রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রমা রলাঁর মধ্যে সংগীত বিষয়ে কথোপকথন

দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়

রমা রলাঁর জন্ম ফ্রান্সে, ২৯ জানুয়ারি ১৮৬৬ সালে। তিনি ছিলেন একাধারে একজন নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, শিল্পকলার ইতিহাসবিদ এবং একজন মরমি লেখক। ১৯১৫ সালে তাঁর প্রধান উপন্যাস জাঁ ক্রিসতফের জন্য (Jean Christophe) তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, ‘as a tribute to the lofty idealism of his literary production and to the sympathy and love of truth with which he has described different types of human beings.’

একজন মানবতাবাদী লেখক হিসেবে ভারতীয় দর্শনের প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা (‘Conversations with Rabindranath Tagore’ and ‘Mohandas Gandhi’)। স্বামী বিবেকানন্দের রচনা পাঠের মধ্য দিয়ে রলাঁ ভারতীয় বেদান্ত দর্শনের সঙ্গে পরিচিত এবং গভীরভাবে প্রভাবিত হন।

তিনি সরবন (Sorbonne) বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। সংগীত বিষয়ে তাঁর একাধিক গ্রন্থের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো Life of Beethoven, Contemporary Musicians, Musicians of the Past, Handel প্রভৃতি। ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৪৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

১৯২৬ সালের ২৪ জুন ফ্রান্সের ভিলেনেভে (Villeneuve) রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তাঁদের মধ্যে সংগীত বিষয়ে যে-আলোচনা হয়, তারই অনুবাদ এ-রচনাটি।

রলাঁ : আপনি কি গস্নুকের (Gluck) সংগীত শুনেছেন? আঠারো শতকের মানুষ ছিলেন তিনি। আধুনিক ইউরোপীয় কম্পোজারদের মধ্যে তাঁর কাজেই সবথেকে বেশি গ্রিক প্রভাব কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়। সংগীতে তিনি সেটুকুই রেখেছেন, যা স্বচ্ছ এবং সুন্দর, বাকি যা কিছু অতিরিক্ত তাকে কঠোরভাবে বাদ দিয়েছেন। তাঁর আগে ইউরোপীয় সংগীতে মধ্যযুগীয় গথিক স্থাপত্যের মতো একটা ব্যাপার ছিল। প্রাণোচ্ছল উচ্ছ্বাসের প্রাচুর্য যেমন ছিল, তেমনি আবার সবিসত্মার (details) বিবিধ বর্ণনার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও ছিল।

অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে ফরাসি বিপস্নব শুরুর ঠিক আগে আগে গস্নুক সংগীতে যে-সংস্কারসাধন করলেন তাতে ইউরোপীয় সংগীত আবার বিশুদ্ধ লাইন এবং ফর্মে ফিরে আসতে শুরু করল। জার্মান হলেও গস্নুক ছিলেন বোহেমিয়ান, জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি ফ্রান্সে কাটিয়ে গেছেন, যেখানে তাঁর কাজ ভীষণভাবে সমাদৃত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ : ইউরোপীয় সংগীত বিষয়ে আপনার অসাধারণ জ্ঞানের কথা আমি সবসময় শুনে এসেছি। বিঠোফেন, বাখ শুনতে আমি ভালোবাসি। কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আপনাদের সংগীতের বিশেষ অর্থপূর্ণ শব্দগুচ্ছ (Idiom) পুরোপুরি বুঝতে এবং হৃদয়ঙ্গম করতে আমার অনেক সময় লাগে। তরুণ বয়সে ইউরোপীয় সংগীত শুনেছিলাম (পিয়ানোবাদন), ভালো লাগলেও আমি কিন্তু সম্পূর্ণভাবে এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। ইউরোপের অন্যান্য দেশের সংগীতেরও কি তাদের নিজেদের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে? যেমন ধরুন, ইতালীয় সংগীতের কি কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে? ইতালীয় সংগীত কি জার্মান সংগীত থেকে আলাদা?

