনি খেটে টাকা পাঠায়, মাসে মাসে কিছু জমাও। মেয়ে সারাজীবন বিদেশে থাকব নাকি!

পদ্ম সারাজীবন বিদেশে থাকবে না এ-কথা মনে হলেই মেহেরজানের বুক ধড়ফড় করে। চার বছরের বেশি পদ্ম দেশছাড়া। চার বছর কম সময় নয়। মেয়েকে একনজর দেখতে সারাক্ষণ ভেতরে জ্বালাপোড়া, তাই বলে ফিরে আসবে ভাবলেই মাথায় বুঝি আসমান ভেঙে পড়ে। রুজি-রোজগারের ধান্ধা বাদ দিয়ে গত চার বছর মেয়ের টাকায় চলছে, বয়স বাড়ায় শরীর-গতর ভারী হয়েছে। বসে বসে খেলে যা হয়। এদিকে মেয়ের কড়া হুকুম – কাম করতে পারবা না। আমি আছি না? কথায় কী জোর, আর পরান-উথালি মায়া! কী কপালেই-না এমন সোনার টুকরা পেটে ধরেছিল, আগে যদি জানত!

কাজ করতে দিতে পদ্মর আপত্তি নিয়ে কথা বলে লাভ হয়নি। যেন জ্ঞান হওয়ার পর থেকে মাকে কাজ করতে দেখে দেখে সে অতিষ্ঠ। পদ্ম তখন সবে দুই-চার পা হাঁটে, জয়তুনবুড়ি মেহেরজানকে রোজগারের বুদ্ধি বাতলালো। বাসাবাড়ির কাম তো করছস, কয়টা টেকাই-বা, তোর বেশি বেশি রুজি দরকার। সেই বেশির পথ ছিল খোয়া ভাঙা। জয়তুনখালা একসময় করেছে। খাটনি যেমন, পয়সাও তেমন। তোর আর তোর মাইয়ার খাওন-পরন ভালাই চালাইতে পারবি, বুদ্ধি কইরা খরচ করলে কিছু জমাইতেও পারবি। মেহেরজান রাজি। খোলা আসমানের নিচে আগুন-রোদে মাথায় গামছা পেঁচিয়ে হাতুড়ি-ঘাই মেরে ইট ভেঙে সাইজমতো খোয়া বানানো। প্রথম প্রথম ব্যথার চোটে কনুই-ঘাড়-কোমর মনে হতো খুলে খুলে পড়বে। ব্যথা কমার বড়ি খেয়েও রাতে ঘুমাতে পারত না। তার ওপর ভয়ডরও কম ছিল না। ইটের টুকরা-ধরা হাতে বা আঙুলে একটা ঘা পড়লে হাড়-হাড্ডি মিসমার হতে কতক্ষণ! টায়ারের টিউব কেটে আঙুল-বাঁচানি হাতা কত আর ঠেকাতে পারত। কপাল ভালো যে অঘটন কিছু ঘটেনি। তবে রুজি যে বেশি হবে বলেছিল জয়তুনখালা, কথা ঠিক। প্রথম যখন কাজ ধরল তখনই দিনে দুইশো টাকা। সেই আমলে সোজা কথা! ঘরভাড়া ম্যালা বাকি পড়েছিল, এছাড়া নানাজনের কাছে ধারকর্জ। আসেত্ম আসেত্ম মিটিয়েছে। টাকার গন্ধ শুঁকে তোরাব ভিড়তে নানা কায়দাকানুন করেছে। মেহেরজান পাত্তা দেয়নি, মনে মনে বলেছে, সামনে যুদি পাই এই আতুড়ির তলে কলস্না খুয়াইবি হারামির বাচ্চা।

