রক্তফুলের বরণডালা

সে লি না হো সে ন

কবি রাশেদ মুস্তাফা এখন দিল্লিতে।
এর আগে কোনো উপলক্ষে ওর দিল্লি আসা হয়নি। প্রথমবার আসার আনন্দ নিয়ে প্রাণভরে দিল্লির বাতাস বুকে ঢোকাচ্ছে। স্বাধীনতার আটাশ বছর পেরিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওর বয়স ছিল দু-বছর। বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বছরতিনেক আগে মারা গেছেন। বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময় কবিতা লেখা শুরু করেছিল। এখন ভাবে, ওর সামনে কবিতা লেখার সুদিন। দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে, পাঠকের কাছে ওর কবিতা পৌঁছেছে। সমালোচকদের কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েছে। বন্ধুরা বলে, লেখা ছাড়িস না। দাঁড়াতে পারবি। বেশি সময় লাগবে না। এসব শুনলে রাশেদের বুকের ভেতর গুঞ্জন ছড়ায়।
প্রিয়তি বলে, তোমার কবিতায় আমি নিজেকে খুঁজে পাই। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করি। এজন্যই তোমার সঙ্গে আমার প্রেম। আগে কবিতা পড়েছি, তারপরে ভালোলাগা –
সেদিন প্রিয়তির কথায় উৎফুল্ল হয়ে রাশেদ বলেছিল, তোমার ভালোবাসায় আমার কবিতা লেখা নন্দিত হয়েছে প্রিয়তি।
কবিতা নিয়েই ভালোবাসার সম্পর্ক বছর গড়িয়েছে। দুজনের দিন ভালোই কাটছে।
রাশেদ দুদিন আগে দিল্লির সার্ক রাইটার্স ফাউন্ডেশন থেকে সাহিত্য উৎসবে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ পেয়েছে। ই-মেইলটা পড়ে প্রিয়তি নানাভাবে নিজের খুশির কথা জানিয়েছে। একগুচ্ছ গোলাপও রাশেদের হাতে তুলে দিয়েছে। বলেছে, লাল গোলাপের রং আর সৌরভ তোমার জীবনজুড়ে থাকুক।
– শুধু আমার? রং আর সৌরভ তুমি নেবে না?
– নেব তো। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত কী করে বলি যে নিলাম? ধৈর্য ধরো।
– ধৈর্য ধরা আমার শেষ। আমি তোমার ভালোবাসার দেয়ালে ছবি এঁকে শেষ করেছি। দ্বিতীয় চিন্তা নেই।
– ঠিক আছে, কবিতাই হোক আমাদের ভালোবাসার কুঠুরি। চলো আমরা তোমার দিল্লি যাওয়ার আমন্ত্রণ উদ্যাপন করি।
দুজনে রেস্তোরাঁয় ঢোকে।
রাশেদ জানে, এই উৎসবে দেশের অনেকেই যোগ দিয়েছে। তাদের কাছ থেকে নানা গল্প শুনতে পায়। ও জানে, এই ফাউন্ডেশন পাঞ্জাবি ভাষার লেখক অজিত কৌরের উদ্যোগ। প্রতিবছর তিনি একের বেশি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এখন তাঁর প্রতিষ্ঠান সার্ক কালচারাল সেন্টারের এপেক্স বডি। সাউথ এশিয়ার লেখকদের জন্য তিনি একটি বড় জায়গা তৈরি করেছেন। এবারের সম্মেলন হচ্ছে মার্চ মাসে। ওপেনিং সেশন হবে ছাব্বিশে মার্চ। রাশেদ ওর লেখা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কবিতার অনুবাদ করিয়েছে। প্রেমের কবিতা আছে। অন্য কবিতাও লিখছে, যেখানে দেশ আর মানুষের কথা আছে। এভাবে ও নিজেকে গুছিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে ওর মনে হচ্ছে ও একজন পূর্ণ কবি। জীবনের জলছবি আঁকার সাধনায় নিমগ্ন।