রলাঁ : অবশ্যই আলাদা। আধুনিক ইউরোপীয় সংগীতের অনেক কিছুই মূলত এসেছে ইতালি থেকে এবং সংগীতের উন্নতির জন্য (development) নানাভাবে আবার তাকে পরিবর্তনও করা হয়েছে। দক্ষিণের সংগীতের মাধুর্য অনেক বেশি, কিন্তু যত আপনি উত্তরে যাবেন সংগীত তত জটিল হয়েছে। ষোলো শতকের প্রাচীন ইতালীয় সংগীতে আপনি সূক্ষ্ম, কোমল পর্দা (lines) এবং আলোছায়ার (shades) ব্যবহার দেখবেন, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেলোডির পরিচ্ছন্ন প্রকাশ। কিন্তু উত্তরের সংগীতে শুধুই আবেগের ছড়াছড়ি। আধুনিক কম্পোজারদের মধ্যে সংগীতে পুসিনির (Puccini) বিরাট অবদান আছে। আবার তাঁর রুচিবোধের অভাবও আছে, আমার তো মনে হয় আধুনিক ইতালীয় সংগীত তাতে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ইউরোপীয় সংগীতেরও ক্ষতি হয়েছে। প্রাচীন ইতালিতে কম্পোজার এবং কবি উভয়েই বিশুদ্ধতার উৎস অনুসন্ধান করে গেছেন।

[রলাঁ এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সংগীত বিষয়ে আরো কিছুক্ষণ আলোচনা হওয়ার পর]

রবীন্দ্রনাথ : একটা প্রশ্ন আপনাকে আমি করতে চাই। শিল্প সৃষ্টির উদ্দেশ্য শুধু আবেগের প্রকাশ নয়, বরং শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ধারা সৃষ্টিতে আবেগকে ব্যবহার করা হয়। সাহিত্য কেবল আবেগের প্রকাশ নয়, আবেগ সেই উপলক্ষ তৈরি করে, যা সৃষ্টিশীল কাজের সম্ভাবনাকে সম্ভব করে তোলে। ‘A Grecian urn’ (Keats) কোনো বিশেষ আবেগের প্রকাশ নয়, আবেগ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারও নয়, এখানে আবেগ (‘A Grecian urn’) কবির মনের সুপ্ত ইচ্ছাকে জাগিয়ে তার প্রকাশ ঘটিয়েছে। ইউরোপীয় সংগীতে কখনো কখনো বিশেষ একটি ভাব প্রকাশের প্রচেষ্টা লক্ষ করি। এটা কি ঠিক? ভাব প্রকাশ করাই কি সংগীতের অন্যতম বিষয়; নাকি এটাই সংগীতের সব?

রলাঁ : মহৎ একজন সংগীতজ্ঞ সবসময়ই ভাবকে বিষয় হিসেবে ব্যবহার করে সংগীতে সুকুমার ধারা সৃষ্টি করেন। ইউরোপে সংগীতজ্ঞদের জন্য সংগীত রচনার প্রচুর বিষয় থাকায় ভাব প্রকাশে জোর দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। মহৎ সংগীত-স্রষ্টার পরিমিতিবোধ অবশ্যই থাকতে হবে, এটা না থাকলে তাঁর সৃষ্টি নষ্ট হয়ে যাবে।

রবীন্দ্রনাথ : Traviata অপেরার কথাই ধরুন। মনে হয় নাকি এটা খুব বেশি নির্দিষ্ট করে একটা ছকে বেঁধে দেওয়া, সবকিছুর বর্ণনা এভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়ে সংগীতকে একটা বৃত্তের মধ্যে বেঁধে ফেলা হয়েছে?

