যদি কেউ যায়

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

মৃত্যুতে তাঁর ভয় ছিল না। কোনো এককালে শোনা কথা তাঁর কানে বাজতো – ‘ওহে মৃত্যু তুমি মোরে কি দেখাও ভয়, ও ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়।’ কিন্তু ভয় না-করে তাঁর উপায়ও ছিল না। দূর দিগন্তের কোণে লাল রং যে কেবল সূর্যের ডুবে যাওয়া কি উঠে আসা নয় এমন বোধ স্পষ্ট হলে উদ্বেগ গ্রাস করে। আর সবাই যখন আগুনের অাঁচ থেকে সরে দূরে চলে যায়, তখন তাঁকেও ভাবতে হয়। আগুন কেবল ঘর পোড়ায় না জীবন নাশও করে।

তবুও পরপারে যাবার ইচ্ছে তাঁর ছিল না। সীমানার ওপারেও নয়, জীবনের ওপারেও নয়। এমনি যাওয়া না-যাওয়ার ভাবনায় দীর্ঘকাল কেটেছিল তাঁর।

 

দুই

তাঁর পিতা যেদিন গৃহত্যাগ করেছিলেন সেদিনও বৃষ্টি ছিল। প্রচন্ড বর্ষণে ভেসে যাওয়া মাঠ ও শস্যক্ষেত্র কেবল সমুদ্রের আভাস দিচ্ছিল। অবশ্য গর্জন ও ঢেউ ছিল না। বৃক্ষরাজিও অমনি ভেসেছিল, জনপদের মতোই, এবং বড়ঘরের চালায় বসে কদিন কাটানো যায় এই ভেবে একদিন বিরক্ত হয়ে তিনি চালা থেকে নেমে চলে যান। তাঁর চলে যাওয়া পথের দিকে মাতা অনেককাল তাকিয়ে ছিলেন, ধুলো ওড়া সড়ক পর্যন্ত এবং সেটি পার হয়ে অনেক দূর বন্দরের আবছা সীমানা যেখানে, সেদিকেও।

পিতা সন্ন্যাসী ছিলেন না। মাটি টাকা, টাকা মাটি – এই বলে দুটিকেই ছুড়ে ফেলে দেওয়ার মানুষ তিনি ছিলেন না। সিন্দুকভরা তেজারতির মাল দেখলেই তা বোঝা যেত। তবুও তাঁকে যে যেতেই হয়েছিল, না-গিয়ে উপায় ছিল না বলেই।

এতোকাল পরে আবার তেমনি বৃষ্টি নামলে পুরনো দিনের কথা তাঁর মনে পড়ছিল। পূর্ণ দিনের বর্ষণের পরে তাঁর মনে হয়েছিল এই প্রপাত যদি না-থামে। শিহরিত তিনি দেখেছিলেন, ক্রমে পুকুরের সব মাছ দিব্যি হেঁটে নদীর দিকে চলে যাচ্ছে এবং পুকুর ও নদীর মধ্যবর্তী সবুজ রং পাল্টানোর জন্যে প্রস্ত্তত। যদি বৃষ্টি না-থামে এই কথা ভাববার পরেই আকাশ আরো অন্ধকার হয়েছিল এবং তিন সুখী শৃগাল ও সর্পরাজ ভিন্ন ডাঙার দিকে চলে গেলে তিনি তালগাছের শীর্ষে কোনো বাবুই দেখেননি। যদি বৃষ্টি না-থামে এই কথা আবার ভাবলে গৃহতক্ষক তিনবার শব্দও করেনি। তখন তাঁর চলে না-গিয়ে কি উপায় ছিল?

সুজানগর থেকে তিন পালের তিন নৌকায় তাঁর পিতার জিনিস এসেছিল। বড় বড় তিনটি কাঠের সিন্দুকে কী কী ছিল কেউ জানত না। এক এক সিন্দুক এক এক নৌকায় দিয়েছিলেন পিতা। তিন সিন্দুক কেন, এর জবাবে নিশ্চয়ই ‘তিন পুরুষের জন্যে’ এ-কথা বলাই যেতো। কিন্তু তিনি নিজে কখনোই তাঁর সিন্দুকটি পাননি।

প্লাবনভূমির ওপর দিয়ে তাঁর পিতা হেঁটে চলে গিয়েছিলেন। জলপৃষ্ঠে পদযাত্রা কি সম্ভব – এ-প্রশ্ন কেউ কখনো করেনি, বরং তিনি যেদিকে চলে যান সেই দিকে, ঠিক মাঝখানে, বিশাল অগ্নিগোলক সকলেই দেখেছিল। ওই অগ্নিগোলকে তাঁর ছায়া থাকতে পারে না, কারণ যাদের বন্ধকি গহনায় তাঁর সিন্দুক ভারী ছিল, তারা অমন কোনো ছায়া দেখেনি।

