মোবারক হোসনে খান শিল্পসাহিত্যের বরেন্যজন

মোবারক হোসেন খানের জন্ম ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮ এবং মৃত্যু ২৪ নভেম্বর ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ। বর্ণাঢ্য ও সৃষ্টিশীল জীবনকর্ম রেখে পরিণত বয়সেই হয়েছে তাঁর পরকালযাত্রা। তাঁর জন্মভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। লেখাপড়া কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ইতিহাসের ছাত্র। তাঁর সময়ে অনেক মেধাবী ছাত্র ইতিহাস বিষয়ে অধ্যয়নশেষে সরকারি-বেসরকারি উচ্চপদে চাকরি করতেন। মোবারক হোসেন খানও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনি বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক, শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক, নজরুল ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগীত বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
মোবারক হোসেন খান বিশ্ববিখ্যাত সংগীতসাধক পরিবারে বেড়ে ওঠেন। তাঁর পিতা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, চাচা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তাঁর ভাইবোনেরাও ছোটবেলা থেকে সংগীতশিক্ষায় মনোযোগী ছিলেন। মোবারকও প্রচলিত পথ ধরেই এগোতে চেয়েছিলেন। তাঁর মনেপ্রাণে ছিল সুরের দোলা। তিনি বলেন, ‘গানের সুর প্রতিদিন সকাল আর সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে ধ্বনিত হয়। সুরের সাথে একাত্মতা তাই ছোটবেলা থেকেই। … ছোটবেলায় গান গাইতাম। কিন্তু বাবার প্রভাবেই হয়তো একসময় সুরবাহার বাজানোর সাধ জাগে। স্কুলে একজন প্রিয় স্যার ছিলেন ইসমাইল স্যার। মাঝে মাঝে তিনি আমাদের কবিতা সুর করে গাইতে বলতেন। তার সাথে বিশেষ তোফাও থাকতো। যে ছাত্র সুর করে গাইতে পারবে সেদিন সে ছাত্র ক্লাস শেষ হবার আগেই ছুটি পেতো। এই প্রতিযোগিতাটা আমি খুব উপভোগ করতাম। প্রায়ই আগেভাগে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। কৈশোরে সে আনন্দ আমাকে সুরের আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল।’ (সুরে সুরে পথ চলা)
মোবারক হোসেনের ভাইবোনদের গান-বাজনা করতে গিয়ে লেখাপড়া ছাড়তে হয়েছে। তাঁর মেজোভাই ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান। ছোটভাই শেখ সাদী খান এবং ছোটবোন মমতা খানম মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ছিলেন। মোবারক খানের স্ত্রী কণ্ঠশিল্পী ফওজিয়া খান। মেয়ে রিনাত ফৌজিয়া খানও শিল্পী-অধ্যাপক। আগেই বলেছি, পারিবারিক ঐতিহ্যানুযায়ী মোবারক খান সংগীতসাধনায় নিবিষ্ট হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা ওস্তাদ আয়েত আলী খান তাঁর অন্য ছেলেমেয়েদের মতো মোবারকের