রলাঁ : হ্যাঁ, আমাদের সংগীতের এটা একটা বড় ত্রম্নটি, এই ধারা বিশেষভাবে শুরু হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে, বিঠোফেন (Beethoven), বিশেষ করে ভাগনারের (Wagner) রোমান্টিক সৃষ্টিগুলোর পর থেকে।

রবীন্দ্রনাথ : ভারতে আমাদের সংগীতের ব্যাপারটা একেবারে আলাদা। গায়ক এখানে সংগীত পরিবেশনে অনেকটা স্বাধীনতা নিয়ে থাকেন। চিত্রকলা এবং সাহিত্যে বাইরের (outward) রূপটি নির্দিষ্ট করা থাকে, কিন্তু সংগীতে ভাব প্রকাশের জন্য প্রয়োজন হয় কণ্ঠের, এমনকি যন্ত্রসংগীতেও শিল্পীর হাতের নৈপুণ্যের ব্যবহার হয়, যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় না। একজন গায়ককে অবশ্যই একজন দক্ষ শিল্পী হতে হবে, শুধু সংগীতের দক্ষ কারিগর হলে হবে না। ভারতে সংগীত-রচয়িতাকে অনেকাংশে গায়কের সংগীত পরিবেশন ক্ষমতা বা দক্ষতার ওপর নির্ভর করতে হয়, কারণ তাঁর সৃষ্টিকে একজন দক্ষ গায়কই কেবল তাঁর গায়নশৈলী দিয়ে সম্পূর্ণ করে তুলতে পারেন। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, গায়ক প্রায় সময়ই তাঁর নিজের গায়নশৈলী প্রয়োগ করে সংগীত-রচয়িতার সৃষ্টিকে ঢেকে ফেলেন, বিকৃত করেন।

রলাঁ : হ্যানডেলের (Handel) সময়ে ইউরোপেও এরকম অবস্থা ছিল। প্রাচীন ইতালীয় সংগীতে সংগীত-স্রষ্টারা সবসময়ই তাঁদের সৃষ্টিকে নির্দিষ্ট বা সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ না করে তার ব্যাখ্যা বা রূপায়ণের জন্য গায়কের ওপর ছেড়ে দিতেন। ইতালির জনপ্রিয় কমেডিগুলোতে সংগীত-রচয়িতার ব্যবহৃত সংগীতগুলো নকশা (sketch) ছাড়া কিছু ছিল না। পরিবেশনকারী নিজের ইচ্ছামতো তাকে একটা সম্পূর্ণ রূপ দিয়ে নিজের মতো গাইতেন, কখনো কম্পোজারের সামনেই, আবার কখনো তাঁরই নির্দেশনায় সেই সংগীত পরিবেশন করা হতো। এভাবে প্রতিবার ভিন্ন ভিন্নরূপে সেই সংগীত পরিবেশনের ফলে স্বাভাবিকভাবেই মূল সৃষ্টি থেকে তার অনেক কিছুই হারিয়ে যেত।

রবীন্দ্রনাথ : সংগীতের এটা একটা বিশেষ ব্যাপার, অনেকটাই শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যায়। গায়কের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে, কারণ গায়কই তাঁর পরিবেশনার মধ্য দিয়ে রচয়িতার সঙ্গে যোগসূত্র (living channel) নির্মাণ করেন।

রলাঁ : সে-সময়ে গায়করা ছিলেন ভীষণ সব ক্ষমতার অধিকারী, বিশেষ করে দক্ষক্ষণে। উত্তরের সংগীতে চমৎকার শুদ্ধতা ছিল, উত্তরের ঐতিহ্য (tradition) যতটা সম্ভব সেই শুদ্ধতাকে ধরে রেখেছে।

রবীন্দ্রনাথ : এটাই দরকার। আপনাদের আধুনিক সংগীত এখন সুসংগঠিত (well-organized) এবং একসূত্রে বাঁধা বলেই সে-সংগীত বিশুদ্ধ, কোনো দেশের মুদ্রা যেমন টাঁকশালে (mints) সুরক্ষিত থাকে, তেমনই কৃত্রিমতা, অপমিশ্রণ এবং ভেজাল থেকে মুক্ত।

রলাঁ : কিন্তু আপনার কি মনে হয় না সংগীতের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য সংগীতকে একই জায়গায় বেঁধে রাখা হলে তার নিরবচ্ছিন্ন
যে চলমানতা তা ব্যাহত হয়?

