রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনা

আহমদ রফিক

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনার বিষয়টি বেশ জটিল। সেখানে রয়েছে নানা মাত্রিক ভাবনার মিশ্র চরিত্র, তাতে স্ববিরোধিতারও অভাব নেই। তাঁর স্বদেশভাবনা যেমন রাজনৈতিক চিন্তা, তেমনি সমাজভাবনা-নির্ভর। সেখানে যুক্ত হয়েছে ভারতবর্ষীয় ইতিহাসের উপলব্ধি – যে-উপলব্ধির মধ্যমণি প্রাচীন ভারত, সনাতন ভারত। যে-ভারতের চরিত্র সমাজপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান নয়। আবার  সে-সমাজভাবনায় একপর্যায়ে এসে যুক্ত হয়েছে পল্লিপুনর্গঠন ও উন্নয়ন বিষয়ক আধুনিক চেতনা।
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনার বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের চরিত্র বিশ্লেষণ নিয়ে, পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম নিয়ে বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী আন্দোলন নিয়ে, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে, সর্বোপরি বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের আগ্রাসন নিয়ে মতামত প্রকাশ। শেষোক্ত বিষয়টির গুরুত্ব সর্বশেষ এ-কারণে যে, যখন ভারতে ইংরেজ শাসনে আধুনিকতার পতন এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতির রেনেসাঁস নিয়ে রবীন্দ্রচেতনায় যথেষ্ট মুগ্ধতা, তখনো ইংরেজের নিষ্ঠুর বিশ্ব-আগ্রাসী তথা সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদী।
ভারতে ইংরেজ শাসনের সমর্থক ভূমিকায় বিশ্বাস শুধু উনিশ শতকী নবজাগরণের নায়কদেরই ছিল না, ওই রেনেসাঁসের কনিষ্ঠ সন্তান রবীন্দ্রনাথেরও ছিল। রামমোহন বিদ্যাসাগর থেকে ব্রাহ্মসমাজের শীর্ষস্থানীয় এলিটদের চোখে এদেশে ইংরেজের  শিল্প-সাংস্কৃতিক ও আধুনিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা-রূপটিই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নেটিভ তথা ভারতীয়দের প্রতি তাদের অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনা, ঘৃণা-বিরূপতার দিকগুলো তাদের চোখে বড় হয়ে ধরা পড়েনি।
এ-প্রসঙ্গে কার্ল মার্কসের ভারত প্রসঙ্গকথা উদ্ধার করা হয়ে থাকে। কিন্তু মার্কস ভারতে ইংরেজ-প্রবর্তিত আধুনিক ব্যবস্থার পত্তন, স্থবির সনাতন সমাজ ভাঙা ইত্যাদি প্রসঙ্গে সাধুবাদ জানিয়েও ভারতে উপনিবেশবাদী ইংরেজ শাসন-শোষণের ভয়ংকর রূপটির সমালোচনা করতে ভোলেননি এবং এ-অবস্থা থেকে ভারতীয়দের সংগ্রাম ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করেছিলেন।
কিন্তু নবজাগরণের প্রাথমিক পর্বের নেতারা এ-বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না। তাই তাঁরা রাজনৈতিক সংগ্রামের পরিবর্তে সমাজ-সংস্কারে মনোনিবেশ করেছিলেন। রামমোহনের সতীদাহ প্রথা বন্ধ করা, বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রবর্তন থেকে শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য (অবশ্য এসবই ছিল হিন্দু সমাজের সংস্কার প্রচেষ্টা); কিন্তু তাঁরা বিদেশি   শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে, পরাধীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণ করেননি। তাঁরা সবাই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রশংসাধন্য ব্যক্তি।
আর রবীন্দ্রনাথ? তিনিও দীর্ঘ সময় শাসক ইংরেজ সম্পর্কে ওই একই ভাবনার পথ ধরে হেঁটেছেন। তবে বিষয়টা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন ছিলেন বলেই বোধহয় ‘ছোটো ইংরেজ বড়ো ইংরেজ’ তত্ত্ব তুলে ধরে নিজেকে বোঝাতে চেয়েছেন, তাঁর ভাবনার একটা যুক্তিসঙ্গত রূপ দিতে চেষ্টা করেছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে ভারত শাসন করে যে ‘ছোটো ইংরেজ’ তার অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে শাণিত বক্তব্য রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ একের পর এক নিবন্ধে। কিন্তু বিলেতে অবস্থানরত বড়ো ইংরেজের ভারত বিষয়ক হিতব্রতা রূপ তাঁর চোখে বড় হয়ে উঠেছিল। ভাবেননি তারাই ওই অন্যায় শাসনের কেন্দ্রবিন্দু।
রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনি ও জানি একজন সমন্বয়বাদী ধারণায় বিশ্বাসী ব্যক্তি হিসেবে। ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে, দেশ বা সমাজের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তাঁকে সমন্বয়বাদী রূপে দেখা গেছে। এখানেও বোধহয় ছিল সমন্বয়ের চেষ্টা। উন্নত, আধুনিক ভারতবর্ষ বিনির্মাণে ইংরেজ ভূমিকা নেবে – দীর্ঘদিন এমন বিশ্বাস তিনি লালন করেছেন। একাধিক প্রবন্ধে তা প্রকাশ পেয়েছে। পেয়েছে ইংরেজের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্বন্ধে তাঁর বিশ্বাস। ভাবেননি যে, উপনিবেশবাদী শোষক কখনো উপনিবেশকে স্বদেশ হিসেবে ভাবে না।
তাঁর ‘পূর্ব ও পশ্চিম’ (১৯০৮) প্রবন্ধটি যেন তাঁর ভারতবর্ষ-বিষয়ক ইতিহাস-ভাবনার প্রতিফলন। এখানে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব ও পশ্চিমের মিলনে প্রত্যাশী। কিন্তু পশ্চিম বলতে এখানে তিনি ইংরেজকেই বুঝিয়েছেন। তাই বলতে পেরেছেন : ‘ইংরেজের সঙ্গে আমাদের মিলন সার্থক করিতে হইবে। মহাভারতবর্ষ গঠনের ব্যাপারে এই ভার আজ আমাদের উপর পড়িয়াছে।… ইংরেজের যাহা কিছু শ্রেষ্ঠ, ইংরেজ তাহা যে সম্পূর্ণভাবে ভারতবর্ষে প্রকাশ করিতে পারিতেছে না, সেজন্য আমরা দায়ী আছি।’
রবীন্দ্রনাথের ‘মহাভারত’ চিন্তা অবশ্য বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দু ভারত থেকে ভিন্ন। রবীন্দ্রভারতে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, এমনকি ইংরেজ ও আমন্ত্রিত – তারা সবাই মিলে দেশ গড়বে এমন বিশ্বাস নিয়ে কথাগুলো লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কারণ ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ভক্ত রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন : ‘য়ুরোপের প্রদীপের মুখে শিখা জ্বলিতেছে। সেই শিখা হইতে আমাদের প্রদীপ জ্বালাইয়া লইয়া আমাদিগকে কালের পথে আর একবার যাত্রা করিয়া বাহির হইতে হইবে।’
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ভেবে দেখেননি যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞান সমৃদ্ধ সংস্কৃতি থেকে আধুনিক চেতনা গ্রহণ আর উপনিবেশবাদী শাসককে শোষকের আসনে বসিয়ে রেখে তাদের সাংস্কৃতিক সম্পদ গ্রহণ (নৃতাত্ত্বিক অ্যাকালচারেশন) এক বিষয় নয়। ‘ভারতীয়’ কবিতায় তিনি যতই ডাক দিন না কেন, ইংরেজ ভারতে স্বমূর্তিতেই বিরাজ করবে। সে-মূর্তি শোষকের, বণিকের, অত্যাচারীর ও নিষ্ঠুর শাসকের। এদিকটায় সচেতন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হয়তো তাই ‘ছোটো ইংরেজ’ অর্থাৎ ভারতে অবস্থানকারী শাসক ইংরেজের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এন্তার লিখে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এবং তা উনিশ শতকের শেষদিক থেকেই। যেমন ভারতবাসীর বাক স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করতে আনীত ‘সিডিশন বিলের’ বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ চড়াভাষায় লেখেন ‘কণ্ঠরোধ’ প্রবন্ধটি এবং তা পাঠ করেন কলকাতা টাউন হলে (১৭-২-১৮৯৮)। ‘বঙ্গরাজকতা’ (১৩২২) প্রবন্ধে রয়েছে বিদেশি শোষণের উল্লেখ।
‘এবার ফিরাও মোরে’ (১৮৯৪) কবিতায় উদ্দীপক সুরে স্বাধিকার চেতনায় জ্বালানি যোগ করেন কবি রবীন্দ্রনাথ। ‘নৈবেদ্য’ কবিতায় ভক্তিবাদ ও তপোবন সংস্কৃতির পাশাপাশি শাসকবিরোধী, অন্যায়বিরোধী বক্তব্য স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তবে এখানে সাম্রাজ্যবাদী মুক্তির সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও তার আগ্রাসী চরিত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অভিশাপের রূপ নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কবি বরাবর সোচ্চার। তা দেশি বা বিদেশি যা-ই হোক।
দুই

