যুদ্ধের উপন্যাস : টিন ড্রাম

মহীবুল আজিজ

সাহিত্যতাত্ত্বিক মিখাইল বাখতিন তাঁর রচনায় বলেন, ১৯২০-এর দিকে উপন্যাস তার নিজের পথ নির্মাণ করতে সমর্থ  হয় এবং এরপর থেকে উপন্যাস তার সেই পথকেই অনুসরণ করে চলতে থাকে। এর আগে উপন্যাসে যত গল্প-চরিত্র-ঘটনাই থাকুক, এর কেন্দ্রীয় আবেগ ও পরিচর্যা  কবিতাক্রান্ত ছিল। কাজেই এই পথ করতে গিয়ে উপন্যাসকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে কবিতার বলয় থেকে। এক সাক্ষাৎকারে পাবলো নেরুদা বলেছেন, কবিকে তাঁর কবিতায় তাঁর নিজের জীবনকে প্রতিফলন করতেই হয়। সেটাই শিল্পের রীতি এবং তা জীবনেরও রীতি। প্যারিস রিভিউ পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে আইজাক বাশেভিস সিঙ্গার বলেন, পোল্যান্ড থেকে আমেরিকায় অভিযোজন করার পর পাঁচ-পাঁচটি বছর এক ধরনের শূন্যতার বোধে আক্রান্ত হন তিনি। কিছুই লেখা তাঁর সাধ্যে কুলোয় না। তাঁর মনে হয় যে, তিনি লেখার ভাষা এবং অনুভূতি সবই হারিয়ে ফেলেছেন। যে-জীবন তিনি পোল্যান্ডে কাটিয়ে এসেছেন সে-জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি কোনোভাবেই নবলব্ধ মার্কিন বাস্তবকে অনুবাদ করতে পারছিলেন না। পুরনো অভিজ্ঞতা কাজে লাগছে না, নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে উঠতে সময় লাগছে। নতুন বাস্তবকে কীভাবে নেবেন তা নিয়েও চলছে দ্বন্দ্ব-অনিশ্চয়তা। তাঁর মনে হতে থাকে, চারপাশটা দারুণ পরিপূর্ণ ও সমগ্র, তবু তিনি হারিয়ে গেছেন – হারিয়ে গেছেন আমেরিকায়।

আমার নিজের কাছে মনে হয় ১৯২০-এ উপন্যাস তার নিজের পথ রচনা করতে পারার পেছনে যে-কারণ নিহিত সেটা হচ্ছে যুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নেপথ্য এবং প্রত্যক্ষ প্রভাবেই উপন্যাসের পক্ষে আর তার পুরনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয় না। বিশ শতককে তো যুদ্ধের শতকই বলা যায়। দুই দশকের ব্যবধানে দু-দুটো আন্তর্জাতিগত যুদ্ধ প্রচলিত অনেক কিছুকেই ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয়। আমূল পালটে দেয় সবকিছুর স্বভাব। সব ক্ষেত্রেই মূল্যায়নের নতুন পরিভাষা দাঁড়ায় – যুদ্ধের আগে ও পরে। এমনকি ‘দুই যুদ্ধের অন্তর্বর্তী সাহিত্য’ বলেও একটা মানদন্ড সমালোচকের হাতে চলে আসে। একই লেখকের পক্ষেও যুদ্ধের আগের অবস্থান বা দৃষ্টি দিয়ে যুদ্ধের পরের বাস্তবকে পরখ করাটা সম্ভব বলে মনে হয় না। তাঁকে খুঁজতে হয় নতুন ভাষা, যেহেতু তাঁর অনুভূতির জগতেই ঘটে গেছে একটা প্রচন্ড ওলট-পালট। অনুভূতির পরিচালনাতেই চলতে হয় লেখককে। এই বদলটাই অনিবার্য হয়ে ওঠে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে একবার, যা দৃষ্টিগোচর না হওয়ার কোনোই কারণ নেই এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আবার একবার, যা প্রথম পরিবর্তনের ইতিহাসকে বলতে গেলে প্রায় বিস্মৃত হয়ে এমন একটা অবয়বে উপস্থিত হয়, যার জন্যে পাঠক কেন, হয়তো লেখক নিজেও তৈরি থাকেন না। অ্যালাঁ রব গ্রিয়ে বলেছিলেন, নতুন ধরনের উপন্যাস বলেকয়ে দেখা দেয় না, লেখা হয়ে গেলে দেখা দেয়।

