রবীন্দ্রনাথের ‘ক্যামেলিয়া’ ও ‘প্রথম পূজা’ : নিজেকে ভাঙা

রাশিয়া-ফেরত রবীন্দ্রনাথ পুনশ্চ (১৯৩২) কাব্যটি যখন লিখলেন তখন তাতে লক্ষ করি তিনটি নতুন বাঁক-পরিবর্তন। বস্তুজগতের অনুপুঙ্খ বয়ান, এমনকি তুচ্ছ অবপ্রাণী পর্যন্ত; দ্বিতীয়ত, চিত্রকলা সৃষ্টির অভিজ্ঞতালব্ধ রঙরেখার আরোপণ, শেষত কাহিনি-কাঠামোয় গদ্যছন্দ – যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ভাবছন্দ দিয়ে নতুন ডিকশন রচনা। এর নেপথ্যে তিরিশের কবিতার গদ্যকবিতা সৃষ্টির প্রেরণা থাকলেও যাঁরা পূর্বাপর রবীন্দ্রকবিতা পাঠ করেন তাঁরা জানেন গদ্যকবিতার স্ফুরণ রবীন্দ্রনাথের ১৯২২ সালে প্রকাশিত লিপিকার গদ্যেই বিন্যস্ত হয়েছিল। পুনশ্চের গদ্যকবিতা একান্তই স্বকীয়, রাবীন্দ্রিক, তিরিশি কবিতার চারিত্র্য এতে নেই। তবে বস্তুচিত্র আর কাহিনি-কাঠামো থাকায় কবিতাগুলোকে কবির নবনিরীক্ষাই বলা চলে। কিন্তু বস্তুচিত্রের ভেতরে নিহিত ভাবই মূল মুখশ্রী এবং তা রাবীন্দ্রিক ভাবাদর্শ-বহির্ভূত ভিন্ন কিছু নয়। মানবসংসার, তার চারপাশ, অবহেলিত-অচ্ছ্যুত মানুষের জীবনরূপ ও তার নিত্যদৈনন্দিন বাস্তবতায় এগুলোতে নতুন রং ধরেছে –

যদিও তা পাকা ফলের গায়ে প্রথম রং ধরার মতো।

ঢাকার বলধা গার্ডেনে কবি ক্যামেলিয়া নামের বিদেশি ফুলটিকে দেখেছিলেন। এই ফুলের রাবীন্দ্রিক তাৎপর্য কবিতাটিতে অন্তর্বয়িত – কিছুটা কৌতুককর গল্পচ্ছলে ও মধ্যবিত্ত পুরুষ-চরিত্রের পরিহাসমূলক উপস্থাপনায়। ‘ক্যামেলিয়া’ নামকরণে ঔপনিবেশিক জীবনের পরিস্থিতির গভীরার্থ লুকানো আছে; আছে শ্রেণিবৈষম্যের ইশারাও।

উপনিবেশিত কলকাতার নিম্নবিত্ত কেরানির জীবনরূপ ও মনোলোক আঁকতে গিয়ে ‘বাঁশি’ কবিতায় কবি এঁদোগলির কুশ্রী চিত্র তুলে ধরেন। ‘কলেপড়া জন্তুর মতন অসার’ হরিপদ কেরানি বারবার এই নগর ছেড়ে ধলেশ্বরী নদীপাড়ের গ্রামে ফিরতে চায়, বাঁশির সুর তাকে আহ্বান করে সীমা পেরিয়ে অসীমের দিকে নয় – বাস্তব পৃথিবীর ধলেশ্বরীতীরে, পিসিদের গ্রামে – যেখানে অপেক্ষা করে ছিল কেউ, যার পরনে ‘ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর’। উপনিবেশ-প্রত্যাখ্যানের এই কবিতারই আরেক মাত্রা লক্ষ করা যায় ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতায়। যার পারসোনা একজন মধ্যবিত্ত নায়ক, ট্রামে যাতায়াত-করা কলেজপড়–য়া কমলার পিছু ধাওয়া করে – ‘ও মেয়ে পারে নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে।’ নায়কের পুরুষসুলভ বীরত্ব আর পিছু-ধাওয়া তাকে বিব্রত করে। ট্রাম আর যুবকটি যেমন কলকাতার ঔপনিবেশিক পরিচিহ্ন তেমনি মেয়েটি তা ভেদ করে আত্মসবল, দৃঢ় তার চিবুকের গঠন। এ আর যোগাযোগের কুমুদিনীর মতো ‘সকালের বাসি রজনীগন্ধার ডাঁটা নয়’, এ-নারী সতেজ, কিন্তু সংবৃত। সম্পূর্ণ কবিতায় তার কোনো উচ্চারণ বা কথা নেই, সে নিঃশব্দ, শুধু তার উপস্থিতি আছে। তিরিশের দশকে কলকাতায় শিক্ষিত নারীরা দৃশ্যমান ছিল পথেঘাটে, তারা একলা পথচলা শিখে নিয়েছিল। খণ্ডিত হলেও রেনেসাঁসের আলোর ছোঁয়া সে/ তারা পেয়েছে। পথেঘাটে তাকে আগলে রাখার পুরুষসুলভ বীরত্বপনায় সে বিব্রত। রবীন্দ্রনাথ এই কবিতার পারসোনাকে ‘আমি’র অস্তিত্বে ধারণ করেও তাকে ঊর্ধ্বতন অবস্থানে ধরে রাখেননি। নীরবভাষী কমলা উচ্চ বা অধস্তন – কোনো অবস্থানেই নেই, সে আছে নিজের জায়গায় – আত্মসম্ভ্রম নিয়ে, নিজের অভিরুচি, পরিশীলিত মন নিয়ে। তার

পাশে বরং যুবকটিকেই মনে হয়, করুণাপ্রার্থী, পিছু-ধাওয়া করা হাস্যকর চরিত্র। তার জীবনটাই একঘেয়ে ডোবাজলের ব্যাঙের মতো। প্রেম-প্রত্যাশাই তার জীবনে একমাত্র উদ্দেশ্য।

এই কবিতার আখ্যানে ছোটগল্পের কাঠামো আছে, এটি গদ্যে লিখিত হলে গল্পই হতো। বিস্তারিত কাব্যিক কথনে গল্পটি বয়ন করা হয়। শেষে দেখা যায় কোনো এক ভক্ত তরুণীর কাছ থেকে টবে লাগানো ক্যামেলিয়া ফুলের চারা তার প্রাপ্য হয়। ক্যামেলিয়া ও কমলা – নাম দুটির অনুপ্রাসগত সাদৃশ্য তাৎপর্যময়।

ক্যামেলিয়ার প্রতীকী অর্থ হলো ইউরোপীয় শিক্ষা-সভ্যতা-সৌন্দর্যবোধের পুষ্পালোক, যা এদেশের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণিকে আলোকিত করেছিল। উপনিবেশিত কলকাতার নাগরিকরাই এর দ্বারা বেশি সমৃদ্ধ ছিল। দেশের মূলধারার সব জনমানুষ এই শিক্ষালব্ধ সৌন্দর্যবোধ থেকে ছিল বঞ্চিত। শ্রেণি হিসেবেও এই অধিকার তারা পায়নি। প্রত্যন্ত আদিবাসীরা তো পায়ইনি, এমনকি আজো-প্রায় নয়। শোষণ-বঞ্চনার মধ্য দিয়ে তাদের শ্রম ও জীবনের মৌলিক শক্তিগুলো ছিল অবরুদ্ধ। দু-একজন শিক্ষিত সমাজসচেতন সংস্কারচেষ্টা করেছিলেন তাদের বিকাশ ঘটাতে। সভ্যতামাত্রে মানুষের মৌলিক অস্তিত্ব-পরিচিতি ও সংস্কৃতিকে বিকৃত করে, নিজের মতো করে গড়ে-পিটে নয়। রবীন্দ্রনাথ ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতায় কি ভূমিকা রেখেছেন? পুনশ্চ কাব্যে এই মূলধারা ও আদিধারার যে জীবনরূপায়ণ তা তাঁর শান্তিনিকেতন ও পদ্মাতীরের বসবাস-অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ এবং উদারনৈতিক মানবতাবাদ দিয়ে আলোকিত। ‘ক্যামেলিয়া’য় তিনি এই উদারতাবাদকে ভেঙেছেন। কীভাবে?

তিনি সরাসরি নিজেকে ভেঙেছেন ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতার সাঁওতাল মেয়েটিকে দিয়ে। কবিতার কথক ঘুরেছিল শিক্ষিত কমলার পাছু-পাছু, যদিও তার কাছ থেকে কোনো সাড়াই সে পায়নি। এই ব্যর্থতা মেনে নিয়ে সে প্রত্যাবর্তনে ইচ্ছুক হয়। যাওয়ার আগে সেই টবে লাগানো সদ্যফোটা ক্যামেলিয়া ফুলটি উপহারস্বরূপ কমলার কাছে পাঠাতে চায় গৃহকর্মে রত সাঁওতাল মেয়েটিকে ডাকে। তখন দেখতে পায় ক্যামেলিয়া ফুলটি মেয়েটির – ‘বেরিয়ে এসে দেখি ক্যামেলিয়া/ সাঁওতাল মেয়ের কানে,/ কালো গালের উপর আলো করেছে।/  সে আবার জিগেস করলে, ‘ডেকেছিস কেনে?’ আমি বললেম, ‘এই জন্যেই’,/ তার পরে ফিরে এলেম কলকাতায়।’ এখানে সাঁওতাল মেয়ে নিজেই নিজের অধিকার বুঝে নিয়েছে, সেই অধিকারবোধেই তার সৌন্দর্যবোধ দিয়ে ফুলটি কানে গুঁজেছে। রবীন্দ্রনাথ কী বলতে চাচ্ছেন – এদেরকেই অধিকারচেতন হয়ে আপন স্বত্ব বুঝে নিতে হবে? কেউ তাদের শিক্ষা-সভ্যতার-আলোকস্পর্শ দেবে না, লক্ষণীয় বাক্য ‘কালো গালের উপর আলো করেছে’। এই আলোক একদিকে বঞ্চিত মানুষের ঊষবসবহঃধষ ঋড়ৎপব ড়ভ ষরভব, আরেকদিকে তার প্রাপ্যতা। এখানে উদারনৈতিকতার কোনো পরিসর নেই। এই পরিসর তারা নিজেরাই গড়ে নেবে। কবিতার পারসোনা – ‘আমি’ কিন্তু কলকাতা ফিরে গেল, এর থেকেই ইশারা মেলে যে সে কিছুই করেনি মেয়েটির জন্য, তার জীবনে কোনো পরিবর্তনই আনেনি। নিজের ভালোবাসার মরীচিকার পেছনেই শুধু ঘুরেছে। এমন তাৎপর্য রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ উপন্যাসেও আছে যে, ইতিহাসের নায়ক হয়েও ঘুরপাক খেয়েছে রূপ-অরূপ, ঈশ্বর-নাস্তিকতা, রাজনৈতিকতা, ভক্তিবাদ ইত্যাকার বিষয়ে। কোনো নারীর জীবনই সে রক্ষা করতে পারেনি, বরং দামিনীর মৃত্যুর কারণ হয়েছে।

 

দুই

‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি যেমন রবীন্দ্রনাথের প্রকাশধর্মী ভাবকল্প – অবচেতনের স্বতঃস্ফূর্ত সৃজন নয়, তেমনি ‘প্রথম পূজা’ কবিতাটিও ইতিহাসজ্ঞান এবং অস্পৃশ্য শ্রেণিমানুষের জীবনরূপায়ণ। ভারতবর্ষের অতীতকালের ইতিহাসধারা নিয়ে তাঁর অনেক চিন্তাকল্প ছিল। তার মধ্যে প্রধান সূত্রটি হলো একটি ‘নিত্য লক্ষণ’ – বিচিত্র সংঘাত-যুদ্ধ, বহির্শত্রু-কবলিত ভারতবর্ষ ভাঙনে-গড়নে ওই নিত্য লক্ষণ নিয়ে সগৌরবে ইতিহাসে আসীন। এই নিত্য লক্ষণ হলো পরিবর্তনের মধ্যেও অপরিবর্তনীয় শান্তশ্রী, যার উৎস কল্যাণ। চিন্তাকল্পটি যখন কবিতার ভাবকল্পে রূপায়িত হতে থাকে তখন উদারনৈতিক মতাদর্শ ও সমকালীন রাজনীতির যুগ্মতায় রাবীন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। ‘প্রথম পূজা’য় ন্যারেশনে মতাদর্শ ও বিশ শতকের তিরিশের দশকে সংঘটিত অস্পৃশ্যতাবিরোধী আন্দোলনের প্রতি কবির সজাগ ভূমিকাটি স্পষ্ট হয়। এ-বিষয়ক যে-কটি কবিতা তিনি লিখেছেন তার মধ্যে ‘প্রথম পূজা’ই একমাত্র বিদ্রোহাত্মক। এখানে রবীন্দ্রনাথ নিজের উদারনৈতিক মানবতাবাদী মতাদর্শকে ভেঙেছেন। এ-বিষয়ক বাকি চারটি কবিতায় তিনি উচ্চশ্রেণি কর্তৃক দলিতদের বুকে টেনে নেওয়ার উদারতা দেখিয়েছেন, আর তাদের জীবন-প্রতিবেশকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরিয়ে প্রকাশ করেছেন এবং তাদের শ্রমশক্তিকে মর্যাদা দিয়েছেন।

‘প্রথম পূজা’য় আছে ইতিহাস আর আদিবাসী কিরাত জাতির ভক্তিবাদী চিত্ত ও শিল্পীসত্তার রূপায়ণ। এটিও কাহিনিকল্প, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় রূপকচরিত্র রাজা এখানে নেতিবাচক চরিত্র নিয়ে উপস্থিত। কবিতার স্থানজগৎ ত্রিলোকেশ্বরের মন্দির, সময় দূর-অতীতকাল। আরো দূরাতীতে গিয়ে কবি ইতিহাসগর্ভে প্রবেশ করেন, যখন আর্য-ক্ষত্রিয়রা এই মন্দিরটি দখল করে। যদিও লোকবিশ্বাস মতে, এটি মান্ধাতার আমলে দেবলোকের বিশ্বকর্মা গড়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের পণ্ডিত বলেন, ‘এ মন্দির কিরাত জাতের গড়া/ এ দেবতা কিরাতের।/ একদা যখন ক্ষত্রিয় রাজা জয় করলেন দেশ/ দেউলের আঙিনা পূজারিদের রক্তে গেল ভেসে -/ দেবতা রক্ষা পেলেন নতুন নামে, নতুন পূজাবিধির আড়ালে -/ হাজার বৎসরের প্রাচীন ভক্তিধারার স্রোত গেল ফিরে।/ কিরাত আজ অস্পৃশ্য, এ মন্দিরে তার প্রবেশাধিকার নেই।’ দক্ষিণ ভারতে তিরিশের দশকে অস্পৃশ্যদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার নিয়ে প্রবল আন্দোলন হয়। গান্ধী এতে অংশগ্রহণ করেন। এটি ছিল ধর্মাধিকারের আন্দোলন। যার বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ধর্মাধিকারের আগে দরকার ওদের অর্থনৈতিক উন্নতির অধিকার। সমাজচিন্তক রবীন্দ্রনাথের এ-বিষয়ক ভাবনার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছেন নেপাল মজুমদার তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ-এ। এতে বর্ণিত প্রেক্ষাপট ও বিশ্লেষণ কবিতাটির পটভূমিকে স্পষ্ট করে। আমরা খুঁজছি এর মর্মার্থ ও তাৎপর্য। যা ঘিরে আছে কিরাত জাতির স্থপতি-শিল্পী বৃদ্ধ মাধবের আখ্যানে।

মাধব দূর থেকে ত্রিলোকেশ্বর মন্দিরের দেবতাকে প্রণাম করে, তার ‘মন্দির নেই কিন্তু কণ্ঠে গান আছে’ আর আছে হস্তশিল্প কাজের নৈপুণ্য ও জাদু। যদিও নেই তার ‘বেশে বাসে ব্যবহারে সম্মানের চিহ্ন হতে সে বর্জিত/ বঞ্চিত সে পুঁথির বিদ্যায়।’ – তবু সে ‘জানে কী করে পিতলের উপর রুপোর ফুল তোলা যায়,/ কৃষ্ণশীলায় মূর্তি গড়বার ছন্দটা কী।’ কার্তিক পূর্ণিমার পূজার উৎসবে বিচিত্র বেশে বিচিত্র শ্রেণির মানুষ জমায়েত হতে থাকে। কিন্তু শুক্ল-ত্রয়োদশীর রাতে আকস্মিক ঝড়ে মন্দিরের দেবতার মাথা ভেঙে পড়ে। পূজা উপলক্ষে লোকমেলার উৎসবের বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ ছুঁয়ে যান লোকায়ত সংস্কৃতিকে। আর ঝড়ের তা-বে প্রকৃতির ধ্বংসকারী শক্তিকে দেন চিত্রকল্পের রূপ।

রবীন্দ্রনাথ অস্পৃশ্যদের জীবনচিত্র আঁকতে গিয়ে তা করে তোলেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মোহনীয় চিত্রমালা। কিন্তু মন্দিরের দেবতার ভগ্নদশা রাজাকে ভাবিত করে, কী করে পূজা সম্পন্ন হবে, কেননা খণ্ডিত দেবমূর্তির পূজা হয় না। এটিকে সংস্কার করার কাজে তখন কিরাত জাতির শিল্পী বৃদ্ধ মাধবকে প্রয়োজন হলো – ‘ওই কিরাতেরা ছাড়া কে করবে পাথরের কাজ!/ ওদের দৃষ্টিকলুষ থেকে দেবতাকে রক্ষা’ করা হবে কী উপায়ে। তখন সিদ্ধান্ত হয় যে, মাধব দেবতামূর্তি গড়বে কিন্তু কাপড়ে চোখ বেঁধে নিয়ে। মাধব এ-প্রস্তাবে সম্মত হয় – ‘অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে কাজ করিয়ে নেবেন অন্তর্যামী/ যতক্ষণ কাজ চলবে, চোখ খুলব না।’ তাহলে বলা যায়, কবির মতে, শিল্পীর অন্তর্দৃষ্টিলোকই শিল্পরচনার মৌল শক্তি। দুই চোখ ‘পাকে পাকে কালো কাপড়ে’ বেঁধে দিনরাত মাধব তার সৃষ্টিকাজ করে যায়, আর কিরাতের দল বাইরের সংস্কারকাজ করতে থাকে। একাদশীর রাতে প্রথম পূজার শুভক্ষণ উপস্থিত হলে মাধবের কাজও সমাপ্ত হয়। তখন ‘সূর্য অস্ত গেল, পা-ুর আকাশে একাদশীর চাঁদ।/ মাধব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললে -/ যাও প্রহরী, সংবাদ দিয়ে এসো গে/ মাধবের কাজ শেষ হল আজ।/ লগ্ন যেন বয়ে না যায়।’ প্রহরী চলে গেলে ‘মাধব খুলে ফেললে চোখের বন্ধন।/ মুক্ত দ্বার দিয়ে পড়েছে একাদশী চাঁদের পূর্ণ আলো/ দেবমূর্তির উপরে।’

‘মাধব হাঁটু গেড়ে বসল দুই হাত জোড় করে,/ একদৃষ্টে চেয়ে রইল দেবতার মুখে,/ দুই চোখে বইল জলের ধারা।/ আজ হাজার বছরের ক্ষুধিত দেখা/ দেবতার সঙ্গে মানুষের।’ সেই মুহূর্তে রাজা মন্দিরে প্রবেশ করে দেখেন ‘মাধবের মাথা নত বেদীমূলে।/ রাজার তলোয়ারে মুহূর্তে ছিন্ন হল সেই মাথা।’ মাধব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিদ্রোহ করল। কবিতার তাৎপর্য শেষ দুটি পঙ্ক্তিতে – ‘দেবতার পায়ে এই প্রথম পূজা,/ এই শেষ প্রণাম।’ শিল্পী ও ভক্ত মাধবের বেদিমূলে প্রার্থনা নিবেদনেই দেবতার প্রথম পূজা সম্পন্ন হলো। আর এর পরে দেবতা কারো প্রণতি গ্রহণ করবেন না; তাই ‘এই শেষ প্রণাম’। কিরাত মাধবের এই রাজদ্রোহ রবীন্দ্রনাথেরও; উদারনৈতিক মানবতাবাদের নির্মোক খসিয়ে এই প্রথম তাঁর দ্রোহ, নিজেকে ভেঙে-ফেলা। এ-বিষয়ক বাকি কবিতাগুলোতে তিনি উচ্চশ্রেণি কর্তৃক নিম্নশ্রেণিকে সম্মান প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। কবি ‘ক্যামেলিয়া’র সাঁওতাল মেয়েটির অধিকারবোধকে যেমন নতুন অর্থান্তরে ধারণ করেন, তেমনি ‘প্রথম পূজা’য়ও বঞ্চিত-নির্জিত আদিবাসীদের পূজার অধিকার-প্রতিষ্ঠার দ্রোহ ও গৌরবকে কাহিনিকল্পে রূপায়িত করেন। এই কবিতার নান্দনিকায়ন এই দ্রোহ ও মানুষের গৌরবকেই মর্মবস্তু করে তুলেছে।

কবিতাটি আজো প্রাসঙ্গিক। আজো পৃথিবীতে দখলীকরণ, ক্ষমতায়ন ও ধর্মবাজদের দম্ভের ঘটনাপ্রবাহ অব্যাহত। রবীন্দ্রনাথ এই বাস্তবতার ইশারাও কবিতায় গেঁথে দিয়েছেন। ধর্মাধিকার যে মানুষের অন্তর্সত্তার উৎসারণ – কেড়ে নেওয়া বা চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, সেটিও উক্ত মর্মবস্তুতে নিহিত। এবং শিল্পীকে তাঁর শিল্পকাজ থেকে বঞ্চিত করার ক্ষমতাও দেবতার কাছে গ্রহণীয় নয়। শিল্পীই তাঁর শিল্পকাজের প্রথম পূজারি ও শেষ প্রণতির অধিকারী।