অনেকে বলে, সুজানগর নয়, বেলকুচি থেকে মাত্র একটি সিন্দুক এসেছিল লেপতোষক ও হাঁড়িকুড়িতে বোঝাই হয়ে, এইটিই বরং বিশ্বাসযোগ্য। কাঁসাপিতল ছিল নিঃসন্দেহে, না হলে বছরে দু-দশবার চটের থলিটিতে কী ভরে নিয়ে যেতেন তিনি বাসনের দোকানে, আর কেউ না জানলেও তিনি তো জানতেন। তাঁর ভগিনীদ্বয় ‘ভাত খাওনের দুইটা থালও পাইলাম না’ বলে ক্ষীণ বিলাপ করলে তিনি কখনো বাদী ছিলেন না। অগ্নীশ্বর কী প্রকারে অমন কাঠকুটোর পুতুল বানিয়েছিলেন নিঃশব্দে ভাবলেও মুখে কখনো কাউকে বলেননি।

তিন

‘যদি বৃষ্টি না থামে’, এই চিন্তা তাঁর পিতার মাথায়ই প্রথম এসেছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু মনে হয় তিনিই স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে থাকতে প্রথম অমন চিন্তা করেছিলেন। তিনি বারান্দায়ই তাঁর কাষ্ঠাসনে বসা। আসনের পশ্চাদ্ভাগ টিনের বেড়ার সঙ্গে ঠেকানো। সদর রাস্তা দেখা যেতো ওই বারান্দায় বসলে। সদর রাস্তা থেকে নৌকাটি মোড় নিয়ে পাড়ার রাস্তায় এসেছিল এবং পরে উঠানে। ছোট ছোট ঢেউ ছলাৎ-ছলাৎ করে বারান্দার ওপরেই উঠে আসে বুঝি-বা। বন্দরও তখন জলপ্রপাতাক্রান্ত এবং স্বয়ং চিকিৎসকই চিকিৎসাকাঙ্ক্ষী, এই খবর দিয়ে নৌকাসহ দূত চলে যায়। তখন আবার বড়ো বড়ো ফোঁটা, দূতপ্রবরের সর্বাঙ্গে, তার নৌকার গলুইয়ে এবং তার পাশের একরকম মেটে-নীল তরল জাজিমে দ্রুত পড়তে থাকে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারায়, তখনই বুঝি তাঁর মনে এসেছিল ‘যদি বৃষ্টি না থামে।’ এর জন্যে যথেষ্ট খেসারত দিতে হয়েছিল।

স্ত্রী, এক পুত্র ও কন্যাকে মাত্র পনেরো দিনের সময়কালে হারিয়েছিলেন তিনি। ওইরকমই হওয়ার কথা ছিল। কেননা, মাত্র দুদিন আগে গরুর গাড়ি চলার পথটি যখন সদ্য নৌ-পরিবহনের উপযুক্ত হয়ে উঠেছে, তখনই বৃষ্টির তোড়ের মুখে মায়ের নামে  স্থাপিত ‘… মেমোরিয়াল লাইব্রেরি’র ছাপ দেওয়া বইটি ভেসে যেতে দেখেন তিনি। জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বইটি তুলে এনেও কিছু লাভ হয়নি – শুকোলেও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হবে না ভেবে আবার পুণ্যস্মৃতিকে ভাসিয়ে দিতে হয়েছিল। সে-ই শুরু। ক্রমে পুণ্যস্মৃতি কাগজের ঠোঙা অবধি চলে যায়। ‘… মেমোরিয়াল লাইব্রেরি’ এই ছাপ মুড়ির ঠোঙার গায়ে অনেকেই দেখেছে।