লেখাপড়ায় ছেদ পড়তে দেননি। বাবার কথামতো তিনি এমএ পাশ করে বাংলাদেশ বেতারে চাকরি নেন। চাকরিতে প্রবেশের পূর্বে তিনি বেতারে সুরবাহার বাজাতেন। তার আগে বাবার তৈরি বিশেষ সংগীতযন্ত্র ‘মন্দ্রনাথ’ ও ‘চন্দ্রসারং’ রেডিওতে বাজিয়েছেন। তৎকালীন সরকারি চাকরির বিধি অনুযায়ী সে-চর্চাতেও বাধা পড়ে। বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ তখন বেতারে অনুষ্ঠান প্রচারের সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন, নিজেরা শিল্পী হিসেবে অংশ নিতে পারতেন না। তবে ত্রিশ বছরে বেতার চাকরিজীবনে তিনি বহু শিল্পী গড়েছেন, অসংখ্য মানুষের সাহচর্যে এসেছেন। এ-প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বেতারের চাকরি করার লাভ হলো বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ। শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে মুটে-মজুর আর চাষী ভাইদের সাথে এখানে মেলামেশার সুযোগ পাওয়া যায়। এভাবেই বাণিজ্যিক কার্যক্রমে থাকার সময়টা আমার কাছে খুব স্মৃতিময় হয়ে উঠেছিল। এখানে আমার অবস্থানকালে গান নিয়ে আসতেন রাহাত খান। তাঁর কিছু গান আমি নিজেও সুর দিয়েছি’। (আমার স্মৃতি)
সুরবাহার যন্ত্রের সুরের প্রতি মোবারক হোসেন খানের বিশেষ অনুরাগ ছিল। বেতারের চাকরি থেকে অবসরগ্রহণের পর তিনি চলচ্চিত্রে ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের উচ্চাঙ্গসংগীত অনুষ্ঠান ‘সুরলহরী’তে সুরবাহার পরিবেশন করেন। তবে তাঁর সার্বিক জীবনে এসব গৌণ কাজ, মৌল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সংগীতবিষয়ক শাস্ত্রীয় গবেষণা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা, সংগীতজ্ঞদের জীবনীগ্রন্থ প্রণয়ন, বিপুলসংখ্যক বিশ্বসাহিত্য বাংলায় অনুবাদ, গল্প-উপন্যাস নির্মাণ এবং শিশুতোষ সাহিত্য রচনা। এগুলো তাঁর শ্রমনিষ্ঠ সাধনা ও অবিচল ইচ্ছাশক্তির ফল। সংগীতবিষয়ক লেখালেখি সম্পর্কে মোবারক হোসেন খান বলেন, ‘চাকরিজীবনে যখন রেয়াজ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি, তখন সংগীত গবেষণায় মনোনিবেশ করি। সংগীত নিয়ে পড়াশোনা করেছি প্রচুর। লেখালেখি শুরু ছাত্রজীবন থেকে। এবার সংগীতকে উপজীব্য করে নিয়মিত লিখতে শুরু করলাম। এভাবে সংগীত গবেষক হিসেবে একটা পরিচিতি এসে যায়। প্রথমে আমাদের সংগীত পরিবারের ইতিহাস লেখা শুরু করি। পরে সংগীতের তত্ত্বীয় এবং ব্যবহারিক বিষয়গুলো নিয়েও লেখা শুরু করি। … আমার লেখা বইয়ের সংখ্যা একশ ছাড়িয়ে গেল এক সময়। সংগীত মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেগুলো পঠিত হয়।’ (ওস্তাদ নই আমি)
