রবিউল হুসাইনের কবিতা ওড়ে জীবনের শত পতাকা


থাটা বলেছিলেন বোর্হেসই, একটা বিশেষ সময়ে একজন ব্যক্তিমানুষ যে-অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে তাঁর সময়টা অতিক্রম করেন, সে-অভিজ্ঞতাই তাঁর লেখায় প্রতিফলিত হয়। শুধু বোর্হেস নন, শিল্পসাহিত্যে নিবেদিত প্রত্যেক মানুষের কথা এটি। বোর্হেস এ-বিষয়টিকে আয়নার রূপকে তুলে ধরেছেন, ‘শিল্প হচ্ছে সেই আয়না যা আমাদের মুখটাকে দেখতে সাহায্য করে।’ এই মুখ, বলা বাহুল্য, আমাদের মনোজগতের প্রতিবিম্ব, অর্থাৎ সৃষ্টিশীল রচনা। পুনরুক্তি হলেও রবিউল হুসাইনের কবিতা-প্রসঙ্গে এ-কথাগুলো উল্লেখ করছি এই কারণে যে, রবিউল হুসাইনের সামগ্রিক শিল্পযাপনেরই অংশ হয়ে উঠেছিল তাঁর কবিতা। এটা ঘটতে শুরু করেছিল তাঁর লেখক-জীবনের শুরু থেকেই। তিনি শুধু একজন কবি নন, ছিলেন আমাদের
সমকালীন জাতিগত সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও চর্চার পুরোধা ব্যক্তিত্ব। কতটা তিনি এসবের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন, কতটা এ-বিষয়গুলো তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে প্রভাবিত করেছিল, অপ্রয়োজনীয় প্রবন্ধ শীর্ষক তাঁর প্রবন্ধ-সংকলনটির লেখাগুলো পড়লেই তা বোঝা যায়।

দুই
রবিউল হুসাইনের সৃজনীসত্তার অনেক সূত্র অপ্রয়োজনীয় প্রবন্ধ বইটির একত্রিশটি প্রবন্ধে নানাভাবে উৎকীর্ণ হয়ে আছে। বিশেষ করে কবিতা নিয়ে যেসব প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন, সেসব প্রবন্ধে তাঁর কবিতা-সম্পর্কিত ভাবনার কথা পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে অন্য প্রবন্ধগুলোতে তিনি কীভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারও বিবরণ আছে; আর ওই বিবরণের মধ্যেই তাঁর শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কিত ভাবনার সূত্রগুলো রয়ে গেছে।
কবিতায় একধরনের ‘অঙ্গীকার’ থাকে আর তা হলো ‘ভালো কবিতা লেখা।’ ‘সাম্প্রতিক কবি ও কবিতা’র কিছু কথা শীর্ষক প্রবন্ধটি এভাবে শুরু করে রবিউল হুসাইন লিখেছেন, ‘কবিতার কথার মধ্যে থাকবে ভবিষ্যতের বীজ, যেগুলো পরবর্তীকালে এক-একটি শূন্য বা ফসলে রূপ নেবে এবং সেখান থেকে আবার বীজ ও শস্যের জন্ম হবে। এভাবেই চলবে এর পরম্পরা।’ কবিকে, কৃষকের রূপকে উপস্থাপন করে লিখেছেন, ‘সমগ্র মনুষ্য পরিবারের’ সচেতন প্রতিনিধি হিসেবে কবির অঙ্গীকার হচ্ছে ‘মানুষের অধিকার’কে শিল্পে রূপান্তরিত করা। কবিতা হচ্ছে সবকিছুর সারসংক্ষেপ : বোধ, দর্শন, বিবেচনা, জ্ঞান, ধারণা, হিংসা, প্রেম, ঘৃণা, যুদ্ধ, হত্যা, ধূর্ততা, শঠতা, ক্লেদাক্ততা, অনুভব, অবমাননা, প্রতিটি মানবিক পঞ্চইন্দ্রিয়জাত বোধের প্রকাশ। এ-কবিতা যিনি লিখবেন, সেই কবিকে হতে হবে ‘আধুনিক, উদার, দৃষ্টান্তমূলক, আদর্শ ও অগ্রসরমান।’ তিনি ক্ষুদ্র স্বার্থ ও সুযোগসন্ধানী মনমানসিকতা ত্যাগ করে ‘মানবিক ধর্মে দীক্ষিত’ হয়ে ‘মুক্তবোধচর্চার ফসল’ হিসেবে কবিতা রচনা করবেন। কবির এই ভূমিকার কথা বলার পাশাপাশি কবি-প্রসঙ্গে আরেকটি রূপক ব্যবহার করেছেন তিনি, সেটা হলো চিকিৎসকের :