একটিমাত্র নৌকাতেই সব তুলেছিলেন তিনি। কিছু কাঁসাপিতল, লেপতোষকের সঙ্গে তোরঙ্গকটি। কী ছিল ওইসব তোরঙ্গে কেউ জানত না। অবশ্য বিপত্নীক প্রৌঢ় যে এক বিপুল স্বর্ণসম্ভার নতুন রাজকন্যার জন্যে নিয়ে চলেছিলেন এমন ভাবা ঠিক হবে না। কেনা নবীনা রাজকন্যা, তাঁর দ্বিতীয় পত্নী, কোনো এক সময়ে ‘মার চুড়িখানও লইয়া গেছ’ বলে হিসহিস করে উঠেছিল। কিন্তু পুণ্যস্মৃতি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন তাঁর সাধ্য কী? ভুল করেছিলেন অনেক। উচিত ছিল তাঁর ওই প্লাবনকালেই যাত্রা শুরু করা। জলপৃষ্ঠে পদযাত্রা না হলেও জলপৃষ্ঠে যাত্রা অনেক সহজ ছিল কিন্তু হেমন্তের ধানকাটা প্রান্ত তরণীর দুপার্শ্বে ধুধু করবে এই আশায় বসেছিলেন বলেই খানপুরের মোহনায় বড়ো গাঙ ছেড়ে ছোট গাঙে উঠবার মুখে নৌকা আটকে যায়। খরায় এই চরের দুপাশে কেবল শীর্ণ দুটি স্রোতই থাকবে – এই কথা যারা জানত তারা আদৌ বিস্মিত হয়নি। ভার কমানোর জন্য তোরঙ্গকটি একে একে তীরে নামাতে হয়েছিল এবং ওজন দেখেই মাল্লারা সম্ভবত পুণ্যস্মৃতির আন্দাজ করেছিল। ‘ফালাইয়া দিলে ভার কমতো’ – নিচুগলায় তাদের কথা যে-কেউ শুনতে পেতো। কিন্তু ঠিকমতো মাথায় তুলতে না-পারায় পা পিছলে নদীতীরে মাঝির সহকারী যখন আছাড় খায়, তখন তোরঙ্গে তোলা পুণ্যস্মৃতি জনসমক্ষে আদুল গায়ে এসে দাঁড়ালে তিনি বিভ্রান্ত-পায়ে ছপ্-ছপ্ করে জল ভেঙে ডাঙায় উঠে যান স্মৃতিরক্ষার্থে। পাড় থেকে কুড়িয়ে তুললেও নদীদীরের কাদা ভালো চিহ্নই রেখেছিল তোরঙ্গের বিষয়বস্ত্ততে। পরে শহরের ফুটপাতের পুরনো বইয়ের দোকানে কি ঠোঙার গায়ে ‘… মেমোরিয়াল লাইব্রেরি’ লেখা তোরঙ্গের বিষয়বস্ত্ত এই কারণেই খুব বিস্ময়ের সৃষ্টি করেনি।

তোরঙ্গের মালামাল আর কখনো কেউ দেখেনি। তাছাড়া ছোট শহরে এ-বাসায় তিন মাস, ও-বাসায় ছ’মাস এমনি করে ছোটাছুটি করলে মরচেপড়া তলা খসে-যাওয়া বাক্স কিছুই ধরে রাখতে পারে না। ধরে রাখতে পারে না সদ্য তরুণ পুত্রটিকেও যে মাতুলালয়ে বয়ঃপ্রাপ্ত বলেই পিতার ‘… মেমোরিয়াল লাইব্রেরি’র প্রতি কোনো আস্থা না রেখে আরো অনেকের সঙ্গে স্টেশন রোড ধরে ভিন্ন পারে চলে যায়।

 

চার

কয়েকটি টাকা ও একটি চিঠি তাঁর ছোট শ্যালক সদ্যতরুণ পুত্রটির হাতে তুলে দিয়েছিল, ‘বড়দাকে দিস।’ ওপারে তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা তখনো পসার না-জানা চিকিৎসকের কথাই বোঝায় সে। ‘বাবা’ – দ্বিধান্বিত স্বরে পুত্রটি বলেছিল। ‘আবার বাবা – নে চলে যা।’ মাতুল তাকে পথে তুলে দেয়।

সে-কারণেই কখনো তিনি পারাপারের কথা মুখেও আনেন না। তোরঙ্গের সব মালামাল এবং পুণ্যস্মৃতি ঘরশূন্য করে চলে গেলেও পরপারে যাওয়ার কথা মনে আসে না। সজোরে প্রতিবাদ করেন। ‘মাতৃভূমি’, ‘নিজের মাটি’ ইত্যাকার নানা কথা বলেন এবং এরকমভাবে অনেকদিন পার হলে হঠাৎই মনে হয় একবার সদ্যতরুণ পুত্রটি, যে এখন যুবক এবং প্রায় নিজপায়ে দাঁড়ানো, তাকে একবার দেখে আসা প্রয়োজন, সন্তানই তো। কিন্তু ততোদিনে পথে পথে নানা বাধার সৃষ্টি হয়েছে, রাস্তার মাঝখানে মস্ত দেয়াল তুলে দরজায় পাহারা বসানো হয়েছে। দুপারেই। অনুমতিপত্র দেখালেই কেবল পারাপারের সুযোগ মেলে। এবং ওইরকম সময়ে একদিন পুত্রকে দেখবার প্রবল বাসনায়ই নিশ্চয় অনুমতিপত্রের জন্যে একটি দরখাস্ত জমা দিয়ে আসেন নিজ শহরের অফিসেই। তারপর অনেক দিন কোনো খবর না পেয়ে নিজেই খোঁজ নিতে যান। ততোদিনে মধ্যমপুত্র দূরের বড় শহরে নিজ ভাগ্য গড়ে নেওয়ার জন্যে চলে গেছে। বোঝা যায় সে-ও সফলই। তাই পাসপোর্ট অফিসে একাই যান তিনি এবং সেখানে গেলে শোনা যায়, পুলিশের ছাড়পত্র না পেলে মিলবে না পারাপারের অনুমতিও।

 

