রবীন্দ্রনাথরে ভ্রমণসাহিত্যে উগ্রবাদবিরোধিতা

পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টিভান্ডারে অনন্য মাত্রা যোগ করেছেন অসাধারণ সব ভ্রমণকাহিনি লিখে। তিনি প্রথম বিদেশে যান ১৮৭৮ সালে। তখন তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে দেড় বছর ছিলেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লিখেন য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র যা প্রকাশিত হয় ১৮৮১ সালে। দ্বিতীয়বার তিনি ইংল্যান্ডে যান ১৮৯০ সালে। তিন মাস কালের এই অবস্থান নিয়ে দু-খণ্ডেপ্রকাশিত হয় য়ুরোপযাত্রীর ডায়েরী। তাঁর পরবর্তী ভ্রমণকাহিনিগুলোর মধ্যে রয়েছে – যাত্রী, যাভাযাত্রীর ডায়েরী, জাপানযাত্রী, পারস্যে এবং রাশিয়ার চিঠি। বিদেশভ্রমণ ছাড়াও তৎকালীন ভারতবর্ষের উড়িষ্যা, বিহার ও বাংলায় জমিদারি উপলক্ষে স্থল ও জলপথে ভ্রমণ নিয়ে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে যেসব চিঠি তিনি লেখেন এর সংকলন প্রকাশিত হয় ছিন্নপত্র ও ছিন্নপত্রাবলী নামে। বর্তমান আলোচনার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে রাশিয়ার চিঠি ও পারস্যকে। এ দুটি বইয়ে তিনি ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন।
রাশিয়া-ভ্রমণকে রবীন্দ্রনাথ অভিহিত করেছিলেন ‘তীর্থদর্শন’ হিসেবে। বলশেভিক-বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মুক্তির মন্ত্র পড়ে ধর্ম আর দাসত্বের মন্ত্র পড়ে ধর্মতন্ত্র। ধর্ম হলো আগুন, আর ধর্মতন্ত্র ছাই। ধর্মতন্ত্র আঁকড়ে ধরে জীর্ণ আচারকে, কুসংস্কারকে। নতুন রাশিয়া যে ধর্মের নামে তৈরি হওয়া সাম্প্রদায়িকতা ও সংঘাত সৃষ্টিকারী ধর্মতন্ত্রকে উচ্ছেদ করেছে তা দেখে রবীন্দ্রনাথ আনন্দিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধ অভিব্যক্তি –
যে পুরাতন ধর্মতন্ত্র এবং পুরাতন রাষ্ট্রতন্ত্র বহু শতাব্দী ধরে এদের বুদ্ধিকে অভিভূত এবং প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ প্রায় করে দিয়েছে এই
সোভিয়েত-বিপ্লবীরা তাদের দুটোকেই দিয়েছে নির্মূল করে। এত বড়ো বন্ধনজর্জর জাতিকে এত অল্পকালে এত বড়ো মুক্তি দিয়েছে দেখে মন আনন্দিত হয়। কেননা যে ধর্ম মূঢ়তাকে বাহন করে মানুষের চিত্তের স্বাধীনতা নষ্ট করে, কোনো রাজাও তার চেয়ে আমাদের বড়ো শত্রু হতে পারে না – সে রাজা বাইরে থেকে প্রজাদের স্বাধীনতাকে যতই নিগড়বদ্ধ করুক না। এ-পর্যন্ত দেখা গেছে, যে রাজা প্রজাকে দাস করে রাখতে চেয়েছে সে রাজার সর্বপ্রধান সহায় সেই ধর্ম যা মানুষকে অন্ধ করে রাখে। সে ধর্ম বিষকন্যার মতো; আলিঙ্গন করে সে মুগ্ধ করে, মুগ্ধ করে সে মারে। শক্তিশেলের চেয়ে ভক্তিশেল গভীরতর মর্মে গিয়ে প্রবেশ করে, কেননা তার মার আরামের মার।
‘সোভিয়েটরা রুশসম্রাটকৃত অপমান এবং আত্মকৃত অপমানের হাত থেকে এই দেশকে বাঁচিয়েছে – অন্য দেশের ধার্মিকেরা ওদের যত নিন্দাই করুক আমি নিন্দা করতে পারব না। ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো। রাশিয়ার বুকের ’পরে ধর্ম ও অত্যাচারী রাজার পাথর চাপা ছিল; দেশের উপর থেকে সেই পাথর নড়ে যাওয়ায় কী প্রকা- নিষ্কৃতি হয়েছে, এখানে এলে সেটা স্বচক্ষে দেখতে পেতে।’
