রশীদ করীমের উত্তম পুরুষ

শহীদ ইকবাল

উপন্যাসের আদর্শটিতে আচ্ছন্ন তার শিল্পরূপ – এমতে উপন্যাসের শিল্পরূপ উপন্যাসশিল্পকে নির্মাণ করে, প্রতিশ্রুত করে তোলে। আর কাহিনিগদ্য তার নির্ণায়ক। সেটি বলীয়ান হয় পরিস্রুত আধুনিক উপাদানে। বাংলা ভাষা তাকে স্পর্শ করে স্মর্তব্য আধুনিকতায়। রশীদ করীমে (১৯২৫-২০১১) তা ধৃত বিশ শতকের মধ্যভাগে  – অনেক আর্থ-সাংস্কৃতিক প্রতিকূলতায়। বলছি, বাঙালি মুসলমান মনে, এবং এতদ্সংশ্লিষ্ট আখ্যায়। কহিনিগদ্যের প্রস্ত্ততিবীক্ষায় – সমাজের ‘ব্যক্তি’ সংবাদ, পুঁজিসম্ভূত আচরণ, প্রগতি-উপচার উনিশ শতকের আখ্যানকারগণ ইঙ্গিতে পেয়ে গেলেও ক্রমশ তা দ্বিধা কাটিয়ে দ্বন্দ্বকে স্বতন্ত্রগুণে তুলে আনেন। কিন্তু তা শিল্পরূপ সর্বাঙ্গীণতায় মাত্রামাফিক পৌঁছাতে পারে না। বোধকরি তাতে বস্ত্তনিরপেক্ষ বা সময়নিরপেক্ষ কৌশলসমূহ অনায়ত্ত থাকে। ক্রমপর্যায়ে সে তপ্ত পরিক্রমা কার্যকর হতে থাকে, পেতে থাকে কালখন্ডের নির্ধারিত প্রবাহ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) ও রুশ বিপ্লবের (১৯১৭) সমাজতন্ত্রগরিমা কায়েমি হয়ে উঠলে ব্যক্তি-কাঠামো কাঙ্ক্ষিত বলয়ে দ্বন্দ্বাত্মক সিদ্ধিতে দাঁড়ায়। কাহিনিগদ্যের শিল্পরূপ তাতে ছায়া ফেলে, সময়খন্ডে আটকায়, ভেতরের রূপরেখায় আত্মময়-আপনে পৌঁছায়, মন্ডনশৈলীতে থিতুরূপে ধরা দেয়। এক পর্যায়ে পূর্ববঙ্গের মুসলমান মন ঐতিহ্যিক ধারায় মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর বা ত্রৈলোক্য-অমিয়ভূষণ-প্রবোধ-সতীনাথের শিল্পধরনে রাজনীতিরমণ-দৃকপাত, দ্যোতিত করণকৌশলে বিক্ষুব্ধ ক্ষুধা-দুর্ভিক্ষ – সবটাই বিশ্বযুদ্ধ-কাঠিন্যে কর্কশ কুন্ডলায়িত, ক্ষাত্র-তৃষায় নির্মম। তারপর উপায়হীন আকরণে গদ্য ‘অভিভূত’-ব্যক্তিকে এক অপার ভিন্নতায় বর্ণময় করে তোলে : ‘একজন উত্তম পুরুষ প্রথম বচনে এই কাহিনি লিখেছেন। উপন্যাসের আঙ্গিক হিসেবে এই কৌশলটি অভিনব বা মৌলিক নয়, এমনকি এ বাংলা সাহিত্যেও নয়।’ কেমন সে? একাকী থাকতে ভালোবাসে। ভালোলাগাটুকু নিজের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানমনে বিধৃত এ-কাহিনিগদ্য। এ ব্যক্তিটুকু নিজের মর্জির ওপরে নির্ভরশীল। পুর্ব-বাংলার বাঙালি মুসলমান মনে বিধৃত এ কাহিনিগদ্য। এ ব্যক্তিটুকু সংশয়কাতর, ভয়ার্ত, সংস্কারাচ্ছন্ন, বৈপরীত্যময়, উদ্ভিন্ন, দ্বিধাসঙ্কুল। এ প্রস্তাবনায়, এরূপ চরিত্র, এবং এ-প্রচ্ছদপটে কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নকাতর কাহিনি নিয়ে হাজির রশীদ করীম। এটা বিরল, ওই সময়ে। উপন্যাসটি লেখা ১৯৬১-এ, কাহিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন – এ- বঙ্গদেশের। নিটোল আঙ্গিক। ভিন্নতরও বটে। কীভাবে? তার প্রামাণিক উত্তর নিয়েই বক্ষ্যমাণ আলোচনা।

কাহিনিগদ্যের প্রস্ততিকাঠামো এবং ক্রমবিকাশে আটকানো আমাদের উপন্যাস। বোধকরি তা তাবৎ ফিকশনের ইতিহাসের সঙ্গেই বাধা। এরূপে আমাদের হয়ে-ওঠা পর্বে রশীদ করীম দুর্মর – কয়েকটি লেখায়।