পাঁচ

থানায় কনস্টেবল তার কোমরে দড়ি বেঁধেই নিয়ে গেছিল। পাড়ায় পরিচিতি থাকলেও সমাজে তেমন ছিল না। এ-কারণে কনস্টেবল বিবেকদংশনে পীড়িত হয়নি। দারোগা সাহেবও চোখ বড় করে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন – কোন সাহসে তিনি দরখাস্তে ভুল জন্মবৃত্তান্ত লিখেছেন এবং সরাসরি হাজতে ঢুকিয়ে দেন। এক রাত্রির হাজতবাস শেষে পাড়ার উকিল সাহেব এসে তাঁর জামিনের ব্যবস্থা করেন। আদালতে মামলা যদিও থাকেই।

দরখাস্তের ফরম পূর্ণ করার সময় অতো কিছু মনে ছিল না তাঁর। এই শহরে না-জন্মালেও আছেন তো দীর্ঘকাল ভেবে এই শহরই তাঁর জন্মস্থান লিখে দেন। পুলিশি তদন্ত সেটি সঠিক নয় বলে মনে করে। পাড়ার নানা লোক নানা কথা বলে এই স্বাভাবিক, পুলিশ অত বোঝে না।

উকিলসাহেব তাঁকে বোঝান, সত্যপ্রমাণের সুযোগ যেহেতু নেই ওই মিথ্যা জন্মস্থানকেই সত্য বানাতে হবে। তাই ধর্মাবতারের দিকে চোখ তুলে করজোড়ে তিনি বলেন, এই শহরেই আমার জন্ম – অনেককাল আগে আমার মা এই শহরে বেড়াতে এসে আমায় জন্ম দেন। ধর্মাবতার সাক্ষ্যপ্রমাণ চাইলে অনেক খুঁজে তাঁর সেই ফেলে আসা গ্রামের এক বৃদ্ধাকে খরচ দিয়ে শহরে নিয়ে এলে সে সাক্ষ্য দেয়, ঘটনাটি সত্যি। মামলা উঠে যায় যদিও অনুমতিপত্র মেলে না।

 

ছয়

এখনো দেয়ালে পিঠ তাঁর, কাষ্ঠাসনটিতেই বসা। ভিন্ন কাষ্ঠাসন অবশ্যই। সম্মুখে কোনো মেটে-নীল রঙের তরলে ভরা উঠোন নেই। আসে না কোনো নৌকাও বন্দর থেকে। মফস্বল শহরের চার শরিকের বাড়ির একটি ঘরই তো। অনেক বাড়িতে উঠোনও থাকে না। স্থির বসা তিনি। বৃষ্টি এখানেও আছে। কিন্তু ‘যদি বৃষ্টি না থামে’ – এমন কথা তাঁর মনে আসে না। বৃষ্টি না-থামলেও যে জলপথে পদযাত্রা করা যাবে না এ কথাও জানা। রক্তগোলকে কেউ যদি কখনো মিশে গিয়ে থাকে এখনো তাকে দেখা যাবে না।

গৃহত্যাগী পুত্রের অনেক খবর এখন তাঁর জানা। একসময়ে ত্যাজ্যপুত্র বলে ঘোষণা দিলেও পুত্রটি তাঁকে ত্যাগ করেনি বরং নিজেকে দাঁড় করানোর সঙ্গে সঙ্গে পিতার কথাও ভোলেনি সে। পুলিশ, দারোগা, কোমরে দড়ি, ধর্মাবতারের সম্মুখে সাক্ষ্যাদি ইত্যাকার নানা কথা শুনেছে সে এবং এ-কারণেই আর অনুমতিপত্র নয়, অপরপারে যাত্রার অনুমোদনই নিতে বলে সে।

হোরাসাগর থেকে ঢেউ উঠে এসে তাঁর উঠানে ছলকায়। চোখ বন্ধ করে ভাড়াবাড়ির বারান্দায় বসে থাকায় তিনি সেটি দেখেন না। পনেরো দিনের মাথায় স্ত্রীপুত্রকন্যা চলে গিয়েছিল, সে-কথাও আর মনে পড়ে না তাঁর। হোরাসাগরের জলে পা ধুয়ে আটদিনের  নৌযাত্রা শুরু করার সময় তো জানতেনই আর সেখানে ফেরা যাবে না, তাহলে বুকে এই ভার কিসের? পুণ্যস্মৃতির কোনো স্মৃতিই তো আর অবশিষ্ট নেই। সঙ্গে আনা তোরঙ্গটিও বহুকাল আগেই              অন্তঃসারশূন্য। তাহলে?