সুকুমার স্যারের কথা ঠিক; কিন্তু নিজের খোরাকির খরচ আর ঘরভাড়া মিটিয়ে পদ্মের দশ-এগারো থেকে হাতে কী-ই-বা থাকে! তবে একেবারে কিছুই যে মেহেরজান জমায় না তা-না। জমাতে পারত আরো, যদি নিজে কিছু করত। মেয়ে বাগড়া দিয়েছে ঠিক, কিন্তু যদি কিছু একটা করার পথ পায় পদ্ম জানবে কী করে!  সেলাই-ফোঁড়াই জানলে কিসিত্মতে একটা মেশিন কিনে বাড়তি রোজগারের পথ বের করতে পারত। কিন্তু এ-বয়সে কার কাছে সেলাই শিখবে! বাসাবাড়িতে ছোটা-কাজ চাইলেই পাওয়া যায়। বসিত্মতে কতজনই তো করে। মুখ ফুটে বললেই কাজ জুটবে। কিন্তু পদ্মর কানে যদি যায়? মাঝে মাঝে ভেবেছে পদ্মকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে রাজি করাবে, সাহসে কুলায়নি। এ পদ্ম আগের পদ্ম না, শুনে কী করবে বলা মুশকিল। পদ্ম নিজে অবশ্য যে-কাজ করে সেও বাসাবাড়ির কাজ, তবে বিদেশ তো বাংলাদেশ না যে বাসাবাড়ির কাজ মানে ঝিগিরি। পদ্ম যে-কাজ করে সেটা বাচ্চা রাখার, ইংরেজি নাম বেবিসিটিং – পদ্ম বলেছে। তার ম্যাডামের দুই বাচ্চা, দুইটাই মেয়ে। কাজ বলতে বাচ্চাদের মম-ড্যাডি মানে মা-বাবা বাইরে কাজে চলে গেলে ওদের খাওয়ানো, জামাকাপড় বদলানো, ওদের  নিয়ে টিভিতে কার্টুন ছবি দেখা, আর দুনিয়ার খেলার জিনিস নিয়ে ওদের সঙ্গে খেলা। ঝিগিরি যে নয়, তার প্রমাণ পদ্মর পাঠানো ছবি। কে বলবে এ আগের পদ্ম! পার্লি, হ্যাঁ পার্লি বললে মানায়। পরনে জিনসের প্যান্ট, গাঢ় গোলাপি টিশার্ট, আর পায়ে যে-জুতা এদেশে কয়জন বড়লোকের মেয়ে এমন তুলতুলে লোম-লোম জুতা পায়ে দেয়! পুরু গদির সোফায় বসে মেয়ে তার টিভি দেখে, হাতের পাঞ্জায় বেড় না পাওয়া চ্যাপ্টা মোবাইল। চেয়ার-টেবিলে বসে খায়। চেহারা-সুরত আগেও খারাপ ছিল না, যত্নের অভাবে আসল চেহারা চাপা পড়ে ছিল। এখন দেখলে, নিজের মেয়ে বলে না, চোখ ফেরানো কঠিন। পথেঘাটে কত মেয়েই তো দেখে, কয়জনের ক্ষমতা আছে তার পদ্মর পাশে দাঁড়ায়! লেখাপড়া তো বসিত্মর ইশকুলে ফাইভ পর্যন্ত, কেউ বলবে এখন এ-কথা! আর আরবি জবান যে ও শিখল, কেউ শিখিয়েছে? নিজে নিজে এর-ওর মুখে শুনে এখন তো তার জবান পাক্কা সে-দেশের মানুষের জবানের মতোই।

এই পদ্মর কারণে একটা সময় গেছে মেহেরজানের শান্তিতে শ্বাস ফেলার ফুরসত মিলত না। সারাদিন খাটনি খেটে ঘরে ফিরতে না ফিরতে নালিশ আর নালিশ। একে মেরেছে, ওর খেলনা চুরি করেছে। কিছুটা বয়স বাড়তে বড় বড় নালিশও আসতে শুরু করল। বসিত্মর উঠতি মাস্তানদের সঙ্গে ফুসুর-ফুসুর, ঢলাঢলি। দু-একবার  বেকায়দায় ধরা পড়ে বিচার-সালিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। এ-অবস্থায় মেহেরজান হাত গুটিয়ে থাকে কী করে! খোয়া-ভাঙা হাতে হাতুড়ি থাকলে বুঝি সুবিধা হতো, মাথা গুঁড়ো করে মাপমতো খোয়া বানাতে না পারলেও ছেঁচতে অসুবিধা কী!