প্রাসঙ্গিকভাবে উত্তম পুরুষ সর্বোচ্চ মর্যাদার। উত্তম পুরুষে ‘শাকের’ বিবৃত, সে লেখক নিজেই, নিজের স্বপ্ন ও তার অনুসন্ধান। কী তার ইচ্ছা! কোনটি তার দৃষ্টিকোণ (point of view)। কীভাবে সে কাহিনিগাত্রে উঠে আসে। আদৌ কি কোনো গদ্য আছে তখন! বা তা কি অতীতচারি, বা অতীতবেদিতার ভাষ্য? এক সময় উপন্যাস তো ছিল পাশ্চাত্যানুসারী – তা এখন নেই, রোমাঞ্চের প্রাবল্য নেই, সবই এখন একপ্রকার নিয়ামকে বাঁধা। শাকেরও তো তাই! কিন্তু কেমন সে? বলে নিয়েছেন লেখক : ‘গল্প বলাই গল্পলেখকের একমাত্র কাজ নয়। তাকে কিছু কিছু জীবনের কথাও বলতে হয়।’ আরো এগিয়ে বলি, সেটি শ্রেণিকাঠামোর ভেতরে থেকেই। জীবনটি নির্ণীত আর তা শ্রেণিকাঠামোতেই, মধ্যবিত্ত-সম্প্রসারিত পুঁজির বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত শাকের, মুশতাক, কাঞ্জিলাল, শিশির, শেখর বা এদের পূর্ব প্রজন্ম; ৩৩ সংখ্যক কোমেদান বাগান লেনের বাড়ির খান বাহাদুর আবদুস সানী। ডিটেলে তার বিবরণ। ভঙ্গুর সামন্ত সমাজ, পুনর্বিন্যস্ত ব্যক্তির স্তর-কাঠামোয় আসীন। সে-রূপে ব্যক্তির বিন্যাস। নতুন ফর্মে সেটির অন্তর্বয়ন, অসাধারণ সে-কাঠামোটি : সংলাপে উক্তিতে নাটকীয়তায় আধুনিক ও সংহত। বহুবঙ্কিম রেখাত্মক। পূর্বতন সাহিত্যধারায় সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে দ্রুততায় তাতে যুক্ত হয়েছে ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার বা ব্যক্তিবিবরণের প্রয়াসে ‘বস্ত্তনির্মাণক্ষমপ্রজ্ঞার’ সৃষ্টিসম্ভার :

(ক) আমার তখন যে বয়স সেই বয়সে এমন তলিয়ে চিন্তা করার মত বুদ্ধি পরিণতি থাকার কথা নয়। কিন্তু কতকগুলি সামাজিক অভ্যাস, রীতিনীতি আদব-কায়দার পিছনে এমন-ধারা অনুচ্চারিত কতকগুলি কারণেই কাজ করতে থাকে। এতো ভালই যে রীতিনীতিগুলি এই কার্য-কারণের সূত্র ধরেই অগ্রসর হয়। তবু সেদিন বড্ডকষ্ট পেয়েছিলাম। না হয় আমার পকেটের পাঁচটি টাকাও আমার নিজের নয়, তবু আমার বিল শোধ করতে দিলে কি আর এমন ক্ষতি হতো।…

(খ) নিয়মিত এই নিদারুণ পরিহাসকে হাসিমুখে মেনে নিতে পারে ক’জন। বাইরে বিড়ম্বিত হয়ে, অন্দরে বিড়ম্বনার সৃষ্টি করাই অধিকাংশ লোকের অভ্যাস হয়ে যায়। তাদের শক্তির সমারোহ শুরু হয় বাড়ীরই লোকজনদের উপর, নির্ভরশীলদের উপর।  তখন বাড়ীর কুকুরটি পর্যন্ত ঘেউ ঘেউ করতে সাহস করে না – টিকটিকিগুলি আওয়াজ করতে ভয় পায় – ঘড়ির টিকটিক শব্দ এক প্রচন্ড বেয়াদপির মতো মনে হয়।

(গ) সেলিনার রূপ, তার যৌবন, তার নির্মম আচরণ, তার নির্বোধ ক্রোধ সবকিছু মিলে তাকে এক অপার্থিব প্রাণী বলে মনে হতো। তার অহঙ্কার যতই দুর্বিনীত হোক, তার মধ্যেও এক স্পর্শাতীত সৌন্দর্য এক অপ্রতিরোধ্য মাধুর্য ছিল। কিন্তু একটি অপ্রত্যাশিত মুহূর্তের এক অসতর্ক কথায় সে আমার বড়ই কাছাকাছি নেবে এলো। তাকে ভয় করবার, সমীহ করবার, পৃথক মনে করবার যেন আর কোন কারণই থাকল না।

