রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

 

সাহিত্যের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার পাওয়াটা যেমন অপ্রত্যাশিত তেমনি আনন্দদায়ক ও তাৎপর্যপূর্ণ। অপ্রত্যাশিত, ছিল সবার জন্যই। তাঁর দেশবাসী, এবং এশীয়বাসী কেউই আশা করেন নি যে এমন একটি ঘটনা ঘটবে। তাঁর আগে কোনো এশীয়বাসী তো ননই, এমনকি কোনো আমেরিকাবাসীও এই পুরস্কার পাননি। রবীন্দ্রনাথের নিজের ধারণা ছিল যে, নোবেল পুরস্কার ইউরোপীয়দের জন্যই নির্দিষ্ট, এশীয়দের এটা পাবার কথা নয়। ১৯১৩ সালে পুরস্কারটি পেলেন তিনি, আগের বছরে প্রকাশিত গীতাঞ্জলির ইংরেজি তর্জমার জন্য। নিয়ম ছিল যে, আগের বছরে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের জন্যই পুরস্কারটি দেওয়া হবে। সুইডিশ অ্যাকাডেমির নোবেল পুরস্কার কমিটি ১৯১২-তে পাঠকসমক্ষে এসেছে এমন রচনার মধ্যে গীতাঞ্জলিকেই শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করেছে। চমকে ওঠার মতো ব্যাপার বইকি। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন বায়ান্ন বছর ঠিকই, কিন্তু তিনি তো বিদেশে তেমন পরিচিত নন। পুরস্কার পেলেন ইংরেজি রচনার জন্য, অথচ তিনি ইংরেজ লেখক নন, তিনি খাঁটি বাঙালি, এবং লেখেন বাংলাভাষায়। তাঁর কয়েকটি রচনার ইংরেজি অনুবাদ ততদিনে ছাপা হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলো তেমন কোনো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে নি। নোবেল কমিটি তাদের প্রদানপত্রে উল্লেখ করেছিল যে, ‘পরিপূর্ণ বিচারে’ গ্রন্থটি ইংরেজি সাহিত্যের অংশ। অনেক ব্যাপারেই ইংরেজরা বেশ রক্ষণশীল, যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়, তাদের ইংরেজি সাহিত্যের রচয়িতা হিসেবে গ্রহণে তাদের কৃপণতা সর্বজনবিদিত, রবীন্দ্রনাথকে তাঁরা একজন ইংরেজ লেখক হিসেবে গ্রহণ করে নি। এ-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজেরও বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। বাঙালিদের কাছে তিনি ‘বিশ্বকবি’ বলে পরিচিত, সারাবিশ্ব নিয়ে তিনি ভাবতেন বলে; এবং সেই ভাবনার ব্যাপারে বিশ্ববাসীও অনবহিত ছিল না।

বিস্মিত হয়েছিল আমেরিকানরাও। কেবল বিস্মিত নয়, বিরক্তও। কেননা তাদের মতে, নোবেল পাওয়ার মতো লেখক তাদের দেশে ছিলেন, বিশেষ করে হেনরি জেমস তো তখনো জীবিত, অথচ কোনো আমেরিকানকে না দিয়ে পুরস্কার দেওয়া হলো একজন ভারতীয়কে, তাও আবার সেই ভারতীয়ের ইংরেজি রচনার জন্য। আমেরিকানদের পত্রপত্রিকায় তাঁকে বলা হয়েছে হিন্দু কবি, যদিও কোথাও কোথাও ছাড় দেওয়া হয়েছে এই বলে যে, যাই হোক ওই কবি একজন আর্য বটেন, সেই বিবেচনায় সাদা আমেরিকানদের সঙ্গে একেবারেই যে সম্পর্কহীন তা নয়। পরে অবশ্য তাঁর বক্তৃতা শুনে ও রচনা পাঠ করে তাঁরা না মেনে পারেন নি যে, রবীন্দ্রনাথ মোটেই অবজ্ঞেয় নন।

রবীন্দ্রনাথের এই পুরস্কার-প্রাপ্তি বিস্ময়কর এই জন্যও যে, গীতাঞ্জলি খুবই ক্ষুদ্রাকৃতির একটি গ্রন্থ, বাংলায় যাকে আমরা চটি বলি বই সেই রকমের। ১০৩টি কবিতার সংকলন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাদেরকে গানই বলেছেন, গীতাঞ্জলির ইংরেজি নাম দিয়েছেন Song Offerings। এদেরকে তিনি সংগ্রহ করে নিজের হাতে তর্জমা করেছেন। (‘তর্জমা’ কথাটা রবীন্দ্রনাথ নিজেও ব্যবহার করেছেন। এর দ্যোতনা ‘অনুবাদে’র তুলনায় অধিক)।

এই গানগুলো অভিভূত করেছিল তখনকার দিনে বিলেতে প্রতিষ্ঠিত কবি ডব্লু বি ইয়েটস্কে, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়সে যিনি ছিলেন চার বছরের ছোট। এজরা পাউন্ডকেও, যিনি তখন বিখ্যাত নন, কিন্তু বিখ্যাত যে হবেন এমন সম্ভাবনায় সমৃদ্ধ, রবীন্দ্রনাথের তুলনায় কনিষ্ঠ, বয়সের ব্যবধান বাইশ বছরের। কবি টমাস স্টার্জ মুরেরও গীতাঞ্জলির কবিতাগুলো ভালো লেগেছিল, এবং তিনিই নোবেল কমিটির কাছে অতিসংক্ষিপ্ত এক পত্রে রবীন্দ্রনাথকে পুরস্কার প্রদানের জন্য বিচারের আনুষ্ঠানিক সুপারিশটা করেছিলেন। স্টার্জ মুরের সঙ্গে ইয়েটসের যোগাযোগ ছিল। মুর কেবল কবি নন, চিত্রশিল্পী এবং নাট্যকারও ছিলেন। তাঁর ভাই জি ই মুর ছিলেন খ্যাতনামা দার্শনিক। স্টার্জ মুর তাঁর পত্রটি লিখেছিলেন রয়েল সোসাইটি অব লিটারেচার অব দি ইউনাইটেড কিংডমের ফেলো হিসেবে। কমিটি মুরের প্রস্তাব বিবেচনায় নেয়, কয়েকজন সদস্য এর পক্ষে রায় দেন। সবচেয়ে অধিক গুরুত্ব পেয়েছিল সুইডিশ কবি ভারনার ভন হেইডেনস্টামের বক্তব্য। তিন বছর পরে ইনি নিজেও নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এঁর বক্তব্যের ভেতর ছিল এই মন্তব্য যে, গীতাঞ্জলির কবিতাগুলোর ভেতর দিয়ে আমাদের কালের শ্রেষ্ঠতম কবিদের একজনের সঙ্গে পরিচয় লাভ করা সম্ভব। কবিতাগুলো পাঠে মনে হয় যেন নির্মল স্বচ্ছ ঝরনাধারার জল পান করছি। কবির অনুভূতিতে যে তীব্র ঈশ্বরপ্রেম ও ধর্মানুভূতি পরিব্যাপ্ত এবং তাঁর রচনারীতিতে যে মহৎ ও অকৃত্রিম উচ্চতা লক্ষণীয় তা গভীর ও দুর্লভ আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের একটি ধারণা তৈরি করে। কবিতাগুলোতে এমন কিছুই নেই যা বিতর্কমূলক ও বিরক্তিকর; অহমিকাপূর্ণ, বৈষয়িক অথবা ক্ষুদ্র। সবকিছু বলে হেইডেনস্টাম নোবেল কমিটিকে জানিয়েছেন যে, কোনো কবি সম্পর্কে যদি বলতে হয় যে তিনি নোবেল পুরস্কারে যোগ্য ত হলে সেই কবি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি এও উল্লেখ  করেছেন যে, গ্যেটে রচিত একগুচ্ছ কবিতা পড়ে যেমন নিশ্চিত হওয়া যায় যে সেগুলো গ্যেটেরই, ঠিক তেমন কথা এই কবি সম্পর্কেও বলা সম্ভব।

দুই

প্রশ্ন উঠবে, এবং উঠেছেও, যে একেবারেই অপরিচিত রবীন্দ্রনাথকে হঠাৎ করে এভাবে কেন পুরস্কৃত করা হলো। জবাবে একাধিক কারণের কথা উল্লেখ করা সম্ভব। প্রথম কারণ হলো শিল্পগুণ। যার কথা হেইডেনস্টাম তাঁর সুপারিশে বলেছেন। সে-গুণের উল্লেখ যে প্রদানপত্রে থাকবে তাও স্বাভাবিক, এবং তেমনটা ঘটেছেও। তিনি যে একজন বিশ্বমাপের কবি পুরস্কারদাতাদের পক্ষে সেটা অনুভব করতে বিঘ্ন ঘটে নি।

কিন্তু সেই সঙ্গে একটা মতাদর্শিক বিবেচনা যে ছিল না তাও নয়, হেইডেনস্টাম যেদিকে কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ১৯১৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধেনি ঠিকই, কিন্তু ইউরোপ যে অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল ও যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হচিছল সেটা ঠিক। ওই রকমের বড় যুদ্ধের কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা ইউরোপের ছিল না। যুদ্ধকালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক ইংরেজ বন্ধুকে যে লিখেছিলেন, যা দেখছেন তাতে মনে হচ্ছে মরণখেলায় ব্যস্ত কোনো বদ্ধ উন্মাদ অট্টহাসিতে ভেঙে পড়েছে, সে-উক্তিতে যুদ্ধ যখন বাধে তখন তা কীভাবে সমগ্র বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল তার সারসংক্ষেপ পাওয়া যায়। এজরা পাউন্ডের কথা উল্লেখ করেছি। গীতাঞ্জলি প্রকাশের এক মাস পরে বইটির একটি আলোচনা লেখেন তিনি। এতে তিনি যা বলেছেন তার অর্থ এই রকমের, কবিতাগুলো কথিত আধুনিক ধারা থেকে স্বতন্ত্র। এখানে প্রকৃতি আছে তার নৈঃশব্দ্য নিয়ে, এবং কবির রয়েছে ধর্মবোধ যেমনটা ছিল দান্তের। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কটা এখানে অবিচ্ছেদ্য, যেমনটা বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে পাওয়া যায়। পরিবেশটা রেনেসাঁস-পূর্ব ইউরোপের সমতুল্য। এজরা পাউন্ড জানিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি পাঠে তাঁর ভেতর এমন একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছে যেন তিনি নিজে একজন আদিম বর্বর, পরিধানে তাঁর পশুচর্ম, হাতে পাথুরে অস্ত্র।

পাউন্ড যা বলেছেন নোবেল কমিটির অনুভূতিটা নিশ্চয়ই সেরকমের ছিল না। কিন্তু এটা সত্য যে, শঙ্কিত ইউরোপ তখন মানসিক শান্তি ও নির্ভরতার জায়গা খুঁজছিল। এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতায় তারই প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল। সংঘর্ষপ্রবণ বস্ত্তবাদের বদলে সেখানে ছিল প্রার্থনা ও আত্মনিবেদনের কথা। ছিল ভিন্ন এক পৃথিবীর উল্লেখ যে-পৃথিবী তখন ইউরোপে তো নয়ই, রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষেও ছিল না। ইউরোপ কবিকল্পনার এই পৃথিবীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। শিল্পগুণের সঙ্গে এই ভিন্নধর্মিতার সংযোগ ঘটায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা বিশেষভাবেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। প্রদানপত্রে কবিতাগুলোকে বলা হয়েছিল ‘finest poems of an idealistic tendency’.

Idealism-এর এই বিবেচনার উল্লেখ কিন্তু আলফ্রেড নোবেলের দানপত্রেও ছিল। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার তেমন রচনাকেই দেওয়া হবে যেটি একই সঙ্গে শিল্পগুণ ও আদর্শবাদিতায় সমৃদ্ধ, একথা নোবেল বলেছিলেন। তখনকার দিনে আদর্শবাদিতা বলতে বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার প্রতি বিরুদ্ধাচরণ নয়, বরঞ্চ রক্ষণশীলতাকেই বোঝানো হতো। পরে অবশ্য ওই দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছিল, আদর্শবাদিতার ভেতর সমালোচনাও প্রবেশের অধিকার পেয়েছিল। কিন্তু ১৯১৩-তে তেমনটা দেখা যায় নি। জানা যায়, ওই বছর টমাস হার্ডি পুরস্কারের জন্য বিবেচ্যদের তালিকায় ছিলেন, কিন্তু তিনি বাদ পড়ে গেছেন, সম্ভবত মতাদর্শের দিক থেকে তিনি রক্ষণশীল ছিলেন না বলে। অথচ ঔপনিবেশিকতায় আস্থাশীল রুডিয়ার্ড কিপলিং কিন্তু ঠিকই পুরস্কৃত হয়েছিলেন কয়েক বছর আগেই, ১৯০৭ সালে। হার্ডি ১৯১৩-তে কেন – এর পরেও ওই পুরস্কার পাননি। যদিও তিনি বেঁচে ছিলেন ১৯২৮ পর্যন্ত। পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ব্যক্তিমানুষের যে-সংগ্রামের ছবি তাঁর উপন্যাসে আছে বিবেচকদের হয়তো তা পছন্দ হয়নি। এটিও স্মরণ করা যেতে পারে যে, শিল্পবিচারে টলস্টয় তো অবশ্যই, চেকভ, ইবসেন, প্রুস্ত, জোসেফ কনরাড, ডি এইচ লরেন্স, জেমস জয়েস – এঁদের কাউকেই অগ্রাহ্য বিবেচনা করা যাবে না, কিন্তু সুইডিশ অ্যাকাডেমি এঁদেরকে নোবেল পুরস্কার দেন নি। পরবর্তীকালের নাট্যকার ব্রেখটের জন্য তো পাওয়ার প্রশ্নটি ছিল সম্পূর্ণ অবান্তর, তাঁকে তো কমিউনিস্ট বলেই গণ্য করা  হতো। মোটকথা পুরস্কারদাতারা যে রাজনীতিনিরপেক্ষ ছিলেন তা মোটেই নয়।

গীতাঞ্জলির প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯১২ সালে লন্ডনের ইন্ডিয়ান সোসাইটির উদ্যোগে, ছাপা হয়েছিল সাতশো পঞ্চাশ কপি, যার মধ্যে আড়াইশো কপি ছিল বিক্রির জন্য, বাকি পাঁচশো বিতরণ করা হয়েছিল বিশিষ্টজনদের ভেতরে। দ্বিতীয় সংস্করণ বের করে ম্যাকমিলান কোম্পানি, সেটি ছিল বাণিজ্যিক প্রকাশনা। ডব্লু বি ইয়েটস একটি হৃদয়গ্রাহী ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন এই সংস্করণের জন্য। এটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়, এবং অতিদ্রুত কয়েকবার পুনর্মুদ্রিত হয়। যুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪-তে, কিন্তু বিদ্বৎসমাজ ইতিমধ্যেই শঙ্কিত বোধ করছিল, তারা যেন এই রকমের একটি বইয়ের জন্যই প্রতীক্ষা করছিল। কেবল বিদ্বৎসমাজ নয়, নোবেল কমিটিও তো মনে হয় প্রতীক্ষায় ছিল। যুদ্ধ যখন সত্যি সত্যি বেধে গেল, তখন রবীন্দ্রনাথের কবিতার মূল্য কতটা যে বৃদ্ধি পেয়েছিল তার একটি নিদর্শন রয়েছে যুদ্ধে-নিহত তরুণ কবি উইলফ্রেড ওয়েন গীতাঞ্জলিকে কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন সেই ঘটনার মধ্যে। তরুণদের জন্য যুদ্ধে যাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল, যুদ্ধে গিয়েও ওয়েন কবিতা লিখেছেন, কিন্তু ১৯১৮-তে যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক আগে তিনি প্রাণ হারান। নিজের কবিতার প্রকাশ তিনি দেখে যেতে পারেননি, তাঁর মৃত্যুর পরে বন্ধুরা তাঁর কবিতার একটি সংকলন প্রকাশ করেন। ১৯২০ সালে উইলফ্রেডের মা সুজান ওয়েন রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠি লেখেন যাতে তিনি স্মরণ করেছেন যে, যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সময়ে উইলফ্রেড যে-কথাটি বলে তাঁর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেন সেটি ছিল ইংরেজি গীতাঞ্জলির ‘When I go from hence, let this be my parting word, that what I have seen is unsurpassable’। মৃত ওয়েনের পকেটে-পাওয়া নোটবইটি তাঁর মাতার কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। তাতেও রবীন্দ্রনাথের নামসহ ওই কথাগুলো লেখা ছিল। বাংলা কবিতাটির পঙ্ক্তি দুটি আমাদের খুবই পরিচিত : ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যাই/ যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’

গীতাঞ্জলির স্থায়ী মূল্যের পাশাপাশি তাৎক্ষণিক মূল্যও যে নোবেল কমিটির বিবেচনায় অনুপস্থিত ছিল না তা প্রদানপত্রে স্বীকার করা হয়েছে। মোটা দাগে চিহ্নিত করা হয় নি, করার কথাও নয়, তবে বলা হয়েছে যে, বিদ্যমান ব্যস্ততা ও অস্থির ছোটাছুটিতে দুর্বল হয়ে-যাওয়া সংস্কৃতির বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ একটি বিপুল ও শান্তিপূর্ণ সংস্কৃতিকে আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন। তাঁর কবিতায় যে-ছবিটি উন্মোচিত হয়েছে সেটি ঐতিহাসিক নয়, কাব্যিক, এবং সেটির উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের (অর্থাৎ ওই সময়ের ইউরোপীয়দের) এই বলে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে, শান্তি অপেক্ষমাণ। একালের আমরা অবশ্য জানি যে, তাঁর কবিতা তিনি যুদ্ধবিক্ষুব্ধ ওই বিশেষ পৃথিবীকে আশ্বস্ত করার জন্য লেখেননি, লিখেছিলেন আত্মপ্রয়োজনেই, কিন্তু বিচলিত ইউরোপ তাঁর কবিতাপাঠে যে স্বস্তি পেয়েছিল তা বোঝা যায়।