কী মারটা না মারত! মার খেয়ে খেয়ে ও হয়তো ঠিক করে ফেলেছিল – মারবা মারো, কত আর মারবা, আমার মন যা চায় করুম। খোয়াভাঙা রুজি তোমার, আমার পথ আমার। অনেকদিন ধরেই হয়তো মনে এমন জেদ বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল, মেহেরজান টের পায়নি। পরিবর্তনটা নজরে পড়ল পদ্মর বয়স যখন পনেরো-ষোলো, শরীরে বাড় বেশি বলে মনে হতো সতেরো-আঠারো – একদিন ঘোষণা দিলো সে কাজ ধরবে, কাজ নাকি ঠিকও
করে ফেলেছে। না, খোয়া ভাঙাভাঙি না, বাসাবাড়িতে ঝিগিরিও না। সে করবে চাকরি, চাকরির নাম সেলসগার্ল। এক বড়লোক মহিলার এলাহি দোকান, মেহেরজান বুঝবে না তাই বলেছিল দোকান, আসল নাম শোরুম। বাচ্চাদের, মহিলাদের জামাকাপড়, অলংকার, ঘর সাজানোর হাজারো জিনিসে ঠাসা। আরো বলেছিল – দোকান বড়লোকগো পাড়ায়, ধানম–তে। মাস গেলে বেতন পাঁচ হাজার, লাঞ্চ মানে দুইফরের খাওয়া ফিরি, উপরি ওভারটাইমও আছে।

মেহেরজান শুনছিল আর ভাবছিল কোন গুণ্ডা-বদমাইশের খপ্পরে পড়ল কে জানে! চাকরিটা তাকে দিলো কে, খোঁজই-বা পেল কী করে – এসবের সোজাসাপটা জবাব –  তুমার চিমন্তা করন লাগব না গো, বুইজা-শুইনা আগাইছি। কথাবার্তার ধরন নতুন। বুইজা-শুইনা আগাইছি কথাটা কানে আঠার মতো লেগে থাকলেও কী বুঝেছে জানতে মেহেরজান কী করবে! খুব যে বলল বড়লোকের দোকান, তো চাকরিতে যে যাবে, ভালো জামাকাপড় কোথায় পাবে, খালি কি জামাকাপড়, কিছু সাজগোজও তো লাগবে। পদ্মর সেই এক কথা – তুমার চিমন্তা করন লাগব না।

সেই শুরু। দেখা গেল মুখে যা বলেছিল তার থেকে এক চুলও এদিক-ওদিক না। মেহেরজান একদিন চুপিচুপি বাইরে থেকে দোকান দেখে তাজ্জব হয়েছে, সত্যিই বড়লোকি কারবার। সকাল আটটায় পদ্ম বেরিয়ে যেত, প্রথমদিকে নিজের পুরনো জামাকাপড়ই ধুয়ে আবুলের লন্ড্রি থেকে ইস্ত্রি করিয়ে পরত। মাস-দুই যেতে নতুন সালোয়ার-কামিজ, স্যান্ডেল, মোবাইল। সেইসঙ্গে শ্যাম্পু, সাবান, ক্রিম, লিপস্টিক, এমনকি সেন্টও। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে মেহেরজানের জন্য নিয়ে এলো কমলা রঙের টাঙ্গাইল শাড়ি। বলল, ঈদের বোনাস দিয়ে ঘরে ফ্যান লাগাবে, রাতে গরমে ঘুমাতে পারে না, সারাদিন এসির ঠান্ডায় পার করে এমন দোজখের গরম।