রাশিয়ার সমৃদ্ধ নবরূপের পশ্চাতে কাজ করেছে শিক্ষাব্যবস্থার অভূতপূর্ব অগ্রগতি। শিক্ষার অভাবে মানুষ কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে, মনুষ্যত্ববোধকে বিসর্জন দেয়। কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে রাশিয়ার উত্তরণ ঘটেছে শিক্ষার সাহায্যে। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন –
ওরা একদিন ডাইনী বলে নিরপরাধকে পুড়িয়েছে, পাপিষ্ঠ বলে বৈজ্ঞানিককে মেরেছে, ধর্মমতের স্বাতন্ত্র্যকে অতি নিষ্ঠুরভাবে পীড়ন করেছে, নিজেরই ধর্মে ভিন্ন সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রাধিকারকে খর্ব করে রেখেছে, এছাড়াও কত অন্ধতা কত মূঢ়তা কত কদাচার মধ্যযুগের ইতিহাস থেকে তার তালিকা স্তূপাকার করে তোলা যায়। এ সমস্ত দূর হল কী করে। বাইরেকার কোনো কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের হাতে ওদের অক্ষমতার সংস্কার সাধনের ভার দেওয়া হয়নি; একটিমাত্র শক্তি ওদের এগিয়ে দিয়েছে, সে হচ্ছে ওদের শিক্ষা।
রাশিয়া সরকারের এমন যুগান্তকারী উদ্যোগ সর্বমহলে অভিনন্দিত হয়নি। উগ্রবাদ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে রাশিয়ার অগ্রযাত্রাকে কেউ কেউ অধার্মিকতা বলে নিন্দা করেছেন। নিন্দুকদের এই প্রবণতার বিরোধিতা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। মনুষ্যত্ব অর্জনই যে প্রকৃত ধার্মিকতা এ-কথা জোর দিয়ে বলেছেন –
আমি নিজের চোখে না দেখলে কোনোমতেই বিশ্বাস করতে পারতুম না যে, অশিক্ষা ও অবমাননার নিম্নতম তল থেকে আজ কেবলমাত্র দশ বৎসরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এরা শুধু ক খ গ ঘ শেখায়নি, মনুষ্যত্বে সম্মানিত করেছে। শুধু নিজের জাতকে নয়, অন্য জাতের জন্যেও এদের সমান চেষ্টা। অথচ সাম্প্রদায়িক ধর্মের মানুষেরা এদের অধার্মিক বলে নিন্দা করে। ধর্ম কি কেবল পুঁথির মন্ত্রে, দেবতা কি কেবল মন্দিরের প্রাঙ্গণে? মানুষকে যারা কেবলই ফাঁকি দেয় দেবতা কি তাদের কোনোখানে আছে?
পারস্যরাজের নিমন্ত্রণে ১৯৩২ সালে রবীন্দ্রনাথ পারস্য ভ্রমণ করেন। সুদূরের পিয়াসী রবীন্দ্রনাথ সত্তর বছর বয়সেও যেন অক্লান্ত। আনন্দচিত্তে গোটা পারস্য ঘুরে ঘুরে দেখছেন। রাজপরিবারের উত্থান-পতনের ইতিহাস মনোরঞ্জক কাহিনির মতো শুনিয়েছেন। তিনি লক্ষ করেছেন যে, আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করার রাস্তা সংকুচিত হয়ে গেছে পারস্যে। পরধর্মের প্রতি বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা দূর হয়ে গেছে। ধর্মের নামে হিংস্রতা ও রক্তপাত বন্ধ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় –
অনতিকাল পূর্বে ধর্মযাজকম-লীর প্রভাব পারস্যকে অভিভূত করে রেখেছিল। আধুনিক বিদ্যাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রভাবের প্রবলতা কমে এল। এর পূর্বে নানা শ্রেণীর অসংখ্য লোক, কেউ বা ধর্মবিদ্যালয়ের ছাত্র, কেউ বা ধর্মপ্রচারক, কোরান পাঠক, সৈয়দ – এরা সকলেই মোল্লাদের মতো পাগড়ি ও সাজসজ্জা ধারণ করত। যখন দেশের প্রধানবর্গের অধিকাংশ লোক আধুনিক প্রণালীতে শিক্ষিত হলেন তখন থেকে বিষয়বুদ্ধি প্রবীণ পুরোহিতদের ব্যবসায় সংকুচিত হয়ে এল। এখন যে খুশি মোল্লার বেশ ধরতে পারে না। বিশেষ পরীক্ষা পাস করে অথবা প্রকৃত ধার্মিক ও ধর্মশাস্ত্রবিদ প-িতের সম্মতি অনুসারে তবেই এই সাজ-ধারণের অধিকার পাওয়া যায়।