নোবেল কমিটির রায়টিকে তাই রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। কমিটি আরো একটি নিরিখের উল্লেখ করেছে যেটি পরিষ্কারভাবেই রাজনৈতিক। সেটা হলো এই ধারণা যে, রবীন্দ্রনাথ যে এতটা উন্নতমানের চিন্তা ও প্রকাশদক্ষতা অর্জন করতে পেরেছেন তার পেছনে ইউরোপের সাংস্কৃতির, বিশেষ করে খ্রিষ্টধর্মের অবদান রয়েছে। যে-ইংরেজরা রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা করেছেন তাঁদের কণ্ঠেও কিন্তু এমন উচ্চধ্বনি শোনা যায়নি, তাঁরা হয়তো ধরেই নিয়েছেন যে, প্রাচ্যের ওপর তাঁদের প্রভাব এতটাই স্বীকৃত যে নতুন করে তার উল্লেখ অপ্রয়োজনীয়। সুইডিশ অ্যাকাডেমির নোবেল কমিটি অবশ্য স্মরণে রাখেন নি, রাখাটা রেওয়াজ ছিল না, তখনো ছিল না, এখনো হয়নি, যে খ্রিষ্টধর্মের অভ্যুদয় প্রাচ্যেই ঘটেছিল, পাশ্চাত্যে নয়, যিশু খ্রিষ্ট ইউরোপীয় ছিলেন না, ছিলেন প্রাচ্যদেশীয়। বস্ত্তগত সম্পদের মতো মানসিক সম্পদকেও ইউরোপ তাদের নিজস্ব বলে গণ্য করেছে, সমুদ্রে ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থাৎ জলদস্যুপনা ও স্থলে উপনিবেশ স্থাপনে সাফল্যের কারণে। এটাও তাঁদের মনে থাকে নি যে, একসময়ে ভারতবর্ষের মানুষ যখন সভ্য জীবনযাপন করতো ইউরোপের অনেক স্থানেই মানুষের জীবনযাপন তখন সীমিত ছিল গুহার অন্ধকারে।

তিন

১৯১২-এর আগে রবীন্দ্রনাথ দুবার ইংল্যান্ড গেছেন। প্রথমবার যান ১৮৭৮-এ। তাঁর বয়স তখন সতেরো। দ্বিতীয়বার যান ১৮৯০-তে। প্রথমবার ছিলেন দেড় বছরের কিছু কম; দ্বিতীয়বার ছিলেন মাত্র এক মাস। প্রথমবার যখন যান তখন তাঁর পিতার ইচ্ছা ছিল সেখানে তিনি শিক্ষালাভ করবেন, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তাঁর আগ্রহ ছিল না। যেজন্য বিলেতি সমাজকে তিনি দেখলেন, বুঝলেন, তাকে নিয়ে লিখলেনও, কিন্তু কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে ফিরলেন না। তাঁর দ্বিতীয় যাত্রা ছিল ব্যারিস্টার কিংবা আইসিএস হওয়ার জন্য। তাঁর পক্ষে কাজটা করা কঠিন ছিল না। বিত্তবান ঘরের সন্তানেরা বিলেতে গিয়ে অনায়াসে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরতেন। তাঁর আপন ভাইদের একজন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ভারতীয়দের ভেতর প্রথম আইসিএস; ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে রবীন্দ্রনাথেরও কষ্ট হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু তিনি ব্যারিস্টার ও আইসিএস এ দুটির কোনোটিই হলেন না। কিছুটা হতাশ ও অনেকটা চিন্তিত হয়ে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কনিষ্ঠতমপুত্র ‘প্রাণাধিক রবি’কে সংসার জীবনের দায়িত্ব দেওয়ার উপায় হিসেবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে পূর্ববঙ্গে জমিদারি দেখার দায়দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেন। স্বামী, পিতা, জমিদার কোনো ভূমিকাতেই রবীন্দ্রনাথকে ব্যর্থ হতে দেখা যায় নি। পূর্ববঙ্গে থাকতেন, কখনো কখনো দিবস-রজনী হাউস বোটেই কাটাতেন, জমিদারি তদারকি করতেন, এবং লিখতেন। সেসব লেখা কলকাতার পত্রপত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতো। একসময়ে তাঁর মনে হলো আরো বড় জগতে যাওয়া দরকার। ১৯০১ সালে বোলপুরে গিয়ে একটি বিদ্যালয় ও আশ্রম প্রতিষ্ঠা করলেন। এরপরে চিন্তা এলো ভারতবর্ষের বাইরের জগতে যাওয়া প্রয়োজন। ১৯১২-তে তিনি লন্ডন গেলেন, সেখান থেকে গেলেন আমেরিকাতে। যৌবনে গিয়েছিলেন সংগ্রহের ইচ্ছায়, এবার, মধ্যবয়সে গেলেন কিছু দেবেন বলে। দিলেন বইকি, ইংরেজি গদ্যে অনুবাদ করা কবিতার সংকলনটি উপহার দিলেন, এবং তাতে পাশ্চাত্য এই অপরিচিত কবিকে সম্মান প্রদানে উদ্বুদ্ধ হলো।

বিলেতে তাঁর সঙ্গে তেমন কারো পরিচয় ছিল না। ঠিকানা জানা ছিল উইলিয়াম রদেনস্টাইনের। রদেনস্টাইন ছিলেন চিত্রশিল্পী এবং রয়েল কলেজ অব ফাইন আর্টসের অধ্যক্ষ। বয়সে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশ ছোট। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রদেনস্টাইনের পরিচয় কলকাতার জোড়াসাঁকোতে। সেখানে তিনি যেতেন অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথের সঙ্গে শিল্প-বিষয়ে আলোচনা করতে। রবীন্দ্রনাথকে দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ইনি একজন মহৎ মানুষ, কবির অনুমতি নিয়ে রদেনস্টাইন তাঁর একটি স্কেচ অাঁকেন, পেনসিলে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্ব তাঁর কাছে আরো প্রকাশ পায় যখন তিনি রবীন্দ্রনাথের তর্জমা-করা কবিতাগুলো পড়েন। রদেনস্টাইন ওই কবিতাগুলো টাইপ করে কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্যিকের কাছে পাঠান, এঁদের মধ্যে একজন হলেন ডব্লু বি ইয়েটস।

রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে পৌঁছেন ১৯১২ সালের ১৬ জুন। রদেনস্টাইন রবীন্দ্রনাথের পরিবারের জন্য হোটেলে আবাস ঠিক করে দেন। জুনের ৩০ তারিখে তিনি তাঁর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠের জন্য একটি বৈঠক ডাকেন। তাতে ইয়েটস ও এজরা পাউন্ড উপস্থিত ছিলেন। ইয়েটস তখন কবি হিসেবে অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত, সে তুলনায় এজরা পাউন্ড ছিলেন অল্পবয়স্ক, কিন্তু তাঁর মধ্যেও বিপুল সম্ভাবনা ছিল। যেটা পরে প্রকাশ পেয়েছে; টি এস এলিয়টের কবিতা তিনি সম্পাদনা করে দিয়েছেন, এলিয়ট যা মেনে নিয়েছেন। এর কয়েক দিন পরে ইস্ট ওয়েস্ট ক্লাব রবীন্দ্রনাথের জন্য একটি সংবর্ধনার আয়োজন করে। পরে জুলাইয়ের ১০ তারিখে ইন্ডিয়া সোসাইটি একটি ভোজসভার ব্যবস্থা করে, যাতে ইয়েটস সভাপতিত্ব করেন। এতে সত্তর জনের মতো অতিথি উপস্থিত ছিলেন। সভাপতির ভাষণে ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি যা বলেন তা অনেকটা এই রকমের :

একজন শিল্পীর জীবনে মস্ত বড় ঘটনা হচ্ছে এমন একজন মেধাবী মানুষের কাজ আবিষ্কার করা যাঁর সম্পর্কে পূর্বে তিনি কিছুই জানতেন না। আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথ তেমন একটি বড় মাপের ঘটনা। আমি তাঁর একশটির মতো বাংলা গীতিকবিতার ইংরেজি গদ্য তর্জমার একটি পান্ডুলিপি সঙ্গে করে নিয়ে বেড়িয়েছি। আমাদের সময়ে এমন কাউকে জানি না যিনি ইংরেজি ভাষায় এমন কিছু রচনা করেছেন যার সঙ্গে এই গীতিকবিতাগুলোর তুলনা চলে। শব্দার্থিক গদ্য তর্জমাতেও এই রচনাগুলো চূড়ান্ত রূপে সুন্দর – যেমন রচনারীতিতে তেমনি চিন্তায়। তাঁর রচনারীতিটি ইউরোপে কয়েকশ বছর আগে পরিচিত ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বড় সংগীতরচয়িতাও, তিনি তাঁর নিজের কবিতায় সুরারোপ করেন, তার পরে কবিতা ও গান অন্যদের শেখান। এভাবে সেগুলো মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। লোকেরা তাঁর গান গায়, অনেকটা সেইভাবে যেভাবে চারশো বছর আগে ইউরোপে কবিতা গাওয়া হতো। তাঁর সকল কবিতারই অন্তর্গত বিষয় হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা।

ইয়েটস আরো বলেন,

প্রকৃতিকে রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসেন। তাঁর কবিতা অনিন্দ্যসুন্দর সব স্পর্শে পরিপূর্ণ; সঙ্গে রয়েছে তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ও গভীর প্রেমের পরিচয়।

জবাবে সংক্ষিপ্ত, গোছালো ও আন্তরিক ভাষায় রবীন্দ্রনাথ বলেন,

এই অনুষ্ঠান আমার জীবনের সবচেয়ে গর্বের মুহূর্তগুলোর একটি। আপনাদের ভাষার সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আছে; কিন্তু বাংলাভাষা আমাকে ছাড় দেয় না, সে-ভাষা আমার সকল নিবেদনের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য চায়। তার দাবির কাছে আমি সানন্দে আত্মসমর্পণ করেছি; না-করে উপায় ছিল না। আজ শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে, যে-অব্যর্থ দয়াশীলতার সঙ্গে ইংল্যান্ড আমাকে গ্রহণ করেছে তাতে আমি যে পরিমাণে অভিভূত তা ভাষায় প্রকাশ করাটা দুঃসাধ্য। আমি এটা বুঝেছি যে আমাদের ভাষা ভিন্ন হতে পারে, আমাদের আচার-আচরণেও পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে আমাদের হৃদয় অভিন্ন।

রবীন্দ্রনাথ যোগ করেন,

প্রাচ্য প্রাচ্যই, পাশ্চাত্য পাশ্চাত্যই, দোহাই ঈশ্বরের অন্যরকম যেন না-ঘটে, কিন্তু হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের সম্প্রীতি ঘটে মৈত্রী, শান্তি ও সমঝোতায়; আর তাদের মিলন আরো বেশি ফলপ্রসূ হয় পার্থক্যের কারণেই।

ভোজসভায় উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন এইচ জি ওয়েলস এবং সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী লেখক কানিংহাম গ্রাহাম। ওই বছরই বাণিজ্যিকভাবে ম্যাকমিলান কোম্পানি গীতাঞ্জলি ছেপে প্রকাশ করে, এবং ইয়েটস তাতে ভূমিকা লিখে দেন। ভূমিকাতে ভোজসভায় তিনি যা বলেছিলেন সে-কথাগুলো আছে, তবে তাঁর সঙ্গে গীতাঞ্জলি পাঠে নিজের রক্তের ভেতর যে চাঞ্চল্য অনুভব করেছিলেন তার উল্লেখও রয়েছে। তিনি স্মরণ করেছেন যে, দিনের পর দিন তিনি রবীন্দ্রনাথের পান্ডুলিপি বহন করে বেড়িয়েছেন; ট্রেনে বাসে রেস্টুরেন্টে যখনই সুযোগ পেয়েছেন পড়েছেন, এবং প্রায়ই এমনটা ঘটেছে যে, পাছে কেউ দেখে ফেলে যে কবিতাগুলো তাঁকে কীভাবে অভিভূত করেছে সেটা ভেবে পাঠ বন্ধ করতে হয়েছে।

তিনি জানেন যে তর্জমায় মূল রবীন্দ্রনাথকে খুঁজতে নেই। এমন কী তাতেও নয় যে-তর্জমা রবীন্দ্রনাথ নিজেই করেছেন। এর একটি অতিরিক্ত কারণ এই যে, ইয়েটস ভারতীয়দের মুখে শুনেছেন যে ওই লিরিকগুলো ছন্দস্পন্দের সূক্ষ্মতায়, রং ও ছান্দিক উদ্ভাবনায় এমনভাবে পরিপূর্ণ যে তাদের তর্জমা করা অসম্ভব, তথাপি কবিতাগুলো তাদের চিন্তার ঐশ্বর্যে এমন একটি জগৎকে সামনে নিয়ে এসেছে যেটির স্বপ্ন ইয়েটস সারাজীবন ধরে দেখেছেন।

আরেকটি গুণের তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। সেটি হলো স্বতঃস্ফূর্ততা। তিনি বলেছেন, ‘আমরা লম্বা লম্বা যেসব বই লিখে থাকি তাদের কোনো পৃষ্ঠাতেই হয়তো এমন কিছু থাকে না লেখার কাজটাকে যা আনন্দের ব্যাপার করে তুলতে পারে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর ভারতীয় সভ্যতার মতোই নিজের আত্মাকে খুঁজে পেয়েছেন এবং তাকে স্বতঃস্ফূর্ততার কাছে অর্পণ করে সন্তুষ্ট হয়েছেন।

ইয়েটস যে এভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন তার একটি কারণ নিশ্চয়ই আবিষ্কারের আনন্দ; কিন্তু যাকে তিনি আবিষ্কার করলেন এবং পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর সঙ্গে তিনি নিজের আত্মীয়তা যে বোধ করেছিলেন তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। গ্রন্থি ছিল একাধিক। প্রবণতায় তাঁরা উভয়েই ছিলেন রোমান্টিক। তদুপরি, ইয়েটস ইংরেজি ভাষার কবি ঠিকই, কিন্তু তিনি তাঁর আইরিশ পরিচয় সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। আয়ারল্যান্ডের ওপর ইংরেজদের আধিপত্যকে বিতাড়নের জন্য যে আন্দোলন তাঁর সময়ে বেশ প্রবল হয়ে উঠেছিল ইয়েটস তার সঙ্গেই ছিলেন। আয়ারল্যান্ডের জন্য স্বতন্ত্র সাহিত্যধারা ও নাট্য-আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁর চেষ্টা ছিল। আয়ারল্যান্ডের রূপকথা ও লোককাহিনিকে তিনি নিজের কবিতায় ব্যবহার করেছেন। মোটকথা প্রথম জীবনে নানাদিক থেকেই তিনি ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী। রবীন্দ্রনাথের ভেতরও তিনি জাতীয়তাবাদী উপাদান লক্ষ করে থাকবেন।

রোমান্টিকতার ব্যাপারটা ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে স্বতঃস্ফূর্ততা, কল্পনাপ্রিয়তা ও ঈশ্বরমুখিতার পরিচয় তিনি পেয়েছিলেন তা তাঁকে আকর্ষণ করার কথা; এবং করেছিল যে সেটা তো তাঁর উচ্চ প্রশংসা থেকেই বোঝা যায়। ইয়েটসকে লন্ডনেই থাকতে হয়েছে অধিকাংশ সময়, কিন্তু সে সময়ের লন্ডনবাসী আধুনিক কবিদের একজন হতে চান নি তিনি। তখনকার নাগরিক আধুনিকতার প্রতিনিধি যদি কাউকে বলতে হয় তবে তিনি হচ্ছেন টি এস এলিয়ট। ইয়েটস এলিয়টদের কবিতা মোটেই পছন্দ করতেন না। ১৯৩৬ সালে ইয়েটস Oxford Book of Modern Verse নামে একটি কাব্যসংকলন সম্পাদনা করেন। এতে রবীন্দ্রনাথের সাতটি কবিতা ছিল; এলিয়টের কবিতাও ছিল, অবশ্যই, না-থেকে উপায় ছিল না। কিন্তু সংকলনের ভূমিকায় এলিয়ট সম্পর্কে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তাতে টের পাওয়া যায় এই রোমান্টিক কবি ক্ল্যাসিসিজম ও নাগরিকতায় স্বেচ্ছাবন্দি এলিয়টদের থেকে কতটা দূরবর্তী ছিলেন। এলিয়ট সম্পর্কে তাঁর ধারণাটি ছিল এই রকমের :

এলিয়ট তাঁর প্রজন্মের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছেন, এর কারণ হলো তিনি তাঁর কবিতায় নরনারী যে নিতান্ত অভ্যাসবশতই বিছানা ছেড়ে ওঠে এবং বিছানায় ফেরত যায় সেটা দেখিয়েছেন, এবং হতাশাপীড়িত ওই জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি নিজেই হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন; তাঁর নিজের হৃদয় মনে হয় ধূসর, শীতল, শুষ্ক। আমার কাছে মনে হয় তিনি ঠিক কবি নন, যেন ব্যঙ্গরচয়িতা; যেন একজন আলেকজান্ডার পোপ যিনি কাজ করছেন দৃশ্যমান কল্পনাশক্তি ছাড়াই, তাঁর নিজের যা তাঁর জন্য তিনি যেন নিজের ছন্দস্পন্দন ও উপমা খুঁজে বার করার পরিবর্তে বরঞ্চ তাঁর তুলনায় জনপ্রিয় রোমান্টিক কবিদের ব্যবহৃত ওইসব উপাদান প্রত্যাখ্যানের ওপরই অধিক নির্ভরশীল। এই প্রত্যাখ্যানটাই তাঁর দৃষ্টিকে একটা অতিরঞ্জিত সাদামাটাভাব ও অভিনবতেবর চেহারা দিয়েছে।