সাধারণভাবে কবিতা একটি নিয়মিত ব্যক্তিগত উচ্চমার্গীয় রোজনামচা লেখার নিয়তি, একা একা নিজের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বা হৃদয় ও বোধসংক্রান্ত যাবতীয় চর্চায় আমূল নিমজ্জিত থেকে, নিজে চিকিৎসক সেজে নিজের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ অসহায়ভাবে দেখা। সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ পায় নিত্যনতুন বোধের প্রকাশে, শব্দের মাধ্যমে। এখানে কবি হন চিকিৎসক, আবিষ্কারক, সৃষ্টিশীল একজন স্রষ্টা, নিত্যনতুনপ্রয়াসী, চিরজাগরূক ও অনুভূতিসম্পন্ন।
রবিউল হুসাইনের মতে, এই হচ্ছেন কবি। এই সংবেদনার পাশাপাশি কবিতার কলাপ্রকরণ নিয়েও কবিকে সচেতন হতে হবে। অনায়াসলব্ধ শিল্পসুষমাহীন ক্লিশে শৈলীকে পরিহার করে ‘শিল্পগুণসম্পন্ন’ কবিতা লিখতে হবে কবিকে। এ-কথাটি অভূতপূর্ব নয়, অনেক কবিই কবিতার রচনারীতির বিশিষ্টতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু রবিউল হুসাইন কীভাবে সেটা দেখেছেন, সে-দিকটিও তাঁর কবিতার চারিত্র্য উন্মোচনে সহায়ক হতে পারে। তিনি বেশ স্পষ্ট করেই বলেছেন, কবিতা ‘নিয়মসর্বস্ব একটি শৈলী’। ‘তুমি-মার্কা’ কবিতার সৃষ্টি হোক; কিন্তু তা শিল্পগুণসম্পন্ন হতে হবে। তিনি লক্ষ করেছেন, কবিতাচর্চা এদেশে এখন পর্যন্ত দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমেই হয়ে আসছে। প্রতি সপ্তাহে বিপুলসংখ্যক কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ছাপা হচ্ছে কিন্তু সাহিত্যের মান বাড়ছে না। এখন কবির ‘মাথায় ও বোধে হাজারটা অ্যান্টেনা জুড়ে দেওয়া’ আছে এবং ‘কবিতা গঠনমূলক, সৃষ্টিমূলক, অবশ্যই এর নিয়মনীতি নির্দিষ্ট’ আছে। এসবের মধ্য থেকে কবিকে ‘নতুন পথের সন্ধানে ব্রতী হতে হবে যুগের এবং সময়ের প্রয়োজনে। এই বিষয়ে কর্ষণ ও আহরণ খুবই প্রয়োজন। স্বভাব-কবির যুগ এখন নেই, স্বাভাবিক কবির যুগ এখন। এখনো যেহেতু কবিতা সর্বগ্রাসী, সর্বত্রগামী সেইজন্য কবিকেও অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের জন্য এইরূপ পরিণত হওয়ার প্রয়াসে নিয়মিত হতে হবে।’
রবিউল হুসাইন এই যে কথাগুলো বললেন, তা ছিল তাঁর পরিণত জীবনের ভাবনা। কিন্তু কবিজীবনের শুরুতেই তিনি বুঝেছিলেন যে, গতানুগতিক পথে নয়, প্রচলিত নান্দনিক রীতি আর ভাবাদর্শকে পরিহার করে বা কম গুরুত্ব দিয়ে সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত হতে হবে। এই লক্ষ্যেই গত শতকের শেষদিকে তিনি যখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্র, তখন না নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন। সতীর্থ কবি-যশোপ্রার্থীদের সঙ্গে নিজে জোর দিয়েছিলেন ‘অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের’ ওপর। লিখতে শুরু করেছিলেন নতুন ধরনের কবিতা। ফরাসি কবি অ্যাপলেনিয়রের দ্বারা প্রভাবিত ছিল সেসব লেখা। কবিতার সম্পূরক, যাকে তিনি বলেছেন ‘ছবির রেখা’ বা ‘ছবিতা’, তাই দিয়ে কবিতা রচনা করেছিলেন। নিজেই জানাচ্ছেন :