মোবারক হোসেন খান নিজ পরিবারের সংগীতচর্চার ঐতিহ্য ও পূর্ণাঙ্গ চালচিত্র তুলে ধরেন। রচনা করেন বাবা ওস্তাদ আয়েত আলী খান ও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জীবনীগ্রন্থ এবং নিজের আত্মজীবনী। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ইতিহাস, নির্মাণকৌশল, বাজানোর নিয়মকানুন সম্পর্কিত তাঁর একাধিক গ্রন্থ রয়েছে। এজাতীয় গ্রন্থ তিনি শিশুদের উপযোগী করেও লিখেছেন। যেমন, সুর নিয়ে যার খেলা (১৯৮১)। তিনি সংগীতসাধক অভিধানও প্রণয়ন করেন, যা শ্রমসাধ্য ও অতিপ্রয়োজনীয় কাজ হিসেবে স্বীকৃত।
জীবনের প্রথম লেখা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জীবনী সম্পর্কে মোবারক হোসেন খান উল্লেখ করেন, ‘কুমিল্লা জিলা স্কুলের বার্ষিক সাহিত্য ম্যাগাজিন বেরুবে। তার জন্য আমাকে একটা লেখা দেয়ার হুকুম দিলেন আলী আহমেদ স্যার। তাঁকে যমের মতো ভয় করি। মুখের ওপর মানা করতে পারলাম না যে আমার কলম দিয়ে পরীক্ষার লেখা ছাড়া আর কোনো লেখা আসে না। এক সপ্তাহ কেটে গেল। অনেক চেষ্টা করেও এক লাইন লেখাও বেরুলো না। স্যার ডেকে পাঠালেন। বলির পাঁঠার মতো তাঁর সামনে হাজির হলাম। … তিনি বজ্রগম্ভীর স্বরে বললেন, ‘কিরে লেখা তৈরি হলো?’ অনেক সাহস সঞ্চয় করে জবাব দিলাম ‘স্যার লিখতে চেষ্টা করেছি কিন্তু লিখতে গেলেই সব ‘রচনা’ হয়ে যায়। ‘রচনা’ তো স্যার রচনা বইয়ে আছে। বার্ষিক সাহিত্য ম্যাগাজিনে কি সে রচনা ছাপা যাবে?’ আমার কথা শেষ হতে না হতেই তিনি হুংকার ছাড়লেন। আমার সারা শরীর কেঁপে উঠল। বললেন, ‘তোকে রচনা লিখতে কে বলেছে, বুরবক কোথাকার। তুই তোর চাচা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জীবনী লিখবি। এক সপ্তাহ সময় দিলাম। এই সময়ের মধ্যে লেখা চাই।’ অগত্যা কাগজ-কলম নিয়ে বসতে হলো। লিখলামও একটা রচনা। আলাউদ্দিন খাঁর জীবনীমূলক রচনা। যেমনটি রচনা বইয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী বা কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী। লেখাটা শেষ পর্যন্ত স্কুলের সাহিত্য ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। আর সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম লেখা।’
বলা যায়, ১৯৫০-৫১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মোবারক হোসেন খান লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন। কুমিল্লা থেকে মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি আমোদ পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি মোবারক হোসেন খানকে লেখার দায়িত্ব দিলেন। এ-প্রসঙ্গে মোবারক হোসেন খান লেখেন, ‘অভ্যাস নেই, জানা নেই, আনাড়ি বললেও অত্যুক্তি হয় না। এ অবস্থায় লেখা যখন শুরু করলাম, দেখলাম হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে গেছি। লিখতে গেলে পড়তে হয়, পড়তে গেলে দুরন্তপনার সময় কম পাওয়া যায়। ফলে আমার স্বভাবে পরিবর্তন আসতে লাগল, আমি অবাক হয়ে গেলাম। লেখার কি অদ্ভুত গুণ। মানুষের চরিত্রের উপর তার কি প্রভাব। আর সে দিন ‘আমোদ’ পত্রিকায় নিয়মিত না লিখলে সত্যি কি আজ সাহিত্যিক হিসাবে পরিচয় লাভ করতে পারতাম।’