জার্মান ঔপন্যাসিক গুন্টার গ্রাসের উপন্যাস টিন ড্রাম তেমনই একটি উপন্যাস, যা উপন্যাসের প্রচলিত আঙ্গিকের অবলম্বন কাঁধে বয়ে এর অন্তর্নিহিত সাম্রাজ্যে সবকিছু ভেঙেচুরে এক নতুন শিল্পসত্তার নিয়ামক হয়ে উঠল, যাকে বলা যায় বদলে যাওয়া পৃথিবীকে ধরার জন্যে বদলে যাওয়া কাঠামো। দুই যুদ্ধের মধ্যবর্তী বাস্তবতার যথার্থ প্রতিনিধি গ্রাস তাঁর সাহিত্যজীবনের সূচনা করলেন এমন এক বিপুল মহাকাব্যিক পটভূমি দিয়ে, যেটির জন্যে এক অর্থে পৃথিবী তৈরি থাকে আবার যার দেখা পেয়ে একই সঙ্গে পৃথিবী বোধ করে বিমূঢ়তা। দুটো বিশাল সমরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ঔপন্যাসিক উপন্যাস লিখতেই পারেন; কিন্তু গ্রাসের উপন্যাস কেবল যুদ্ধের বিবরণ হয়ে থাকে না, যুদ্ধ-ঘটনার আশ্রয়ে দেশ-জাতি-সংস্কৃতি-দায়বোধ-ক্ষমতা-নিয়ন্ত্রণ-মারণযজ্ঞ এসবের মানব-পরিণতিকেই তিনি সাজান তাঁর নিজস্ব ধরনের বিপুল ক্যানভাসে। বাখতিন ১৯২০-কে চিহ্নিত করেন উপন্যাসের নতুন রাস্তার একটা সূচক বলে, গ্রাসের টিন ড্রামকে (১৯৫৯) বলতে হবে সেই রাস্তায় সবচেয়ে দৃষ্টিযোগ্য বাঁক। উপন্যাসটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমালোচকরা একে বারোক-উপন্যাস বলে অভিহিত করতে চান। বস্ত্তত সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের ইউরোপীয় শিল্প-স্থাপত্য-সংগীত বহুবিচিত্র সজ্জাসমন্বিত এক অখন্ড ও পরিব্যাপ্ত শিল্পপ্রণালী বিশ্বকে উপহার দেয়। গ্রাসের উপন্যাসকে বোঝার জন্যে সমালোচককে অনেককাল আগেকার এক শিল্পাঙ্গিকের শরণ নিতে হয়। তারপরও এটি কেবল বারোক-নভেল নয়, কেউ বলেন – এ এক নিদারুণ ফ্যান্টাসি – তাঁরা গ্রাসের মধ্যে গরগন্ডুয়া-পেন্টাগ্রুয়েলের র‌্যাবেলেকে আবিষ্কার করেন। আবার কেউবা বলেন, এটা অজস্র দৃশ্যচিত্রের সংবদ্ধতায় গাঁথা এমনই এক শিল্প, যাকে আমরা হয়তো অভিজ্ঞতার অভ্যাসবশে উপন্যাসই বলি, কিন্তু এটা তারও অধিক কিছু। হয়তো সবই সত্য। যেটা সবচেয়ে বড় সত্য তা হলো, যুদ্ধকে বাইর থেকে নয়, নিজের সত্তার ভেতর থেকে দেখতে-দেখতে এক অবিরাম যুদ্ধপ্রবাহের মধ্য দিয়ে লেখক আমাদের নিয়ে যান এবং যেখানে আমাদের শেষে দাঁড় করান, সেখানে উপন্যাস একটা নতুন নৃতাত্ত্বিক পরিভাষার নামান্তর।