এই রকম দুটো কবিতা এঁকে লিখেছিলাম, মাতাল এবং সাপ। এছাড়া লম্বিত খাড়া এবং আনুভৌমিক লাইনের আঁটসাঁটবদ্ধতাধর্মী কবিতাও ছিল। বক্তব্য, বিষয় ও ছবি মিলে এই প্রয়াস খুব দুরূহ আর ছাপাছাপিও বিশেষ মনোযোগ ও কষ্টের। এরকম কংক্রিটধর্মী কবিতার বোধহয় এখানে সেবারই সর্বপ্রথম সূচনা হয়। যদিচিহ্নহীন, ঠাসবুনুনি, লাইনন্দী, জগদ্দল শব্দমালা দিয়ে কবিতা, অঙ্কের যোগ, গুণ, ব্রাকেট দিয়ে এবং সর্বোপরি প্রেমহীন যৌনতার বাড়াবাড়ি, যৌনহিংসা অথবা যৌনক্ষুধাসম্বলিত প্রগলভপূর্ণ যৌনপলায়নী মনোবৃত্তিমূলক সাবলীল উচ্চারণে পঙ্ক্তিমালা রচিত হয়েছিল।
এ-সময়েই প্রকরণের দিক থেকে নতুন ধরনের কবিতা রচনার পাশাপাশি বিষয়-ভাবনারও প্রসারণ ঘটছিল নানা ধরনের পশ্চিমী ভাবার্পণের মাধ্যমে :
ঢাকার সাহিত্য আবহাওয়াতে তখন ক্ষুদে পত্রিকার ধুম। বিলেত আর আমেরিকার বীট, রাগী, কলকাতার হাংরি বা ক্ষুধার্ত গোষ্ঠীর লেখালেখি আর ওদিকে সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী গল্প-উপন্যাস এবং এর সঙ্গে কামু-কাফকার অন্ধকারমগ্ন শিল্পসাক্ষাৎ আমাদের হয়েছে। ককতো-রায়-বেরীম্যানের চলচ্চিত্র এবং লুই কানের স্থাপত্য সব চাক্ষুষ দেখেছি। রাজনীতিতে ভাষা আন্দোলন থেকে জাতীয়তাবাদী মানসিকতার রূপরেখা ও তার বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া চলছে দ্বিজাতিতত্ত্বের সৃষ্টি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতায়। এক ধরনের মানস-ছুট্ সেই আবহাওয়ার আবেশ।
উল্লিখিত উদ্ধৃতির শেষের দিকে যে ‘পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক’ প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন রবিউল হুসাইন, পরবর্তীকালে স্বাধীনতা-উত্তর সময়পর্বে দেখা যাবে কবিতা রচনা ছাড়াও কবিদের মানবিক শ্রেয়োবোধের প্রতি একধরনের ‘বিশ্বাস ও প্রত্যয়’ থাকা উচিত বলে উল্লেখ করেছেন। কাজও করেছেন এর সপক্ষে।
কবিহৃদয় সবসময় সুন্দরের মঙ্গলের এবং কল্যাণের জন্য আকুল। দুঃখ-বেদনা, জাগতিক ও মানসিক অনাকাক্সিক্ষত কোলাহল, সামাজিক ও দৈশিক অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তসমূহ, ব্যক্তিগত ও মনোগত উপেক্ষা, অপমান ও অবিচার Ñ সবকিছুর উজানে জেগে রয় স্বপ্ন ও আলোকের উজ্জ্বল বিকিরণ। মানুষের শ্রেয়োবোধের উত্থান ও পরিচর্যা সব শিল্পেরই মুখ্য উদ্দেশ্য।
