যূথবদ্ধ শিল্প

Juth bodho Shilphoইব্রাহিম ফাত্তাহ

এখন ঢাকায় অন্তত ত্রিশটি আর্ট গ্যালারি কার্যকর। সাজু আর্ট গ্যালারি সবচেয়ে পুরনো। সম্প্রতি এর চল্লিশ বছর পূর্ণ হয়েছে। ঢাকার সবল গ্যালারিগুলোর মধ্যে সাজু সবচেয়ে পুরনো। চল্লিশ বছরের মাইলফলক পেরোনো চাট্টিখানি কথা নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর নতুন এই দেশে চারুশিল্পের বিপণন ব্যবস্থা প্রায় বিপর্যস্ত ছিল। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ফিরে রমিজ আহমেদ চৌধুরী নামের এক ভাগ্যান্বেষী যুবক ১৯৭৪ সালে গুলশানে সাজু আর্ট গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করে শিল্পকর্ম বিপণনে এগিয়ে আসেন। এরপর এই দীর্ঘ সময়ে ক্রমান্বয়ে এগিয়েছে বাংলাদেশের চারুশিল্প ও এর বিপণন ব্যবস্থা। এখন এখানে অগ্রজ ও গুণী শিল্পীদের চিত্রকর্মের মূল্য অনেক। এ অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে সাজু আর্ট গ্যালারির অবদান পথিকৃতের।

প্রতিবছরই দেশের খ্যাতনামা প্রবীণ-নবীন চারুশিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে সাজু একটি করে গ্র্যান্ড গ্রুপ আর্ট এক্সিবিশন আয়োজন করে থাকে। চল্লিশ বছরপূর্তিতে এবার তারা আয়োজন করেছে তেত্রিশতম যৌথ শিল্পকর্ম-প্রদর্শনী। ১৯ এপ্রিল ২০১৪ শনিবার অপরাহ্ণে আরম্ভ এ-প্রদর্শনী চলবে ১৮ মে রোববার পর্যন্ত।

প্রদর্শনীতে ৮৭ জন শিল্পীর ১২৭টি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। বরাবরের মতো এই শিল্পীদলের শুরুতে আছেন পথিকৃৎ শিল্পীদের কয়েকজন। যেমন – কামরুল হাসান, এস এম সুলতান, সফিউদ্দীন আহমেদ, আমিনুল ইসলাম, বিজন চৌধুরী, মুর্তজা বশীর প্রমুখ থেকে নবীন রফিক রনি, আমজাদ আকাশ পর্যন্ত। প্রথম থেকে ত্রিশতম আয়োজন অবধি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাজ থেকেছে প্রদর্শনীতে। এখন তাঁর কাজ পাওয়া দুরূহ বটে। তাঁর মৃত্যুরই তো আটত্রিশ বছর সমাগত।

প্রদর্শনীতে কামরুল হাসানের (১৯২১-৮৯) যে-কাজটি প্রদর্শিত হচ্ছে, সেটি উডকাট মাধ্যমের ছাপচিত্র। ২০ গুণিতক ৫৬ সেন্টিমিটার আকৃতির ছাপচিত্রটি ১৯৭৪ সালের। শিরোনাম – ম্যাডোনা। সূক্ষ্ম রেখায় অনেকটা এনগ্রেভিং পদ্ধতির এই উডকাট-চিত্রে জননী ও তার সন্তানের অবয়ব, এক্সপ্রেশন তুলে ধরেছেন শিল্পী তাঁর স্বকীয় ধারায়। বাঙালি রমণীর ললিত শরীরকাঠামো আর অবয়বের লাবণ্য ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী সামান্য রেখার জাদুতে।