এরূপ প্রশ্রয়টি উপন্যাস-শিল্পরূপে বিভাগোত্তর পর্বে ভিন্ন বার্তা বহন করে। যে-জীবনের কথা স্থানিক অন্তর্বয়নে প্রদান করেন লেখক, তা ‘ট্রুথ টেলারে’র। শাকেরের বেড়ে ওঠা, বিচিত্র অভিজ্ঞতায়, নিজের আগ্রহী অভিজ্ঞতা, নির্মোহ সে দৃষ্টিকোণ, নিজেকেই সে তুলে আনে, নিজের অন্তর্খনন; অতঃপর আসে বড় পরিসরে – বন্ধু মুশতাকের বোন সেলিনা। সেলিনাকে পেয়ে তার মনঃস্রোত, মন-কাঠামো, পুনর্গঠিত মনন; এবং তাকে লগ্নী করে বিবর্তিত আর্থ-সমাজ পরিবেশিত। সে-পরিবেশনে গুরুতর কালখন্ড ও বিধৃত জনতা। সেটিতে ব্যক্তি নির্বিকল্প নয়। ব্যক্তি শাকেরের/ ‘আমি’র ভেতর দিয়ে। যেটি ত্রিকালসঞ্চারী। এ দৃষ্টিকোণ এক ধরনের দ্রুততা দেয় কাহিনিকে, পাঠক ট্রিটমেন্টে পড়ে।  পৃথক ‘ফর্মাল রিয়ালিজমে’র প্রকরণে ‘as auch as’ রূপে কহিনিবৃত্ত নির্মাণ করে। শাকের কেন্দ্রে থেকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ [‘স্টেট্সম্যানের বিশেষ সংখ্যা। খবর : জাপানিরা পার্ল হারবারে বোমা ফেলেছে – যুদ্ধ ঘোষণা না করেই’, ‘সেই রোববার দিন সকালবেলা খিদিরপুরে বোমা পড়ল, তারপর থেকেই আতঙ্ক শুরু’, ‘- কলকাতায় নাকি বোমা পড়বে। আমরা সকলেই তাই আববার কাছে মাদারীপুর চলে যাচ্ছি’], এ-কারণে দুর্ভিক্ষ, কালোবাজারি, দুর্ঘট, দাঙ্গা। শাকের-সলিলকে দেখে, তার অবক্ষয়ী রূপ, ভোগলালসা, পুঁজির প্রতিক্রিয়াশীল বা আগ্রাসী অস্থিরতা  –  শেখরের পরিবারকে ঘিরে, ‘ফর্মাল ট্রিটমেন্ট’; উদ্ধৃতি : ‘আরে থো তোর নীতিকথা। ঢের ঢের নীতিকথা … আমিও সলিল চাটুয্যে, দেখে নেব’ – শাকের বলছে : রাগে আমার শরীর কাঁপছিল। কিন্তু অসহায় ক্রোধে নিরুপায় হয়ে বসে থাকলাম। একবার ভাবলাম উঠে চলে যাই। কিন্তু কে যেন শিকল দিয়ে আমার হাত- পা বেঁধে রেখে দিয়েছে, কিছুতেই নড়তে পারলাম না।’ এতে শাকেরের অন্তর্মুখিনতা, আত্মতা, আত্মঅবয়ব, পলায়নমনস্কতা, অক্রিয়-আচরণ লক্ষণীয়। মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক আড়ষ্টতায় আপ্লুত শাকের। শাকেরের প্রতিচিত্রও এতে পরিশ্রুত। কাহিনিবৃত্ত শাকের বয়ানে পরিচালিত, শাকের তারও পরিবেশনায় মগ্ন, দ্বিধা-সংশয়-আত্মমুখিনতা তার, সেটিরও ব্যক্তির ভেতরে-বাইরে, ইচ্ছা বাসনার রূপ, প্রেম-প্রণয় ব্যক্তিত্বে বহাল এবং সর্বসাকল্য প্রকাশমান। ভঙ্গি বর্ণনাত্মক বা মনঃস্রোতময় নয় শুধু, সংলাপময় এবং আধুনিক মননঋদ্ধ। ব্যক্তি-নির্মিত রশীদ করীমের লেখায়, চিহ্নিতও বটে। সেক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত ব্যক্তির তথা শাকেরের প্রণয়রূপটি সেলিনা বা চন্দ্রার ভেতর দিয়ে প্রকটিত।

ত্রিকালসঞ্চারী চেতনায় নিছক মুদ্রিতব্যক্তির তর্পণ নয়, তাপিত ব্যক্তিসমগ্রতায় সান্নিধ্যময়। এতে কোনো অংশে স্বপ্ন বা ইনার চেতনার রূপময় প্রকাশ আছে। সেটি অন্য কোনো উপন্যাসকারের মতো নয়, বাংলাদেশ উপন্যাসের প্রথম পথচলায় তা ‘দুর্লভ উদ্ধার’ই বলতে হয় : ‘সেই রাত্রেই এক স্বপ্ন দেখলাম – এক আশ্চর্য স্বপ্ন। স্বপ্নটা এরকম … ঘুম ভেঙে দেখলাম আমার গোটা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। অদ্ভুত স্বপ্ন! এমন স্বপ্নও লোকে দেখে…।’ ইনার রিয়ালিটির একটি রূপ প্রবলভাবে দীর্ঘ বর্ণনার ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয়। চন্দ্রা এবং শাকেরের পারস্পরিক সম্পর্কের ভেতর মান-অভিমান বা আকর্ষণের প্রকাশ সেখানে বিধৃত। এছাড়া ব্যক্তিসঞ্চারী বাস্তবানুগ পিকটোরাল ট্রিটমেন্টেও এক গভীর ও নিরবচ্ছিন্ন চেতনায় প্রবাহিত :

সেদিন রাত্রের কথা পরিষ্কার মনে আছে, যাকে বলে পুলকিত জ্যোৎস্না মানুষের মাথা দালান-কোঠা,  গাছ, পালা সবকিছুর উপর তারই বন্যা নেমে এসেছে। যুদ্ধের বাজার, তাই রাস্তার আলোগুলি লাইটিং রেস্ট্রিকশন’ অনুসারে অর্দ্ধ অবগুণ্ঠিত করা হয়েছে। তাই পূর্ণ চন্দ্রের সম্পূর্ণ রূপটাই আজ এভাবে চোখে ধরা পড়ল। পথে লোকজন চলাফেরা করছে, গাড়ী ঘোড়াও নেহাৎ কম নয়, গাছপালাগুলিও কেমন যেন সলজ্জ সঙ্কোচে এক পাশে সরে দাঁড়িয়েছে। এ সব কিছুই আমার চোখে স্বপ্নে দেখা দৃশ্যগুলির মতোই অপার্থিব মনে হচ্ছিল। পৃথিবীতে যে এত শান্তি থাকতে পারে তা কল্পনাতীত। চতুর্দিকে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি বিরাজ করছে কিন্তু তাও যেন কেমন অবাস্তব মনে হচ্ছিল।

এতে প্রবহমান চেতনায় ব্যক্তির ভেতরসত্তার স্বরূপটি চিহ্নিত, প্রকৃতি-আলো-পারিপার্শ্বিকতা প্রতিবিম্বিত হয়ে তাতে সম্মিলিত দৃশ্যচিত্রের ইমেজ তৈরি করে, দৃষ্টিকোণের আবিলতা তুচ্ছতার রঙে বৃহৎ বর্ণিল আভাময় – সূক্ষ্মতায় তা বর্ণিল, দ্বিধায়-সংশয়ে সামগ্রিক এবং পূর্ণতায় শীলিত।

 