প্রথমদিকে মোবারক হোসেন খান নামে-ছদ্মনামে লিখতেন গল্প-উপন্যাস। তাঁর দুটি গোয়েন্দা ধাঁচের উপন্যাস আছে – আগন্তুক (১৯৮৭) ও হত্যাকারী (১৯৮৭)। উপন্যাসের পথে তিনি বেশি না হাঁটলেও গল্পের প্রতি তাঁর আগ্রহ থেকেই যায়। তবে সংগীত-গবেষণা, জীবনী রচনা ও অনুবাদকর্মে তিনি অধিক মনোযোগী হয়েছেন। তিনি বাংলা-ইংরেজি উভয় ভাষায় লিখতেন। বিদগ্ধজনের জন্যে তাঁর যা লেখা, তার অনেকটাই আবার শিশুদের উপযোগী করে রচনা করেন।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও তাঁর পত্রাবলি (১৯৮৩), Ustad Alauddin Khan : The Legend in Music (২০০২), সংগীত গুণীজন (১৯৮৬), ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ (১৯৮৭), স্মৃতিকথা : জীবনস্মৃতি (১৯৯৮), আমার সংগীত স্বজন (২০০৪) প্রভৃতি গ্রন্থে নিজ পারিবারিক সংগীতের ঐতিহ্য-সাধনা এবং এ-উপমহাদেশের সংগীত-ইতিহাসের বিস্তৃত চালচিত্র হয়েছে বর্ণিত।
সংগীতের সব মনীষীই নিরন্তর সুরসাধানার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। চাচা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সম্পর্কে মোবারক হোসেন বলেন, ‘আমার পিতৃব্য ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে একবার প্রশ্ন রেখেছিলাম, সারা জীবন সংগীতের সাধনা করে কি তিনি সুরদেবীর নাগাল পেয়েছেন? আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘আমি সাধনা করেছি। সিদ্ধি লাভ করতে পারি নি। সুরকে সারাজীবন ধরে খুঁজেছি, খোঁজার পথই হলো সাধনা। সুরকে খুঁজতে গিয়ে সাধনা করে গেলাম। আল্লাহর দুনিয়াতে যদি তিনশ বছর বাঁচতাম, তাহলে সাধনা করেই যেতাম’।’
মোবারক হোসেন খানের সংগীত প্রসঙ্গ (১৯৮০), বাদ্যযন্ত্র প্রসঙ্গ (১৯৮২), রাগ সংগীত (১৯৮৫), যন্ত্রসাধন (১৯৮৬), কণ্ঠসাধন (১৯৮৯), সংগীত দর্পণ (১৯৯৯) ইত্যাদি গ্রন্থে সংগীতের নানা রাগ-রাগিণী, সুরবৈচিত্র্য, বাদ্যযন্ত্রের উৎপত্তি, নির্মাণকৌশল ও বিকাশসাধন আলোচিত হয়েছে। প্রাসঙ্গিতভাবে স্থান পেয়েছে উল্লিখিত ক্ষেত্রে তাঁর বাবা-চাচার অবদান। আত্মজীবনীমূলক রচনায় মোবারক হোসেন খান বলেন, ‘তিনি (বাবা) শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতীতে যন্ত্র-সঙ্গীত বিভাগের প্রধান ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আমার বাবাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। বাবার শিক্ষাদান পদ্ধতি দেখে তিনি চমৎকৃত হয়েছিলেন।’ ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর বাদ্যযন্ত্রের একটা কারখানা ছিল। তিনি বহু বাদ্যযন্ত্র নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ কিংবা রূপান্তর করেছেন। মোবারক হোসেন খান ছবিসহ সেসব বাদ্যযন্ত্রের বিবরণ উপস্থাপন করেন। যেমন –