শিল্পী এস এম সুলতানের (১৯২৩-৯৪) ১৯৫৯ সালে আঁকা অবয়বকেন্দ্রিক দুটি কাজের মাধ্যম কালি ও কলম। প্রতিমার মতো এক নারীর অধিষ্ঠান হয়েছে শ্মশ্রুমন্ডিত এক পুরুষ অবয়বের ওপরে। নারী এখানে ভাবলেশহীন হলেও পুরুষ অবয়বে ভীতি আর কষ্টের এক্সপ্রেশন। পাশের কাজটি আরো মজার। নানা ফল আর সবজি সাজিয়ে এক পুরুষ অবয়ব তৈরি করেছেন শিল্পী। দুটি কাজেই শিল্পীর সৃজনশীলতার সঙ্গে মজা করার প্রবণতা পাওয়া যায়। পঞ্চাশের দশকে সুলতানের চিত্রপ্রবণতা কেমন ছিল, সেই অনুসন্ধিৎসার কিছুটা জবাব হয়তো মিলবে এতে। ওই সময়টায় শিল্পী নিজের আত্মপরিচয়ের সন্ধানে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর শক্তিমান কৃষক-দর্শন তখনো অনাবিষ্কৃত, তবে তার প্রস্ত্ততিপর্ব চলছে বলেই প্রতীয়মান হয় শিল্পীর কিছু অনুশীলনে। সুলতানের দুটি চিত্রকর্মের শিরোনাম – আদিম যুগ ১ ও ২।

সফিউদ্দীন আহমেদের (১৯২২-২০১২) এচিং মাধ্যমের ছাপচিত্র ‘ক্রন্দন’। বাদামি রঙে ব্যাকগ্রাউন্ড প্রিন্ট করে কালচে রেখায় জ্যামিতিক ফর্মে শিল্পী ফুটিয়ে তুলেছেন চোখ, মুখাবয়ব, মাছ আর পাখির ভঙ্গিমা। সবকিছু মিলিয়ে একটি ক্রন্দনের আবহ তৈরি হয়েছে। সফিউদ্দীনের রেখা এমনই দৃঢ় ও সংঘবদ্ধ যে, বিষয় ‘ক্রন্দন’ হলেও এর আবহ ও পরিবেশনা ভালো লাগে; দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় গঠনের সৌন্দর্যের দিকে। প্রদর্শিত চিত্রকর্মটি শিল্পীর ১৯৮০ সালের রচনা।

আমিনুল ইসলাম (১৯৩১-২০১২) তাঁর প্রায় সমসাময়িক বন্ধু কবি শামসুর রাহমানের (১৯২৯-২০০৬) কবিতা নিয়ে অনেকগুলো ছবি এঁকেছিলেন সিল্কস্ক্রিন মাধ্যমে ১৯৯৪ সালে। তারই একটি ‘কৃতজ্ঞতাস্বীকার’ এ-প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। গতিময়, কালো, মোটা ও চিকন রেখার ছন্দে অাঁকা নকশাকৃতির চিত্র আর কবিতার পঙ্ক্তি মিলে চোখ ও মনকে তৃপ্ত করে। আমিনুলের সহপাঠী শিল্পী বিজন চৌধুরী কালি ও কলমে এঁকেছেন অশ্বারোহীর ছবি – শিরোনাম ‘আমাদের জাতি’! সেই রাজা-রাজড়ার আমলের বীরত্বের লড়াই প্রতিভাত হয়েছে এই অঙ্কনে। মুর্তজা বশীর এঁকেছেন রেখাচিত্র। তাতে এক নারীর প্রোফাইল। এটি তাঁর ২০০৭ সালের কাজ। সৈয়দ জাহাঙ্গীর নদীকে ঘিরে অনেক নৌকাকে নকশায় বেঁধেছেন।

শামসুল ইসলাম নিজামীর পেইন্টিং – ‘কম্পোজিশন’ ১৯৯৮ সালের কাজ। সবুজাভ ক্যানভাসের ভেতর পাথরের ফর্মের প্রয়োগে এই গঠন। উৎসবের আমেজ এসেছে আবু তাহেরের পেইন্টিং ‘আনন্দ’তে। জলরঙের দুর্দান্ত কাজ রফিকুন নবীর ‘রূপসী বাংলা’। ফসলের বোঝা নিয়ে ছুটে চলা দুই গরুর গাড়ি, পেছনে আবছায়া দিগন্তরেখা আর সামনে বাতাসে নুয়ে পড়া ঘাসের এ-ছবিতে বাংলার গ্রামীণ জীবনের সংগ্রাম উঠে এসেছে সাবলীল দৃষ্টিনন্দন ছন্দে।