তাঁর চিঠিপত্রেও এলিয়ট সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য পাওয়া যায়। যেমন তিনি বলেছেন যে, এলিয়ট অতীতের ঘাড় মটকে রসটাকে নিঃশেষ করে দেন এবং সেটিকে যাঁরা এলিয়টের যতোটা প্রয়োজন ততোটা পড়তে পারে না, হয় ব্যস্ততার কারণে, নয় তাদের নিজেদের মধ্যেই সৃষ্টিশীলতা থাকার দরুন, তাদের গলার ভেতর তা ঢেলে দেন। ইয়েটসের ধারণা হয়েছে, একসময়ে এলিয়টকে মনে হবে একটি অসুস্থ ও বিষণ্ণ যুগের কৌতূহলোদ্দীপক নিদর্শন। এলিয়টীয় ধরনের কবিতার প্রতি এই অনীহার ভেতর রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিকতার প্রতি ইয়েটসের আকর্ষণের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে বইকি।

রোমান্টিকেরা বুদ্ধির চাইতে সৃষ্টিশীল কল্পনাকে সর্বদাই অধিক গুরুত্ব দেন। ইয়েটসও দিতেন। বিজ্ঞানের জগৎটাকে তাঁর মনে হতো ভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ। তাঁর মতে, বিজ্ঞানের অন্তরালে রয়েছে সুন্দর একটি জগতের উপস্থিতি, যেখানে পৌঁছার জন্য বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি নয়, চাই হৃদয়ানুভূতি ও কল্পনাশক্তি। উইলিয়াম ব্লেকের রচনায় ইয়েটস এ-ধরনের একটি জগতের সন্ধান পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতাতেও তিনি এই রকমের জগতের উপস্থিতি লক্ষ করেছেন।

ইয়েটসের আস্থা ছিল ধর্মে। নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি স্মরণ করেছেন,

আমাদের প্রজন্মের অনেকের থেকেই আমি ভিন্ন ধরনের। সেটি কেবল এই একটি বিষয়ে যে আমি খুবই ধর্মবিশ্বাসী। বাল্যকালের একরৈখিক ধর্মবিশ্বাস থেকে বঞ্চিত হয়ে আমি নিজে নিজেই একটা ধর্ম তৈরি করে নিয়েছিলাম, সেটা ছিল প্রায়-অভ্রান্ত কাব্যিক ঐতিহ্য ও আবেগের একটি গির্জার মতো। এর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য রূপে যুক্ত ছিল দার্শনিক ও ধর্মশাস্ত্রবিদদের কাছ থেকে খানিকটা সহায়তা নিয়ে কবি ও চিত্রশিল্পীদের দ্বারা প্রজনম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরিত প্রাথমিক অভিব্যক্তিগুলো।

রবীন্দ্রনাথের কবিতাপাঠে ইয়েটস গভীর ধর্মবিশ্বাসের সন্ধান পেয়েছিলেন। সে-প্রাপ্তিটা মিথ্য নয়, কেননা গীতাঞ্জলির সব গানেই ধর্মবোধ অত্যন্ত প্রবল। ঈশ্বর প্রায় কোথাও অনুপস্থিত নন। ঈশ্বরের সঙ্গে কবির সম্পর্কটা একান্তই ব্যক্তিগত; তাতে আস্থা, আশা, নিবেদন, ভক্তি, এমন কী সংশয়ও রয়েছে। ঈশ্বর কখনো নিকটজন, কখনো উপস্থিতি, কখনো-বা অভিজ্ঞতা। কিন্তু সম্পর্কটা কখনোই নৈর্ব্যক্তিক নয়। এমনও তো বলা আছে যে, আমি আছি বলেই তুমি আছো। এই ঈশ্বর অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান, উপাসনাগৃহের নয়, যেমন আছেন গৃহে তেমনি আছেন আকাশে, তবে সব সময়েই রয়েছেন একান্ত নিভৃতে। এবং দুজনের সম্পর্কটা সম্পূর্ণরূপেই ব্যক্তিগত। ঈশ্বর কায়াহীন সত্তা হিসেবেই তাঁর কল্পনায় ও অনুভূতিতে উপস্থিত। আর ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়েই তিনি মুক্ত হবেন। আবার ঈশ্বরকে যে ভালোবাসেন সেটাও জগৎকে ভালোবাসেন বলেই।

রোমান্টিসিজমে ব্যক্তির স্থানটা প্রধান। ইয়েটস যেমনটা করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথও তেমনি তাঁর অনুভবের উপাদানগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে নিয়েছেন। প্রধান উৎস উপনিষদ। উল্লেখ্য যে, ইয়েটসও উপনিষদের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মধ্যযুগের ভারতের ভক্তিসংগীত, বিশেষ করে কবিরের গানের বিষয়ে অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। বৈষ্ণব কাব্য, রাগসংগীত এবং লালনের গান থেকেও নিজের জন্য কাব্যের উপাদান সংগ্রহে তাঁর কোনো কার্পণ্য ছিল না। রবীন্দ্রনাথে ইয়েটস তাঁর নিজের মতোই আরেকজনকে খুঁজে পেয়েছিলেন যিনি সমসাময়িক কালের ঠিকই, কিন্তু বস্ত্ততান্ত্রিক নন, আধ্যাত্মিক; এবং যুগের তুলনায় অপর এক রহস্যঘেরা পৃথিবীর বাসিন্দা। কিন্তু পার্থক্যও ছিল, যেজন্য পরবর্তীকালে দুজনের ভেতর একসময় দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, যে-প্রসঙ্গে আমরা পরে আসবো।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় উগ্রতা নেই, যে-জন্য তিনি উগ্রতায় আক্রান্ত ইউরোপের কাছে অতটা আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলেন। গভীর ও গম্ভীর বিষয়কে তিনি সহজ ভাষায় প্রকাশ করেছেন, যা ইয়েটসেরও অভিপ্রেত ছিল। বংশপরিচয়ে ইয়েটস অভিজাত ছিলেন, এবং তিনি কেবল আভিজাত্যে নয়, অভিজাততন্ত্রেও বিশ্বাস করতেন। রবীন্দ্রনাথের বংশপরিচয় ইয়েটসের অজানা থাকার কথা নয়। এই ভারতীয় কবির কাব্যে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন এমন একটি আভিজাত্য যা সরল সাধারণ মানুষের ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর ধারণা ছিল যে, অভিজাত রবীন্দ্রনাথ যে-গান নিজে গেয়েছেন তা গ্রামের চাষি ও ধীবরও শিখে নিতে পারে। ধারণাটা যে একেবারেই ভ্রান্ত ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ অভিজাত বংশের মানুষ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু রুচিতে ছিলেন পরিপূর্ণরূপে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। তাঁর সাহিত্যের মতো তাঁর গানও মধ্যবিত্তেরই পাঠ্য, তাদের জন্যই রচিত। চাষী ও ধীবর দূরের কথা, মধ্যবিত্তের পশ্চাদপদদের জন্যও এ-গান ছিল দূরবর্তী। অভিজাততন্ত্রী ইয়েটস মধ্যবিত্তকে খুবই অপছন্দ করতেন, যেটা একটা কারণ, যে-জন্য তিনি এলিয়টের কবিতার প্রতি অতটা বিরূপ ছিলেন।

সেকালের আধুনিক ইংরেজি কবিতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে-অনুরাগ ছিল তা নয়। ওই কবিতা নিয়ে তিনি কৌতুকও করেছেন। ১৯৩২ সালে ‘আধুনিক সাহিত্য’ নামে একটি প্রবন্ধে তাঁর মন্তব্যগুলো লক্ষ করার মতো। তিনি বলেছেন, রোমান্টিক কবিতাতে ছিল ব্যক্তিগত খুশির দৌড়, আধুনিককালের মনের মধ্যেও তাড়াহুড়ো আছে, তবে সে-মনটা ভিন্ন রকমের। এখানে রয়েছে নৈর্ব্যক্তিকতা ও মোহমুক্তি। চটিজুতো নিয়ে, ব্যাঙকে নিয়েও কবিতা লেখা হচ্ছে। যে-এজরা পাউন্ড রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী ছিলেন Aesthetics- এর ওপরে তাঁর একটি কবিতায় তিনি কৌতুকের সঙ্গে দেখেছেন যে, সৌন্দর্যের উপস্থিতি যেমন দেখা যাচ্ছে পথচলা মেয়েটির চলার যে ভঙ্গিতে, তেমনি তা আছে সার্ডিন মাছ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার এবং মাছগুলোর লাফালাফি করার ভেতরও। আগের কালের বাছাই করতেন এটা উল্লেখ করে তিনি বলছেন,

অতি আধুনিকেরা বাছাই করেন না, সে কথা মানি নে; তাঁরাও বাছাই করেন। তাজা ফুল বাছাই করাও বাছাই, আর শুকনো পোকায়-খাওয়া বাছাইও বাছাই।

এ প্রসঙ্গে তাঁর আরেকটি উক্তি মনে রাখার মতো,

একটি মেয়ের সুন্দর হাসির খবর কোনো কবির লেখায় যদি পাই তা হলে বলব, এ খবরটা দেওয়ার মতো বটে। কিন্তু তার পরেই যদি বর্ণনায় দেখি ডেনটিস্ট এলো, সে যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল মেয়েটির দাঁতে পোকা পড়েছে, তা হলে বলতে হবে নিশ্চয়ই খবর বটে তবে সবাইকে ডেকে বলার মতো খবর নয়। যদি দেখি কারও এই কথাটা প্রচার করতেই বিশেষ ঔৎসুক্য, তা হলে সন্দেহ করব তাঁরও মেজাজে পোকা পড়েছে।

কথিত আধুনিক কাব্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে ইয়েটসের তিনি নিকটবর্তী; কিন্তু তাঁর অবস্থান সহনশীল, এবং কৌতুকমিশ্রিত। এই সহনশীলতারই প্রকাশ দেখি যখন তিনি প্রায় ওই সময়েই তীর্থযাত্রী নাম দিয়ে এলিয়টের ‘ঔড়ঁৎহবু ড়ভ ঃযব গধমর’ কবিতাটি অনুবাদ করেন। এলিয়ট কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কোনো আগ্রহ দেখান নি। রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিকতা থেকে তিনি দূরেই ছিলেন।

কবিতায় ইয়েটস আবেগের প্রাবল্য পছন্দ করতেন, সে-আবেগ রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ছিল, এবং ইয়েটস সেই আবেগের পরিচয় পেয়ে বিশেষভাবে চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন। ইয়েটস কলাকৈবল্যবাদী ও সৌন্দর্যবিলাসীদের বৃত্ত ভেঙে বের হয়ে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের তেমন কোনো বৃত্তের অস্তিত্বই ছিল না। উভয়ের কবিতায় প্রকৃতি ও গতি উপস্থিত। হংস বলাকাদের উড়ে যাওয়া দুজনের কবিতাতেই উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের ভাষার সরলতায় বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সেখানে জটিলতা নেই, পান্ডিত্য অনুপস্থিত, প্রচেষ্টা নেই বাগ্বৈদগ্ধ প্রকাশের। তাঁর বাংলা কবিতাতে পাই,

আমার এ গান ছেড়েছে তার

সকল অলংকার

তোমার কাছে রাখে নি আর

সাজের অহংকার।

অলংকার যে মাঝে প’ড়ে

মিলনেতে আড়াল করে,

তোমার কথা ঢাকে যে তার

মুখর ঝংকার।

গীতাঞ্জলির ইংরেজি তর্জমাতে কথাগুলো দাঁড়িয়েছে,

My song has put off her adornments.

She has no pride of dress and

decoration. Ornament would mar our

union; they would come between thee and

me; their jingling would drown thy whispers.

এর চেয়ে স্বাভাবিক ও সুন্দর ভাষান্তর আর কী হয়ে পারতো? এক্ষেত্রে যেমন, অন্যক্ষেত্রেও তেমনি, রূপান্তরিত কবিতাটিকে ভাষান্তরিত না বলে নতুন সৃষ্টি বলাই ভালো। তবে সন্দেহ নেই বাঙালি পাঠক কবিতাটির যে আবেদন পাবেন ভিনদেশি পাঠক তা পাবেন না, বাংলা শব্দ, তার ধ্বনি, সুর, ছন্দ, ছন্দস্পন্দন মিলে যে আবহ ও অনুষঙ্গ তৈরি করে তা তর্জমায় নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। ছন্দ ধরে রাখে; সুর আগুন লাগায়, সে আগুন যতই শান্ত, এমন কী শীতলও হোক না কেন। অন্যকথা বাদ থাক, ‘ঝংকারে’ যে ব্যঞ্জনা আছে, jingle-এ কি তা পাওয়া সম্ভব? আদৌ?

১৯১০ সালে ইয়েটস ‘A Coat’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন যার বক্তব্য রবীন্দ্রনাথের এই গানের মতোই। দুই কবিতার ভেতর যে-মিলটি রয়েছে তাতে ভাষা ব্যবহারের যে সরলতার ব্যাপারটি ইয়েটস ও রবীন্দ্রনাথকে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল সে-ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ইয়েটসের কবিতাটি এ-রকমের :

I made my song a coat,

Covered with embroideries,

Out of all mythologies,

From heel to throat.

But the fools caught it,

Wore it in the world’s eyes,

As though they’d wrougth it,

Song, let them take it,

For there’s more enterprise

In walking naked.

মিল রয়েছে, কিন্তু পার্থক্যও কম নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের গানের নিরাভরণতার কথা বলেই সন্তুষ্ট, অন্যেরা অনুকরণ করল কী করল না তা নিয়ে তাঁর কোনো উদ্বেগ বা বিতৃষ্ণা নেই, যা ইয়েটসের কবিতায় রয়েছে। পার্থক্য হিসেবে এটা সামান্য নয়।

মিলের অন্য একটি ক্ষেত্র তাঁদের সংগীতপ্রিয়তা। কবিতায় যে গান থাকবে এ-প্রত্যয় তাঁদের উভয়েরই। রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর অনেক কবিতাকে সরাসরি গানই বলেছেন, তাঁর বহু কবিতাকে গান হিসেবে গাওয়া হয়। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত তো তাঁর কবিতা থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে। তাঁর গান বাঙালিকে গাইতে হবে – একথা তিনি বলেছিলেন, এবং সে-কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয় নি। ধ্রুপদী-সংগীত ও লোকসংগীতের বিভাজন ভেঙে দিয়ে তিনি নিজের গানের সুর ও ধ্বনি তৈরি করেছেন, সাহায্য নিয়েছেন বাউল ও বৈষ্ণবদের কাছ থেকে। এদিকে ইয়েটসও কবিতার সঙ্গে গানের সম্মিলনে বিশ্বাস রাখতেন। নিজের একটি কবিতার বইয়ের নাম রেখেছেন Words for Music Perhaps। বেতারে কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে পাঠের সঙ্গে বাজনা বাজানোরও নিরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন।

রবীন্দ্রনাথও মানতেন যে ‘music expresses where words are helpless’, সংগীতের সেই শক্তির ওপর তাঁর আস্থা ছিল যা বুদ্ধির সীমাকে লঙ্ঘন করে। সেই ১৮৮১ সালে বয়স যখন মাত্র বিশ, তখন কলকাতায় জীবনের প্রথম যে-বক্তৃতা তিনি দেন, সেটি ছিল সংগীতবিষয়ক।

রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় সংগীতের ভাবপ্রাচুর্য জীবনস্রোতের ওঠানামা, আলো-আঁধারির খেলা, অবিরাম স্রোতকে পছন্দ করতেন। এ-সম্পর্কে তিনি বলেছেন :

হারমনি বা স্বরসংগতি য়ুরোপীয় সংগীতের প্রধান বস্তু, আর রাগরাগিণীই আমাদের সংগীতের মুখ্য অবলম্বন। য়ুরোপ বিচিত্রের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াছে, আমরা একের দিকে। […] চিরধাবমান বিচিত্রের সঙ্গে যোগ দিয়া তাল রাখিয়া চলা, ইহাই য়ুরোপের প্রকৃতি, আর চিরনিস্তব্ধ একের দিকে কান পাতিয়া, মন রাখিয়া চলা, ইহাই আমাদের স্বভাব।

১৯১৩ সালে আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ড হয়ে ফেরার সময়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ছাত্ররা রবীন্দ্রনাথের জন্য এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন। অক্সফোর্ডে তখন কবি রবার্ট ব্রিজেস বাস করতেন, পরের বছর তিনি পোয়েট লরেট পদ লাভ করেন; বয়সে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিনি সতেরো বছরের বড়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ব্রিজেসের একটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা ভারতীয় ছাত্ররা করেছিলেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে আলাপ হয়েছিল সংগীত নিয়ে এবং সে আলাপে প্রাচ্য সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতের পার্থক্যের বিষয়টি স্বভাবতই চলে এসেছিল। রবীন্দ্রনাথ ওপরের উদ্ধৃতিতে যে-কথা বলেছেন ব্রিজেসের সঙ্গে আলোচনাতেও তাই বলেছিলেন। বলেছিলেন, পাশ্চাত্য যেখানে বিভিন্ন স্বরের ভেতর হারমনি গড়ে তোলে, ভারতীয় সংগীত সেখানে একটি স্বরের মেলোডিকেই বিভিন্নভাবে প্রত্যক্ষ করে তোলে। রবীন্দ্রনাথের নিজের গানেও তেমনটিই ঘটেছে, তিনি হারমনি নয়, মেলোডি গড়ে তুলেছেন। তার গান চাঞ্চল্য ও বৈচিত্র্যকে সুরের ভেতর ধারণ করেছে, এবং সে-কাজ করতে গিয়ে সুরকে চঞ্চল করে তুলেছে।

রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষের সঙ্গে ইয়েটসের আয়ারল্যান্ডের মিল আছে। আয়ারল্যান্ড তখন ইংরেজ শাসনের অধীনে। আইরিশরা লড়ছে স্বাধীনতার জন্য। আর ব্যক্তিগতভাবে ইয়েটস যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন তার আরো একাধিক কারণ ছিল। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তিনি সন্ধান পেলেন একজন ধর্মবিশ্বাসী কবির যিনি উৎসাহ রাখেন অধিদৈবিকে। রবীন্দ্রনাথের তুলনায় অনেক কম মেধাবী একজনকে – নাম পুরোহিত স্বামী – তিনি উপনিষদের ইংরেজি অনুবাদের কাজে সাহায্য করছিলেন। এটাও মানতে হবে যে, বয়সে বড় এবং ইংরেজি যাঁর মাতৃভাষা নয়, তেমন একজন বড়মাপের কবিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পেরে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।

চার

১৯১২-তে রবীন্দ্রনাথ যখন বিলেত যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিচ্ছেন তখন তাঁর মনের অবস্থা ভালো নয়। বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। স্বদেশে স্বীকৃতি কিছুটা পেয়েছেন, কিন্তু অত্যন্ত সন্তুষ্ট হওয়ার মতো নয়। পঞ্চাশ বছরপূর্তি উপলক্ষে কলকাতায় তাঁকে একটি সংবর্ধনা দেওয়া হয় এটা সত্য; কিন্তু তিনি নিজে যতটা এগিয়ে গিয়েছিলেন তখনকার বিদ্বৎসমাজ ততটা পারে নি। তাঁর কবিতার বিরুদ্ধে নানা রকমের অভিযোগ ছিল। এও তো আমরা জানি যে, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরও ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক পরীক্ষার আবশ্যিক বাংলা বিষয়ে প্রশ্নপত্রে তাঁর লেখা গদ্যাংশ উদ্ধৃত করে সেটিকে শুদ্ধ পুনর্লিখনের প্রশ্ন দেওয়া হয়েছিল।

ওদিকে শোক এবং দুঃখ তো রবীন্দ্রনাথের পিছু ছাড়ে নি। তিনি মাতাকে হারান তেরো বছর বয়সে। মায়ের তিনি চতুর্দশ সন্তান, সে-কারণে জীবিত অবস্থাতেও মাতা যে তাঁর প্রতি পর্যাপ্ত মনোযোগ দিতে পেরেছেন তাও নয়। ১৯০১ সালে পূর্ববঙ্গে জমিদারি দায়িত্বপালন থেকে অবকাশ নিয়ে শান্তিনিকেতন আবাস ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। কাজটা সহজ ছিল না। প্রথমে ছাত্র ছিল মাত্র পাঁচজন, যাদের একজন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র। শিক্ষকও ছিলেন পাঁচজন। ঠিক পরের বছর স্ত্রী মৃণালিনীর মৃত্যু ঘটে। স্বামী-স্ত্রীতে বয়সের ব্যবধান ছিল বারো বছরের। স্ত্রীর নাম ছিল ভবতারিণী, বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথ সে-নাম বদলে মৃণালিনী করে দেন। ব্রাহ্মণ হলেও পূর্বপুরুষের মুসলমান সংস্পর্শের দরুন ঠাকুর পরিবারের  সন্তানদের জন্য কুলীন ঘরের পাত্রপাত্রী পাওয়া খুব সহজ ছিল না। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী ছিলেন ঠাকুর পরিবারেরই একজন কর্মচারীর কন্যা। বয়স, শিক্ষা ও রুচিতে প্রচুর দূরত্ব সত্ত্বেও তাঁদের বৈবাহিক জীবন সুখের ছিল। কিন্তু সে-সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি, মাত্র উনিশ বছর দাম্পত্য জীবনযাপনের পর মৃণালিনী অসুস্থ হয়ে পড়েন, কলকাতায় তাঁর চিকিৎসা চলে, দুমাস ধরে রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর রোগশয্যার পাশেই ছিলেন, এবং স্ত্রী বিয়োগে অত্যন্ত শোকভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন।

স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক মাস পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দ্বিতীয় কন্যা রেণুকাকে হারান। এর পরের বছর তাঁর অত্যন্ত আপনজন শান্তিনিকেতনে তাঁর সহযোগী সতীশচন্দ্র রায় বসন্তে আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। ১৯০৫-এ পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরলোকগমন ঘটে। সন্তানদের ভেতর রবীনদ্রনাথ ছিলেন মহর্ষির প্রিয়; এই পুত্রটিকে তিনি পত্রালাপে ‘প্রাণাধিক রবি’ বলে সম্বোধন করতেন। এর ঠিক দুবছর পরে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠপুত্র সতীন্দ্রনাথ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা মাধুরীলতার বিয়ে হয় ১৯০১ সালে, সে-বিয়ে সুখের হয় নি। রবীন্দ্রনাথের জন্য একটি মর্মান্তিক আঘাত এসেছিল তাঁর ভ্রাতৃবধূ কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুতে। রবীন্দ্রনাথের বিবাহের কয়েকমাস পরে, ১৮৮৪-তে কাদম্বরী আত্মহত্যা করেন। কাদম্বরী তাঁরা সমবয়সী ছিলেন, এবং দুজনের ভেতর গভীর বন্ধুত্ব ছিল। অনেকের মধ্যে থেকেও রবীন্দ্রনাথ একাকী ছিলেন; তাঁর ডাকঘর নাটকের অমলের নিঃসঙ্গতা ও দুঃখের দিকটা তিনি নিজের জীবনের ভেতরই অনুভব করে থাকবেন।

১৯১২-তে তিনি বিলেত যাবেন ঠিক করেন, জীবনযাত্রায় সাময়িকভাবে কিছুটা বৈচিত্র্য আসবে, হয়তো এটাই ছিল প্রত্যাশা। কিন্তু যেটা ঘটলো তা বড় একটা ঘটনা। তাঁর জন্য নোবেল পুরস্কার কেবল একটা প্রাপ্তি ছিল না, ছিল বিশ্বমাপের স্বীকৃতি এবং বিশ্বের কাছে পৌঁছার দ্বারোন্মোচন। পরবর্তীকালে ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনে তিনি যে বিশ্বভারতী নামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর পেছনে এই স্বীকৃতি নিশ্চয়ই কাজ করেছে।

পুত্র রবীন্দ্রনাথ এবং পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা বন্দর থেকে রওনা হওয়ার কথা ছিল মার্চ মাসে। কিন্তু বিদায় নেওয়ার ব্যস্ততা, কলকাতার শুকনো আবহাওয়া, শারীরিক ক্লান্তি এসবের দরুন জাহাজে ওঠার আগের মুহূর্তে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। মালপত্র জাহাজে তুলে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো পরে মাদ্রাজ থেকে ফেরত আনা হয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হলো না। বিশ্রামের জন্য তিনি শিলাইদহে চলে যান। এই দুর্ঘটনা রবীন্দ্রনাথের নিজের এবং বাঙালি ও বাংলা সাহিত্যের জন্য অত্যন্ত মঙ্গলজনক প্রমাণিত হয়েছে। কেননা শিলাইদহে গিয়ে তিনি তাঁর পুরনো সেই পরিবেশে বিশ্রাম নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে হালকা ধরনের কাজ হিসেবে নিজের লেখা গানের তর্জমা শুরু করেন। সেখানে তিনি ২৪ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত ছিলেন।

কাজটি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন –

আমি কোনো একটা অবকাশের মুহূর্ত্তকালে নিজের কতগুলো কবিতা ও গান ইংরেজি গদ্যে তর্জমা করিবার চেষ্টা করিয়াছিলাম। ইংরেজী লিখিতে পারি এ অভিমান কোনও কালেই নাই; অতএব ইংরেজী রচনায় বাহবা লইবার প্রতি আমার লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু নিজের আবেগকে বিদেশী ভাষার মুখ হইতে একটুখানি নূতন করিয়া গ্রহণ করিবার যে সুখ তাহা আমাকে পাইয়া বসিয়াছিল। আমি আর এক বেশে নিজের হৃদয়ের পরিচয় লইতেছিলাম।

এরকমের সুন্দর বক্তব্য রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই প্রকাশ করা সম্ভব। আত্মপ্রচারের তথা বাহবা পাওয়ার জন্য লেখেন নি, এটা অবশ্যই সত্য। অন্তর্গত প্রেরণায় তর্জমার মাধ্যমে ভিন্ন বেশে নিজের হৃদয়ের পরিচয় যে নিতে চেয়েছিলেন এতে সন্দেহ নেই। তবে নিজের লেখার সঙ্গে অন্যরা পরিচিত হোক – এই ইচ্ছা অবশ্যই ছিল। নইলে তর্জমার খাতা সঙ্গে নেবেন কেন, এবং একাধিক অনুষ্ঠানে তর্জমা পড়েই বা শোনাবেন কেন? কিন্তু এই পরিচিতি যে অতদূর পৌঁছে যাবে এ তিনি আশা করেন নি; সেই আশাতীত ঘটনাই ঘটেছে। তাঁর লেখার গুণ ছিল, এবং পরিবেশও ছিল প্রস্ত্তত। মণিকাঞ্চনের যোগ ঘটেছে।

সেই তর্জমাই ইংরেজি গীতাঞ্জলির আকারে পরে প্রকাশিত হয়। জুন মাসের দুই তারিখে কলকাতা থেকে জাহাজে করে আবার রওনা হলেন, সঙ্গে থাকল তর্জমার খাতা। লন্ডনে পৌঁছানোর পর আরেক বিপদ ঘটে। পুত্র ও পুত্রবধূর সঙ্গে হোটেলে পৌঁছে দেখলেন জরুরি কাগজপত্র এবং ইংরেজি গীতাঞ্জলি র পাণ্ডুলিপিসহ অ্যাটাচি কেসটি পাওয়া যাচ্ছে না। সেটি ছিল রথীন্দ্রনাথের হাতে। পাতালরেলে চেপে হোটেলে পৌঁছানোর পথে রথীন্দ্রনাথ সেটি রেলকামরায় ফেলে রেখে ওপরে উঠে এসেছিলেন। পরে অবশ্য লস্ট প্রপার্টি অফিসে ব্যাগটি পাওয়া যায়। না-পাওয়া গেলে কী ক্ষতিটা যে ঘটতো তা অকল্পনীয়। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তর্জমার কাজটি দ্বিতীয়বার করা হয়তো সম্ভব হতো না।

তাঁর সঙ্গে তর্জমার খাতাটি থাকার কারণে বেশ কয়েকজন কবিতাগুলো পড়তে পেরেছিলেন, যার ফলে বিভিন্ন মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতীয় বোদ্ধারা তো বটেই, ব্রিটিশদের অনেকেই সেগুলো পাঠ করে তৃপ্তি পেয়েছেন। কাব্যপাঠ ও সংবর্ধনার অনুষ্ঠান হয়েছে। তখনকার দিনে প্রভাবশালী লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের কারো কারো সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ও মতামত বিনিময় হয়; এঁদের মধ্যে ছিলেন জর্জ বার্নার্ড শ, বার্ট্রান্ড রাসেল ও এইচ জি ওয়েলস। সবাই যে তাঁকে একভাবে নিয়েছেন তা নয়, তবে কারো পক্ষেই না-মেনে উপায় থাকেনি যে, শিল্পী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ একেবারেই মৌলিক।

তর্জমায় যাঁরা তাঁর কবিতা পড়েছেন তাঁরা মূল বাংলা রচনার স্বাদ যে পেয়েছেন তা মোটেই নয়; সেটা তর্জমাতে তো নয়ই, বাংলা জানা থাকলেও পাওয়া সম্ভব ছিল না; পাওয়ার জন্য রুচিবান বাঙালি হওয়া আবশ্যক ছিল। যদিও এ তর্জমা কেবল রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই করা সম্ভব ছিল, অন্য কেউ মূল অনুভূতি ধরতে পারতেন না, এবং তাদের উপস্থিত করার জন্য যে স্বতঃস্ফূর্ত সাহস আবশ্যক তাও সঞ্চয় করতে ব্যর্থ হতেন।

কবিতাগুলো বাংলা গানের মতোই সরল ভাষায় লিখিত, এদেরকে তো গানই বলেছেন আমাদের কবি, কিন্তু যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতায় প্রতিদিনের কথোপকথনের ভাষা ব্যবহারের ‘বৈপ্লবিক’ কাজটি করেছিলেন তিনিও তো স্বীকার না-করে পারেন নি যে, কবিতা গদ্য নয়, সবঃৎরপধষ পড়সঢ়ড়ংরঃরড়হ বটে। আর তাঁর কবি বন্ধু কোলরিজ আমাদের জানিয়েছেন যে, কবিতায় ছন্দ ব্যবহার করলে অনেক কিছু বদলে যায়, শব্দের উপস্থাপনা তো বটেই, শব্দবাছাই পর্যন্ত, সে-জ্ঞানও একটি অমোঘ সত্য। ইংরেজি গীতাঞ্জলির ছন্দে নয়, গদ্যেই রচিত; সেজন্য ছন্দে পাঠের যে আনন্দলাভের কথা ওয়ার্ডসওয়ার্থও প্রকারান্তে যা স্বীকার করেছেন, তা ওই গদ্যে ছিল না। স্বভাবতই।

তবু যা ছিল তা অসাধারণ। গানগুলো ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, করে দেওয়া। তাদের আন্তরিকতা যে কাউকে স্পর্শ করবে। আবেগের স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে বৈদগ্ধ্যের যে বন্ধন তা অসামান্য। কবিতাগুলোর ধরনটা স্বগতোক্তির, কবির নিজের কথা; নিজের মতো করে কখনো-বা নিজের সঙ্গেই বলা। হঠাৎ হঠাৎ মনে হবে ইনি বুঝি মরমিবাদী, নিজেকে লুপ্ত করে দিতে চান; কিন্তু আসল ঘটনা মোটেই সে-রকম নয়। তিনি আছেন বলেই ঈশ্বর আছেন। এই প্রসঙ্গটা ভিন্নভাবে এসেছিল আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনে, যার বিবরণ ১৯৩০ সালের The New York Times-এ প্রকাশিত হয়। মানুষ না থাকলে সৌন্দর্যের ধারণাও থাকবে না, এ ছিল রবীন্দ্রনাথের মত। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তখন জিজ্ঞাসা করেন, কিন্তু সত্যের ধারণা? সত্যও কি অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে মানুষ না থাকলে? রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ঠিক তাই, সত্যও ব্যক্তির ধারণার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। কথাটা দাঁড়ায় এই যে, মানুষ না থাকলে জগতে সৌন্দর্য তো নেই-ই, সত্যও নেই। অথচ রবীন্দ্রনাথ যে ব্যক্তিকে অত্যন্ত বড় করে তুলেছেন তাও তো নয়।

রবীন্দ্রনাথের নিজের করা তর্জমাতেও মূল রবীন্দ্রনাথকে পাওয়ার উপায় নেই এটা ঠিক; কিন্তু যা পাওয়া গেছে তা একেবারেই মৌলিক। সেখানে ছন্দ নেই ঠিকই, কিন্তু সুর আছে, রয়েছে ছন্দস্পন্দন, কবির অনুভূতিকে যা সাহায্য করে পাঠকের কাছে পৌঁছে যেতে, বুদ্ধিগ্রাহ্য অর্থপ্রাপ্তির আগেই। বৈচিত্র্য আছে বিভিন্ন ভাবের। ঈশ্বরকে তিনি নানাভাবে পেয়েছেন, বাংলায় যাকে জীবনদেবতা বলেছেন তিনিও আছেন, ভেতরে নয়, বাইরে। ওদিকে যা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত তাকেও সর্বজনীন করে তুলেছেন। ঈশ্বর কখনো নয়নসম্মুখে, কখনো দূরে। নারীর কোমলতা ও নিবেদন পাওয়া যাবে তাঁর আত্মনিবেদনে। সেইসঙ্গে বজ্রও শোনা যায় বাঁশিতে। নিজের ভেতরে থাকতে চান, বাইরে গিয়ে দাঁড়াবেন ইচ্ছা করেন, ঈপ্সিতকে পেতে চান নিখিলের মাঝে, পেতে চান আকাশকে, আবার নত হতে চান চরণধুলার তলে। আছে তাঁর নিরুদ্দেশ যাত্রা, যেমন রয়েছে হাটের ভেতর বেচাকেনার অভিজ্ঞতা। কবিতাগুলো ঈশ্বরবিষয়ক নয়, ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কবিষয়ক,               যে-সম্পর্ক বদলে যায় অবস্থা ও অবস্থানের কারণে। ভিক্ষা, অহংকার, ভীতি, স্মিত হাসি, স্পর্শ, ছেলেখেলা – সবকিছুই আছে, রয়েছে জগতের সৌন্দর্য ও ঔজ্জ্বল্যের প্রতি অতিনিবিড় আকর্ষণ।

‘আমার মাথা নত করে দাও তোমার চরণধুলার তলে’, এমন পঙ্ক্তি বাংলাতেও খুব তৃপ্তিদায়ক নয়, ইংরেজিতে তার রূপ: ‘My heart has touched thy feet’-কে চমৎকার ধারণা বলে মনে হওয়ার কথা নয়; কিন্তু ইংরেজিতে বহু পঙ্ক্তি আছে যেগুলো পড়লে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা ইউরোপের বিরূপ মৃত্তিকায় কেন প্রাণের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক।

1. Mother, I shall weave a chain of pearls to thy neck with tears […] But this my sorrow is absolutely my own.

2. I will deck thee with trophies, garlands of my defeat. It is never in my power to escape unconquered.

3. In this playhouse of infinite forms here have I caught the sight of him that is formless.

4. The joy that sits still on the open lotus of pain, and the joy that throws everything it has upon the dust, and knows not a word.