দুই

এমতে পর্যাপ্ত হওয়া যায় রশীদ করীম কী ধরনের শিল্প করেছেন, তখন তাঁর কহিনিটি কী? বালিগঞ্জের ফুটবল ম্যাচ, ‘আমি ছিলাম রেইনবো ক্লাবের ‘লেফট ইন’ – দলের একমাত্র মুসলমান খেলোয়াড়’। সে-খেলার মাঠে দুই গোল করা মুশতাক এবং মুশতাকের পরিচয় ও তার পরিবার, সেখানে শাকেরের যাতায়াত শুরু, পরম নির্ভরতায়। পরিবারপরিজন, দুই পরিবার শাকের-মুশতাক, তার ভেতরে সেলিনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ক্রমশ। খুব কিছু পরম মমতার স্নেহের বিষয়ও দাঁড়ায়, ঐতিহ্যিক বা ঐমতো সমাজ-কাঠামোটি ধরার জন্য। পাওয়া যায়, অনিরুদ্ধ অনুভব, কাছের-একান্তের-ভেতরের। আমি হলেও তা ম্যাক্রো – সামষ্টিক, সবার – সার্বিক কথকতা। নিজের বলেই এগোয়, দৃষ্টিপাতে জীবনের জয়সূচক বারতা। ‘আমিও এমন ভাব করতাম যেন তাঁকে দেখিনি; আনমনে গাছের পাতানড়া দেখছি। মায়ে-পোয়ে এইভাবে ফাঁকি চলত।’ নিজেরই অমোঘ আরতি : এইভাবে আমার দিন কাটতে থাকে। এক এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এক এক দিনে এক এক বছর করে বয়স বাড়তে থাকে, – ‘as the narrative continues, situation after situation develops in which individuals mustbe experiencing the intensest emotions’-স্বীকারোক্তি শাকেরের, মধ্যবিত্ত ক্ষয়িষ্ণু চিত্তের। ক্রনলজিক্যালি বাড়ন্ত চরিত্রের রূপ, পূর্ণায়ত হয় সেলিনা-সান্নিধ্যে, তার ভেতরের সূক্ষ্মতায়, ব্যক্তিত্বের গঠনে, বিকাশে, প্রতিশ্রুতিতে। একই  সঙ্গে তার ‘developmental’ রূপ :

আমার তখন যে বয়স সেই বয়সে  এমন তলিয়ে চিন্তা করবার মত বুদ্ধির পরিণতি থাকবার কথা নয়। কিন্তু কতকগুলি সামাজিক অভ্যাস, রীতিনীতি আদব-কায়দার পিছনে এমন-ধারা অনুচ্চারিত কতকগুলি কারণই কাজ করতে থাকে। এতো ভালই যে রীতি নীতিগুলি এই কার্যকারণের সূত্রে অগ্রসর হয়।

অতঃপর উপন্যাসে আরো ঘনিয়ে আসে পারিবারিকতা বা দেশজ ভাবনার ভেতর দিয়ে উত্তরোত্তর জীবন-নিরীক্ষার উদ্ভাসন – অপেক্ষায় অনিমা-সামাদ, বালীগঞ্জ-টালিগঞ্জ-কলকাতার নগর-নাগরিকতার (সিনেমা, আড্ডা, কফিহাউস, রেস্টুরেন্ট)  অ্যাডভেঞ্চার, আকস্মিকতা, বিস্ময়বোধ। শাকেরের ইঙ্গিতে উঠে আসে তারই অবভাস তাঁর বাবা। বাবার আচরণের, শাকের নির্লিপ্ততায় প্রকাশ – বিপুল পরিভ্রমণে, এন্তার সব – শ্রীমন্ডিত সে-বিবরণ, বাঙালি মুসলিম এক হাকিমের শান-শওকত জৌলুস, অবসরের পর ক্ষেদ, তাইতো অন্দরের ভাবগাম্ভীর্য, অতল উষ্ণতায় কঠিন ব্যক্তিত্ব-চিহ্ন, যে-কারণে শাকের এক পর্যায়ে সমস্ত সামন্ত রূপটি বিপুলান্ত করে তোলে। ওই সানী  – ‘খান বাহাদুর’, তুমুল বারতায়  তাকে প্রতীকায়িত করা :

ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। জানলার গরাদ ধরে আমি আর আম্মা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম, জানলার বাইরে শূন্য দৃষ্টি মেলা। যেন ঘোড়ার ক্ষুরের মিলিয়ে যাওয়া শব্দটুকুর দিকেই তাকিয়ে আছি। সেই টুকুই ধরে রাখতে চাই।

আরো সেটি মহান হয়ে ওঠে কোমেদান লেনের বাড়িতে, সানী সাহেবের ‘presenting the inward life’ – ‘ওই দাঁড়াবার ভঙ্গিটুকুর মধ্যে এক অব্যক্ত কাঠিন্য, এক অনুচ্চারিত ঔদ্ধত্য’। অতঃপর ‘দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি অপেক্ষমাণ ব্রুহামে গিয়ে উঠলেন। জুতা মোজা প্যান্ট-শার্ট আর গ্যালিস পরা দুই ছেলে একপাশে, খান বাহাদুর একপাশে। মাঝখানে পায়ের কাছে বসে আছে বাড়ির এলসেশিয়ানটি।’ এটিতে ধরা পড়ে ancient & honorable history-র ‘mood of mental process।’  এমনটিই এ-উপন্যাসের ‘pivotal point’ – আকর্ষণীয় ‘পাড়ার রাজা চলে গেল’, দুর্মর চেতনায় দাঁড়ায় এরূপ প্রকাশভঙ্গি, ‘রাজা’ – ছিলই তো সে, চলে গেল, বলেছি ‘honorable history’ একটু মিথিক রঙেরও বটে। সর্বময় চৈতন্যে যার তুমুল অভিষেক।