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনায় স্বাদেশিকতার সুচিন্তিত রূপ প্রকাশ পেয়েছে তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘স্বদেশী সমাজে’ (১৯০৪) এবং সম্পূরক রচনা ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’য় (১৯০৫), পরে পাবনা সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে (১৯০৮)। এখানে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা সমাজভাবনার রূপ নিয়ে প্রতিফলিত। তাঁর ভাষায় ‘মধ্যযুগে পড়ে থাকা’ গ্রামের সর্বতোমুখী উন্নয়ন ও পল্লিপুনর্গঠন প্রধান বিবেচ্য বিষয়। তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’ ভাবনায় স্ফুলিঙ্গপাত ঘটে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের দুর্বুদ্ধিজাত বঙ্গভঙ্গের কারণে। বঙ্গভঙ্গ ছিল বাঙালির  আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ওপর বড়সড় আঘাত।
বঙ্গপ্রদেশে জ্বলে ওঠে আগুন। যদিও তাতে কংগ্রেস রাজনীতি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাধান্য তবু সেখানে নবাব সলিমুল্লাহ বা আগা খান প্রমুখের কথা বাদ দিলে জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতৃত্বের উপস্থিতি কম ছিল না। যেমন ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, আবদুল হালিম গজনভি, মোহাম্মদ ইউসুফ, ডা. গফুর, দেদার বক্স, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী বাদেও একাধিক মুসলমান নেতা।
রবীন্দ্রনাথ গভীর আবেগ নিয়ে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে একাধিক বন্ধুসহ যোগ দেন। রচনা করেন স্বদেশবন্দনা ও প্রতিবাদী চরিত্রের কবিতাগুচ্ছ – যেগুলোর অন্যতম ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘সার্থক জনম আমার’, ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই’ ইত্যাদি।
এ আন্দোলন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তাই ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’য় তিনি বলেন : ‘আমরা হিন্দু মুসলমান, ধনীদরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, স্ত্রীলোক ও পুরুষ সকলেই বাঙালি বলিয়া যে এক বাংলার বেদনা অনুভব করিতে পারিয়াছি – আঘাতের কারণ দূর হইলেই … সেই ঐক্যের চেতনা যদি দূর হইয়া যায় তবে আমাদের মতো দুর্ভাগা আর কেহ নাই। এখন হইতে আমাদের ঐক্যকে নানা উপলক্ষে নানা আকারে স্বীকার করিতে হইবে।…
‘এই অভিপ্রায়টি মনে রাখিয়া দেশের কর্মশক্তিকে একটি বিশেষ কর্তৃসভার মধ্যে বদ্ধ করিতে হইবে। অন্তত একজন হিন্দু ও একজন মুসলমানকে আমরা এই সভার অধিনায়ক করিব।’ সাম্প্রদায়িক ঐক্য রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল বলে তিনি সেই ঐক্য বাস্তবায়িত করতে চেয়েছেন জাতীয় জীবনের নানা খাতে। চেষ্টাও কম করেননি তাঁর লেখায় ও কাজে।
যেমন গ্রামের স্বকীয় শাসন ব্যবস্থায়, জীবিকার সমবায়ভিত্তিক নানামুখী ক্ষেত্রে, তেমনি সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায়। এমনকি ‘এই উপলক্ষ্যে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদকে বাংলার ঐক্য সাধন যজ্ঞে বিশেষভাবে আহবান’ জানান। পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর একাধিক রচনায় বাংলাদেশের জেলায় জেলায় মেলা অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও জাতীয় ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক মিলনের আহবান জানান। তাঁর মতে, ‘চিন্তার ঐক্য, ভাবের ঐক্য, ভাষার ঐক্য, সাহিত্যের ঐক্য’ সাধনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাবিত রাখিবন্ধন অনুষ্ঠান ও সে-বিষয়ে তাঁর তৎপরতা উল্লেখযোগ্য।
প্রসঙ্গত, স্মর্তব্য সর্বজনীন বাঙালি ঐক্যের আবেগপ্রসূত রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ বক্তব্য ও গান (বাংলার মাটি, বাংলার জল) যা তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করেছিল। বাঙালির এ মহামিলনে কিন্তু ইংরেজের প্রতি আহবান নেই, থাকার কথাও নয়। বরং স্বনির্ভর জাতীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়া উপলক্ষে ছাত্রদের ওপর সংঘটিত রাজনৈতিক হয়রানির বিরুদ্ধে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সভায় (অক্টোবর, ১৯০৫) সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেন : ‘আমাদের দেশে শিক্ষার ভার যাহাদের উপর ন্যস্ত আছে তাহাদের স্বার্থের সঙ্গে ছাত্রদের স্বার্থের বিরোধ।… তাই আমাদের শিক্ষার ভার নিজেদের হাতে রাখিতেই হইবে।’ (রবি জীবনী, পঞ্চম, পৃ ২৭২)।