5. With the tune of thee and me all the air is vibrant and all ages pass with the hiding and seeking of thee and me.

6. Thou art the Brother amongst my brothers, but I heed them not, I divide not my earnings with them, thus sharing.

7. O thou lord of heavens, where would be thy love if I were not?

তর্জমাতেও তাঁর অনেক উক্তি রবীন্দ্রনাথের মতোই। যেমন, ‘the horizon is fiercely naked’, ‘perfume of promises’, ‘glad humiliation’, ‘dim delight’, ‘fearful joy’, ‘life-throb of ages dancing in my blood’, ‘we are too poor to be late.’

তবুও মূল বাংলা কবিতার যে-আবেদন তা রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও যে ইংরেজিতে রূপান্তরিত করা ছিল অসম্ভব সেটা সত্য। কয়েকটি দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক।

‘জীবন যখন শুকায়ে যায় তৃষ্ণাধারায় এসো’কে করা হয়েছে

When the heart is hard and parched,

Come upon me with a shower of mercy.

মূলের তুলনায় এ তর্জমা সামান্য। পাঠকের তৃষ্ণা মিটবে না, বিশেষ করে মূলের সঙ্গে যদি তাঁর পরিচয় থাকে। বাংলাতে                 অল্প কথায় যা বলা হয়েছে তর্জমায় তাকে বর্ধিত করা হয়েছে। সহজ-সরল ‘শুকায়ে যায়’কে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করতে হয়েছে ‘hard and parched up’, তবু ঠিক বোঝানো যায় নি। ‘শুকায়ে যায়’ অনেক বেশি স্পষ্ট, সন্দেহ কী। ‘তৃষ্ণাধারা’কে ‘shower of mercy’ ছাড়া কী-ই বা করা যেত; কিন্তু ‘shower of mercy কি ‘তৃষ্ণাধারা’র জন্য আকুতিকে বোঝানোর জন্য যথেষ্ট?

‘সকল মাধুরী লুকায়ে যায়/ সংগীত সুধা রসে এসো’, রূপ নিয়েছে : ‘When grace is lost from life, come with a burst of song’. মাধুরী একেবারেই বাঙালির খাঁটি বস্ত্ত, তাকে grace করলে মাধুর্য কিছুটা হলেও যে লুকিয়ে পড়বে তাতে সন্দেহ কী? কিন্তু সে-অনিবার্যতাকে মেনে না নিয়ে উপায় ছিল না রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও। আবার

কর্ম যখন প্রবল আকারে

গর্জি উঠিয়া ঢাকে চারিধার

হৃদয়প্রান্তে হে নীরবনাথ

শান্তচরণে এসো

এর তর্জমা যতদূর এগোতে পারতো ততো দূরই এগিয়েছে।

When the tumultuous work raises its din on all sides shutting me out from beyond, come to me, my lord of silence, with peace and rest.

ইংরেজিতে ‘to me’ যোগ করতে হয়েছে; শান্তচরণে রূপান্তরিত হয়েছে ‘with peace and rest’-এ। কিন্তু বাংলায় যে স্বাদ পাওয়া যাবে ইংরেজিতে তার ঘাটতি আছে; ‘গর্জে ওঠা’ স্তিমিত, ‘শান্তচরণে’র ধ্বনিটুকুও নেই, এবং ‘হৃদয়প্রান্ত’ একেবারেই অনুপস্থিত।

এরকম উদাহরণের অভাব নেই গীতাঞ্জলির ইংরেজি উপস্থাপনায়।

ক. বাংলায় ছিল

দীর্ঘকাল অনাবৃষ্টি, অতিদীর্ঘকাল,

হে ইন্দ্র, হৃদয়ে মম। দিকচক্রবাল

ভয়ংকর শূন্য হেরি, নাই কোনখানে

সরস সজল রেখা – কেহ নাহি আনে

নববারিবর্ষণের শ্যামল সংবাদ।

ইংরেজিতে –

The rain has been held back for days and days, my God, in my arid heart. The horizon fiercely naked – not the thinnest cover of a soft cloud, not the vaguest hint of a cool shower,

এখানে সবচেয়ে মর্মান্তিক হচ্ছে ‘শ্যামলে’র অন্তর্ধান। একই কবিতায় বংলায় পড়ি

সংহারো সংহারো, প্রভো, নিস্তব্ধ প্রখর

এই রুদ্র, এই ব্যাপ্ত, এ নিঃশব্দ দাহ

নিঃসহ নৈরাশ্যতাপ। চাহো নাথ, চাহো

জননী যেমন চাহে সজল নয়নে

পিতার ক্রোধের দিনে সন্তানের পানে।

পড়লে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারা যায় মূল বাংলা কবিতাটি কত সমৃদ্ধ, এবং তাকে ইংরেজি ভাষায় উপস্থিত করাটা কেন প্রায় অসম্ভব। বাংলা কবিতাটিতে পিতার ক্রোধের দিনে সন্তানকে বাঁচানোর জন্য বাঙালি মাতার যে সকল আকুতি সেটাও যে ভাষান্তরে ফুটে উঠেছে এমনটা দাবি করার উপায় নেই।

ধরা যাক না কেন, আমাদের সকলেরই বিশেষভাবে পরিচিত সেই কবিতাটির তর্জমার দৃষ্টান্ত। ‘নৈবেদ্যে’র কবিতাটি – ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’ – ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে যে রূপ পেয়েছে সেটি এরকমের :

৫.   Deliverance is not for me in renunciation. I feel the embrace of freedom in a thousand bond of delight, thou ever pourest for me the fresh draught of wine of various colours and fragrance, filling the earthen vessel to the brim. My world will light its hundred different lamps with the flame and place them by the altar of thy temple.

No, I will never shut the doors of my senses, the delights of sight and hearing and touch will bear thy delight.

Yes, all my illusions will burn with illumination of joy and my desires ripen into the fruits of love.

মূল কবিতার ‘অমৃত’কে কি ‘wine’ দিয়ে বোঝানো যাবে, ‘a thousand’ কি ‘অসংখ্য’র জন্য পর্যাপ্ত? ‘জ্বলিয়া’র ভেতর যে-তেজ রয়েছে তা কি ‘burn into illumination’ বহন করতে সমর্থ! ‘ripen into fruits’-এর চেয়ে ‘রহিবে ফলিয়া’ কি অধিক দৃশ্যমান নয়?

মূলের সঙ্গে তর্জমাকে মিলিয়ে পড়ার লোভ সংবরণ করা সহজ নয়, তাই আরো কিছু দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। মূলে আছে :

৬. ক.  চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির

জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর

আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী

বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,

যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে

উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে

দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়

অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়

এর পাশে যখন ইংরেজি পড়ি তখন মূলটি জানা থাকায় পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাই না। বাংলা পাঠ না-জানা পাঠকের জন্য অবশ্য এটা একটা সুবিধা যে মিলিয়ে পড়ার সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত। ইংরেজিতে আছে :

Where the mind is without fear and the head is high; where knowledge is free, where the world has not been broken into fragments by narrow domestic walls, where words come out from the depth of truth; where tireless striving stretches its arms towards perfections;

অন্য পঙ্ক্তিগুলোও মিলিয়ে পড়া যাক :

খ.       যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালি রাশি

বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,

পৌরুষেরে করে নি শতধা; নিত্য যেথা

তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা –

নিজহস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ

ভারতরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।

ইংরেজিতে –

Where the clear stream of reason has not lost its way into the dreary desert of dead habit; where the mind is led forward by thee into ever-widening thought and action – Into that heaven of freedom, my father, let my country awake.

বাংলায় –

গ.   জগতের আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ

ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন

ইংরেজিতে –

I have found my invitation to this world’s festival and thus my life has been blessed.

বাংলায় –

ঘ.   তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার

বাজাই আমি বাঁশি

গানে গানে গেঁথে বেড়াই

প্রাণের কানণাহাসি

ইংরেজিতে –

It was my part at this feast to play upon my instrument, and I have done all I could.

বাংলায় –

ঙ.   এখন সময় হয়েছে কি

সভায় গিয়ে তোমায় দেখি

জয়ধ্বনি শুনিয়ে যাব

এ মোর নিবেদন

ইংরেজিতে –

Now, I ask, has the time come at last when I may go in and see thy face and offer my silent salutation.

অন্যত্র, বাংলায় –

ক.   একটি নমস্কারে প্রভু

একটি নমস্কারে

সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক

তোমার এ সংসারে

ইংরেজিতে –

In one salutation to thee, my God, let all my senses spread out and touch this world at they feet.

বাংলায় –

খ.   ঘনশ্রাবণ মেঘের মতো

রসের ভারে নম্র যত

একটি নমস্কারে প্রভু

একটি নমস্কারে

ইংরেজিতে –

Like a rain-cloud of July hung low with its burden of unshed showers let all my mind down at thy door in one salutation to thee

বাংলায় –

গ.   নানা সুরের আকুল ধারা

মিলিয়ে দিয়ে আত্মপরা

একটি নমস্কারে, প্রভু

একটি নমস্কারে

সমস্ত গান সমাপ্ত হোক

নীরব পারাবারে

ইংরেজিতে –

Let all the songs gather together their diverse strains into a single current and flow to a silence in one salutation to thee

বাংলায় –

ঘ.   হংসগুলো যেমন মানসযাত্রী

তেমনি সারা দিবসরাত্রি

একটি নমস্কারে প্রভু,

একটি নমস্কারে

সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক

মহামরণ-পারে

ইংরেজিতে –

Like a flock of homesick cranes flying night and day back to their moutain nests let all my life take its voyage to its eternal home in one salutation to thee.

মোট কথা, সেই পুরনো সত্যকেই স্মরণ করতে হয় যে, কবিতার যথার্থ অনুবাদ সম্ভব নয়। ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে রবীন্দ্রনাথের যে তর্জমা তা অন্য কেউ করলে ভিন্নতর হতো; তিনি তাঁর নিজস্ব সৃষ্টিকে নিয়ে খেলা করার স্বাধীনতা, তাঁর অসামান্য কল্পনাশক্তি, ছন্দস্পন্দনের বোধ এবং শব্দের জ্ঞান ও কানকে (ইংরেজি ভাষার হলেও) ব্যবহার করে গীতাঞ্জলির কবিতাগুলো অতুলনীয় করে তুলেছিলেন, যা পড়ে যাঁরা বাংলা জানেন না তাঁরাও মুগ্ধ হয়েছেন – এসবই সত্য। কিন্তু শিক্ষিত বাঙালি পাঠকের এদের যে আবেদন তা ভিন্নভাষীর পক্ষে লাভ করা সম্ভব নয়, তা তিনি যতই সংবেদনশীল হোন না কেন।

পাঁচ

কিন্তু ইংরেজি তর্জমা পড়েই তো অসংখ্য পাঠক অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন। নোবেল পুরস্কার প্রদানপত্রে সেই আনন্দের সংবাদ রয়েছে। প্রদানকারীরা অবশ্য কয়েকটি ভ্রমের মধ্যেও ছিলেন, সে-সকল ভ্রম কোনো ব্যক্তির নয়, আত্মগরিমায় উদ্বুদ্ধ ইউরোপেরই। ভ্রান্তিগুলোর দিকে তাকানো যাক। শুরুতেই বলা হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন একজন Anglo-Indian Poet। কী করে বা কোন অর্থে বললেন বোঝা গেল না। রবীন্দ্রনাথ যে সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় সে-বিষয়ে ভ্রান্তিকে কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। উক্তিটি তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান দাবি করে। তারপরেই বলা হচ্ছে যে, [যেটা আগেও উল্লেখ করেছি] তাঁর রচনা in a full sense […] has belonged to English literature. এটি যে সত্য নয় তাও তো কমিটির পক্ষে অজানা থাকার কথা নয়, তিনি তাঁর কিছু রচনা (গীতাঞ্জলিসহ) ইংরেজিতে তর্জমা করেছেন বটে কিন্তু তিনি নিজেকে কখনই ইংরেজি সাহিত্যিকদের একজন বলে ভাবেন নি। ইংরেজরাও এ ব্যাপারে ভীষণ রক্ষণশীল। এক জোসেফ কনরাড এবং হালের ডি এস নাইপল ও সালমান রুশদী ব্যতীত অন্য কোনো ভিন্নভাষী লেখককে মূল ধারার ইংরেজ লেখক বলে স্বীকার করে নিতে তাদের গভীর অনীহা। তারপরে অবশ্য বলা হয়েছে যে, তিনি বাংলা ভাষাতে কবিতা লিখেছেন, কিন্তু সেখানেও ভ্রান্তিবশত উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাঁর যে অর্জন তা সম্ভব হয়েছে এই কারণে যে ভারতে ‘a never-failing […] expansion of British civilization ever since the days of Queen Elezabeth’ প্রবহমান ছিল। কূপমন্ডূকতার কী অসাধারণ দৃষ্টান্ত। প্রদানপত্রে আরো পরের দিকে ভারতবর্ষের পুনর্জাগরণে খ্রিষ্টান মিশনারিদের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। উইলিয়াম কেরির প্রসঙ্গও এসেছে। বলা হয়েছে :

It was in Bengal, the oldest Anglo-Indian province and the scene many years before of the indefatigable labours of the missionary pioneer, Carey, to promote the Christian religion and to improve the vernacular language, that Rabindranath Tagore was born in 1861.

রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা বলা হয়েছে। ব্রাহ্ম সমাজে তাঁদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিও জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে যে, এটি হিন্দু ধর্মসম্প্রদায় থেকে কিছু স্বতন্ত্র। বরঞ্চ এটি was founded […] by an enlightened and influential man who had been impressed by the doctrine of Christianity, which he had studied also in England.

এই বিশিষ্ট ব্যক্তিটি যে রামমোহন রায় এটা বোঝা গেল, কিন্তু রামমোহন যে ইংল্যান্ডে গিয়ে খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা করে ওই ধর্মমতের প্রভাবে পড়েছিলেন এবং সেজন্যই ব্রাহ্মমত প্রচারে উৎসাহী হয়েছিলেন, এই ধারণাটি কেবল মিথ্যা নয় কৌতুককরও বইকি। রামমোহন তো ইংল্যান্ডে থেকে ফিরে এসে তবে ব্রাহ্ম হন নি, ব্রাহ্ম হওয়ার পরেই ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন।

কমিটির এমনও ধারণা হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত প্রথার অনুসরণে ধ্যানী সন্ন্যাসীর জীবনযাপনের অভিপ্রায়ে ‘পবিত্র গঙ্গা নদীর’ একটি শাখায় নৌকায় কিছুকাল বসবাস করেছেন। রবীন্দ্রনাথ পদ্মায় বোটে থেকেছেন ঠিকই, কিন্তু সেটা তো ধ্যানের জন্য নয়, তখন তিনি পারিবারিক জমিদারি দেখাশোনার গুরুতর দায়িত্বভার বহন করছিলেন। নোবেল কমিটির হয়তো জানা ছিল না, যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের মতো করে গড়ে তোলা একটি ধর্মধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন, যার প্রতিফলন গীতাঞ্জলির গানগুলোতে রয়েছে; তদুপরি তিনি ছিলেন পরিপূর্ণরূপে ইহজাগতিক, বিজ্ঞানমনস্ক এবং বৈষয়িক কর্মে অত্যন্ত দক্ষ। রবীন্দ্রনাথ কৃষি ব্যাংক গঠন করেছেন, কৃষির আধুনিকায়নের ব্যাপারে সচেষ্ট থেকেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, কৃষকদের সমবায়ী ব্যবস্থায় আসতে উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁর ভাববাদিতা ইহজাগতিকতার প্রতিপক্ষ ছিল না, ছিল মিত্রপক্ষ। কমিটি এমনও ভেবেছে যে, ভারতবর্ষের সংস্কৃতি আরণ্যক, এবং রবীন্দ্রনাথ সেই সংস্কৃতির একজন মুখপাত্র।

এসব ভ্রান্তি ছিল; তবে কমিটি রবীন্দ্রনাথের কবিতার যে বিশেষ গুণ সেটা চিনতে ভুল করে নি, করলে তাঁকে ওইভাবে সম্মানিত করতে পারতো না। তাঁর কবিতায় শব্দ-নির্বাচন, রচনারীতিতে কোমল ও কঠোরের সমন্বয়, রচনায় কালজয়ী রুচির প্রকাশ – প্রদানপত্রে এসবের উল্লেখ অত্যন্ত যথার্থভাবে ঘটেছে। প্রেমের আনন্দ ও বেদনার যে বৈচিত্র্য এবং উন্নততর একটি জগতের যে চকিত আভাস গীতাঞ্জলিতে রয়েছে তাও লক্ষ করা হয়েছে। আরো যা বলা হয়েছে সেগুলো এ রকমের :

ক. সাহিত্যের ইতিহাসে সুর ও রঙের এমন বৈচিত্র্য কমই দেখা যায়। অনন্তের জন্য আত্মার আকুতি থেকে শুরু করে শিশুর খেলার আনন্দকৌতুক পর্যন্ত প্রত্যেকটি অনুভূতিকে সমানভাবে সুরেলা ও সুন্দর করে উপস্থিত করার এমন দৃষ্টান্ত সত্যি সত্যি বিরল।