মধ্যমপুত্রটি দূর শহরে। নিজের শিক্ষাব্যবস্থা তার নিজেরই। আরো দূরযাত্রার অভিলাষ তার। সে-ও অগ্রজের সমর্থক। পিতাকে সে নিজের শহরে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ভিন্নপারে যাত্রার অনুমোদন নিয়ে যেতে বলে।

কাষ্ঠাসনেই বসা তবুও তিনি। পুত্রদের বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ায় তাঁর কোনো কৃতিত্ব নেই। কেবল জন্ম দেওয়ার অধিকারটুকুই সম্বল। আর ওই সম্বল নিয়ে এতোকাল পরে তাদের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ানো যায় না।

তবুও বড় শহরে যান তিনি। অনুমোদনপত্র মিলে যায় অতি সহজেই। জ্যেষ্ঠপুত্রই সমস্ত দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়েছে, এই জন্যে।

অবশেষে ভিন্ন কিছু তোরঙ্গে, দু-চারটি পোঁটলাপুঁটলি লেপতোষকের বান্ডিল ইত্যাদি ট্রেনের কামরায় তুলে দিয়ে নিজেও সেটিতে উঠে পড়েন। খানপুরের মোহনায় তাঁকে আর আটকে পড়তে হবে না, শাহজাদপুরের বাজারে নৌকা ভিড়িয়ে কাটবে না রাত, বড়াল ব্রিজের নিচে নৌকায় আসবে না আর প্রত্যুষ।

সঙ্গের অনুমোদনপত্র দেখালে বিনা কথায় দরজা খুলে যায় দুপারেই। পাসপোর্ট, ভিসা কিছু লাগে না আর। কারো মুখে কোনো আপত্তির কথা শোনা যায় না – না এপারে, না ওপারে।

 

সাত

ওই সামান্য ঘুমের মধ্যেও তিনি অস্থির। রাত্রি আজকাল দীর্ঘ মনে হয়। পাখি অনেক দেরিতে ডাকে। সকাল আসে না, আলো ফোটে না, যেন অন্ধকারেই শেষ হয়ে যাবে। আর এরকম মনে হতেই তিনি দ্রুত উঠে জানালা খুলে দেন। তখন অন্ধকার কিছু ম্লান মনে হয়।

জানালার পাশেই তাঁর শয্যা। অক্লেশে জানালা খোলা ও বন্ধ করাই উদ্দেশ্য। মুক্ত জানালাপথে এক ঝলক বাতাস আসে। শেষ হেমন্তের হাওয়া, খুব ঠান্ডা নয়, তাই পার্শ্বে শায়িতা সঙ্গিনীর কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। কিন্তু বালিশের নিচে থেকে টিনের ছোট চারকোনা কৌটোটি বের করার চেষ্টা করলে ‘রাত শেষ হইতেই শুরু হইলো’ কথাকটি শোনা যায়। হাত টেনে নিয়ে জানালা দিয়ে আবার বাইরের দৃশ্য দেখেন। কিন্তু কেবল দৃশ্যে সুখ নেই। সেখানে গাছপালা ও মাটিতে কোনো তফাৎ নেই, শুধু গাছের মাথায় ঈষৎ কিসের আভা। পাশের এবং দূরের বাড়িঘর তখনো কেবল কৃষ্ণাকৃতি।

তারপরে সেই আভা যখন আর একটু উজ্জ্বল হয়, তখন আর অপেক্ষা করা যায় না। বাক্সটি বের করে ঢাকনা খুলে কিয়ৎকাল দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় নিশ্চল থাকেন। দিনের আরম্ভ মনে একটা তৃপ্ত ভাব আনুক এই চিন্তায় প্রতিদিন যেমন করেন, আজো তা-ই হয়। মশারির বাইরে দেহের অর্ধেক অংশ, আধশোয়া তিনি মুখের ধোঁয়া জানালার বাইরে পাঠিয়ে দেন, কিন্তু ‘অকম্মা মানুষের বিড়ি খাওনই কাম’, এই বহুশ্রুত বাক্যটি আবারো তাঁর কর্ণগোচর হয়। জন্মের পঁচাত্তর বছর পরে বিড়ির ধূমপান ছাড়া অনেকেরই কিছু করার থাকে না, বিশেষত তাঁর তো নয়ই, এ-কথা বোঝানোর চেষ্টা করেন না।

তারপরে গাছপালা, ঘরবাড়ি এবং যেসব পাখি এতোক্ষণ শব্দের মধ্যেই পরিচিত ছিল, দৃশ্যগোচর হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে। দূর দিগন্তের সীমারেখা স্পষ্ট হয় এবং সেখানে বর্ণ আসে। কাছে তাঁর দৃশ্যে স্বাচ্ছন্দ্য আসে। তিনি ধাতব চারকোনা বাক্সটির খোঁজ করতে থাকেন আবার।

বিদেশবাসী সদ্য সপরিবারে প্রত্যাগত পুত্র যখন ঘরে ঢোকে তখন তাঁর মুখ, কপাল ও শ্বেত কেশের মধ্য দিয়ে ধোঁয়া উড়ছিল এবং মাঝে মাঝে কাশির দমক আসছিল বলেই বুঝি তিনি দিশাহারা হয়ে যান।

সে একটু তাকিয়ে দেখে, যদিও তার চোখে তখনো ঘুমের রেশ। চুল অবিন্যস্ত। ‘আবারো আপনি বিড়ি খাচ্ছেন’ বলে কাছে এসে দাঁড়ায়। ‘ডাক্তারের নিষেধ আপনি জানেন। একটু-আধটু খাবেন বলে আমি যে ফিল্টারড সিগারেট এনে দিয়েছি, তা-ও আপনাকে দেওয়া উচিত নয়।’

তিনি চুপ করে থাকেন। ‘আপনাকে যে দশ প্যাকেট স্টেট এক্সপ্রেস এনে দিলাম, সেগুলো কোথায়?’