এরপর সরকারবিরোধী তৎপরতায় রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা ও ভাষণ। অন্তত মাস দুই একনাগাড়ে। মূল বক্তব্য দুটো : জাতীয় পর্যায়ে স্বনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার পত্তন এবং আন্দোলনে নিঃস্বার্থ  হিন্দু-মুসলমান ঐক্য প্রচেষ্টা। এ-প্রসঙ্গে দুবছর পর লেখা ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধের বক্তব্য ছিল যেমন বাস্তবতাসম্মত, তেমনি সময়ানুগ ও দূরদর্শী। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান বিরোধের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনার গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকগণ আমলে নেননি।
হয়তো তাই ওই আন্দোলনের চরিত্র অনুধাবন করে রবীন্দ্রনাথের মনে এ-সম্পর্কে হতাশা জন্ম নিতে থাকে। কারণ ইতোমধ্যে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে তৃণমূল স্তরে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যে ফাটল দেখা দিতে শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ তাই সমস্যার মূল চিহ্নিত করে পূর্বোক্ত প্রবন্ধে লেখেন : ‘হিন্দু মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে,… আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নহে। আমরা বিরুদ্ধ।… আমাদের পাপই ইংরেজের প্রধান বল। ইংরেজ আমাদের ব্যাধির একটা লক্ষণ মাত্র।’
এ-প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন : ‘লক্ষণের দ্বারা ব্যাধির পরিচয় পাইয়া ঠিকমত প্রতিকার করিতে না পারিলে গায়ের জোরে অথবা বন্দেমাতরম মন্ত্র পড়িয়া সন্নিপাতের হাত এড়াইবার কোনো সহজ পথ নাই।’ এমন এক বাস্তববোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে রবীন্দ্রনাথ এরপরও হিন্দু-মুসলমান বিরোধের মূল বিন্দুগুলো চিহ্নিত করেছেন নানা দিক বিচারে। এ-বিষয়ে লিখেছেন আমৃত্যু। বলেছেন এমন কথাও যে, ‘হিন্দু সমাজে আচার নিয়েছে ধর্মের নাম’ যেজন্য মুসলমান হিন্দুর কাছে অস্পৃশ্য ইত্যাদি। চেয়েছেন শিক্ষা এবং ‘পদমানমর্যাদায়’ মুসলমান হিন্দুর সমকক্ষ হয়ে উঠুক এবং হিন্দু যেন তা প্রসন্নচিত্তে মেনে নেয়।
কিন্তু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস রাজনীতি ও রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তা মেনে নিতে পারেনি। চিত্তরঞ্জন-সুভাষের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও পারেনি। তাই চিত্তরঞ্জনের অকালমৃত্যুর পর তাঁর-সম্পাদিত সংরক্ষণমূলক ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ কংগ্রেসি সদস্যদের চেষ্টায়ই বাতিল হয়ে যায়। তাতে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যে ফাটল ধরে, উভয়ের মধ্যে সংঘাত দেখা দেয়। কংগ্রেস ক্রমশ মুসলমান প্রতিনিধিত্ব হারাতে থাকে এবং মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক শক্তি বৃদ্ধি পায়। এসব ঘটনা অবশ্য বঙ্গভঙ্গের অনেক পরের। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক বিবেচনা মাথায় রেখে শুরু থেকে শেষ অবধি এর সুষ্ঠু সামাজিক-রাজনৈতিক সমাধানের পথ বাতলেছেন। কিন্তু হিন্দুসমাজ বা কংগ্রেস রাজনীতি তাঁর পরামর্শে কান দেয়নি।
সাম্প্রদায়িক অনৈক্য বা সমস্যা ছাড়াও পূর্বোক্ত আন্দোলনে আরো যে-সমস্যা রবীন্দ্রনাথের নজরে এসেছে তা ছিল গ্রাম-নগরের ব্যবধান, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য। তাঁর বিচারে ‘গ্রাম পড়ে আছে মধ্যযুগে আর শহর আধুনিক যুগে।’ এ ব্যবধান দূর করতে গ্রামোন্নয়ন ও পল্লিপুনর্গঠন তাঁর কাছে প্রধান করণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। শহর-গ্রাম তথা শিক্ষিত-অশিক্ষিতের আর্থ-সামাজিক ব্যবধানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে রবীন্দ্রনাথ লেখেন : ‘আমরা শিক্ষিত কয়েকজন এবং আমাদের দেশের বহুকোটি লোকের মাঝখানে একটা মহাসমুদ্রের ব্যবধান।’