টিন ড্রামের পরিপার্শ্বে থাকে এক বিশাল ঐতিহাসিক বাস্তব যাকে অনেক সময় সন-তারিখের বা লোকজনের প্রামাণ্যতায় ধরা সম্ভব নয়; কিন্তু সেই ইতিহাস এক অদৃশ্য আচ্ছাদনের মতো বিস্তীর্ণ।  সে-ইতিহাসটাকে লেখক হাতে রাখেন এটা যেমন সত্য, তেমনি এও সত্য যে, এর ক্রূরতাকে লেখক প্রত্যাখ্যান করেন। গ্রাসের এই উপন্যাস একই সঙ্গে গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানের কাহিনি। উপন্যাসের নায়ক অস্কার ম্যাটজেরাথের সামগ্রিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয় গ্রাসের সেই প্রত্যাখ্যান-চেতনা। বিস্মৃতিপরায়ণতা ও অস্বীকৃতির চাইতে সেটা অনেক জরুরি। আর গ্রাস এক মহাজাতিগত অপরাধের বোধ ছড়িয়ে দেন, যা নিয়তির মতো জড়িয়ে থাকে তাঁর পাত্রপাত্রী ও তাদের পরিণতিতে। যেহেতু প্রচলিত ইতিহাস, রাষ্ট্রীয় আইন, সামাজিক রীতি এসব প্রতিষ্ঠান কখনো অপরাধ ও শাস্তির আনুষ্ঠানিকতার অধিক কিছু করতে অসমর্থ, সেহেতু ঔপন্যাসিককেই এক অনন্ত ভবিতব্যের কথা ভেবে নতুন বিধান সৃষ্টি করতে হয়। ফলে ঔপন্যাসিক যা চান তাঁর চরিত্রেরা ঠিক তাই করে, আমরা না চাইলেও। গ্রাসের চরিত্র অস্কারও তাই – আমরা তাকে অবিশ্বাস্য ভাবি বলে ফ্যান্টাসি আখ্যা দিই। তারও যে কারণ থাকা সম্ভব, সেটা বোঝা যাবে একমাত্র লেখকের সংবেদনার গহিন জায়গাটিকে বুঝতে পারলে। অনেক সময় এমনও হয়, ফকনার যেমন বলেন, লেখক যা আগাম ভাবেন তাঁর লেখার পরিচর্যা ও পরিণাম সম্পর্কে লিখতে গেলে দেখা যাচ্ছে যে, তাঁর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে তাঁরই শব্দরাজি। গ্রাসের টিন ড্রাম শুধু শব্দশিল্পের উপন্যাস নয়, পাঠকের সামনে এনে জড়ো করে ইতিহাস-সমাজ-রাষ্ট্র-সংস্কৃতি-ধর্ম-ব্যক্তি-ভাষা সবকিছু। পাঠক চাইলে শুধু উপন্যাস পাঠের পরিতৃপ্তি নিয়ে সুখী থাকতে পারেন। আবার কেন গ্রাসের উপন্যাস চেনা  রাস্তায় না হেঁটে এমন অনন্য রাস্তার দিকে গেল তা জানতে গেলে পাঠককেও ঢুকে পড়তে হবে সে-রাস্তায়। এবার আমরা বলতে পারি, মহাযুদ্ধ হচ্ছে সেই ভয়ংকর সুযোগ, যা বিশ্বের জাতিতে জাতিতে নৈকট্যের মাধ্যমে পরস্পর পরস্পরকে বিনাশের এক জটিল নাট্যিকতা, যার সফল শিল্পরূপ অন্তিমে রচয়িতার হাতেই নির্ধারিত হয়; কিন্তু আন্তর্জাতিগত যুদ্ধের বীজ পারস্পরিকতা অর্জনের আগেও যে অভ্যন্তরাধারেই পারস্পরিকতা চিহ্নিত হয়ে বিচ্ছিন্নতার বৈশিষ্ট্য লাভ করে, তা হয়তো সবচেয়ে ভালো দেখতে পান শিল্পীই। যুদ্ধ তাঁকে সে-সুযোগটা করে দেয় যখন তিনি ভেতর-বাহির মিলিয়ে মানচিত্রের মধ্যে ও মানচিত্রের বাইরে তাঁর দৃষ্টিকে আনা-নেওয়ার প্রক্রিয়ায় এক সম্প্রসারিত অভিজ্ঞতার উৎসারণ ঘটান যা পাঠ করে জার্মান পাঠক এবং পোলিশ পাঠকের অভিজ্ঞতা মিলে যায়। পৃথিবীর ভিন্ন-ভিন্ন দেশের মানুষকে প্রভাবিত করেন ঔপন্যাসিক তাঁর শব্দের মাধ্যমে, নিজে তিনি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থেকে। আমরা দেখি দ্বিতীয় মহাসমর শেষ হওয়ার চোদ্দো বছর পরে প্রকাশিত হচ্ছে গুন্টার গ্রাসের টিন ড্রাম। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে! বাস্তবে যুদ্ধ শেষ কিন্তু গ্রাস তখনো যুদ্ধের মধ্যেই স্থিত।

শুধু কী যুদ্ধের মধ্যে! দেশজুড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর মন্দা,  অভ্যন্তরে ফ্যাসিবাদ-স্বৈরাচারের উত্থান, জাতিগত বিদ্বেষ-বৈরিতার বিস্তার – এসবের চাপ সামলে গ্রাসের সমগ্র যুদ্ধকান্ডের দুঃস্বপ্নের ভেতরে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই এবং যুদ্ধশেষে বাস্তবের লড়াইও উপন্যাসে চিত্রণ ঘটবে, সে-লড়াইয়ের মধ্যে একটা পারস্পরিক সাম্যাবস্থা গড়ে তোলা একজন লেখকের জন্যে কী কষ্টের কাজ, তা কেবল তেমন সংগ্রামে বর্তমান থাকা লেখকের পক্ষেই অনুমান করা সম্ভব। প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে ক্রম-জটিল জার্মানির রাজনীতি পরে ভার্সাই চুক্তির অপব্যাখ্যাকারী হিটলারের কালে পরিণত হয় হিস্টেরিয়ায়, যার ছায়ায় গ্রাসের বেড়ে ওঠা। ফ্যাসিবাদ তাঁর স্বদেশ ডিঙিয়ে পাড়ি দেয় অন্যান্য দেশেও। পৃথিবী থেকে ইহুদি জাতিকে নির্মূল করার এক ভয়ংকর খেলায় মেতে ওঠেন হিটলার। ছয় লাখ ইহুদিকে ধ্বংসের আদেশনামার কোনো লিখিত রূপ কোথাও থাকে না, তবু আউশভিচ-ডাচাউয়ের গ্যাস-চেম্বারগুলোর চিমনিপথে গলগল করে বেরোতে থাকে ইহুদি মানবের ভস্মীভূত ছাই। নির্মম সাক্ষী হয়ে পড়ে থাকে হয়তো কিছু হাড়গোড়। লাখ-লাখ ইহুদি রমণীর মাথার চুল বস্তাভর্তি হয়ে চলে যায় জার্মানিতে। প্রমাণ দেখে হিটলার নিশ্চিত হয় যে, তার স্বপ্ন অন্যের জন্যে দুঃস্বপ্নে পর্যবসিত হতে পেরেছে। এমন বৃহদায়োজনের পরও জার্মানি হেরে যায়। সভ্যতার দেহে দগদগে হয়ে লেগে থাকে এক অমোচনীয় ছাপ। সৃজনশীল লেখক যখন এ-জায়গা থেকে শুরু করতে চান, তাঁর পক্ষে সেই দুঃস্বপ্নের ঘোর থেকে মুক্ত হওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। মুক্ত যদিওবা হন তিনি, একটা বিশাল অপরাধের দায় তাঁর কাঁধে বর্তায় – তিনি কী আড়াল করবেন, না প্রকাশ্য হবেন! গুন্টার গ্রাসের টিন ড্রাম পৃথিবীর পাঠককে সেই সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। পেঙ্গুইনের এক পরিসংখ্যান বলে, উপন্যাসটি বিভিন্ন ভাষায় এ-যাবত দশ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে, যার অর্থ প্রায় দশ লাখ পাঠকের এই উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা ঘটেছে। উপন্যাস লেখার সময়ে তিনি হয়তো জানতেনই না যে, গ্রন্থটি এত এত পাঠকের কাছে যাবে; কিন্তু গুন্টার গ্রাস জানতেন, ইতিহাসের দায় তাঁর কাঁধে এবং সে-দায়ের ভার অনেকখানি। কাজেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও দেড় দশককাল তিনি যুদ্ধের মধ্যেই বসবাস করেন।