খ. রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে বিশ্বাস ও চিন্তার ভেতর সত্যিকার সম্পর্ক খুঁজে বের করতে চেয়েছেন তার ফলে তিনি কবি হিসাবে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছেন; তাঁর রচনাতে আছে চিন্তার গভীরতা, এবং তার চেয়েও যা উল্লেখযোগ্য তা হলো অনুভূতির উষ্ণতা ও কাব্যিক ভাষার চাঞ্চল্যকর ক্ষমতা।

গ. তিনি দূরবর্তী কিন্তু আবার সর্বজনীন। তিনি দেখিয়েছেন ক্ষণস্থায়ী কি ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় অনন্তকালীনে।

ঘ. পরস্পর থেকে অত্যন্ত দূরবর্তী সভ্যতার দুটি ক্ষেত্রের (অর্থাৎ পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের) ভেতর সমন্বয় স্থাপনে তিনি সচেষ্ট। দুই সভ্যতার ওই দূরত্বটাই হচ্ছে এ যুগের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, এবং এদেরকে সমন্বিত করাই হলো প্রধান কাজ এবং সমস্যা। যে ব্যস্ততা ও ছোটাছুটির জন্য আমরা দুর্বল হয়ে পড়ছি তার বিপরীতে তিনি এমন একটি সংস্কৃতির সন্ধান দেন যেটি বিপুল, শান্তিপূর্ণ, এবং যার পক্ষে ভারতবর্ষের অরণ্যকে ধারণ করে নিজের পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হয়েছে।

ঙ. তাঁর কিছু ছোটগল্প ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে, অনুবাদ তাঁর নিজের নয়, অন্যের করা, তবু সেগুলো পড়লে বোঝা যায় তিনি কেমন বহুমুখী, তাঁর পর্যবেক্ষণের এলাকা কতটা বিস্তৃত, বিভিন্ন ধরনের মানুষের ভাষা ও অভিজ্ঞতার প্রতি তাঁর হৃদয়ের সহানুভূতি কত গভীর, এবং গল্পের কাঠামো তৈরি ও বর্ণনায় তিনি কেমন সুদক্ষ।

উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভিন্ন ভাষায় তাঁর কবিতাকে উপস্থিত করা অত্যন্ত কঠিন, তবু তাঁর রচনার আবেদন অত্যন্ত গভীর। তাঁর রচনার গুরুত্ব ও প্রভাবের মূল্যায়ন ইতিহাসে অনিসন্ধিৎসু ভবিষ্যতের মানুষেরা আরো ভালো করতে পারবেন, এবং এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে তাঁরা এখনকার অনেকের তুলনায় তাঁকে উচ্চতর স্থান দিতে চাইবেন।

এই সংবর্ধনাতে নিজের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা অবশ্য রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সম্ভব হয় নি; পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন না, এমন কি জানতেনও না যে, তাঁকে পুরস্কৃত করা হবে। খবরটা তাঁর কাছে পৌঁছায় প্রকাশকের মাধ্যমে। প্রকাশক টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের ঠিকানায়। শান্তিনিকেতনে তখন টেলিফোন ছিল না, কাজেই বোলপুরের পোস্ট অফিস থেকে তাঁকে টেলিফোনে জানানো সম্ভব হয় নি। ঘটনার দিন ১৩ নভেম্বর ১৯১৩, ছাত্রদের নিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে রবীন্দ্রনাথ বেড়াতে বের হয়েছিলেন, পথিমধ্যে ছিল পোস্ট অফিস, সেখান থেকে একজন কর্মচারী দৌড়ে এসে তাঁকে টেলিগ্রামটি দেন। পরে পড়বেন ভেবে সেটা তিনি রেখে দিচ্ছিলেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন একজন ইংরেজ অভ্যাগত, এডওয়ার্ড থমসন। যিনি আভাস পেয়েছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, ওই ভদ্রলোক বলেন যে, টেলিগ্রামটিতে জরুরি বার্তা থাকতে পারে। রবীন্দ্রনাথ সেটি পড়ে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেন নি। ছাত্ররা শুনে উল্লাসে ফেটে পড়ে, এবং সমগ্র শান্তিনিকেতনজুড়ে উৎসব শুরু হয়ে যায়।

আনুষ্ঠানিক ভোজসভাতেও তিনি উপস্থিত হতে পারেন নি। আমন্ত্রণের জবাবে তিনি টেলিগ্রাম করে বলেছিলেন, ‘যে-সহমর্মিতার বিস্তার দূরকে নিকটে নিয়ে এসেছে এবং একজন অপরিচিতকে ভ্রাতায় পরিণত করেছে তার জন্য সুইডিশ একাডেমীকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।’ ১৯১৪ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট হাউসে সুইডিশ অ্যাকাডেমির পক্ষে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে তখনকার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কারের সনদ ও মেডেল রবীন্দ্রনাথকে অর্পণ করেন।

রবীন্দ্রনাথ সুইডেনে যান ১৯২১ সালে, সাত বছর পরে এবং স্টকহোমে প্রদানপত্রের জবাবে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, কীভাবে টেলিগ্রামে তিনি বার্তাটি পেয়েছিলেন। ছাত্রদের আনন্দ ও গর্ব দেখে তাঁর হৃদয় ভরে গিয়েছিল, এবং তিনি অনুভব করেছিলেন, যে-সম্মান তাঁকে দেওয়া হয়েছে তাতে তাঁর দেশবাসী অংশগ্রহণ করবে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, যখন তাঁর বয়স পঁচিশ তখন গঙ্গা নদীতে বাংলার এক অপরিচিত গ্রামে নৌকাকে গৃহে পরিণত করে একান্তে জীবনযাপন করেছেন। তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছিল শরৎকালে হিমালয় থেকে উড়ে-আসা পাখি। আকাশের সূর্য, পাখির কলকাকলি, নদীর ধ্বনিতে জীবন ছিল স্বপ্নের মতো। সেখান থেকে তিনি তাঁর রচনা কলকাতায় পাঠাতেন। এক সময়ে মনে হলো খুব হয়েছে, এবার নির্জনতার ওই জগৎ থেকে বের হয়ে এবং মানুষের জন্য কিছু করা আবশ্যক, যার মধ্য দিয়ে হয়তো তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পারবেন, জীবনের সমস্যা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করাও সম্ভব হবে, এবং নির্দিষ্ট কাজের মধ্য নিয়োজিত হয়ে মানুষের উপকারও করা যাবে। একটি চিন্তা তাঁর মধ্যে সব সময়েই ছিল সেটা হলো শিশুদের জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এই শিক্ষাটা হবে আনন্দ এবং স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে, যার জন্য আবশ্যক হবে প্রকৃতির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ। এ উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি শান্তিনিকেতনে একটি স্কুল গড়ে তোলেন।

আর যা বলেছেন সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ তা এরকম দাঁড়ায় :

আমি কবিতা লিখতাম, মধ্যরাতের তারকালোকিত আকাশের নীচে বসে গানের মতো করে সেগুলো গাইতাম। লিখতাম প্রত্যুষে, লিখতাম প্রদোষের আলোতে। এক সময়ে মনে হলো বৃহৎ যে পৃথিবী বাইরে অপেক্ষা করছে সেখানেও আমার যাওয়া প্রয়োজন, পশ্চিমের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা চাই। কারণ এটা আমি বুঝেছিলাম যে শক্তির অতিপ্রাচুর্য নিয়ে পশ্চিমের যে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে এ যুগ তারই করতলগত।

তাই আমি বের হয়ে এলাম। গীতাঞ্জলিতে সংকলিত আমার বাংলা কবিতাগুলো ইংরেজীতে অনুবাদ করেছিলাম। তার পান্ডুলিপিটি ছিল সঙ্গে, ধারণা ছিল না যে সেটি প্রকাশ করবো, কেননা ইংরেজী ভাষার ওপর আমার দখল নিয়ে নিজের ভেতর সন্দেহ ছিল। কিন্তু দেখা গেল পান্ডুলিপি থেকে পাঠ শুনে ব্রিটিশ শ্রোতারা কবিতাগুলো পছন্দ করলেন। আমি গৃহীত হলাম; বিলম্ব না-করে পশ্চিম আমার জন্য তার হৃদয় উন্মুক্ত করে দিল।

যে আমি পঞ্চাশ বছর ধরে পশ্চিম থেকে অনেক দূরে বসবাস করেছি তাকে সে যে প্রায় মুহূর্তের মধ্যে গ্রহণ করে নেবে সেটা ছিল এক পরম বিস্ময়। মনে হয় গঙ্গাতীরের পরিপূর্ণ নিঃসঙ্গতার কাছ থেকে যে অবকাশ, সমাহিতচিত্ততা এবং অনন্তকে অনুভব করবার শিক্ষা আমি নিয়ে এসেছি পশ্চিমের জন্য তা প্রয়োজন ছিল।

আমাকে দেয়া এই পুরস্কার কেবল একজন ব্যক্তিকে নয়, আসলে প্রাচ্যকেই দেওয়া। প্রাচ্য কী আত্মিক মানবতার মাতা নয়? সংকটের মুহূর্তে পাশ্চাত্য কী মাতৃরূপী এই প্রাচ্যের দিকে তাকায় না? সৌভাগ্য আমার, আমি সেই মুহূর্তেই এসে হাজির হয়েছি পাশ্চাত্য যখন প্রাচ্যের দিকে তার নিজের প্রয়োজনে ফিরে তাকিয়েছে, এবং আমি যেহেতু প্রাচ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছি তাই পশ্চিমের বন্ধুদের কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছি।

আপনাদের আমি আশ্বস্ত করতে পারি যে আপনাদের দেওয়া পুরস্কার আমার নিজের জন্য ব্যয়িত হবে না। ব্যক্তি হিসেবে এটি গ্রহণ করার অধিকার আমি রাখি না, তাই একে আমি ব্যবহার করেছি আমাদের প্রাচ্যদেশীয় শিশু ও ছাত্রদের প্রয়োজনে। সম্প্রতি আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি, যার কাজে এ অর্থ ব্যবহৃত হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ্চাত্যের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাচ্যদেশীয় ভাইদের সঙ্গে মিলিত হয়ে শত শত বছর ধরে যে-ঐশ্বর্য প্রাচ্যে লুকিয়ে আছে তার সন্ধানে একত্র কাজ করতে পারবে, এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রাচ্যের আত্মিক সম্পদকে ব্যবহার করার পথ খুঁজে বের করবে।

আমি অনুভব করি যে, আমরা প্রাচ্যদেশীয়রা আজ যে-বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছি সেটা হলো এই যে অবজ্ঞার ও দূরবর্তিতার; পৃথিবীর মানুষকে আতিথেয়তা দেবার এবং পৃথিবীকে আমাদের যা কিছু দেবার আছে তা দিতে ব্যর্থতার। এক শতাব্দীর অধিককাল পাশ্চাত্যের বস্ত্ততান্ত্রিক ও শিক্ষাগত আধিপত্যের অধীনে থেকে নিজেদের সভ্যতার ওপর আমরা আস্থা হারিয়ে ফেলি কিন্তু এখন সময় এসেছে আমাদের ভেতর যা কিছু ভালো আছে তাকে বিকশিত করার। অন্যদের কাছে আমরা আর আমাদের দারিদ্র্য উন্মোচিত করতে চাই না। আর সেই সংকল্প থেকেই আমি একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ হই যেখানে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের শিক্ষার্থীরা একত্র হতে এবং আধ্যাত্মিক আহার ভাগাভাগি করে নিতে পারে।

তাই আমি একথা বলতে গর্ব অনুভব করি যে, আপনাদের প্রদত্ত পুরস্কার আমাকে ওই কাজে সাহায্য করবে। আজ আমি আপনাদের সামনে আবারো এসে হাজির হয়েছি দূর প্রাচ্যে যে ভোজের আয়োজন অপেক্ষা করছে তাতে আপনাদেরকে আমন্ত্রণ জানাবার জন্য। আমার আশা এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যাত হবে না। পাশ্চাত্যের আজ প্রাচ্যকে প্রয়োজন ঠিক যেভাবে প্রাচ্যের প্রয়োজন পাশ্চাত্যকে। সময় এসেছে তাদের মিলনের। আমি আনন্দিত যে আমি এই মহৎ সময়ের, মহৎ যুগের মানুষ এবং পূর্ব ও পশ্চিম যখন কাছাকাছি চলে আসছে তখন তার প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছুটা কাজ করতে পেরেছি।

লক্ষ করার বিষয় এটি যে, তাঁর বক্তৃতায় তিনি অর্থনীতি ও রাজনীতিকে গুরুত্ব দেন নি। বরঞ্চ রাজনীতি সম্পর্কে এমনটা বলেছেন যে, রাজনৈতিক ঐক্য হবে অগভীর, প্রকৃত ঐক্যের হওয়া চাই আতিমক। তিনি বলেছেন, মানুষের কাজ যুদ্ধ করা নয়, শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। কেননা ‘We are not like fighting beasts’. অথচ কথাগুলো তিনি ইউরোপের উদ্দেশে বলছিলেন ১৯২১ সালে, যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে। সে-যুদ্ধের চরিত্রটি ছিল সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক। ওদিকে ভারতবর্ষে ১৯১৯-এ জালিয়ানওয়ালাবাগে নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটে গেছে, যার প্রতিবাদে ওই বছরই তিনি তাঁর ব্রিটিশ-প্রদত্ত স্যার উপাধি পরিত্যাগ করেছেন। কেবল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও রবীন্দ্রনাথকে দেখে যেতে হয়েছে। সূচনাটা দেখেছেন, সমাপ্তিটা দেখতে হয় নি। যা দেখেছেন তা-ই যথেষ্ট ছিল তাঁর জন্য, মানুষ পরস্পরের প্রতি কতটা নৃশংস হতে পারে সে অভিজ্ঞতা তাঁকে লাভ করতে হয়েছে।

যে সমঝোতা, মিলন, শান্তি ও সহযোগিতার কথা তিনি তাঁর লেখাতে বলেছেন, নোবেল পুরস্কার প্রদানপত্রের জবাবে যা বলেছেন তার মূল্য সাময়িকভাবে হলেও হারিয়ে গেছে। সভ্যতার মিলন নয়, সংকটই প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। পশ্চিমের ওপর আস্থা রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি, তাকিয়েছেন তিনি পূর্বের দিকেই। ১৯৪১ সালে তাঁর শেষ জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে, মৃত্যুর অল্পকিছুদিন আগে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে তিনি সে-কথাই বলে গেছেন। কথাগুলো সুপরিচিত, তবু কিছু অংশ পুনর্স্মরণযোগ্য।

দেখা গেল য়ুরোপের বর্বরতা কি রকম নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত। […] জীবনের প্রথম আরম্ভে সমগ্র মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে-বিশ্বাস একেবারে দেউলে হয়ে গেল। আজ আশা করছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে, অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা সে শোনাবে পূর্ব দিগন্ত থেকে। […] মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব, মহাপ্রলয়ের পর বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মকাল হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের থেকে।

মৃত্যুর তিন মাস আগে এই ছিল রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি। জীবিত থাকলে সভ্যতার আরো মর্মান্তিক বিরোধ প্রত্যক্ষ করা তাঁর জন্য অবধারিত ছিল।

ছয়

ইয়েটসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কটি কৌতূহলোদ্দীপক। ইয়েটস রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজি গীতাঞ্জলি প্রকাশে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর লেখা ভূমিকাটি বইটির প্রচারে সহায়ক হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ১৯৩১ সালে সপ্তদশ জন্মদিবস উপলক্ষে Golden Book of Tagore-এর জন্য তাঁকে লিখতে অনুরোধ করা হয়েছিল, তিনি সম্মত হয়েছিলেন, কিন্তু ব্যস্ততার জন্য লিখে উঠতে পারেন নি।  সে-সময়ে রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেছিলেন –

জীবনের গ্রন্থি, যা জটিল, তা থেকে যখনই নিজেকে আমি আলাদা করি তখনই জীবন আমার কাছে এশীয় রূপ নিয়েছে। এই রূপ আমি প্রথম দেখতে পাই আপনার রচনায়। কতগুলো চীনা কবিতায় ও জাপানী লেখকদের গদ্য রচনায়।

আপনার কবিতা প্রথম যখন পড়ি তখন কী উদ্দীপনাই না অনুভব করেছিলাম, মনে হয়েছিল এরা যেন মাঠ আর নদী থেকে বেরিয়ে এসেছে তাদের অপরিবর্তনীয় সুষমা নিয়ে।

কিন্তু এর চার বছর পরে ১৯৩৬-এ রদেনস্টাইনকে লেখা এক চিঠিতে তিনি যা বলেছিলেন তা যেমন অন্যায় তেমনি বিস্ময়কর। কথাগুলোর বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায় :

জাহান্নামে যান রবীন্দ্রনাথ। একসময়ে স্টার্জ মুর আর আমি মিলে তাঁর তিনটি বই বের করেছিলাম, তার পর তিনি বড় কবি হওয়ার চেয়ে ইংরেজী ভাষাটা জানাটাকে বড় বলে বিবেচনা করলেন। রবীন্দ্রনাথ ইংরেজী জানেন না, কোনো ভারতীয়ই ইংরেজী জানে না। শৈশবে যে-ভাষা শেখা হয় নি, এবং তখন থেকেই চিন্তার বাহন হিসাবে ব্যবহার করা হয়নি। সে-ভাষায় গীতিময়তা বা স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে কেউ কিছু লিখতে পারেন না।

তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ যেন ইংরেজি ছেড়ে দেন এবং বাংলায় লেখেন। এই উপদেশটি দেওয়াটা ছিল একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক, ঠিক যতটা অবিবেচনার কাজ ছিল রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজি ভাষা আয়ত্তে আনার জন্য ব্যস্ত একজন মানুষ হিসেবে চিত্রিত করা। কাজটা ব্যক্তিগত চিঠিতেই করা হয়েছে এটা ঠিক, কিন্তু এর পেছনে যে মনোভঙ্গিটি কাজ করেছে সেটা তো মিথ্যা নয়।

এমন একটি সম্পূর্ণরূপে অপ্রত্যাশিত পরামর্শ এবং অন্যায় মন্তব্য ইয়েটস কেন করলেন? হঠাৎ কী কোনো বিভ্রমে পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছে, রবীন্দ্রনাথকে তিনি উচ্চমানের কবি হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তা হলে হঠাৎ কেন এমন বিরূপতা ও বিভ্রান্তি? রবীন্দ্রনাথের ধর্মবাদিতা, স্বতঃস্ফূর্ততা, রোমান্টিকতা, তাঁর কাব্যের রহস্যময়তা, ভাষার শিল্পগুণ এবং গভীরকে সরলভাষায় প্রকাশের ক্ষমতার প্রতি যে আকর্ষণ লক্ষ্য একদা যিনি প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়েছিলেন হঠাৎ করে তিনি কেন এতটা বিমুখ হলেন? এটা কী কোনো কারণে আকস্মিক বিরূপতা?

