রবীন্দ্রনাথের একটি অগ্রস্থিত রচনা

পূর্বলেখ : ভূইয়া ইকবাল

রবীন্দ্রনাথের একটি অজানা রচনা পাওয়া গিয়েছে। প্রয়াণের কয়েক মাস আগে কবি শান্তিনিকেতনে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণটি ‘নূতন কবিতা’ শিরোনামে হাতে-লেখা পত্রিকা সাহিত্যিকায় ১৩৪৭-এ গ্রথিত হয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত রবীন্দ্র-রচনাবলীতে বা কবির কোনো বইয়ে প্রকাশ পায়নি।

কবি শান্তিনিকেতনে যেসব মৌখিক বক্তৃতা দিতেন, আশ্রম বিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে কেউ-কেউ (দু-একজন শিক্ষকও) সেসব ভাষণের অনুলিখন করতো। তৎকালের কিশোর অনুলেখকদের মধ্যে কয়েকজন পরবর্তীকালে রবীন্দ্র-পরিকররূপে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। যাঁরা অনুলেখক হিসেবে কবির আস্থা অর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পল্লি-উন্নয়ন প্রকল্প শ্রীনিকেতনের মুখ্য সংগঠক ও শিক্ষক কালীমোহন ঘোষ (১৮৮২-১৯৪০), বিদ্যালয়ের ছাত্র সমেত্মাষচন্দ্র মজুমদার (১৮৮২-১৯২৬), প্রমথনাথ বিশী (১৯০১-৮৫), পুলিনবিহারী সেন (১৯০৮-৮৪), কানাই সামন্ত (১৯০৪-৮৮)ও রথীন্দ্রকান্তি ঘটক চৌধুরী (১৯২১-৮৮) প্রমুখ।

ওইসব অনুলিখিত ভাষণ বিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রদের হাতে-লেখা পত্রিকায় প্রচারিত হতো। শান্তিনিকেতনে ছাত্রছাত্রীদের প্রায় তিরিশটি হাতে-লেখা পত্রিকার নাম জানা যায়। এসব পত্রিকার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিল : শান্তি, বীথিকা, প্রভাত, বাগান, শিশু, কুটির, কানন, বিকাশ, দৈনিক, অরুণ, পঞ্চমী, মধ্যাহ্ন, নিশীথ, যাত্রী, গবেষণা এবং ছবি (এই পত্রিকাটি ছিল ছবি নিয়ে, এতে কোনো লেখা প্রচার হতো না), প্রমা (হিন্দি) ও আশ্রম (বাংলা ও ইংরেজি)।

শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র ও কবির স্নেহধন্য প্রমথনাথ বিশী তাঁর রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন বইয়ে জানাচ্ছেন : এসব পত্রিকা ঘরে ঘরে ‘পড়িবার জন্য দেওয়া হইতো; আর শেষের দিকে লাইব্রেরীতে রাখার ব্যবস্থাও হইয়াছিল।’… ছাত্ররা নিজেরাই লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক; ছবিও নিজেরাই আঁকতো।

রথীন্দ্রকান্তি ঘটক চৌধুরী ও সুপ্রিয়া ঘোষ (পরে শুভময় ঘোষের স্ত্রী)-সম্পাদিত হাতে-লেখা কলেজ বিভাগের সাহিত্যিকা (১৩৪৭) থেকে অনাথনাথ দাস-সম্পাদিত রবীন্দ্রভবনের রবীন্দ্রচর্চা প্রকল্পের ষান্মাসিক সংকলন রবীন্দ্রবীক্ষায় (সংকলন-৩০) ‘নূতন কবিতা’ রচনাটি প্রকাশ পেয়েছিল (ডিসেম্বর ১৯৯৬)। সংকলক আশিসকুমার হাজরার অনুমান রচনাটি রবীন্দ্রনাথ-কর্তৃক পরিমার্জিত। রচনাটি প্রবাসী পত্রিকায়ও  (বৈশাখ ১৩৪৭) পত্রস্থ হয়।

 

নূতন কবিতা

তোমরা আমার ছড়াছন্দে লেখা নতুন কবিতা শুন্তে চেয়েছ, কিন্তু কাজ কী? যার পরিচয় পাকা হয়নি তাকে সহজেই হাত বাড়িয়ে পাবার চেষ্টা করলে পাওয়াই হবে না। এতদিন আমার কাব্যের যে পরিচিত পথে তোমরা চলে এসেছ এদের পথ তার থেকে সম্পূর্ণ বিভিন্ন। প্রথম শুনে এইটেই মনে লাগবে যে এ জিনিস অদ্ভুত। কবি কেন যে হঠাৎ লিখতে বসল ভেবেই পাবে না। পরের সুপারিশ নিয়ে এসব জিনিষ মেনে যাবার বিপদ হচ্ছে এই যে, কী যে মানচ তা নিজেই স্পষ্ট বুঝতে পারবে না। অপেক্ষা করতে দোষ কী? যখন সুযোগ হবে তখন নিজেরাই আবিষ্কার করবে এর স্থান কোথায় এর অর্থ কী। তখন যে চমক লাগবে সে যেন ভ্রমণকারীর মনে নতুন দেশ আবিষ্কারের চমকের মতো। হয়তো কিছুটা সময় নেবে সেই আবিষ্কারের পথে। তা হোক – তাতে ক্ষতি নেই।