এক ঘরে, এক চৌকিতে পাশাপাশি শুয়েও মেহেরজানের উপায় ছিল না পদ্মর মতিগতির হদিস পায়। খুব ইচ্ছা করত জানতে সারাদিন কী করল; বড় দোকান, আরো নিশ্চয় মেয়েরা আছে, ওদের সঙ্গে ওর সম্পর্ক কেমন। দুপুরে কী খায়? আরো কত কী! তবে একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খেলেও মুখে আনার সাহস পেত না। পদ্ম যদি দোকান থেকে চুরি-টুরি করে তাহলে জেলখাটা ছাড়া পথ থাকবে না – কথাটা দুদিন আগে হলে বলতে মুখে আটকাত
না। মুখে আটকানোর মতো আরো কত কথা! মারগুলো যে দিত উঠতে-বসতে, এতে তার নিজের কষ্টও কম হতো না। বলতে পারলে বুক হালকা লাগত; কিন্তু পদ্ম বিশ্বাস করবে এমন কথা? আর কথাটা কি সত্যি? মারত যখন, বিলাইর জান বলত, তখন তাকে বিলাই ভেবেই পেটাত।

বছর না ঘুরতে সংসারের চেহারা বদলে গিয়েছিল। মেহেরজানের খটকা লাগত, বেতন মোটে পাঁচ হাজার, কিন্তু খরচের সঙ্গে পাঁচ হাজারের হিসাব মেলাতে পারত না। বসিত্মতে যে ঘুপচিঘরে তারা থাকত, সেটা ছেড়ে কাছেই বড় একটা ঘর নিল পদ্ম। ফ্যানের ব্যবস্থা আগেই হয়েছিল, নতুন ঘরে খাট-জাজিম ঢুকল, চোদ্দ ইঞ্চি টিভি, এমনকি বেঁটেখাটো ফ্রিজও। সবই নাকি কিসিত্মতে। তো কিসিত্মতে হোক বা বিনা পয়সায়ই হোক, এমন পরিবর্তনে মানুষের চোখ টাটাবে জানা কথা। শুরু হলো কানাঘুষা। মেহেরজানের কানে সব না এলেও কিছু কিছু যা আসত সেসব আমলে না নিলেও নিজের মনের খটকাই তাকে সময়-অসময় খোঁচাত। পদ্মর চাকরি বুঝি নামেই, ওটা নাকি সাইনবোর্ড, রুজির আসল পথ অন্য। না হলে দুদিনে কী করে প্রিন্সেস বনে যায়! আড়ালে-আবডালে না, সামনাসামনিই বলাবলি করত – এমুন পিন্সেস থাকতে খোয়া ভাঙো!

নিজে থেকে জানতে চাওয়ার দরকার পড়ল না, পদ্মই মুখ খুলল – মাইনষ্যের কতা কানে তুলবা না। আমার যা উচিত মনে অয়, করি। মাইনষ্যের খাই না, পিন্দিও না। আমার মন যা চায় করুম। আমার ভালা আমি বুজুম, না হেরা বুজব! চিমন্তা করবা না, ভালা খবর আছে, বিদেশ যাওয়ার পথ পাইছি।

কথাটা কানে নিয়ে মেহেরজান থ হয়ে বসে থাকল। কথার কথা যে না, বলার ঢংয়ে পরিষ্কার। মাসখানেক যেতে একরাতে
ঘটনা খুলে বলতে মেহেরজান থম ধরে শুনে গেল। পদ্ম জানাল, কামাই-রুজির জন্য বিদেশ যাওয়া ছাড়া গতি নেই। অনেকদিন ধরেই নাকি পাত্তা লাগাচ্ছিল, এতদিনে যাওয়ার ব্যবস্থা প্রায় ঠিক হয়ে গেছে। যাচ্ছে সে লেবাননে, একা না, সঙ্গে আরো মেয়ে যাবে। তবে যাওয়ার পর কাজের জায়গা যার যার আলাদা। কেউ কারখানায়, কেউ হাসপাতালে, কেউ বাসাবাড়িতে। তবে বাসার কাজ মানে বাংলাদেশের চাকরানিগিরি নয়। বেবিসিটিং। কাজটা যে কী বুঝিয়ে বলে এও বলেছিল, বিদেশে এই কাজ ভালো ঘরের শিক্ষিত মেয়েরা করে। তাকে এ-কাজে নেওয়া হচ্ছে তার কপালের জোরে। কথায় কথায় পদ্ম আরো বলল, যেন বলাটা তেমন জরুরি নয়, টাকা লাগবে ম্যালা। তবে একসঙ্গে দিতে হবে না, যারা পাঠাচ্ছে তারা মাসে মাসে বেতন থেকে কেটে রাখবে। সত্য-মিথ্যা মেহেরজান কী বুঝবে! বোঝার মধ্যে এটুকু – মেয়েকে হারাচ্ছে। বিদেশে যাবে, কিন্তু টাকা-পয়সার এমন সোজাসরল ফয়সালা! তার মন বলল, পদ্ম পাচার হয়ে যাচ্ছে, নিজের ইচ্ছাতেই হচ্ছে। মানুষ যা নিয়ে কানাঘুষা করে তা তবে সত্যি। পদ্ম খানকি হয়ে গেছে। দিন কয়েক আগে সে তার ব্যাগ ঘাটতে গিয়ে রাঙতায় মোড়ানো বেশকিছু রঙিন বড়ি পেয়ে  কিসের ওষুধ জানতে চাইলে ব্যাগ হাতড়ানোর জন্য পদ্ম তেড়েমেড়ে এক চোট নিয়েছে। কিছু সময় পর গলা নরম করে বলেছে – মাথা ধরার ওষুধ, সারাদিন এসির ঠান্ডা।