এ ব্যবধান দূর করতে রবীন্দ্রনাথ যে-পথ অবলম্বন করেন অর্থাৎ অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভর পল্লিসমাজ গঠন তা ছিল সীমাবদ্ধ বৃত্তে, কবির ভাষায় সমগ্র দেশের জন্য ছোট একটি মডেল হিসেবে পরীক্ষা। এর মূল ভিত্তি ছিল জীবিকাভিত্তিক সমবায়নীতি, কুটিরশিল্প ও ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা (কৃষি ব্যাংক বা ‘সামাজিক ব্যবসা’ ছিল না)। চরিত্র বিচারে এটা সংস্কারবাদী ব্যবস্থা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, এ পন্থায় গ্রামীণ অর্থনীতির পুরুজ্জীবন সম্ভব। সম্ভব গ্রামের আধুনিকায়ন এবং আদর্শ পল্লিসমাজ গড়ে তোলা।
বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নিহিত রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, শিক্ষিত ‘ভদ্রলোক শ্রেণীর’ স্বার্থ তথা নগর স্বার্থের প্রাধান্য, গ্রামীণ জনস্বার্থের প্রতি অবহেলা ইত্যাদি কারণে আন্দোলন থেকে সরে আসার ফলে জাতীয়তাবাদী মহলে নিন্দিত হন। যেমন হন ‘বিলেতি বর্জন’ উপলক্ষে পরবর্তীকালে গরিব মুসলমান জনতার ওপর অসহযোগীদের জবরদস্তির সমালোচনা করে, যে-জবরদস্তি শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সংঘাতে পরিণত হয়। ঘরে বাইরে উপন্যাসে এ-ঘটনার কিছুটা পরিচয় মিলবে।
এ-সম্বন্ধে ড. অরবিন্দ পোদ্দার লিখেছেন : ‘তার মন এমন এক দ্বন্দ্ব সংঘাতের আলোড়নে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে যে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।… এ যেন তার গোত্রান্তর।’ (রবীন্দ্রনাথ/ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব) ড. পোদ্দারের মতে, সম্প্রদায়গত সমস্যা তাঁর সরে আসার বড় কারণ। আর ‘গোত্রান্তর’ শব্দটি তিনি ইতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করেছেন।
একই বিষয়ে প্রশান্তকুমার পালের বিশ্বাস ‘জাতীয় নেতাদের মতিগতি দেখে মাসদেড়েকের মধ্যেই তাঁর মোহভঙ্গ ঘটে।’ আর সত্যেন্দ্রনাথ রায়ের মতে, রবীন্দ্রনাথ ‘যখনি বুঝেছেন, এ আন্দোলন শিক্ষিত ভদ্রলোকদের নিজেদের জন্যই আন্দোলন, জনসাধারণ এখানে তাদেরই উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায়মাত্র, তখনি তিনি আন্দোলনের উত্তেজনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।’ কিন্তু তাই বলে রবীন্দ্রনাথ এরপর স্বদেশহিত থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেননি। স্বদেশি আন্দোলন বা বিপ্লবী আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকারি দমননীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর একাধিক প্রবন্ধে। তাঁর শাসকবিরোধী গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘মেঘ ও রোদ্র’, ‘রাজটিকা’ ইত্যাদি।
শুধু প্রবন্ধে বা গল্পেই নয়, তাঁর কবিতায়ও দেখা গেছে আগুনজ্বলা দীপ্তি। বিশদ আলোচনায় না গিয়েও উল্লেখ করতে হয় ‘সুপ্রভাত’ কবিতার বহুউদ্ধৃত আত্মদানের আহবান-সংবলিত পঙ্ক্তিমালা :
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মানবতাবাদী চেতনার রবীন্দ্রনাথকে এতটা তাড়িত করেছিল যে, তাঁকে লিখতে হয় ‘ঝড়ের খেয়া’ কবিতায় স্বদেশিকতায় জারিত কিছু অসাধারণ পঙ্ক্তি : ‘বীরের এ রক্ত স্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা/ এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা।… রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন’ ইত্যাদি। এরপর আমরা দেখি পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডে রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ, নাইটহুড খেতাব বর্জন, গান্ধী-চিত্তরঞ্জনকে দিয়ে প্রতিবাদ সভা আহবানের ব্যর্থচেষ্টার মতো ঘটনাবলি।
রবীন্দ্রনাথের ‘বড়ো ইংরেজ ছোট ইংরেজ’ ধারণা সত্ত্বেও স্বদেশি আন্দোলনের পক্ষে শব্দধ্বনির দামামা বাজাতে রবীন্দ্রনাথ যে কার্পণ্য, করেননি তার প্রমাণ ধরা রয়েছে তাঁর কবিতায়, প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে। বিপ্লবপন্থী কবি নজরুলের অগ্নিক্ষরা ধূমকেতু পত্রিকার জন্য ‘আশীর্বাণী’ কবিতা পাঠাতে দ্বিধা ছিল না রবীন্দ্রনাথের (১৯২২), যদিও জানতেন এ-পত্রিকা বিপ্লব পন্থার মুখপত্র। তাই তাঁর পঙ্ক্তিমালাও ছিল বিষয়ানুগ। স্বাদেশিকতায় সচেতন করে তোলার পক্ষে উপযুক্ত দুটো ছত্র :
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে
আছে যারা অর্দ্ধচেতন।
অর্ধচেতনদের সচেতন করে তোলার আহবান জানিয়ে লেখা কবিতার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পেরেছিলেন নজরুল, ফলে পত্রিকার ওপর হামলাই শুধু নয়, শাসকবিরোধী কবিতার জন্য সম্পাদক কবি নজরুলকে জেলে যেতে হয়েছিল। আর রবীন্দ্রনাথ তাঁকে উৎসর্গ করেন নিজের লেখা নাটক বসন্ত।