ও ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত বাসে এসেছে। কলকাতা থেকে দিল্লিতে এসেছে ট্রেনে। যাত্রার আনন্দও ওকে সুখের জোয়ারে ভাসিয়েছে। ট্রেনযাত্রার বাড়তি আনন্দ ছিল হিমাদ্রি গুহর সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়া। হিমাদ্রি কবি। দিল্লির সার্ক রাইটার্স সম্মেলনে সেও যাচ্ছে। পাশাপাশি সিটে বসার কারণে দুজনের কবি-পরিচয়ের আকস্মিকতা দুজনকে উচ্ছ্বসিত করে। একই সীমান্তের ভিন্ন দেশ, একই ভাষায় কবিতা লেখা। দিল্লিতে গিয়ে অন্য ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় হবে। রাশেদের মনে হয়, ওর পরিচয়ের সীমানা বাড়বে। এ এক দারুণ যাত্রা। এ-সময় প্রিয়তি যদি কাছে থাকত, তাহলে সময়টা অন্যরকম হতো। প্রিয়তি কবিতা লেখে না; কিন্তু বোঝার ক্ষমতা অসাধারণ।
রেলস্টেশন থেকে ট্যাক্সি নিয়ে দুজনে উঠে পড়ে। ওরা অরবিন্দ আশ্রমে যাবে। আয়োজকরা সেখানে তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। দিল্লি শহরের চারদিকে তাকিয়ে রাশেদের মনে খুশির উচ্ছ্বাস। হিমাদ্রিকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কতবার দিল্লিতে এসেছ?
– অনেক অনেকবার। গুনে রাখিনি। এ তো আমার দেশ। আমার শহর।
– এই শহরের চারদিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, এটা আমার ইতিহাসের সময়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
– হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। তোমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমার স্মৃতিতে আছে। আমার বাবা শরণার্থীদের জন্য পুরো নয় মাস কাজ করেছেন।
– সত্যি! তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমার খুব গর্ব হচ্ছে হিমাদ্রি। তুমি আর আমি সারাজীবন বন্ধু থাকব।
– হ্যাঁ, তাই হবে। আমিও তোমাকে মনে রাখব। আমাদের রবিশঙ্কর তোমাদের শরণার্থীদের জন্য নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন।
রাশেদ ওর হাত চেপে ধরে বলে, আমি এখন এ সবকিছু জানি। সবকিছুই আমার যুদ্ধের ইতিহাস। আজ দিল্লির রাস্তায় যেতে যেতে মনে হচ্ছে এই শহর ইন্দিরা গান্ধীর শহর।
হিমাদ্রি হা-হা করে হাসে। রেড সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ছিল বলে ট্যাক্সি-ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দিকে তাকায়। কথা বলে না। মৃদু হাসে। মনে হয় ওদের হাসি-আনন্দ তাকেও ছুঁয়েছে। লোকটি বাংলা ভাষার লোক নন। হিমাদ্রি তার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলেছে। রাশেদ বুঝতে পারে যে, মানুষ তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে মানুষের আবেগের সঙ্গী হয়, এ মুহূর্তে ট্যাক্সি ড্রাইভার তেমন সঙ্গী। ও আবার বলে, আমাদের স্বাধীনতার প্রাণপ্রিয় মানুষ শেখ মুজিবকে আমি দেখিনি। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে দিল্লি তারও শহর। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তিনি লন্ডন হয়ে দিল্লিতে এসেছিলেন। ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিনের জন্য হলেও দিল্লি বঙ্গবন্ধুর শহর হয়েছিল।