‘ব্রুহামের চাকা ঘুরতে থাকে। বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়’, উপন্যাসের কাহিনিও গড়ায়, সম্মুখে। বড় হয় শাকের – বাড়ে তার ব্যক্তিত্ব, অনেকের সংস্পর্শে; অনেক অভিজ্ঞতায়। নাইন থেকে টেন। সময়ের প্রবাহে দাঙ্গা-যুদ্ধ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম-হিন্দু সম্প্রদায়গত তাপ-প্রতাপ বাড়ে। ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার, বাদ-প্রতিবাদ, তবু মানুষ-ইঙ্গিতটি প্রধান হয়ে ওঠে। জীবন-যাপনের কাহিনি বিপুল আস্থা অর্জন করে। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠে দাহ, অনুকরণসিদ্ধি – ‘মাইমেটিক’। অবশ্যই তা ‘রিপ্রেজেন্টেশনাল’। একরকম সময়কে বা প্রতিবেশকে প্রতিতুলনীয় করে তোলে, যা ইমেজে আর ইঙ্গিতে ভরপুর। মধ্যবিত্তের সারাৎসার, এবম্বিধ রূপটি আমরা পেয়ে যাই। গোটা সময়ের প্রবাহে, সময়চিত্রের নিগড়ে, ব্যক্তি প্রতুল বা অপ্রতুল আবহটি চিনে নেওয়া চলে। প্রকৃত সত্যটি বর্ণনায় তৈরি হয়, নিবেদিত হয়, রোমাঞ্চে-প্রণয়ে, ব্যাকুলতায়, ছড়ানো অবক্ষয়ে, প্রতিকৃতির বিকৃতিপনায়। শাকের তা প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়, সাক্ষ্য দেয় আবার তা উপেক্ষিতও হয়। এসব ছল, পেছনটান, পিছুহটা, উন্মূলতা, পুঁজির ক্রূরতা, বিনাশী বুঁদ। রশীদ করীম অনাদ্যন্ত হয়ে ওঠেন এরূপের বর্ণনায়, তীক্ষ্ণ রসবোধের দ্যোতনায়, জীবন পরিতৃপ্তির বিলাসে। এটি উত্তম পুরুষের সন্দেহাতীতভাবে একটি সাহসী পদক্ষেপ, এবং নিশ্চয়ই ষাটের উপন্যাসশিল্পের বাস্তবতায়। দাঙ্গার দাহ, বিশ্বযুদ্ধের তান্ডব, ব্যক্তির আত্মকূন্ডলায়ন, ‘মুসলিম’ বাঙালির কলকাতা-নিবাস ও তার মনস্তত্ত্ব, ঘোরতর বন্ধুর মানবতার-সহপাঠীয় ক্রিয়া, সংলাপে-কথাকথায় উত্তুঙ্গ প্রতিবেশী নির্ণয়। যুদ্ধের বাজার, আঙুল ফুলে কলাগাছ, মদ্যপায়ী মাতাল, গুজব, মুনাফাখোর – এসবের ঘোর পেরিয়ে শাকের বলে : ‘আজ রাত্রির ঘটনাগুলো চিন্তা করতে করতে এক সময় ট্রামে উঠলাম, তারপর বাড়ী পৌঁছলাম। নিদ্রিত গৃহের শান্তি অব্যাহত রেখে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। সেই রাত্রেই একটি আশ্চর্য স্বপ্ন দেখলাম।’ এ সাইক উৎস-উপাদান সজ্ঞান মনঃশক্তির উদ্বোধন। আচরণে তার প্রক্ষেপ-প্রকাশ। শিল্পকর্মের বিস্তৃতির রূপটি এতে আর অপ্রকাশিত থাকে না। তবে এর ডিটেইলিংটি নেই, সে-অভ্যাসটি তখনো আমাদের উপন্যাসে প্রায় অনায়ত্ত। পেইন্টিং ও সাহিত্যের ‘ডিসটিংগুইস’ তো মেলে না। তবে প্রবাহটি নানাভাবে ধরা দিচ্ছে। অনেক রকমে কাছে আসছে, বুর্জোয়া পুঁজির প্রকোপে, শাকের তো সে-বর্ণনাও বয়ান করেছেন, মিনিংটি তখন উপন্যাসে ঢুকে পড়েছে, দ্রুততায় – সবকিছু ছাপিয়ে : ‘মুখ বদলাবার জন্য অনাস্বাদিত খাদ্যের মত, চোখ বদলাবার জন্য এমন আর একটি পাড়া গোটা কলকাতায় আর নেই। মনে হয় এক নতুন দুনিয়ায় চলে এসেছি।’ আর নায়িকা –  সে কেমন? ‘সেলিনার পরনে পাতলা ফিনফিনে শাড়ী। অবগুণ্ঠনের অছিলায় উন্মোচনের নতুন কৌশল সে জানে।… লজ্জায় সেলিনার চিবুক তার বুকের ওপর নেবে এল। পাশের  কেবিনে ছুরি কাঁটার শব্দ, মদের বোতল খুলবার শব্দ, আর অস্ফুট প্রেমালাপের শব্দ। সেলিনা নিজের সঙ্গে লড়াই করছিল। এক সময় সে মনস্থির করে মাথা উঁচু করে বসল। বেল টিপে ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার দিল : প্রথমে এক বোতল বিয়ার নিয়ে এস। তারপর ছাউ ছাউ নুডুলস সুইট এন্ড সাওয়ার পোর্ক আর সুইট এন্ড সাওয়ার প্রন?’ রশীদ করীমের এ মনস্কতাটুকু তার প্রতিপাদ্যকে অনেক দূর বাড়িয়ে দিয়েছে, বিবিধ মাত্রায়। এটি আমাদের সাহিত্যের জন্যও প্রেরণাময়, দুর্মূল্য। ভাষা বা তার ভেতরের চাহিদায় যে ‘নোশন’টুকু উপস্থাপিত হয়, তা বাস্তব ও বাস্তবানুগ। একেবারে পলে পলে, তন্ন তন্ন করে ব্যবচ্ছেদ, এ ব্যক্তি বিশ শতকের মধ্যপাদের উঠতি পুঁজির ভোগবাদী-অবক্ষয়ী-ক্ষিণ্ণ অসার ভুঁইফোড় প্রতিভূ। মুসলিম বাঙালির আর্থ-সমাজে এটি এক্কেবারে নতুন। রাজনৈতিক সংস্কৃতির নেতি-ইঙ্গিতে এর প্রসার। ক্ষমতা বা উচ্ছিষ্ট ক্ষমতালোভী দালাল, দাপুটে, সারসত্তাহীন-অসংস্কৃত বিজাতীয় মুনাফালোভী এ-ব্যক্তি উঠে আসে বিভাগোত্তর সময়খন্ডে। যার প্রকাশ স্বাধীনতার পূর্বেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রকোপে ঘনীভূত, উঠে আসছিল উপনিবেশ-উত্তর পুঁতিগন্ধময় সমাজ কাঠামোর ভেতর থেকেই। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘উত্তম পুরুষের দৃষ্টিকোণে সলিল। সেটি সক্রিয় সংলাপ আবহে প্রতীয়মান, কোনো সময় তা প্রতীকীরূপে প্রকাশমান। তবে সলিল নয়, নিঃস্ব শেখরদের পরিবারও এ বিশ্বযুদ্ধ-সমাজের ভেতরের বিনষ্টিকর এক দূরায়ত ধ্বনিতে উদ্ধৃত হওয়ার সুযোগ পায় :

