রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে এক আত্মমুখচ্ছবি

সৌভিক রেজা

প্রভাতসূর্য
রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ

সম্পাদক : ভীষ্মদেব চৌধুরী

নবযুগ প্রকাশনী
ঢাকা, ২০১১

৮০০ টাকা
শরৎচন্দ্রের সূত্রে ‘সার্বভৌম কবি’ রবীন্দ্রনাথকে এই বিশেষণে অভিহিত করেছিলেন হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘সর্বভূমিতে তাঁর বিচরণ, সর্বক্ষেত্রে তাঁর ব্যাপ্তি, সর্বদেশে তাঁর অধিষ্ঠান, সর্বমানবীয় আস্বাদে ও আকুলতায় তাঁর শিল্পীসত্তার পুষ্টি, সর্বজনের অন্তরে তাঁর অধিকার।’ অন্যদিকে, তারও আগে, অমিয় চক্রবর্তীও রবীন্দ্রনাথকে বলেছেন, ‘কবি-সার্বভৌম’। রবীন্দ্রনাথের ‘আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘যে-চোখে তিনি… বিশ্বকে দেখেছেন তাঁরই মধ্যে তাঁর সৃষ্টিকে খুঁজব। দেখা তো কেবলমাত্র চোখ দিয়ে দেখা নয়, তার পিছনে আছে চৈতন্যের শক্তি, আনন্দ-বেদনায় মিশ্রিত মনের সংস্কার এবং তাতে আছে গভীর অভিজ্ঞতায় সঞ্জাত প্রতিভার অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদর্শিতার একটি যৌগিক পরিচয়।’ সেই পরিচয় আমরা নানা সময়ে নানা সূত্রে খুঁজে চলেছি; বলা যায় অনেকটা আত্মগরজেই। কেন এই গরজের কথা উঠছে? উঠছে তার কারণ সেই কবে বিষ্ণু দে বলেছিলেন : ‘বাংলার ছোটো ঐতিহ্যের ধারায় রবীন্দ্রনাথের বিরাট আবির্ভাব একটা প্রাকৃতিক ঘটনা।… তাঁর তুলনা অন্য সাহিত্যেও ঠিক পাওয়া যায় না। একদিকে ইংরেজিতে চসর, অন্যদিকে জর্মানে গয়েটে মিলিয়ে হয়ত খানিকটা তুল্যাভাস দিতে পারেন। তাঁর প্রভাবে বাংলা সাহিত্যে এল অনেক বিন্যাস, তাঁর প্রতিটি বই টেকনিকের প্রগতিতে পদক্ষেপ ও বিষয়বস্ত্তর বাহুবিস্তার। …প্রাদেশিকতাদুষ্ট বাংলায় তিনি আনলেন বিশ্বের মানদন্ড। রোমান্টিকদের পরিবর্তন-অভীপ্সা, হৃদয়বৃত্তির সূক্ষ্ম সৌকুমার্য, পেলবতা তাঁর দান।’ কথাগুলোর প্রাসঙ্গিকতা তো এখনো শেষ হয়ে যায়নি; বরং জীবনানন্দ দাশ যে বলেছিলেন : ‘ইংরেজ কবিরা যেমন যুগে-যুগে ঘুরেফিরে সেক্শপিয়রের কেন্দ্রিকতা থেকে সঞ্চারিত হয়ে বৃত্ত রচনা করে ব্যাপ্ত হয়ে চলেছে, আমাদের কবিরাও রবীন্দ্রনাথকে পরিক্রমা করে তাই করবে – এই ধারণা প্রত্যেক যুগসন্ধির মুখে নিতান্তই বিচারসাপে বলে বোধ হলেও অনেককাল পর্যন্ত অমূলক বা অসংগত বলে প্রমাণিত হবে না।’ সেখানে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা বারবারই অনুভূত হবার তাগিদ, সময়ের দূরত্বটাকে ছাপিয়েও রয়ে যায়। অবশ্য ‘প্রাসঙ্গিক বলতে এই বোঝায় যে সেটা অনুধাবনযোগ্য, সেটা অনুসরণযোগ্য নাও হতে পারে’ শঙ্খ ঘোষের এই কথাটিও নানাবিধ কারণেই মনে রাখতে হয়েছে।
এক (দুই). রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণে এ-বছর আমরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা ধরনের সংকলন হাতে পেয়েছি। নানারকম বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও এই সময়টাকে স্মরণ করবার একটা উপরি-লাভ হচ্ছে এই নানা-রকমের, নানা-বিষয়ের সংকলনের প্রকাশ; যার কেন্দ্রে থাকছেন রবীন্দ্রনাথ। বিশিষ্ট অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক ভীষ্মদেব চৌধুরীর ‘প্রভাতসূর্য’ তারই একটি উজ্জ্বল নিদর্শন।
দুই. ব্যাপ্তির কথাই বলি কিংবা বিস্তারের, রবীন্দ্রনাথ প্রধানত কবি। তাঁর কবিতা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের আত্মসচেতনতার অন্যতম প্রোজ্জ্বল উদাহরণ; তেমনি তাঁর সৃষ্টিশীলতারও। সিদ্দিকা মাহমুদা রবীন্দ্রনাথের ‘আকাশপ্রদীপ’ কাব্য সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিরিশের দশকের শেষ প্রান্তে যখন বাংলা সাহিত্যগগনে রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিতা-আন্দোলন যথেষ্ট শক্তিসঞ্চয় করেছে তখন আকাশপ্রদীপ-এর জন্ম। সুতরাং সন্ধিক্ষণের রবীন্দ্রমনোলোকের চাবিকাঠি হিসেবে গ্রন্থটির গুরুত্ব কম নয়।’ (‘আকাশপ্রদীপের রবীন্দ্রনাথ’, পৃ ৪১৬)। অন্যদিকে, শিশিরকুমার ঘোষ অবশ্য প্রতিতুলনা করেই বলেছিলেন, ‘প্রান্তিকের পাশে ‘সেঁজুতি’ ও ‘আকাশপ্রদীপ’ যথেষ্ট ম্লান ও ক্ষীণ।’ কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ‘স্মৃতির কাজ জীবনের এই দ্বিতীয় রূপ সৃষ্টি করা।’ আর তার জন্যে প্রয়োজন অভিজ্ঞতাকে সমন্বিত করা, সংহত করা। সেটা রবীন্দ্রনাথ কতটুকু পেরেছিলেন সে-বিষয়ে সমালোচক যথেষ্ট সংশয়ে ছিলেন। তাছাড়া এও ঠিক যে, ‘অভিজ্ঞতা তো বিভিন্ন স্তরের।’ সিদ্দিকা মাহমুদা অবশ্য ‘আকাশপ্রদীপ’ প্রসঙ্গে কবির ‘জীবনস্মৃতি’ আর ‘ছেলেবেলা’র ‘কথকতায় সংলগ্ন’তার কথা বলেছিলেন। কথাটি এই কাব্য প্রসঙ্গে খুবই সত্যি, কিন্তু এটি কি নতুন কোনো কথা? ‘Akashpradip continues and completes Senjuti. There is an increasing self-consciousness, and old memories return, especially memories of early childhood.’ শিশিরকুমার ঘোষই প্রথমে জানিয়েছিলেন। তবে আকাশপ্রদীপে নতুন কালের সঙ্গে সংগ্রাম ও সমন্বয়ের ক্ষতচিহ্ন যে প্রকাশিত সেটি প্রাবন্ধিক সিদ্দিকা মাহমুদেরও দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি (পৃ ৪২৫)। সাহিত্যের বিচার-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘প্রতিদিনের কথাবার্তা চিঠিপত্র দেখাসাক্ষাৎ কাজকর্ম শিক্ষাদীক্ষার মধ্যে কবিত্বের মূল নাই; তাহার মূলে রহিয়াছে এক বৃহৎ আবেগের সঞ্চার, যেন একটি অলৌকিক আবির্ভাবের মতো।’ সেইসঙ্গে তিনি এও মানতেন যে, আমাদের প্রাচীন ‘কবির জীবনের ‘গল্পগুলি জনগণ কবির জীবন হইতে সংগ্রহ করে নাই, তাহার কাব্য হইতে সংগ্রহ করিয়াছে। কবির জীবন হইতে যে-সকল তথ্য পাওয়া যাইতে পারিত, কবির কাব্যের সহিত তাহার কোনো গভীর ও চিরস্থায়ী যোগ থাকিত না। বাল্মীকির প্রাত্যহিক কথাবার্তা কাজকর্ম কখনোই তাঁহার রামায়ণের সহিত তুলনীয় হইতে পারিত না। কারণ, সেই সব-সকল ব্যাপার সাময়িক, অনিত্য; রামায়ণ তাঁহার অন্তর্গত নিত্যপ্রকৃতির – সমগ্র প্রকৃতির – সৃষ্টি, তাহা একটি অনির্বচনীয় অপরিমেয় শক্তির বিকাশ, তাহা অন্যান্য কাজকর্মের মতো ক্ষণিকবিক্ষোভজনিত নহে।’ আর তার সূত্র ধরেই তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রাচীন ভারতবর্ষের কোনো কবির জীবনচরিত নাই। আমি সেজন্য চিরকৌতূহলী, কিন্তু দুঃখিত নহি।’ কথাগুলো বলতে হলো সুতপা ভট্টাচার্যের পূরবী, কাব্যের সমালোচনার বিষয়টি উত্থাপন করবার জন্য। সুতপা বলেছেন, ‘কবি রবিঠাকুরকে ডাক দেয় তাঁর কবিতা তাঁর গান আর ডাক দেয় রাণুর মতো সংবেদনশীল সরলা মেয়ে।… কবি ঠাকুর আর রবিঠাকুর এই দুই পরিচয়ই তাঁর সত্য পরিচয়। এই দুয়ের দ্বান্দ্বিকতা তাঁর নিয়তি।’ (পূরবী ‘সৃষ্টিছাড়া ব্যর্থ ব্যথা’, পৃ ৩৯১)। শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন, এই নিয়তি তো প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষেরই। কিন্তু সেদিকে তেমন দৃষ্টি না-দিয়েই সুতপা রবীন্দ্রনাথ-রাণু মুখার্জির সম্পর্কের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছেন। বলছেন : ‘রবীন্দ্রনাথের চিঠি থেকেই জানতে পারি, রাণু এবং ঠাকুর পরিবারের কোনো কোনো যুবককে ঘিরে রীতিমতো নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত চলছিল। রাণুকে তিনি কোনো চিঠিতে তিরস্কার করছেন, কোনো চিঠিতে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আর তাঁর নিজের মনে কী চলছিল? তার পরিচয় তখনই মিলবে না, মিলবে পরে, ‘পথিক’ অংশের কবিতায়।’ খুব নিশ্চিতভাবে কথাগুলি বলেছেন সমালোচক। আরো বলেছেন : ‘পূরবী’ আর ‘পথিক’ দুই অংশ মিলিয়ে ‘পূরবী’ কাব্যে যেন অনেকদিন পর ‘সাধকে’র বদলে ‘প্রেমিকে’র প্রকাশ, ‘জীবনদেবতা’র পরিবর্তে ‘মানসসুন্দরী’র প্রত্যাবর্তন ‘লীলাসঙ্গিনী’ নামে’ (পৃ ৩৯২)। রাণুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির সূত্রেই তিনি প্রশ্ন করেছেন : ‘১৯১৯-এর পর, অর্থাৎ রাণুর বাল্যবয়সের পরের কোনো চিঠি রবীন্দ্রভবনে রতি নেই। কেন?’ (পৃ ৩৯৪)। কিংবা ‘রবীন্দ্রনাথের… চিঠিতে বর্ণিত আক্ষেপ কয়েকদিন পরে রচিত ‘আহবান’ কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে’ (পৃ ৩৯৪); ‘আশা’ কবিতা… বাষট্টি বছর বয়সে নারীর প্রেমের জন্য কেন এমন ব্যাকুলতা? (পৃ ৩৯৪); ‘যে গভীরতা তাঁর সৃষ্ট নারীচরিত্র সুচরিতা কিংবা দামিনী কিংবা কুমুদিনীর মধ্যে দেখি, সেই গভীরতাই তিনি দেখতে চেয়েছিলেন রাণুর মধ্যে।’ (পৃ ৩৯৫) রবীন্দ্রনাথ যখন ভানুসিংহের পত্রাবলী প্রকাশ করেছিলেন, তখন তার ভূমিকায় বলেছিলেন : ‘পত্রধারার দ্বিতীয় পর্যায়ের চিঠিগুলি লেখা হয়েছিল একটি বালিকাকে। সে চিঠির বেশির ভাগ লেখা শান্তিনিকেতন থেকে। তাই সেগুলির মধ্যে স্বতই বয়ে চলেছে শান্তিনিকেতনের জীবনযাত্রার চলচ্ছবি। এগুলিতে মোটা সংবাদ বেশি কিছু নেই, হাসিতামাশায় মিশিয়ে আছে সেখানকার আবহাওয়া, জড়িয়ে আছে সাংসারিক ব্যাপারে আনাড়ি মেয়েটির ছেলেমানুষির আভাস; আর তারি সঙ্গে লেখকের সকৌতুক স্নেহ। বিশেষ কিছু বলতে হবে না মনে করে হালকা মনে আটপৌরে রীতিতে যা বলা যেতে পারে তাকে কোনো শানবাঁধানো পাকা সাহিত্যিক রাস্তায় প্রকাশ করবার উপায় নেই।’ কিন্তু সমালোচক সে-কথা শুনতে-মানতে নারাজ। পূরবীর সূত্র ধরেই তিনি আমাদের জানিয়ে দেন, ১৯২৪ সালের ‘১২ নভেম্বর থেকে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছিলেন ওকাম্পোর আতিথ্য, অসুস্থ শরীরে।’ (পৃ ৩৯৮) তিনি এও জানান, ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁকে (ওকাম্পো) না বুঝলেও তাঁর ভালোবাসা বুঝেছিলেন’ এই এক নতুন সমালোচনার রীতি তৈরি হয়েছে আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে। বৌঠান কাদম্বরী দেবীকে দিয়ে যা শুরু হয়েছিলো এখন তা বৌঠানকে ছাপিয়ে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী, রাণু মুখার্জি, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এমনকি পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীও বাদ যাচ্ছেন না। মনজুরে মওলা বলেছিলেন, ‘একটি কবিতাকে ভালো কবিতা হয়ে উঠতে গেলে তাতে কেবল আবেগের নৈর্ব্যক্তিক প্রতিরূপ থাকাই যথেষ্ট নয়, তাকে শিল্পকাজ হয়ে ওঠার অন্যসব শর্তও পূরণ করতে হয়।’ (রবীন্দ্রনাথের একটি ইংরেজি কবিতা, পৃ ৪১৪)। তাই যদি হয়, তাহলে সমালোচককেও তো কিছু শর্ত মেনে চলতে হবে। এলিয়ট তো সমালোচনার রীতি সম্পর্কে বলেছিলেন যে : ‘Honest criticism and sensitive appreciation is directed not upon the poet but upon the poetry.’। যে-কারণে এসব তথ্যের গুরুত্বকে এতটা প্রাধান্য দেওয়া অনুচিত। আবদুল হক যথার্থই বলেছিলেন, ‘যা ভালো সাহিত্য তা নির্লিপ্ত পক্ষপাতহীন বিচার প্রার্থনা করে।’ সুতপা ভট্টাচার্য যখন বলেন, ‘পূরবীর কবিতাগুলির রচনাপটে যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি বৈচিত্র্যে ভরপুর রচনার অন্দরমহলের বিবিধ তোলপাড়। সমস্ত বৈচিত্র্যকে ঐক্যময় করে তুলেছে সংগীত। এ বইয়ের অধিকাংশ কবিতাতেই আছে গান তথা সুরের প্রসঙ্গ’ (পৃ ৪০২) তখন তিনি সেই পক্ষপাতহীন বিচারের দিকেই যেন অগ্রসর হতে থাকেন। ব্যক্তিজীবনের অন্দরমহল হেঁটে-বেড়ানো সাহিত্যের ব্যবসাদার বিচারকের প্রতি রবীন্দ্রনাথ আর যা-ই হোন প্রসন্ন ছিলেন না কারণ : ‘তাহারা পোশাক চেনে, তাহারা মানুষ চেনে না। তাহারা উৎপাত করিতে পারে, কিন্তু বিচার করিবার ভার তাহাদের উপর নাই।’ অপরপক্ষে তিনি মনে করতেন, ‘সারস্বতদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া লইবার ভার যাঁহাদের উপরে আছে তাঁহারা নিজে সরস্বতীর সন্তান; তাঁহারা ঘরের লোক, ঘরের লোকের মর্যাদা বোঝেন।’ এই মর্যাদার বিষয়টি যদি সমালোচকরা ভুলে যান তাহলে সাহিত্য-সমালোচনাকে উৎপাত ছাড়া আর অন্য কিছু বলা কষ্টকর হয়ে উঠবে। তবে এও সত্যি যে, ‘রবীন্দ্রকাব্যের নানা দ্বন্দ্ব, উপাদান ও ইঙ্গিত টীকাকারদের পক্ষে মহা-সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ভক্ত-অভক্তের টানাটানির ফলে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়া কঠিন।’ মিহিরকান্তি চৌধুরীর ‘তব সুর বাজে মোর গানে’ প্রবন্ধেও নানাভাবে উঠে এসেছে যে ‘রবীন্দ্রসাহিত্যের ইতিহাসে বৌঠান কাদম্বরী দেবী এক অনন্যসাধারণ উপাদান।’ সবাই যে বর্তমানের দিকেই দৃষ্টি ফিরিয়েছেন তা নয়; রবীন্দ্রনাথের কথা ও কাহিনী থেকে শুরু করে চিত্রাঙ্গদা বিভিন্ন রচনায় পুরাণের ব্যবহার নিয়ে সনৎকুমার সাহা মন্তব্য করেন, ‘তিনি বিচরণ করেছেন কাল-চিহ্নিত অতীতে… ফিরে চলেন আরো পেছনে। কালের চিহ্ন সেখানে লুপ্তপ্রায়। সম্ভাবনার বহুবর্ণিল জগৎ অসংখ্য মানব-মানবীর প্রাণের বিপুল আকুতি নিয়ে, তৃপ্তি-অতৃপ্তির, সার্থকতা-বিফলতার অবিনশ্বর পসরা নিয়ে চেতনার আকাশ ছেয়ে ফেলে। উঠে আসে তা পুরাণ থেকে। কালকে অস্বীকার করতে চায় বলে তার দাবি চিরকালের। অতীত অবগাহন করে কবি সেখান থেকেও সংগ্রহ করেন সমিধ। প্রজ্বলিত করেন তাকে চেতনার আগুনে। যজ্ঞাগ্নি থেকে উঠে আসে নতুন… সব পুরাণ-প্রতিমা। অতীতকে তারা ছুঁয়ে থাকে। কিন্তু দাঁড়ায় বর্তমানে। এই বর্তমান শুধু এখনকার নয়, তা অতীতের, এবং ভবিষ্যতেরও’ (‘রবীন্দ্রনাথের পুরাণপ্রতিমা’, পৃ ১৫১)। পুরাণপ্রতিমায় রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে বীতশোক ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সংলাপের কোন শেষ নেই, প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের এবং প্রাচীনতা আর আধুনিকতার কথোপকথন এখনও অফুরান।