‘সকাল বেলা সিগারেট ভালো লাগে না। বহু দিনের অভ্যাস’, আস্তে বলেন।

‘অভ্যাসটা বাদ দিন। কদিন আগেই কী অবস্থা হয়েছে মনে নেই?’

অন্ত্রাশয়ে রক্তক্ষরণের ফলে মাসছয়েক আগে তাঁর জীবনসংশয় দেখা দেয়। পুত্রবধূ নার্স। ভোর বেলায় ঘটনাটি বুঝে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুরকে তার হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরিচিত ডাক্তার ও নার্সদের দ্রুত ব্যবস্থায় দুসপ্তাহের মধ্যেই তিনি ঘরে ফিরে এসেছিলেন।

সেই কথা ভেবে ‘এই একটু-আধটু খাই, আগের মতো আর না,’ বলে সব যেন ঝেড়ে ফেলে দেন। তাঁর মুখে কোনো অপরাধ, গ্লানি, বিরক্তি বা অন্য বোধের ছায়া ছিল না।

মানুষের জীবন বড় দীর্ঘ। জীবনে করণীয় বড় কম। এমন অদ্ভুত চিন্তা তাঁর মাথায় অনেককাল হলো ঘুরছে। বেঙ্গল ইমিউনিটিজের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরে আর কোনো স্থায়ী চাকরিতে ঢোকা হয়নি তাঁর। কেননা, যে-শহরে তাঁর চাকরি ছিল, সেই শহর নিষিদ্ধ হয়ে যায়, আর নতুন শহরে কেউ তাঁকে চিনতো না।

সন্তানকটির ব্যবস্থা যেন প্রকৃতি নিজ হাতে তুলে নিয়েছিলো। মাতুলালয়ে আশ্রিত কন্যাটি নিজেই নিজের সঙ্গী খুঁজে নিয়েছিল। মধ্যমপুত্রটি কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও শিক্ষাজাতীয় কর্মসূচির আওতায়ই যেন এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে থেকে স্কুল পেরোয়। তারপর কলেজ-ইউনিভার্সিটির ধূসর জগতে একাকী শূন্যহাতে ঢুকে যায়। সে আজ বিদেশবাসী। জ্যেষ্ঠপুত্র বহু আগে নিজের ভাগ্য নিয়ে দূরে সরে যায় এবং নিজেকে একরকম করে গড়ে তোলে। ছোট ভাইটিকে সে-ই নিজের কাছে রেখে শিক্ষিত ও চাকরিজীবী করে দেয়।

তাঁরা দুজনে কেমন করে ভেসেছিলেন সে-কথা মনেও পড়ে না যেন। বড়ো ছেলে কোনোমতে বাড়িটি খাড়া করে বিমাতাসহ তাঁকে মফস্বল শহর থেকে নিয়ে না আসা পর্যন্ত দিনগুলি ভেবেও দেখতে চান না। প্রৌঢ়ত্ব থেকে বার্ধক্যে পৌঁছানো পর্যন্ত সবকটি দিনই যেন তাঁর নখদর্পণে – সেখানে কৃতকর্মের কোনো ছায়া দেখতে পান না। মফস্বল শহর থেকে তাঁদের নিয়ে এসে বড়ো ছেলেও বিদেশে চলে যায় – সেখানেই সপরিবারে বাস তার। সংসার খরচের টাকা এখনো সে তাঁর নামেই পাঠায়। মধ্যমপুত্রটি পাঠাতে শুরু করে কিছুকাল পরে থেকেই। কনিষ্ঠপুত্র সপরিবারে তাঁর সঙ্গে বাস করে। সমস্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য তাঁর কাঁধে হলেও বৃদ্ধ পিতা সম্মানী হন এই ভেবে সে নিজেও নিজ উপার্জনের কিয়দংশ তাঁর হাতে তুলে দেয় এবং তিনি নিজে প্রতি মাসে মুদি, ধোপা, দুধওয়ালা ইত্যাকার খরচ স্বহস্তে মিটিয়ে দেন। বাজার করার অভ্যাস এক সময় ছিল। কাঁচাবাজারের পসারিরা তাঁর প্রাপ্য সম্মান চিরকালই দিয়েছে। কিন্তু অশক্ত শরীরে আর তাদের সামনে যেতে পারেন না। তবুও সচ্ছল সংসারের প্রতিভূ তিনি। তাঁর অস্তিত্বই শুধু মূল্যবান। কেবল দেহী নিজেকেই কোথাও খুঁজে পান না।