আজও জ্যোৎস্নায় আলো আছে। আজও চারপাশ নিঝঝুম। আজও শোবার ঘরে হ্যারিকেন জ্বলছে। আজও দোরগোড়ায় পাম্প-সু  রাখা আছে। তবে পেটেন্ট লেদারের নয়। আধ ময়লা আধ ছেঁড়া মোটা চামড়ার পাম্প-সু।

এসব দৃশ্যপটে মনোরূপ বা মনোলোভা বর্ণনার অর্থটি কী? ইন্টেরিয়র মনোলগে লেখক এক ধরনের প্রতিবিম্ব রচনা করেন নির্ভার গদ্যকাঠামোর ভেতরে। সলিলের কালোবাজারি অর্থ শেখরের বৈপরীত্যময় জীবনকে শ্যেনদৃষ্টিতে ব্যঙ্গ করে, স্থূল ব্যক্তি-অহংকে ইন্ধন দেয়। সমাজ-সংকটের অপ্রতিরোধ্য এ-অসদাচরণে কোনো শুদ্ধব্যক্তি কার্যত তার অসহায়ত্বই প্রকাশ করে। উপন্যাসের এ জটিল প্রকরণটি তীক্ষ্ণধী, অপরূপ বিবরণধর্মে সেটির আরেকটি প্রকাশ শাকেরের চোখে নিহার ভাবি। উপন্যাসের একেবারে শেষপাতায়, এ-চরিত্রের ক্ষণিক অবভাসে এক বিপুল তরঙ্গে ধ্বনিত। মনোপ্রবাহে এ-রংটি এক আধুনিক অঙ্গীকারে প্রতিধ্বনিত। তবে পূর্ণায়ত নয়। অভিষেকটি সম্পন্ন, তার বিস্তার ব্যক্তি-শাকেরের আকরণে, ‘the representation of slices of real life could be seen as the true end of narrative literature’ – এটিই চারুময়তা। তবে যেমনটি বলেছি, সে-রূপটি বিস্তারিত নয়, পথটি অবমুক্ত মাত্র। রশীদ করীমের শিল্পে বিজ্ঞানভিত্তিক জীবনচিত্রটি প্রত্যক্ষণ, স্মৃতিশক্তি, অবহিতিবোধ, ভেতরের চাহিদা প্রভৃতি অন্তর্লীন উপাদানে নির্মিত। সেটি দুর্মররূপে প্রকাশিত আলোচ্য উপন্যাসে। শাকেরের মনোজগতে তার প্রতিফলন আছে। সেটি গৃহীতও হয় উপন্যাসের পরিকাঠামোয়। সে-রূপেই তার অন্তর্বয়ন। বা অন্যসকল চরিত্রের যাত্রারথ। স্বপ্নে বা কল্পনার ঈষৎ পরিসরের এ-ব্যক্তিটি গঠিত। খুব সংহতও সে। শেষাংশেও তা সংযত। ট্রানজিশনের শহরে কলকাতায় অতঃপর ঢাকায়। এটি একটি পূর্ণ মেসেজ। ফিরলেন শাকের ঢাকায়। কার্যত মুসলিম বাঙালি ফিরল তার নিজ দেশে। কীভাবে? বিবাদ-বিসংবাদ মিটিয়ে ফেলল সেলিনা। পূর্ণ ট্রেনে যাত্রা। সেটি সময়চিত্র, স্মৃতিচিত্র, জীবনচিত্রও। স্টেশন অতঃপর যাত্রার বিবরণটি পূর্ণায়ত। কলকাতা থেকে ঢাকা এবং তার পথরেখায় বিচিত্র বর্ণ-গন্ধে চিত্রময় তা উত্তমরূপে আমাদের নায়কমুখে (যে শ্রেণিটি বিভাগোত্তরকালে সমাজ-রাজনীতি ও সংস্কৃতির ধারক) বর্ণিত, সেই তো এ বাংলার-পূর্ব বাংলার তথা বাংলাদেশের ভাষ্যবিন্দু।