হিমাদ্রি আবার হা-হা করে হাসে।
– একাত্তর সালে তোমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরও যুদ্ধ ছিল। আমি ছোট ছিলাম, কিন্তু স্মৃতিতে অনেক কিছু ভাসে। বাবা-মা শরণার্থী মানুষদের বাড়িতে রাখতেন। সবধরনের সহযোগিতা করতেন। দুজনকে কখনো টায়ার্ড হতে দেখিনি।
– কলকাতা হয়ে তো আমি দেশে ফিরব। তখন তোমার বাবা-মাকে সালাম করব। হাত দিয়ে সালাম নয়, তাদের পায়ে আমার মাথা ঠেকাব।
– বাবা-মাকে তুমি তোমার দেশেই দেখতে পাবে।
– তাই? তাঁরা বেড়াতে আসবেন? ভালোই হবে।
– না, বেড়াতে যাবেন না। আমার বাবাকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দেওয়া হবে। তোমাদের সরকার মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতাকারীদের যে-সম্মাননা দিচ্ছে সে-সম্মাননা গ্রহণ করার জন্য বাবাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
– হুররে, দারুণ খবর। তুমিও আসবে বন্ধু। তোমার জন্য আমি একটা কবিতা পাঠের আসর বসাব।
হিমাদ্রি আবার হাসে। হাসতে হাসতে বলে, ছোটবেলায় তোমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দু-তিনটে গান আমার মুখস্থ ছিল।
– তাহলে দুজনে মিলে একটা গানের একটুখানি গাই –
– কোনটা? পুরোটা তো এতদিনে আর মুখস্থ নেই –
– এ গানটা গাই – সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর একটি নাম/ মুজিবর মুজিবর মুজিবর/ সাড়ে সাত কোটি প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম। জয় বাংলা, জয় মুজিবর, জয় বাংলা জয় মুজিবর -।
– দারুণ হবে। হিমাদ্রি নিজের মুঠিতে রাশেদের হাত নিয়ে গুনগুন শুরু করে।
রাশেদ মৃদুস্বরে বলে, আমরা তো সুর ঠিক রেখে গাইতে পারব না।
– আমরা কি শিল্পী নাকি যে, সুর ঠিক রেখে গাইতে পারব? আমরা গান গেয়ে ইতিহাসের একটি বিশেষ সময়কে স্মরণ করছি।
– ঠিক। ঠিক বন্ধু। চলো গাই।
দুজনের কণ্ঠে ছড়াতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গান। দুটো লাইনই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গাইতে থাকে। রাশেদের মনে হয় ওদের কণ্ঠস্বর থেকে দিল্লির বাতাসে মিশে যাচ্ছে মুজিবুর নাম। এ এক বিরল অভিজ্ঞতা। যে-যুদ্ধের সময়ের কথা ওর জানা নেই, সে-সময় আশ্চর্য জীবন্ত এখন ওর সামনে। ও চারদিকে তাকায়। বুকের ভেতরের উচ্ছ্বাস টুং-টাং শব্দে ধ্বনিত হয়। ওর বুকের ভেতর মগ্নতার আবরণে আচ্ছাদিত হয়। একটি-একটি কবিতার চরণ জমতে থাকে করোটিতে। কিন্তু ব্যাগে রাখা ল্যাপটপে সেটা পঙ্ক্তির আকার পায় না। ভাবে, এমন শব্দ বুকেই থাকুক হৃদয়ের অংশ হয়ে।
একসময় দুজনের কণ্ঠের গান থেমে যায়। দুজনে-দুজনের দিকে তাকায়। হিমাদ্রি মৃদুস্বরে বলে, তোমাদের যুদ্ধের গল্পটা ছিল আমার শৈশবের। ভাবিনি ছোটবেলার গল্পের সঙ্গে তোমার-আমার বন্ধুত্ব হবে। আসলে আমি যে ঘটনাকে গল্প বলছি সেটি আর এক দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাস। সে দেশের সঙ্গে আমাদের সীমান্তের সংযোগ আছে।