জীবনানন্দ দাশের কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে এই কথাগুলো বলেছিলেন রবিউল হুসাইন। কথাগুলিকে বিস্তৃত করে আরো জানিয়েছেন, ‘কবির যাবতীয় বোধ আর চেতনা অন্ধকারের ভেতরে শাশ্বত আলোকবর্তিকার মতো উদ্ভাসিত Ñ সবই প্রভাত, সবই সূর্যোদয়।’ কবিতা হচ্ছে এই মহত্তম অনুভবের শাব্দিক রূপ আর প্রগাঢ় উচ্চারণ। দ্বন্দ্ব ও সংঘাতময় পরিবেশ-প্রতিবেশে কবিতা আশা ও স্বপ্নের কথা বলে যায়।
আমরা মানুষ মাত্রই বেদনার সন্তান। পৃথিবীর সভ্যতা, ইতিহাস সমাজ সব এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু দিন দিন মানুষের প্রতি ভালোবাসা কমে যাচ্ছে কিংবা বলা যায় পিছিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগতভাবে। এই বৈরী-বিপরীত পরিবেশেও মানুষ পরাজিত হয় না, তার স্বপ্নের ভেলা সংঘাতময় জলস্রোত পাড়ি দিয়ে তরতর করে আগুয়ান হয়, মানুষের জয়গান গায় আর স্বপ্নের কথা বলে।
মানবজীবনের এই বিপ্রতীপ অনুভবই কবিতা। এই অনুভবই মানবধর্মের লক্ষ্য বলে মনে করেছেন রবিউল হুসাইন :
কবিতা যেন ধ্যানের গভীরতম অনুভব যা সন্ন্যাসব্রতের কথা মনে করিয়ে দেয়, আরও মনে করায় কবিতা এক পবিত্র জীবনঘন ও প্রকৃতিঘন আত্মোপলব্ধির মন্দ্রিত মন্ত্রপূর্ণ উজ্জ্বলিত উচ্চারিত মানবধর্মের সারাৎসার।
উল্লিখিত আলোচনা থেকে সহজেই কবিতা সম্পর্কে রবিউল হুসাইন কী ভাবতেন, সূত্রবদ্ধ করা যায় :
[১] কবিতায় কবির থাকতে হয় একধরনের অঙ্গীকার যা
ভবিষ্যপ্রসারী।
[২] কবি সমগ্র মনুষ্য-সমাজের সচেতন প্রতিনিধি।
[৩] কবিতা মানবীয় বোধের প্রকাশ। মানবিক প্রতিটি বিষয়
কবিতা ধারণ করে থাকে।
[৪] কবি হবেন মানবধর্মে দীক্ষিত। মুক্তবোধসম্পন্ন মানুষ।
[৫] মানুষের যন্ত্রণা-আর্তি কবি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেন।
[৬] কবিতায় থাকে নিয়মবদ্ধ শৈলী।
[৭] কবিতাকে হতে হয় শিল্পগুণসম্পন্ন সৃষ্টি।
[৮] কবিতায় অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের ওপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
সমস্ত শিল্পই হয়ে উঠতে পারে এই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার
উৎস।
[৯] কবিতা রচনা করতে হবে মানবিক শ্রেয়োবোধের ওপর
ভিত্তি করে।
[১০] কবিতা হচ্ছে মহত্তম অনুভবের শাব্দিক প্রগাঢ় উচ্চারণ।
[১১] দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কথা কবিতায় থাকবে, তবে কবি লিখবেন
আশা ও স্বপ্নের কথা।
[১২] কবিতা আত্মোপলব্ধিজাত মানবধর্মের সারাৎসার।

তিন
আন্তোনিয়ো মাচাদো একবার বলেছিলেন, ‘কবিদের হাতে রয়েছে সূক্ষ্ম তন্তু, এই তন্তু দিয়েই আমাদের স্বপ্ন, শুধুই স্বপ্ন, বুনে যেতে হবে।’ এই বুনে যাওয়াটাই একধরনের বৃত্ত। রবিউল হুসাইনের মধ্যেও এই বৃত্তাবদ্ধ মানুষের বোধটাই প্রখর। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত তাঁর আমগ্ন কাটাকুটি খেলা (২০১২) কাব্যগ্রন্থের শুরুর কবিতাটির একটা অংশে আছে :
ঘুরছি আমি ঘুরছি আমি জীবন নিয়ে