১. এসরাজ একটি সুমিষ্ট সুরের যন্ত্র। এসরাজের সুর বেশ করুণ ও হৃদয়গ্রাহী। … এসরাজ কাঠের তৈরি। এসরাজের দুটো অঙ্গ। উপরের অঙ্গ দ-। নিচের অঙ্গ খোল। একটা নিরেট কাষ্ঠ টুকরো খোদাই করে খোল প্রস্তুত করা হয়। … খোলের উপর আচ্ছাদিত ছাউনির বুকে
হাড়-নির্মিত সওয়ারী স্থাপন করা হয়। প্রধান তারগুলো সওয়ারীর উপর দিয়ে প্রসারিত। … এসরাজের মূল বা নায়কী তারটি লোহার। বাকি তিনটি তার পিতলের। … বাঁ হাতের তর্জনী ও মধ্যমার সাহায্যে তারটিকে পর্দার সাথে চেপে ছড় দিয়ে এসরাজ বাজানোর নিয়ম।
২. এসরাজ যন্ত্রটির সংস্কার সাধন করে আরেকটি নতুন যন্ত্র উদ্ভাবন করা হয়। সুরের মাধুর্যের জন্য এই নতুন যন্ত্রটির নামকরণ করা হয় মনোহর। যে যন্ত্রের সুর মন হরণ করে নেয় সেই মনোহরা বাদ্যযন্ত্রটির আবিষ্কর্তা সংগীত সাধক ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ।
৩. দোতারা বাংলাদেশের একটি প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র। দোতারাতে সাধারণত চারটি তার ব্যবহৃত হয়। দোতারা নামের সঙ্গে তার সংযোজনের কোনো সংগতি নেই। কোনো কোনো যন্ত্রী আজকাল দোতারাতে পাঁচটি তারও ব্যবহার করে থাকেন। সুরের রেশ বা ঝঙ্কারের জন্য পঞ্চম তারটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। … দোতারা গানের অনুগামী যন্ত্র হিসাবেও ব্যবহৃত হয়, আবার একক বাদনও প্রচলিত। বিশেষ করে বাঁশি ও দোতারার দ্বৈত বাদন খুবই শ্রুতিমধুর। দোতারা পল্লীগানের প্রাণস্বরূপ।
ছোটদের জন্যেও মোবারক হোসেন খান সংগীতবিষয়ক গ্রন্থ লিখেছেন – সুর নিয়ে যার খেলা (১৯৮১), ছোটদের ওস্তাদ আলাউদ্দিন (১৯৮৩), ছোটদের সারেগামা ও সংগীতবিদ্যা (২০০২) প্রভৃতি।
শিশু-কিশোরদের পরিচিত করার জন্যে তিনি প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী-ওস্তাদদের ছবি, বাদ্যযন্ত্র ও বাদনকালে তা ধরার নিয়ম সচিত্র সংযুক্ত করেছেন সুর নিয়ে যার খেলা গ্রন্থে। কানাইলাল শীল, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, ওস্তাদ ফুলঝুরি খাঁ প্রমুখের ছবি কৌতূহলী সংগীতানুরাগীদের দুর্লভ প্রাপ্তি। গ্রন্থকারের সাবলীল ভাষায় চমৎকার সব বর্ণনা – ‘আনন্দ-উৎসব মুখরিত মেলা। একপাশে একটা গোল চত্বরে একজন পল্লী-গায়ককে ঘিরে রেখেছিল ছেলে-বুড়োর দল। পল্লী-গায়কের কাঁধে ঝোলানো ছোট একটা বাদ্যযন্ত্র। দেখতে বেশ সুন্দর। ডান হাতে ছড় দিয়ে যন্ত্রের তারে টান দিলেই বেরিয়ে আসে সুন্দর সুরের আওয়াজ। … সেই যন্ত্রটির নাম ‘সারিন্দা’।’