হিমাদ্রি একটু থামে। রাশেদ কিছু বলে না। ওর কথা শোনার জন্য কান পেতে রাখে। হিমাদ্রি বলে, আমি কলকাতার মানুষ। গড়িয়াহাটায় আমাদের বাড়ি। একটি অনুষ্ঠানে পরিচিত হই শাওন্তীর সঙ্গে। ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে পাশ করে রবীন্দ্রভারতী বিশ^বিদ্যালয়ে পিএইচ-ডি করছে। মাঝেমধ্যে আমাদের বেশ আড্ডা জমে। নানা বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয় উঠে আসে। অনেকের সঙ্গে আড্ডায় কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করলে শাওন্তী খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। আক্ষেপ করে বলত, কেন যে আমার মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্ম হলো। সেই সময়ের কথা শুনলে আমার গৌরব হয়। আবার দুঃখও হয় যখন ভাবি আমার কেন যুদ্ধ করার বয়স ছিল না।
কথা শেষ করে হিমাদ্রি হাসতে হাসতে বলে, স্বাধীনতার স্বপ্ন মানুষের বুকের ভেতর এমনই থাকে।
রাশেদ গুনগুনিয়ে বলে, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার’ পরে ঠেকাই মাথা’ –
হিমাদ্রি রাশেদের দিকে সরাসারি তাকিয়ে বলে, তোমার সঙ্গে এই গান আমারও গাইতে ইচ্ছা করছে। আমাদের পরিবার তোমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরিবার হয়েছিল। প্রতিদিন কত মানুষ যে বাসায় আসত তার ঠিক ছিল না। বাবা-মা তাদের দেখাশোনা করেছেন। আমার বয়সী একটি ছেলের কথা আমার এখনো মনে আছে। সীমান্ত পার হওয়ার সময় পাকিস্তান আর্মির গুলিতে ওর বাবা মারা গিয়েছিল। আমাদের বাড়িতে যে-কদিন ছিল, আমি ওর কান্না ফুরোতে দেখিনি। ওর সঙ্গে খেলার জন্য হাত ধরে টানলে ও আরো জোরে জোরে কাঁদত। তিন-চার দিন পরে বাবা ওদেরকে শরণার্থী শিবিরে দিয়ে আসে। আমি বড় হওয়ার পর কয়েকবার ভেবেছি, ওকে খুঁজতে বাংলাদেশে যাব। বাবা বলেন, কোথায় খুঁজবি? ভেবে দেখ ওদের এক কোটি শরণার্থীর মধ্যে ও একজন। খুঁজে পাওয়া কি সহজ কথা! তাই তো, আমি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকতাম। ভাবতাম, যুদ্ধসময়ের আবেগ কত বিচিত্র হতে পারে আমি তার প্রমাণ।
– ঠিক বলেছ। কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের স্বাধীনতা সহজ কথা নয়।
– এই সাহিত্য সম্মেলনে আমি কয়েকবার এসেছি। এবার তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে যেতে পারছি। এটা আমার বড়ই ভাগ্যের ব্যাপার। জানো, গত দু-চার বছর ধরে আমি ভাবছি আমার শৈশবের স্মৃতি এখন আমার কবিতায় মানুষের অধিকারের পক্ষে লড়াকু হাতিয়ার।
আবার হাসে হিমাদ্রি। বাইরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে বলে, ওই দেখ দিল্লির বিখ্যাত জামে মসজিদ। এই মসজিদের সঙ্গে আমাদের কবি মীর্জা গালিবের স্মৃতি আছে।
রাশেদ নিজের কণ্ঠে ধ্বনিত করে কবির নাম। বলে, গালিব। গালিব। দুশো বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন।
– গালিবের অনেক কবিতা আমার মুখস্থ আছে।
– আমারও আছে। তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব জমবে মনে হচ্ছে। আমাদের চিন্তার সংলগ্নতা আছে।