আমিই আমার লাটিম হয়ে নিরবধি
ঘুরছি আমি বৃত্তের ভেতর ঘুরছি আমি
ঘুরছি আমি ঘুরবো আমি
মধ্যবৃত্তে মৃত্যুবধি ঘুরছি আমি অবিরত
ঘুরছি আমি ঘুরছি আমি
ঘুরছি আমি ক্রমাগত।
‘লাটিম’ নামের কবিতার এটাই হচ্ছে অন্তিম স্তবক। কবিতাটিতে লাটিমের রূপকে ব্যক্তিমানুষের বৃত্তাবদ্ধ জীবনের কথা বলা হয়েছে। কবিতাটার শুরু একধরনের পর্যবেক্ষণ থেকে। কবিতার কথক, হয়তো কবি নিজেই, জানাচ্ছেন, তার একটা পেয়ারা কাঠের লাটিম ছিল। মাটির ’পরে বৃত্ত এঁকে তার ভেতরে শব্দ করে লাটিমটা ঘুরত। লাটিমের স্থানে আমরা যদি মানুষকে প্রতিস্থাপন করি, তাহলে কবিতাটার অর্থ আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। তবে একেবারে স্থির নয় এ-জীবন। দ্বিতীয় স্তবকেই সে-কথা আছে : আগে ছিল ‘বৃহৎ জীবন ক্ষুদ্র বৃত্ত’ আর ‘এখন অনেক ক্ষুদ্র জীবন বৃহৎ বৃত্ত।’ শৈশবের বৃত্তাবদ্ধ উন্মুক্ত জীবনের ক্ষুদ্র বৃত্ত থেকে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনের বৃত্তটাও যে বড় হয়ে ওঠে, সে-কথাই বলা হয়েছে এই কবিতায়। আর এই বৃত্তটা হচ্ছে ‘মধ্যবিত্তে’র বৃত্ত। আমাদের মতো দেশগুলোর মানুষের এই হচ্ছে ভবিতব্য। বৃত্ত আছে আবার তা অতিক্রমও করা যায় না। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায় ‘অনতিক্রান্ত বৃত্ত’। কবিতাটি আবার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা বলে বৃত্তবোধটি এই কবিতায় শৈলী ও বোধে সমীকৃত হয়ে গেছে।
রবিউল হুসাইনের কবিতায় এই যে বৃত্তাবদ্ধ মানুষের কথা পাওয়া গেল, এই মানুষ মূলত বিপন্ন। বিপন্নতার ছবিটিই তাঁর কবিতার প্রধান উপজীব্য বিষয়। এই বিপন্নতার দিকটি স্পষ্ট হয়ে যায় যখন তিনি ফিরে যান অতীতে। অতীত থেকে যখন তিনি সমকালে সরে আসেন, তখন বর্তমানকে নিয়ে হয়ে পড়েন বিশ্লেষণপ্রবণ। আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মউন্মোচন, আত্মদীর্ণ হতে দেখি তাঁকে। রবিউল হুসাইনের কবিতার কেন্দ্রে যেন কবির অধিষ্ঠান। প্রধান কথক কবি নিজেই। আধুনিক লিরিকের এটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ আধুনিক কবিতাই আত্মজৈবনিক, সেইসঙ্গে স্বীকারোক্তিমূলক। ওই কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতাটিতেও পাচ্ছি আরো একটু প্রসারিত বিপন্নতার কথা : স্মৃতি-বোধ-বিপন্নতার বিমিশ্র ভাবচ্ছবি।
এখানে রবিউল হুসাইনের কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলি। গল্প, তাঁর কবিতায় গল্প থাকে। কবিতা বলে গল্পগুলো নিটোল নয়, অনুভূতিকে অনুসরণ করে গল্পগুলো কবিতায় আবছায়ার মতো ধোঁয়াশাপূর্ণ। বইটির দ্বিতীয় কবিতা ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো যারা’। নামেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে গল্পের। কবিতাটির শুরুতেই মানবিক বিপন্নতার কথা, ‘একদার আপন মানুষের একরৈখিক চোখগুলো/ আজ নিরুপায় দর্শক হয়ে দেখে/ বালিয়াড়ির ঢিবিতে শিশুচাঁদ সব/ ডুবে যায় …।’ এই যে আপন মানুষ, এরা হচ্ছেন কবির বন্ধু। ভীষণ বিপন্ন। একসময় যারা ছিল ছল্ছল্ ঝর্ণা, তারা এখন ‘মরা রোদের উত্তাপহীন শুকনো পাথর’। যে ছিল সর্বক্ষণ ঝুম্ঝুম্ নূপুর, সে এখন ডোবাজলের মরামাছি। যে ছিল খুব কাছের টইটম্বুর পুকুর, আজ সে অনুভূতির আবেগহীন বিধ্বস্ত দেয়াল। সে-সময় কেউ কেউ ছিল ‘শূন্য বুকের ধু ধু প্রান্তর’, কিন্তু এখন তারা কেবলি ‘ধূপছায়ার হাওয়াহীন নিশ্চল ছায়াহরিণ’। বিপ্রতীপ এই যে অবস্থান ও পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন কবি, তার কেন্দ্রে আবার তাঁরই অবস্থান : ‘আমি নাকি ডানা ভাঙা মরা পাখি পুরোনো/ ছেঁড়া শাড়ি কিংবা বিপন্ন ভাঙা বাড়ি।’ মানুষের সঙ্গে মানুষ ঘনিষ্ঠ হলেই বন্ধুত্ব হয় না। কেবল বন্ধুত্ব হলেই সেই সম্পর্ক শিল্পময় বন্ধুত্বে রূপান্তরিত হয়। এ উচ্চারণ অনেকটাই দার্শনিক। কিন্তু এর পরে যে-কথাটি বললেন কবি, তাতে দার্শনিক বোধটি স্পষ্ট হয়ে যায় : ‘এ জগৎসংসারে সব সম্পর্কই সামান্য ও সাময়িক’। বন্ধুত্বের বিষয়টি যেমন সুখের, তেমনি বিপন্নতার কথাও কবি বলেছেন বেশ সহজভাবেই। কবি-কথক লক্ষ করেছেন, যারা ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাদের অনেকেই আজ প্রবাসী, কেউ কেউ প্রবাসেই নিখোঁজ হয়ে গেছে। শুধু প্রবাসে চলে যাওয়ার কারণে নয়, দেশেই পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও বিচ্ছিন্নতা আমাদের গ্রাস করে :
পাশেই থাকে একই পাড়াতে বহুদিন
হয় না দ্যাখা, দ্যাখা হলেও হাত নেড়ে হ্যালো বলা
পর্যন্তই কারো কারো দেশে থেকেও প্রবাসী জীবন
কোনো শহরে কিংবা গ্রামে বহুদিন কোনো সংবাদ
জানি না শুধু দূর থেকে শুনি সুখেদুঃখে
ভালোই আছে ছেলেমেয়ে বউঘর নিয়ে তারা আজ।
রবিউল হুসাইনের কবিতায় যেহেতু গল্প থাকে, ফলে, অধিকাংশ কবিতাই দীর্ঘ হয়। মানবিক সম্পর্কের রূপটিও আবার যেহেতু ব্যাপক, ফলে, মানবিক সম্পর্কের ব্যাপ্তিও লক্ষণীয়। তাঁর কবিতায় থাকে গল্পের ডিটেইলস। কবিতার সমাপ্তিও ঘটে পূর্ণাঙ্গ একটি গল্পের তৃপ্তিদায়ক পরিসমাপ্তির মতো। তবে পরিসমাপ্তিটা তৃপ্তিদায়ক হলেও বিপন্নতার ছবিটি কখনো মুছে যায় না, বরং মনোলোকে বিপন্নতার তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করে শেষ হয় :
এই মধ্যপথাবলম্বী মধ্যবিত্তের বিবর্ণ সময়ে মনে হয়
একটি মানুষের সঙ্গে আরেকটি মানুষের
একটি জীবনের সঙ্গে আরেকটি জীবনের সম্পর্ক এখন
একটি সবুজ দুঃখী গ্রামের সঙ্গে একটি স্বচ্ছ
অসুস্থ নদীর একটি খঞ্জ বোবা ভিখিরির সঙ্গে
একটি জনশূন্য পোড়োবাড়ির একজন বিপন্ন
পথিকের সঙ্গে একজন বিষণœ স্বৈরিণীর
এই পরিসমাপ্তি, লক্ষ করলে দেখা যাবে, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ছেঁড়াখোঁড়া কয়েকটি ছবি নির্মাণের মধ্য দিয়ে শেষ হলো। মধ্যবিত্ত-জীবনের বিচ্ছিন্নতা ও বিপন্নতার দিকগুলো পূর্ণায়ত হয়ে উঠল।