… কেননা রবীন্দ্রনাথপ্রত্ন-খননে ভারতের পুরাণ উঠে আসে, বেদের মতো সেও এক পুরাণী যুবতী, নিত্যনব হয়ে জন্মায় বলেই তো সে পুরাণ, আর পুরাণের সঙ্গে কবিতার সংলাপ ফুরোয় না, সংলাপ ফুরোয় না রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের, রবীন্দ্র ও তাঁর কবিতার পাঠকের।’ অনেকটা একই মত পোষণ করে সনৎকুমার সাহা বলেন, ‘কথা বা কাহিনীতে তিনি (রবীন্দ্রনাথ)… পৌরাণিক জগতেই বিচরণ করেছেন। আলোকসম্পাত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তির মুখের ওপর। ব্যক্তি অবশ্য প্রায়শই নিজেকে অতিক্রম করে বৃহৎ কোনো ভাব, বা মূল্যবোধে একাকার হয়। পৌরোণিকী কেবল ঘটনার বিবরণ মাত্র থাকে না। কবির নির্বাচন ও তাঁর হাতে পাত্র-পাত্রীর আন্তর-সত্যের উন্মোচন কবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করে।’ (পৃ ১৫৪-৫৫)। আন্তর-সত্যের এই উন্মোচনের দিকটি সমালোচকের নজর এড়িয়ে যায়নি বলেই এসব পুরাণপ্রতিমাকে তিনি বলেছেন কবির ‘চৈতন্যশাসিত’ (পৃ ১৬৯)। শুধুই পুরাণ নয়, আমাদের লোকসংস্কৃতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল সবসময়ই সঞ্চারণশীল। সত্যেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার যথার্থই বলেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ ‘লোকসংস্কৃতিকে যোগ্য মর্যাদা দিয়ে তাকে অধ্যয়নের কাজে উদ্যোগী’ হয়েছিলেন। এই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতিভাবনা আমাদের আগ্রহ তৈরি করে। বেগম আকতার কামালের মতে, ‘দেশের ভাবচেতনা ও মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগবর্জিত দেশপ্রেম তিনি সমর্থন করেননি; রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থজড়িত শ্রেণিপ্রীতির নামান্তর যে দেশপ্রেম তার প্রতিও শ্রদ্ধা প্রকাশ করেননি।… তাঁর উপলব্ধি ঘটেছিল যে, কোনো নব্যশিক্ষিতের দৃষ্টিলোকে দেশের মানুষকে বিচার করলে এবং তার অন্তরের ভাব ও ভাষাকে অবজ্ঞা করলে দেশের মঙ্গল সাধন হবে না, প্রকৃত জাতীয় সাহিত্য ও ভাষার বিকাশ ঘটবে না।’ (‘রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতিভাবনা’, পৃ ২৬১)। সেইসঙ্গে তিনি এটিও বলতে ভোলেননি যে, ‘সংস্কৃতিভাবনার দৃশ্যমান বাস্তবতা যে লোকসংস্কৃতির উপকরণ সংগ্রহ করা তার পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ।… এ ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টি ছিল বিজ্ঞানীর মতোই অনুসন্ধিৎসু এবং নৃতত্ত্ববিদের মতো আগ্রহব্যঞ্জক।’ (পৃ ২৬২) সবশেষে এসে বেগম আকতার কামাল সিদ্ধান্ত টেনেছেন এইভাবে যে, ‘বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ও শিক্ষার শক্তভিত গড়ে না তুললে ঐতিহ্য-সংস্কৃতি কোনোটাই বাঁচে না এ সত্য বোঝার সময় উপস্থিত। ওই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতিভাবনা আমাদের অনুসরণযোগ্য। কেননা, তিনি তো শুধু শিল্পসাহিত্য ও বাংলা ভাষার মহান শিল্পীই নন, মানুষের জীবনদর্শন, অধিচেতনা ও সুপার পারসোন্যালিটি গড়ার দিক-নির্দেশকও বটে।’ (পৃ ২৭০)
তিন. নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘কালের সঙ্গে পদক্ষেপ এবং বারেবারে নবতম আন্দোলনের অধিনায়কত্ব গ্রহণ এই চিরসজাগ প্রগতিশীলতাই রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত সৃষ্টিগর্ভ এবং সমুজ্জ্বল করে রেখেছে। তাঁর ছোটগল্প ও কালের সহগামী – যুগচেতনার শীর্ষে থেকে রীতি ও বক্তব্যে নবীনায়িত হয়েছে।’ সেদিক দিয়ে আরো অগ্রসর হয়ে সমালোচক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে যেসব নিম্নবর্গভুক্ত মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তাদেরকে স্পষ্টরেখায় দুভাগে বিন্যাস করা সম্ভব। প্রথম ভাগে রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে অসহায় মানুষেরা; আর দ্বিতীয় ভাগে ভারতীয় বর্ণপ্রথায় বিন্যস্ত সর্বনিম্নশ্রেণির শূদ্র জনগোষ্ঠী, যাদের বলা যেতে পারে তলের তল।’ (‘রবীন্দ্র-ছোটগল্পে নিম্নবর্গ’, পৃ ৪২৬)। সোনিয়া নিশাত আমিনের প্রবন্ধ ‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী’ : রবীন্দ্রগল্পের নায়িকারা’ কিংবা কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শেষের রাত্রি এবং রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনা’ শীর্ষক প্রবন্ধগুলো রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প এবং তার নারী-চরিত্রগুলো নিয়ে এ-যুগের আলোচকের ভাবনার চিহ্নটুকু দেখে নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় যেমন বলেছিলেন, ‘নারীর অন্তরবেদনা এবং পুরুষের আচ্ছন্ন বুদ্ধিতে নারীত্বের যে-অবমাননা তা রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলিতে দেখা গিয়েছে।’ কিংবা ‘রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে সৌন্দর্যচেতনা আর শৈল্পিক শুচিতার প্রতীক হল নারী।’ এই প্রবন্ধগুলিতে তার চেয়ে বেশি কিছু জেনে-বুঝে-নিতে পারা যায় না। তবে একটি ব্যাপার লক্ষ করবার মতো। তা হলো এই যে, এখানে কোনো আলোচকই রচনার পটভূমিটাকে আলাদা করে দেখবার চেষ্টা বা কিংবা তাকে বাদ দিতে চাননি। সৈয়দ আকরম হোসেন বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্র-কথাসাহিত্যে পটভূমি… নিছক প্রথাবদ্ধ পরিপ্রেক্ষিত নয়, কিংবা নয় বিশুদ্ধ বিভাব। পটভূমি রবীন্দ্র-কথাসাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে সামাজিক অবয়ব-উন্মোচনে এবং চরিত্রচিত্তের পরিস্ফুটনে। আবার কখনো পটভূমির প্রতীতী প্রজ্ঞাময় ব্যঞ্জনায় শিল্পিত হয়েছে জীবন, সমাজ ও সময়।’ তাকে বিন্যাস-প্রতিবিন্যাসের সূক্ষ্মতায় মেনে নিতেই হয়।
চার. বিশেষ এক অন্ধতা যে নেশনতন্ত্রের মূলগত ব্যাধি এই বিশ্বাস থেকে রবীন্দ্রনাথ সরে আসেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘মিথ্যা দ্বারাই হউক, ভ্রমের দ্বারাই হউক, নিজেদের কাছে নিজেকে বড়ো করিয়া প্রমাণ করিতেই হইবে এবং সেই উপলক্ষে অন্য নেশনকে ক্ষুদ্র করিতে হইবে, ইহা নেশনের ধর্ম, ইহা… পরস্পরের সমৃদ্ধিতেও পরস্পরের চিত্তকে বিষাক্ত করে। এক নেশনের প্রবলত্ব অন্য নেশনের পক্ষে সর্বদাই আশঙ্কাজনক।’ এই জাতীয়তাবাদী-চেতনার প্রাসঙ্গিকতা ধরেই গোরা উপন্যাসের কথা স্বাভাবিকভাবেই সামনে চলে আসে। দেবেশ রায় বলেছিলেন, গোরা সেই বিল উপন্যাস যা দাঁড়িয়ে রয়েছে উনিশ-বিশ শতকের জোড়ে, যে-উপন্যাসকে সন্ধান করতে হয়েছে এক স্বদেশ, সেই কল্পনার স্বদেশের জন্যে প্রমাণ করতে হয়েছে এক ধর্ম, সেই ধর্মকে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক গাথার কাজে ব্যবহার করে তার যোগ্যতা পরীক্ষা করতে হয়েছে ও সেই আবিষ্কৃত স্বদেশের নাগরিকের জন্যে নতুন নীতিবোধকে প্রাণনের পক্ষে অপরিহার্য করে তুলতে হয়েছে।’ আর তারই কারণে শিল্পকল্পনার এক বিশাল আয়োজন। কৃষ্ণ কৃপালিনীর মতে, ‘Gora is more than a mere novel; it is the epic of India in transition at the most crucially intellectual period of its modern history… it is to Bengali fiction what Tolstoy’s ‘War and Peace’ is to the Russian.’। তাছাড়া ‘একই দেশে সবাই বাস করলেও এটা যে এক দেশ নয়, এই চেতনাই গোরা উপন্যাসের ক্রমস্থানিক ছন্দকে নিয়ন্ত্রিত করেছে, উপন্যাসটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য এক ভাষা-সংকটে। আত্মসংশয়ে ছিন্নভিন্ন হতে হতে গোরা যে পর্যায়ে পৌঁছায়, তাতে সে যে হিন্দুঘরের ব্রাহ্মণ সন্তান নয়, আইরিশ, এ-তথ্যটা বাহুল্য মাত্র।’ শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় সে-কারণেই বলেন, ‘এদিকে, জানা না-জানার এক অঙ্কেও গোরা গোড়া থেকেই হেরে আছে। বড়ই শঠতা করেছে তার সঙ্গে কথক। কাহিনীর মূল গায়েন, নায়ককে অজ্ঞতার অন্ধকার-কূপে রেখে আপাত-পাঠককে সাংঘাতিক একখানি সংবাদ আগেভাগেই জুগিয়ে দিয়েছে।’ এর মধ্যে দিয়ে কথকের ভাবনার পক্ষপাতটুকু পাঠকেরও একেবারে অগোচর থাকে না। ‘কিন্তু সমাজ একটা আছে সেটা তো বোঝ, সেটা তোমার মেনে চলাই উচিত’ কৃষ্ণদয়ালের এই কথার প্রত্যুত্তরে আনন্দময়ী বলেছিলেন, ‘আমার বুঝে কাজ নেই। আমি বুঝে নিয়েছি যে, গোরাকে যখন ছেলে বলে মানুষ করেছি তখন আচার-বিচারের ভড়ং করতে গেলে সমাজ থাক আর না-থাক ধর্ম থাকবে না।’ (রবীন্দ্র উপন্যাস-সংগ্রহ, ১৩৯৭, পৃ ৫২৭)। পাঠকও জেনে যায়, ‘গোড়ার বাপ লড়াইয়ে মারা গেছে, ওর মাও তো মরেছে।’ আর এসব কারণেই ‘দ্বিতীয় তরফের কাছে গোরার ‘হিন্দু-হিন্দু’ আস্ফালন ও বামনাইপণা আপনা থেকেই প্রথম থেকে ‘ভিত্তিহীন’ হয়ে আছে। গোরার মর্মস্পর্শী আন্তরিকতা ও ঈর্ষণীয় প্রাণপ্রাচুর্য সত্ত্বেও, এমনই আখ্যানের করণকৌশল যে, কখনই তাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্যতায় গ্রহণ করা যায় না।’ আনন্দময়ী যতই বলুন, ‘বাবা গোরা তুই যে আমার পুত্রহীনার পুত্র, তুই যে গর্ভের ছেলের চেয়ে অনেক বেশি’ (পৃ ৭৯১) কিন্তু তারপরও ঔপন্যাসিকের বিবরণে দেখি : ‘এক মুহূর্তেই গোরার কাছে তাহার সমস্ত জীবন অত্যন্ত অদ্ভুত একটা স্বপ্নের মতো হইয়া গেল। শৈশব হইতে এত বৎসর তাহার জীবনের যে ভিত্তি গড়িয়া উঠিয়াছিল তাহা একেবারেই বিলীন হইয়া গেল। সে যে কী, কোথায় আছে, তাহা যেন বুঝিতেই পারিল না। তাহার পশ্চাতে অতীতকাল বলিয়া যেন কোনো পদার্থই নাই এবং তাহার সম্মুখে তাহার এতকালের এমন একাগ্রবর্তী সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গেছে।… তাহার মা নাই, বাপ নাই, দেশ নাই, জাতি নাই, নাম নাই, গোত্র নাই, দেবতা নাই। তাহার সমস্তই একটা কেবল ‘না’। (পৃ ৭৯১)। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘ওই ‘না’র কবলে বাংলা উপন্যাসের সংবেদনশীল মধ্যবিত্ত নায়কেরা বারংবার পড়বে; অচিরেই ফুরোবে তাদের উৎসাহ-উদ্যম, কেবলই হারাবে তারা নৈরাশ্যের শূন্যতায়।’ আর এইভাবেই গোরা উপন্যাসের প্রাসঙ্গিকতা আজকের দিনেও ফুরোয় না। মোহাম্মদ আজম তাঁর ‘গোরার ‘জাতীয়তাবাদী’ প্রকল্পের বিচার’ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বহু রচনায় রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমা জাতীয়তাবাদের বাইরের এমনকি ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের ধারণার বাইরের নানা প্রস্তাব অনবরত পেশ করেছেন, যেখানে নেশনের বদলে বড়ো হয়ে উঠেছে সমাজ, রাষ্ট্রীয় ঐক্যের স্থলে সামাজিক সামঞ্জস্য। (পৃ ৪৭৮) প্রাবন্ধিকের মতে, ‘গোরা নীতিনির্ধারক পাত্রপাত্রীদের জীবনবাস্তবতা, স্বপ্ন ও সম্ভাবনা, আনন্দ ও ব্যাধির একটা তালিকা করলে নিঃসন্দেহে প্রতীয়মান হয়, ওই কালের তো বটেই, এমনকি আজকের দিনের বেশিরভাগ ভারতবাসীর সঙ্গেও এর যোগ অতি সামান্য। বিদ্যাশিক্ষা এদের ব্রত, কিন্তু সে-বিদ্যাকে ডেপুটিগিরি ফলে পরিণত করতে তারা পুরামাত্রায় অনীহ। বিবাহিত সংসারজীবন নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্কের মিষ্টতাই এদের পরম ধ্যান।… কাজ তারা করে বা করতে চায়; কিন্তু তা জীবিকার মতো তুচ্ছ প্রয়োজনে নয়, দেশের কল্যাণে উচ্চ আদর্শে’ (পৃ ৪৮৯)। উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীদের জীবনবাস্তবতার এরকম তালিকা যদি করা হয়, তাহলে ইয়োরোপ-আমেরিকা-লাতিন আমেরিকা-আফ্রিকার অনেক উপন্যাসই সে-তালিকায় চলে আসে। প্রাবন্ধিক যখন বলেন, ‘গোরার প্রস্তাব বৈপ্লবিক নয়। বরং সমকালীন বাস্তবতায় বিদ্যমান সম্ভাবনাসমূহের সংশ্লেষণ। আরো বোঝা যায়, সবচেয়ে প্রতিভাবান শিল্পী-বুদ্ধিজীবীও আসলে আসমানী পয়দা নন, মাটিতেই বসতি করেন। প্রতিভাবানরাও ইতিহাসের অধীন; কদাচ ইতিহাসকে প্রভাবিত করেন মাত্র।’ (পৃ ৪৮৮) সেটাও কিন্তু আমরা অস্বীকার করতে পারি না। শুধু যা বুঝে উঠতে পারি না, তা হলো এই কথাগুলো কেন বলা হচ্ছে! রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সাহিত্য যাহা আমাদিগকে জানাইতে চায় তাহা সম্পূর্ণরূপে জানায়; অর্থাৎ স্থায়ীকে রক্ষা করিয়া, অবান্তরকে বাদ দিয়া, ছোটোকে ছোটো করিয়া, বড়োকে বড়ো করিয়া, ফাঁককে ভরাট করিয়া, আলগাকে জমাট করিয়া দাঁড় করায়। প্রকৃতির অপক্ষপাত প্রাচুর্যের মধ্যে মন যাহা করিতে চায় সাহিত্য তাহাই করিতে থাকে। মন প্রকৃতির আরশি নহে; সাহিত্যও প্রকৃতির আরশি নহে। মন প্রাকৃতিক জিনিসকে মানসিক করিয়া লয়; সাহিত্য সেই মানসিক জিনিসকে সাহিত্যিক করিয়া তুলে।’ গোরা উপন্যাসেও তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু করতে চাননি। যে-কারণে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘গোরার ক্রমস্থানিক বিপর্যয়ে আপাত-পাঠক হয়তো ব্যথা পায়, কিন্তু সমানুভবে ছলছলে ভাবার্দ্র হয় না।’ মোহাম্মদ আজম যখন তাঁর প্রবন্ধে ‘তা এস্তেমাল করতে পেরেছেন গুটিকয়েক মানুষকে’, অথবা ‘যে-কোনো বয়ানের গোড়ার জরুরত’ এরকম ভাষা ব্যবহার করেন তখন মাঝে-মাঝে মনে হয়েছে বুঝি-বা ১৯৪৯ সালে ফিরে গেছি; কেননা তৎকালীন সরকারি মাহেনও পত্রিকায় প্রবন্ধ ছাপা হতো এরকম ভাষায় : ‘গোজাশতা এশায়াতে আমরা অতীতে বাংলা ভাষার নানা মোড় পরিবর্তনের কথা মোখতাসারভাবে উল্লেখ করেছিলাম। বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল সকলকে স্বীকার করতেই হবে যে, শৈশবে বাংলা ভাষা মুসলমান বাদশাহ এবং আমীর ওমরাহদের নেকনজরেই পরওয়ারেশ পেয়েছিলেন এবং শাহী দরবারের শান-শওকত হাসিল করেছিল।… সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের তাহজীব-তমদ্দুনের তায়াল্লুক বর্জিত বাংলা ভাষা মাশরেকি পাকিস্তানের মাতৃভাষা নয়।’
পাঁচ. শঙ্খ ঘোষ বহু বছর আগে বলেছিলেন, ‘গুরুদেব এটা একেবারেই একটা আঞ্চলিক এবং সাময়িক ডাক। শান্তিনিকেতনে যাঁরা দু-চারজন পুরোনো মানুষ আছেন, রবীন্দ্রসান্নিধ্যে ছিলেন যাঁরা একদিন, বা তাঁদের উত্তর-পরিজনেরা, কেবল তাঁদেরই মধ্যে এই ডাকের প্রচলন আছে।… আস্তে আস্তে ধারাটা বিলীন হয়ে যাবে।’ কিন্তু এই ‘গুরুদেব’ আর সেইসঙ্গে একেবারেই ব্যক্তিগত ঘটনাবলি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্যের বোধ ও আইডেনটিটির ধারণার পুনর্বিচার করতে চেয়েছেন সালাহউদ্দীন আইয়ুব। শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ‘এক শিল্পীর ভিতর অগণিত আমির বসবাস’ (‘রবীন্দ্রনাথ : ঐতিহ্য ও আইডেনটিটি’, পৃ ১৯৯)। আর সেই শিল্পী তাঁর নিজের প্রতিভার কাছে বিশ্বস্ত থাকবেন জীবনানন্দ দাশের চাওয়া ছিল এরকমই। কারণ তার মধ্যে দিয়েই নিজের মাত্রাচেতনার ব্যাপারটি নিহিত থাকে। শিল্পীর এই মাত্রাচেতনা সমাজের, ব্যক্তির মধ্যে মুক্তির চেতনায় ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। সিরাজ সালেকিন সে-কারণেই হয়তো বলেন, – ‘মুক্তি তোরে পেতেই হবে ‘পূজা পর্যায়ের গানের এই বাক্যাংশে রবীন্দ্রনাথের আত্মপরিচয় ও নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার ইঙ্গিতটি আছে। কেবল পূজার নয়, সামাজিক প্রকাশেও এর দার্শনিকভাষ্য তৈরি করেছেন রবীন্দ্রনাথ।…মুক্তি নিজের সীমা অতিক্রম করার প্রয়াস। এই অতিক্রম একটি চিরন্তন যাত্রা, কর্মময়তায় – ফলাতিরেক কর্মে, বৃহৎ মানবের কল্যাণে, বৃহৎ অর্থে ত্যাগে – মুক্তির বোধ স্বতঃপ্রকাশিত। এর ফল প্রেম – মানুষে কিংবা ঈশ্বরে, সর্বত্রই।’ (‘এই কথাটা ধরে রাখিস’, পৃ ২০০)। আর এই ‘মুক্তি কোনো খন্ডিত ভাবনা নয়, মুক্তি জীবনসমগ্রতায়। সাহিত্যের তাই একক কোনো মুক্তি নেই, সমাজ-সভ্যতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই উপাদানটিকে সমাজমুক্তির সঙ্গেই এগিয়ে যেতে হবে। (পৃ ২০৪)। ‘মুক্তি শূন্যতায় নয়, পূর্ণতায়’ সেটিও আমাদের মনে রাখা কর্তব্য। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী রবীন্দ্র-নাটক নিয়ে আলোচনায় বলেছেন, ‘নাটকে প্রাণ থাকে দ্বন্দ্বে, রবীন্দ্রনাথের নাটকেও সেই দ্বন্দ্বটা আছে, এবং তা প্রধানত মুক্তির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বন্ধনের বাস্তবতার, যেন ‘অচলায়তনে’র সঙ্গে ‘মুক্তধারা’র।… জীবনের দুর্ভোগকে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই জানতেন, এবং মানতেনও, কিন্তু জীবনকে ট্র্যাজেডি হিসেবে দেখতে সম্মত ছিলেন না।’ সেইসঙ্গে তিনি এও যোগ করেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ সর্বত্রই মুক্তির পক্ষে, এবং বন্ধনের বিপক্ষে। তাঁর নাটকে দেখি মুক্তির জন্য মানুষ কাজ করছে, চঞ্চল, অস্থির হয়ে উঠছে, কিন্তু বন্ধনটা তো বাস্তবতা, তাকে ভাঙা সহজ নয়। তবু ভাঙতে হয়। আর ওই ভাঙার চেষ্টার ভিতর দিয়ে বন্ধনের যে চরিত্র সেটা পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। পাখি মুক্তি চায়। কিন্তু তার মুক্তির প্রসঙ্গে খাঁচার কথা এসে যায়।’ (‘রবীন্দ্রনাথের নাটকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং বন্ধনের সত্য’, পৃ ৩০৫)