– সংলগ্নতা! বেশ শব্দ। মনে রাখব।
– এবারের সম্মেলনে আমি আমার চিন্তার সংলগ্নতার কবিবন্ধু খুঁজব। তারপর সাউথ এশিয়ার কবিবন্ধুদের নিয়ে রাখি-উৎসব করব।
– ঠিক আছে, আজ আমি তোমার হাতে লাল সুতো বেঁধে দেব। বন্ধুত্ব বেঁচে থাকার দিন পর্যন্ত থাকবে।
– তোমাকে আমার শুভেচ্ছা বন্ধু।
– আমাদের বন্ধুত্বের লাল সুতো হবে কবিতার পঙ্ক্তি। আমার বর্ণমালার অধিকারের কথা বলব। আমরা অধিকারের চেতনা সাউথ এশিয়ার মানুষের কাছে নিয়ে যাব।
হিমাদ্রি হাসতে হাসতে বলে, এই সম্মেলনে যারা আসবে তাদের সবার কাছে এই কথা বলব।
রাশেদ জোরালো কণ্ঠে বলে, আমি তো প্রথমবার এলাম, এরপর থেকে আমিও শব্দের বারুদ ছড়াব। কাছে টানব সার্ক দেশের লেখকদের। তোমার হাসির শব্দও আমার কাছে বারুদের শব্দ।
হিমাদ্রি হাসতে শুরু করলে রাশেদ হাসে। দুজনের হাসির রেশ শেষ হতে না হতেই ট্যাক্সি এসে থামে অরবিন্দ আশ্রমের গেটে। ট্যাক্সি ছেড়ে গেটে ঢুকতেই রাশেদের চোখ জুড়িয়ে যায়। বলে, বাহ্ চমৎকার আশ্রম। গাছ আর পাখিতে মন ভরে যাচ্ছে।
হিমাদ্রি সায় দেয়। ঘন-ঘন মাথা নেড়ে বলে, এই আশ্রম আমার খুব প্রিয় জায়গা। ভেতরে ঢুকলে দেখতে পাবে এর বিভিন্ন গাছের সৌন্দর্য অন্যরকম। আরো আছে ময়ূরের চলাচল, আছে কূজন। তবে খেতে হবে নিরামিষ। এখানে মাছ-মাংস রান্না হয় না।
– তিনদিন মাছ মাংস না খেলে কিছু এসে যাবে না। থাকার আনন্দই আমার কাছে প্রধান।
হিমাদ্রি ওর ঘাড়ে হাত রাখে। রাশেদ বলে, এতকিছুর মধ্যে সবার সঙ্গে বেশ সময় কাটবে।
– দিল্লি শহর দেখবে না?
– হ্যাঁ, তা তো দেখবই। গান্ধীজির স্মৃতিসৌধে যাব। কবি গালিবের কাছে যাব।
হিমাদ্রি ভ্রু উঁচু করে কৌতুকের ভঙ্গিতে বলে, কবির কাছে যাবে? জিজ্ঞেস করবে নাকি কেমন আছেন কবিভাই?
– মনে করো, তেমন একটা কিছু।
– তুমি প্রেমে পড়েছ রাশেদ?
– আমি যাকে ভালোবাসি তার নাম প্রিয়তি। কবিতা বোঝায় ওর জুড়ি নেই। দারুণ মেয়ে।
– তুমি ভাগ্যবান। আমি তোমাকে ঈর্ষা করি। আমি একজনকে ভালোবেসেছিলাম। ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন আমি মনে করি, কবিতার সঙ্গে আমার প্রেম। নারীর প্রেমের দরকার নেই।
– নিজেকে সান্ত¡না দিচ্ছ?
– যদি তুমি তা মনে করো তাহলে তা-ই করছি।
হাসতে হাসতে দুজনে আশ্রমের ভেতরে ঢোকে। শিমুলগাছের নিচ দিয়ে সামনে যায়। দুজনের জন্য দুটো ঘর বরাদ্দ হয়েছে দোতলায়। দুজনে যার যার ঘরে চলে যায়। রাশেদের ঘরের জানালার পাশে ফুটে আছে লাল রঙের ফুল। গাছটি লতাঝোপ। রাশেদ নিজের মনে কবিতার পঙ্ক্তি আওড়ায়। ভাবে, একটি সিম কিনে মোবাইল ফোন চালু করবে। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে বিকেলে ক্যান্টিনে চায়ের খোঁজে যায়। ঘরে তেমন কেউ নেই। চায়ের কাপ নিয়ে টেবিলে বসলে পাশের টেবিল থেকে পাকিস্তানের কবি হামিদ আলি বলে, আপনি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?
– হ্যাঁ, আমি রাশেদ মুস্তাফা। কবিতা লিখি।
– আমিও কবিতা লিখি। আমার নাম হামিদ আলি। আপনি কি আগে এই সম্মেলনে এসেছেন?