উপন্যাসের পটভূমি ডানজিগ জনপদ। এটি জার্মানি-পোল্যান্ড সীমান্তের একটি গ্রাম। এটি গ্রাসের জন্মস্থানও বটে। উপন্যাসের মধ্যে ঘটমান কাহিনির কালগত ব্যাপ্তি ত্রিশ বছর (১৯২৫-৫৫) এবং তার ঐতিহাসিক পটভূমি ১৮৯৯-১৯৫৫ অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতাকেও সঙ্গে রাখেন ঔপন্যাসিক। উপন্যাসের শুরুর বিন্দু এবং এর শেষের বিন্দু একই জায়গায় – একটা হাসপাতালের রোগী অস্কার ম্যাটজেরাথ তার জীবনে ঘটে যাওয়া যে-কাহিনি লিপিবদ্ধ করে রেখে যান, সেটাই উপন্যাস। তিন বছর বয়স থেকে এক অদ্ভুত রোগের শিকার হয়ে পড়ে অস্কার। জন্মক্ষণ থেকেই তার সেই রোগের সূচনা। তার শরীর কোনো এক জীববিদ্যাগত কারণে বৃদ্ধি-স্থবিরতায় আক্রান্ত হয়, চিরবামনত্বের শিকার হয় সে। ষোলো বছর বয়সে একজন নার্সকে হত্যার দায়ে তার ভাগ্যে জোটে কারাবরণ, যদিও নার্সের হত্যাকারী সে নয়। কিন্তু অস্কার স্বেচ্ছায় নিজেকে হত্যাদায়মুক্ত করে না। কেননা, তার চেয়ে উন্মাদাশ্রম অনেক নিরাপদ এবং আরামের। সেখানে পৃথিবীর জটিলতা নেই, পারস্পরিক দ্বন্দ্বের সুযোগ নেই, যেখানে তার নিজের শরীরটাই বৃদ্ধির বিপরীতে সেখানে বাইরের পৃথিবীতে কত আর সে বিকশিত হবে! তার একটা প্রিয় কাজ বা খেলা যা-ই বলা যাক, ড্রাম-বাজানো। রোজ একটা নির্দিষ্ট সময়ে ড্রাম-বাজানোর অনুমতি তাকে দেওয়া হয় কারা-তরফের পক্ষ থেকে। আর তার কণ্ঠস্বর – তীব্র-তীক্ষ্ণ সে-স্বর এমনই অস্বাভাবিক শক্তিমন্ত যে, তার শব্দে ভেঙে যায় জানালার কাচও। উন্মাদাশ্রমে তাকে দেখতে আসে তার বন্ধুবান্ধব ও চিকিৎসকরা। সশব্দ ও নিঃশব্দ এই দুই জগতে পালা করে দিন কাটে অস্কারের।