তেমন তোড়জোড় ছাড়াই পদ্ম মাসতিনেক পর চলে গেল। যাওয়ার আগে মেহেরজানকে ধরে খুব কাঁদল, আর একটা খামভর্তি টাকা হাতে গছিয়ে বলল – কাম ছাইড়া দিবা, যতদিন টেকা না পাঠাইছি এই দিয়া চলবা। নিজের মোবাইলটা দিয়ে বলল – ফোন দিমু।

পদ্ম চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন ধন্ধ কাটেনি। কাজ মেহেরজান ছাড়েনি। খরচ কমাতে ছোট একটা ঘর নেওয়ার কথা চিমন্তা করছিল, আর টিভি-ফ্রিজ বেচে দেবে ভেবেছিল। মাঝে মাঝে এমনও ভাবত, অন্য কোথাও গিয়ে ঘর নেয়। পদ্ম না থাকলেও তাকে নিয়ে কথাবার্তা কানে আসত। নতুন জায়গায় গেলে এ থেকে অন্তত রেহাই পাবে, যদিও জানত তার নিজের মাথার পোকা ঠিকই কামড়াবে। কিন্তু যেই পদ্মর ফোন আসা শুরু করল, মেহেরজান অবাক হলো – সে যা ভেবেছিল তা কি সত্যি নয়? পদ্ম তবে পাচার হয়নি? এক বড়লোকের বাড়িতে নাদুসনুদুস দুইটা বাচ্চা দেখাশোনা করছে। বাচ্চাদের সঙ্গে, তাদের মায়ের সঙ্গে তার নিজের ছবি পাঠিয়েছে।

ধন্ধ কাটানো মুশকিল। তারপর যখন মাসে মাসে টাকা পাঠানো ধরল, পাঠিয়েই ফোন, যেন টাকার অভাবে তার মা না খেয়ে মরছে, মেহেরজানের মাথায় তখন অন্য পোকা – এ পদ্ম কোন পদ্ম! মায়ের সঙ্গে এক বিছানায় শুয়েও যে-কথা বলার দরকার মনে করত না, সে-ই বিদেশে পা দিয়ে সারাক্ষণ মাকে নিয়ে দুশ্চিমন্তায়! দিনে দিনে মেহেরজানেরও জড়তা কেটেছে। আগে মেয়ের সঙ্গে ভালোমন্দ কিছু বলার ইচ্ছা থাকলেও পারত না; যখন তখন চুলমুঠি পাকড়ে আছড়ানোর ঘটনাগুলো মনে পড়ামাত্র সে কুঁকড়ে যেত। সমস্যা থেকে পদ্মই তাকে বের করে আনল। তারপর যেদিন মেহেরজান পদ্মসোনা ডাকল, বুকটা হুহু করে উঠল। শুনে ওপাশে পদ্মর কী হয়েছিল বলতে পারবে না, তবে ডাকটা মেহেরজানের জ্বালাপোড়ায় মলমের কাজ দিয়েছিল। ওদিকে পদ্মও যেন হঠাৎ করে মায়ের আদর-সোহাগের কাঙাল। কোনোদিন যেসব কথা বলেনি, বলত। আইজ রান্দা কী গো মা বলে এমনভাবে ফোনের ওপাশে জবাবের অপেক্ষায় থাকত যেন মেহেরজান ভাত বেড়ে দিতে দেরি করায় তার তর সইছে না।