এমন মুগ্ধ পর্যবেক্ষণেই রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি শেষ হয়ে যায়নি। পারস্যের মতোই এমন এক ভারতবর্ষ তিনি কল্পনা করেছেন যেখানে আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে ধর্মমোহ, ধর্মব্যবসা বিলীন হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সাহসী ও তির্যক বক্তব্য যে-কোনো দেশের ধর্মের লেবাসধারীদের মুখোশ খুলে দিতে যথেষ্ট –
অন্তত একবার কল্পনা করে দেখতে দোষ নেই যে, হিন্দুভারতে যত অসংখ্য পান্ডা পুরোহিত ও সন্ন্যাসী আছে কোনো নূতন আইনে তাদের উপাধি-পরীক্ষা পাস আবশ্যিক বলে গণ্য হয়েছে। কে যথার্থ সাধু বা সন্ন্যাসী কোনো পরীক্ষার দ্বারা তার প্রমাণ হয় না স্বীকার করি – কিন্তু স্বেচ্ছাগৃহীত উপাধি ও বাহ্য বেশের দ্বারা তার প্রমাণ আরো অসম্ভব। অথচ সেই নিরর্থক প্রমাণ দেশ স্বীকার করে নিয়েছে। কেবলমাত্র অপরীক্ষিত সাজের ও অনায়াসলব্ধ নামের প্রভাবে ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ লোকের মাথানত হচ্ছে বিনা বিচারে এবং উপবাসপীড়িত দেশের অন্নমুষ্টি অনায়াসে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে, যার পরিবর্তে অধিকাংশ স্থলে আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কোনো প্রতিদান নেই। সাধুতা ও সন্ন্যাস যদি নিজের আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য হয় তা হলে সাজ পরবার বা নাম নেবার দরকার নেই, এমন-কি, নিলে ক্ষতির কারণ আছে; যদি অন্যের জন্যে হয় তা হলে যথোচিত পরীক্ষা দেওয়া উচিত। ধর্মকে যদি জীবিকা, এমন-কি, লোকমান্যতার বিষয় করা যায়, যদি বিশেষ বেশ বা বিশেষ ব্যবহারের দ্বারা ধার্মিকতার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় তবে সেই বিজ্ঞাপনের সত্যতা বিচার করবার অধিকার আত্মসম্মানের জন্য সমাজের গ্রহণ করা কর্তব্য এ কথা মানতেই হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মসমূহের উৎপত্তি ঘটেছিল মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য। সময়ের বিবর্তনে মানুষের রুচি, প্রয়োজন ও সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে। নতুন যুগের সঙ্গে অবিকলভাবে সাম্প্রদায়িক ধর্ম খাপ খাইয়ে চলতে পারে না। প্রয়োজন হয় ধর্মীয় আচার ও রীতিনীতি সংশোধনের। ধর্মতন্ত্রের স্বঘোষিত পাহারাদারগণ এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারেন না। ফলে রক্ষণশীল ও প্রগতিশীলদের মধ্যে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব। নতুন যুগের প্রাণস্পন্দনকে অনুভব করার তাগিদ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ কণ্ঠে সাম্প্রদায়িক অনাচার ও ধর্মান্ধতার বিরোধিতা করেছেন রবীন্দ্রনাথ –
আজকের দিনে কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্ম ধর্মের বিশুদ্ধ প্রাণতত্ত্ব নিয়ে টিকে নেই। যে-সমস্ত ইটকাঠ নিয়ে সেই-সব সম্প্রদায়কে কালে কালে ঠেকো দিয়ে দিয়ে খাড়া করে রাখা হয়েছে তারা সম্পূর্ণ অন্য কালের আচার-বিচার প্রথা বিশ্বাস জনশ্রুতি। তাদের অনুষ্ঠান, তাদের অনুশাসন এক কালের ইতিহাসকে অন্য কালের উপর চাপা দিয়ে তাকে পিছিয়ে রাখে।
