রবীন্দ্রনাথের একটি অজানা কবিতা

সংগ্রহ ও পূর্বলেখ : ভূঁইয়া ইকবাল

 

স্বাক্ষর-শিকারিদের আবদার ছাড়াও নানা প্রতিষ্ঠানের দাবি ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ যে-সব কবিতা লিখেছিলেন তার সব  রবীন্দ্র-রচনাবলী কিংবা অটোগ্রাফ-কবিতার সংগ্রহ স্কুলিঙ্গ অথবা লেখনে সংকলিত হয়নি। এসব অসংকলিত কবিতা রবীন্দ্রভবন মহাফেজখানায়ও গরহাজির।

‘সামাজিক কর্তব্য সাধনে’র উপলক্ষ্যে নানা সময়ে রচিত কিছু লেখার উদাহরণ দেওয়া যাক।

১৮৮৭ সালের ১০ এপ্রিল কলেজছাত্রদের এক সম্মেলন উপলক্ষেও দুটি গান লিখে কবি নিজে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। গান দুটি – ‘আগে চল্ আগে চল্ ভাই’ এবং ‘তবু পারিনে সঁপিতে প্রাণ’ (দেখুন, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র-জীবনী, ১ম খ-, পুনর্মুদ্রণ, ১৪০১, পৃ ২৪৮)।

এক দশক পরে ১৮৯৬-এ কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের এক অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন রহিমতুলস্নাহ মুহম্মদ সিয়ানি। কংগ্রেস প্রতিনিধিদের সম্মানে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এক পার্টি অনুষ্ঠিত হয়; কবি গেয়ে শোনান সদ্যরচিত ‘অয়ি ভুবনমোহিনী’।

১৩১১ বঙ্গাব্দে বেঙ্গল ল্যান্ডহোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনে বরোদার রাজা গায়কোয়াড়ের অভ্যর্থনা উপলক্ষ্যে কবি লেখেন – ‘বঙ্গজননী মন্দিরাঙ্গণ মঙ্গলোজ্জ্বল আজ হে’। পরে মুসোলিনির চর প–ত কার্লো ফরমিকির শান্তিনিকেতনে আসা উপলক্ষ্যে গানটির কিছু পরিবর্তন করা হয়। আবার ১৯৪০-এর আগস্টে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট. উপাধি প্রদান উপলক্ষ্যে শান্তিনিকেতনের অনুষ্ঠানেও গানটি পরিবর্তিত হয়েছিল।

১৯২৬-এর ৮ নভেম্বর হাঙ্গেরির বালাতন হৃদের তীরে লিন্ডেন্ ট্রি চারা রোপণ করেন কবি; ওই বৃক্ষরোপণ উৎসব উপলক্ষ্যে লেখেন – ‘হে তরু, এ ধরাতলে রহিব না যবে’।

১৯৩৫-এর জুনে চিত্তরঞ্জন দাশের স্মৃতিসৌধ উন্মোচনের জন্য কবি লেখেন চতুষ্পদী – ‘স্বদেশের যে ধূলিরে শেষ স্পর্শ দিয়ে গেলে তুমি’ (দেখুন, প্রকীর্ণ কবিতাবলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবিতাসমগ্র (৫ম খ-), পৃ ৪৬২)।

পরের বছর ৬ মার্চ মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনের শান্তিনিকেতন-সফরে আগত প্রতিনিধিদল কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। অসুস্থ কবি মুখে মুখে এই কবিতাটি বলেন, কেউ শ্রম্নতলিপি করেন। কবিতাটির প্রথম চরণ – ‘তোমার আমার মাঝে ঘন হল কাঁটার বেড়া এ কখন সহসা রাতারাতি।’ (দেখুন, রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ, প্রথমা প্রকাশন, দ্বি-স, ২০১২, পৃ ৪০)

১৯৪০-এর নভেম্বরে কলকাতায় অন্ধত্ব মোচন ক্যাম্প উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথের শিরোনামহীন এই দশ চরণের কবিতাটি অনাথনাথ
দাস-সম্পাদিত কবিতাসমগ্রে (৫ খ-) সংগৃহীত হয়নি। কবিতাটি প্রবাসী পত্রিকায় (অগ্রহায়ণ, ১৩৪৭) প্রকাশকালে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে ছাপা হয়নি। ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ বিভাগে ‘অন্ধদের দুঃখ লাঘব শিবির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা’ শিরোনামে সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে কবিতাটি মুদ্রিত হওয়ায় রচনাবলীর সম্পাদকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। কবিতাটির ওপরে এই সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশ পায় :

কলিকাতায় অন্ধজনের যে দুঃখলাঘব-শিবির (Blind Relief Camp) প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে ও যাহা কলিকাতার লর্ড বিশপ ও ভারতের মেট্রোপলিটান [?] উদঘাটন করিয়াছেন, তাহা সাতিশয় প্রয়োজনীয় ও অত্যন্ত হিতকর প্রতিষ্ঠান। আমরা ইহার স্থায়িত্ব ও সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কামনা করিতেছি।

ওই সম্পাদকীয় মন্তব্যে উলেস্নখ করা হয় যে, ‘এই উদ্যোগে ব্যবহারের নিমিত্ত রবীন্দ্রনাথ যে কবিতাটি লিখিয়াছেন, তাঁহা তাহার প্রসাদে পাইয়া নীচে মুদ্রিত করিতেছি।’

 

আলোকের পথে প্রভু দাও দ্বার খুলে

আলোকপিয়াসী যারা আছে আঁখি তুলে।

প্রদোষের ছায়া তলে

হারায়েছে দিশা

সমুখে আসিছে ঘিরে

নিরাশার নিশা।

নিখিল ভুবনে তব যারা আত্মহারা

আঁধারের আবরণে খোঁজে ধ্রম্নবতারা

তাহাদের দৃষ্টি আনো রূপের জগতে

আলোকের পথে।

 

জোড়াসাঁকো। ২.১১.৪০

প্রবাসী

অগ্রহায়ণ ১৩৪৭

পৃ ২৭০-৭১