মোবারক হোসেন খান কাজী নজরুল ইসলামের গান নিয়েও কাজ করেছেন। নজরুলের গানসম্পর্কিত দুটি গ্রন্থ – নজরুল সংগীতের বিচিত্র ধারা (২০০৫) এবং প্রসঙ্গ নজরুল সংগীত (২০০৬)। এছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধের গান (১৯৯৯), ছড়াগান (১৯৯১) ও দেশের গান (২০০৬)-এর সংকলন প্রকাশ করেন।
সংগীত সংক্রান্ত নিবন্ধ-প্রবন্ধ-গবেষণা তথা লেখা-চর্চা-সাধনা ছাড়াও মোবারক হোসেন খান ইতিহাস, বিজ্ঞান, রূপকথা ও লোককথা বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করে পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন। মোঘল সম্রাট (১৯৮২), সম্রাট আকবর (১৯৮৫), চন্দ্রাভিযান (১৯৮৬), বিজ্ঞানের রহস্য (১৯৯০), রূপকথার রাজ্যে (২০০০), এশিয়ার লোককাহিনী (১৯৮৮) – এরকম বহু গ্রন্থের সার্থক রচয়িতা মোবারক হোসেন খান।
ইতিপূর্বে মোবারক হোসেন খানের ছোটদের সংগীতগ্রন্থ রচনার কথা বলেছি। শিশুতোষ সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর সুনামসঞ্চয় কম নয়। রিমির কথামালা (১৯৮২), গ্রামবাংলার মজার গল্প (২০০১) প্রভৃতি গ্রন্থ তার প্রমাণ। দু-একটি গ্রন্থ থেকে সামান্য দৃষ্টান্ত – যেখানে সাবলীল ভাষায় বর্ণিত হয়েছে গল্পের গাঁথুনি :
১. অনেক-অনেক দিন আগের কথা। সূর্য তার রথে চড়ে সারাদিন ধরে নীল আকাশে ঘুরে বেড়ায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে পূর্ব দিক থেকে ঘুরতে শুরু করে এবং সন্ধ্যা হলে ক্লান্ত দেহখানা নিয়ে পশ্চিম দিকের সমুদ্রে ডুব দেয়। সারাদিন তার কত কাজ। মানুষ, গাছপালা, জীবজন্তু, পাখণ্ডপাখালি থেকে শুরু করে সব রকম প্রাণীর জন্য আলো দরকার। আলো ছাড়া তারা বাঁচতে পারে না। দিনের বেলায় তার মোটেই সময় নেই। তাই সারাদিনের খাটুনির পর বিশ্রামের দরকার। ঘুমের দরকার। রাতের বেলা সূর্য ঘুমাতে যায়। সূর্যের এক ছেলে। তার নাম পেইবালকে-কিরণ। ছোটবেলা থেকে বাবার সাথে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সে বেশ বড় হয়ে উঠেছে। একদিন বাবাকে সে বললো, ‘বাবা, আমার তো বিয়ের সময় হয়ে এলো’। তা ঠিক, ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে, সূর্য ভাবলো। বাবা বললো, ‘পছন্দমতো কোনো কনের খোঁজ পেয়েছ?’ ‘না বাবা, পাইনি। আমার সোনালী জুতো জোড়া পৃথিবীর কোনো কনের পায়ে লাগে না। … আমাকে আকাশেই কোনো কনের খোঁজ করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।’ … সূর্য ঠিক করলো, চন্দ্রকে তার মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করবে। (চাঁদের কন্যা সূর্যের পুত্র)
২. ধোপা খপ্ করে শিয়ালের লেজটা ধরে বললো, ‘শয়তান’ তুমিই আমার মুরগীগুলো রোজ রোজ সাবাড় করছো। তাই না? বেশ, আজ তোমাকে মজা দেখাচ্ছি।’ ধোপা শিয়ালের লেজ ধরে কাপড় আছাড় মারার মতো পাথরের উপর আছাড় মেরে বললো, ‘আর কোনোদিন খাবি, বল্ শয়তান?’