‘সাম্প্রদায়িক ধর্ম জিনিসটাই সাবেক কালের জিনিস। পুরাকালের কোনো একটা বাঁধা মত ও অনুষ্ঠানকে সকল কালেই সকলে মিলে মানতে হবে, এই হচ্ছে সম্প্রদায়ের শাসন। বস্তুত এতকাল রাজশক্তি ও পৌরোহিতশক্তি জুড়ি মিলিয়ে চলেছে। উভয়েই জনসাধারণের আত্মশাসনভার, চিন্তার ভার, পূজার ভার, তাদের স্বাধীন শক্তি থেকে হরণ করে অন্যত্র এক জায়গায় সংহত করে রেখেছে। ব্যক্তিবিশেষ যদি নিজের চিন্তাশক্তির প্রবর্তনায় স্বাতন্ত্র্যের চেষ্টা করে তবে সেটাকে বিদ্রোহের কোঠায় ফেলে তাকে প্রাণান্তকর কঠোরতার সঙ্গে শাসন করে এসেছে। কিন্তু রাষ্ট্রনৈতিক শক্তি ক্রমে এক কেন্দ্রের হাত থেকে সাধারণের পরিধিতে ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে, অথচ চিরকালের মতো বাঁধা মতের ধর্মসম্প্রদায় আজকের দিনে সকলেরই চিত্তকে এক শাসনের দ্বারা, ভয়ের দ্বারা, লোভের দ্বারা, মোহের দ্বারা অভিভূত করে স্থাবর করে রেখে দেবে – এ আর চলবে না।
… যুগে যুগে জ্ঞানের পরিধি বিস্তার, তার অভিজ্ঞতার সংশোধন, তার অবস্থান পরিবর্তন চলছেই; মানুষের মন সেইসঙ্গে যদি অচল আচারে বিজড়িত ধর্মকে শোধন করে না নেয় তা হলে ধর্মের নামে হয় কপটতা নয় মূঢ়তা নয় আত্মপ্রবঞ্চনা জমে উঠতে থাকবেই। এই জন্যে সাম্প্রদায়িক ধর্মবুদ্ধি মানুষের যত অনিষ্ট করেছে এমন বিষয়বুদ্ধি করেনি। বিষয়াসক্তির মোহে মানুষ যত অন্যায়ী যত নিষ্ঠুর হয়, ধর্ম মতে আসক্তি থেকে মানুষ তার চেয়ে অনেক বেশি ন্যায়ভ্রষ্ট অন্ধ ও হিংস্র হয়ে ওঠে, ইতিহাসে তার ধারাবাহিক প্রমাণ আছে; আর তার সর্বনেশে প্রমাণ ভারতবর্ষে আমাদের ঘরের কাছে প্রতিদিন যত পেয়ে থাকি এমন আর কোথাও নয়।
ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি ভারতবর্ষের ঐক্যসাধনে প্রধান বাধা, এটি রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন। পারস্যের জনগোষ্ঠীর ঐক্যচেতনা দেশের উন্নতিকে সুগম করেছে। এর বিপরীত অবস্থা ভারতবর্ষে। এর বিপরীত অবস্থা ভারতবর্ষে। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা –
ঐক্যটাই আমাদের দেশে সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বেশি চাই, অথচ ঐটের বাধা আমাদের হাড়ে হাড়ে। ভারতীয় মুসলমানের গোঁড়ামি নিজের সমাজকে নিজের মধ্যে একান্ত কঠিন করে বাঁধে, বাইরেকে দূরে ঠেকায়; হিন্দুর গোঁড়ামি নিজের সমাজকে নিজের মধ্যে হাজারখানা করে, তার উপরেও বাইরের সঙ্গে তার অনৈক্য। এই দুই বিপরীতধর্মী সম্প্রদায়কে নিয়ে আমাদের দেশ। এ যেন দুই যমজ ভাই পিঠে পিঠে জোড়া; একজনের পা ফেলা আর একজনের পা ফেলাকে প্রতিবাদ করতেই আছে। দুইজনকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করাও যায় না, সম্পূর্ণ এক করাও অসাধ্য।
পারস্যে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ রবীন্দ্রনাথকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। সম্প্রদায়ের ভিন্নতা সত্ত্বেও তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছে মনুষ্যত্বের দীপ্তি। রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে বলেছেন –
দেখা যাচ্ছে ঈজিপ্টে তুরস্কে ইরাকে পারস্যে সর্বত্র ধর্ম মনুষ্যত্বকে পথ ছেড়ে দিচ্ছে। কেবল ভারতবর্ষেই চলবার পথের মাঝখানে ঘন হয়ে কাঁটাগাছ উঠে পড়ে, হিন্দুর সীমানায় মুসলমানের সীমানায়। এ কি পরাধীনতার মরু দৈন্যে লালিত ঈর্ষাবুদ্ধি, এ কি ভারতবর্ষের অনার্যচিত্তজাত বুদ্ধিহীনতা।