– না, এবারই প্রথম।
– আমি আরো তিনবার এসেছি। এই লিটারেরি ফেস্টিভ্যাল আমি খুব এনজয় করি।
কথা বলতে বলতে হামিদ আলি রাশেদের টেবিলে এসে মুখোমুখি বসে। চায়ের কাপের বাকি চা এক চুমুকে শেষ করে। দু-হাত টেবিলের ওপর রেখে বলে, আগামীকাল ছাব্বিশে মার্চ। আপনাদের স্বাধীনতা দিবস। ওপেনিং সেশনে আমাকে কিছু বলতে বলা হয়েছে। আমি ঠিক করেছি, আমি বাংলাদেশের লেখকদের স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাব। বক্তৃতার শেষে পাকিস্তান সরকারকে আহ্বান জানাব বাংলাদেশে গণহত্যা করার জন্য ক্ষমা চাইতে।
– তাই কি? রাশেদ দুচোখ বিস্ফারিত করে তাকায়।
– হ্যাঁ, আমি নিজের দেশেও এ-কথা বলি। আমি ইসলামাবাদে একটি দৈনিক পত্রিকায় কাজ করি। আমি বিশ^াস করি, কবিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়।
– তুমি আমার বন্ধু।
হামিদের হাত জড়িয়ে ধরে রাশেদ। দুজনে চা শেষ করে গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়।
– তুমি কি কোথাও যাবে?
– হ্যাঁ, মোবাইলের জন্য একটি সিম কিনতে যাব।
– চলো, আমরা হেঁটে আসি। এ-রাস্তার নাম বেগমপুর। বেশ নিরিবিলি। আমার হাঁটতে ভালো লাগে।
রাশেদের মনে হয় হামিদের হাতের উষ্ণতা ওকে জড়িয়ে রেখেছে।
ওর সামনে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভেসে ওঠে। গণহত্যার কালরাত ওকে পীড়িত করে। নয় মাসের জনযুদ্ধ ওর স্বাধীনতা অর্জনকে গৌরবান্বিত করে। ওর সামনে দাঁড়ানো হামিদ আলি ওর জানা মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন ইতিহাস হয়ে ওঠে। হামিদ আলি গণমানুষের অধিকার আদায়ের লড়াই। হামিদ আলি গণতহ্যার প্রতিবাদ। হামিদ আলি স্বাধীনতাকে দেওয়া গৌরবের স্যালুট।
হামিদ আলি ওর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলে, কী ভাবছ? আমি বাংলাদেশে গিয়েছি। ওখানেও আমার কথা বলেছি। নিষ্ঠুর গণহত্যার বিরুদ্ধে আমি কথা বলে যাব। কবিতা আমার শিল্পের লড়াই। যে-কোনো জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার যুদ্ধকে আমি নিজের গৌরবের জায়গা ভাবি। স্বাধীনতা কি সহজ কথা!
ওহ্, শব্দ করে দুহাত ওপরে তোলে রাশেদ। মনে হয় ওর সামনে লাখো শহীদের মুখ ভেসে উঠছে। বিশেষ করে তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, যাদের ও ছবিতে দেখেছে। রাশেদ দুহাতে চোখের পানি মোছে।
হামিদ তাকিয়ে বলে, চোখে পানি কেন?