তিন

শাকের যে আর্থ-সমাজে কলকাতা থেকে ঢাকায়, তা গ্রন্থনে রসবোধ ও মুনশিয়ানার বিষয়টি লক্ষণীয়। একজন লেখক লেখেন কীভাবে? বা কেন লেখেন? রশীদ করীম উদ্যমী হন, শাকেরকে নিয়ে, নিজেকে নিয়ে, ‘অ্যাজ সাচ অ্যাজ’ বা ‘মাইমেটিক’ ধরনের কিছু বপনে, সেটি তাঁর ব্যক্তি-অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিচেতনাপ্রসূত। যে-রূপে সম্প্রদায়গত মনস্তত্ত্ব উঠে আসতে দেখা যায়, তা তাঁর মনের, বিপর্যস্ত চিত্তের। তাঁকে পীড়িত করে, লেখকের ভেতরে-বাইরে সে-প্রতিক্রিয়া নিহিত। চল্লিশের অন্য লেখকদেরও  এমনটি হয়েছে, ‘ভাগের দেশ’ কে মানতে পারে! কিছু স্পর্শকাতর বিষয় আছে শাকের সলিল, শেখরদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে অনিমা বা শেখরের বোন চন্দ্রার কাছে গেলে ‘জল খাওয়া’ নিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি, জলের বদলে অন্য কিছু খাওয়াতেই বেশি আগ্রহ করে তোলা ডি-কের সঙ্গে তর্কের পর ‘অনিমা ত্রস্ত হরিণীর মতো ভীতচকিত দৃষ্টিতে তৎক্ষণাৎ আমার [শাকের] দিকে তাকাল। আমিও একবার তার দিকে তাকালাম। একটুখানি হাসতেও ভুলে যাইনি। অনিমা তার মাতা আর দৃষ্টি দুই নত করে নিল।’ মুসলমান হিসেবে দ্বিতীয় শ্রেণি গণ্য হওয়া, ধর্মের চালে জীবনকে ছাঁচে ঢালা, মানুষকে গৌণ করে তুলে ধর্মকে বড় করে দেখা, প্রতিটি পদক্ষেপে ধর্মই যেন ‘জান’, ধর্মই তৈরি করছে মন-মগজ, পারস্পরিক ও চিরন্তন বন্ধনগুলো হয়ে যাচ্ছে শিথিল, এমনটা এই শাকের কীভাবে গ্রহণ করবে! সে হোঁচট খাচ্ছে বন্ধুমহলে, আটকে যাচ্ছে হৃদ্যমন্ডপে, উপায়হীন উপায় কীভাবে আর চলে, মুশতাক বা সেলিনাই শুধু নয়, কিংবা মুশতাক-সেলিনারও তো বন্ধু ওই সলিল-শেখর-অনিমা-সমীর সকলেই। তাতে কি সম্প্রদায় বাধা! সেটি কিসের তুল্যমূল্যে আটকান। এ-বিষয়ে লেখকের প্ররোচনা আর তার ভেতরের ক্ষয়বিনাশ ইঙ্গিতে জীবনের রূঢ়তার জয়-পরাজয়ের সম্ভাব্যতার আখ্যান, এ -উপন্যাস – উত্তম পুরুষ। রীতিটির কথা আগেই বলেছি, কখনো ফ্ল্যাশব্যাক, কখনো ফ্ল্যাশ ফরওয়ার্ড, ত্রিকালসঞ্চারী – তবে এতে আকর্ষণীয় সবকিছুর ভেতর দিয়ে শেষটায় – প্রত্যাবর্তন, যেন বাংলাদেশে। নায়ক পৌঁছাল, তপ্ত সে-নায়ক, বড় হয়েছে সে-অভিজ্ঞতায়, ব্যক্তিত্বে, অনেক পোড়া দাগ সেখানটায় – দাঙ্গার, বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার, দেশ ছেড়ে আসার, পরভূমে বাসের যন্ত্রণা, মাইনরিটি সাপ্রেশান, অভাব, যন্ত্রণা, অপচয়, দুর্ভিক্ষ, দাহ সব পেরিয়ে – এসেছি এ-ভুবনডাঙায়, এ-দেশে। সে পৌঁছার প্রবণতায় উত্তম পুরুষ-আলোকিত উদ্ধার। কীভাবে তা পৌঁছায়? শাকেরের ভেতর অনেক ভাংচুরের ভেতর দিয়ে, সে দেখেছে যুদ্ধের হনন, দেখেছে নির্মম সাম্প্রদায়িকতা, ব্যক্তির ভেতরের যুদ্ধ, বন্ধু হারানোর জ্বালা। এভাবে সোনার টুকরো, একফালি মজার আনন্দময় রোদ্দুর আসে এ-বাসে, ঢাকায় এসে দাঁড়ায় ব্যক্তি-শাকের, কিন্তু তাও তো স্বাভাবিক নয়, ট্রেনে কতো মানুষ, কী সে ব্যস্ততা, প্রাণ নিয়ে যাত্রা, আশ্রয়ের সন্ধানে যাত্রা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোনো ভেদ নেই – সবাই আস্তানা চায়, নির্ভার নিরাপত্তা চায়। সেখানে ধর্ম কোথায়! সেখানে সংস্কার-মূল্যবোধ কোন তারে বাঁধা? স্থির হয়ে নিরাপত্তায় নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করতে চায় সবাই। শুধু বিবরণ বলি কেন, জীবনের অনিবার্য স্বপ্নছায়াকল্পনার দূরাগত ধ্বনি কোন মানুষ খোঁজেনি, তার আখ্যায় বলি :

