রবীন্দ্রনাথ : আনিসুজ্জামানের চোখে

১৮৮৬ সালে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থের ‘প্রাণ’ কবিতায় লিখেছিলেন –
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার এই প্রার্থনা ও প্রবর্তনাকে নিজের জীবনে পূর্ণমাত্রায় আত্মস্থ ও অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি; উত্তরসূরি আনিসুজ্জামানেও সুলক্ষ তারই অবিকল অনুরণন, তাঁর জীবনকৃতি প্রবল প্রতাপে সেই সাক্ষ্যই দেয়। মানবধর্মে উদ্বোধিত ও মানবহিতৈষণায় নিবেদিত বলেই তিনি সুস্পষ্ট অবস্থান থেকে সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্রমাগত বিশ্লেষণ করেছেন সাহিত্য ও সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ইতিহাস, সমাজ ও স্বদেশ; প্রকাশ করেছেন নিজস্ব অভিমত। রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শনে যেমন, তেমনই আনিসুজ্জামানের জীবনবোধেও মানুষ ও ইহজাগতিকতাই প্রধান। ঈশ্বর, ধর্ম ও পরকাল ছাপিয়ে এই অবস্থান উজ্জ্বল ও উচ্চকিত।
আনিসুজ্জামান রবীন্দ্রসাহিত্যের পাঠ প্রথম নিয়েছেন (জগন্নাথ কলেজে) অধ্যাপক অজিতকুমার গুহর কাছে, (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে) অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর কাছে, উল্লেখ পাই তাঁর রবীন্দ্রনাথ : একালের চোখে বইয়ের উৎসর্গপত্রে। তারপর নিরন্তর তাঁর নিবিড় চলা রবীন্দ্রবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক উপান্তে। নানা কোণ থেকে তিনি আলোকসম্পাত করেছেন রবীন্দ্রনাথের নানা দিকে, অবলোকন করেছেন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে, চেষ্টা করেছেন ‘নানা রবীন্দ্রনাথের মালাকে – বিশ্লিষ্ট করে নয় – যতটা সম্ভব, অখণ্ডরূপে দেখতে।’ কারণ তিনি জানান, ‘খণ্ডকে যদি সম্পূর্ণ বলে ভুল করি, তবে তাঁকে জানার সাধনা ব্যর্থ হবে।’
উনিশ শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকচক্রের প্রতিকূলতায় রবীন্দ্রচর্চা যখন বিপন্ন তখন আনিসুজ্জামান কলমে ও কর্মে হয়ে ওঠেন সবিশেষ সক্রিয়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন কমিটির সদস্য হিসেবে চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আয়োজন, ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ১৯ জন নাগরিকের বিবৃতিতে স্বাক্ষরসংগ্রহ ও তা প্রকাশের ব্যবস্থা, ১৯৬৮ সালে প্রবন্ধ-সংকলন রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর লেখালেখির পরিসর অর্ধশতকেরও অধিক। যত লিখেছেন তার অল্প অংশই গ্রন্থবদ্ধ হয়েছে, প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুই। পূর্বোক্ত রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও পরবর্তীকালে সম্পাদনা করেছেন সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ : বাংলাদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং রবীন্দ্রনাথ, এই সময়ে । এসব গ্রন্থে বিভিন্ন রচনায় তিনি তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সাহিত্যজীবন, শিল্পীজীবন, ভাবুকজীবন, সামাজিক জীবন ও আন্তর্জাতিক জীবন; ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজচিন্তা; বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর জীবনবীক্ষা; সৃষ্টিশীল সত্তার পাশাপাশি গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁর কারয়িত্রী সত্তাকে; উন্মোচন করেছেন কবির মানবভাবনার স্বরূপ।