আজ আমি যদি ছড়াগুলি তোমাদের পড়ে শোনাই, আমার কণ্ঠস্বরের মোহে এবং পাঠের বৈশিষ্ট্যে হয়তো সেগুলি তোমাদের মনে কিছু রস সৃষ্টি করতে পারে; কিন্তু সে রসসঞ্চার হবে সম্পূর্ণ সাময়িক – তার কোন স্থায়িত্ব নেই। এ সম্পর্কে তোমাদের দিক থেকেই প্রস্ত্তত হতে হবে রসাস্বাদনের জন্যে। এবং সত্যিকারের কাব্যরস উপভোগের সহায়তা তাতেই করবে। যে সৌন্দর্যের মায়াস্পর্শে, ধ্বনির বৈচিত্র্যের যে আঘাতে কবির মনের দ্বার যায় খুলে, উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে রসের প্রস্রবণ – তাঁর রচনার মধ্যেও সেই ধ্বনি এবং সৌন্দর্য বিভিন্ন প্রকারে রূপ লাভ করে। পাঠকেরা নিজেদের মনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং পরিবেষ্টনের সঙ্গে মিলিয়ে নেন কবির রচনার সেই বিশেষ পরিবেষ্টন। পাঠকের এটি একটি বিশেষ শক্তি। এই মিলিয়ে নেবার কৌশলই রসাস্বাদনের পথে সহায়তা করে পাঠকবর্গকে। এই শক্তি সুলভ নয় কাব্য-পাঠকদের মধ্যে – তাই খাঁটি রসগ্রাহীর সংখ্যাও জগতে অধিক নয়। কবিতার বিচারের সময় এই কথা সর্বদা স্মরণ থাকে না। কবিতা আসলে ভালও নয় মন্দও নয়, কবিতার রসগ্রহণের মধ্যে আছে স্বীকৃতি। সার্থক কবিতা হচ্ছে পজেটিভ্ – একটা হ্যাঁ। ছবির উদাহরণ দিয়েই বলা যাক্। নন্দলাল এঁকেছিলেন একটি গাধার ছবি। সে ছবি আমাদের মনকে সম্পূর্ণরূপে অধিকার করেছিল। একথা নিঃসঙ্কোচেই স্বীকার করতে হয়, জীব গাধাটির ধ্বনির মোহ নেই – আকৃতিগত সৌন্দর্যেও কোন গৌরব নেই। কিন্তু নন্দলালের গাধার ছবি দেখে বিনা দ্বিধায় বলতে হয়, হ্যাঁ – কিছু একটা হয়েছে। মনের এই স্বীকৃতির পথটাকে রোধ করে দাঁড়ায় না আমাদের সৌন্দর্যবোধ – কারণ নন্দলালের ছবিতে পাই গাধার প্রকৃত পরিচয়। এই ভাবেই খাঁটি কবিতা রসপিপাসুদের মনের স্বীকৃতি আদায় করে নেয় আপনার সুনিশ্চিত দাবিতে।

একদিন চলেছিলাম বাঁধা পথ বেয়ে। আচমকা চোখে পড়লো অজানা একটি ফুল। ওকে সেই মুহূর্তেই অভিনন্দন জানালেম কল্পনার রাজ্যে, নাম দিলেম রক্তমুখী; স্বীকার করে নিলেম সৃষ্টিকৌশলের নতুন রূপ বলে। মনের সেই সহজ স্বীকৃতি আদায়ের মূলে ছিল না ফুলটির সৌন্দর্যের মোহে ভোলাবার জাদু। ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে নতুন আবিষ্কারের। সৃষ্টির নতুন একটি প্রকাশ বলেই তাকে স্বীকার করে নিয়েছি সহজে। নব নব রস-প্রস্রবণে কবিদের সৃষ্টি এইভাবেই নব-নব রূপে প্রকাশ পায়। সেই নতুন সৃষ্টিকে স্বীকার করে নিতে হয় আপন আবিষ্কারের মধ্যে। সমুদ্র মন্থনে উঠেছিল উচ্চৈঃশ্রবা, – ঐরাবত; তারই সঙ্গে উঠেছিলেন লক্ষ্মী। একই মন্থনে উঠেছিল বিষ – উঠেছিল অমৃত। রূপলাভ করেছিল নব নব সৃষ্টি। কবির মনেও চলেছে নিত্যকালের সেই সমুদ্রমন্থন – নতুন সৃষ্টি আত্মপ্রকাশ লাভ করে সেই মন্থনের ফলে। কোন্ ঢেউয়ের আঘাতে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন কোন সৃষ্টি তা শুধু তারাই জানে, যারা সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে দেখেছে সেই মন্থন।

তাই তোমাদের বলি, চিরকাল আমার কাব্যের একটি বিশেষ পথ ধরে চলতেই তোমরা অভ্যস্ত। তোমরাই আবার একদিন নতুন পথে চল্তে অভ্যস্ত হবে তোমাদেরই নতুন আবিষ্কারে। আমি সে পথ দেখাতে পারি না – তোমরা নিজেরাই সেই পথ আবিষ্কার করো। r