চোখের সামনেই দেখলাম দেয়ালের গায়ে বড় বড় হরফে লেখা : বাইশ জন বসিবেক। বসিবেক তো বুঝলাম, কিন্তু বাইশ জন কেন, অন্তত : দেড়শত যাত্রী বাইশ জনের জন্য বরাদ্দ স্থানে কোনমতে ঠাঁই করে নিয়েছে। নারীর পক্ষে স্পর্শ বাঁচাবার উপায় নেই আব্রু রক্ষার অতটা সুযোগ নেই। একজন জোয়ান মদ্দের ঠিক চোখের সামনেই শিশুকে স্তন দিতে হচ্ছে। সারা রাত্রির সফর। পার্শ্বের অনাত্মীয় অপরিচিত পুরুষের ঠিক বুকের উপর অনূঢ়া তরুণীর তন্দ্রা ভারাক্রান্ত মাথা বারবার নুয়ে পড়ছে; সামনে পুরুষটির কোলের পাশে তার পা জোড়া কোন মতে একটুখানি জায়গা করে নিয়েছে। দুটি বেঞ্চির মাঝখানকার যে স্থানটুকু ট্রেন কর্তৃপক্ষ চলাফেরার জন্য খালি রেখেছেন, সেই জায়গাটুকু বাক্স প্যাটরা পুটলী বিছানা প্রভৃতি রাজ্যের জিনিসপত্র দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে –  যাত্রীদের আসনের ব্যবস্থা করবার জন্য।

এই তো লেখকের দৃষ্টিকোণ। সে দেখেছে পৃথিবীর রূপ। ফিরেছে তার সুখ-সমুদ্দুরে। ট্রেন, যোগাযোগ আর সম্পর্ক সে তো বুর্জোয়া পুঁজি আর ব্যক্তিমানুষের বিকাশমান জীবনের ভাংচুরের অন্তর্বয়ন। ভেঙেছে সংস্কার, বাতিল হয়েছে নিয়মের বেড়াজাল, ধর্মবুদ্ধি পেরিয়ে গেছে তার সময়, বিবর্ধিত এ-ব্যক্তি এখন অস্থির অবাধ পুঁজির সংস্করণে আটকান। বিশ শতকের সমাজ রাষ্ট্র তো তারই পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্বেল। ঘরে-বাইরে সেই ভাংচুরই দেখছে ব্যক্তি শাকের। আধুনিক ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়াতেও তা ইন্ধনময়। আমাদের উপন্যাসগদ্যে সেটি দাঁড়াল উপর্যুক্তরূপে, আটপৌরে-দ্বিধাহীন হয়ে। এটি বাঙালি মুসলমানের হাতে অভিনয়, দুর্দান্ত। কোন পথে তা অর্জিত? বিশ শতকের বিশ্বযুদ্ধ-অভিজ্ঞতা, দাঙ্গা-দাপট ব্যক্তিকে ক্ষয়িষ্ণু করে তুললে সচেতন শিল্পমেধা কী করতে পারে! কোন পথে সে তা শৈলীকে পরিচালিত করবে? রশীদ করীম অগ্রবর্তীরূপে আগুয়ান, জয়ধ্বজায় আছে তার ভেতরে দাহন, পটচিত্রে বিদ্যমান সত্যময় শিল্পীর দায়, নির্মাণ-সমর্থতায় বিধৃত যে-প্রবণতা তা কর্কশ-জঙ্গমী বিশ্বাস। সেসবে একক ব্যক্তি কারুময় হয়ে ওঠে ভঙ্গুর সামন্ত-সমাজপিঠে। ৩৩ নং কোমেদান বাগান লেন তো শুধু একটি বাড়ি নয়, হাবিব খান বাহাদুর সানী বা খাদিজা শুধু চলমান জীবমাত্র নয় – একটি কালখন্ড, যেখানে তপ্তময় ‘তখন অন্ধকার ঘর ভরে গেছে’। কেন? তার উত্তরও ওই প্রতিবেশে। এটি একটি অংশ, যা শাকেরের বাইরের অভিজ্ঞতার, আলোড়নের, আর ঠিক বিপরীতে শাকেরের ভেতরের অংশটি কী, যা আগেই উক্ত হয়েছে – প্রণয়, দাঙ্গার ক্ষেদ, বন্ধুময়তার আহাজারি, নতুন জায়গায় পৌঁছান। সে বিবরণে শিল্পময় মনোগাহন। নি–দ্রময়, নির্বিকল্প প্রণয়, নারীর ইঙ্গিত, বিপুল রমণীময়, সেলিনা বা নিহার ভাবি। এটি প্রতীকে যেমন, আলোড়নে আরো বেশি উদ্দীপনাময়। শুদ্ধ-পরিশীলিত বয়ানে। পূর্ণ আস্থায়। বিকশিত প্রবণতায়। উত্তম পুরুষ তারই সাক্ষ্য দেয়।

চার

রশীদ করীম আমাদের উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ সজ্জন। উত্তম পুরুষ তাঁর একটি রচনা, অন্য রচনায় তাঁর ব্যাপ্তি আরো নানাকৌণিক। শুধু বিভাগোত্তর উপন্যাসের পথরচনার জন্য নন, তিনি বাঙালি মুসলমানের মধ্যবিত্ত মনন, তার ভেতর-কাঠামো বয়ন কিংবা আধুনিক উপচারে দূরায়ত প্রতিশ্র“ত শৈলী নির্ণয়ে স্বতন্ত্র হয়ে বিশেষ ঔজ্জ্বল্যে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্যান্য উপন্যাস-রচয়িতাদের সঙ্গে তুলনীয় করে তুললেও তাঁর রচনার অবস্থান ও অভিনবত্বটি আরো স্পষ্ট হয়। এখানে উত্তম পুরুষের  সরল পাঠটি আছে, তাতে বিবৃত বিষয়ের দুর্বলতা বা তুচ্ছতা ধরা পড়েছে; কিন্তু ইঙ্গিতে – বিশেষত গদ্যশৈলীতে তা অপরূপতা পেয়েছে, অসাধারণ হয়ে উঠেছে। এটিকে শুধু আমাদের উপন্যাসের পথ পেরুনো বললে হবে না, স্বীয় ভিত্তিটি কায়েমের দৃষ্টান্তও বলতে হবে। আর তা তাঁর অন্য রচনায় বা সমসাময়িক অন্য উপন্যাসকারগণের তুলনীয় করে তুললে আরো বেশি উপলদ্ধি করা যাবে বারান্তরে, সে-অপেক্ষায় আছি।