আনিসুজ্জামানের আলোচনার উপজীব্য হয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, কথাসাহিত্য, সংগীত, নাটক, প্রবন্ধ, চিত্রকলা; তাঁর উপন্যাসের নারীচরিত্র, তাঁর অসংগতি, তাঁর দুর্ভাগ্য ও দুর্ভোগ, তাঁর শিক্ষাদর্শ ও শিক্ষা-আন্দোলন, পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, বাংলাদেশে তাঁর মূল্যায়ন, তাঁর উৎসব-ভাবনা, জমিদারির নানা দিক, রাষ্ট্রভাবনা ও জাতীয়তাবোধ, ব্রিটিশরাজের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের টানাপড়েন, তাঁর গণতান্ত্রিক চেতনা, তাঁর নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি, বহির্বিশ্বে তাঁর পূর্বাপর অবস্থান এবং রবীন্দ্রবিরূপতা ও রবীন্দ্রবিরোধিতা প্রভৃতি। এত বিচিত্র বিষয়ে রবীন্দ্রনাথকে জানার একটাই কারণ, ‘তাঁকে জানা ফুরোয় না।’ সেই কবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘তোমার পানে চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের অবধি নাই’, আর আজো আনিসুজ্জামান বলেন, ‘যুগান্তরেও সে-বিস্ময়ের ঘোর আমাদের কাটতে চায় না।’ কিন্তু বিমুগ্ধ বিস্ময় সত্ত্বেও আনিসুজ্জামানের রবীন্দ্রবিশ্লেষণ মুক্ত, নির্মোহ। যুক্তির আলোয় তিনি দেখিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের সকল চিন্তা কর্ম ও সৃজনশীলতার মর্মে মূলত মানুষ – ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’; তাঁর মূলমন্ত্র মানুষ; মানুষের সাধনাই তাঁর আরাধ্য। বিস্তারিত বিচার-বিবেচনার উপসংহারে আনিসুজ্জামানের উপলব্ধি, ‘মানবধর্মের সাধনার আহ্বানই রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্যের সারকথা। তাঁর ঈশ্বরভক্তি, নারীপ্রেম, প্রকৃতিপ্রীতি, স্বদেশানুরাগ, সৌন্দর্যবোধ – সব এইখানে এসে মিলেছে।’ প্রণিধানযোগ্য কিছু প্রতিপাদন উদ্ধৃত করা হলো –
১. কিন্তু সবার আগে তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষে। (শুধু গীতাঞ্জলি নয়)
২. তাঁর কাছে, বিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। (প্রাগুক্ত)
৩. রবীন্দ্রসাহিত্যের মূল বিষয় মানুষ – মানুষের সঙ্গে মানুষের, সমাজের, প্রকৃতির, বিশ্বজগতের সম্পর্কটাই সেখানে মুখ্য, মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক গৌণ। (নানা রবীন্দ্রনাথের মালা)
৪. রবীন্দ্রনাথ যেসব নারীচরিত্র চিত্রিত করেছেন, তাদের মধ্যে যেমন স্থানিকতার পরিচয় আছে, তেমনি আছে চিরন্তন মানবসত্তা। তাই তাদের বিশেষ পটভূমিটি অপসৃত হলেও যা রয়ে যায়, তা সর্বকালীন মানবসত্য। (রবীন্দ্রনাথের নারীরা)
৫. ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ রবীন্দ্রনাথকে পরিচিতি দেয় মরমি কবি বলে। … এর ফলে, রবীন্দ্র-সাহিত্যের বিষয় যে ইহজগৎ ও তার মানুষ – মানুষের চিরকালীন আবেগ-অনুভূতি এবং সমকালীন জীবনের নানারকম ঘাতপ্রতিঘাত – সে কথাটা পাশ্চাত্য জগত বিশেষ করে জানল না। (ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ : রচনা ও অভ্যর্থনা)
৬. চলতে চলতে রবীন্দ্রনাথ মত বদলেছেন, পথ বদলেছেন। ক্রমেই সকল সংকীর্ণতার গণ্ডি ভেদ করে তিনি মানুষের পৃথিবীর নাগরিক হতে চেয়েছেন। (রবীন্দ্রনাথ)
৭. সে চিত্ত বুদ্ধ-খ্রিস্ট-মুহম্মদের মিলন কামনা করেছে আর মনুষ্যত্বের সাধনাকে সবার উপরে স্থান দিয়েছে। (রবীন্দ্রনাথের ধর্ম)
৮. জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ‘সভ্যতার সংকটে’ শেষবারের মতো মানুষের প্রতি কৃত মানুষের অবিচার-অন্যায়ের একটা সূত্রবদ্ধ পরিচয় তুলে ধরলেন এবং মানুষের ওপরেই আস্থা রাখলেন সেই সংকট থেকে মুক্তিলাভের। (সভ্যতার সংকট ও রবীন্দ্রনাথ)
আনিসুজ্জামানের রবীন্দ্রবিষয়ক প্রবন্ধ ছাড়াও অন্যান্য লেখায় বারংবার নানা প্রসঙ্গে নানা অনুষঙ্গে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকি তাঁর স্মৃতিকথায়ও উৎকীর্ণ হয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন একজন মানুষ ‘যিনি সত্যের কাছে, ইতিহাসের কাছে, মানুষের কাছে দায়বদ্ধ’ এবং যিনি ‘সত্য ও ন্যায়, শুভ্র ও কল্যাণের পক্ষে।’ ফলে, আনিসুজ্জামান বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ছাড়া তাই আমাদের চলে না।’