সমরজিৎ রায় চৌধুরী তাঁর নিজস্ব নকশায় তুলে ধরেছেন বাংলা সংস্কৃতির রূপলাবণ্য – যার শিরোনাম ‘সংস্কৃতির নির্যাস’। মনিরুল ইসলাম এঁকেছেন ‘হলুদ বৃষ্টি’। যেন চরাচরজুড়ে বৃষ্টির সিম্ফনি শোনা যায় এমনই প্রাণবান তাঁর চিত্রকর্ম। ‘প্রকৃতি থেকে’ প্রকৃতির রং আর রূপ নিংড়ে তার ছন্দ রেখার আলিম্পনে নতুন এক প্রকৃতি এঁকেছেন আবুল বারক আলভী। জ্যামিতিক বলয়ের ভেতর থেকে ছন্দময় রেখা ও বর্ণে রঞ্জিত ‘সৃজনের আনন্দ’ এঁকেছেন মাহমুদুল হক। সবুজ রঙের নানা গ্রেড প্রয়োগ করে ‘সবুজে প্রতিবিম্ব’ এঁকেছেন বীরেন সোম। আবদুস শাকুর এঁকেছেন নকশাধর্মী অঙ্কনরীতিতে ‘পাত্রের উপর দাঁড়ানো কাক’। তৃষ্ণার্ত কাকের জলপানের গল্প যেন উঠে এসেছে এতে। ফরিদা জামানের ‘পাখি’ ওই ধাঁচেরই গল্প তুলে ধরে। রঙের সিম্ফনি এঁকেছেন সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, ভিন্ন ধরনের জড়জীবন এঁকেছেন চন্দ্রশেখর দে। নিসর্গের রূপ উঠে এসেছে স্বপন চৌধুরী, মোহাম্মদ ইউনুস, রোকেয়া সুলতানা, মো. নজীব, শায়লা শার্মিন, মাকসুদা ইকবাল, মোহাম্মদ মহসীন, রেজাউল করিম, হামিদুজ্জামান খান, আব্দুস সালামদের চিত্রকর্মে।

বাংলার রূপলাবণ্যের ছবি উঠে আসে আমাদের অনেক শিল্পীর কাজে। প্রকৃতি মানুষের প্রথম পাঠশালা। চারুশিল্পীরা এই পাঠশালার রূপদর্শী শিক্ষার্থী। নিসর্গের রূপলাবণ্যের ছবি এঁকেছেন অনেকেই – সাজুর এ-প্রদর্শনীতে। আবদুল মান্নান এঁকেছেন নদী-তীরবর্তী নৌকার সারি – ‘এই আমার দেশ’ শিরোনামে। আহমেদ শামসুদ্দোহা এঁকেছেন সুন্দরবনের কটকা। মনিরুজ্জামান এঁকেছেন নারী ও নিসর্গ। আনোয়ারুল হক এঁকেছেন রাধাকৃষ্ণ। মিজানুর রহমান এঁকেছেন কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ও প্রকৃতি। জহিরউদ্দিন এঁকেছেন প্রকৃতি। জালাল উদ্দিন এঁকেছেন শঙ্খ নদীর বাঁক। তাঁরা সবাই বাস্তবানুগ ধারায় কাজ করেছেন। প্রকৃতি কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে মিজানুর রহমান ফকির, এঞ্জেলা হক, বিদ্যুৎ জ্যোতি সেনশর্মা, নূরুল আমিন, হুমায়ুন কবির,  রেজাউন নবী, আমজাদ আকাশের চিত্রপটে। নদীর এক প্রান্তে নিঃসঙ্গ এক নৌকা, নদীজলে পারের গাছের ছায়াঘেরা প্রতিবিম্ব অসাধারণ এঁকেছেন ছাপচিত্রী আনিসুজ্জামান। নিসর্গের রূপরস নিংড়ে তার সৌন্দর্য রঙের আলিম্পনে তুলে এনেছেন আসমা কিবরিয়া। সাধনা ইসলাম এঁকেছেন বসন্ত। মোখলেসুর রহমান এঁকেছেন মেঠো গান।