এবার কী ভেবে টাকা বেশি পাঠাল? অন্য এক ব্যাংকে পদ্মর আলাদা অ্যাকাউন্ট আছে, মেহেরজান জানে। সেখানে সে নিশ্চয় কিছু না কিছু জমায়। কিছু কিছু কেন, বেশি বেশিই জমানোর কথা। নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পদ্ম যদি তাই করে –  করা অবশ্যই উচিত – সেটা খুবই ভালো খবর।

ঘরে ফিরে সারাদিন ফোনের অপেক্ষায় থেকে ফোন না পেয়ে মেহেরজান টাকার চিমন্তাতেই ফিরে গেল। অন্যান্যবারের চেয়ে যে বেশি পাঠাল! সে তো বাড়তি কোনো খরচের কথা বলেনি, পদ্মও জানতে চায়নি। পদ্মর ফোন এলো আরো দুদিন পর। ব্যস্ত ছিল তাই ফোন দিতে পারেনি বলে জানতে চাইল মেহেরজান টাকা তুলেছে কি না। টাকা বেশি কেন পাঠিয়েছে এর জবাবে পদ্মর গলায় অভিমান – আমি আমার মারে টেকা বেশি পাঠামু আমার ইচ্ছা। এখন থাইকা এরমই পাইবা। তুমার শখ মিটাইয়া খরচ করবা।

মেহেরজানের মুখে কথা ফোটে না। এই পাগলিকে কী বলবে! মাকে বেশি টাকা পাঠাচ্ছে এ তার ইচ্ছা – এ কেমন যুক্তি! খাটনির রোজগার, সাবধানে আগলে রাখতে হয়। অবশ্য মেহেরজান মাথায় কিছু বুদ্ধিশুদ্ধি রাখে, টাকা বেশি পাঠালেই খরচ করে ফেলতে হবে কোন আহ্লাদে! দরকারের বেশি ব্যাংক থেকে না তুললেই হলো। তারপরও মেহেরজান না বলে পারল না, সব কামাই যদি মাকে দিয়ে দেয় তার কী থাকে? এক সুযোগে কায়দা করে কথাটা বলে ফেলে সে অপেক্ষা করল পদ্ম কী বলে। পদ্ম হাসল। আমার জইন্য একদম চিমন্তা করবা না বলে মেহেরজানের দুশ্চিমন্তাকে এক ফুঁতে উড়িয়ে দিয়ে জানাল, সে তার টাকাকড়ির ভালোই ব্যবস্থা করে রাখছে। কথা শেষ করেই বলল – সামনে বকরি ঈদে একটা ছাগল কোরবানি দিবা। কুচকুইচা কালা। পারবা না?

পদ্ম চলে যাওয়ার পর বসিত্মতে তাকে নিয়ে কথাবার্তা কানে কম আসে। তারপরও ইতর পোলাপান পথেঘাটে খোঁচায় – ও খালা পিন্সেসের খবর কী, কবে আসব? পড়শিরা তার সুখে জ্বলেপুড়ে খাক হলেও জানতে চায় – মাস-মাস কত জানি পাডায়? জয়তুনবুড়ি একমাত্র যে পদ্মর খোঁজ নিতে গিয়ে মেহেরজানকে হিংসা করে বলে মনে হয় না। ছোটবেলা পদ্মকে সে-ই দেখেছে, পদ্ম নামটাও তার দেওয়া। পদ্ম সেসব ভোলেনি। দেশে যখন চাকরি করত, প্রায়ই বুড়িকে এটা-ওটা এনে দিত। এবার পদ্ম যে এতগুলো টাকা পাঠাল, এর থেকে বুড়িকে হাজার দুয়েক দিলে পদ্ম খুশি হবে।