মোবারক হোসেন খানের গল্প, উপন্যাস, বিজ্ঞান ইতিহাস, রূপকথা, শিশুতোষ রচনা অপ্রতুল নয়। তথাপি তাঁর প্রধান সৃজনসাধনা সংগীত ও অনুবাদসাহিত্য। এ-দুটি শাখাতেই তিনি আমৃত্যু কাজ করে সাফল্যের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধকরণের জন্যে বিদেশি ভাষার সাহিত্য অনূদিত হওয়া আবশ্যক। নিজেকে পরিপূর্ণভাবে জানার আগে অন্যকে জানা দরকার। তার আলোকেই নিজের অবস্থান নির্ধারণ ও মূল্যায়ন করতে হবে। এভাবেই উন্নয়নের জয়যাত্রাকে সুগম করা যাবে। মোবারক হোসেন খান তাই বলেন, ‘বিশ্বসাহিত্যকে অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের জগতে পরিচয় করার লক্ষ্যে একদিন অতি উৎসাহে অনুবাদের কাজ শুরু করি। আমার স্বপ্ন বিশ্বসাহিত্যকে জয় করবো। হয়তো জয় করতে পারি নি, তাই বলে পরাজিত হই নি। আসলে ইচ্ছাশক্তি প্রবল থাকলে কোনো কাজই অসম্ভব হয় না। অনুবাদকের কাজ যখন শুরু করি তখন পারা-না-পারার একটা দ্বন্দ্ব ছিল না। কিন্তু শুরু করার পর সব দ্বন্দ্ব অন্তর্হিত হয়ে যায়। আমি অনুবাদের কাজে ব্রতী হলাম। জীবন তো সীমিত। তার মাঝে যতদূর সম্ভব অনুবাদ সাহিত্যকর্মে নিজেকে নিয়োজিত রাখার সচেষ্ট প্রয়াস আমার সাহিত্যজীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্যভুবনে আমার পরিচয়ের পরিসরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি আমার কথা নয়। যাঁরা আমার অনূদিত বই পড়েছেন তাঁদের কথারই প্রতিধ্বনি’।
অনুবাদক কবীর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মমতাজউদ্দীন আহমেদের অবদান স্মরণে রেখেও বলতে হয়, মোবারক হোসেন খানের অনুবাদ স্বতন্ত্র, অস্পষ্ট কিংবা অনস্বীকার্য নয়। তিনি সাধারণত ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেন। আক্ষরিক অনুবাদ নয়। আবার পুরোপুরি রূপান্তরও নয়। অনুবাদের জন্যে গ্রন্থ নির্বাচনের ক্ষেত্রে মোবারক নিজ দেশকাল-সচেতন। চিরন্তন বিশ্বসাহিত্যের প্রতি তাঁর ঝোঁক বেশি পরিলক্ষিত হলেও যে-গ্রন্থ আমাদের নাড়াতে পারে, বাড়াতে পারে – সেসব গ্রন্থই নির্বাচন করেন। সে-ক্ষেত্রে তাঁর সামাজিক ও দৈশিক দায়বদ্ধতা কম নয়, সাহিত্যপ্রীতি এবং সমৃদ্ধি সাধনের লক্ষ্য তো আছেই। মোবারক হোসেন খানের প্রথম প্রকাশিত অনূদিত গ্রন্থ আইভনভ মুক্তধারা কর্তৃক প্রকাশিত। চার অংকবিশিষ্ট আইভনভ নাটকের একটি চরিত্রের সংলাপ, অংশবিশেষ –
না, ঘ্যানঘ্যানানী নয়। ঠাট্টা। হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, আমি তোমাকে ঠাট্টা করছি। আমি যদি নিজেকে হাজার বার খুব নির্মম ভাবে ঠাট্টা করতে পারতাম আর সমস্ত পৃথিবীকে যদি আমার প্রতি বিদ্রƒপ করাতে পারতাম তাহলে আমি তাই করতাম। আমার প্রতিবিম্ব দেখেছি – আমার বিবেকের মধ্যে ঠিক যেন একটা গোলা বিদীর্ণ হলো। আমি নিজেকে ধিক্কার দিলাম এবং লজ্জায় আমি প্রায় মাটিতে মিশে গেলাম।
আন্তন চেখভের তিন তরঙ্গ (১৯৮৩) শিরোনামে আরেকটি একাঙ্ক নাট্যগ্রন্থ তিনি অনুবাদ করেন। একাঙ্ক নাটক তিনটির বাংলা নাম – প্রস্তাব, ভল্লুক ও জয়ন্তী। এগুলো কৌতুক-একাঙ্কিকা। প্রস্তাব একাঙ্কিকা থেকে সংলাপের সামান্য দৃষ্টান্ত :
নাতালিয়া : প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো? আমার কাছে? আমাকে আগে বলো নি কেন বাবা?