তিন

আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ রাজনীতি ক্ষেত্রে সহিংসতা তথা গুপ্ত হত্যাকান্ডের পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু শাসক শ্রেণির চরম নির্যাতন, অন্যায় ও দমননীতির বিরুদ্ধে ঠিকই সোচ্চার হয়েছেন, যা বিপ্লবীদের প্রেরণা জুগিয়েছে। কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর মতো করে বিপ্লবীদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন তাঁর রচনায়। কিন্তু হত্যার রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরো একাধিক কালক্ষণের মতো ১৯৩০-৩১ সালও ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের সপক্ষে অবিস্মরণীয় সময়। বাংলা পাঞ্জাব পেশোয়ার এ-পর্বে ইতিবাচক অবস্থান।
ইতিহাস স্মরণে রেখেছে ১৯৩০ সালের এপ্রিলে বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের অভিযান ও সপ্তাহকালব্যাপী জালালাবাদ পাহাড়ে শাসক বাহিনীর সঙ্গে বিপ্লবীদের অসম যুদ্ধ, বীরকন্যা প্রীতিলতার ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণ ও আত্মদান। অন্যদিকে লাহোর দুর্গে ১৯৩১ সালে বিপ্লবী ভগত সিং ও তাঁর সহকর্মীদের ফাঁসি। এর আগে ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বরে ৬৩ দিনের অনশন শেষে বিপ্লবী যতীন দাসের মৃত্যু।
রবীন্দ্রনাথ এ-সংবাদ শুনে লেখেন ‘সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধ দাহ -/ হে ভৈরব শক্তি দাও…/ মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ’ ইত্যাদি পঙ্ক্তি যা বিপ্লবীরা কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন।            এ-সময়ের আরেকটি দুঃস্বপ্নের মতো ঘটনা হিজলি বন্দিশিবিরে কারাপ্রহরীদের গুলিতে কয়েকজন বিপ্লবীর মৃত্যু (১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩১)। এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় বয়সের ভারে জীর্ণ, অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদী বক্তব্য রাখেন। এ-সময় লেখেন বহুউদ্ধৃত ‘প্রশ্ন’ কবিতাটি।
এর আগে বকশা কারাদুর্গে বন্দি বিপ্লবীরা পঁচিশে বৈশাখ অনুষ্ঠান পালন করে যে অভিনন্দনবার্তা পাঠান তার জবাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁদের পালটা অভিনন্দন জানান কাব্যপঙ্ক্তিতে। একইভাবে ১৯৩২ সালে হিজলি কারাগার থেকে বিপ্লবীদের পাঠানো অভিনন্দনপত্রেরও জবাব দেন কবি। হিজলি হত্যাকান্ডের দুবছর পর আন্দামান সেলুলার জেলে অনশনরত রাজবন্দিদের জবরদস্তিমূলক অনশন ভাঙানোর চেষ্টার ফলে তিন বিপ্লবীর মৃত্যু। প্রতিবাদে জনসমাবেশ ও বন্দিদের দেশে ফিরিয়ে আনার দাবিতে সরকারের কাছে যে স্মারকলিপি পেশ করা হয় তাতে থাকে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর। এমনকি একই বিষয়ে ১৯৩৭ সালে বন্দিমুক্তি আন্দোলনে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ অগ্রজের ভূমিকা পালন করেন। কলকাতা টাউন হলে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদী সভায় তাঁর ভাষণ (২ আগস্ট, ১৯৩৭) ছিল স্মরণযোগ্য।
শাসকবিরোধী তাঁর ওই ভাষণের অন্তত দুটো বাক্য আমাদের বুঝিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সেও শাসকের মানবতাবিরোধী অপরাধের সমালোচনায় সোচ্চার। তাঁর ভাষায়, ‘ভারতের শাসন কর্তৃপক্ষ ফ্যাসিস্ট আক্রমণের হাত হইতে রক্ষা পায় নাই। আমার দেশের নামে এসবের প্রতিবাদ করিতেছি।’ ওই জনসভায় গঠিত ‘আন্দামান রাজনৈতিক বন্দী সহায়ক সমিতি’র সভাপতি নির্বাচিত হন রবীন্দ্রনাথ। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে তিনি তাঁর বার্তা পাঠান আন্দামানে বন্দি বিপ্লবীদের উদ্দেশে (নেপাল মজুমদার)।
প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, এ-বিষয়ে তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘প্রচলিত দন্ডবিধি’ (১৯৩৭) যেখানে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ শাসকের উদ্দেশে স্পষ্টভাষায় বলেন : ‘দন্ড প্রয়োগের অতিকৃত রূপকে আমি বর্বরতা বলি।’ শাসক শ্রেণিকে ‘বর্বর’ আখ্যা দিয়ে বলেন যে, এ হিংস্রতার অবসান না ঘটলে তিনি ‘নিচে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করবেন’। স্বভাবতই এ রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব ‘দানবের সাথে সংগ্রামের জন্য ডাক পাঠানো’ কিংবা ঘোষণার মতো উচ্চারণ ‘দামামা ঐ বাজে/ দিন বদলের পালা এল গোড়োযুগের মাঝে।’ এ-প্রসঙ্গে শুধু কবিতা নয়, পাঠ অপরিহার্য কালান্তরে সংকলিত অসাধারণ প্রবন্ধগুলো। বিষয় শাসকবিরোধতা, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য, সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন ও উদ্ধত ধনগরিমা।
অবশেষ বিচারে বলতে হয়, স্বদেশ-পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ভাবনা তাঁর রচনায় ও কর্মতৎপরতায় প্রতিবাদী পথ বেছে নিয়েছে। সে-পথ শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আপসবাদিতার নয়, ‘আবেদন নিবেদনের’ নয়। রথের রশি থেকে কালান্তর অবধি অর্থাৎ জীবনের শেষ দশকের গদ্যপদ্য রচনা তেমন প্রমাণই রাখে। বিষয়টা আরো স্পষ্ট হয় সুভাষ রাজনীতি প্রসঙ্গে তাঁর মতামতে, সংশ্লিষ্ট পত্রাবলিতে এবং তাসের দেশ নাটিকার বক্তব্যে। তাসের দেশ সুভাষকে উৎসর্গ করে লেখেন : ‘স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পুণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ করে।’ সঙ্গে গান ‘খরবায়ু বয় বেগে’ কিংবা ‘বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, ভাঙো’। তাঁর একাধিক নাটকে দেখা যায় উদ্ধত রাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্র বিরোধিতা, ধর্মীয় রক্ষণশীলতা-বিরোধিতার পরিচয়।