পারস্যের রাজার সঙ্গে বৈঠকে রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা থেকে, উদার ধর্মের অবমাননা থেকে কীভাবে মনুষ্যত্বকে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে দুজন মতবিনিময় করেছেন। রাজার সঙ্গে কথোপকথনে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে –
রাজা বললেন, ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের যে দ্বন্দ্ব বেধেছে নিশ্চয়ই সেটা ক্ষণিকা যখন কোনো দেশে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বোধন আসে তখন প্রথম অবস্থায় তারা নিজেদের বিশিষ্টতা সম্বন্ধে বেশি সচেতন হয়ে ওঠে এবং সেইটেকে রক্ষা করবার জন্যে তাদের চেষ্টা প্রবল হয়। এই আকস্মিক বেগটা কমে গেলে মন আবার সহজ হয়ে আসে। আমি বললেম, আজ তুর্কি ঈজিপ্ট পারস্যে নবজাগ্রত জাতির যে পরিচয় আমরা পেয়েছি তাতে দেখলুম, যে বিশিষ্টতাবোধ সংকীর্ণভাবে আত্মনিহিত ও অন্যের প্রতি বিরুদ্ধ, সচেষ্টতার সঙ্গেই তার তীব্রতা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, নইলে সেই অন্ধতার দ্বারা জাতির রাষ্ট্রবুদ্ধি অভিভূত হয়। ভারতবর্ষের উদ্বোধনে যদি সেই সর্বজনের হিতজনক শুভবুদ্ধির আবির্ভাব দেখতে পেতেম তা হলে নিশ্চিন্ত হতেম। কিন্তু যখন দেখতে পাই হিন্দু-মুসলমান উভয়পক্ষেই শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গেই আত্মঘাতী ধর্মান্ধতা প্রবল হয়ে উঠে রাষ্ট্রসংঘকে প্রতিহত করছে তখন হতাশ হতে হয়।
রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণকাহিনিগুলোর মধ্যে পারস্যে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে শিক্ষা, রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ধর্ম সম্পর্কে অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণের কারণে। বোধগম্য ও যৌক্তিক ভাষায় তিনি ধর্মান্ধতার কুফল উপস্থাপন করেছেন। পারস্যের ইতিবাচক সংস্কারকে অনুসরণ করার তাগিদ দিয়েছেন ভারতবাসীকে। শাস্ত্রের অন্ধ অনুকরণের চেয়ে অন্তরের সত্যকে বড় করে ভাবতে বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। একবার কয়েকজন মোল্লা তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়েছিলেন। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, নানা জাতির নানা ধর্মগ্রন্থে নানা পথ নির্দেশ করে, তার মধ্য থেকে সত্যপথ নির্ণয় করা যায় কী উপায়ে। পারস্যের সেই সাক্ষাৎপ্রার্থীদেরকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন –
ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, ‘আলো পাব কী উপায়ে’ তাকে কেউ উত্তর দেয় চকমকি ঠুকে – কেউ বলে তেলের প্রদীপ, কেউ বলে মোমের বাতি, কেউ বলে ইলেকট্রিক আলো জ্বেলে। সেই-সব উপকরণ ও প্রণালী নানাবিধ, তার ব্যয় যথেষ্ট, তার ফল সমান নয়। যারা পুঁথি সামনে রেখে কথা কয় না, যাদের সহজ বুদ্ধি, তারা বলে, দরজা খুলে দাও। ভালো হও, ভালোবাসো, ভালো করো, এইটেই হল পথ। যেখানে শাস্ত্র এবং তত্ত্ব এবং আচার-বিচারের কড়াক্কড়ি সেখানে ধার্মিকদের অধ্যবসায় কথা-কাটাকাটি থেকে শুরু করে গলা-কাটাকাটিতে গিয়ে পৌঁছয়।
রবীন্দ্রনাথের এই অনুধাবন একবিংশ শতাব্দীতে আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে
উঠেছে। উগ্রবাদ আরো হিংস্র ও রক্তপায়ী একালে। এটি মোকাবিলায় প্রয়োজন উগ্রবাদের বিপরীত মতবাদ। রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন সেই মতবাদের প্রাণভোমরা মনুষ্যত্ববোধ।