তবুও ব্যাংকে যাওয়ার স্বভাবটি এখনো আছে তাঁর। ছেলেরা একবার বলেছিল, কষ্ট করে ব্যাংকে যাওয়ার কী প্রয়োজন। পুত্র-পুত্রবধূ উভয়েই কাজ চালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু তিনি রাজি হননি। ব্যাংকে তাঁর নামে অ্যাকাউন্ট খোলা আছে। ব্যাংকের ম্যানেজার নিজের ঘরে তাঁকে বসিয়ে সব কাজ করে দেয়। টাকার কুলজি জানতে চায় না। তাই তিনি ব্যাংকে যান।

 

আট

ঘরের খোলা দরজা দিয়ে চঞ্চল পৌত্র মুহূর্তের জন্যে ঘরে ঢুকেই বেরিয়ে যেতে চায়। তিনি, ‘শোন, শোন এই দ্যাখ কী’ – বলে তাকে কাছে ডাকেন। সে স্থির হয়, তাঁর ডাক শোনে, কিছু ভাবে এবং অবশেষে ‘না তোমার কাছে কিছু নাই’ বলে বেরিয়ে যায়। তিনি তার পেছনে ছুটে যান না। সেই ক্ষমতা তাঁর নেই। তিনি কেবল উঠে দাঁড়ান। খাটের পায়ের কাছে রাখা আলমারির মাথা থেকে চাবি নিয়ে সেটি খুলে একটি ছোট ব্যাগ বের করে আনেন। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ভেতরে হলুদ আভা, স্বচ্ছন্দেই অন্তর্গত বস্ত্তর পরিচয় পাওয়া যায়।

প্যাকেটটি নিয়ে বাড়ির ভেতরের দরজায় এসে দাঁড়ান, দরজা দিয়ে উঠোনে নামেন। হাতে যে বাজারের থলি ঝোলানো, তার ভেতরে ছোট প্লাস্টিকের ব্যাগটি ভরে নিয়েছেন। ছাতা বগলে উঠান পার হন, বাইরের দরজা খুললে শব্দ হয়, রান্নাঘরের দরজায় স্ত্রী এসে দাঁড়ালো ‘কই যাও’ এই কথার জবাবে ‘একটু ব্যাংকে’ বলে চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে পা রাখেন। বাথরুমের দরজা খুলে সেই মুহূর্তে পুত্রবধূ বেরিয়ে আসে, সদ্যস্নাতা, এবং ‘কী জন্যে যে ওঁকে প্রতিদিন ব্যাংকে যেতে হয়। একসঙ্গে বেশি টাকা তুলে আনলেই তো পারেন। রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়লে তখন কী হবে’ বলতে বলতে সে নিজ ঘরের দিকে চলে যেতে থাকে। দরজার বাইরে সচল তিনি সবকটি কথাই শুনতে পান। ওরকম একদিন হয়েছিল। চৌরাস্তার মনিহারি দোকানের সামনে মাথা ঘুরে বসে পড়লে পরিচিত রিকশাওয়ালা তাঁকে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল।

পাশের বাড়ির প্রতিবেশী আইনজীবীর সঙ্গে ছোট রাস্তার মাথায় দেখা হয়ে যায় – ‘আপনার মেজছেলে এসেছে বুঝি?’

তিনি একটু থামেন। বগলের ছাতাটি হাতে নিয়ে মাটিতে ঠেকান। এতে ভারসাম্য বজায় থাকে – ‘হ্যাঁ, এই দুই সপ্তাহের জন্যে।’

‘বড়জনও আসবে নাকি শিগগির?’

‘ডিসেম্বরে আসার কথা। কিন্তু আমার যা শরীরের অবস্থা -।’

‘কিছু হবে না। এই তো বেশ আছেন। আপনার মতো সৌভাগ্য কজনার হয়। নিজেদের চেষ্টায় তিন ছেলে দাঁড়িয়ে গেছে আর কী চাই।’

প্রতিবেশীর গলায় আন্তরিকতা ছিল, প্রশংসা ছিল। সব শুনে তিনি একটু হাসেন। ছাতাটি আবার বগলে নিয়ে খোলা হাতে মাথাটি চুলকে নেন। তারপর ‘আচ্ছা আসি’ বলে চলা শুরু করেন।

হাঁটতে কষ্ট হয়। মাঝখানে একবার হাঁটু ফোলায় দীর্ঘদিন ঘরে বসে ছিলেন। মাঝে মাঝেই এরকম হাঁটু ফুলে যায় তাঁর। তারপরে কাশি। সকালবেলায় প্রথম ধূমপানের পরে যে কাশির দমক আসে তা যেতে অনেক সময় নেয়। শীতকালে খুবই বাড়ে।

শ্লেষ্মার সঙ্গে মনে হয় ফুসফুসের অংশ গলে বেরিয়ে আসবে।

বড় রাস্তার মোড়ে রকমারি দোকানের সামনে এসে দাঁড়ান। ‘এই যে আসুন’ বলে দোকানি তাঁকে সামনে পাতা চেয়ারে আগ্রহ করে বসায়।

‘কই আপনার জিনিস কই, এনেছেন?’