চার

উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তার প্রকাশ যতটা স্বদেশে শাসকদের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সম্ভবত তার চেয়ে বেশি বিশ্বপরিসরে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাঁর স্বদেশভাবনার সঙ্গে বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক কোথায় বা কিভাবে। প্রকৃতপক্ষে সে-কালে বিশ্বশাসনে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ, যে-শক্তি তখন ভারত শাসন করছে, আফ্রিকা-এশিয়ার বৃহৎ অংশ তাদের দখলে, যে কারণে বলা হতো, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না।’ স্বভাবতই এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ভাবনার রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে তাঁর সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক ভাবনার যোগসূত্র গভীর।
সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বা আগ্রাসনের চরিত্র যেমন বিদেশে তেমনি রবীন্দ্রনাথের স্বদেশে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ যে সাম্রাজ্যবাদী শাসক শক্তির নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা ও শাসন-শোষণ সম্বন্ধে সচেতন থেকেই প্রতিবাদী ছিলেন তাঁর লেখায় তেমন পরিচয় অনেক মিলবে। যেমন বুয়র যুদ্ধ বা বক্সার যুদ্ধের মতো ঘটনায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা মানবিক চেতনার কবি রবীন্দ্রনাথের মর্মবেদনার কারণ হয়ে ওঠে, তেমনি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে ভারতের সংশ্লিষ্টতা তাঁর কাছে আপত্তিকর মনে হতে থাকে।

শিলাইদহে পদ্মাতীরে বসে উনিশ শতকের শেষ দিনে সূর্যাস্তশোভা তাঁর জন্য সৌন্দর্য উপভোগ ছিল না, ছিল যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। আফ্রিকায় ব্রিটিশ বাহিনীর নির্মমতার সংবাদে ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ লেখেন বহুখ্যাত কবিতা যার সূচনা পঙ্ক্তি – ‘শতাব্দীর সূর্য আজি রক্ত মেঘ মাঝে/ অস্ত গেল’। গোটা কবিতাটি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতিবাদে সাগ্নিক।