আকস্মিক বিরক্তির সামান্যতার ব্যাপারটাকে একেবারে যে উড়িয়ে দেওয়া যাবে তা নয়। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই একদা রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন; সে-পুরস্কার ইয়েটসও পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বেশ পরে, প্রায় দশ বছর পরে, ১৯২৩ সালে। যতই মহৎ হোন না কেন  ব্যক্তির পক্ষে সম্পূর্ণরূপে ঈর্ষামুক্ত হওয়া যে সম্ভব নয় তাঁর বিরক্তির ভেতর সেটা যদি প্রকাশ পেয়ে থাকে তবে সে-ঘটনাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর ইউরোপ ও আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ যেভাবে প্রশংসিত হয়েছেন সেটাও ইয়েটসের কাছে বাড়াবাড়ি ঠেকতে পারে। আমরা জানি যে যুদ্ধকালীন সময়ে একজন খ্যাতিমান লেখক ডি এইচ লরেন্সও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ‘হইহই’ করাটাকে মেনে নিতে পারেন নি। লরেন্স নিজে একজন বড়মাপের লেখক, তাঁর কালের বস্ত্ততান্ত্রিক সভ্যতার অতিশয় তীব্র সমালোচনা তিনি করেছেন, কিন্তু বর্ণবাদী ইংরেজের মানসিকতার হাত থেকে তাঁর পক্ষেও যে অব্যাহতি লাভ সম্ভব হয় নি তাঁর লেখায় প্রমাণ আছে, এবং রবীন্দ্রনাথের শান্তসমাহিত মনোভাব সেটা তাঁর মোটেই পছন্দ হয় নি। তিনি ব্যক্তি নেতৃত্বে বিশ্বাস করতেন, যেমনটা ইয়েটসও করতেন, রবীন্দ্রনাথ যে তেমন নেতৃত্বের কথা বলেন নি তাও নয়, যে জন্য এক সময়ে তিনি কিছুটা মুসোলিনির প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে ফ্যাসিবাদকে সমর্থনের কোনো প্রবণতা ছিল না। যেমনটা ছিল লরেন্স, ইয়েটস ও এজরা পাউন্ডের মধ্যে। ১৯১৬ সালে তাঁর এক বন্ধু – লেডি ওটোলিন মারলের কাছে লরেন্স মন্তব্য করেছিলেন, ‘this wretched worship-of-Tagore attitude in disgusting.’ তাঁর বক্তব্য এমনও ছিল যে –

The East is marvellously interesting for tracing our steps back. But for going forward, it is nothing. All it hopes for is to be fertilized by Europe, so that it can start on a new phase.

ইয়েটসও অবশ্য পশ্চিমের উর্বরতাদান ক্ষমতার ওপর ওই ধরনের আস্থা রাখতেন না; উপনিষদে তাঁর আগ্রহ শেষ জীবন পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল, এবং স্বামী পুরোহিতানন্দ নামে একজন ভারতীয়কে ইংরেজিতে উপনিষদ অনুবাদ করার কাজে তিনি সাহায্য করেছেন। প্রাচ্যকে তিনি পছন্দ করতেন, কিন্তু আবার ভয়ও করতেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে তিনি একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক দেখতে পেতেন। খ্রিষ্ট ধর্মকে তিনি পছন্দ করতেন না ঠিকই, কিন্তু তাঁর এরকম ধারণা ছিল যে, ইউরোপের যে কৃতি তা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে এশিয়াকে দমন করে তবেই। পাছে ইউরোপের জন্য একটি এশীয় বিপর্যয় এসে উপস্থিত হয় এ নিয়ে তাঁর শঙ্কা ছিল।

বস্ত্তত এখানেই ছিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্যের ভেতর পার্থক্যের মূল সূত্রটি নিহিত। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন সমন্বয়ে, ইয়েটসের আস্থা ছিল দ্বন্দ্বে। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য মিলিত হবে, পরস্পরের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে সমৃদ্ধ হবে মিলনের এই বাণী নিয়েই একদা তিনি সমুপস্থিত হয়েছিলেন, এবং সুবিপুল গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলেন, এবং যদিও তিনি মিলনের সেই ধারণা শেষ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেন নি, তবুও দুয়ের ভেতর দ্বন্দ্বের কথা তিনি বলেন নি। চরমপন্থায় তাঁর আস্থা ছিল না।

ইয়েটস মনে করতেন যে, নিজের সঙ্গে ঝগড়া থেকে জন্ম নেয় কবিতা, এবং অন্যের সঙ্গে ঝগড়া থেকে জন্মায় রেটরিক। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে ঝগড়া নেই তা নয়। তবে সেটা প্রবল নয়; এবং তার রচনায় রেটরিকের অভাব রয়েছে।

কেবল দ্বন্দ্বে আস্থা নয়, ইয়েটস জীবনকে দেখতে চাইতেন ট্র্যাজেডি হিসেবে; রবীন্দ্রনাথের অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত             প্রান্তে। তিনি জানতেন দুঃখ ও বিরোধ আছে, কিন্তু জীবনযাপন তাঁর কাছে ট্র্যাজিক মনে হয় নি। তিনি নাটক লিখেছেন, তাঁর রচনাতে নাটকীয়তার অভাব নেই, কিন্তু তিনি মীমাংসায় বিশ্বাসী। ইয়েটস মনে করতেন যে, জীবনকে ট্র্যাজেডি হিসেবে দেখার মধ্য দিয়েই আমরা বাঁচতে শুরু করি, রবীন্দ্রনাথ সকল সময়েই আস্থা রাখতেন সমাধানে। ওই সমাধানের ব্যাপারটাতে ইয়েটসের আপত্তি ছিল, তিনি এমন মন্তব্য করেছেন যে, প্রাচ্যে সবকিছুর সমাধান আছে, তাই ট্র্যাজেডি কাকে বলে তা সে জানে না। পূর্ণতার জন্য দ্বন্দ্ব ও হিংসা আবশ্যক বলে ইয়েটস ধারণা করতেন। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বদৃষ্টি অনেক প্রকাশের ভেতর একটি প্রকাশ এই রকমের :

এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ইয়েটসের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যটা মৌলিক বইকি।

অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো

সেই তো তোমার ভালো

সকল দ্বন্দ্ব-বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো

সেই তো তোমার ভালো।

রবীন্দ্রনাথ করুণায় বিশ্বাস করতেন, ইয়েটসের আস্থা ছিল দ্বন্দ্ব ও বীরত্বে। একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য।

১৯৩৬ সালে Oxford Book of Modern Verse-এর কবিতা নির্বাচনের জন্য প্রধান কবিদের বিবেচনায় তো নিয়েছেনই, রবীন্দ্রনাথের সাতটি কবিতা ছিল ওই সংকলনে, তিনি অপ্রধান কবিদের তাৎপর্যপূর্ণ কবিতার জন্যও জায়গা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাদ পড়েছেন উইলফ্রেড ওয়েন (১৮৯৩-১৯১৮), যাঁর কথা এ-আলোচনার শুরুর দিকেই আমরা উল্লেখ করেছি। ওয়েনকে বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে হয়েছিল, কারণ যোগদানটা ছিল বাধ্যতামূলক। প্রতিভাবান এই তরুণ মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক পূর্বক্ষণে প্রাণ হারান। ওয়েন তাঁর নিজের কবিতার একটি সংগ্রহ তৈরি করেছিলেন, কিন্তু প্রকাশ করার সুযোগ পান নি। ওয়েনের মৃত্যুর পর তাঁর কবি-বন্ধুরা সেটা প্রকাশ করেন। কবিতাগুলো আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং আধুনিক ইংরেজি কবিতার ইতিহাসে স্থান পেয়েছে, কিন্তু ইয়েটস ওয়েনের কোনো কবিতা তাঁর সংকলনে নেন নি। এতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন, ইয়েটসের বিরূপ সমালোচনাও হয়েছে। ইয়েটস কান দেন নি। আসলে war poets বলে যাঁরা খ্যাত তাঁদের স্বীকৃতিদানে তাঁর আপত্তি ছিল। এঁদের বিষয়ে তাঁর অভিযোগ ছিল দুটি। তাঁর মতে, প্রথমত, এঁদের ভেতর কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বাস ছিল না; দ্বিতীয়ত এঁরা যেভাবে নিষ্ক্রিয় যন্ত্রণাকে কবিতার বিষয়বস্ত্ত করে তুলেছিলেন সেটাও আপত্তিকর। ইয়েটস মনে করেন, সক্রিয় মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে নীরবে রক্তাক্ত হওয়ার পরিবর্তে নিজের যন্ত্রণার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা।

ওয়েন তাঁর কবিতার সংকলনটির জন্য একটি ভূমিকা লিখে রেখে গেছেন, তাতে বলা হয়েছিল, ‘the subject of it is War and the Pity of War’। ওই করুণার ব্যাপারে ইয়েটসের আপত্তি ছিল। সাহিত্যে তিনি করুণা দেখতে চান নি, দেখতে চেয়েছেন বীরত্ব, এবং বীরত্বের প্রতি পক্ষপাতের দরুনই তাঁর ভেতর একটি ফ্যাসিবাদী প্রবণতা গড়ে উঠেছিল। ওয়েনের কবিতায় বীরত্ব ছিল না। তাছাড়া তাঁর মনে হয়েছিল যে, ওয়েনসহ war poets-দের অধিকাংশই যুদ্ধকে কল্পনার বিষয়বস্ত্ত না করে স্নায়বিক অনুভূতির বিষয় করে তুলেছেন।

রবীন্দ্রনাথের লেখায় করুণার বিষয়টি বারবার আসে, ওয়েন যে pity-র কথা বলেছেন তা ইয়েটসের যতই অপছন্দ হোক, রবীন্দ্রনাথের কাছে আকর্ষণীয় হওয়ার কথা। ওদিকে ওয়েন নিজেও যে রবীন্দ্রনাথের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন সে তো আমরা জানি।

ইয়েটস যে ওয়েনের লেখাকে গ্রাহ্যই করলেন না তাতে তখনকার বামপন্থী মহল বিশেষভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। তাঁদের পত্রিকা ডেইলি ওয়ার্কারে এ-বিষয়ে লেখা ছাপা হয়েছে। ইয়েটস তাতে বিরক্ত হয়ে ব্যক্তিগত পত্রালাপে কমিউনিস্টদের গালমন্দ করেছেন। ভারতবর্ষীয় কমিউনিস্টদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে-আস্থা ছিল তা মোটেই নয়, কিন্তু তাঁর অনাস্থা কখনই উগ্র রূপ ধারণ করে নি। ইয়েটসের পক্ষে চরমপন্থী হওয়া সম্ভব ছিল, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে নয়।

কমিউনিস্টদের ওপর ইয়েটসের বিরাগের আরেকটি কারণ হয়তো এই যে, এই ধারার মানুষেরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেই আগত। ইয়েটস মধ্যবিত্তকে অপছন্দ করতেন। এলিয়টের ব্যাপারে তিনি যে অসন্তুষ্ট ছিলেন তারও অন্তত আংশিক ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে এইখানে যে, এলিয়ট মধ্যবিত্ত জীবনকে নিয়েই লিখছিলেন। স্মরণীয় যে, রবীন্দ্রনাথকে তিনি দেখেছেন মধ্যবিত্ত হিসেবে নয়, একজন অভিজাত হিসেবেই। সে ধারণায় অবশ্য ভ্রম ছিল, কারণ রবীন্দ্রনাথ অভিজাত বংশে জন্মেছিলেন ঠিকই কিন্তু রুচি ও অবস্থানে মধ্যবিত্তই ছিলেন, অভিজাত বংশের আভিজাত্য নিয়ে  তাঁর কোনো বড়াই ছিল না।

ইয়েটস বিশ্বাস করতেন যে, প্রাচীন সংস্কৃতির প্রচন্ড আবেগ ও প্রবল বিশ্বাসের জোয়ার যদি সাহিত্যকর্মে প্রকাশ না পায় তাহলে রচনা পরিস্থিতির ধারাবিবরণী বা আবেগবিহীন ছায়ামূর্তি ভিন্ন অন্যকিছু হবে না। অর্থাৎ কি না পরিণত হবে সাংবাদিকতায়। রবীন্দ্রনাথও আবেগ ও ঐতিহ্যে আস্থা রাখতেন, কিন্তু ইয়েটসের মতো করে নয়। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তিনি মরমিবাদী প্রবণতা দেখেছিলেন, যা তাঁর পছন্দ হয়নি। রবীন্দ্রনাথের রচনায় ঈশ্বরানুভূতির অতিরেক দেখে ইয়েটস খুশি হন নি, প্রকাশের কথিত অস্পষ্টতাতেও বিরক্ত হয়েছেন। সবমিলিয়ে মূল সত্যটা দাঁড়ায় এই যে, দুজনের ভেতর ঐক্যের একটা ক্ষেত্র অবশ্যই ছিল, কিন্তু পার্থক্যের এলাকাটা ছিল বড় ও মৌলিক, যেজন্য ইয়েটস যে রবীন্দ্রনাথ থেকে দূরে সরে যাবেন এটা ছিল অবধারিত। প্রথম পাঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ইয়েটস যে নান্দনিক আধ্যাত্মিকতা, ছন্দের সূক্ষ্মতা, শব্দের বর্ণাঢ্যতা, পরিমিতিবোধের মৌলিকত্ব, স্বতঃস্ফূর্ততা এবং কাব্য ও ধর্মের একত্রগামিতা দেখতে পেয়েছিলেন সে-দেখাটা মিথ্যা ছিল না, কিন্তু তাঁদের অবস্থানে যে পার্থক্য ছিল সেটা তাতে স্থায়ীভাবে ঢাকা পড়ার কথা নয়, পড়েও নি।

সাত

নোবেল পুরস্কার রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বের কাছে নিয়ে গেছে, এবং নিজের দেশও তাঁকে নতুনভাবে চিনতে পেরেছে। ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’ কথাটা সবদেশেই সত্য, বিশেষভাবে সত্য বোধ করি বাঙালিদের দেশে। স্বদেশবাসীর নতুনভাবে চেনাতে অবশ্য তিনি যে অতিশয় প্রীত হয়েছিলেন তা নয়, ভেতরে ভেতরে একটা অভিমান ছিল বিদ্বৎসমাজের বিরুদ্ধে, যাঁরা তাঁকে ইতিপূর্বে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদাদানে কুণ্ঠা প্রকাশ করেছে, কেউ কেউ তাঁর বিরুদ্ধেও লিখেছেন। পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরটা শান্তিনিকেতনে পৌঁছায় নভেম্বরের ১৩ তারিখে, দশ দিনের মাথায় ২৩ তারিখে কলকাতা থেকে পাঁচশো জন বিশিষ্ট ব্যক্তি একটি বিশেষ ট্রেনের যাত্রী হয়ে রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানানোর জন্য শান্তিনিকেতনে আসেন। তাঁদের আপ্যায়নের জন্য উপযুক্ত আয়োজন করা হয়েছিল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, তাঁদের অভ্যর্থনায় তিনি যে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন তা নয়। প্রকারান্তরে তাঁর বক্তব্য ছিল ওই সম্মাননাকে প্রত্যাখ্যানেরই শামিল। বিমুখ হয়ে বিশিষ্টজনেরা ফিরে আসেন। রদেনস্টাইনকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে, চতুর্দিকে তাঁকে নিয়ে যে হট্টগোল হচ্ছে সেটা তাঁর কাছে দুর্বিষহ ঠেকছে। প্রতিদিন তিনি এত টেলিগ্রাম ও চিঠি পাচ্ছেন যে মনে হচ্ছে তাদের চাপে তলিয়ে যাবেন। যেসব লোক তাঁর প্রতি আগে কোনো রকমের সৌহার্দ্য প্রকাশ করে নি, তাঁর লেখা একটি লাইনও পড়ে দেখে নি তাদের কণ্ঠেই সবচেয়ে উচ্চধ্বনি শোনা যাচ্ছে। মন্তব্য করেছেন যে, এ সমস্ত লোক তাঁকে সম্মান করে না, সম্মান করে তিনি যে সম্মান পেয়েছেন তাকে।

তাই বলে তাঁর দেশবাসী যে খুশি হন নি তা নয়। পরাধীন বাঙালির জন্য তো বটেই, ভারতের মানুষদের জন্যও ঘটনাটা গৌরবের ছিল বইকি। যে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের অবজ্ঞা করতো, এবং তাঁদের রাজনৈতিক আন্দোলনে রুষ্ট ছিল, তারাই তাঁর পক্ষ হয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করেছে, এবং তাঁকে সেটা পৌঁছে দিয়েছে। এ ব্যাপারটা সামান্য নয়। ১৯০৬-০৭ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তখন ভারত সরকারের মুখ্য সচিব চিঠি দিয়ে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক বক্তৃতা দান থেকে বিরত থাকার জন্য সতর্ক করে দিয়েছিল। তারাই এখন তাঁর খ্যাতির কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হলো।