‘ব্যাগে আছে’ বলে তিনি চেয়ারে বসেন। বড়ো ক্লান্ত মনে হয়।  দোকানি খবরের কাগজটি তাঁর হাতে তুলে দেয়। খুলে পড়বার মতন শক্তি আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এখন তাঁকে ব্যাংকে যেতে হবে, টাকা তোলবার জন্য নয়। জমা দেবার জন্য। তিনি হাত থেকে কাগজটি দোকানের কাউন্টারে রেখে দেন। পায়ের কাছে রাখা থলে খুলে সেই প্যাকেটটি বের করে দোকানির হাতে দেবেন যখন, তখন ‘কী কেমন আছ’ শুনে ফিরে তাকান। দোকানির সঙ্গে যে কথা বলে, বিদেশ-প্রত্যাগত সন্তান তাঁর, দোকানির প্রসারিত হাতে, স্বচ্ছ প্লাস্টিকের মোড়া হলুদ রঙের আভার বস্ত্ত কী মুহূর্তে বুঝে যায়। নিজ হাতে কেনা ‘স্টেট এক্সপ্রেস’ সে চিনবে না কেন?

দোকানি তাঁর দিকে তাকায়। বার্ধক্যের মুখও বিবর্ণ হয়।

 

নয়

ব্যাংকে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন তিনি। সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছেন। চেক বইটি, জমা দেওয়ার রসিদ। পরিচিত রিকশাওয়ালা তার নতুন রিকশাটি নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। দর্পিত পা ফেলে স্বচ্ছন্দে তিনি রিকশায় ওঠেন। শালটি বুকের ওপর আড়াআড়ি করে কাঁধের ওপর তুলে দিয়েছেন। মৃদু সুবাস আসে তা থেকে। রিকশা চলতে শুরু করে। সুন্দর প্রশস্ত রাস্তা। রিকশাওয়ালার পায়ে জোর আসে।

রাস্তার পাশে প্রতিবেশী আইনজীবী সহাস্যে হাত নাড়েন, ‘কেমন আছেন’ বলে জোরে ডাক দেন। তিনি ফিরেও যেন দেখেন না। ও-পাড়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের মুখ তাঁকে দেখে অমায়িক হাসিতে উদ্ভাসিত হয়। রাস্তার যানবাহন তাঁর রিকশাটিকে আগে চলে যেতে দেয়। রিকশা দ্রুতগতিতে যেন হাওয়ায় ভেসে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। পথচারী তাঁর দিকে সম্ভ্রমে তাকায়।

ব্যাংকের দরজায় দাঁড়ানো প্রহরীর বন্দুকটি ঝকঝক করে। সে দু-পা এক করে তাঁকে কুর্নিশ করে। তাঁকে দেখে ব্যাংকের ম্যানেজার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার অফিস থেকে বেরিয়ে এসে সহাস্যে অভ্যর্থনা করে। ব্যাংক ম্যানেজার পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে চায় তাঁকে। হঠাৎ এক ঝলক আলো-ছবি তোলা হচ্ছে। এনলার্জ করে দেয়ালে টাঙালে সর্বদা অমলিন থাকে।

ভেতরে ঢুকে দেখেন টাকা দেওয়া-নেওয়ার কাউন্টার সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কেরানিদের টেবিলগুলো ঘরের মাঝখানে আলাদা আলাদা সাজানো; চারপাশে চেয়ার দিয়ে। ধবধবে চাদর, টেবিলের ওপর ফুলদানি। পেয়ালা-পিরিচে সুন্দর কারুকাজ। মাঝখানের  প্লেটটি সবচেয়ে বড়। চারপাশের সাজানো চেয়ারে প্রতিবেশী আইনজ্ঞ, কলেজের প্রফেসর, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সবাই তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে। তিনি এগিয়ে যান। ম্যানেজার তাঁকে বসিয়ে নিজে পাশের চেয়ারটিতে বসেন। সাদা পোশাকে বেয়ারার দল সারিবদ্ধ হয়ে ধোঁয়া-ওঠা থালা হাতে তাঁর টেবিলের দিকে আসতে থাকে। দূরের দেয়াল ঘেঁষে একটি মঞ্চ। মৃদু আলোকিত মঞ্চ অকস্মাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাঁকে মঞ্চে ওঠার জন্যে ডাকে বুঝি কেউ।

 

দশ

তিন সিন্দুক, চার তোরঙ্গ, পুণ্যস্মৃতির নানা বাক্স নিয়ে বজরা নৌকাটি ঘাটে এসে লাগে। দেখেন সমস্ত গ্রামের স্ত্রী-পুরুষ এসে দাঁড়িয়ে আছে হোরাসাগরের তীরে। মাঝি সাবধানে নৌকাটি স্থির দাঁড় করিয়ে দিয়ে তাঁকে হাত ধরে নামায়।

কত সহজেই না সময়-অসময়ে পারাপার করা যায়।