– শহিদদের স্মরণ করছি। লাখো প্রাণের বিনিময়ের স্বাধীনতা তো।
– হুঁ, শব্দ করে হামিদ আলি গুনগুনিয়ে কবিতা আওড়ায়। নিজের কবিতা কিনা, তা ওকে আর জিজ্ঞেস করা হয় না রাশেদের। শুধু ওর মুখে উর্দু ভাষার শব্দরাজি শুনে একুশে ফেব্রুয়ারির কথা মনে হয়। মাতৃভাষার জন্য লড়াই। রাশেদ ভাবে, হামিদ আলির দেশের চেয়ে ওদের গৌরবের জায়গা অনেক বড়। ওর বুকের ভেতর খুশির উচ্ছ্বাস গড়ায়। মনে হয় একছুটে দিল্লির মাঝে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়াতে, কিন্তু হবে না। কাল ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান হবে। এবার ওর যমুনা নদী হয় তো দেখা হবে না। আবার এলে যমুনার পাড়ে গিয়ে দাঁড়াবে। বলবে, আমি বাংলাদেশের যমুনা নদীর পানি এনে তোমার গায়ে ছিটিয়ে দেব, দিল্লির যমুনা – এর মধ্যে তৈরি হবে আমার কবিতা।
দুজনে গিয়ে মোবাইলের সিম কিনে ফিরে এলে গেটের কাছেই দেখা হয় হিমাদ্রির সঙ্গে। ও দুপুরে খেয়ে কোথাও গিয়েছিল, ফিরে এসেছে পড়ন্ত বিকেলে। চারদিকে নরম রোদের ছায়া বিছিয়ে আছে। দূরে তাকালে দেখা যায়, অরবিন্দ আশ্রমের দেয়ালে লেজ ঝুলিয়ে বসে আছে ময়ূর। তিনজনই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। হামিদ আলি মৃদু হেসে বলে, এটা আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। আমি এত কাছ থেকে ময়ূর দেখিনি।
রাশেদ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, কাল দিনের প্রথম আলোয় আমি ময়ূরটাকে দেখব।
হিমাদ্রি সায় দেয়, আমিও দেখব। দারুণ লাগছে।
আমিও দেখব।
হামিদ আলি একসঙ্গে যুক্ত হলে হিমাদ্রিকে ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় রাশেদ। বলে, হামিদ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু।
হিমাদ্রি জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকায়।
মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু কীভাবে? যুদ্ধের তো আটাশ বছর পেরিয়ে গেছে।
তখন আমি ছোট ছিলাম। আমি বাংলাদেশের এখনকার বন্ধু। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে-গণহত্যা করেছে তার জন্য ক্ষমা চাইতে বলি।
হিমাদ্রি গলা উঁচিয়ে বলে, সে-সময়ে আমিও ছোট ছিলাম; কিন্তু আমার বাবা-মা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। বিশেষ করে শরণার্থীদের জন্য তারা নিজেদের বাড়ির দরজা খুলে রেখেছিলেন। কত যে মানুষ আমি দেখেছিলাম।
– বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার কথা আমি জানি। ছোটবেলায় আব্বার কাছ থেকে জেনেছি। বড় হয়ে ইতিহাস পড়েছি।
হুররে কবিতার বন্ধুত্বে মুক্তিযুদ্ধ। চলো যাই, আমি তোমাদের মিষ্টি খাওয়াব।
রাশেদ দুজনের হাত ধরে। নিজের মুঠিতে দুজনকে এক করে।
হিমাদ্রি হাসতে হাসতে বলে, আমাকে দুটো মিষ্টি বেশি দেবে।
– কেন? তোমাকে বেশি কেন?
– যুদ্ধের সময় আমরা ওদের বন্ধু ছিলাম।
হামিদ আলির কণ্ঠস্বর বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়। বলে, তোমরা বন্ধু থাকতে পেরেছিলে। কারণ তোমার দেশের সরকার আর সাধারণ মানুষ এক ছিল। আমার বাবা যখন গণহত্যার প্রতিবাদ করেছিল, তখন আমার বাবার মতো অনেকের পাশে পঁচানব্বই ভাগ সাধারণ মানুষ ছিল না। সরকার তো ছিল হত্যাকারী।
হিমাদ্রি হিম হয়ে যায়। হামিদের দিকে সরাসরি তাকাতে পারে না। বুঝতে পারে, ওদের লড়াই ছিল অনেক কঠিন।
হামিদ আলি অপরূপ ময়ূরের ওপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ওদের দিকে সরাসরি তাকায়। বলে, আমাদের বাবাদের মতো লোকদের লড়াই ছিল নিজেদের মানবিক চেতনা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিল, একটি দেশের আপামর মানুষ খারাপ হতে পারে না। গোটা জাতি হত্যাকারী নয়।
রাশেদ আর হিমাদ্রি নিজেদের না-জানা এক ভিন্ন ইতিহাসের পৃষ্ঠার সামনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। রাশেদের মনে হয়, কবি হামিদ আলির কণ্ঠস্বর দিল্লির যমুনা নদীর স্রোতে ছড়াচ্ছে বিশ্বময়। এক বিপুল সত্যের স্রোত ওদের চারপাশে। দুজনে নিজেদের অজান্তে পরস্পরের হাত ধরে। হাতের মুঠি শক্ত হয়। ভেসে আসে কবি হামিদ আলির কণ্ঠস্বর, আমার বাবার মতো অনেককে ওরা বিশ্বাসঘাতক বলত। পরে কেউ কেউ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন।
রাশেদ আর হিমাদ্রির অস্ফুট উচ্চারণ, বিশ্বাসঘাতক!