আমগ্ন কাটাকুটি খেলা কাব্যগ্রন্থের ‘মই ও বেশ্যা’ কবিতাটিও মধ্যবিত্তের অবস্থান ও দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত। এ-কবিতাটিও দীর্ঘ। একই রকম আঙ্গিক, অর্থাৎ গল্পের মতো এর ন্যারেটিভের ধরন। মধ্যবিত্তের জীবন আবার প্রাধান্য পাচ্ছে এ-কবিতায়। মধ্যবিত্তের জীবনাচরণ, ক্ষুদ্রতা, কূপম-ূকতা, সংকীর্ণতা এ-কবিতার বিষয়। দার্শনিক উচ্চারণও আছে কবিতাটির শেষদিকে। মধ্যবিত্তের বৃত্তটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তার পতনের প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন কবি। কবিতাটির কথক বা ন্যারেটর নিজের বৈরী অবস্থানেরও বর্ণনা দিয়েছেন কঠোর ভাষায়। শেষদিকে দৃষ্টিভঙ্গিগত প্রতিরোধও প্রাধান্য পেয়েছে।
শুরুতেই শ্রমবিমুখ পরনির্ভরশীল নিরাপদ জীবনের কল্পনা আছে এতে, যা, আরামদায়ক হলেও মধ্যবিত্তের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকেই তুলে ধরে :
যারা ঘরজামাই হয় এবং যাদের কর্মজীবী
স্ত্রীর জন্যে আহার ও বাসস্থানের সঙ্গে নিশ্চিত
নিয়মিত আইনানুগ রমণের সাশ্রয় আছে
তাদেরকে আমি খুব হিংসে করি আর
এই শহরে নিজের বাবা কিংবা স্ত্রীর বাবার দেওয়া
বাড়ি পেয়ে অথবা তাদের কারো দেওয়া জমিতে
নতুন বাড়ি বানিয়ে যারা মাসে মাসে জমিদার এক
ভাড়ার টাকা না গুনে নিরাপদে বসবাস করে যাচ্ছেন
কিন্তু পরনির্ভরশীল এই মধ্যবিত্তের তুলনায় অন্য শ্রেণির যারা রয়েছেন, তাদের সম্পর্কে দার্শনিকোচিত উচ্চারণ আছে কবির। এই উচ্চারণ কবির আরেকটি সত্তা, যা তাঁর বৌদ্ধিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন সত্তা। কবিরা অনেক সময় এভাবে নিজের সত্তাকে দ্বিখ-িত করে বিপ্রতীপ অবস্থান গ্রহণ করেন। এরপর পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবে নেতিবাচক অবস্থানের বিপরীতে ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেন। এ-কবিতাতেও তাই ঘটেছে। বেশ কঠোর ও তীক্ষè ভাষায় মধ্যবিত্তের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির নিন্দা করেছেন ‘বেশ্যা’র রূপকে :
বেশ্যা শব্দটি গালাগালি পর্যায়ের যদিয়ো এবং
শুনতে খুব খারাপ লাগলেও এর একটি
অন্তর্নিহিত সুন্দর ও গূঢ় অর্থ আছে
বিশদভাবে বললে বলতে হয় যেসব নারী
অথবা পুরুষ ঘন ঘন বেশ অর্থাৎ
সাজসজ্জা বা পোশাক পরিবর্তন করতে করতে
বার বার ন্যাংটো হতে ভালোবাসেন এককথায়
তাদেরকেই সত্যিকার অর্থে বেশ্যা বলা হয়
সেই হিসেবে আমরা সবাই কমবেশি বেশ্যা
দিনের মধ্যে দু’তিনবার তো ন্যাংটো হই-ই
বেশভূষাগতভাবে তো বটেই মনোগতভাবেও।
মধ্যবিত্তকে, যে-মধ্যবিত্তের অংশ কবি নিজেও, একেবারে নগ্ন করে ছেড়েছেন। কবি মনে করেন ‘বেশ্যাশিল্প ও তার শিল্পীবৃন্দ’র এখন দিনকাল। তাদেরই জয়জয়কার। কিন্তু এরপরই কবির প্রতিবাদী দ্বিতীয় সত্তা এর বিরুদ্ধে গড়ে তুলছে প্রতিরোধ :