ঈদে ছাগল কোরবানির কথা পদ্মর মাথায় কেন এলো বুঝতে পারছে না। বসিত্মতে  কেউ কোনোদিন কোরবানি দিয়েছে মেহেরজান শোনেনি। পদ্মর টাকায় এবার সে-ই প্রথম দেবে। মানুষের চোখ টাটায়, টাটাক। অন্যের ভালো দেখতে-না-পারা মানুষের রক্তের দোষ। বড়লোক ছোটলোক এ-জায়গায় সমান।

টাকা পেয়ে জয়তুনবুড়ি কেঁদে ফেলল। সে এখন বলতে গেলে ঘরবন্দি, হাঁটাচলা তেমন করতে পারে না, শরীরে একশটা অসুখ। বুড়ি বিড়বিড় করে কতক্ষণ পদ্ম পদ্ম করল, তারপর চোখ মুছে গলা নামিয়ে বলল – আইচ্ছা ক তো পদ্ম ওইখানে কী করে? তোরে কাম ধরতে মানা করে, মাস-মাস টেকা পাডায়, ও কত রুজি করে? তোরে কী কমু, মাইনষ্যে কত কতা কয়! বুড়ি থেমে গলার সুর বদলে বলল, ভালা আছে আমাগো পদ্ম? দেখতে দেখতে কত বড় অইয়া গেল, বিদেশে একলা থাকে, কামাই করে। কী মাইর না মারতি গো! দোয়া করি ভালা থাউক। আওনের সুময় আমার লাইগা একখান পশমের কম্বল আনতে কইবি। মারপিটের কথা মনে করিয়ে দেওয়ায়, না-কি মানুষের মুখে পদ্মকে নিয়ে আকথা-কুকথা শুনেছে বলে মেহেরজানের ইচ্ছা করল বুড়ির হাত থেকে টাকাগুলো কেড়ে নেয়।

বেশ রাতে ঘরে বসে তার মনে হলো বুড়ি শুনেছে বলে বলেছে, বিশ্বাস করেছে বলেনি। সে নিজেও তো শুনেছে, আগে বেশি বেশি শুনত, এখন পদ্ম এখানে নেই বলে কম শোনে। একসময় তো এমন ছিল, সে মা হয়েও ধন্ধে ছিল। ভাবতে ভাবতে একসময় সে আনমনা হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে যা ভাবল তা তাকে চমকে দিলো। পদ্মকে নিয়ে যা শোনে সেসব যদি সত্যি হয়, হয়ই যদি, কার কী! কোন হারামির বাচ্চার কী! পদ্মর নিজের মুখের কথা মনে করে ভাবল, পদ্ম কারো খায় না, পিন্দেও না, ওর যা মন চায় করুক, তোগো কী! চমকানোর ধাক্কাটা সয়ে নিয়ে সে অন্য কথা ভাবল। দুনিয়ায় পদ্মর মতো কে আছে যে মার কথা চিমন্তা করে এমন আছাড়িপিছাড়ি করে, তাও যে মা কথায় কথায় কিল-লাথি ছাড়া কিছু বুঝত না! বুকে দুধ ছিল না বলে জন্মানোর পর মায়ের এক ফোঁটা দুধ পর্যন্ত পায়নি। চোখ ভাসিয়ে কান্না চাপতে তার ইচ্ছা জাগল, গোটা বসিত্মর লোকজনের ঘুম ছুটিয়ে চিল্লিয়ে কাঁদে। কেন কাঁদছে বলবে না। কাউকে না, কেউ জানবে না। প্রাণভরে গলা খুলে কাঁদবে। সবাই ভাববে, পদ্ম মরে গেছে। পদ্ম ছাড়া তার কে আছে যে কাঁদবে! ভাবুক, যার যেমন খুশি ভাবুক। কেবল সে জানবে পদ্ম ওরফে পার্লি মরবে কোন দুঃখে, তার মা আছে না? যেমন পদ্ম তাকে বলে, বলেছিল, আমি আছি না?