চুবুকভ : আর সেজন্যেই তো সে অমন ফুলবাবু সেজে এসেছিলো। নচ্ছার! নীচ্ !
নাতালিয়া : আমার কাছে? প্রস্তাব? ওহ্! তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। তাকে আসতে বলো। জলদি তাকে ফিরিয়ে আনো। … আমি মুর্চ্ছা যাচ্ছি। …
চুবুকভ : দুত্তোর মেয়ে, অত বেহায়ার মত বিলাপ করিস না।
মোবারক হোসেন খানের প্রচুর অনুবাদকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি – নোবেল বিজয়ীদের নির্বাচিত গল্প, বিশ্বের অনন্য গল্প, আফ্রিকার নির্বাচিত গল্প, পৃথিবীর সেরা গল্প, বিশ্বনন্দিত গল্প, বারো দেশের একডজন গল্প, শেক্সপীয়রের রোমান্টিক কমেডি, শ্রেষ্ঠ থ্রিলার কাহিনী, উপমহাদেশের নির্বাচিত গল্প, নোবেল পুলিৎজার ও বুকার বিজয়ীদের শ্রেষ্ঠ গল্প প্রভৃতি। তালিকা নির্দেশ করে ছোটগল্প অনুবাদের দিকেই অনুবাদকের ঝোঁক বেশি। তাঁর বিশেষভাবে স্মরণীয় কটি অনুবাদ গল্প – সমারসেট মমের ‘অঘটনপটীয়সী’, জেমস জয়েসের ‘অনুরাগ’, ও হেনরির ‘দুই বান্ধবীর ঘরকন্না’, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘ইসাবেনার স্বগতোক্তি’, আলবার্তো মোরাভিয়ার ‘বংশবাদ বিড়ম্বনা’, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘সংগ্রামী’, ও’ ফ্লেহার্টির ‘মুক্তিযোদ্ধার মুখ’।
আয়ারল্যান্ডের লেখক নিয়াম ও’ ফ্লেহার্টির প্রসিদ্ধ উপন্যাস দ্য ইনফরমার। তাঁর ‘দ্য স্ন­াইপার’ গল্পের অনুবাদ করেন মোবারক হোসেন খান – ‘মুক্তিযোদ্ধার মুখ’। গল্পটি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দুই বিরোধী যোদ্ধার যুদ্ধকাহিনি। একজনের গুলিতে আরেকজন নিহত হয়। বিজয়ী যোদ্ধার অভিব্যক্তি – ‘রাস্তার উপর পা দিতেই স্নাইপার তরুণের মনে মৃত মুক্তিযোদ্ধার মুখটা একবার দেখে যাবার কৌতূহল হলো। দুশমন যে-ই হোক না কেন লোকটা তুখোড় লক্ষ্যভেদী ছিল তাতে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। হয়তো মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার আগে তার কোম্পানির একজন সৈনিক ছিল। ঝুঁকি নিয়ে হলেও একবার লোকটার মুখ দেখে যাবে বলে সে ঠিক করলো। ও কোনেলী রাস্তার এপাশ-ওপাশ উঁকি মেরে ভালো করে দেখে নিল। দূরে কোথাও গুলিগালাজ হচ্ছে। তবে এদিকটা শান্ত। স্নাইপার তরুণ একদৌড়ে রাস্তাটা পার হয়ে গেল। … পাশের লাশটাকে হাত দিয়ে ঠেলে চিৎ করে শুইয়ে দিলো। লাশটার মুখের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো – দেখতে পেলো, সে আর কেউ নয়, তারই আপন ভাই।’
মোবারক হোসেন খান ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভা ও কর্মগুণে ঋদ্ধ। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ছাড়াও বহু প্রাতিষ্ঠানিক পদক-সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হন। আমরা সদ্যপ্রয়াত এই বিদগ্ধজনের প্রতি জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য।