হামিদ আলি মাথা ঝাঁকায়।
অরবিন্দ আশ্রমের গাছপালার মাথায়, আকাশ-বাতাসে উড়তে থাকে কবিতার শব্দরাজি। রাশেদের মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের এটা এক অন্যরকম গল্প। বাতাসে উড়ে যাওয়া শব্দরাজি টেনে রাশেদের বুকের ভেতর গল্পের অনুভব জমে থাকে।
পরদিন ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে শুরু হয় সাহিত্য সম্মেলন। হামিদ আলি কবিতা পড়ার আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে মাফ চায়। করতালিতে মুখরিত হয় মিলনায়তন। হিমাদ্রি তালি বাজিয়ে বলে, মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা নেওয়ার সময় বাবা ঢাকায় যাবে। আমিও যাব। হামিদ তোমার অতিথি হবে রাশেদ। তুমি ওকে নিমন্ত্রণ কর। আমরা তিনজনে সাভার স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে যাব।
– অবশ্যই নিমন্ত্রণ করব। সাহিত্য সম্মেলনে এসে আমি যে দুই বন্ধু পেলাম তারা আমার মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। একদমই অন্যরকম কবিতা।
রাশেদ দুহাতে চোখের পানি মোছে।
ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের বাতাসে উড়ে যায় শব্দরাজি। ওই শব্দ ঠোঁটে নিয়েছে অরবিন্দ আশ্রমের পেখম মেলে রাখা ময়ূর। রাশেদ ভাবে, ও আরেকটি একাত্তরের সময়ে আছে। ও পৌঁছে যায় নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে। রবিশঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসন-আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশে’ গলা মেলায়। কনসার্টের শব্দরাজি মৌমাছির গুঞ্জন নিয়ে বুকের ভেতরে ঢুকছে।
মিলনায়তনে তখনো করতালি চলছে।
রাশেদের মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের শহীদের রক্তফুল উপস্থিত সবার করতলের বরণডালায় জমা হয়েছে। কবিতার শব্দরাজি শোভিত হয়ে উঠছে বরণডালার ফুলে। ওর সামনে একাত্তর ফিরে আসে। বিকেলে কবিতা পড়ার জন্য ওর নাম ঘোষণা করা হয়। রাশেদ স্টেজের সিঁড়িতে পা রেখে নিজেকে বলে, আজ আমার আরেক শুরু। ভালোবাসার প্রিয়তি, তোমার জন্য কবিতা বলতে বলতে মঞ্চে উঠছি – বরণডালার রক্তফুলে ভালোবাসার স্বপ্নকুঁড়ি। আমরা দুজন সাজাই এখন একাত্তরের নতুন দিন।
কবিতা পড়া শেষ হলে আবার করতালিতে মুখরিত হয় মিলনায়তন। নিচে নেমে এলে হামিদ আলি বলে, তুমি এ-সময়ের একাত্তর। ভালো লেগেছে তোমার কবিতা। হিমাদ্রি মৃদু হেসে বলে, দারুণ লিখেছ। কবি তো সময়ের একজন। তুমিই তোমার জাগিয়ে রাখা একাত্তর।
রাশেদ চারদিকে তাকায়। এখন প্রিয়তির সঙ্গে প্রেমই ওর একাত্তর। নতুন অনুভবে জীবনের নতুন মানে খোঁজা।