জনজীবনের নানা বিষয়-আশায় ও অবয়ব নিয়ে কাজ করেন কিছু শিল্পী। আবদুস সাত্তার প্রাচ্যরীতিতে ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকেন বাংলার তরুণী নারীর প্রতিকৃতি, অবয়ব। জামাল আহমেদ নারী অবয়ব আঁকেন, বাউলের ছবিও আঁকেন। এ-প্রদর্শনীতে সাত্তার এঁকেছেন সোনাবউ; জামাল এঁকেছেন বৃদ্ধ বাউল। ফারুক আহমেদ কাঠ খোদাই করে গড়েছেন নারী ও পুরুষ অবয়ব। ফুল, পাখি, লতাপাতা, বাঁশিওয়ালা এঁকেছেন প্রয়াত গোলাম সারোয়ার। শাহাবুদ্দিন এঁকেছেন ছুটেচলা ষাঁড়ের গতিময় ছবি। অলকেশ ঘোষ এঁকেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সৌম্য প্রতিকৃতি, সঙ্গে তাঁর গানের কলি – ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে। প্রতিকৃতির ছোট ছোট অঙ্কন সাজিয়ে কম্পোজিশন করেছেন তাজউদ্দিন। পোড় খাওয়া গার্মেন্ট কন্যার অবয়ব এঁকেছেন রণজিৎ দাস। অজানা মুখাবয়ব ফুটিয়ে তুলেছেন মোহাম্মদ ইকবাল। গ্রামীণ নারী বঁটিতে মাছ কুটছে দাওয়ায় বসে, তাকে ধরে আছে সন্তান। এই ছবিটি শেখ আফজালের আঁকা। নারীর মাতৃত্বের অন্তর্গত রূপকে তুলে এনেছেন ছাপচিত্রী সেলিনা চৌধুরী মিলি। পৃথিবীর আবেগ পরিবেশ ও নারী অবয়বে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন জাহিদ মুস্তাফা। সমীরণ চৌধুরী এঁকেছেন বন্ধুত্ব। নারী ও পাখি এঁকেছেন আবদুল আজিজ প্রাচ্যরীতির জলরঙে। রাগি বেড়াল এঁকেছেন গৌতম চক্রবর্তী। স্বপ্নের সাঁতারু এঁকেছেন সৈয়দ ইকবাল। নাসরিন বেগম এঁকেছেন ক্যাকটাস বাগানে বধূ। জলের অতলে মাছের চলাচল এঁকেছেন কামাল কবির। আরো যাঁরা অংশ নিয়েছেন তাঁদের তালিকায় আছেন – অনুকূল মজুমদার, মলয় বালা, ওয়াদুদ কফিল, সুমনা হক, রেবেকা সুলতানা, রফি হক, শামিম সুব্রানা, গুলশান হোসেন, বিপাশা হায়াত, রফিকুল ইসলাম রনি প্রমুখ। ভাস্কর্য গড়েছেন মুকুল মুকসুদ্দিন।

সাজু আর্ট গ্যালারির এ যৌথ প্রদর্শনীতে আমাদের অগ্রজ শিল্পীদের শিল্পভাবনার সঙ্গে নবীনদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মিথস্ক্রিয়া দেখতে পাই। মোটা দাগে আমাদের সমকালীন শিল্প ও শিল্পীদের কাজ করার প্রবণতার ভেতর দিয়ে আমাদের শিল্পের স্বরূপ সন্ধান পাওয়া যায়। এক চিত্রশালার দেয়ালে একসঙ্গে এই দেখা দর্শকদের জন্য সুখকর অনুভূতি আনে বই কি। ১৯ এপ্রিল শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী চলবে আগামী ১৮ মে রোববার প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা।