রবীন্দ্রনাথের নাটকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং বন্ধনের সত্য

নাটকে প্রাণ থাকে দ্বন্দ্বে, রবীন্দ্রনাথের নাটকেও সেই দ্বন্দ্বটা আছে, এবং তা প্রধানত মুক্তির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বন্ধনের বাস্তবতার, যেন অচলায়তনের সঙ্গে মুক্তধারার। ওই দু’টি তাঁর নাটকের নাম; এবং অচলায়তনে (১৯২২) যেমন মুক্তধারাতেও (১৯২২) তেমনি বন্ধন আছে, আর আছে সেই বন্ধন থেকে মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা। শেষ পর্যন্ত মুক্তির আকাঙ্ক্ষাটাই জয়ী হয়। রবীন্দ্রনাটকের পরিণতি বিয়োগান্ত নয়, মিলনান্ত; যদিও যন্ত্রণা, দুঃখ, মৃত্যু, আত্মাহুতি অনেক বেদনাদায়ক ঘটনা নাটকের ভেতর ঘটে। জীবনের দুর্ভোগকে রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই জানতেন, এবং মানতেনও, কিন্তু জীবনকে ট্র্যাজেডি হিসাবে দেখতে সম্মত ছিলেন না।

বন্ধন মানুষ নিজেই তৈরী করে, নিজের জন্য কখনো কখনো, অপরের জন্যই অধিকাংশ সময়েই। কাজটা শত্রুতামূলক; কিন্তু এটা অনিবার্য হয়ে ওঠে স্বার্থঘটিত কারণে। রবীন্দ্রনাথ সর্বত্রই মুক্তির পক্ষে, এবং বন্ধনের বিপক্ষে। তাঁর নাটকে দেখি মুক্তির জন্য মানুষ কাজ করছে, চঞ্চল, অস্থির হয়ে উঠছে, কিন্তু বন্ধনটা তো বাস্তবতা, তাকে ভাঙা সহজ নয়। তবু ভাঙতে হয়। আর ওই ভাঙার চেষ্টার ভেতর দিয়ে বন্ধনের যে চরিত্র সেটা পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। পাখি মুক্তি চায়। কিন্তু তার মুক্তির প্রসঙ্গে খাঁচার কথা এসে যায়। ‘পাখির বেদনাকে সত্য করিয়া দেখাইতে হইলে খাঁচার বদ্ধতা ও কঠিনতাকে পরিস্ফুট করাইতেই হয়।’ কথাটা রবীন্দ্রনাথের নিজেরই, অচলায়তনের প্রসঙ্গে লিখেছেন।

নাটক রবীন্দ্রনাথ কম লেখেন নি। হিসাব করলে দেখা যাবে সংখ্যার দিক থেকে কবিতার পরেই তাঁর নাটকের স্থান; কিন্তু কবিতা ও কথাসাহিত্যের তুলনায় তাঁর নাটকের পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তাটা খাটো। তার কারণ আছে। নাটক যদিও তিনি মানুষের জীবন ও তার মনুষ্যত্বের সঙ্কট নিয়েই লিখেছেন, তবু তাতে তত্ত্ব আছে, রয়েছে দার্শনিকতা, যে জন্য সংকেত ও রূপকের ব্যবহার এসে গেছে, অর্থটা সরল হয়ে ওঠেনি; সূক্ষ্মতা এসে সরল সমীকরণের পথে অন্তরায়ের সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া অধিকাংশ নাটকেই রয়েছে গানের ব্যবহার। গান অবশ্যই কাব্যময়তা নিয়ে আসে, তবে নাটকের ভেতরের লড়াইটাকে খানিকটা বুঝি-বা স্তিমিতও করে দেয়। লড়াইটা অবশ্য ভীষণ রক্তপাতের নয়। তাতে রোমহর্ষকতার অভাব রয়েছে; সেই রণক্ষেত্রে গানের সুর ও ছন্দ যে অশোভন এমন বলা যাবে না।

 

দুই

রবীন্দ্রনাথের লেখা নাটকের মধ্যে সবচেয়ে অধিক পরিচিত, আলোচিত ও তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে রক্তকরবী (১৯২৬)। এ নাটকের নান্দনিক সৌন্দর্য অসাধারণ। কিন্তু অন্তর্গত দার্শনিক বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। রক্তকরবীর মূল দ্বন্দ্বটাকে একাধিক নামে চিহ্নিত করা সম্ভব এবং তা করা হয়েছেও বৈকি। একদিকে আছে মানুষের সর্বগ্রাসী রাক্ষুসে লালসা, অন্যদিকে প্রকৃতির স্বাভাবিক ও প্রবহমান জীবন। লড়াইটাকে যন্ত্রের সঙ্গে মনুষ্যত্বের বিরোধ হিসাবে ব্যাখ্যা করাও অযৌক্তিক নয়। দ্বন্দ্বটির ভেতর একটি সময়োত্তীর্ণতা রয়েছে। এটি আগের কালেও সত্য ছিল। কিন্তু একালে বিশেষরূপে প্রকট হয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, ‘কৃষিজীবী ও আকর্ষণজীবী এই দুই জাতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে, এ সম্বন্ধে বন্ধুমহলে আমি প্রায়ই আলাপ করে থাকি। কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্লীকে কেবলই উজাড় করে দিচ্ছে। তাছাড়া শোষণজীবী সভ্যতার ক্ষুধা তৃষ্ণা দ্বেষহিংসা বিলাসবিভ্রম সুশিক্ষিত রাক্ষসের মতোই। আমার মুখের এই বচনটি কবি তাঁর রূপকের ঝুলিতে আত্মসাৎ করেছেন, সেটি প্রণিধান করলেই বোঝা যায়।’

সুশিক্ষিত রাক্ষসের যে শোষণজীবী চরিত্রের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন তার নামটি তিনি উল্লেখ করেন নি; করলে হয়তো ব্যাপারটা স্থূল হয়ে পড়তো, অথবা হতে পারে কবির যে নিজস্ব সংস্কৃতি তার সঙ্গে ওই নামকরণ খাপ খেতো না, কিন্তু আমাদের পক্ষে এটা কোনো অযৌক্তিক কাজ হবে না যদি চিরকালের ওই ব্যাধিটাকে একালের পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদী শোষণব্যবস্থা বলে চিহ্নিত করি। বরঞ্চ তাতে করে ব্যাপারটিকে বুঝতে সুবিধাই হবার কথা। রক্তকরবী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ হবার পরে লেখা, যে যুদ্ধটা ছিল বিশ্বের পুঁজিবাদী শক্তিগুলোর ভেতর আধিপত্য নিয়ে লড়াই। যুদ্ধটা ওইখানেই শেষ হয়ে যায় নি, নাটকটি রচনার একযুগ পরে পুঁজিবাদীরা আরেকটি যুদ্ধ বাধায়, রবীন্দ্রনাথ যেটি দেখে গেছেন, যদিও তার ধ্বংসকার্যের সবচেয়ে নির্মম ছবিগুলো তাঁকে সহ্য করতে হয় নি, সেটি ঘটার আগেই তিনি চলে গেছেন।

নাটকটির নাম প্রথমে ছিল যক্ষপুরী, পরে বদল করে রেখেছিলেন নন্দিনী, এবং শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় রক্তকরবী। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, রক্তকরবীর সমস্ত পালাটি নন্দিনী বলে একটি মানবীর ছবি। চারি দিকের পীড়নের ভিতর দিয়ে তার আত্মপ্রকাশ। ফোয়ারা যেমন সঙ্কীর্ণতার পীড়নে হাসিতে অশ্রুতে কলধ্বনিতে ঊর্ধ্বে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে তেমনি।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘নাটকের মধ্যেই কবি আভাস দিয়েছেন যে, মাটি খুঁড়ে যে পাতালে ধন খোঁজা হয় নন্দিনী সেখানকার নয়, মাটির উপর তলে যেখানে প্রাণের, যেখানে রূপের, যেখানে প্রেমের লীলা নন্দিনী সেই সহজ সুখের, সেই সহজ সৌন্দর্যের।’ নন্দিনী এবং রক্তকরবী আসলে একই, তারা স্বাভাবিক ও প্রাণবন্ত।

মকররাজের এই যক্ষপুরীতে মানুষের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। এখানকার লোকেরা উৎপাটিত, পরস্পরবিচ্ছিন্ন, যান্ত্রিক। তারা আত্মপরিচয় হারিয়েছে। স্বর্ণখোদাইকারকেরা নিজের নামে পরিচিত নয়, তারা পরিণত হয়েছে একেকটি সংখ্যায়। বেচারা অধ্যাপক এখনো পুরোপুরি যন্ত্রে পরিণত হন নি, নবাগত পুরাণবাগিশকে তিনি বোঝাচ্ছেন, ‘পৃথিবীর প্রাণভরা খুশিখানা নির্জের সর্বাঙ্গে টেনে নিয়েছে ওই আমাদের নন্দিনী। এই যক্ষপুরে যত সর্দার আছে, খোদাইকার আছে, আমার মতো পণ্ডিত আছে, মুর্দাফরাশ আছে সব বেশ মিশ খেয়ে গেছে। কিন্তু ও একেবারে বেখাপ্পা। চার দিকে হাটের চেঁচামেচি, ও হলো সুরবাঁধা তাম্বুরী।’ এই নগরটি পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক, পুঁজিবাদ যেমনটা হয়ে থাকে। এখানে কেউ ওকে চায় আত্মসাৎ করবে, কেউ চায় তাড়িয়ে দেবে। কিন্তু নন্দিনী তার স্বভাবগুণেই চায় ব্যবস্থাটাকে ভাঙবে, অস্ত্রের জোরে নয়, প্রাণের জোরে। রাজাকে সে জানিয়ে দিয়েছে, ‘আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমার সঙ্গে লড়াই।’

রাজা নিজেও কিন্তু বন্দী, তার নিজের গড়া ওই ব্যবস্থার ভেতরে। সে নিঃসঙ্গ, তপ্ত, রিক্ত, ক্লান্ত। থাকে লোহার তৈরী জালের ভেতরে। যে সর্দার ও মোড়লরা তার চার পাশে রয়েছে তারা তার পক্ষে কাজ করে, আবার তাকে পাহারাও দেয়, ঘিরে রাখে, রাজা যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে। যক্ষপুরীতে মৈত্রী নেই। রয়েছে রাগ, অবিশ্বাস, হিংসা ও ষড়যন্ত্র। নগরের বাইরে আছে জীবন্ত প্রকৃতি, সেখানে কৃষিকাজ চলে, সেখান থেকে ডাক আসে : ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয়রে চলে আয়, আয়, আয়।’ ঘটনার সময়টা পৌষ মাসের, ফসলকাটার দিনের। রাজার ভেতরে আছে লালসা; তাল তাল সোনা খুঁড়ে তুলেছে তার খোদাইকাররা। কিন্তু ভেতরের মানুষটা এখনো একেবারে পাথর হয়ে যায় নি। যে জন্য নন্দিনীর প্রতি সে চঞ্চল হয়। নন্দিনীর সঙ্গে রঞ্জনের বন্ধুত্ব রাজাকে ঈর্ষাকাতর করে, তার ভেতরে কম্পন ধরায়, রঞ্জনও বিদ্রোহী, সে এই রাজ্যের যান্ত্রিকতাকে মানে না, সে গান গায়, নানান সাজে নিজেকে সাজায়; রঞ্জন কিছুতেই খোদাইকার হবে না। আর আছে বিশুপাগলা। সেও গান গায়, এবং যক্ষপুরীর নিয়মকানুন মানে না।

রঞ্জনকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাজপ্রাসাদে। অন্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেখানে তাকে হত্যাও করা হয়েছে। রাজা বলে রঞ্জনকে সে চিনতে পারে নি। তাকে রঞ্জন বলে না চিনুক, বিদ্রোহী বলে নিশ্চয়ই চিনে ছিল। বিশুপাগলাকেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বন্দীশালায়। কিন্তু সর্দারের লোকেরা শেষ পর্যন্ত কাজটা সম্পূর্ণ করতে পারে নি, বিশুর কারিগরেরা বন্দীশালা ভেঙে ফেলে তাকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছে। ওদিকে নন্দিনীর ডাকে সাড়া দিয়ে রাজা নিজেও এসেছে বের হয়ে; সে ভেঙে ফেলেছে তার ধ্বজা। খবর পেয়ে সর্দার ছুটে এসেছে সৈন্যদের নিয়ে, রাজাকে আটক করবে বলে। কিন্তু তার আগেই রাজা চলে গেছে তাদের নাগালের বাইরে, নন্দিনীর পিছু পিছু। জয় হয়েছে নন্দিনীর, অর্থাৎ প্রাণের। পৌষের যে গান শুরুতে শোনা গিয়েছিল, শেষেও সেটি শোনা যায়। যন্ত্র হেরে যায় মানুষের কাছে।

আসল শত্রু অবশ্য পুঁজিবাদ, ধনলালসার ওপর ভিত্তি করে যে দানবের রূপ নিয়েছে, এবং কেড়ে নিতে চেয়েছে মানুষের মনুষ্যত্ব। মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের যে বিরোধ সেটার মূলে আছে শ্রমের ওপর পুঁজির কর্তৃত্ব, যদিও রবীন্দ্রনাথ ঘটনাটিকে সেভাবে দেখাচ্ছেন না। তাঁর নাটকে সত্য হয়ে উঠেছে মানুষের অস্বাভাবিক ধনলিপ্সা। এই লিপ্সাই আসলে পুঁজিবাদের রূপ গ্রহণ করেছে। যন্ত্রের নিজের কোনো দোষ নেই, যন্ত্র পুঁজিবাদের দাসে পরিণত হয়েছে। কেবল যন্ত্র নয়, যন্ত্রের উদ্ভাবক বিজ্ঞানও পুঁজিবাদের দাসত্ব করছে। মকররাজ তারই অধীনে রয়েছে। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ তাতে নন্দিনী আছে, রয়েছে রঞ্জন ও বিশুপাগলা। বিশুপাগলার পক্ষে কারিগরদের একাংশ যোগ দিয়েছে, তারা বন্দীশালায় আগুন দিয়েছে এবং বিশুকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছে। এমন কি ফাগুলাল, যে কিনা ইতিমধ্যে খোদাইকারদেরই একজন হয়ে গেছে, সেও রুখে দাঁড়িয়েছে, তার দলবলও এই ভাঙার কাজে অংশ নেবে বলে জানা যাচ্ছে। নন্দিনী একা হলে এত সব ঘটনা ঘটতো না। নন্দিনীর জয় তাই পুঁজিবাদবিরোধীদেরই জয়; এবং এই জয়ই হচ্ছে রক্তকরবীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। সেটি ভুললে এর পুরো অর্থ আমরা বুঝতে পারবো না, লড়াইটা আসলে পুঁজিবাদের মনুষ্যত্ববিরোধী নিষ্ঠুর ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতার বিরুদ্ধে মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার। সে আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে রাজা নিজেও যুক্ত হয়ে পড়ে।

রাজার পলায়ন এবং অন্যদের বিদ্রোহে সাময়িক মুক্তির একটা সুবাতাস বইবে এমন আশা আমরা করতেই পারি; কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটার যে অবসান ঘটবে তেমনটা তো ভরসা করা যাচ্ছে না। বিজ্ঞান, যন্ত্র, সম্পদ – সমস্ত কিছুর ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে একটি নতুন ব্যবস্থার তথা সভ্যতারই উদ্ভব ঘটা সম্ভব। কিন্তু সেটা ঘটবে কি ঘটবে না তা বলার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথের নয়, এবং তাঁর পারিপার্শ্বিক সময়, অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির দরুন সে-দায়িত্ব তাঁর পক্ষে নেওয়াটা সম্ভবও ছিল না। নন্দনতত্ত্বের সকল নিয়মকানুনের ভেতরে থেকে রক্তকরবীতে রবীন্দ্রনাথ যা করেছেন তা হলো পুঁজিবাদ যে চরম সত্য তা নয়, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ যে অবশ্যম্ভাবী, এবং সেই বিদ্রোহে মনুষ্যত্বের বিজয় যে অনিবার্য সেই সত্যটাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসা।

রক্তকরবীতে রাজনীতি আছে, এবং সেই রাজনীতিটি পুঁজিবাদের। মকররাজের রাজত্বটা স্বাধীন, অন্য কোনো রাষ্ট্রের সে উপনিবেশ নয়। রাজনীতির এক ধরনের ঔপনিবেশিক তৎপরতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় ১৯২২-এ লেখা তাঁর নাটক মুক্তধারাতে। উত্তরকূটের অবস্থান ওপরে। শিবতরাই রয়েছে নীচে। উত্তরকূট শিবতরাইয়ের ওপর কর্তৃত্ব করে, অনেকটা ঔপনিবেশিক পদ্ধতিতে। উত্তরকূটের যুবরাজ অভিজিৎকে শিবতরাইয়ের শাসনকর্তা নিয়োগ করা হয়েছিল; শিবতরাইয়ের লোকেরা উত্তরকূটের রাজাকে খাজনা দেয়। শিবতরাইয়ের ওপর উত্তরকূটের কর্তৃত্বের আসল ভিত্তিটা হলো নদীর প্রবাহ। মুক্তধারা নেমে এসেছে ওপর থেকে নীচে। সেই ধারাপ্রবাহকে বাঁধ তুলে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্যটা হচ্ছে নদীপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণের ওই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শিবতরাইয়ের প্রজাদের ভেতর ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে তাকে দমন করা। প্রজাদের অসন্তোষ নির্দিষ্ট আকার নিয়েছে খাজনা প্রদানে অসম্মতিতে। শিবতরাইয়ের লোকদের অজুহাত সেখানে দুর্ভিক্ষ চলছে; রাজা রণজিৎ-এর বক্তব্য দুর্ভিক্ষ হয়েছে বলে রাজার প্রাপ্য তো বন্ধ হতে পারে না। উত্তরকূটে বিভূতি নামে একজন বুদ্ধিমান ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক আছে; জন্ম তার কামারের ঘরে, কিন্তু নিজের ‘যোগ্যতা’য় সে এখন যন্ত্ররাজ হয়ে উঠেছে, এবং শিবতরাইয়ে নদীর জলপ্রবাহকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য যে বাঁধ তৈরী সে-কৃতিত্ব তারই প্রাপ্য। এজন্য সময় লেগেছে, বহু মানুষকে বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োগ করা হয়েছে, যাদের অনেকেই ফিরে আসে নি।

মন্ত্রীর সঙ্গে রাজার কথোপকথনে রাজনৈতিক সমস্যাটা প্রকাশ পায়। রাজা তার মন্ত্রীকে বলে, শিবতরাইয়ের প্রজাদের কিছুতেই তো বাধ্য করা যাচ্ছিল না, মুক্তধারার জলকে আয়ত্ত করে এখন ওদের বশ মানাবার উপায় হয়েছে। জলের প্রবাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে অন্যের ওপর কর্তৃত্ব করার যে রাজনীতি বর্তমানকালে বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে, এবং আগামী দিনে তেলের সঙ্গে জল নিয়েও যে যুদ্ধ লাগবার আশঙ্কা সেটা রবীন্দ্রনাথ অত আগে, সেই ১৯২২ সালেই আঁচ করতে পারছিলেন। অন্য অনেকদিকে তো অবশ্যই, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হিসাবেও তিনি মোটেই সামান্য ছিলেন না।

রাজা মন্ত্রীকে অভিযুক্ত করছে, ‘কতবার বলেছ উপরে চেপে বসে নীচে চাপা দেওয়া সহজ, আর বিদেশী প্রজাদের সেই চাপে রাখাই রাজনীতি। এ কথা বলো নি?’ মন্ত্রী স্বীকার করে যে চেপে বসবার সেই রাজনৈতিক পরামর্শ সে দিয়েছিল, কিন্তু সেটা ছিল তখনকার জন্য, এখন অবস্থা বদলেছে, শিবতরাইয়ের প্রজারা ক্ষেপে উঠেছে, এখন তাই আগের নীতি আর চলবে না। রণজিৎ-এর খুড়া মহারাজ বিশ্বজিৎ রাজত্ব করেন পার্শ্ববর্তী মোহনগড়ে, তাঁর পরামর্শ মুক্তধারার প্রবাহকে বাঁধমুক্ত করে দেবার। রণজিৎকে তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সকল তৃষিতের জন্য দেবদেবীর কমণ্ডলু যে জলধারা ঢেলে দিচ্ছে সেই মুক্ত জলকে তোমরা বন্ধ করবে কেন?’ ওদিকে শিবতরাইয়ের লোকেরা বিশ্বাসই করতে পারে না যে, দেবতা তাদের যে জল দিয়েছেন কোনো মানুষ তা বন্ধ করতে পারবে। অথচ বিভূতি ঠিক সেটাই করেছে। দম্ভ ভরে সে বলে, ‘দেবতা তাদের কেবল জলই দিয়েছেন, আমাকে দিয়েছেন জলকে বাঁধবার শক্তি।’ সেই শক্তি সে পেয়েছে রাজার সমর্থনে; বিজ্ঞানকে পরিণত করেছে দাসে, রক্তকরবীর শাসক শ্রেণীর মতোই। উত্তরকূটের মানুষেরাও শিবতরাইয়ের ওপর কর্তৃত্ব করার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে দীক্ষিত হয়ে পড়েছে। সেখানকার বিদ্যালয়ের ছেলেরাও জানে যে বিভূতি শিবতরাইয়ের খাবার জল বন্ধ করে দিয়েছে। এবং বন্ধ করার কারণ হচ্ছে ওদেরকে জব্দ করার ইচ্ছা। ওদেরকে কেন জব্দ করতে হবে? তার কারণও লেখা আছে পাঠ্যপুস্তকে। কারণ হলো শিবতরাইয়ের লোকেরা খারাপ, ওদের ধর্ম খুব খারাপ, ওদের নাকও উত্তরকূটের লোকদের নাকের মতো উঁচু নয়।

উত্তরকূটে অবশ্য ধনঞ্জয় বৈরাগীর মতো মানুষও রয়েছে। এই রাজনীতি সে মানে না। সে গান গায়, এবং না-মানার কথা বলে। খাজনার প্রশ্নে ধনঞ্জয় রাজাকে জানিয়ে দেয়, ‘আমার উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার, ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়।’ শিবতরাইয়ের মানুষদেরকে সে ক্ষেপিয়ে তোলে। কিন্তু তার তো কোনো দলবল, সৈন্যসামন্ত নেই। ধনঞ্জয় বলেছে তার সঙ্গীদেরকে, ‘এক পায়ে চলার মতো দুঃখ কি আর আছে? রাজত্ব একলা যদি রাজারই হয়, প্রজার না হয়, তা হলে সেই খোঁড়া রাজত্বের লাফানি দেখে তোরা চমকে উঠতে পারিস কিন্তু দেবতার চোখে জল আসে। ওর খাতিরেই রাজত্ব দাবী করতে হবে।’ ধনঞ্জয় নন্দিনী ও রঞ্জনের মতো কেবল বিদ্রোহী নয়, সে প্রায় বিপ্লবীই। কিন্তু ওই যে বললাম তার তো কোনো নিজস্ব বাহিনী নেই। শিবতরাইয়ের মানুষদের কপাল ভালো তাদের পক্ষে আছে উত্তরকূটের যুবরাজ অভিজিৎ। অভিজিৎকে পাঠানো হয়েছিল শিবতরাইয়ে, শাসন করতে। কিন্তু সে প্রজাদের পক্ষে চলে যাচ্ছে দেখে তাকে ফেরৎ নিয়ে আসা হয়েছে। অভিজিৎ বাঁধটাকে ভেঙে ফেলতে কৃতসংকল্প। কেননা শিবতরাইয়ের মানুষের জন্য তার ভালোবাসা তো রয়েছেই, তদুপরি মুক্তধারা নদীর জলের শব্দে সে তার নিজের ‘মাতৃভাষা’ শুনতে পায়।

অভিজিৎকে বিপজ্জনক বিবেচনা করে রাজা রাজকর্তব্য পালন করে, তাকে আটক করার পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু সফল হয় না। যুবরাজ চলে গেছে বাঁধের কাছে। রাজকুমার সঞ্জয়ও যুবরাজের পক্ষে। অভিজিৎ-এর  হস্তক্ষেপে ঘটনা শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছে তার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে : ‘ওই বাঁধের একটা ত্রুটির সন্ধান কী করে তিনি জেনেছিলেন। সেইখানে যন্ত্রাসুরকে তিনি আঘাত করলেন, যন্ত্রাসুর সেই আঘাত ফিরিয়ে দিলে। তখন মুক্তধারা সেই আহত দেহকে মায়ের মতো কোলে তুলে নিয়ে চলে গেল।’ যুবরাজের প্রাণের বিনিময়ে শিবতরাইয়ের লোকেরা সাময়িকভাবে রক্ষা পেলো। নইলে রক্তপাত ঘটতো। বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হতো। কেননা যুবরাজকে বন্দী করা হয়েছে শুনে শিবতরাইয়ের হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসছিল তাকে মুক্ত করবার জন্য। যুবরাজকে ফেরৎ না পেলে তারা ফিরে যেতো না। তাদের ইচ্ছা যুবরাজকে তারা শিবতরাইয়ের রাজা করবে।

নাটকের সমাপ্তি জলস্রোতের শব্দের ভেতর দিয়ে। বাঁধ ভেঙে গেছে। মুক্তধারা ছুটছে। ধনঞ্জয় বলে, যে যুবরাজকে তারা খুঁজতে বের হয়েছিল শিবতরাইয়ের মানুষেরা তাকে চিরকালের জন্য পেয়ে গেল মুক্তধারার বন্ধনমুক্তির মধ্য দিয়ে।

বাঁধ ভাঙার গান দিয়ে তাসের দেশেরও (১৯৩৩) সমাপ্তি বটে। তবে এই বাঁধ ভিন্ন প্রকারের, নদীর নয়, নিয়মকানুন শৃঙ্খলের। নাটকের শেষে আমরা ওই দেশের সকল মানুষের একসঙ্গে গাওয়া গান শুনতে পাই, ‘বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও/ বন্দী প্রাণমন হোক উধাও।’ নাটকের শুরুতে শুনতে পেয়েছিলাম রাজপুত্র বলছে সোনার খাঁচায় সে আর বন্দী থাকবে না। যে রাজ্যে তার বসবাস সেখানে কোনো বৈচিত্র্য নেই, সুযোগ নেই কোনো প্রকার দুঃসাহসিক কাজের। শিকারে গেলে মনে হয় রাজশিকারী বাঘগুলোকে অহিংসা নীতির দীক্ষা দিয়েছে। এ পর্যন্ত একটি বাঘকেও সে ভদ্ররকমের লাফ মারতে দেখে নি। মুক্তির খোঁজে রাজপুত্র জাহাজ নিয়ে বের হয়ে পড়ে, সঙ্গে নেয় সওদাগরপুত্রকে। ঝড়ের মুখে পড়ে তাদের জাহাজটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, এবং রাজপুত্র ও বণিকপুত্র গিয়ে ওঠে এক নতুন দেশে। সে-দেশটা অদ্ভুত। সেখানকার মানুষগুলো সব তাসের মতো। তাদের নিজস্ব কোনো পরিচয় নেই, ব্যক্তিত্ব নেই, স্বাধীনতা থাকবার প্রশ্নই ওঠে না। আসলে তাসেরই দেশ সেটা, মানুষের নয়। এদের দলীয় গানে রয়েছে : ‘তোলন নামন/ পিছন সামন/ বাঁয়ে ডাইনে/ চাইনে চাইনে।’ তাসদের রাজা আছে, রানী আছে, গোলাম আছে; কিন্তু তারা সবাই একই ভাবে বন্দী। অনেকটা বুঝি পরাধীন ভারতবর্ষের স্বৈরাচার-শাসিত রাষ্ট্রের মুখ”ছবি। সকলেই যথারীতি চলে, নিয়মের বাইরে যায় না কোনো মতেই। এরা শিকলকে মনে করে অলঙ্কার, জেলখানাকে বলে শ্বশুরবাড়ি।

এখানে বিদেশী ওই দুই জন, দু’টি স্বাভাবিক মানুষ, রাজপুত্র ও সওদাগরপুত্র এসে পড়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এরা গান গায়, নৃত্যও করে, বলে ‘আমরা নতুন যৌবনেরই দূত, আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত।’ দেশের মেয়েরাই দেখা গেল প্রথমে নিয়ম ভাঙতে চাইছে। তারা আর তাস থাকবে না, মানুষ হয়ে উঠবে, এই রকমের ইচ্ছা। রাজা দেখছে ক্রমশ সে একলা হয়ে পড়ছে। এমন কি রানীও তার সঙ্গে নেই। ক্রুদ্ধ রাজা রানীকেও নির্বাসনে পাঠায়। কিন্তু রানী তাতে মোটেই অসন্তুষ্ট নয় দেখে রাজা নিজেও তাসের রাজ্যের বাইরে রওনা দেয়, রানীর পেছনে পেছনে। বিদেশী রাজপুত্রকে সে জিজ্ঞাসা করে, ‘ওগো বিদেশী, আমিও কি পারব?’ অর্থাৎ সেও তাস না থেকে মানুষ হতে চায়। মানুষ হওয়ার প্রথম পদক্ষেপটাই হচ্ছে মুক্ত হওয়া।

নাটকটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে, সুভাষচন্দ্র বসু তখন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি; তাঁর নেতৃত্বে দেশে নতুন চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। আবার রক্ষণশীল যাঁরা তাঁরা সুভাষকে পছন্দ করছেন না, তাঁদের মধ্যে স্বয়ং গান্ধীজিও ছিলেন। পরাধীনদের মুক্তির জন্য আপোসবিমুখ এবং অঙ্গীকারবদ্ধ নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন করে, এই বক্তব্য তাসের দেশের ভেতরে রয়েছে। তবে সে-নেতৃত্ব কেবল বয়সেই নতুন হবে না, তাকে চিন্তার দিক থেকেও নতুন হতে হবে। জনগণের ভেতর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, প্রয়োজন নতুন চিন্তা ও নেতৃত্বের; তাসের দেশ এই সত্যের দিকেও ইঙ্গিত করছে।

 

রবীন্দ্রনাথের ছোট্ট একটি নাটক, নাম ডাকঘর (১৯১২); সেখানেও দেখি বন্ধনের বিরুদ্ধে মুক্তির প্রবল আকুলতা। ডাকঘরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিজের জীবনের একটি সঙ্কটের যোগ আছে। বয়স তখন তাঁর পঞ্চাশ হয়ে গেছে। অথচ যে সব কাজ করতে চেয়েছিলেন সেগুলো করে উঠতে পারেন নি। জনস্বীকৃতিও উল্লেখযোগ্যরূপে আসে নি। কোথাও যাবার ডাক তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন। এ সময়ে সাময়িকভাবে হলেও মৃত্যুচিন্তাতেও তাঁকে পেয়ে বসেছিল। রবীন্দ্রনাথের নিজের পক্ষে এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। যে-বছর ডাকঘর লেখেন সে-বছরই তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমাকে সঙ্গে নিয়ে ইংল্যান্ড যান, সঙ্গে ছিল গীতাঞ্জলির অনুবাদ, যা তার জন্য বিশ্বজুড়ে খ্যাতি বহন করে আনে। কিন্তু বালক অমলের পক্ষে তো তেমন কোনো মুক্তি লাভ সম্ভব ছিল না।

অমল উন্মুক্ত পথের ডাক শুনেছে, সে অস্থির হয়ে পড়েছে বের“বার জন্য, কিন্তু তার পক্ষে আটক অবস্থা থেকে ছাড়া পাবার কোনো উপায় নেই। বালকটির মা নেই, বাবাও মারা গেছে। মাধব দত্ত সংসারী গৃহস্থ, তার সন্তান নেই, অমলকে সে পালক হিসাবে নিয়েছে। তার অতিযত্নের কারণেই হয়তো অমল অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অমল এখন গ্রাম্য কবিরাজের চিকিৎসাধীন, যে কবিরাজ তার চলাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। এক সময়ে সে চলাফেরা করতো, এখন উঠানে পর্যন্ত যাওয়াও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তার ঘরের দরজা বন্ধ, সে জানালার পাশে বসে থাকে, দূরের ও নিকটের দৃশ্য দেখে, নানা কিছু কল্পনা করে। দইওয়ালাকে দেখে, বালকদেরকে দেখে যারা মাঠে যাচ্ছে খেলা করতে, সুধাকে দেখে, যে মালিনীর মেয়ে। তাদের সঙ্গে তার কথা হয়। এরা সকলেই সহানুভূতিশীল। অমলের দুঃখটা তারা বোঝে। এমন কি প্রহরীও তার বাইরে যাবার আকাঙ্ক্ষাটার প্রতি দুর্বল। বোঝে না কেবল কবিরাজ এবং মোড়ল। মাধব দত্ত জানে অমলের কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু মনে করে কবিরাজের নিষেধাজ্ঞা না মানলে অমলের ক্ষতি হবে। জানালার পাশে যে অন্ধখোঁড়া ভিখিরি আসে, একজন যাকে ঠেলে নিয়ে যায়, অমল বলে ভালো হয়ে উঠলে ঠেলে নেবার কাজটা সে নিয়ে নেবে।

কিন্তু এক সময়ে জানালার পাশে বসে থাকাটাও বন্ধ হয়ে যায়। মাধব দত্তের ধারণা জানালার পাশে রোজ রোজ বসে থেকেই তার ব্যামোটা বেড়ে গেছে। অমল বলে, ‘আমার ব্যামোর কথা আমি কিছুই জানি নে কিন্তু সেখানে থাকলে আমি খুব ভালো থাকি।’  মাধব দত্তের প্রতিক্রিয়া : ‘সেখানে বসে তুমি শহরের যত রাজ্যের ছেলেবুড়ো সকলের সঙ্গেই ভাব করে নিয়েছ – আমার দরজার কাছে যেন মস্ত মেলা বসে যায় – তাতেও কি কখনো শরীর টেকে।’ অমলের যথার্থ আপনজন শুধু একজনই, ফকিরবেশী ঠাকুরদা।

এরই মধ্যে অমল দেখেছে নতুন ডাকঘর বসেছে। ঠাকুরদাকে সে জানায়, ‘প্রথমে যখন আমাকে ঘরের মধ্যে বসিয়ে রেখে দিয়েছিল তখন আমার মনে হয়েছিল যেন দিন ফুরাচ্ছে না, আমাদের রাজার ডাকঘর দেখে অবধি আমার রোজই ভালো লাগে।’ সে আশা করে রাজার কাছ থেকে তার নামে চিঠি আসবে। আর ডাক-হরকরা হতেও তো তার ভীষণ ইচ্ছা। শেষ পর্যন্ত এক রাতে রাজদূত এসে উপস্থিত। বন্ধ দরজা ভেঙে তার প্রবেশ। রাজকবিরাজও আসে। দরজা জানালা সব খুলে দিতে বলে। অমলের ঘুম পায়। সে ঘুমিয়ে পড়ে। ধারণা করা যেতে পারে যে অমলের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সে ঘুমিয়ে পড়েছে এমনটা মনে করাটাও অসঙ্গত নয়। ঘুম হোক আর মৃত্যুই হোক, সামান্য মানুষদের অসামান্য তত্ত্বাবধানের হাত থেকে অমল যে মুক্তি পেয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

অচলায়তন (১৯১২) এবং ডাকঘর একই বছরে লেখা। উভয় নাটকেই মানুষকে আটকে রেখেছে মানুষের শত্রুপক্ষ। ডাকঘরের ঘটনা ছিল একজন বালককে ঘিরে, অচলায়তনে দেখা যাচ্ছে একটি জনগোষ্ঠী আটকা পড়ে আছে। অচলায়তনে কোনো কিছুই সচল নয়। এখানে আছে পাথরের প্রাচীর, বদ্ধ দরজা, নানা রেখার গণ্ডি, স্তূপাকার পুঁথি, মন্ত্রপাঠের গুঞ্জনধ্বনি – এসব হচ্ছে এই বিশেষ আয়তনের ভেতরকার বৈশিষ্ট্য। পরিবেশটা অত্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন, বলা যায় ইউরোপে যেমনটা ছিল মধ্যযুগ বলে কথিত সময়টাতে। এখানে জ্ঞানের চর্চা চলে, কিন্তু সে-জ্ঞান মাকড়সার জালের চাইতে উন্নত মানের কিছু নয়। পঞ্চক এই অচলায়তনের বাসিন্দা বটে, কিন্তু সে বাইরের ডাক শুনতে পেয়েছে, টানটা এমন যে তার পক্ষে সেটাকে উপেক্ষা করবার কোনো উপায়। অচলায়তনের ছাত্রদের একজন পঞ্চককে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘আচ্ছা। বলো দেখি হরেত পক্ষীর নখাগ্রে যে পরিমাণ ধূলিকণা লাগে সে পরিমাণ যদি -,’ জবাবে পঞ্চকের বক্তব্য, ‘আরে ভাই, হরেত পক্ষীই কোনো জন্মে দেখি নি।’ যে পরিবেশে তাদের বসবাস সেখানে ছাত্রের প্রশ্নটি কিন্তু মোটেই অস্বাভাবিক নয়। মধ্যযুগের ইউরোপেও শোনা যায় একটি সূচের চিকন অংশ কয় শ’ শয়তান নৃত্য করতে পারে নিয়ে জিজ্ঞাসা উত্থিত হতো এবং সংখ্যা নিয়ে বিতর্কও চলতো। সুভদ্র নামে এক বালক নিতান্ত ভ্রমবশত উত্তরের একটি জানালা খুলে ফেলেছিল, যেখান থেকে দেখা যায় বাইরে পাহাড় আছে এবং সেখানে গোরু চরছে। তিনশ’ পঁয়তাল্লিশ বছর যে জানালা খোলা হয় নি সেটিকে এভাবে উন্মুক্ত করায় সুভদ্র অত্যন্ত বিপন্ন বোধ করছে, এবং কান্নাকাটি করছে।

অচলায়তনটা যে কেবল বাইরের ঘটনা তা নয়, ভেতরেরও ব্যাপার বৈকি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সংশয়ও দেখা দিয়েছে। পঞ্চকের চঞ্চলতা আমরা দেখেছি। আচার্যও বলছেন যে তাঁর আশা ছিল যে সাধনার শেষে কিছু পাওয়া যাবে, এখন টের পাচ্ছেন যে সেই সাধনা কেবল আপনাকেই আপনি প্রদক্ষিণ করেছে। ওদিকে প্রতীক্ষা চলছে গুরুর। বর্ষার আরম্ভে তিনি নাকি আসবেন। এসে হয়তো-বা লজ্জায় ফেলবেন অচলায়তনিকদেরকে তাদের জ্ঞানের স্বল্পতা অবলোকন করে।

শেষ পর্যন্ত গুরু যখন এলেন তখন অচলায়তনের গোঁড়া সদস্যদেরকে তিনি সত্যি সত্যি ভীষণ লজ্জায় ফেললেন, কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে, দেখা গেল তিনি অচলায়তনের বিধিব্যবস্থা ও সনাতনী প্রথা মোটেই মানেন না, উল্টো সেটাকে ভেঙে ফেলতে চান। এ কাজে তাঁর সহায়ক শক্তি হচ্ছে দেয়ালের বাইরের শোণপাংশুরা, যারা কাজের লোক, কাজ খোঁজে, কাজ ছাড়া কিছু বোঝে না, এবং কাজ না পেলে ভারি অস্থির হয়ে পড়ে। শোণপাংশুদের কাছে তিনি দাদাঠাকুর হিসাবে পরিচিত। শোণপাংশুদের তিনি নেতা, ওদের সঙ্গে তিনি খেলে বেড়ান। খেলতে খেলতে তাঁর মনে হয় ‘আমি ঝরনার সঙ্গে খেলছি, সমুদ্রের সঙ্গে খেলছি।’ শোণপাংশুদের একজন তার দলের সকলের পক্ষ হয়েই যেন বলে যে, দাদাঠাকুর যদি অচলায়তনের ভেতরে যান তাহলে সেখানকার পাথরগুলোসুদ্ধ নাচতে আরম্ভ করবে, পুঁথিগুলোর মধ্যে বাঁশি বাজবে। পঞ্চক বেরিয়ে এসেছে। তার বড় ভাই মহাপঞ্চক অচলায়তনের রক্ষাকর্তাদের মধ্যে প্রধান হয়ে ওঠে, পঞ্চককে সে নির্বাসনে পাঠায়। পঞ্চক ভাবে সে বেঁচে গেল। তার উপলব্ধি এই রকমের : ‘খাঁচায় যে পাখিটা জন্মায়, সে আকাশকেই সব চেয়ে ডরায়।’ পঞ্চকের ভয়-ডর ভেঙে গেছে। শোণপাংশুরা ছাড়াও রয়েছে দর্ভক সম্প্রদায়। তারা সামান্য মানুষ। তাদের আস্থা ভক্তিতে। দাদাঠাকুরকে তারা চেনে গোঁসাই হিসাবে। অচলায়তন ভাঙার কাজে যারা বাধা দেবে তাদের বিরুদ্ধে লড়তে তারাও সম্মত। অচলায়তন সম্পর্কে দাদাঠাকুরের ঘোষণা : ‘আমাদের রাজার আদেশ আছে – এদের পাপ যখন প্রাচীরের আকার ধরে আকাশের জ্যোতি আচ্ছন্ন করতে উঠবে তখন সেই প্রাচীর ধূলোয় লুটিয়ে দিতে হবে।’ প্রাচীরের ওপর রাজপথ তৈরী হবে, রাজপথ দিয়ে চলবে রাজার বিজয় রথ।

শীঘ্রই খবর আসে দাদাঠাকুরের অনুসারী শোণপাংশুরা অচলায়তনের প্রাচীর ফুটো করে দিয়েছে। মহাপঞ্চকের কাছে এ খবর মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে তার সঙ্গের লোকদের আশ্বাস দেয়; বলে শিলা কি কখনো জলে ভাসে। ‘ম্লেচ্ছরা অচলায়তনের প্রাচীর ফুটো করে দেবে। পাগল হয়েছ।’ তার প্রতীক্ষা এখনো গুরুর জন্য। সে আশা করে, গুরু এসে সব ঠিক করে দেবেন। তিনি আসবেন দ্বারপথে। কিন্তু উপাধ্যায় জানাচ্ছে যে দ্বারের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না, ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। মহাপঞ্চক তবু হার মানবে না, তার ভরসা ভেতরে আছে লোহার দরজা।

অচলায়তনেরও একজন রাজা আছেন। নাম তার মন্থর গুপ্ত। রাজা খবর পেয়েছেন দাদাঠাকুরের দল অচলায়তনের রাজ্যসীমার প্রাচীর ভাঙতে আরম্ভ করেছে। পরে যখন শুনলেন উত্তর দিকের জানালা খোলা হয়ে গেছে, তখন বেচারার নিতান্তই বেহাল দশা, তিনি একেবারে বসে পড়লেন। বালকেরা কিন্তু মহাখুশি। তারা মজা পেয়েছে। হঠাৎ করেই যেন ছুটি পেয়ে গেছে। সবদিক থেকেই আলো আসছে, সব যেন ফাঁক হয়ে গেছে। সমস্ত আকাশটা ঘরের মধ্যে দৌড়ে এসেছে। খুশি নয় কেবল মহাপঞ্চক। সে দেখে যোদ্ধৃবেশে দাদাঠাকুর এসেছেন; পেছনে প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে অস্ত্রধারী শোণপাংশুরা যাদেরকে সে কর্মকাণ্ডহীন ম্লেচ্ছ ভিন্ন অন্যকিছু মনে করে না। বাইরের সব কিছুই যখন বেদখল হয়ে গেছে অপরাজেয় মহাপঞ্চক তখন তার নিজের ভেতর চলে যায়, ইন্দ্রিয়ের সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে প্রায়োপবেশনে বসে।

দাদাঠাকুরের দল লড়াই করেছে। বীরবেশে দাদাঠাকুরকে দেখায় অত্যন্ত মনোহর। ততক্ষণে দর্ভক দলও এসে পড়েছে। তারা শুনেছে অচলায়তনে লড়াইয়ের জন্য তাদের প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজন হয় নি। তার আগেই পতন ঘটেছে অচলায়তনের প্রাণহীন অবরোধের। আকাশে মেঘ করেছিল, বজ্রধ্বনি শোনা যাচ্ছিল, এবার নেমে এলো বৃষ্টি, যার জন্য শুকনো পৃথিবী প্রতীক্ষায় ছিল। দাদাঠাকুর বলেন, ‘ভাবনা নেই আচার্য, ভাবনা নেই – আনন্দের বর্ষা নেমে এসেছে… বাইরে বেরিয়ে এলেই দেখতে পাবে চারি দিক ভেসে যাচ্ছে।’ কিন্তু ওই যে ভেঙে ফেলা অচলায়তনকে সেটা ধ্বংসের প্রয়োজনে নয়, সৃষ্টির প্রয়োজনে বটে। শোণপাংশুরা অস্থির হয়ে পড়েছে; তারা কাজ চায়। দাদাঠাকুর এবার তাদেরকে কাজ দেবেন গঠনের, মুক্ত অচলায়তনকে আয়তনে অনেক বড় করবার, যাতে সেখানে সকলেরই স্থান হয়, বাধা নিষেধ উবে যায়। এতে নেতৃত্ব দেবে পঞ্চকদাদা। পঞ্চকের গান দিয়ে নাটকের শুরু, নবনির্মাণে নিযুক্ত হতে তার প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে নাটকের শেষ।

 

মধ্যযুগের ইউরোপের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল ইহজগতবিমুখতা, যে রকম ঘটনা আমরা দেখলাম অচলায়তন নাটকে; ওই যুগের আরেকটি দিক গীর্জার সঙ্গে রাজপ্রাসাদের প্রচণ্ড বিরোধ। রবীন্দ্রনাথের একেবারে প্রথম দিকের নাটক বিসর্জন (১৮৯০); সেখানে ওই বিরোধটিকে আমরা দেখতে পাবো।

ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা গোবিন্দমাণিক্য রাজপুরোহিত রঘুপতির সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে চান না। রাজমন্দিরকে তিনি মান্য করেন। কিন্তু পুরোহিত রঘুপতির কামনা তাঁর নিজের ক্ষমতা রাজপ্রাসাদের অধীনে থাকবে না, বরঞ্চ ছাড়িয়ে যাবে। রঘুপতির ক্ষমতা কম নয়। রাজ্যের মানুষ তাদের সঙ্কটে বিপদে ধর্মের আশ্রয় নেয়; আর ধর্মের আশ্রয় মানেই দেবীর কাছে আসা, সেখানে আছেন রঘুপতি, একাধারে মা কালীর সেবক ও তার রক্ষক হিসেবে। সেদিক থেকে রঘুপতির প্রতাপ রাজক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যায়। স্বয়ং রাজমহিষী তার অনুগ্রহপ্রার্থী। রাজমহিষীর কোনো সন্তান নেই, তাই তিনি ঠিক করেছেন মন্দিরে একশ’ মহিষ ও তিনশ’ ছাগ বলি দেবেন। রাজায় রাজপুরোহিতে বিরোধের প্রকাশ্য সূত্রপাত এখান থেকেই।

বলির জন্য যে তিনশ’ ছাগ সংগ্রহ করা হয়েছে তাদের একটি অনাথ ভিখারী বালিকা অপর্ণার; সে-মেয়ে মাতৃস্নেহে ওই ছাগ শিশুটিকে লালনপালন করেছে। রাজা গোবিন্দমাণিক্য যাচ্ছিলেন মন্দিরে, প্রবেশপথে অপর্ণার সঙ্গে তাঁর দেখা। অপর্ণার ছাগ শিশুটিকে রক্ষা করার অশ্রুময় নিবেদনে রাজা বিচলিত হলেন, তিনি নির্দেশ দিলেন এখন থেকে ত্রিপুরা রাজ্যে কোনো পশুবলিদান চলবে না। এতে রঘুপতির ক্রুদ্ধ হবার কথা, তিনি হলেনও, তাঁর ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে দেখে। রাজমহিষী ক্ষুব্ধ তাঁর সন্তান লাভের আশা নষ্ট হচ্ছে ভেবে। কিন্তু রাজা অনড়।

জয়সিংহ রাজপুরোহিত রঘুপতির পালিত রাজপুত যুবক, সে রাজমন্দিরের সেবক। তার ওপর ভার পড়েছে বলির পশু সংগ্রহের। অপর্ণা তাকে ডাকে। মন্দির থেকে বের হয়ে আসতে বলে। জয়সিংহ বিচলিত হয়। ক্রোধান্ধ রঘুপতি রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায়কে প্ররোচিত করেন রাজাকে হত্যা করে মা কালীর রক্ততৃষ্ণা মেটাতে। নক্ষত্ররায়ের সাহস হয় না। তখন জয়সিংহের ওপর আদেশ আসে রাজরক্ত সংগ্রহের। জয়সিংহকে অপর্ণা আবারো ডাকে মন্দির ছেড়ে চলে আসতে। ‘তুমি চলে এসো জয়সিংহ, ও মন্দির ছেড়ে দু’জনে চলে যাই।’ জয়সিংহ দ্বিধায় পড়ে। দেবীপ্রতিমাকে সে বলে, ‘তোমার মন্দিরে এ কী নতুন সঙ্গীত/ ধ্বনিয়া উঠিল আজি, হে গিরিনন্দিনী…/ হে শোভনে, কোথা এ মন্দির ছেড়ে/ কোথায় আশ্রয় আছে?’ শেষ পর্যন্ত সে ঠিক করে তার নিজের দেহেও যেহেতু রাজরক্ত আছে, তাই গোবিন্দমাণিক্যের রক্তের পরিবর্তে নিজেদের রক্ত অর্পণ করে দেবীর রক্ততৃষ্ণা নিবারণ করবে। আর ঠিক সেটাই করল সে। জয়সিংহের মৃতদেহ দেখে অপর্ণা মূর্ছা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারই জয় হয়। জয়সিংহকে হারিয়ে রঘুপতি অপর্ণার মধ্যে নিজের জননীকে দেখতে পায়, পাষাণের কালীমূর্তিকে সে গোমতী নদীতে নিক্ষেপ করে। অপর্ণা তাকে পিতা বলে সম্বোধন করে মন্দির থেকে বের হয়ে আসতে বলে। রঘুপতি তাই করে।

ইতিমধ্যে গোবিন্দমাণিক্যও অবশ্য তাঁর রাজত্ব হারিয়েছেন। ষড়যন্ত্রের দায়ে ভ্রাতা নক্ষত্ররায়কে তিনি অষ্টবর্ষের জন্য নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন; রঘুপতিকেও সেই একই দণ্ড দিয়েছিলেন, যে জন্য রঘুপতি রাজরক্ত সংগ্রহের জন্য জয়সিংহকে আদেশ করেছিলেন। নির্বাসিত নক্ষত্ররায় মোগলসেনাদের হাতে পড়ে যায়, এবং তাদের প্ররোচনায় রাজাকে নির্বাসন দণ্ড দিয়ে পত্র পাঠায়। যুদ্ধ অবধারিত ছিল, কিন্তু গোবিন্দমাণিক্য রক্তপাত চান না, তাই তিনি স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান। তাঁর সঙ্গে রাজমহিষী গুণবতীও যোগ দেন।

জয় ভিখারিণী অপর্ণারই। অপর্ণার অন্য কোনো সম্পদ নেই। কিন্তু রয়েছে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা। রঘুপতি ধার্মিক নয়, ধর্মব্যবসায়ী। তার আসক্তি ক্ষমতায়। নিজের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য মদ্যপান করে। রাজ্যের সাধারণ মানুষকে সে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে দেবীর পূজায় বিঘ্ন ঘটলে হিন্দু রাজত্বের অবসান ঘটবে, রাজ্য মুসলমানদের হয়ে যাবে। তার পরাজয় গোবিন্দমাণিক্যের কাছে নয়, গোবিন্দমাণিক্য তাকে অষ্টবর্ষের জন্য নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন, সেখানে তিনি নক্ষত্ররায়ের সান্নিধ্য পেতেন এবং রাজত্ব দখলের ষড়যন্ত্রে অনায়াসে অংশীদার হয়ে পড়তেন। রাজপুরোহিত পরাজিত হয় ভিখারিণী অপর্ণার কাছেই। যাকে সে গালমন্দ করতো, দুর দুর করে তাড়িয়ে দিত, তাকেই জননী বলে গ্রহণ করেছেন। জয়সিংহের আত্মাহুতিই ধরিয়ে দিয়েছে ক্ষমতালিপ্সার প্ররোচনায় কেন রঘুপতি নৃশংস ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।

গোবিন্দমাণিক্যের ভেতর একজন সন্ন্যাসী ছিল, এমনটা বলা যায়; কিন্তু তিনি যে স্ত্রীর অনুরোধ, পুরোহিতের ষড়যন্ত্র, প্রজাদের অসন্তোষ সব কিছুকে উপেক্ষা করে জীববলিদান নিষিদ্ধ করে দিয়ে ‘সহস্র বছর ধরে’ প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন সেই শক্তিটা পেলেন কোথায়? পেয়েছেন ওই অপর্ণার কাছ থেকেই। রাজার নিজের উক্তি এই রকমের : ‘বালিকার মূর্তি ধরে/ স্বয়ং জননী মোরে বলে গিয়েছেন/ জীবরক্ত সহে না তাঁহার?’ জয়সিংহ পারতো মন্দির ত্যাগ করে অপর্ণার সাথে পথে চলে আসতে, রক্তকরবীর রাজা যেমন ভাবে বেরিয়ে এসেছে নন্দিনীর পিছু পিছু, কিন্তু কিশোর জয়সিংহের ভেতর অতটা শক্তি ছিল না। চূড়ান্ত বিচারে মন্দিরের দেবী মা কালীও পরাভূত হয়েছে অপর্ণার কাছেই। ওই দেবী পাষাণ প্রতিমা, অপর্ণা মূর্তিমান মানুষ। অপর্ণার কারণেই নিষিদ্ধ হয়েছে জীববলিদান, পাষাণ মূর্তি নিক্ষিপ্ত হয়েছে নদীতে।

অপর্ণা যেন রক্তকরবীর নন্দিনীর পূর্বাভাস। নন্দিনীর তুলনায় তার সাফল্য অধিক। নন্দিনী একজন রাজাকে মুক্ত করেছে, পুরোহিততন্ত্রের আধিপত্যকে পরাভূত করে। অপরদিকে অপর্ণা মুক্ত করতে পেরেছে একটি রাজ্যকে। দু’জনের সাফল্যের ভেতর এই যে পার্থক্য সেটা যে তাদের চরিত্রের ব্যক্তিগত গুণের ব্যবধানের দরুন তা নয়; আসলে দু’জনের শত্রু ছিল দু’রকমের। নন্দিনীকে লড়তে হয়েছে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, যেটি অনেক বেশী সুসংহত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। অপর্ণার লড়াইটা ছিল পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে যেটি ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল। তবে এদের দু’জনের সঙ্গেই অন্যরাও ছিল; অপর্ণা পেয়েছে রাজা এবং জয়সিংহের সাহায্য, নন্দিনীর পক্ষে ছিল রঞ্জন, বিশু এবং পরে ফাগুলাল।

 

তিন

রবীন্দ্রনাথের নাটকে আমরা যে রাজাদেরকে পাচ্ছি তারা সকলে এক রকমের নয়। মুক্তধারার রাজা রণজিৎ-এর রাষ্ট্রশাসনে ঔপনিবেশিকতা আছে, তাসের দেশের রাজা নিজের দেশে প্রচলিত আইনকানুন বিধিনিষেধে নিজেই বন্দী। অচলায়তনের রাজা তেমন শক্তিশালী নয়। গোবিন্দমাণিক্যের স্বভাব অনেকটা রাজর্ষির মতো। ডাকঘরের রাজা অনুপস্থিত। রক্তকরবীর মকররাজ পুঁজিবাদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। রথের রশিতে রাজা বড়ই অসহায়। কিন্তু রাজা (১৯১০) নাটকের রাজাকে নিয়ে সমস্যা আছে ব্যাখ্যার।

এই নাটকে রাজা থাকেন অন্ধকার ঘরে। রানী সুদর্শনার সঙ্গে তাঁর মিলন অন্ধকারেই। রানী নানাভাবে চেষ্টা করেন রাজার চেহারা দেখতে। অনুরোধ, অভিমান, রাগ কোনো কিছুতেই কাজ হয় না, রাজা রানীর সামনে আলোতে আসতে রাজি হন না। সুরঙ্গমা রাজার দাসী, সে রাজাকে দেখতে পায় সেবার মধ্য দিয়ে, ঠাকুরদা’র সঙ্গে রাজার বন্ধুত্ব, তিনিও রাজাকে চেনেন। চেনে না শুধু রানী, রাজাকে যে একান্ত আপন ও নিজের মতো করে পেতে চায়। সুদর্শনা অস্থির। তাকে রূপের নেশায় পেয়েছে। রাজাকে সে দেখতে চায়, বুঝতে চাইবার আগ্রহটা তার নেই। রাজা জানেন চঞ্চল সুদর্শনা তাঁর রূপটাকে সহ্য করতে পারবে না। এর আগেই বিভিন্ন দেশের রাজারা এসে হাজির হয়েছে, তারা রানী সুদর্শনাকে দেখতে চায়। কাঞ্চীরাজ ষড়যন্ত্র করে রানীর প্রাসাদে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, রানী যাতে বেরিয়ে আসে। কিন্তু রানী বেরিয়ে আসে না, রাজা আগুন নেভানোর ব্যবস্থা করে ফেলে, এবং রানীর বারংবার অনুরোধে রাজা শেষ পর্যন্ত তাঁকে দেখা দেন। তিনি জানতেন যে রানী কেবল রূপকেই দেখবে, অরূপকে নয়; রাজার নিষ্ঠুরতার দিকটা তার চোখে পড়বে, ভালোবাসার দিকটা রয়ে যাবে অপ্রকাশ্য। রাজার যে রূপ রানী দেখতে পায় সেটা তার কাছে এমনই অপ্রত্যাশিত ও কালো যে তাকে ভীষণভাবে হতাশ হতে হয়। রানীর ইচ্ছা করে দূরে চলে যেতে, রাজা বাধা দিলে কী হতো বলা যায় না, কিন্তু রাজা বলেন, ‘ঝড়ের মুখে ছিন্ন মেঘ যেমন অবাধে চলে তেমনি তুমি অবাধে চলে যাও।’

রানী সুদর্শনা চলে যায় তার পিতা কাণ্যকুব্জরাজার গৃহে। সুদর্শনার পিতা দুর্বল এবং ভীষণ রকমের পিতৃতান্ত্রিক। তার বিশ্বাস সুদর্শনা যেহেতু আপন প্রতিষ্ঠা থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে তখন সংসারে সে ভয়ংকর বিপদ হয়ে দেখা দেবে। সেই বিপদটা ঠিকই আসে। আশেপাশের সাত রাজা তৎপর হয়ে ওঠে, তারা সুদর্শনার পিতৃগৃহে গিয়ে হানা দেয়। অসহায় কাণ্যকুব্জরাজকে তারা লাঞ্ছিত করে, এবং সুদর্শনাকে বাধ্য করে স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হতে। কিন্তু রাজা তো রয়েছেন, অলক্ষ্যে থেকে তিনি সবটা দেখছেন। সেনাপতির দায়িত্বসহ ঠাকুরদাকে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন রাজাদেরকে বিতাড়িত করতে। ঠাকুরদা যোদ্ধৃবেশে প্রবেশ করেন। কিন্তু কোনো যুদ্ধ হয় না, কেননা নরপতিদের কেউ অনিশ্চিত পুরস্কারের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিল না। তারা মোটেই লড়াইয়ের দিকে চোখ রাখেনি, পরস্পরের দিকেই চোখ রেখেছিল। একজনই কিছুটা লড়ে, কিন্তু সে-ও আহত হয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।

রাজাকে দেখা না-দেখা, এবং রাজার রূপ-অরূপ নিয়ে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব, এবং তা যে দেওয়া হয় নি এমনও নয়। তবে রাজার অদৃশ্য থাকার প্রবণতা ও রাজ্য শাসনপ্রণালীর ভেতর রাষ্ট্রীয় রাজনীতিও রয়েছে। ওই রাজ্যের রাষ্ট্রীয় রীতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় কয়েকটি বিষয় থেকে। প্রথমত, নাগরিকদের গান, যেটা অনেকটা জাতীয় সঙ্গীতের মতো, গানের ভেতর দিয়ে তারা বলছে : ‘আমরা সবাই রাজা/ আমাদের এই রাজার রাজত্বে/ নইলে মোরা রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে।’ আরো বলা হচ্ছে, ‘আমরা নই বাধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে’; এবং ‘রাজা সবারে দেন মান মান,/ সে মান আপনি ফিরে পান/ মোদের খাটো করে রাখে নি কেউ কোনো অসত্যে।’ বোঝা যাচ্ছে রাজ্যে বৈষম্য নেই, রয়েছে সমানাধিকার ও স্বাধীনতা। এখানে ত্রাস নেই; রাজা নিজে কারো দাস নন, অন্যকেও তিনি দাস বানাতে চান না, সকলের জন্যই রয়েছে সমান সম্মান। এই রকমের একটি কল্পলোকে রাজা যদি প্রকাশ্য হয়ে পড়েন তাহলে বিপদের আশঙ্কা থাকে। কেননা তখন পক্ষপাতের প্রশ্ন আসবে, বিপরীতে দেখা দেবে কারো কারো প্রতি অপক্ষপাত। কেউ আশা করবে পুরস্কার, কাউকে দিতে হবে শাস্তি। চলবে আবেদন নিবেদন ও তোষামুদি। রাজা তাই পথে বের হওয়াটা পছন্দ করেন না, অথচ তিনি সর্বত্রই আছেন – সূর্য যেমন থাকে। নাগরিকদের গানে এটাও বলা আছে, ‘আমরা চলব আপন মতে/ শেষে মিলব তারি পথে।’

পথের ব্যাপারটাও লক্ষ্য করবার মতো। এ রাজ্যে পথচলার কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, সবাই চলে আপন মতে, কিন্তু সব পথই রাষ্ট্রীয় পথ, কোনোটাই ব্যক্তিগত নয়। কয়েকজন বিদেশী এসেছে বসন্ত পূর্ণিমার উৎসবে যোগ দিতে। তারা রাস্তা খোঁজে। প্রহরী বলে, ‘এখানে সব রাস্তাই রাস্তা। যেদিক যাবে ঠিক পৌঁছবে। সামনে চলে যাও।’ বিস্মিত এক বিদেশী জানায়, ‘আমাদের দেশে তো রাস্তা নেই বললেই হয় – বাঁকাচোরা গলি, সে তো গোলক ধাঁধা। আমাদের রাজা বলে, খোলা রাস্তা না থাকলেই ভালো; রাস্তা পেলেই প্রজারা বেরিয়ে চলে যাবে। এদেশে উল্টো, যেতেও কেউ ঠেকায় না, আসতেও কেউ মানা করে না – তবু মানুষও তো ঢের দেখছি – এমন খোলা পেলে আমাদের রাজ্য উজাড় হয়ে যেত।’ এই রাজ্য অচলায়তন নয়, এখানে সবকিছু খোলামেলা। এবং খোলা বলেই কেউ রাজ্য ছেড়ে চলে যায় না। ঠাকুরদা’র বক্তব্যও ব্যাপারটাকে তুলে ধরে; নাগরিকদেরকে তিনি বলেন, ‘রাজা নেই, তোমরাই আছো। তাঁর সবই তো তোমার জন্যেই।’ এখানে তথাকথিত আইনের শাসন খুব একটা জরুরী নয়।

সুদর্শনার উদ্দেশে রাজার গান আসলে নাগরিকদের ক্ষেত্রেও খাটে : ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব।’ কিন্তু রাজা তো ননীর পুতুলটি নন, তাঁকে রাজ্য শাসন করতে হয়। এবং শাসনের ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর হতে হয় বৈকি। ভয় দেখানোরও প্রয়োজন পড়ে। ওই রাজ্যের নাগরিকদের একজনই তো মন্তব্য করছে, শুনি আমরা, ‘সকল দেশেই রাজাকে দেখে দেশশুদ্ধ লোকের আত্মাপুরুষ বাঁশপাতার মতো হী হী করে কাঁপতে থাকে।’ রাজাকে দেখে লোকে ভয় পাক, আঁতকে উঠুক, কাঁপতে থাকুক, এবং বিরূপ হয়ে বলতে থাকুক তিনি কেমন ভয়ঙ্কর, বিদঘুটে, কুৎসিত – রাজা তা চান না। তিনি যে অপরূপ, অনুপম, সেটা বুঝতে অনুশীলনের প্রয়োজন, যেটা সুদর্শনার ছিল না। সে জন্যই তার কাছে দৃশ্যমান হতে রাজার আপত্তি। এমন কি সুরঙ্গমার কাছেও তো এক সময়ে রাজা ছিলেন ভীষণ ভয়ঙ্কর। তার কারণ সুরঙ্গমা রানী সুদর্শনাকে জানিয়েছে। সুরঙ্গমার বাবা মদ খেত আর জুয়া খেলত। রাজ্যের যত যুবক সঙ্গে এসে জুটত। রাজা বাবাকে শাস্তি দিয়েছিলেন, তাকে নির্বাসিত করেছিলেন। সুরঙ্গমা জানাচ্ছে, ‘খুব রাগ হতো। ইচ্ছে হয়েছিল যদি কেউ রাজাকে মেরে ফেলে তো বেশ হয়।’ বাপের থেকে ছাড়িয়ে এনে সুরঙ্গমাকে রাখা হয়েছিল। সুরঙ্গমার বর্ণনায় : ‘আমি নষ্ট হবার পথে গিয়েছিলুম। বাবা ইচ্ছে করেই আমাকে সে পথে দাঁড় করিয়েছিলেন। আমার মা ছিল না।’ সুরঙ্গমার তখন ‘কী কষ্ট। আমাকে যেন ছুঁচ ফোটাতো, আগুন পোড়াত, কেননা আমি নষ্ট হবার পথে গিয়েছিলুম। সেই পথ বন্ধ হতেই মনে হলো আমার যেন কোনো আশ্রয় রইল না। আমি খাঁচায় পোরা বুনো জন্তুর মতো কেবল গর্জে বেড়াতুম এবং সবাইকে আঁচড়ে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করত। উঃ কী নিষ্ঠুর। কী নিষ্ঠুর। কী অবিচলিত নিষ্ঠুরতা।’ তারপরে, ‘সমস্ত দুরন্তপনা হার মেনে একদিন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তখন দেখি যত ভয়ানক ততই সুন্দর।’

দেখবার এই চোখটা সুদর্শনার থাকবার কথা নয়; ছিলও না। রাজা চেয়েছিলেন ক্রমে ক্রমে রানীর কাছে নিজেকে প্রকাশ করবেন। সুদর্শনার বিলম্ব সয় নি, অপ্রস্তুত অবস্থায় রাজদর্শনের বিড়ম্বনা তাই তাকে সহ্য করতে হয়। নানা রকমের দুর্যোগ, দুর্ভোগ ও আশঙ্কা পার হয়ে শেষ পর্যন্ত রাজার সঙ্গে রানীর মিলন ঘটে, রাজপ্রাসাদে নয়, রাস্তায়। সুদর্শনা জানায় : ‘আজ আমার সেই ধূলোমাটির রাজার সঙ্গে পদে পদে এই ধূলোমাটিতে মিলন হচ্ছে – এ সুখের খবর কে জানত।’

এ নাটকের রাজনৈতিক তাৎপর্যটি লক্ষ্য করা জরুরী। দেশের শাসক, এক্ষেত্রে রাজা, যতই অপ্রত্যক্ষ থাকেন ততই দেশের জন্য মঙ্গল। রাজা থাকবেন, তিনি লক্ষ্য করবেন সমস্ত কিছু, কিন্তু প্রয়োজন না হলে আত্মপ্রকাশ করবেন না। আদর্শ রাষ্ট্রে রাজার হস্তক্ষেপও ঘটবে কম, সেখানে নাগরিকেরা সবাই সমান, ব্যবস্থাটা গণতান্ত্রিক। সকলেই সম্মানিত, এবং সবার মধ্যেই এই ভাবটা থাকবে যে রাজ্য তাদের সকলের, মালিকানা তাদেরই। রাজা রইবেন অটল, যে জন্য তাঁকে মনে হবে নিষ্ঠুর, এমনও ভ্রম ঘটবে যে তিনি বীভৎস, কিন্তু আসলে তিনি অপরূপ, অনুপম। একটা বন্ধন থাকবে, কিন্তু সেটা দরকার হবে অন্য কারণে নয়, মুক্তির প্রয়োজনে।

 

চার

খুবই ছোট একটি নাটক রথের রশি (১৯৩২)। কিন্তু যেমন নান্দনিক বিচারে, তেমনি দার্শনিক বিবেচনায় এ নাটক প্রায় রক্তকরবীর কাছাকাছি অবস্থানে পৌঁছে যায়। রথের রশিতে ঘটনা নিতান্ত কম ঘটে না, এর সংলাপ অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও ঝলমলে। ব্যক্তি চরিত্র দাঁড় করবার অবকাশ সঙ্কীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তির ভেতরে শ্রেণী চরিত্র দেদীপ্যমান। রথের রশিতে কৌতুকের ব্যাপার বিস্তর আছে, প্রহসনের উপাদানও উপস্থিত, কিন্তু বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রক্তকরবীতে আমরা পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য দেখেছি, মানুষ সেখানে উৎপাটিত, বিচ্ছিন্ন, যান্ত্রিক ও মনুষ্যত্ববিহীন হতে চলেছে, রথের রশিতে সেই দৌরাত্ম্য আরো গভীরে চলে গেছে। এখানে এসে পুঁজিবাদ ইতিহাসের অগ্রগতিকেই স্তব্ধ করে দিয়েছে। নাটকটির একটি ভিন্ন নামও আছে, সেটি হচ্ছে কালের যাত্রা। রথটি কালের, অর্থাৎ ইতিহাসের। পুঁজিবাদ তাকে অনড় করে দিয়েছে। কিন্তু রথটিকে তো এগুতেই হবে, মানুষের সভ্যতা তো বর্তমানে এসে থেমে যেতে পারে না, তাকে ভবিষ্যতের দিকে চলতেই হবে। সেই যে অগ্রগতি সেটা অসম্ভব করে তুলেছে এতকাল যারা রথের যাত্রী ছিল তারাই। রাজা, পুরোহিত, সৈনিক, ধনিক, সবাই এককালে ক্ষমতাবান ছিল, কিন্তু এখন তারা নিজেদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, রথ তাদের টানে মোটেই সাড়া দিচ্ছে না। আজ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে নতুন শক্তির। সেই শক্তি শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছাল, শূদ্ররা চলে এলো। তারা একসাথে যখন টান দিয়েছে রথের রশিতে রথ তখন জেগে উঠেছে, এবং প্রবল বেগে এগিয়ে গেছে। প্রচলিত, প্রতিষ্ঠিত পথ মানবে না, নতুন পথ পেয়ে যাচ্ছে। ওই যে শূদ্রদের টানে রথ চললো এর তাৎপর্য কেবল এই নয় যে বর্ণভেদ প্রথা ভেঙে না পড়লে সভ্যতার মুক্তি নেই; তাৎপর্যটি আরো গভীর। শূদ্রের রূপক-এ রবীন্দ্রনাথ শ্রমিক শ্রেণীকেই নিয়ে এসেছেন। এরাই চাষ করে এবং অন্ন যোগায়, এরাই তাঁত বোনে এবং বস্ত্র সরবরাহ করে মানুষের লজ্জা ঢাকে, রথও এরাই টেনেছে। কিন্তু এতকাল এদের স্থান ছিল নীচে, রথের চাকার তলায় পড়ে পিষ্ট হওয়াই ছিল এদের বিধিলিপি। এখন নতুন যুগ এসেছে, এ যুগে এরা আর পিষ্ট হবে না, এরাই রথকে টেনে নিয়ে যাবে সামনে। রথ গিয়ে হানা দেবে বণিকের ভাণ্ডারে, সেখান থেকে আর্তনাদ উঠবে, বণিক সাহায্য চাইবে সৈনিকের। কিন্তু সৈনিকের অস্ত্রশালাও দেখা যাবে আর নিরাপদ নয়। রথ মুক্ত, চলমান, এখন সে আর উঁচু-নীচু মানবে না, সবাইকে বুঝি সমান করে দেবে। নাটকের বিষয়টা এই রকমেরই।

এ নাটকের নাম প্রথমে ছিল রথযাত্রা, পরে হয়েছে রথের রশি। অর্থাৎ রথ থেকে সরে গিয়ে চোখটা গিয়ে পড়ল তার রশির ওপর। রথের চেয়ে রথের রশিটাই এখানে বড়। রথ নিজে নিজে চলে না, তাকে টেনে নিয়ে যেতে হয়, টানবার জন্য রশির দরকার পড়ে। বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে এটা যে রশিটা দুর্বল হয়ে পড়েছে, তার গ্রন্থিগুলো এখন শিথিল, যে জন্য রশি ধরে টান দিলে রশি নিজেও আগের মতো নড়ে না, এবং টানটা গিয়ে রথের ওপর পড়ে না। রথ তাই নিশ্চল হয়ে পড়ে রয়েছে। রথের রশি উৎসর্গ করা হয়েছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে, তাঁর ৫৭তম জন্মোৎসবে। উৎসর্গপত্রে রবীন্দ্রনাথ রশির রূপকটাকে বেশ পরিষ্কার করে দিয়েছেন : ‘মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধবোধ দেশে দেশে যুগে যুগে প্রসারিত, সেই বন্ধনই এই রথ টানবার রশি।’ অর্থাৎ এতে রাজনীতি ও অর্থনীতি আছে, এবং সমাজনীতি তো অবশ্যই রয়েছে। চূড়ান্ত বিচারে মানবিক সম্বন্ধই সামাজিক সম্বন্ধ বৈকি। রবীন্দ্রনাথ আরো লিখেছেন, ‘সেই বন্ধনে অনেক গ্রন্থি পড়ে গিয়ে মানবসম্বন্ধ অসত্য ও অসমান হয়ে গেছে, তাই চলছে না রথ। এই সম্বন্ধের অসত্য এতকাল যাদের বিশেষভাবে পীড়িত করেছে, মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, আজ মহাকাল তাদেরই আহ্বান করেছেন তাঁর রথের বাহনরূপে, তাদের অসম্মান ঘুঁচলে তবেই সম্বন্ধের অসাম্য দূর হয়ে রথ সম্মুখের দিকে চলবে।’ এই বঞ্চিত মানুষেরা হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী, ইতিহাস যাদেরকে আহ্বান জানিয়েছে তার রথের বাহন হবার জন্য। ইতিহাসের রথ এখন থেকে এদের টানেই চলবে। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘কালের রথযাত্রার বাধা দূর করবার মহাযন্ত্র তোমার প্রবল লেখনীর মুখে সার্থক হোক, এই আশীর্বাদসহ তোমার দীর্ঘজীবন কামনা করি।’

নাটকে সভ্যতার একটি দুর্দশার ছবি আছে, যেটি বিশেষ ভাবে ফুটে উঠেছে সন্ন্যাসীর বিবরণে। মহিলারা রথ চলে না দেখে খুবই উদ্বিগ্ন, কিন্তু ঘটনার ব্যাপকতা ও গভীরতা তারা তেমনভাবে উপলব্ধি করতে পারে নি যেমনটা করেছেন সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসী জানাচ্ছেন যে, ইতিহাসের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ হয়ে যাবার দরুন ‘বাধবে যুদ্ধ, জ্বলবে আগুন, লাগবে মারী/ ধরণী হবে বন্ধ্যা, জল যাবে শুকিয়ে।’ তিনি দেখতে পাচ্ছেন, ‘আজ ধনীর আছে ধন/ তার মূল্য গেছে ফাঁক হয়ে/ ভরা ফসলের খেতে বাসা করেছে উপবাস।’ সন্ন্যাসী সর্বনাশের নানা লক্ষণ শুনতে ও বুঝতে পারছেন। মাটির নীচে গুরু গুরু শব্দ, আকাশ রক্তবর্ণ। রোগটার কারণ তিনি ধারণা করতে পারছেন। মেয়েদেরকে সামনে রেখে নাগরিকদেরকেই বলছেন, ‘তোমরা কেবলি করেছ ঋণ/ কিছু করো নি শোধ/ দেউলে করে দিয়েছ যুগের বিত্ত।’ আর সৈনিকদেরকে লক্ষ্য করে যে অভিযোগ করেছেন সেটা আরো গুরুতর : ‘তোমরা দড়িটাকে করেছ জর্জর/ যেখানে যত তীর ছুঁড়েছ, বিঁধেছে ওর গায়ে/ ভিতরে ভিতরে ফাঁক হয়ে গেছে, আলগা হয়েছে বাঁধনের জোর।/ তোমরা কেবল ওর ক্ষত বাড়িয়েই চলবে,/ বলের মাতলামিতে দুর্বল করবে কালকে।’ সন্ন্যাসী রোগের নিদান দিতে পেরেছেন, কিন্তু নিরাময়ের ঔষধ তাঁর জানা নেই। থাকবার অবশ্য কথাও নয়। তিনি দার্শনিক নন, দর্শক, সংবেদনশীল দর্শকই শুধু।

রাজা স্বয়ং হাত লাগিয়েছেন কিন্তু রশি নড়ে না। কে যেন রাজাকে বলেছে, যুগটা ধনতন্ত্রের, এখানে ‘না চলে শাস্ত্র, না চলে শস্ত্র,/ চলে কেবল স্বর্ণচক্র।’ সৈনিকরাও জানে যে একালে রাজা থাকেন                সামনে। পেছনে থাকে বেনে। যাকে বলে ‘অর্ধ-বেনে-রাজেশ্বর মূর্তি।’ কিন্তু সৈনিকদের কারো কারো আবার অভিমানে লাগে; তাদের তলোয়ার আছে, তারা কেন বণিকদেরকে মানতে যাবে। তবে নাগরিকদের একজন সতর্ক করে দেয় : ‘তোমাদের তলোয়ারগুলোর কোনোটা খায়/ ওদের নিমক কোনোটা খেয়ে বসেছে ওদের ঘুষ।’ বণিকরা এগিয়ে আসে, রথে রশি ধরে তারা টান দেবে। কিন্তু টান দেওয়া দূরের কথা, রশিটাকে তারা টেনে তুলতেই পারে না। রণে তাদেরকে ভঙ্গ দিতে হয়। ধনপিতারা লজ্জিত হয়, তারা স্বীকার করে তারা চাকায় তেল দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু রশিতে কখনো টান দেয় নি।

রাজা হেরে গেলেন; ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য সবাই ব্যর্থ, তাহলে উপায় কী? উপায় নিজেই এসে উপস্থিত। শূদ্র (শ্রমিক) পাড়ায় রটে গেছে যে রথ চলছে না। এবং তাদের কিছু করা দরকার। কেউ তাদের ডাকে নি, দলবেঁধে তারা নিজেরাই এসে হাজির হয়েছে। সৈনিকরা ঠাট্টা করে, কিন্তু মন্ত্রী বুদ্ধিমান, তিনি বুঝে ফেলেছেন যে রথ চলবে ওদেরই টানে। শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ দল বেঁধে আসছে শুনে তিনি ভয় পান না, কিন্তু ওরাই রথটাকে সচল করতে পারবে এই আশঙ্কায় তিনি বসে পড়েন। তার এই ভয়টাকে সৈনিকেরা ঠাট্টা করে। মন্ত্রী জানেন ভয় করতেই হবে, কেননা তলোয়ারের বেড়া তুলে বন্যা ঠেকানো যায় না। তাঁর এই জ্ঞান আছে যে, এই শ্রমজীবীরাই আজ পেয়েছে নতুন কালের প্রসাদ। মান বজায় রাখতে হলে ওদের সমান হওয়া চাই, হাত দেওয়া চাই রথের রশিতে – ওদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। স্মরণীয় যে রথের রশি লেখা হয় ১৯৩২ সালে, তার আগে ১৯৩০-এ রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবপরবর্তী রুশ দেশে শ্রমিক শ্রেণী কিভাবে সমাজকে বদলে দিয়েছে সেটা দেখে এসেছেন, এবং সে-অভিজ্ঞতার কথা ১৯৩১ সালে লেখা রাশিয়ার চিঠিতে প্রকাশ করেছেন। শ্রমজীবীরা যে ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এবং পুঁজিবাদের তৎকালীন আধিপত্যের কালে কাজটা যে কেবল তাদের পক্ষেই সম্ভব ছিল তা তিনি উপলব্ধি করেছেন।

শ্রমিকদের টানে রথ জেগে উঠেছে। একটা কাঁচা পথে চলেছে বুনো মহিষের মতো। মরা নদীতে যেমন বান আসে দড়ির মধ্যে তেমনি প্রাণ এসে পৌঁছেছে। ধনপতির দল প্রমাদ গুণছে, তারা সৈনিকদেরকে ডাকাডাকি করছে তাদের ধনভাণ্ডারকে বাঁচাবার জন্য। মন্ত্রী সৈনিকদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছেন যে রথ ছুটছে অস্ত্রশালার দিকেও।

নাটকের শেষাংশে কবির দেখা পাই। কবি মন্ত্রীর চেয়েও পরিষ্কার ভাবে বোঝেন ঘটনার কারণ ও তাৎপর্য। তাঁর বক্তব্যটা পরিষ্কার। এতকাল যারা রথ চালিয়েছে চূড়ার দিকে ছিল তাদের চোখ। ‘মানুষের সঙ্গে মানুষকে বাঁধে যে বাঁধন তাকে ওরা মানে নি/ রাগী বাঁধন আজ উন্মত্ত হয়ে লেজ আছড়াচ্ছে/ দেবে ওদের গুঁড়িয়ে।’ ‘রথের দড়ি পড়ে ছিল বাইরে/ সে থাকে মানুষে মানুষে বাঁধা দেহে দেহে প্রাণে প্রাণে/ সেখানে জমেছে অপরাধ, বাঁধন হয়েছে দুর্বল।’ তাই ছন্দ মিলছিল না। একদিকটা উঁচু হয়েছিল অতিশয়। সেটা দেখে ঠাকুর পাশ ফিরলেন। ‘ঠাকুর নীচে দাঁড়ালেন ছোটোর দিকে,/ সেইখান থেকে মারলেন টান, বড়োটাকে দিলেন কাত করে।’ এতে যে সাম্য এলো তা নয়, তবে পাওয়া গেল ভারসাম্য। আর ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলেই রথের পক্ষে চলায় সুবিধা হয়েছে। এক দিকে মানুষে মানুষে সম্বন্ধের সামাজিক শক্তি, অন্যদিকে রথের নিজের ভারসাম্য, এই দুয়ের কারণেই রথ চলছে। শক্ত রশির টান পড়েছে রথে, এবং রথ নিজেই রয়েছে প্রস্তুত, তাই রথের এই তুমুল পথচলা।

কবি সন্ন্যাসীকে যান ছাড়িয়ে তাঁর দেখবার ক্ষমতায়। যুগাবসান ঘটছে, লেগেছে আগুন। পুরোহিতের পক্ষে পরিবর্তনটাকে মেনে নেওয়া শক্ত। কবির কাছে তাঁর সন্দিগ্ধ প্রশ্ন : ‘তোমার শূদ্রগুলোই কি এত বুদ্ধিমান? ওরাই কি দড়ির নিয়ম মেনে চলতে পারবে?’ সে-সন্দেহটা কবিরও। তাঁরও আশঙ্কা এই শ্রমজীবীরা হয়তো একদিন অহঙ্কারী হয়ে উঠবে, ভাববে রথী বলে কেউ নেই, রথের সর্বময় কর্তা ওরাই। ‘তখন আবার নতুন যুগের উঁচুতে নীচুতে হবে বোঝাপড়া।’ কিন্তু তাঁর পরামর্শ : ‘এই বেলা থেকে বাঁধনটাতে দাও মন/ রথের দড়িটাকে নাও বুকে তুলে, ধুলোয় ফেলো না;/ আজকের মতো বলো সবাই মিলে/ যারা এতদিন মরে ছিল তারা উঠুক বেঁচে/ যারা যুগে যুগে ছিল খাটো হয়ে, তারা দাঁড়াক এবার মাথা তুলে।’

ভবিষ্যতে রথচলাকে অর্থাৎ ইতিহাসের অগ্রগতিকে নিশ্চিত করার উপায়টা তাহলে কী হবে? উপায়টা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধনকে শক্ত করা, এবং ভারসাম্য বজায় রেখে চলা। এই ভারসাম্যের ব্যাপারটাকে কবি বলেন গায়ের জোরে নয়, ছন্দের জোরে চলা। কোনো একদিকে ঝুঁকে পড়লে রথ চলবে না, তাহলে তাল যাবে কেটে। চলার জন্য তাল রাখাটা অত্যাবশ্যকীয়। ‘যারা টানছে রথ তারা পা ফেলবে তালে তালে/ পা যখন হয় বেতালা/ তখন ক্ষুদে ক্ষুদে খালখন্দগুলো মারমূর্তি ধরে/ মাতালের কাছে রাজপথও হয়ে ওঠে বন্ধুর।’

 

পাঁচ

সীমার মাঝে অসীমের কথা রবীন্দ্রনাথ বহুভাবে বলেছেন। সীমা ব্যাকুল হয়েছে অসীমের জন্য, তাঁর কবিতাতে পর্বত মিতালী করেছে আকাশের সঙ্গে; পাশাপাশি বন্ধনের ভেতরে আবদ্ধ থেকে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা, এবং তার জন্য বন্ধন ভাঙার যে লড়াই সেটিকেও তিনি উপেক্ষা করেন নি। ওই লড়াইটাকে বিশেষ ভাবে পাওয়া যায় তাঁর নাটকে। কথাসাহিত্যেও বন্ধন এবং বন্ধনমুক্তির এ লড়াইয়ের খবরটা আছে, কিন্তু নাটকের তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা যেমন ভাবে প্রকাশ পেয়েছে অন্য রূপকল্পে তেমনভাবে পায় নি, বিস্তারের তীব্রতায় তা অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে।

দ্বন্দ্বটা বেঁধেছে বন্ধনের কারণেই। আর এই বন্ধন মানুষ নিজেই তৈরী করেছে; অল্প মানুষ তৈরী করেছে বহু মানুষকে আটক করবার জন্য, এবং বহু সেটাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে, ক্ষমতাবানদের আধিপত্যের দরুন। কিন্তু এর বিপরীতে আরো একটি বন্ধন ছিল এবং আছে। সেটি মানুষের সঙ্গে মানুষের মানবিক সম্পর্কের। ওই সম্পর্কের জোরেই আটকাদেশগুলো শেষ পর্যন্ত পরাভূত হয়েছে। একদিকে কতিপয়ের স্বার্থের কারণে তৈরী অচলায়তন, অপরদিকে সকলের উপকারের লক্ষ্যে তাকে ভেঙে ফেলার সংগ্রাম, এই দ্বন্দ্ব রবীন্দ্রনাথের বেশীর ভাগ নাটকেই নাটকীয়তার সৃষ্টি করেছে।

স্বার্থ জিনিসটা লোলুপতার আকার নেয়; লোলুপতাটা ইতর রূপে মানুষের সঙ্গে শত্রুতার সৃষ্টি করে। এটি চরম আকার ধারণ করে পুঁজিবাদের যুগে, যখন নিষ্পেষিত মানুষরা তো বটেই, এমন কি নিষ্পেষণকারী ধনিকেরাও বন্দী হয়ে পড়ে তাদের লালসার জালে। পুঁজিবাদ যে মানুষ ও তার মনুষ্যত্বের কত বড় শত্রু সেটা রবীন্দ্রনাথের কালে তেমন ভাবে প্রকট হয় নি, যেমনভাবে এখন হয়েছে। কিন্তু তিনি ঠিকই দেখতে পেয়েছেন পুঁজিবাদ কীভাবে মানুষকে ইচ্ছাশক্তিহীন ও আত্মপরিচয়বিচ্যুৎ উৎপাটিত যন্ত্রে পরিণত করছে। শুধু মানুষের জন্য নয়, পুঁজিবাদ প্রকৃতির জন্যও একটি দানবীয় শত্রুবিশেষ। শত্রুতার এই দ্বিমাত্রিক ছবি রক্তকরবীতে অত্যন্ত জীবন্তভাবে উপস্থিত। পুঁজিবাদ আরো একটি বড় ক্ষতি করে, তা হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা তৈরী; এই বিচ্ছিন্নতা রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন ইতিহাসের রথকে-টেনে-নেবার রশি সেটিকে দুর্বল করে দেয়। ইতিহাস স্তব্ধ হয়ে যাবে, এমন আশঙ্কা দেখা দেয়।

মানুষের সঙ্গে শত্রুপক্ষের বৈরিতার নানারূপ রয়েছে। নিষ্পেষণ পারিবারিক ভাবে চলতে পারে, যেমনটা দেখতে পাই ডাকঘরের অমলের ক্ষেত্রে ঘটেছে। রাজতন্ত্রের সঙ্গে পুরোহিততন্ত্রের বিরোধও বাধে, যার নিদর্শন রয়েছে বিসর্জন নাটকে। মধ্যযুগীয় অন্ধকারাচ্ছন্নতা তৈরী করা হয়; প্রমাণ অচলায়তন। স্বৈরাচারের নিপীড়ন মানুষকে পুতুলে পরিণত করতে পারে, যেটা দেখা যায় তাসের দেশেতে। ঔপনিবেশিক নির্যাতনও চলে, যেমনটা চলবে বলে মনে হচ্ছিল মুক্তধারার ক্ষেত্রে। এই নাটকটির অসামান্যতা কেবল যে এর নানন্দিক গুণে নিহিত তা নয়, নদীর প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করার যে মারাত্মক রাজনীতি বর্তমান কালে প্রবল হয়ে উঠেছে তার পূর্বাভাস প্রদানের ভেতরও এর অসামান্যতার সন্ধান মেলে। রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা যে একদিন দ্বিখণ্ডিত হয়ে পরস্পরের শত্রুভাবাপন্ন  ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হয়ে যাবে এটা হয়তো তাঁর মতো দূরদৃষ্টি ও কল্পনাশক্তিসম্পন্ন কবির পক্ষেও ধারণা করা সম্ভব হয় নি; কিন্তু নদীর ওপর নিয়ন্ত্রণ যে রাজনীতির একটি ভয়ঙ্কর হাতিয়ার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে এ তিনি ঠিকই টের পেয়েছিলেন। নদীর প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হয়ে তাঁর এককালের কর্মস্থল পূর্ববঙ্গ যে সঙ্কটে পতিত হয়েছে সেটা দেখলে তিনি নদীর ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বিষয়ে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী যথার্থই অবলোকন করে যতটা সন্তুষ্ট হতেন নিশ্চয়ই সে-তুলনায় জলবঞ্চিত মানুষদের দুঃখের কথা ভেবে অনেক বেশী পীড়িত হতেন।

সমাজকে রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রের চেয়ে অধিক জরুরী মনে করতেন। তাঁর নাটকেও সেই পক্ষপাতটা রয়েছে। রাষ্ট্রশক্তি মানুষের উপকারে আসে না, এই সত্যটি বিভিন্নভাবে তাঁর নাটকে দেখতে পাই। রাজা নাটকটিতে রাষ্ট্রশক্তির একটি উপস্থাপনা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন সেই রাষ্ট্রকেই একটি আদর্শ রাষ্ট্র বলা যায়, যার মালিকানা ব্যক্তিগত নয়, সমষ্টিগত; যেখানে সবাই রাজা, কেউ প্রজা নয়। সে রাষ্ট্রে প্রয়োজনে রাজা নিষ্ঠুর হবেন, কিন্তু ওই নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের যাতে আবশ্যকতা না দেখা দেয় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তিনি অকারণে দৃশ্যমান হবেন না, কিন্তু সবকিছুর ওপরই খেয়াল রাখবেন। রাষ্ট্র মানুষের জীবনে যত কম হস্তক্ষেপ করে মানুষের জন্য তা ততই মঙ্গলজনক, মার্কসবাদীদের এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রীয়বিবেচনার সাদৃশ্য আছে, যদিও তিনি অন্য অনেক বিষয়েই মার্কসবাদীদের থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেন।

অচলায়তন স্থায়ী হয় না, মানুষ সেটাকে ভেঙে ফেলে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যে সত্যটা আমরা বিশেষ ভাবে জানি সেটা হলো মানুষের ওপর তিনি কখনো বিশ্বাস হারান নি, বস্তুত বিশ্বাস হারানোকে তিনি পাপ বলেই গণ্য করতেন। সেই আস্থারই প্রতিফলন দেখি অচলায়তন ভেঙে ফেলার মধ্যে। ভাঙে বাইরের আঘাতের সঙ্গে ভেতরের কারণের সম্মিলনে। মকররাজা তার মনুষ্যত্ব পুরোপুরি হারায় নি, তার নিজের মধ্যে মানবিক দুর্বলতা রয়েছে, নন্দিনীর সঙ্গে তার কথা হয়, রঞ্জনের সঙ্গে নন্দিনীর বন্ধুত্ব তাকে ঈর্ষান্বিত করে, রঞ্জনকে হত্যা করে সে অপ্রস্তুত হয় – এসব আছে; নইলে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে, সর্দারদের পাহারা এড়িয়ে তার পক্ষে মুক্ত মাঠে বের হয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। অচলায়তনে পঞ্চক বাইরের ডাক শুনেছে; মুক্তধারায় অভিজিৎ বাঁধ ভাঙার পক্ষে, ধনঞ্জয় বৈরাগী সেখানে বিদ্রোহের গান গায়। রাজা নাটকে সুদর্শনার মোহমুক্তির পেছনে সুরঙ্গমা, ঠাকুরদা এবং স্বয়ং রাজার ভূমিকা রয়েছে। বিসর্জনের গোবিন্দমাণিক্য নিজের মধ্যেই সন্ন্যাসীর গুণ ধারণ করেন। তাসের দেশের মেয়েরা বিদেশীদের দেখে মানুষ হবার জন্য আগ্রহী হয়। রথের রশিতে মন্ত্রী শূদ্রদের শক্তিকে জানে, এবং তাদের সঙ্গে যোগ দিতে সঙ্কোচ বোধ করে না।

রবীন্দ্রনাথ নেতায় বিশ্বাস করতেন এটা সত্য। কিন্তু তাঁর নাটকে নেতার একক শক্তিতে পরিবর্তনগুলো ঘটে না। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই অন্যদের উপস্থিতি দেখা যায়। নন্দিনী সফল হতো না রঞ্জন, বিশুপাগলা ও ফাগুলালের দলবলের সাহায্য না পেলে। অচলায়তনে দাদাঠাকুরের সঙ্গে শোণপাংশুরা আছে, দর্ভকরাও যোগ দিতে প্রস্তুত। মুক্তধারায় শিবতরাইয়ের মানুষের দলে বলে এগিয়ে আসছিল, বাধা দিলে জোর লড়াই হতো। রাজাতে রাজার সৈন্যদল প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে, প্রয়োজনে কাজে লাগাতো, উৎপাতসৃষ্টিকারী বহিরাগত রাজাদের সেটা অজানা ছিল না। তাসের দেশে একে একে সবাই বিদ্রোহ করে, রাজা তখন নিজেও চলে যায় নির্বাসনে, রানীর পিছু পিছু। বিসর্জনের অপর্ণা জয়ী হয় রাজা গোবিন্দমাণিক্য এবং জয়সিংহের সহায়তা পেয়ে। আর রথের রশিতে রথ যে চলে সে তো শূদ্রদের সমবেত অংশ গ্রহণের কারণেই। এই যে সামাজিক শক্তি এর ওপর নির্ভরশীলতার বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই শক্তি না থাকলে কেবল ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিবর্তন যে অসম্ভব রবীন্দ্রনাথের নাটক থেকে অত্যন্ত জরুরী সেই বার্তাটা পাওয়া যায়।

ঘটনা আরো একটি রয়েছে। সেটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটা হলো রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিবর্তন যে শুধু হৃদয়পরিবর্তনে সম্ভব নয় এই ধারণার উপস্থিতি। রবীন্দ্র নাটকে ভয়াবহ রকমের কোনো রক্তপাত ঘটে না; তার একটা কারণ প্রতিপক্ষের দুর্বলতা; কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণ হচ্ছে পরিবর্তনকামীরা প্রয়োজনে সহিংসতার পথ গ্রহণ করতে প্রস্তুত রয়েছে শত্রুপক্ষের এই উপলব্ধি। অচলায়তনের দাদাঠাকুরকে দেখি যোদ্ধৃবেশে উপস্থিত হয়েছেন, রাজা নাটকে ঠাকুরদার সাজসজ্জাও সেনাপতিসুলভ। রক্তকরবীর বিদ্রোহীরা বন্দীশালা ভেঙে ফেলে। রথের রশির রথ যখন চলতে শুরু করে তখন প্রচুর ভাঙচুর ঘটে, আগুনও দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ সহিংসতার পক্ষপাতী নন, কিন্তু হিংসার বিরুদ্ধে অহিংসা অবলম্বন যে কার্যকর হবে না তাঁর সে-বিশ্বাস রবীন্দ্রনাটকে অনুপস্থিত নয়।

মানুষের অগ্রগতিকে প্রতিহত করে যে শক্তি তার বিরুদ্ধে সমবেত প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন, কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধান তো কেবল শত্রুপক্ষের তাৎক্ষণিক পতনে ঘটবে না, তার জন্য যা আবশ্যক সেটি হলো সম্পদের মালিকানায় ও বিতরণে সামাজিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। সেই সমাধানের কথা স্থূল ভাবে বলে দেওয়াটা শিল্পীর কর্তব্য নয়; কিন্তু তার ইঙ্গিত যে রবীন্দ্রনাটকে নেই তাও বলা যাবে না। বঙ্কিমচন্দ্র একদা বলেছিলেন, ‘আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি।’ রবীন্দ্রনাথ তেমন কথা বলেন না। তাঁর নাটক আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে যে তিনি পরিবর্তনের পক্ষে। তিনি জানেন যে ঝরনায় পাঁক জমে যদি সে বহমানতা হারায়। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ তাঁর ঈপ্সিত। মানুষে মানুষে বৈষম্যের তিনি বিরোধী। তবে শ্রেণীব্যবস্থার অবসানের কথা তাঁর নাটকে বলা নেই। শ্রেণী থাকবে, কিন্তু সমাজে ভারসাম্যের প্রয়োজন হবে, সমাজের কর্তৃত্ব কোনো বিশেষ শ্রেণীর দিকে ঝুঁকে পড়লেই বিপদ। শ্রেণীব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে ভারসাম্য বজায় রাখা যে সম্ভব নয় ইতিহাস অবশ্য তার সাক্ষ্য দেয়। সে-জায়গাটা পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের নাটক যায় নি।

শিক্ষার মধ্য দিয়ে সমাজপরিবর্তনে রবীন্দ্রনাথের আস্থা অবিচল ছিল। কিন্তু শিক্ষা নিজেই যখন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অধীনে চলে যায় তখন তার দশাটা কী হয় সে ছবি অচলায়তন, মুক্তধারা ও তাসের দেশে বিশেষভাবেই রয়েছে। যথার্থ শিক্ষার জোর আছে, কিন্তু শিক্ষাকেও মুক্ত করা চাই। এবং মুক্ত করবার সে-লক্ষ্যে বলপ্রয়োগ যে অপরিহার্য রবীন্দ্রনাথ তা মানেন।

রবীন্দ্রনাথের নাটক নানাদিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ ও উপভোগ্য; তাদের নান্দনিক ও ঐতিহাসিক মূল্য কোনোটাই হ্রাস পাবার নয়।
(এ লেখাটি কালি ও কলমের রবীন্দ্রশতবার্ষিকী সংখ্যায় প্রকাশিত)