অস্কারের পিতামহের ভাগ্যও খুব প্রসন্ন ছিল না। একটা কাঠচেরাইয়ের কারখানার চাকুরে ছিলেন জো। কারখানায় অগ্নিকান্ড ঘটানোর অপরাধে তার নাম ওঠে পুলিশের খাতায় এবং তিনি নিরুদ্দেশ হন। ছদ্মবেশে তিনি পাড়ি জমান মার্কিন মুলুকে এবং আমরা দেখি তিনি একটা নতুন নামে, জো কোলচিক, দেখা দেন সেখানে। আমেরিকায় তিনি একটা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা – অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের আর্থিক কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধান তার কাজ, ইংরেজিতে যাকে বলা যায় ফায়ার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। তার মুখের অস্বাভাবিক লালচে ভাবটাকে তার শারীরিক বৈশিষ্ট্যের মতো দেখালেও আসলে সেটা কাঠচেরাই কারখানার আগুন থেকে পাওয়া অাঁচ-দগ্ধতার পরিণাম। অস্কারের জন্মবৃত্তান্তও সরলরৈখিক নয়। সে তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী জার্মান আলফ্রেড ম্যাটজেরাথের সন্তান নয় এবং নয় সে তার মায়ের প্রথম স্বামী পোলিশ জান ব্রনস্কির সন্তানও। সে যে কার সন্তান সেটা হয়তো একমাত্র তার মায়েরই জানা। যদিও সে সংগত কারণেই তার সৎপিতার পদবিটাই নেয়। এখানেও গ্রাস একটা বেশ বড় ধাক্কা দিয়েছেন উপন্যাসের নায়কের ধারণাতে। সে তো অ্যান্টি-হিরোই। কিন্তু তার জন্মের ধোঁয়াশাজনিত ঘটনা দিয়ে তিনি পারস্পরিক দুটি রাষ্ট্রের এবং দুটি জাতির সন্নিহিতি তৈরি করেছেন। কী হয় নায়কের পদ-পরিচিতি থাকলে এবং কী হয় তার পদ-পরিচিতি না থাকলে। সে কেবল বিশেষ্যনির্ভর একজন মানব হলেই তো চলে। নায়কত্বের ধারণা ভেঙে দিয়ে উপন্যাসের ভরকেন্দ্রে আঘাত হানেন গ্রাস। এটা অবশ্য আমরা ডিকেন্সের উপন্যাসেও দেখি। তাঁর বেশ কটি উপন্যাসে অ্যান্টি-হিরোরাই নায়ক। গ্রাসের নায়কের আরো জটিলতা রয়েছে।

শৈশব থেকেই তার কিছু বিচিত্র বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। কোনো কিছু পছন্দ না হলেই সে প্রচন্ড ভেদী চিৎকার জুড়ে দেয়। হাসপাতালের রোগী থাকা অবস্থায় সে স্বগতোক্তি করে, নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে। সে চেষ্টা চালায় স্মৃতি হাতড়ে তার বিগত জীবনের ঘটনাধারাকে জড়ো করতে। আমরা জানতে পারি তার জীবনের প্রথম তেরো বছর কাটে তার নিজের শহর ডানজিগে। তার প্রশ্ন – আমি কী প্রতিরোধ-দলের পক্ষে কাজ করেছি? আমি কী আমার এই ড্রামটাকে বাজিয়েছি মানুষের জন্যে? উত্তরটাও তার জানা। সে ড্রাম বাজিয়েছিল ধ্বংস-সৃষ্টির জন্যে, তার বাজানোর কাজটা ছিল একটা অশুভ তৎপরতা। ড্রামের তীব্র শব্দে সে ভেঙে দেয় বাজারের দোকানপাটের জানালা এবং তার ফলে চোরের দল সেই ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকে চুরি করে নেয় দামি-দামি সব জিনিসপত্র। তার মানে সে অপরাধ-সংঘটনের নিয়ামক। এদিকে তার মা অভিষিক্ত হয় ক্যাথলিক ধর্মে। এই সময়টাতে জার্মানিতে ক্যাথলিক চার্চ ধর্মবিরোধী ব্লাসফেমি নিয়ে বেশ তৎপরতা চালায়। অস্কার তখন আকৃষ্ট হয় নানদের প্রতি। অস্কারের মায়ের মৃত্যু ঘটে অতিরিক্ত মাছ খাওয়ার কারণে। জার্মানিজুড়ে ব্যাপ্ত হতে থাকে নাজিবাদ। অস্কারের জার্মান পিতা আলফ্রেড ম্যাটজেরাথ যোগ দেয় নাজিদলে। ইহুদিদের প্রার্থনাগারে আগুন লাগিয়ে দিয়ে সেই আগুনে শীত-শরীরে তাপ খোঁজে তারা।

জার্মান আগ্রাসনের সূচনা ঘটতে থাকে। অস্কারের পোলিশ পিতা আবার নাজিবিরোধী, কাজ করত পোস্ট অফিসে। নাজিরা তাকে হত্যা করে। অস্কারের বয়স তখন ষোলো। সে-বয়সেই সে গর্ভবতী করে দেয় মারিয়া নামক একটি মেয়েকে। বিয়েও সে করে তাকেই এবং তাদের সন্তান কার্টের জন্ম হয়। নাজি সমর্থক গ্রেফ নামে এক মুদিদোকানি অস্কারকে একটা ড্রাম বানিয়ে দেয়। আদালত থেকে সমন আসে গ্রেফের কাছে। তার অপরাধ ছিল মারাত্মক নৈতিক স্খলন। আত্মহত্যা করে গ্রেফ। নাজিরা দুদ্দাড় মাটি কাঁপিয়ে ডানজিগে আসে। তাদের সন্ত্রাসে নাভিশ্বাস ওঠে শান্তিপ্রিয় মানুষের। নাজিরা কোনোরূপ হিটলার বিরোধিতা সহ্য করতে নারাজ। কোথাও সেই বিরোধিতার গন্ধ পাওয়ার অর্থ তার সমূল বিনাশ। ততোদিনে ড্রাম বাজিয়ে অস্কার এক ওস্তাদ ড্রামবাদকে পরিণত হয়েছে। তার ড্রামের শব্দে চরাচর কেঁপে ওঠে। অস্বাভাবিক সব কান্ড ঘটাতে সে ওস্তাদ। জানালার কাচ-ভাঙার কৃতিত্বের জন্যে তাকে সবাই  চোরের-মাস্তানদের ওস্তাদ বলে অভিহিত করে। তার সেই ওস্তাদির একটা চরম রূপ আমরা দেখতে পাই যখন সে পরাক্রান্ত নাজিদের পর্যন্ত বিভ্রান্ত করে দেয়। সমবেত নাজিরা মার্চপাস্টে তৎপর আর অস্কার তাদের বাদ্য-বাজনার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজের ড্রামের বাজনা দিয়ে ছন্দছুট-ছত্রভঙ্গ করে দেয় তাদের। তারা আজব এক প্রক্রিয়ায় নিজেদের কর্ম ভুলে অস্কারের নির্দেশনায় চলতে শুরু করে। তারা অদ্ভুত নাচ জুড়ে দেয়। অস্কার তার প্রিয় দুই ব্যক্তিত্ব রাসপুটিন আর গ্যেটের বাণীর একনিষ্ঠ অনুসারী। দুই বিপরীত সত্তার সমন্বয় সে ঘটাতে চায় তার নিজের মধ্যে। যুদ্ধ চলাকালে অস্কার যোগ দেয় একটা দাগী ডাকাতদের দলে। তার অদ্ভুত সব কৃতিত্বের জন্য দলের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে সে। তারা অস্কারকে যিশুখ্রিষ্ট বলে সম্বোধন করে যদিও অস্কার নিজে যিশুভক্ত নয়।

রাশান সৈন্যরা নিয়ন্ত্রণ নেয় ডানজিগের। ধরা-পড়া আসন্ন জেনে অস্কারের বাবা আলফ্রেড তার কাছে থাকা নাজিদলের মার্কা গিলে ফেলতে গিয়ে মারা পড়ে। এই সময়টাতেই অস্কারের জীবনে ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা। অস্কারের ছেলে কার্ট একটা শব-সমাবেশে দাঁড়ানো তার গায়ে একটা পাথর ছুড়ে মারে। অস্কার লাফিয়ে গিয়ে পড়ে কবরের মধ্যে এবং তার হাতে থাকা ড্রাম এবং ড্রামের কাঠি সে ছুড়ে দেয় কবরের ভেতরে। প্রচন্ড জ্বর ওঠে তার এবং সারা শরীর ফুলে যায়, হাত-পায়ের সন্ধিগুলো অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যায়, তীব্র ব্যথায় চলাফেরা কষ্টকর হয়ে পড়ে তার জন্যে। তার শরীরেও ঘটে ধীর অথচ প্রবৃদ্ধি। এদিকে তার স্ত্রী মারিয়া নতুন প্রেমিকের সঙ্গে অভিসারে মাতে কিন্তু প্রেমিক তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে রাজি হয় না। স্বামী-সন্তান নিয়ে সে চলে যায় রাইনল্যান্ডে। অলৌকিক বা দৈবিক বলে প্রতীয়মান বাদ্যশক্তি তাকে ছেড়ে যায়। ড্রামের দুটো পাতলা কাঠি ধরার শক্তিও সে হারিয়ে ফেলে। তার পিঠে কুঁজ দেখা দেয়। তীব্র চিৎকারে জানালার কাঁচভাঙার শক্তিও তার অবশিষ্ট থাকে না। অস্কার সম্পূর্ণ ভিন্ন ও রূপান্তরিত এক অস্কারে পরিণত হয়।

অনেক মৃত্যু আর অনেক ধ্বংসের সাক্ষী অস্কারের নতুন জীবন শুরু হয় যুদ্ধশেষের জার্মানিতে। কোলাহল, বিশৃঙ্খলা আর বিপন্নতার এক নতুন জার্মানি। অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়ে মানুষের পক্ষে। দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী, জিনিসপত্র দুষ্প্রাপ্য আর কালোবাজারিতে ছেয়ে যায় চারদিক। অনৈতিকতার ছড়াছড়ি শহরজুড়ে। অস্কারের ছেলে কার্ট পরিণত হয় একজন কালোবাজারিতে। অস্কারের নতুন পেশা দাঁড়ায় একজন সমাধিফলক-নির্মাতার সহকারী, যার কাজ বিভিন্ন খোদাইয়ের কাজে সহায়তা। অস্কার আবার চিত্রাঙ্ক-খোদাই এসব কাজেও পারঙ্গম। হঠাৎ সে আক্রান্ত হয় মৃত্যুচিন্তায়। জীবনটাকে মনে হতে থাকে অর্থহীন। তার মধ্যে নানান ভাবের উদয় হয়। কিছুদিন সে মডেল হয় বিভিন্ন শিল্পীর – প্রয়োজনে নগ্ন মডেল। জীবিকার তাগিদেই সে করে এসব। শিল্পীরা যখন তাকে আশ্রয় করে তাদের শিল্পকর্ম খাড়া করে তখন অস্কার আত্মগত ভাবে, সবাই তার মধ্যে রাসপুটিনকেই দেখে গেল অথচ তার সত্তার মধ্যে সুপ্তভাবে নিহিত গ্যেটেকে কেউ আবিষ্কার করলো না। কিন্তু পৃথিবীর কী সে অবসর আছে! অস্কার আবার ফিরে যেতে থাকে তার সেই পুরনো ফ্যান্টাসিতে, যদিও এবার আর যুক্তিবিহীন পরিণতির জন্যে নয়, এবারে তা প্রত্যক্ষই অর্থসংশ্লিষ্ট। একটা জাজ-ব্যান্ডের বাদক হতে চায় সে। সরকারি একটা চাকরিও জুটে যায় তার – ব্যান্ড বাজানোর চাকরি। অসাধারণ সাফল্য জোটে তার বাদক হিসেবে। তার নাম ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। তার টিনের ড্রাম পরিণত হয় সোনার খনিতে। তার ড্রামের এমনই কেরামতি যে, লোকে ভাবে, সেই বাদনের আবিষ্টতায় তাদের রোগশোকও ভালো হয়ে যাবে। সে যেন এক চিকিৎসক। একটা নতুন জিনিসের জন্ম হলো – ‘অস্কারবাদ’। সেটা কী! যারা মারাত্মক স্মৃতিবিভ্রমের রোগী, অস্কারের বাদন শুনে তারা তাদের হারানো স্মৃতি ফিরে পায়।

এই সাফল্যের মধ্যেই অস্কারের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে। ডরোথি নামের একটি মেয়ের সঙ্গে সে সম্পর্কে জড়ায় এবং মেয়েটি নিহত হয় অন্য আরেকজনের দ্বারা কিন্তু হত্যাপরাধে শাস্তি হয় অস্কারের। একদিন হঠাৎ তার কুকুরটা মুখে করে কোত্থেকে কুড়িয়ে আনে ডরোথির হাতের আংটি। সেটা নিয়ে সে নজরবন্দি থাকা অবস্থায় পালিয়ে চলে যায় প্যারিসে। ফরাসি ইন্টারপোলের হাতে ধরা পড়লে সে জানায় যে, সে হচ্ছে জিসাস। এখানেই তার ড্রাম-বাদনকাহিনির সমাপ্তি। তার ঠাঁই হয়েছে একটা হাসপাতালে। তার মনে হতে থাকে যে, একটা কালো ডাইনি ক্রমে তার দিকে এগিয়ে আসছে তাকে গ্রাস করবে বলে।

ইতিপূর্বে বলেছিলাম, অস্কার এক অদ্ভুত ধরনের অ্যান্টি-হিরো। গ্রাস তাঁর উপন্যাসটির জন্যে সুস্থ-সমর্থ-ধীরোদাত্ত নায়ক খুঁজে পাননি। এটা তাঁর দোষ না। যুদ্ধ-পরবর্তী জার্মান সাহিত্যে অনেককেই আমরা দেখবো যুদ্ধটা তাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে একটা নতুন উপলব্ধি। সেটাকে বলা যেতে পারে একটা যৌথ অপরাধের বোধ। হিটলার নামের একটা ম্যানিয়াক এক ভয়ংকর ধ্বংসের খেলার মধ্য দিয়ে একটা জাতিকে প্রায় নির্মূল করে দিলো জার্মানি থেকে, পূর্ব ইউরোপ থেকে, এমনকি গ্রিসের মতো দূরবর্তী অঞ্চলের ইহুদিরাও রক্ষা পেল না। সমগ্র ইউরোপের ইহুদিরা উদ্বাস্ত্ত হতে থাকলো দলে-দলে। পাড়ি জমালো তারা আমেরিকায়-ইসরায়েলে। যে পোল্যান্ডে-জার্মানিতে নয়শো বছর ধরে তারা বসবাস করেছে পুরুষানুক্রমে সেই দেশগুলো তাদের মৃত্যুর আয়োজন সম্পন্ন করেছে নিষ্ঠুরভাবে। গ্যাস-চেম্বারে ছাই হয়ে তারা চলে গেছে চিরদিনের আকাশে। এই যে হিটলারের বিরুদ্ধে কিছু করতে না পারা, সভ্যতার লজ্জাকর কোনোভাবে সংঘটন থেকে রক্ষা করতে না পারা – এই উপলব্ধি অনেক সৃজনশীল লেখকের সংবেদনায় উপস্থিত হয় যুদ্ধোত্তর সাহিত্যে। থমাস মানের প্রায় সব উপন্যাসে কিংবা অস্ট্রীয় ঔপন্যাসিক হারমান ব্রখের রচনায় আমরা এমনটি দেখতে পাই। তাঁদের মধ্যে এমন চেতনা জাগে যে, তাঁদের মহৎ সব লেখালেখি শেষ পর্যন্ত মানবতার কোনো কাজেই লাগেনি। কাজেই অস্কারের অদ্ভুতত্বের কারণ বাস্তবের মধ্যেই নিহিত। সে কল্পনা এবং উদ্ভাবনার সমন্বয়। সে যেমন কল্পনার ফসল তাকে বোঝার জন্যে আমাদেরও চাই কল্পনা, যে-কল্পনা এই বিশাল  মানব-ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। কেন অস্কার বড়  হওয়াটাকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়, রেখে নিজেকে বয়স্কদের নির্মম দুনিয়া থেকে দূরে রাখতে চায়, সেটা অস্বাভাবিক হলেও অবাস্তব হয়তো নয়।

অস্কার আসলে এক দারুণ ঠাট্টা ও বিদ্রূপের অভিব্যক্তি। সে না-জার্মান, না-পোলিশ – তার প্রকৃত পিতৃপরিচয় জানা যায় না কখনোই। সে একটা প্রতীক, একটা অবলম্বন। হিটলারের বিশাল যজ্ঞ যা এক দুরারোগ্য ব্যাধি-আক্রান্ত স্বৈরাচারের তৎপরতা তাকে বলতে গেলে কারো পক্ষেই ঠেকানো অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। একপর্যায়ে হয়তো তার পরাজয় ঘটেছে; কিন্তু যে-চিরস্থায়ী ক্ষত সে এঁকে রেখে গেছে সভ্যতার অবয়বে, তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন গ্রাস। বিশাল অবমাননার ইতিহাসের পাতা তিনি মেলে ধরেন তাঁর নিজস্ব ধরনের ক্ষুদ্র-বামন ও অবিকশিত একটি মানব-চরিত্র দিয়ে, যার মানবত্বের ব্যাপারটা আমাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। সে যখন তার নিজের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে তখন সে এই প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ধ্বজাধারী মানুষদের দিকে যারা সমাজ-সভ্যতা-রাজনীতি এসবের নামে আসলে মানবতাকে লাঞ্ছিত ও হত্যা করতেই ওস্তাদ। অস্কার জীবনে অনেক কিছুই হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। সে চেয়েছিল ডাক্তার হতে। সে চেয়েছিল খোদাই-শিল্পী হতে। ড্রামের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সে যে নাজিদের মার্চপাস্ট ছিন্নভিন্ন-এলোমেলো করে দেয় সেটাও কিন্তু ফ্যান্টাসি নয়, সেটা তার বিক্ষুব্ধ-প্রতিবাদী আত্মার প্রতিফলন। এর মাধ্যমে সে অস্বীকার করতে চেয়েছে নাজি কর্তৃত্বকে। অথচ বাস্তবে তার সম্বল সামান্য। গোলাবারুদ-অস্ত্র-ক্ষেপণাস্ত্র সবকিছুর মালিক একনায়ক যে অত্যন্ত সুবিন্যস্ত-সুপরিকল্পিতভাবে আসীন এক মেধযজ্ঞাসনে। অস্কারের কর্মকান্ডে আমরা হয়তো মুহূর্তের জন্যে মানুষের ইচ্ছাশক্তির ক্ষমতাকে দেখতে পাই। বাস্তব অস্কারের সপক্ষে থাকে না বলে তার সমস্ত ইচ্ছাশক্তির মৃত্যু ঘটে। হাসপাতালের বিবমিষাক্রান্ত পরিবেশে অস্কারের পক্ষে এমন বিষাদাত্মক ইতিহাসের পরিণামে কোনো আশা জাগানো সম্ভব হয় না। ফলে উপন্যাসেও আমরা দেখি না কোনো আশার প্রতিফলন। যেখানে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে লাখ-লাখ মৃত্যুখুলির মধ্যে একটিমাত্র আকস্মিক গোলাপ ফুটে থাকে, সেখানে সেই গোলাপকে মনে হতে পারে নিছক দুর্ঘটনাই। অস্কার তাই সেই গোলাপের পরিবর্তে মৃত্যুখুলির দিকেই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। আমরা দেখতে পাই, তার চোখ দিয়ে,

আমার পেছনে কোথাও রয়েছে সর্বদাই কালো ডাইনি এক।

এখন ছাড়িয়ে গেছে আমাকেও, আমার দিকে তাকিয়ে, কালো।

কালো শব্দরাজি, কালো কোট, কালো টাকা।

কিন্তু যদি ছেলেমেয়েরা গায় গান, তারা গান গায় না আর :

কোথায় সেই ডাইনি, পিচের মতো কালো?

এই যে এখানে কালো সেই শয়তান ডাইনি।

হা! হা! হা!

সভ্যতা যাতে স্মৃতিভ্রংশ না হয়ে যায়, আপাত-বিশৃঙ্খলার মধ্যেও শেষ পর্যন্ত ফিরে যায় বিন্যাসের দিকে, সে-কারণেই হয়তো দুঃস্বপ্নের কৃষ্ণ ইঙ্গিতটি গ্রাস রেখে যান সংগীতের ছন্দে বেঁধেই। বিশাল গদ্যের সম্ভারের শেষে এই গান যেন বাতাসে তার অনিঃশেষ রেশ রেখে যেতে-যেতে এগিয়ে চলে। আর আমরা তো জানি যে, শোকের ভাষায় সবসময়েই থাকে নির্দিষ্ট তাল ও  লয়।