[কিছু সময় পর]

রবীন্দ্রনাথ : আপনি তো জানেন আমি কেবল কবিতা লিখি না; আন্তরিকভাবে আমি সংগীতের প্রতি অনুরক্ত, আমি নিজেও গান রচনা করি। কিন্তু আমি বিস্মিত হই এ-কথা ভেবে, কেন বিভিন্ন দেশের সংগীত নির্মাণের মধ্যে এত পার্থক্য থাকবে? অন্যান্য শিল্পের চাইতে সংগীত অনেক বেশি সর্বজনীন (universal); কারণ সংগীতের আবেদন খুব সহজে সবার মধ্যে সঞ্চারিত (transmit) হতে পারে?

রলাঁ : সব দেশেই সংগীতকে বিভিন্ন স্তর পার হতে হয়। বিশেষ কোনো এক সময়ে যে-পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, তা সংগীতে বিশেষ কোনো পরিবর্তনের কারণে হতে পারে। সংগীতেরও শৈশব, বৃদ্ধি (growth) এবং বিকাশ আছে। প্রথম রচনাটি যে-ধারায় তার প্রকাশের পথ বেছে নিয়েছিল পরে মনে হলো সেটি যথেষ্ট নয়, ভাব এবং প্রকাশভঙ্গির সুচারু সমন্বয়ে পরে আবার তৈরি হলো নতুন একটি নিখুঁত হারমনি (harmony), সবশেষে সুষ্ঠু নির্দিষ্ট একটি আনুষ্ঠানিক প্রকাশভঙ্গি, কিন্তু কোনো একসময় ছকে বাঁধা অতিব্যবহারে ক্লিশে হয়ে-যাওয়া সংগীতের সেই রূপটি হারিয়ে যায় বা ধ্বংসপ্রাপ্ত (decay) হয়। জীবনের চলমানতা আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে নতুন কোনো সৃষ্টির প্রাচুর্য, তখন নতুন করে আবার তৈরি হয় সৃষ্টিশীল কোনো রচনার সম্পূর্ণ সিরিজ বা সেট।

রবীন্দ্রনাথ : সব শিল্পের একই অবস্থা; সাহিত্যেও দেখি নতুন নতুন তাগিদ থেকে নতুন নির্মাণ-কৌশল সৃষ্টি হচ্ছে, কিছুকাল পরে সেই নির্মাণ-কৌশল যা একসময়ে নতুন ছিল তা পুরনো হয়, বহু ব্যবহারে একঘেয়ে হয় এবং তার আর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। মনে হয় এটা যথেষ্ট নয়।

রলাঁ : হ্যাঁ, জীবনও একইভাবে চলে। এক ধারা থেকে অন্য ধারায় চিরন্তন একটা প্রবাহ চলতেই থাকে।

রবীন্দ্রনাথ : সৃষ্টিশীল মন নতুন নতুন নির্মাণ-কৌশল তৈরি করে। তারপর আবার মেধাশূন্য মানুষ এসে শিল্পকে পুরনো মরচে (rusty) ধরা কারাগারের মধ্যে শৃঙ্খলিত করে ফেলে, আবার একটা সময় আসে এই শৃঙ্খল ভাঙার।

রলাঁ : ইউরোপে আমরা এই শেষ পর্বে আছি; মনে হয় আমরা খাঁচার ভেতর বন্দি হয়ে আছি।

রবীন্দ্রনাথ : আপনারা বোধহয় খুব বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক মনোজগতের অধিকারী, জীবনের জন্য যা কিছু অপরিহার্য, মানবিকতা, জীবন-সম্পৃক্ততা তা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

রলাঁ : একটা বৃহৎ যান্ত্রিক সংগঠনের মধ্যে আমাদের সমগ্র জীবন অধঃপতিত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ : প্রাচীন সুন্দর এই ইউরোপের সর্বত্র আশঙ্কার এই চিহ্ন প্রকট হয়ে উঠেছে। সর্বত্র একই মুখোশ ঢাকা কৃত্রিমতা, যা একেবারেই একঘেয়ে এবং শ্রীহীন, তাই প্রত্যক্ষ করছি। ইতালির যে-শহরগুলোতে আমি গিয়েছিলাম দেখলাম তারা ভীষণভাবে আধুনিক হয়ে উঠছে। ফ্লোরেন্স খুব ভালো লাগল, খুব সুন্দর, সেখানে মানুষ ভোগবাদে আসক্তিহীন নিরাসক্ত মানসিকতাকে ধরে রেখেছে, যা আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছে। প্রলোভনমুক্ত ওই নিরাসক্তি ছাড়া জীবনে শিল্প অসিত্মত্ববিহীন হয়ে পড়ে।

রলাঁ : হ্যাঁ, তারা এখনো একটা সহজ-সরল কৃত্রিমতাবিহীন জীবনের মধ্যে নিজেদের বেঁধে রাখতে পেরেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ফ্লোরেন্সবাসী তাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যের কাছে ফিরে যেতে চাইছে। ফ্লোরেন্স যে বৃহৎ এবং মহৎ একটি শিল্পকেন্দ্র হয়ে উঠেছে, তার পেছনে এটাই সম্ভবত গোপন রহস্য হিসেবে কাজ করেছে।

রবীন্দ্রনাথ : প্রথম লন্ডন ভ্রমণের সময়, আমার বয়স যখন সতেরো তখন, আমি প্রথম ইউরোপীয় সংগীত শুনি। শিল্পী ছিলেন মাদাম নিলসন (Madame Nilson)। তিনি ওই সময়ের বিখ্যাত একজন শিল্পী ছিলেন। প্রকৃতিবিষয়ক গানে পাখির ডাক নকল করে তিনি গান গাইতেন। এই অনুকরণ আমার কাছে একেবারেই হাস্যকর লেগেছিল। পাখির ডাকের যে-মাধুর্য মানুষের মনকে পুলকিত করে তাকে গানের ভাবের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে হবে, পাখির ডাক অনুকরণ করে নয়। ভারতের বর্ষাসংগীতের কথাই বলতে পারি। বর্ষার গানে বৃষ্টি পড়ার শব্দ নকল করা হয় না। বর্ষার আগমনীর আনন্দকে গায়কেরা গানের মধ্য দিয়ে শ্রোতার মনে জাগিয়ে তোলেন, বর্ষার রূপ, ছন্দ, আনন্দ গানের সুর এবং ভাবের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে ছড়িয়ে দেন। যে-কোনো কারণেই হোক বসমেত্মর গানে এই গভীরতা থাকে না, জানি না কেন এমন হয়।

রলাঁ : আপনাদের বসন্ত-উৎসব কখন হয়?

রবীন্দ্রনাথ : বাংলায় ফেব্রম্নয়ারির শেষে এবং মার্চের প্রথমে যখন দক্ষিণের বাতাস বইতে থাকে; দিনের বেলা গরম কিন্তু রাত ঠান্ডা এবং মনোরম থাকে। এই সময়ে কৃষকরা মাঠে তাদের চাষের কাজ শুরু করে। প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণেই কি বর্ষার গানে এত মাধুর্য? অথবা এমন কিছু যা বর্ষা ঋতুর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে, জানি না। তবে এটা সত্য, বর্ষাকালেই বেশি করে আমরা বর্ষার গান শুনতে ভালোবাসি, এ-গানের সঙ্গে একাত্ম হতে পারি; এসব গানের সুর আমাদের মনে বর্ষা ঋতুর আনন্দ এবং শিহরণ এনে দেয়। এরপর বসন্ত আর গ্রীষ্ম আসে তার নিজস্ব রূপ নিয়ে; সে-গানের সুরের সঙ্গে আমাদের নিবিড় যোগ থাকলেও বর্ষার গানের মতো সে-গান আমাদের তত গভীরভাবে নাড়া দিতে পারে না।

রলাঁ : গানের সুরের পার্থক্যের কারণে হয়তো এটা হতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ : একটি কবিতা তার নিজের ভাষার প্রকাশভঙ্গিতে বিশেষ একটি সূক্ষ্ম ভাব প্রকাশ করে। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের অর্থের বিশেষ তাৎপর্য বিদেশি একজন পাঠকের কাছে কখনোই বোধগম্য হবে না। হতে পারে, সেটি ভীষণ সুন্দর একটি কবিতা; কিন্তু শুনে সে-কথা বলা যাবে না, বলা সম্ভবও নয়, এমনকি বারবার পড়ার পরও সম্পূর্ণভাবে তার অর্থ উদ্ধার সম্ভব নয়। কারণ ওই ভাষার বিশেষ সেই প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে তার সংশিস্নষ্টতা কিংবা পরিচয়ের অভাব। যেমন কিট্সের কবিতার এই পঙ্ক্তি দুটি –

Charm’d magic casements, opening on the foam

Of perilous seas, in faery lands forlorn.

বাংলায় অনুবাদ করলে এর কোনো অর্থ দাঁড় করানো যাবে না, বাঙালি পাঠকের কাছে তাই এর কোনো তাৎপর্যও ধরা পড়বে না – ‘Charm’d magic casements, opening on the foam/ Of perilous seas, in faery lands forlorn.’ এই শব্দসমষ্টি যা একটি বাক্যাংশ গঠন করেছে তার সঙ্গে পরিচয় না থাকার কারণে তা বোঝা কঠিন হবে। অথচ শব্দ দিয়ে সাজানো বাক্যটি অর্থময় গীতময় হয়ে উঠতে পারে, যদি দীর্ঘদিন সেই কবিতায় ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে আমাদের পরিচয় থাকে।

রলাঁ : এরকম চিত্রকল্প (image) ইউরোপীয় সংগীতেও দেখা যায়, যেমন বাখের (Bach) ব্যবহৃত চিত্রকল্প, যা সতর্কতার সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে শুনে তারপরই বোঝা সম্ভব। তাঁর সংগীতের সৌন্দর্য অনেকটাই এসেছে সতেরো এবং আঠারো শতকের প্রথম দিকের নির্দিষ্ট কিছু ফর্ম (form) অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁর সংগীতে ব্যবহারের কারণে। চারণসংগীতে (Pastoral) তিনি যে ধরন (groupings) বারবার ব্যবহার করেছেন তা আজো ব্যবহৃত হচ্ছে। Pastoral অন্য সংগীতেও যদি এই ধারার (groupings) ব্যবহার হয় তাহলে সেটাও কিন্তু সংগীতে গ্রাম্য জীবনের আবহ গড়ে তুলতে পারে। মনে হয় বর্ষাসংগীতের সঙ্গে আপনার ভালোলাগার যে-সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা এই সংশিস্নষ্টতার কারণেই।

[কথোপকথনের এই পর্যায়ে রলাঁ ভারতীয় সংগীত বিষয়ে আগ্রহ দেখান এবং বহু প্রশ্ন করেন]

রলাঁ : আপনাদের প্রধান বাদ্যযন্ত্রগুলো কী?

রবীন্দ্রনাথ : বীণা। বীণার আওয়াজ খুবই পবিত্র; বীণার সুরে বেহালার মতো নমনীয়তা নেই, কিন্তু বীণা তার সুরের পবিত্রতার মধ্য দিয়ে আমাদের সংগীতের মেলোডির বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তোলে।

[কবি তখনো সাহিত্যের ভাবের অনুষঙ্গে মগ্ন ছিলেন তাই তিনি আবার কিট্স প্রসঙ্গে ফিরে আসেন]

রবীন্দ্রনাথ : কিট্সের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করা না গেলেও আমি তাঁর কবিতার মাধুর্য, অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারি। শুরুতে তাঁর কবিতার সঙ্গে একাত্ম হতে না পারলেও পড়ার পর কবিতার ভাব এবং কোন পরিস্থিতিতে এই কবিতা তিনি লিখেছিলেন, সেটা জানার পর তাঁর কবিতা উপভোগে কোনো বাধা থাকে না। আমরা তাঁর কবিতার স্বাদ সহজেই গ্রহণ করতে পারি। ব্যক্তিগত প্রকাশভঙ্গির স্বকীয়তা কিংবা ভৌগোলিক অবস্থানের দূরত্ব পার্থক্য রচনা করলেও কবিতায় এমন কিছু থাকে, যার আবেদন সর্বজনীন। সঠিক শিক্ষা এবং নিবিড় পাঠের অভিজ্ঞতা যদি থাকে তাহলে সবাই কবিতা উপভোগ করতে পারেন। বিদেশি একজন শ্রোতার কাছে ভারতীয় সংগীতের যে আবেদন শিক্ষিত একজন শ্রোতাই কেবল পারেন তা গ্রহণ করতে।

রলাঁ : সংগীতের সেই অংশ যা শুধু বাহারি বিনোদনের জন্য রচিত তা থেকে দূরে থাকতে হবে; বিশেষ বিশেষ সময়ে সংগীতে এরকম হালকা, মন-ভোলানো, বিনোদনমূলক কিছু চাল (passing fancy) ব্যবহৃত হয়, যা সংগীতের গভীরতাকে নষ্ট করে।

রবীন্দ্রনাথ : চিত্রকলা কিংবা পস্নাস্টিক শিল্প (Plastic art) যেসব উপাদানে তৈরি হয় তা সাধারণভাবে সবার পরিচিত হওয়ায় সহজে সবাই সেটা বুঝতে পারেন। কিন্তু সংগীতে ব্যবহৃত শব্দ সবার কাছে সেভাবে বোধগম্য না হওয়ায় শিল্প হিসেবে সংগীতের সমগ্র বিষয়টিই একজন বিদেশির কাছে দুর্বোধ্য লাগে। একজন বিদেশি যত সহজে অন্য শিল্প বুঝে তার প্রশংসা করতে পারেন, সংগীত পুরোপুরি বুঝে, উপলব্ধি করে তার প্রশংসা করা তাঁর জন্য ততটাই কঠিন হয়।

[কিছুক্ষণ পর কবি শিল্প এবং সাহিত্য-সৃষ্টিতে প্রেরণার উৎস (উদ্দীপনা) বিষয়ে কথা বলেন]

রবীন্দ্রনাথ : সব শিল্প, কবিতা, চিত্রকলা অথবা সংগীত-সৃষ্টির শুরুর মূল প্রণোদনা মানবশরীরে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দের দোলার মতো স্বাভাবিক, এই ছন্দ সবার মধ্যে সব দেশে কার্যকর – এজন্যই তা সর্বজনীন। তা আমি বিশ্বাস করি, শরীরে রক্ত চলাচল এবং নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দের দোলার মতো সংগীতশিল্পীরা তাঁদের সংগীত-সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ হবেন। বিভিন্ন দেশের সংগীতের চারটি সুর নিয়ে যদি তুলনামূলক একটি আলোচনা করা হয় তাহলে চমকপ্রদ একটি তথ্য বেরিয়ে আসবে। যে-দেশের সংগীত যত উন্নত তা বোঝাও তত কঠিন, ভেতরের অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্য উদ্ধার করাও একটি দুরূহ ব্যাপার।

 

* সংগীতচিন্তা গ্রন্থে (বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা) রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যে তিনজন মনীষীর সংগীত বিষয়ে আলাপ-আলোচনা গ্রন্থিত হয়েছে তার মধ্যে রমা রলাঁ অন্যতম। অন্য দুজন আলবার্ট আইনস্টাইন এবং এইচ.জি. ওয়েল্স্।

* অ্যালেক্স অ্যারন্সন ও কৃষ্ণ কৃপালনী কর্তৃক সম্পাদিত Rolland and Tagore (Visva-Bharati, 1945) গ্রন্থ থেকে আলোচনাটি সংগীতচিন্তা গ্রন্থে গৃহীত। r