পুরস্কারটি জানিয়ে দিলো যে, কেবল অতীত নয়, বর্তমানকে নিয়েও গর্ব করার মতো কৃতি ভারতের রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের নিজের জন্যও এই স্বীকৃতি বিশেষভাবে ফলপ্রসূ হয়েছিল। ওই সময়টায় তিনি নানা ধরনের যন্ত্রণা ও দুঃখে আক্রান্ত ছিলেন, ইংল্যান্ডে গেছিলেন অনেকটা হাওয়া বদলের জন্য, কিন্তু সেখানে গিয়ে কবি হিসেবে যে সমাদর ও পুরস্কারের মধ্য দিয়ে যে অপ্রত্যাশিত সম্মান পেলেন তা তাঁকে নিশ্চয়ই উদ্দীপ্ত করেছিল। খাঁটি বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ভেতরে আন্তর্জাতিকতার একটি বোধ সব সময়েই ছিল, পুরস্কার সেটিকে উৎসাহিত করেছে। বিশ্বজুড়ে তিনি পরিচিতি লাভ করেছেন, বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের আহবান পেয়েছেন এবং সংবর্ধিত হয়েছেন, উগ্র জাতীয়তাবাদের যুগে আন্তর্জাতিকতার এবং স্বার্থপর বস্ত্ততান্ত্রিকতার পরিবর্তে বিশ্বজনীন ঐক্যের কথা বলেছেন। তাঁর রচনা ও বক্তব্য সমাদৃত হয়েছে, তাঁর রচনা বিবেচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের নিজের অভিজ্ঞতার জগতে এবং দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে।

কলকাতা বন্দরে হঠাৎ যদি অসুস্থ না হয়ে পড়তেন তা হলে গীতাঞ্জলির তর্জমা সঙ্গে নিয়ে বিলেত যাওয়াটা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যে সম্ভব হতো এমনটা মনে হয় না। ওই দুর্ঘটনা বড় এক ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাও বলা সম্ভব যে, গ্রন্থটির প্রকাশ ঘটেছিল ঠিক সেই সময়ে যখন তৃষ্ণার্ত ইউরোপ ওই ধরনের কবিতার জন্য অপেক্ষা করছিল; বিলম্বে উপস্থিত হলে ইংরেজি গীতাঞ্জলি হয়তো তেমন সমাদর পেতো না যেমনটি সময় মতো হাজির হয়ে সে পেয়েছিল। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গ্রন্থটি এখন আর আগের জায়গায় নেই; এর তাৎক্ষণিক আবেদন অনেকেটাই হারিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তো গীতাঞ্জলিতে থেমে থাকেন নি, বহুভাবে ও বহুদিকে ছড়িয়ে গেছেন। তাই বলে গ্রন্থটির স্থায়ী মূল্য যে নেই তা নয়। অবশ্যই আছে। এর আবেগ ও চিন্তায় মৌলিকতা, প্রকাশের কাব্যিক সৌন্দর্য, বৈচিত্র্য এবং  আন্তরিকতা, এর নিজস্ব সুর ও স্বর যে কোনো সময়ে পাঠকের চিত্তে সাড়া জাগাবে।

একটি বড় ঘটনা নিয়ে আমাদের এই আলোচনার মূল কথাটা হয়তো এই যে, বাংলায় গীতাঞ্জলির তুলনায় ইংরেজি গীতাঞ্জলি সমমানের না হলেও তার সময়মতো প্রকাশ নানা ধরনের তাৎপর্যের কারণে অত্যন্ত স্মরণীয়, যেমন রবীন্দ্রনাথের নিজের জন্য, তেমনি তাঁর দেশবাসীর জন্য।

আট

তারপরেও অবশ্য কথা থাকে।

একটি অত্যন্ত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সত্য এটি যে, গীতাঞ্জলির রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ নন, তাঁর একাংশ মাত্র। আধ্যাত্মিকতা, ধর্মবোধ, ব্যক্তির অনুভূতি, মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে ভালোবাসা গীতাঞ্জলির বৈশিষ্ট্য, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে জানতে হলে তাঁর অন্য রচনাও পড়তে হবে, যেসব রচনাতে তিনি অতুলনীয় রূপে বাস্তববাদী। যেমন তাঁর ছোটগল্প। গীতিকবিতায় যেমন ছোটগল্পেও তেমনি, তিনি বিশ্বমানের লেখক। পাশাপাশি তাঁর উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, এমন কী চিঠিপত্র ও পাশ্চাত্যের বস্ত্ততান্ত্রিক ও শিক্ষাগত আধিপত্যের অধীনে থেকে নিজেদের সভ্যতার ওপর আমরা আস্থা হারিয়ে ফেলি কিন্তু এখন সময় এসেছে আমাদের ভেতর যা কিছু ভালো আছে তাকে বিকশিত করার। অন্যদের কাছে আমরা আর আমাদের দারিদ্র্য উন্মোচিত করতে চাই না। আঁকা ছবি তো রয়েছেই। আছে তাঁর জীবনকাহিনি, যা মহাকাব্যিক গ্রন্থের মতো বিস্তৃত। বাস্তব জীবনে যত ধরনের ও যে-পরিমাণে কাজ তিনি করেছেন, যত বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছেন এবং ভেবেছেন তা অনন্যসাধারণ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও তিনি ছিলেন, যদিও তাঁর নিজের মতো করেই। কেবল গ্রন্থ বলি কেন, রবীন্দ্রনাথের জীবন তো একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়।

নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি নাম রেখেছিলেন বিশ্বভারতী। প্রতিষ্ঠানটি ভারতবর্ষের, কিন্তু তার সাথে সংযোগ রয়েছে সমগ্র বিশ্বের। রবীন্দ্রনাথের নিজের বেলাতেও সেটাই সত্য। তিনি ভারতবর্ষীয়, বিশেষভাবেই বাঙালি, কিন্তু একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক। আন্তর্জাতিকতা তাঁর চিন্তা ও অনুভবের বৈশিষ্ট্য। সারাবিশ্বের নাড়ির খবর তিনি রাখতেন, নিজের লেখাতে সেই জ্ঞানকে ধারণ করতে চাইতেন এবং আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর লেখাকে সমগ্র বিশ্বে জ্ঞাত ও ব্যাপ্ত করবেন। নোবেল পুরস্কার তাঁর জন্য বিশ্বভ্রমণ ও বিশ্বব্যাপ্তির পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল। এই সুযোগের সদ্ব্যবহারে তিনি কার্পণ্য করেন নি। বিভিন্ন দেশে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছেন, এবং বক্তৃতা দিয়েছেন। এসব বক্তৃতার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘Nationalism’ শীর্ষক তিনটি বক্তৃতা।

নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির তিন বছর পার হতে না হতেই রবীন্দ্রনাথ Nationalism বিষয়ে জাপানে একটি এবং আমেরিকায় দুটি বক্তৃতা দেন। ইংরেজি ভাষাতেই, যে-ভাষায় তিনি গীতাঞ্জলির গদ্য অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু এই গদ্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের, এতে কাব্যিক গুণ যে ছিল না তা নয়, রবীন্দ্রনাথের গদ্যে সেটা থাকবেই, তা সে-গদ্য বাংলায় লেখা হোক কিংবা ইংরেজিতে। বিষয়বস্ত্ত ছিল ভিন্ন; আধ্যাত্মিকতা নয়, রাজনীতি। ওদিকে পরিস্থিতিও ছিল অন্যরকমের। বিশ্বযুদ্ধের যে-আশঙ্কার পরিবেশে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ততদিনে সে-যুদ্ধ বেধে গেছে। সেই ডামাডোলের ভেতরই ১৯১৬-১৭ সালে বক্তৃতা তিনটি দেওয়া। যুদ্ধটা ছিল সাম্রাজ্যবাদী; রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তা না বোঝার কারণ ছিল না। বুঝেছিলেন তিনি স্পষ্ট করেই, কিন্তু সেটিকে সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেন নি, নাম দিয়েছেন ‘পশ্চিমের জাতীয়তাবাদী’ তৎপরতা। সাম্রাজ্যবাদের চালিকা শক্তি হচ্ছে পুঁজিবাদ, পুঁজিবাদের অধীনে শ্রেণিবিভাজন থাকে, থাকে পুঁজির সঙ্গে শ্রমের বিরোধ, পুঁজির লালসায় ঘটে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। এসবের উল্লেখ বক্তৃতায় রয়েছে। খুব বড় করে আছে রাজনীতি ও বাণিজ্যের কথা; ওই রাজনীতি ও বাণিজ্যকে তিনি জাতীয়তাবাদী হিসেবে দেখেছেন। সাম্রাজ্যবাদ বলে তাদের পরিচিত করার ব্যাপারে তাঁর দ্বিধা ছিল। ওই ধরনের ভাষা ব্যবহারে তিনি অভ্যস্তও ছিলেন না। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী তান্ডব যে কতটা পৈশাচিক হতে পারে সংক্ষেপে হলেও তার চিত্র তুলে ধরতে তাঁর সংকোচ ছিল না। বিভিন্ন উল্লেখের মধ্যে দিয়ে তিনি সাম্রাজ্যবাদী জাতীয়তাবাদের চরিত্রের উন্মোচন ঘটিয়েছেন। যেমন জাপানে প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি বলছেন, ওই রাজনীতি feeds upon their [অর্থাৎ ভুক্তভোগী দেশসমূহের] dead flesh and grows fat upon it, so long as the carcasses remain fresh – but they [অর্থাৎ মৃত দেশগুলো] are sure to rot at last, and the dead will take their revenge by spreading pollution far and wide and poisoning the vitality of the feeder.

আগ্রাসী জাতিগুলোকে তিনি সর্বভুক ও নরমাংসাশী বলে চিত্রিত করেছেন। ভাষাটা ইংরেজিই, কিন্তু গীতাঞ্জলির নয়, একেবারেই ভিন্ন। ১৯১২-১৩-তে এই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইউরোপের পরিচয় ঘটে নি, যদিও বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশের নৃশংসতার বিষয়ে বিংশ শতাব্দীর শুরুর আগেই অত্যন্ত পরিষ্কার ও প্রাণবন্ত ভাষায় লিখেছেন।

কিন্তু তিনি যে সাম্রাজ্যবাদকে সাম্রাজ্যবাদ না-বলে জাতীয়তাবাদ বললেন সেটা তাঁর জন্য একটা সীমাবদ্ধতা বইকি। অন্য একটি সংলগ্ন সীমাবদ্ধতা হলো এই যে, জাতীয়তাবাদ যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হতে পারে, এবং ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সেটি যে ওই চরিত্রই গ্রহণ করেছিল সেই বাস্তবতাকে যথোপযুক্ত গুরুত্ব না-দেওয়া। তাঁর বক্তব্যটা হলো, ব্রিটিশরা যদি শেষ পর্যন্ত চলেই যায় তাহলে ভারতবর্ষের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে তা নিয়ে ভারতবর্ষীয় জাতীয়তাবাদীরা ভাবছে না। তিনি নিজে অবশ্য ভাবছিলেন। তিনি চাইছিলেন এমন একটি সৃষ্টিশীল সমাজ যেখানে বর্ণভেদ থাকবে না, এবং শিক্ষার মধ্য দিয়ে সকল প্রকার পশ্চাৎপদতার অবসান ঘটবে। ব্রিটিশের রাজত্ব শেষ হবে অথচ তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের অধীনে সমাজ আগের মতোই থাকবে এটা কখনই কাম্য হতে পারে না। এর জন্য অবশ্যই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা যে জাতীয়তাবাদ চালু করেছে তার দখল থেকে বের হয়ে আসতে হবে। রাজনীতিতে কুলাবে না, কাজ করতে হবে সমাজ পরিবর্তনের জন্য। এ-ই ছিল রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য। এ-কাজটা কীভাবে সম্ভব তা তিনি বলেন নি।  জোর দিয়েছেন ব্যক্তির ওপর, উদারনীতিকেরা যেমন দেন। কিন্তু ব্যক্তির ক্ষমতা কি সমাজ বদলায়?

Nationalism-এর বিষয়ে যখন তিনি বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখনো রুশ বিপ্লব ঘটে নি। ওই বিপ্লবের বেশ কয়েক বছর পরে, ১৯৩০ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে গেছেন, এবং যে উন্নতি সেখানে দেখেছেন তাতে রীতিমতো অভিভূত হয়েছেন। কিন্তু যে সহিংস পদ্ধতিতে ওটি সম্ভব হয়েছে সেটি তাঁর অনুমোদন পায় নি। ১৯২৬-এ প্রকাশিত তাঁর রক্তকরবী নাটকে পুঁজিবাদের মনুষ্যবিরোধিতার সমালোচনা আছে, কিন্তু ওই ব্যবস্থা থেকে মুক্তির যে পথের দিশা পাওয়া যাচ্ছে সেটা বাস্তবসম্মত নয়; কেননা পুঁজিবাদ থেকে বের হয়ে আসতে হলে উন্নততর ব্যবস্থায় যাওয়াটাই হচ্ছে উপায়, কৃষি সমাজে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে তা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে যে গ্রহণ করতে পারছেন না সেটি তাঁর পুঁজিবাদ-বিরোধিতার ক্ষেত্রে একটা অসুবিধার ব্যাপার বইকি।

১৯১৩-তে যে-রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পশ্চিম চঞ্চল হয়েছিল, Nationalism বক্তৃতায় সে-রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যায় নি। আত্মার কথা সেখানেও রয়েছে, কিন্তু বাস্তব পৃথিবীর বিশ্লেষণই প্রধান হয়ে উঠেছে এবং পশ্চিমের বস্ত্ততান্ত্রিকতা যেভাবে আত্মার কণ্ঠরোধ করছে সে ব্যাপারে দুঃখ, ক্ষোভ ও আশঙ্কা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ পেয়েছে। গদ্য অনুবাদেও গীতাঞ্জলির কবিতা ও গানের হৃদয়গ্রাহিতার পেছনে নান্দনিক সৌন্দর্যের সঙ্গে যে দার্শনিক আধ্যাত্মিকতা ছিল তার জায়গায় বক্তৃতাত্রয়ে যে-বাস্তববাদিতা প্রকাশ পেয়েছে পশ্চিমের ভাববাদীদের তা পছন্দ হওয়ার কথা নয়, হয়ও নি; তাই দেখা গেল রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে তাদের উৎসাহে ভাটার টান পড়েছে।

বাস্তববাদীরা অবশ্য ১৯১২-১৩তেও রবীন্দ্রনাথের ভাববাদিতার প্রতি আগ্রহ দেখান নি। যেমন বার্ট্রান্ড রাসেল। রাসেল মনে করতেন যে, ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ‘সর্বোচ্চ সম্মানে’র যোগ্য; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক প্রত্যয়কে তিনি মোটেই গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করেন নি। ১৯১২-তেই রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শোনার পর তাঁর মনে হয়েছিল বক্তৃতার বিষয়বস্ত্তটি হচ্ছে,

Unmitigated rubbish – cut-and-dried conventional stuff about the river becoming one with the ocean and man becoming one with Brahma.

ওই বিষয়বস্ত্তকে তাঁর মনে হয়েছে vague nonsense।

১৯১২-র অক্টোবর মাসে যে এজরা পাউন্ড রবীন্দ্রনাথের প্রতি আকর্ষণে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন, কয়েক মাস পরে, ১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসেই তিনি রবীন্দ্রনাথের দর্শনের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে একটি চিঠিতে লিখেছেন,

As a religious teacher he is superfluous.[…] And his philosophy hasn’t much in it for a man who has ‘felt pangs’ or been pestered with western civilization.[…] So long as he sticks to poetry he can be defended on stylistic grounds against those who disagree with his content.[…] In his original Bengali he has the novelty of rime and rhythm and of expression, but in a prose translation it is just ‘more theosophy’.

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের কাছে নিঃস্ব অবস্থায় যান নি, গেছেন তাঁর নিজস্বতায় সমৃদ্ধ হয়েই, কিন্তু পশ্চিমের পুঁজিবাদী বিশ্বের পক্ষে সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথকে জানা কঠিন ছিল, সহজ ছিল না তাঁর সমালোচনা ও দার্শনিকতাকে গ্রহণ করা। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব একটি সীমানা ছিল; কিন্তু সীমার মধ্যে তিনি যে অসীম ছিলেন সে-সত্য অস্বীকার করবে কে? তাঁর মতো বহুমুখী প্রতিভা বিশ্বে বিরল ছিল বইকি।

তথ্যসূত্র

১.   প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী, কলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৯৭০।

২.   রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র, কলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৯৪২।

3. Rabindranath Tagore, Nationalism, New Delhi, Rupa & Co., 2005.

4. Krishna Kripalini, Tagore : A Life, New Delhi, Orient Longmans, 1971.

5. Krishna Dutta & Andrew Robinson, Rabindranath Tagore : The Myriad-minded Man, New Delhi, Rupa & Co., 2005.

6. Mihir Kanti Chowdhury, Haunting Rays, Tagore Miscellany, Dhaka, Ityadi Grantha Prakash, 2010.

7. Ezra Pound, Selected Letters, 1907-41, New York, New Directions Paperback, 1971.

8. W. B. Yeats, Collected Letters, Oxford University Press, 2007.

9. W. B. Yeats, Letters on Poetry from W. B. Yeats to Dorothy Wellesley, Oxford, Oxford University Press, 1946. r