ছয়. অজয় রায়ের ‘ভৌত বাস্তবতার প্রকৃতি : আইনস্টাইন – নীরস বোর এবং রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে মূল্যবান জিনিসের একটি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের দুটি আলাপচারিতা। যেখানে আইনস্টাইনের ‘জগৎবিচ্ছিন্ন কোনো ঐশ্বরিক সত্তায় আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন?’ – এরকম এক প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তায় নয়, মানুষের অসীম ব্যক্তিত্ব মহাবিশ্বকে অনুধাবন করে। এমন কোনো বস্ত্ত নেই যা মনুষ্য ব্যক্তিত্ব কোনো-না-কোনো শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করতে না পারে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে মহাবিশ্ব সংশ্লিষ্ট সত্য হলো মানবীয় সত্য। (পৃ ১৪২)। এই মানবীয় সত্য রবীন্দ্রনাথের গানে-কবিতায়-গল্পে-উপন্যাসে যেমন, তেমনি তাঁর চিত্রকলাতেও দেখতে পাওয়া যায়, তবে একটু ভিন্নভাবে। অশোক ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের ছবিকে যদি আমরা কোনো খন্ডিতসত্তা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি বলে না দেখি, যদি মনে করি তাঁর সৃজন প্রতিভার বিশেষ এক অভিব্যক্তি, তাহলে মেনে নিতে অসুবিধে হয় না, মানুষের মধ্যে যে ক্রূর দানবিক রূপ তিনি দেখেছিলেন, তা তাঁর সহজাত স্বতঃস্ফূর্ততায় মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর সে-সময়ের ‘উৎকট দর্শন’… এইভাবে প্রতীকে ও সংকেতে তিনি স্বাক্ষর রেখে গেছেন পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে, মনুষ্যত্বের পক্ষে।… তাই এই বিকট দানবিক রূপকে ছাপিয়েও তাঁর ছবি ফুটিয়ে তুলেছে নারীর মনোজগৎ, প্রকৃতির প্রশান্তি ও ফুলের প্রফুল্লতাকে স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যে, ভাবে ও আবেগে’ (‘রবীন্দ্রনাথের ছবি ও ছবির ভাবনা’, পৃ ৪১)। নিজের ছবির বিষয়ে কলম্বোয় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন (১৯৩৪) : ‘আপনারা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন এই ছবিগুলির অর্থ কি? আমি বলি, ইহাদের কোনও অর্থ নাই। প্রাচীন কাব্য ও সাহিত্যের অর্থ আছে, কিন্তু শিল্পকলার অর্থ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না; সুতরাং শিল্পকলার কোনও অর্থ নাই। এই কথা স্মরণ রাখিয়া আপনারা এই চিত্রগুলির মর্ম উপলব্ধির চেষ্টা করিবেন।… জিজ্ঞাসু মন লইয়া এই সকল ছবি দেখিবেন না। আমি এইগুলি অাঁকিয়াছি সুতরাং আমার এই কথায় আপনারা আমাকে কিছু গর্বিত মনে করিতে পারেন। হ্যাঁ, আমি স্বীকার করিতেছি, কবি ও শিল্পীরা কিছু অহংকারীই হইয়া থাকে।’ এখানেও সেই ভাব-আবেগের সামঞ্জস্য দেখতে পাই।
সাত. এই সংকলনে আরো যাঁদের প্রবন্ধ রয়েছে তাঁরা হলেন : আনন্দ ঘোষ হাজরা (রবীন্দ্রনাথ ও ক্রোচে), আহমদ রফিক (রবীন্দ্রচৈতন্যে বৈপরীত্যের দ্বিমাত্রিকতা), কালীপ্রসন্ন দাস (তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ), জুলফিকার মতিন (বোতাম-আঁটা জামার নীচে), অসিতবরণ ঘোষ (সহজ পাঠ : ফিরে দেখা), এম এম আকাশ (রবীন্দ্রনাথ : গ্রামোন্নয়ন ও মালিকানা বিতর্ক), বাল্মীকি ব্যানার্জি (রবীন্দ্রনাট্যম্ শাস্ত্রীয় নৃত্য), পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় (রবীন্দ্রনাট্যম : এক বিস্মৃতপ্রায় ধ্রুপদী নৃত্য-শৈলী), তারানা নূপুর ( রবীন্দ্রনাথের নৃত্যভাবনা : রূপের সন্ধানে), চঞ্চলকুমার বোস ( রবীন্দ্র-সাহিত্যে রাজা : আর্থ-সামাজিক অবলোকন), শিবানী রায় (অচলায়তন : প্রতিক্রিয়া ও শতবার্ষিক প্রাসঙ্গিকতা), সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান (তোমায় নতুন করে পাব বলে), অসীম দত্ত (গীতবিতানে আলো-অন্ধকার), সুদেষ্ণা চক্রবর্তী (রবীন্দ্র কথাসাহিত্যে কয়েকটি আঙ্গিকের বিশেষত্ব)। প্রতিটি প্রবন্ধই আলাদা আলাদা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
আট. শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যখন বলেছিলেন যে, ‘এমন কোনো সৃষ্টি নেই যার মধ্যে ত্রুটি না থাকে’ নিজেকেও তখন সে-হিসেবের বাইরে রাখেননি তিনি, অসম্পূর্ণ বলেই বুঝেছিলেন নিজেকে। মানবতার গ্লানি সেই অসম্পূর্ণতায় নয়, গ্লানি হলো সম্পূর্ণতার দিকে যাবার কোনো চেষ্টামাত্র না-থাকায়। যাবার সেই চেষ্টাটুকুই, সেই সাধনাটুকই, মানবতা।’ ভীষ্মদেব চৌধুরীর এই সংকলনের মধ্যে দিয়ে আমরা যেন সেই সাধনাটুকুর এক বিশদ প্রচেষ্টা দেখতে পাই। এই সংকলন আমাদের রবীন্দ্র-চর্চার ক্ষেত্রেই শুধু নয়, রবীন্দ্রনাথ-কথিত আত্মশক্তি অর্জনেও, পাঠকের দিক থেকে অন্তত, এক নিশ্চয়তাবোধের কাজ করবে। 