বছর কয় পর লিখেছেন তীক্ষ্ণ, তির্যক বাক্যবন্ধের বক্তব্য : ‘ক্ষুধিত ইম্পীরিয়ালিজম স্বার্থজাল বিস্তার করাকেই মহত্ত বলিয়া বিবেচনা করিতেছে’ (১৯০৪)। একই প্রবন্ধে তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ : ‘ইম্পীরিয়ালতন্ত্র নিরীহ তিববতে লড়াই করিতে যাইবেন, আমাদের অধিকার তাহাদের খরচ জোগানো, সোমালিল্যান্ডে বিপ্লব নিবারণ করিবেন, আমাদের অধিকার প্রাণদান করা; উষ্ণপ্রধান উপনিবেশে ফসল উৎপাদন করিবেন, আমাদের অধিকার সস্তায় মজুর জোগান দেওয়া। বড়োয় ছোটোয় মিলিয়া যজ্ঞ করিবার এই নিয়ম’ (‘সফলতার সদুপায়’, ১৯০৪)।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এশীয় আগ্রাসনের আরো উদাহরণ টানতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লোয়েস ডিকিনসনের লেখা ‘চীনে ম্যানের চিঠি’র সূত্রে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের ভয়াবহ আগ্রাসী রূপ সম্বন্ধে সতর্ক থাকার আহবান জানান। এ-বিষয়েই স্পষ্ট করে বলেন, ‘ইংরেজ মানব ইতিহাসে হেয়তম যে পাপ করেছে সে হচ্ছে চীনের মতো অত বড়ো দেশের কণ্ঠে জোর করে আফিম ঠেসে দিয়ে। নিজের উদর পূরণের জন্য এতবড় পরহিংসা সভ্যবর্বরতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত।’ প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, ফ্যাসিস্ট ইতালির আবিসিনিয়া দখলের প্রতিবাদে লেখা অসাধারণ কবিতা ‘আফ্রিকা’।

তবে স্বদেশে সংঘটিত অন্যায় সম্পর্কে চৈনিক সূত্র ধরেই লিখেছেন, ‘ইংরেজ আজ হিন্দু মুসলমানের ভিতরকার প্রভেদকে যে প্রশস্ত করে দিলে এও উক্ত প্রকার বিষপ্রয়োগেরই অনুরূপ।’ ভারতবর্ষে সাম্রাজ্যবাদের চতুর খেলা ও তার রাজনৈতিক পরিণাম সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছেন বা বলেছেন তা রক্তাক্ত দেশবিভাগ ও পরবর্তী রাজনীতি সম্বন্ধে তা অবিশ্বাস্যরকম সত্য হয়ে উঠেছে। যেমন হয়েছে প্রশংসিত সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্বন্ধে বক্তব্যে। বিষয়টি বিশদ আলোচনার দাবি রাখে।

‘কালান্তর’-এ পৌঁছে রেনেসাঁসভক্ত রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদ সম্বন্ধে তাঁর উপলব্ধির জগৎ থেকে বিপরীত সত্যটা তুলে ধরেন এই বলে যে, ‘য়ুরোপের বাইরে য়ুরোপীয় সভ্যতার মশালটি আলো দেখাবার জন্যে নয়, আগুন লাগাবার জন্যে।’ সাম্রাজ্যবাদী রেনেসাঁসের ভয়ংকর রূপের উদাহরণ তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ চীন, পারস্য, মায়া সভ্যতার উদাহারণ টেনে, সেই সঙ্গে গণতন্ত্রী আমেরিকার নিগ্রো নির্যাতনের পাশব চিত্রও এঁকেছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদের সাম্রাজ্যবাদী ফ্যাসিস্ট চরিত্র উন্মোচিত হলো ন্যাশনালিজম পুস্তিকায়। সবশেষে জীবন সায়াহ্নে সভ্যতার সংকটে মানব পীড়নের মহামারি পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি ধিক্কারই নয়, অভিশাপ উচ্চারিত হলো রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে। স্বদেশভাবনাকে ঘিরে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চক্রাবর্তন সম্পূর্ণ হলো মৃত্যুর পূর্বাহ্নে।

তবে রাশিয়া ভ্রমণ এবং কথিত গণতন্ত্রী দেশগুলো সফর শেষে রবীন্দ্রনাথ এমন সিদ্ধান্তে নিশ্চিত হন যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার তথা সাম্রাজ্যবাদের ধনতান্ত্রিক রূপটিতে রয়েছে ঘাতক চরিত্র, শ্রমজীবী মানুষ তার শিকার। তাই এ-অবস্থার পরিবর্তন দরকার। আর ইউরোপের শ্রমজীবী মানুষ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যের পর ভিন্ন সূত্রে যদি তাঁর কণ্ঠে এমন কথা উচ্চারিত হয় যে, ‘য়ুরোপে আজ শ্রেণীগত বিপ্লবের লক্ষণ প্রবল হয়ে উঠেছে’, তাহলে তা অবিশ্বাস্যই শোনাবে! শেষ দশকের রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বদেশভাবনার রাজনৈতিক পর্যালোচনায় আশ্চর্য এক মানবতাবাদী যার পক্ষে বলা সম্ভব ‘মানুষকে মানুষ বলে দেখতে না পারার মতো সর্বনেশে অন্ধতা আর নেই। এই বন্ধন এই অন্ধতা নিয়ে কোনো মুক্তিই আমরা পাব না’ (নবযুগ, ১৯৩৩)। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনার নানামাত্রায় এই মানবিক চেতনাই লক্ষ্য অর্জনের প্রধান শর্ত।

 

Published :


Comments

Leave a Reply