বুকবাঁধা আশা নিয়ে আমরা নিষ্পলক চেয়ে আছি
বহুদিন থেকে মইটি এখন আপনাদের দখলে
দেখা যাক আপনারা কত নিচে নামতে পারেন
কারণ মই থাকলেই ওপরে ওঠা যায় না
মই নিচেও নামায়।
মানবিক বোধে এভাবেই, রবিউল হুসাইন যেমন বলেছেন তাঁর একাধিক গদ্যে, মানবিক শ্রেয়োবোধের কথা উচ্চারণ করেছেন। ‘মসলিন’ শীর্ষক কবিতায় মসলিনের প্রতীকে এই শিল্পটির বিলুপ্তি ঘটলেও আবার তা বিশ্বের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে, অর্থাৎ পুনরুদ্ধার হবে বাংলার গৌরব। অন্য কয়েকটি কবিতাতেও রবিউল হুসাইনের এই ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায়। এখানে সেসব কবিতার প্রাসঙ্গিক অংশগুলো উদ্ধৃত করছি :
মানুষের টিকে থাকা আকর্ষণ দুর্নিবার
আর সব মিছিমিছি মিথ্যাও অসহায়

সেই এক অলৌকিক বন্ধন
জল অগ্নি মাটি মরুৎ ও ব্যোম মিলে উদ্ভাসিত
বৃক্ষ প্রাণী আর মানুষের অটুট বন্ধন

চারদিকে অন্ধকার শীতের প্রবল বিস্তার
তার মধ্যে সূর্য ওঠে তাপ দ্যায় আলো দ্যায়

দোলনায় শূন্যতার বালিয়াড়ি মাকড়সার ঝুল
একটু শব্দেই নিঃশব্দের নির্জন প্রান্তরে র্ঝু র্ঝু
একাকী-দুঃখী নিরাশ্রয় নিরহংকারী
আর সবাই যে-যার অস্তিত্বে স্থির অবিচল নেপথ্যচারী

যদ্দিন জীবন তদ্দিন এই নীল বেদনার সীমাহীন পথ
দুঃখ আর যন্ত্রণা শুধু উদ্ভিদ আর জীবজন্তুর মানুষের
অন্যসবের বেলায় রূপান্তর আর পরিবর্তনের
সাপ-লুডু খেলা
পরিশেষে সব পথ এক অমোঘ মনোবিন্দুতে মিশে যায়

রোদ্দুরে সারি সারি লাল নীল কাপড় জামা শাড়ি ফ্রক বলাকা
দড়িতে মেলে-দেয়া হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে জীবনের শত পতাকা

সারি সারি মানুষেরা মোমবাতি হয়ে অগ্নি-প্রযতেœ
মস্তকে অগ্নি-শিরস্ত্রাণে দাউ-দাউ জ্বলে ওঠে ধীরে ধীরে
রবিউল হুসাইনের এ-কবিতাগুলো তীব্র আঁধারেও আলোকবর্তিকার মতো, ইতিবাচক জীবনের ইশারাই দিচ্ছে। এভাবেই মানবিক উজ্জীবনের কথা বলেছেন রবিউল হুসাইন। আমরা বৈরী প্রতিবেশে জীবনযাপন করি, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। একদিকে মানুষের যন্ত্রণা-আর্তি যেমন তিনি সংবেদনশীল কবি-হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, তেমনি তা থেকে উত্তরণের কথাও ভেবেছেন। এই হচ্ছে সার্বিকভাবে কবি রবিউল হুসাইনের কাব্যিক মানবিক অভিযাত্রা। যে-যাত্রায় হৃদয় দীর্ণ হয়, আত্মযন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয় মন, তবু আকাশ-ভরা নক্ষত্র-সভায় ডুবে থাকে সে-হৃদয়। কেননা তিনি জানেন, ‘সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রখ্যাত মানুষ-মহান’। এভাবেই পরিশেষে মানবিক বিপন্নতা থেকে পৌঁছে যান স্বপ্নলোকের ‘বসন্তপুরে’।
সদ্যপ্রয়াত এই কবির প্রতি ব্যক্তিগত এবং কালি ও কলমের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।